সৈয়দ আলাওল-এর কবিতা |
বসন্তে নাগর বরনাগরী বিলাসে ভণিতা হীন আলাওল কবি আলাওল ১৯৬০ সালে প্রকাশিত, জায়সীর “পদ্মাবত” কাব্যের মহাকবি সৈয়দ আলাওল রচিত, বঙ্গানুবাদ “পদ্মাবতী”- র, দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত সম্পাদিত গ্রন্থের ২০৭-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া রয়েছে। এখানে কবির পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থে, “ষট ঋতু বর্ণনা” খণ্ডের পদের দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদিত পাঠ। ॥ গীত বসন্ত রাগ॥ বসন্তে নাগর বরনাগরী বিলাসে। বরবালা মুখ ইন্দু স্রবে সুধা বিন্দু বিন্দু মৃদুমন্দ ললিত অধর মধুহাসে॥ প্রফুল্লিত কুসুম মধুব্রত ঝহ্কৃত হুঙ্কৃত পরভৃত কুজিত রাবে। মলয়া সমীর সুসৌরভে সুশীতল বিলুলিত পতি অতি রসভাবে॥ পল্লবিত বনস্পতি কুটজ তমালদ্রুম মুকুলিত চূতলতা কোরক জালে। যুবজনহৃদয় আনন্দ পরিপুঞ্জিত লবঙ্গ মল্লিকা মালতীমালে॥ মধু সেনাপতি সঙ্গে মদন মেদিনীপতি বাহিনী কোরক নবপল্লব পুরিত। নবদণ্ড কেশর চামর শির সবের ভুবনবিজয়ী চিত্ত যুবক শাসিত॥ চৌদিগে যুবতিকুল মাঝে সুনায়ব বব নৃত্যগীত অতিশয় আনন্দ বিভোরে। শ্রমযুত শরীর বিশ্রীমিতাশ্রয় ভাবে অতিরসে রমণী লুলিত পতি উরে॥ কুহু করতাল বংশী কাসব মণ্ডল সমধুর ললিত উপাঙ্গ আওয়াজে। তানত থোনত ধিয়া ধিতা তাথি থেই থিয়া জিকু কুসি সুমি কিবা যত পাখোয়াজে॥ মধু মনসিজ মদে নৃত্যকলা বিশারদে তৃষিত নয়ন অঙ্গ আলিঙ্গন চুম্বে। সুবেশ নিকর ভাবে রস ভাব অলসিত বিরমই রমণী উরজ অবলম্বে॥ আনন্দ সায়রে মনো- হরিত যন্ত্র গীত তালে করপদ দোলিত রতি নটরঙ্গে। কুচ কুম্ভ গ্রহি করে চুম্বিল নাগর বরে মজিত উগিত রস উদধি তরঙ্গে॥ রসিক নায়র মণি শ্রীযুত মাগন গুণী মধুঋতু কলাধীর রতিরস বাসে। হীন আলাওলে কহ সতত বসন্ত সুখ যার রমণী বসতি পতি পাশে॥ সম্পাদকের মন্তব্য - আলাএলের এই নিজস্ব বসন্ত গীতটি বিভিন্ন পুঁথিতে বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। বিভিন্ন পাঠ থেকে মোটামুটি একটা শুদ্ধরূপ দেওয়া গেল। পদটির ভাষা ভঙ্গীতে জয়দেবের বসন্ত বর্ণনাপদের প্রভাব সক্ষণীয়। এই পদটি জায়সীর “পদ্মাবত” কাব্যের মহাকবি সৈয়দ আলাওল রচিত, বঙ্গানুবাদের, অংশ বিশেষ, দীনেশচন্দ্র সেনের "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য" গ্রন্থের (৬ষ্ঠ সংস্করণ) নবম অধ্যায়ের ৪৯৬-পৃষ্ঠায় আংশিক এইরূপে দেওয়া রয়েছে। বসন্তে নাগরবর নাগরী বিলাসে। বরবালা মুখ ইন্দু, স্রবে সুধা বিন্দু, মৃদুমন্দ অধরে ললিত মধু হাসে॥ প্রফুল্লিত কুসুম, মধুব্রত ঝঙ্কৃত, হুঙ্কৃত পরভৃত কুঞ্জে রতরাসে। মলয়সমীর, সুসৌরভ সুশীতল বিলোলিত পতি অতি রসভাষে॥ প্রফুল্লিত বনস্পতি, কুটিল তমালদ্রুম, মুকুলিত চূতলতা কোরক-জালে। যুবজন হৃদয়, আনন্দ পরিপুরিত, রঙ্গমল্লিকামালতীমালে॥ . ************************ . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
শেখ মহম্মদ যতি যখনে রচিলা পুঁথি ভণিতা হীন আলাওল কবি আলাওল ১৯৬০ সালে প্রকাশিত, জায়সীর “পদ্মাবত” কাব্যের মহাকবি সৈয়দ আলাওল রচিত, বঙ্গানুবাদ “পদ্মাবতী”-র, দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত সম্পাদিত গ্রন্থের ২৫-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া রয়েছে। এখানে কবির পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থে, “কাহিনী সূত্র” পদের দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদিত পাঠ। ॥ রাগ লাচারী দীর্ঘ ছন্দ॥ শেখ মহম্মদ যতি যখনে রচিলা পুঁথি সংখ্যা১ সপ্ত বিংশ নব শত। চিতাওর গড়েশ্বর রত্নসেন নৃপবর শুক মুখে শুনিয়া মহত॥ যোগী হৈয়া নরাধিপ চলিল সিংহল দ্বীপ ষোলশত কুমার সঙ্গতি। লঙ্ঘি বনখণ্ড বাট উত্তরিলা সিন্ধুঘাট নৌকা দিলা নৃপ গজপতি॥ সিংহল দ্বীপেতে গিয়া নানাবিধ দুঃখ পাইয়া বহু যত্নে পাইল পদ্মাবতী। সাগরে পাইয়া ক্লেশ আসি চিতাওর দেশ কৈল বহু উত্সব আনন্দ। রাঘব চেতন গুণি অবিমর্ষি কহি বাণী প্রতিপদে দেখাইল চান্দ॥ তত্ত্ব জানি নৃপবর তাকে কৈলা দেশান্তর যাইতে হৈল কন্যা দরশন। বহুল আদর মনে করের কঙ্কণ দানে পরিতুষি পাঠাল ব্রাহ্মণ॥ সোলতান আলাউদ্দিন দিল্লীশ্বর জগজিন প্রচণ্ড প্রতাপ ছত্রধর। পণ্ডিত ব্রাহ্মণ তথা কহিল কন্যার কথা শুনি হরষিত নৃপবর॥ শ্রীজা নামে বিপ্রবর পাঠাইল রাজ্যেশ্বর কন্যা মাগি রত্নসেন স্থানে। পদ্মাবতী না পাইয়া শ্রীজা আইল পলটিয়া শুনি সাহা ক্রোধ হৈল মনে॥ বহুল মাতঙ্গ বাজী চতুরঙ্গ দল সাজি গেলা চিতাওর মারিবারে। দ্বাদশ বত্সর রণ তথা ছিল অখণ্ডন রত্নসেন ধরিল প্রকারে॥ দিল্লীশ্বর পাটে আইল নৃপ কারাগারে থুইল তাড়না করিল নানা ভাতি। গৌরা বাদিলা নাম ছিল রত্নসেন ঠাম মুক্ত কৈল কপত যুকতি॥ চিতাওর দেশে আসি বঞ্চিলেক সুখে নিশি পদ্মাবতী সঙ্গে করি রঙ্গ। দেওপাল নৃপ কথা পদ্মাবতী মুখে তথা শুনি নৃপমন হৈল ভঙ্গ॥ সর্বারম্ভে তথা গিয়া দেওপাল সংহারিয়া যুদ্ধক্ষত আইলা নৃপতি। সপ্তম দিবসান্তর২ মৈল রত্নসেন বর দুই রাণী সঙ্গে হৈলা সতী॥ পুনি সাজি দিল্লীশ্বর আসি চিতাওর গড় চিতাধূম দেখিলা বিদিত। সতী গতি পদ্মাবতী শুনি সাহা মহামতি মনে হৈল পরম দুঃখিত॥ চিতাওর ইসলাম করি দিল্লীশ্বর গেলা ফিরি পুস্তকের এই বিবরণ। মহাদেবী পাত্রবর নানা গুণে বিদ্যাধর শ্রীযুত ঠাকুর মাগন॥ তাহান আরতি ভাবি হীন আলাওল কবি রচিলেক সরস পয়ার। সুর শশী বায়ু জল যত দিন ক্ষিতিতল নাম কীর্তি রহুক সংসার॥ শব্দার্থ টীকা - শেখ মহম্মদ যতি - মালিক মুহম্মদ জায়সী। ইনি ছিলেন সুফি সাধক। ১ - সংখ্যা সপ্তবিংশ নবশত - ৯২৭ হিজরী। কিন্তু জায়সীর গ্রন্থ ৯২৭ হিজরীতে নয়, ৯৪৭ হিজরীতে রচিত হয়েছিল বলে পদ্মাবৎ কাব্যের নিম্নলিখিত পংক্তি থেকে জানা যায়--- সন নব সৈ সৈঁতালিস অহা। কথা আরম্ভ বৈন কবি কখা॥ রত্নসেন - চিতোরের রাজা টডের ইতিহাসে ইনি ভীমসিংহ নামে পরিচিত। নাগমতী - চিতোররাজ রত্নসেনের প্রথমা পত্নী। রাঘব চেতন - রত্নসেনের সভাপণ্ডিত। প্রতিপদে. . .চান্দ - প্রতিপদ তিথিতে দ্বিতীয়ার চাঁদ দেখিয়েছিল। আলাউদ্দিন - দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি চিতোর আক্রমণ করেন। জগজিন - জগজ্জয়ী শ্রীজা - সুলতানের দূত। জায়সীতে এর নাম সরজা। গৌরা বাদিলা - রত্নসেনের সেনাপতি। দেওপাল - চিতোরের পার্শবর্তী রাজ্য কুম্ভলনের হিন্দুরাজা দেবপাল। ২ - সপ্তম দিবসান্তর - সাতদিন পর। শহীদুল্লাহের পাঠে সপ্ত মাস অন্তর। চিতাওর ইসলাম করি - আলাউদ্দিন চিতোর জয় করে আপন পুত্র খিজির খাঁর নামানুয়ায়ী এর নতুন নামকরণ করেন খিজিরাবাদ। পদ্মাবৎ কাব্যের শেষে জায়সীও চিতোরের ইসলাম রাজ্যে পরিণত হবার কথা লিখেছেন। . ************************ . সূচীতে . . . মিলনসাগর |