কৃত্তিবাস ওঝার কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
গৌড়েশ্বরের সভায় কৃত্তিবাস

রাজপণ্ডিত হব মনে আশা করে |
সপ্তশ্লোক ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে ||
দ্বারিহস্তে শ্লোক দিয়া রাজাকে জানালাম |
রাজাজ্ঞা অপেক্ষা করি দ্বারেতে রহিলাম ||
সপ্তঘটি বেলা যখন দগড়ে পড়ে কাঠি |
শীঘ্র ধাই আইল দূত হাতে সুবর্ণ লাঠি ||
কার নাম ফুলিয়ার পণ্ডিত কৃত্তিবাস |
রাজার আদেশ হৈল করহ সম্ভাষ ||
*        *        *
পাত্রেতে বেষ্টিত রাজা আছে বড় সুখে |
অনেক লোক দাণ্ডাইয়া রাজার সম্মুখে ||
রাজার ঠাঞি দাণ্ডাইলাম চারি হাত আন্তর |
সাত শ্লোক পড়িলাম শুনে গৌড়েশ্বর ||
পঞ্চদেব অধিষ্ঠান আমার শরীরে |
সরস্বতীপ্রসাদে শ্লোক মুখ হৈতে স্ফুরে ||
নানা ছন্দে শ্লোক আমি পড়িনু সভায় |
শ্লোক শুনি গৌড়েশ্বর আমা পানে চায় ||
নানামতে নানা শ্লোক পড়িলাম রসাল |
খুসি হৈয়া মহারাজ দিল পুষ্পমাল ||
কেদার খাঁ শিরে ঢালে চন্দনের ছড়া |
রাজা গৌড়েশ্বর দিল পাটের পাছড়া ||
রাজা গৌড়েশ্বর বলে কিবা দিব দান |
পাত্রমিত্র বলে রাজা যা হয় বিধান ||
পঞ্চ গৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা |
গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা ||
পাত্রমিত্র সবে বলে শুন দ্বিজরাজে |
যাহা ইচ্ছা হয় তাহ চাহ মহারাজে ||
কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার |
যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার  ||
যত যত মহা পণ্ডিত আছ এ সংসারে |
আমার কবিতা কেহ নিন্দিতে না পারে ||
সন্তুষ্ট হইয়া রাজা দিলেন সন্তোক |
রামায়ণ রচিতে করিলা অনুরোধ ||
প্রসাদ পাইয়া বাহির হইলাম সত্বরে |
অপূর্ব জ্ঞানে লোকে ধায় আমা দেখিবারে ||
চন্দনে ভূষিত আমি লোক আনন্দিত |
সবে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পণ্ডিত ||
মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি |
পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী ||
বাপ মায়ের আশির্বাদ গুরুর কল্যাণ |
রাজাজ্ঞায় রচে গীত সপ্তকাণ্ড গান ||
সাতকাণ্ড কথা হয় দেবের সৃজিত |
লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পণ্ডিত ||

********
*
অত্রিমুনির আশ্রমে রাম, লক্ষণ ও সীতা

কতদূর যান তাঁরা করি পরিশ্রম |
সম্মুখে দেখেন অত্রি মুনির আশ্রম ||
প্রবেশিয়া তিন জন পুণ্য তপোবন |
বন্দনা করেন অত্রি মুনির চরণ ||
রামে দেখি মুনিবর উঠিয়া যতনে |
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া বসাইলেন আসনে ||
আপনার পত্নি ঠাঁই সমর্পিলা সীতা |
পালন করহ যেন আপন দুহিতা ||
দেখি মুনিপত্নিকে ভাবেন মনে সীতা |
মূর্ত্তিমতি করুণা কি শ্রদ্ধা উপস্থিতা ||
শুক্লবস্ত্র পরিধানা শুক্ল সর্ব্ববেশ |
করিতে করিতে তপ পাকিয়াছে কেশ ||
তপস্যা করিয়া মূর্ত্তি ধরেন তপস্যা |
জ্ঞান হয় গায়ত্রী কি সবার নমস্যা ||
কৃতাঞ্জলি নমস্কার করিলেন সীতা |
আশীর্ব্বাদ করিলেন অত্রির বনিতা ||
মুনিপত্নী বসাইয়া সম্মুখে সীতারে |
কহেন মধুর বাক্য প্রফুল্ল অন্তরে ||
রাজকুলে জন্মিয়া পড়িলা রাজকুলে |
দুই কুলে উজ্জ্বল করিলা গুণে শীলে ||
এসব সম্পদ ছাড়ি পতিসঙ্গে যায় |
হেন স্ত্রী পাইলা রাম বহু তপস্যায় ||
জানকী বলেন দেবী কর অবধান |
আমার জন্মের কথা অপূর্ব্ব আখ্যান ||
একদিন রাজর্ষি জনক যবে ক্ষেতে |
উঠিল আমার তনু লাঙ্গল চষিতে ||
এই ভাবে হয় মম জন্ম মহীতলে |
লাঙ্গল ছাড়িয়া রাজা মোরে নিল কোলে ||
নিজ কন্যা বলি রাজা মনে অনুমানি |
হেনকালে আকাশে হইল দৈববাণী ||
দেবগণে ডাকি বলে জনক ভূপতি |
গ্রহণ করহ এই কন্যা রূপবতী ||
পাইয়াছ তুমি এই তোমার দুহিতা |
লাঙ্গলের মুখে জন্ম নাম রাখ সীতা ||

********
*
মৃত্যুশয্যায় রাবণ

প্রাচীন ভূপতি তুমি অতি বিচক্ষণ |
বাহবলে জিনেছ সকল ত্রিভূবন ||
ধর্মাধর্ম রাজধর্ম তোমাতে বিদিত |
তব মুখে শুনিব কিঞ্চিত্ রাজনিত ||
দশানন বলে রাম সংশয় জীবন |
কহিতে বদনে নাহি নিঃসরে বচন ||
যতক্ষণ বাঁচি প্রাণে আছি সচেতন |
কহিব কিঞ্চিত নীত করহ শ্রবণ ||

করিতে উত্তম কর্ম বাঞ্ছা যদি হবে |
আলস্য ত্যজিয়া তাহা তখনি করিবে ||
ফেলিয়া রাখিবে যদি হয় মন্দ কাজ |
প্রমাণ তাহার কহি শুন রঘুরাজ ||
একদিন আসি আমি স্বর্গপুর হৈতে |
যমপুরী দৃষ্ট হৈল থাকি নিজ রথে ||
শূণ্য হৈতে দেখিলাম যমের ভূবন |
তিন দ্বারে নানা স্থানে আছে সাধুগণ ||
দেখিলাম দক্ষিণেতে পাতকীর থানা |
দিবা কিবা রাত্রি কিছু নাহি যায় জানা ||
অন্ধকার চৌরাশীটা নরকের কুণ্ড |
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড ||
পরিত্রাহি ডাকে পাপী বিষম প্রহারে |
না দেয় তুলিতে মাথা যমদূতে মারে ||
তাহা দেখি বড় দয়া হইল মনেতে ||
ঘুচাব পাপীর দুঃখ শমনের হাতে ||
পাপীর দুর্গতি আর দেখা নাহি যায় |
এত ভাবি সেই দিন এলেম লঙ্কায় ||
পুরাব নরককুণ্ড নিত্য করি মনে |
আজি কালি করিয়া রহিল বহুদিনে ||
হেলায় রহিল পড়ে না হৈল পূরণ |
তারপর তব সঙ্গে বাধিল এ রণ ||

আর এক কথা কহি দেখ বিদ্যমান |
সূর্পনখার লক্ষণ কাটিল নাক কাণ ||
সেই আসি উপদেশ কহিল আমারে |
তাহার বুদ্ধিতে আমি সীতা আনি হরে ||
একবার ভাবিলাম আপন মনেতে |
আজি কালি নহে সীতা আনিব পশ্চাতে ||
আবার বিচার করি দেখিলাম ভেবে |
হেলায় রাখিব পাছে আনা নাহি হবে ||
অতএব শীঘ্রগতি হরে আনি সীতে |
সর্বনাশ হৈল মম সীতার জন্যেতে ||
এক লক্ষ পুত্র মরে সোওয়া লক্ষ নাতি |
আপনি মরিনু শেষে লঙ্কা অধিপতি ||
যদি সীতা না আনিতাম ভেবে চিন্তে মনে |
তবে কেন সবংশে মরিব তব বাণে ||
এইমত রাবণ কহিল নীতি কথা |
কহিতে কহিতে হৈল জিহ্বার জড়তা ||
শ্রীচরণে দৃষ্টি করি প্রাণত্যাগ কৈল |
রাবণের মৃত্যু কৃত্তিবাস বিরচিল ||

********
*
শ্রীরামের কৈকেয়ী সম্বোধন

আইল দেশেতে রাম আনন্দ সবার |
শুনিলা কৈকেয়ী রাণী শুভ সমাচার ||
অভিমানে কৈকেয়ীর পরিপূর্ণ আঁখি |
কথা কি কবেন রাম মা বলিয়া ডাকি ||
যদি রাম পূর্বমত করে সম্ভাষণ |
রাখিব এ দেহ নহে ত্যজিব জীবন ||
এতেক ভাবিয়া রাণী হৈল অধোমুখ |
করেতে রাখিল এক বিষের লড্ডুক ||
যদি রাম মা বলিয়া না ডাকে আমারে |
ত্যজিব এ পাপপ্রাণ বিষপান করে ||
এত বলি অভিমানে রহিলেন রাণী |
অন্তরে জানিল তাহা রাম রঘুমণি ||
হইল ব্যথিত প্রাণ বিমাতার তরে |
আগেতে চলিলা রাম কৈকেয়ীর পুরে ||
ধুলায় বসিয়া রাণী বিরস বদন |
হেনকালে রাম গিয়া বন্দিল চরণ ||
কৈকেয়ীরে শ্রীরাম কহেন জোড় করে |
দেখিতে আইনু মাতা চৌদ্দ বর্ষ পরে ||
অরণ্যেতে পড়েছিনু অনেক প্রমাদে |
উদ্ধার হয়েছি সবে তব আশির্ব্বাদে ||
লজ্জা পাইয়া কৈকেয়ী কহে রঘুনাথে |
কোন্ দোষে দোষী আমি তোমার অগ্রেতে ||
বনে গেলে দেবতার কার্যসিদ্ধি লাগি |
আমারে করিলে কেন নিমিত্তের ভাগী ||
তুমি গোলোকের পতি জানে এ সংসার |
অবতার হয়েছ হরিতে ক্ষিতিভার ||
সংসারের সার তুমি কে চিনিতে পারে |
সূর্যবংশ পবিত্র তোমার অবতারে ||
অরি মারি দেবতার বাঞ্ছা পুরাইলি |
আমার মাথায় দিয়া কলঙ্কের ডালি ||
বাছা রাম বলি তোরে আর এক কথা |
এত যে দিতেছ দুঃখ জানিয়া বিমাতা ||
চিরকাল ভরতের বাড়া স্নেহ করি |
কুবোল বলিনু মুখে তোমার চাতুরী ||
সর্বঘটে স্থায়ী তুমি সুখদুঃখ দাতা |
এতেক দুর্গতি কৈলে জানিয়া বিমাতা ||
লজ্জিত হইয়া রাম হেঁট কৈল মাথা |
জোড়হাত করে রাম কহিছেন কথা ||
কৈকেয়ীরে তোষে বলি বিনয় বচন |
তব দোষ নাহি মাতা দৈব নির্বন্ধন ||
কালেতে সকলি হয় বিধির নির্বন্ধ |
তোমার প্রসাদে আমি বধি দশস্কন্ধ ||
তোমা হৈতে পাইলাম সুগ্রীব সুমিত |
সংকটেতে করিল সুগ্রীব বড় হিত ||
তোমার প্রসাদে করি সাগর বন্ধন |
রাবণে মারিয়া আমি তুষি দেবগণ ||
জানিলাম লক্ষণের যতেক ভকতি |
জানিলাম সীতী দেবী পতিব্রতা সতী ||
তোমা হইতে ধর্মাধর্ম জানিলাম মাতা |
ছল বাক্যে কৈকেয়ী দ্বিগুণ পাইল ব্যথা ||
সবার আনন্দ হৈল রাম দরশনে |
আনন্দে রহিল রাম মাতার ভবনে ||
কেহ নাচে কেহ গায় মনের হরিষে |
লঙ্কাকাণ্ড গাইল পণ্ডিত কৃত্তিবাসে ||

********