*
ভিটে মাটি
তপন ব্রহ্ম

জমি বাঁচাও আন্দোলনে
হাজার লোকের ভিড়ে---
কবিগুরুর উপেন দেখি
এলো আবার ফিরে!
জমিদার তার ভিটেমাটি
নিয়েছিলেন কেড়ে |
উপেন এবার নড়বে না আর
জমি-জিরেত ছেড়ে |
বললো উপেন---'হাজার মানুষ সঙ্গে আছে
কীসের আমার ভয়?
চাষের জমির মালিক,
সালিম, টাটা নয়!
যতই বুকে বিঁধুক গুলি,
মাথায় পড়ুক লাঠি--
উপেনরা কেউ এক ইঞ্চি
ছাড়বে না তো মাটি!'
********************
এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' এর
১৯শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ প্রকাশিত
হয়েছিল
*
আমরা সবাই বহিরাগত?
মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়

নিজ ভূমি, পরভূমি
অনাবীসী, অভিবাসী, প্রবাসী
কে বহিরাগত কে নয়?
এই প্রশ্নের সাহিত্যিক কি কোন জবাব আছে?
মানুষ যেখানেই পায় ভীতি ও ভালবাসা
সেই হয়ে ওঠে নিজভূমি |
খিদের জ্বালায় মানুষ বারে বারে
ও-পাড়ায় তার শেকড়, আবার বারে বারে গড়ে |
যখন রুজিতে পড়ে টান
দেয়ালে ঠেকে যায় পিঠ
ভবিষ্যত হয়ে ওঠে অন্ধকার অনিশ্চিত
মানুষ তখনই লড়ায়ে নামে
যারা পাশে এসে দাঁড়ায় সেই লড়ায়ে---
সব দূরত্ব মুছে যায় |
তারাও নুয়ে যায় ভূমি-কন্যা ভূমি-পুত্র
তা সে রাষ্ট্র যতই বহিরাগত বলে হুংকার ছাড়ুক |
সিঙ্গুর হয়ে উঠে আমাদের সবায়ের
আর আমরা তখন বিশ্বাস করি
আজ রাস্তাই দেখাবে রাস্তা |
সরকারের বহিরাগত তকমা ও রাস্তাই
দেখাবে রাস্তা নিয়ে ব্যঙ্গের প্রতিবাদে |

********************

এই কবিতাটি 'ইম্যানসিপেশন পাবলিকেশন' এর কলকাতা বইমেলা
২০০৭ এ প্রকাশিত 'সিঙ্গুর আন্দোলন: আমাদের ভাবনা আমাদের
প্রতিবাদ' পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
সামান্য ক্ষতি?
স্বপ্না- সমাজকর্মী, কবি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের সদস্যা

মরেছে তো ভারি ক্ষেতমজুরের মেয়ে,
বুদ্ধবাবু বেজায় ব্যস্ত শপিং মলের ভিড়ে |
এমনই তো রোজ মরছে কত মেয়ে
ভাবলে চলে? উন্নয়নের রথ থমকে গেলে হবে?
শরীরটাকে জ্বালিয়ে দিল শেষে
ধর্ষণের সব চিহ্ন লোপাট হবে!
তাপসী তো লাশ হয়েছে কবে,
তবু সে লাশ তাড়া করে ফেরে |
তাপসী যে মননের এক নাম---
মনন পোড়ায় এমন আগুন আছে |

********************

এই কবিতাটি 'ইম্যানসিপেশন পাবলিকেশন' এর কলকাতা বইমেলা
২০০৭ এ প্রকাশিত 'সিঙ্গুর আন্দোলন: আমাদের ভাবনা আমাদের
প্রতিবাদ' পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
তাপসী মালিক
স্বপ্না ঘোষ

চমকে উঠেছিলে?
ভাবোনি এভাবে কখনও চাঁদের ছায়া ধরে শ্বাপদেরা
ধানখেতে মৃত্যু হয়ে আপন মহিমায় থিতু হয়ে আছে |
পাশে বহমান নদীতীর জানে,
তোমার চিত্কার, প্রতিরোধ ডানা মেলে
অবশেষে মাটি জুড়ে আঁচড় কাটে
আগামী দিনের জ্যান্ত খবর আমরা চায়ের সঙ্গে পান করি |
কতজন ছিল তোমাকে ঘিরে অন্ধকার গায়ে মেখে?
এ তীক্ষ্ণ নির্মমতা মানুষই পারে |
আর ফিরবে না
মৃত্যু নিয়ে তদন্ত হবে
আর ফিরবে না
মিথ্যে দিয়ে গড়া কিছু বেলপাতা গঙ্গাজলে ভিজে
ছুটে যাবে দুপয়সার কেনা মিডিয়ার কাছে |
কারও কোনো দোষ নেই
তোমার মৃত্যুর জন্য তাপসী তুমিই দায়ী
চমকে উঠলে |
এ কীটের রাজ্যের মৃত তোমার মৃত্যু আবারও হবে,
কেন হবে?
সিঙ্গুরের মাটি ধান মানুষেরা শ্বাপদের থাবা গিলে
শুভ্র প্রহরে ছড়াবে ধানের বীজ
ও পাখি, তীব্র হোক তোর সুরধ্বনি শিস্ |

********************

এই কবিতাটি 'ইম্যানসিপেশন পাবলিকেশন' এর কলকাতা বইমেলা
২০০৭ এ প্রকাশিত 'সিঙ্গুর আন্দোলন: আমাদের ভাবনা আমাদের
প্রতিবাদ' পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
আজকের দুইবিঘা জমি
সুস্মিতা ভট্টাচার্য- নারী আন্দোলনের কর্মি
(উদার মানবতা দরদী রবীন্দ্রনাথ কি জানতে পারছেন, এই একবিংশ শতকেও
উপেনদের কি হচ্ছে? যদি জেনে থাকেন, তবে তিনি কি ভাবছেন? আমি
আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, তাঁর দুইবিঘা জমির প্রথম অংশটি এইভাবে লেখার
প্রেরণা তাঁর কাছ থেকেই এসেছে |)


সুজলা সুফলা ছিল মোর জমি---
কখনো পড়িনি ঋণে,
রাজা বলিলেন--- 'বুঝেছ উপেন,
ও জমি লইবো কিনে |'
আমি বলিলাম--- 'বন্ধ্যা অফলা
জমির অন্ত নাই,
চেয়ে দেখ এ যে ছ-সাত ফসলা
হীরক-ঝরানো ঠাঁই!'
শুনে রাজা কহে--- 'বাপু জানো তো হে,
টাটা দেবে কারখানা,
পেলে সিঙ্গুর পুঁজি, কাটমানি
সবকিছু যাবে টানা!
ওটা দিতে হবে!' বলিলাম তবে
বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে--- 'করুন রক্ষে
সোনা-ফলা জমিখানি!
সারা পরিবার আছে দুধে ভাতে,
এ মাটি সোনার বাড়া,
টাটারে তুষিতে বেচিব এ মায়ে
এমনই লক্ষ্মীছাড়া?'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল
রহিল মৌনভাবে,
বলিলেন শেষে কুরুর হাসি হেসে---
'আচ্ছা সে দেখা যাবে!'
পরে মাস দেড়ে জমি-জমা ছেড়ে
বাহির হইনু পথে,
ঘরে মেয়ে খুন জমিও বিক্রি
মিছে সম্মতি-খতে |
এ জগতে হায় সেই বেশী চায়
আছে য়ার ভূরি ভূরি,
টাটার হস্ত করে কৃষকের
উর্বরা জমি চুরি |
তবুও পরিনি সন্ন্যাসী-বেশ---
প্রতিবাদ চলে আজও,
দেব না এ জমি, কে আছো মানুষ,
প্রতিবাদী সাজে সাজো!

********************

এই কবিতাটি 'ইম্যানসিপেশন পাবলিকেশন' এর কলকাতা বইমেলা
২০০৭ এ প্রকাশিত 'সিঙ্গুর আন্দোলন: আমাদের ভাবনা আমাদের
প্রতিবাদ' পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
ক্রমেই হচ্ছে একা
ভক্তিপ্রসাদ মাকড়, চৈতন্যপুর, পূর্ব মেদিনীপুর

কংগ্রেস দল এখন বারুদ--
বিহীন আতশবাজি
নামের জোরেই চায় খাটাতে
ক্যারিশ্মা-কারসাজি ||

ওল্ড মডেলের দুলকি চালে
চালিয়ে আপনাকে
বর্ষাবিহীন মেঘে ভুলায়
ব্যাঙ ছাড়া আর কাকে ||

ঘায় চুঁয়ে যায় প্রবল খরায়
চৌচির মাঠ ফেটে
চায় সে তখন মরুভূমির
ওপর দিয়ে যেতে ||

সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম
চলছে ফাটাফাটি
প্রাতর্ভ্রমণ সারছে তখন
দূরে সে এলাকাটি ||

করার আছে অনেক কিছুই
লাগাচ্ছে না হাত
গণ্ডি টেনে তার মধ্যেই
কাটাচ্ছে দিন রাত ||

বুঝছে না সে এমনি এমনি
যায় না কভু টেকা
গুটিয়ে থেকে যাচ্ছে হয়ে
ক্রমে ক্রমে একা ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
রূপক কংগ্রেস
পুলক অধিকারী, টালিগঞ্জ, কলকাতা

আমরা হলাম রূপক কংগ্রেস
রূপ আমাদের অনেক
ঘোলা জলে ধরি মাছ
কখনও ধরি ভেক ||

এবার মোরা ভাসাব
আন্দোলনের তরী
'মাল' কামাতে কিন্তু ভাই
বুদ্ধের চরণ ধরি ||

'যুবক তুমি এগিয়ে চল
আমরা তোমার পিছনে'
বিপদ দেখলে কেটে পড়ি
দাঁড়াই নাকো সামনে ||

আরও আছে অনেক কিছু
বলব এবার ভাই
সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামে
আমরা আছি আবার নাই ||

কে বলল একা আছি
একা মোরা নই
সি পি এম পাশে আছে
আমাদের সত্ ভাই ||

কৃষিজমি মাতৃভূমি
চুলোয় যায় যাক
আমাদের সাইনবোর্ড
আমাদেরই থাক ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
শাসক দলের বি টিম
শুভ্র ড্যানিয়েল, কলকাতা

কংগ্রেস ছিল বড় দল এক
প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে
দেশপ্রেমই ছিল তার সম্বল
বুক ভরে যেত গর্বে ||
স্বাধীনোত্তর কালে এ দলের
বাংলা সংস্করণ
নীতিহীনতার দিশাহীনতার
প্রকৃত নিদর্শন ||
কেন্দ্রে গণেশ উল্টিয়ে দেবে
এই আশঙ্কায়
রাজ্যে বামের সব অনাচার
কংগ্রেস সয়ে যায় ||
লক্ষ মানুষ যখন সামিল
কৃষিজমি সংগ্রামে
ক্যাডার-পুলিশ তাণ্ডব নাচে
সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে ||
বিবৃতি দিয়ে সারে দায়িত্ব
রাজ্যের কংগ্রেস
শাসকদলের 'বি টিম' এরা
বাংলার ডিসগ্রেস ||
ঘোলাজলে মাছ ধরতে এবার
পেতে মুসলিম ভোট
আগ্রহী এরা 'জমিয়তে' সাথে
করতে একটা জোট ||
ধন্য তোমরা মানস ভুঁইয়া
প্রণব, প্রদীপ, প্রিয়
টিভি চ্যানেলে শ্রীমুখ দেখিয়ে
যুগ যুগ যুগ জিও ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
লড়াইয়ের তরজা
চন্দন সামন্ত, পূর্ব মেদিনীপুর

আমি কিন্তু জমি ছাড়ার
পক্ষপাত-ই নই
সিঙ্গুর কিংবা নন্দীগ্রামে
করতাম হৈ চৈ ||
কিন্তু আমার পায়ে বাঁধা
বাম পায়েরও কাছে
ছুটে গেলেই দেবে টান
পড়ব নাকি পাছে?
তাই তো এখন সবুর করি
একটা রফা হবেই
তরজা লড়াই জমিয়ে দেব
দেখবে তখন সবেই ||
বেশ তো আমরা ভালই ছিলাম
'মধুভাণ্ড' লয়ে
ডানে বামের গাটছড়াটা
যাচ্ছিল বেশ সয়ে ||
কিন্তু কিসে কি যে হল
এস-ই-জেডের লাগাম
টান লাগাতেই বিগড়ে গেল
চাষা-বাম-অবাম ||
এখন তবে সামলে সুমলে
ফাটল দাগা চাই
গরিব গুর্বো জোট বাঁধলে
রক্ষা কারও নাই ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' এর ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
জনতার জয়
শুভ্র ড্যানিয়েল, কলকাতা

নন্দীগ্রামের চারিদিক ঘিরে
লাইফ করে দিতে হেল
সমবেত হল ক্যাডার-পুলিশ
হাতে বোমা রাইফেল ||

গ্রামের মানুষ শুনছে তখন
মাটি-মায়ের কান্না
ক্রোধে তারা উঠল গর্জে
'অনেক হয়েছে, আর না' ||

ঘরে ঘরে যত মহিম, রহিম
আমিনা, অসিমা ছিল
গ্রাম বাঁচাবার অগ্নিল পথ
সবাই তখন নিল ||

শাঁখ-আজানের মিলে যাওয়া সুরে
হিন্দু মুসলমান
গাইল প্রাণের একতারাতে
মাটি-মায়ের গান ||

কেউ হাতে নিল শাবল-কুড়াল
লাঠি নিল কেউ হাতে
নন্দীগ্রামের সকল মানুষ
প্রহরায় দিনে রাতে ||

অনেক রক্ত ঝরল মাটিতে
সিক্ত নন্দীগ্রাম
ইতিহাসে পেল নতুন মাত্রা
কৃষিজমি সংগ্রাম ||

জন্তা চাপে পিছু হটে গেল
রাজ্যের সরকার
সরকার নয়, স্বীকৃতি পেল
জনতার দরবার ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২রা মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
মেকি মার্ক্সবাদীদের দর্পচূর্ণ  
প্রশান্ত বেরা, কেশপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

বুদ্ধবাবুকে জব্ দ করেছে
নন্দীগ্রামের মানুষ
দেখে শুনে বিনয়, বিমান
হারিয়েছে তাঁদের হুঁশ ||

মানুষমাংসে গন্ধ করেছে
বুদ্ধদেবের ভুল
সাধু হয়ে দিদিকে পাঠান
তোড়া তোড়া ফুল ||

বিনয় বলে দেখাচ্ছি এবার
লাইফ করব হেল
নন্দীগ্রাম বলে এসো একবার
দেখবে কেমন খেল ||

সালিমের কাছে বুদ্ধ গেছেন
নিতে শুধু তালিম
পার্টিকর্মীদের বেতন দিতে
খাচ্ছেন হিমশিম ||

আদর্শ কমিউনিস্টদের হাতে
ভেঙেছে হিটলারের বড়াই
নন্দীগ্রামের মানুষের চাপে
বুদ্ধ বলেন পালাই পালাই ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২রা মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
কালের চাকা ঘুরছে আবার  
অগ্নিমুখ বিশ্বাস, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

ধীরে ধীরে নেমে এসো
অনেক ঘুরেছ আকাশ জুড়ে
এবার জনতার মাটিতে পা ফেলে দেখো
শীচরণ কতখানি পুড়ে ||

জনতা যখন ঘুমিয়ে থাকে
ঘুরিয়েছ যাবতীয় লাঠি
জনতা জেগেছে সিঙ্গুরে-নন্দীগ্রামে
এবার বাঁচাও শ্রীচরণ দুটি!

শ্রীচরণে ধরলে আগুন
জ্বলতে জ্রলতে পোড়াবে গদি
তাই মিউ স্বরে পিছু হটেছ দূরে
যদি বাঁচো শেষ অবধি!

জনতাই যখনই জেগেছে প্রাণের টানে
বীরবিক্রম ইংরেজও চলে গেছে দেশ ছেড়ে
যাদের জমি কেড়ে নিতে এসেছ, এবার
তারাই তোমার জমি নেবে কেড়ে ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২রা মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
জেগে আছে মুখ  
অরবিন্দ সিংহ, এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর

মেদিনীপুরের মাঠে মাঠে দেখে যা
মাতঙ্গিনীর সেই গুলিবিদ্ধ বুক
ক্ষুদিরামের সেই লক্ষ লক্ষ পিস্তল
দেশপ্রাণের সেই কোটি কোটি মুখ ||

এ মাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মোদের
পিতৃপুরুষদের উদ্ধত বুক
এখানে তাই ধানের শীর্ষে বিপ্লব ফলে
ঘরে ঘরে তাই বিপ্লবী মুখ ||

এখানে পুরিমাধব, ভরতচন্দ্র
গৌরহরি, জেগে আছে বিহারীলাল
প্রদ্যোত্, মৃগেন, অনাথ, বিভূতি, আব্দুল
আজিজ, শম্ভুনাথ সাঁওতাল ||

এখানে তাই চোখ রাঙাতে আসিস না
আসিসনা এ মাটির দখল নিতে
এ মাটির ঘরে ঘরে বিদ্যাসাগরের কলম,
খোঁচা তুই খাবিই খাবি ||

তাই চেয়ে দেখ ওই আসছে ধেয়ে
আঁশবটি আর কাস্তে শাবল নিয়ে
মারের বদলে মার খাবিই খাবি
খুন করলে খুন হবিই হবি ||

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২রা মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
রক্ত শপথ  
চন্দ্রশেখর রায়

শোকাতুরা মা'র দু' চোখে অশ্রুধারা
বুকে জ্বলে প্রতিহিংসার দাবানল
ছাই হয়ে যাবে বুক ভেঙে দিল যারা
মিথ্যা হয় না মায়ের চোখের জল
মহাশপথের পোস্টার সেঁটে বুকে
হাতিয়ার তুলে নীরবে দিচ্ছে ডাক :
'ঘেন্নার থুতু ছুঁড়ে দাও ওই মুখে
রক্তপিপাসু নেতাদের চিনে রাখ'
বিশু-সেলিমের ছিল কোন অপরাধ?
অমল রক্তে কাদা হয়ে গেল মাটি
এগারোটি প্রাণ নিমেষেই বরবাদ
পাটি গণিতের অঙ্কটা পরিপাটি
সেলিম-বিশ্বজিতের রক্ত থেকে
হাজার হাজার শপথ উঠছে জেগে
এই রোষানল রাখবে কে আর ঢেকে
প্রলয়ের ঝড় ওই আসে ধেয়ে বেগে |

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ১২রা মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
শান্তিসুখের বৈকুণ্ঠে অনাহার  
তারক আইচ, রিষড়া, হুগলি

এত আরাম এতো সুখ
আর কোথাও নাই
পশ্চিমবঙ্গ পৃথিবীতে
সুখের স্বর্গ চাই ||

মুঠো মুঠো চাকরি হেথায়
নেই কো বেকার কোনো
অনাহার টনাহার
ঝুট বাত হ্যায় শোনো ||

শিল্পের বইছে জোয়ার
প্রকল্প তার নানা
কোনোখানে বন্ধ নেই
একটাও কারখানা ||

বস্তা করে সুখ বইতে
মানুষ যেথায় পারে
সেথায় বৃথা লোকে কেন
মরবে অনাহারে !

কোথায় কোথায় অনাহার
খুঁজবে টাটার গাড়ি
ছুটে যাবে এদিক ওদিক
ঘুরবে বাড়ি বাড়ি ||

তাই হচ্ছে সিঙ্গুরেতে
টাটার কারখানা
এত বড় সত্যি কথা
তাও নেই গো জানা !

********************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ১৬ই মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |

.                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
      সিঙ্গুর            
সুকান্ত দে, কলকাতা

অঘ্রানের দিন শেষ,
দিন শেষ সোনালী ফসলের |
এখন ধানের জমি বুট আর বুলেটের,
এখন ধানের জমি পুলিশ আর পশুদের |
বেরাবেরি, বাজেমেলিয়ার গ্রামে আর নবীন দাস, গৌরহরি          
ধান কাটতে আসবে না | মাঠ হইতে উহাদের
অবসর                
ঘোষিত হইয়াছে | উহারা এখন আসন্ন শিল্পায়নের শরিক |         
বিষন্ন মেঠো ইঁদুর
তাকায়ে থাকে আকাশের পানে,
মাটির গভীরে রাশি রাশি
সোনালী ফসলের ভাঁড়ার শূণ্য আজি |
কালি প্রাতে ভিখু আর পাঁচি
ফিরে যাবে খালি হাতে,
খালি পেটে দিয়ে যাবে
বিধাতারে গালি |
উচ্চিংড়ে আর গুবড়ে পোকার যন্ত্রণার দিন শেষ, ন্যাংটা পুটো    
চাষার ছেলে, গর্তে জল ঢালিয়া উচ্চিংড়ে আর গুবড়ে ধরিয়া      
দেশলাই খাপে ভরিবে না | উহারা মনের আনন্দে                   
কারখানার ফাঁকা জমিতে উড়িয়া বেড়াইবে | উহাদের              
জীবন কৃষি হইতে শিল্পে উন্নীত হইবে | উহারাও আগামী           
শিল্পায়নের শরিক |                                                   
হেমন্তের জ্যোত্স্নায় নিশির শিশির
ধুয়ে দেয় সোনালী ফসল |
টপ্ টপ্ ঝরে পড়ে জল
ভিজে ওঠে মাটি ঘাস
আর রাতজাগা পাখিদের ডানা |
লক্ষ্মীপেঁচা ধেয়ে যায়
মেঠো ইঁদুরের পানে,
ইঁদুর লুকায় পড়ে ধানের জঙ্গল
আর মাটির গভীরে |
ঋতু বৈচিত্রের নিয়ম মানিয়া আবার হেমন্ত আসিবে |              
কিন্তু মেঠো ইঁদুর রাত জাগা পাখি আর ঝিঁ ঝিঁ পোকা             
থাকিবে না | থাকিবে না ধানের গন্ধ মাখা শিশির |                 
থাকিবে শুধু পুঁজির লক্ষ্মী ! লক্ষ্মী পেঁচা | কারখানার                
মিনারে বসিয়া অন্ধকারে চোখ পাল্টাইয়া সে খোঁজ                
করিবে হেমন্ত, হেমন্তের শিশির, মেঠো ইঁদুর আর                 
সোনালী ফসল |                                                       
গংগাফড়িং হারিয়ে গেছে
হারিয়ে গেছে নীল কণ্ঠ |
খাসের ভেড়িতে লাল পতাকা
বাজছে দেখো শিল্পায়নের শঙ্খ |
আকাশে উড়ছে চিল
মাটিতে শকুন |
রক্ত লেগেছে ধানে
মাটিতে তাপসীর খুন |
নবান্ন তো নূতন ধানের গন্ধ
নবান্ন তো শিল্প |
মোটর গাড়ি চড়বে চাষা
শিল্পায়নই বিকল্প |
বহু বছর বাদে, নবীন বালক প্রপিতামহের হাত ধরিয়া কারখানার
প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইবে | বৃদ্ধ বলিবেন --- এই সেই সোনা-         
আবাদী জমি, এখানে সোনা ফলিত | বালক বিস্ময়ে বলিয়া        
উঠিবে --- এতো শুধু ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল,                    
ভাঙ্গা চিমনি আর লোহালক্কড়ের স্থবির শব,
শিয়াল ও বিষধর সরীসৃপের আবাসভূমি |
বৃদ্ধ বলিবেন --- বিদায়, বিদায় প্রিয় আবাদভূমি |                   
বালক বলিল --- টাটা, টাটা |                                         

********************

এই কবিতাটি পশ্চিমবঙ্গ ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক       
সমিতির মুখপত্র 'ভূমিবার্তা' পত্রিকার নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০০৬ এর
সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে |                                          

.                            
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                     সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
মুষ্ঠিবদ্ধ স্বপ্ন ছিল
শ্রেয়া, শ্রীরামপুর কলেজ


মুষ্ঠিবদ্ধ স্বপ্ন ছিল, বজ্র ছিল মনে,
    জানি না কখন কোন উষ্ণ সন্ধিক্ষণে
শিরায় শিরায় সে কি তীব্র উন্মাদনা ---
    মাটিতে ফলেছে রাঙ্গা স্বর্ণবসনা!

পৃথিবীর শূণ্যগর্ভ ভরে গেছে ধানে,
    ধুমন্ত শিশুটি আজ কাঁদেনি ক্ষুধায় ;
লাজুক চোখের নীড়ে জ্বালব সাঁঝবাতি
    সুরভিত ফসলের বিরল সন্ধ্যায় |

হঠাত্ সামনে দেখি উগ্র হানাহানি
    সশস্ত্র হুমকি দেয় মোহিনী সভ্যতা |
যুদ্ধবাজ ডঙ্কা বাজে ত্রস্ত রাজপাট
    একরাত্রে চুরি হয় শস্যঝরা মাঠ!

মৃত্যুর খোলা বাঁটে পেতেছি ফুসফুস
    করিনি ভয় আমি মাটির সন্তান ;
আমার রক্তে ভেজে স্বপ্ন-ঝরা মাটি
    একরাত্রে পণ্য হয় জীবনের মান |

চেতনাগর্ভ থেকে বেদনা শ্বাপদ
    উঠে এসে ছুঁয়ে দেয় বারুদ আকাশ
মৃত্যুমুখ যেন মনে হয় কালো চাঁদ
    আমরা তবু পাশাপাশি স্তব্ ধ-মৃত লাশ |

নগরীর কালসর্প তারা করে বশ
    সাইরেনে শোন আজ অন্য সংকেত!
মৃত্যুর আগামী কোনও অগ্রাসী ভোরে ---
    পৃথিবীর শস্যক্ষেত্রে ফলবে বুলেট ||

       **************************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২৩ই মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |
                              

.                              
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
ছাপোষা
কৌশিক পাল, দমদম, কলকাতা

পদ নেই, তাই পদত্যাগ করতে পারি না
কেউ ছাপবে না, তাই লিখতে পারি না
মাথা রোদ্দুর নেয় না, তাই আমায় মিছিল নেয় না
বন্দুক তো নেইই, ভাবনাও নেয় না
গণহত্যার প্রতিবাদ আমি করব কেমন করে?

বিরোধী হরতালে স্কুলে গেলাম
তার পর ছাত্রশূণ্য ক্লাসে গিয়ে,
মনে হল রয়েছি দাঁড়িয়ে ---
জনশূণ্য গ্রামে একলা পুলিশের মতো |

     **************************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২৩ই মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |
                              

.                              
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম
পল্লব কীর্তনীয়া, কলকাতা

কাঁদতে কাঁদতে এখনও কান্না আছে?
এখনও কি বেঁচে আছে গো চোখের জল?
তজানু হয়ে বসেছি তোমার কাছে
ভরে দাও ভরে দাও দুটি করতল ||

এতকাল ধরে ভরে দিলে এ দু'হাত
ক্ষুধার অন্নে, তাই এই বেঁচে থাকা
এখন থালায় যতবার বাড়ি ভাত,
কিষান তোমার রক্তে অন্ন মাখা!

এ আমার পাপ, আমিও আসলে খুনি
মধ্যবিত্ত ভেসেছি বিশ্বায়নে
পুঁজির তন্ত্রে 'রচি মম ফাল্গুনী'
মগজ রেখেছি হুজুরের শ্রীচরণে |

এখন দু'ফোঁটা অশ্রু আমায় দেবে?
ভয় ধুয়ে নেব বুকের গোপন ঘরে
হয়তো আমিও বুলেটের মুখে যাব
পাপ মুছে দেখা হবে জন্মান্তরে |

   **************************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২৩ই মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |
                              

.                              
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত
*
নন্দীগ্রামঃ চিত্র ১
উত্পল কুমার গুপ্ত, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

তোমার তো সবই ঠিক আছে
   আমার ঘরটা অন্ধকার
ঘর বা কেন বলি তারে
   চোরাকুঠুরির বন্ধদ্বার ||

চোখের সামনে স্বামী শেষ হল
   ছেলে দুটিকেও মারলো গুলি
মেয়েটিকে ধরে কোথায় যে নিল
   আদরের মেয়ে তুলতুলি ||

আমার শরীরে কত যে দাগ
   নখ ও দাঁতের কামড়ের ক্ষত
বিবস্ত্র আমি ভাবতে পারি না
   চুলোয় গিয়েছে সব সহবত্ ||

কে আছো বাইরে বাঁচাও আমাকে
   একখানা শুধু কাপড় দাও
সেই সাথে কিছু বিষও এনো
   আমাকে যদি বাঁচাতে চাও ||

ভবতে পারি না ভাবতে পারি না
   ভরা সংসার সুখের হাট
দেখে যাও এসে সবই শ্মশান
   চার দিকে শুধু ধূ ধূ মাঠ ||

    **************************

এই কবিতাটি 'দৈনিক স্টেটসম্যান' পত্রিকাতে ২৩ই মার্চ ২০০৭ এ
প্রকাশিত হয়েছিল |
                              

.                              
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত