কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তার কবিতা
জীবন্ত দেবতা
কবি অম্বুজাসুন্দরী দেবী
সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার আশ্বিন ১৩০৩ (অক্টোবর ১৮৯৬) সংখ্যায় প্রকাশিত।
মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


কোন স্বর্গ হতে এলে জীবন দেবতা ?
ফুটন্ত কুসুম সম,
বদন পবিত্রতম,
বচন বেদের সম স্বর্গের বারতা।
চরণ পঙ্কজ মাঝে
সহস্র চন্দ্রমা রাজে,
ঘুমায় চরণতলে অসংখ্য তপন ;
অধরে জ্যোছনা ভরা,
কপোল অমৃতে গড়া,
কে তুমি দুঃখীর ঘরে অমূল্য রতন ?
পাইয়া দরশ সুধা
মিটিল পিয়াস ক্ষুধা,
শত পূত পীঠস্থান তব পদ-রজ,---
চাই না অনন্ত স্বর্গ,
চাইনা দেবতাবর্গ,
চাহি না মলয়ানিল,---প্রফুল্ল পঙ্কজ ;
না চাই তপন শশী,
শত ভালবাসাবাসি,
তোমাতে ডুবিয়া রই, সব যাই ভুলি,
জীবন্ত দেবতা স্বামী, দেহ পদ-ধূলি।

.    ***************  

.                                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিষ্ণুপ্রিয়া
কবি অম্বুজাসুন্দরী দাস
সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার ১৯০১ সালের অগ্রহায়ণ ১৩০৭ (ডিসেম্বর ১৯০০)
সংখ্যায় প্রকাশিত। এই কবি আমাদের অনুমান অনুযায়ি স্বয়ং কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশ গুপ্তা। এ বিষয়ে
কবির পরিচিতির পাতায় বিস্তারিত লেখা পড়ুন। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


কত ক’রে সাধিলাম,                        কত ব’সে কাঁদিলাম,
লুটে লুটে পড়িলাম রাঙ্গা চরণে,
তবুও হলো না দয়া পাষাণ প্রাণে।
কেন যাও তেয়াগি,                          কেন এত বিরাগী ?
কি ধারা বহিয়া যায় বাঁকা নয়ানে!
কিসে এত উতরোল,                         মুখ-ভরা হরিবোল,
দিন কাটে রাতি কাটে কার ধেয়ানে ?
আমি দাসী---চিরদাসী,                       চির শুভ-অভিলাষী
নির্নিমেষে চেয়ে আছি ও মুখ পানে ;
কি বুঝিব হরি হরি!                      কিসে এত ছাড়াছাড়ি,
আমি ত ও পদ ভাবি ধ্যানে জ্ঞেয়ানে।
প্রিয়, অতি প্রিয় তুমি,                    কোথা চলে যাও স্বামী,
কিছু কি হয় না দয়া পাষাণ-প্রাণে ?

শ্রীঅম্বুজাসুন্দরী দাস।

.    ***************  

.                                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পাগল ভোলা
কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা
বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে
কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


পাগল ভোলা!
সরলতা চাহ তুমি হ’ব সরলা,
বনদেবী সেজে এসে জুড়াব জ্বালা,
বুক-ভরা সরলতা,                           মুখ-ভরা মিঠে কথা,
আমার সকলি আছে---রয়েছে তোলা।

পাগল ভোলা!
আজ মিটাইব সাধ,                           ভেঙে দিব সব বাধ,
সাজাব কুসুম-ফুলে বরণ-ডালা,
ঝরা তারা কোল পেতে                      ধরিব আঁধার রেতে,
রূপের বাহারে ধোব মনের মলা।

পাগল ভোলা!
এক বস্ত্রে এলোকেশে,                          বিনাসনে বনে ব’সে,
তুমি নাকি ভাল বাস কুসুম-তোলা,
তাই দেখ! এই রেতে                            চলিয়াছি বন-পথে,
কুঁদফুলে কালো অঙ্গ করিব ধলা।

পাগল ভোলা!
অভিমান, মুখ ভার                        দেখিতে হবে না আর,
সরলতা ভালবাস, হ’ব সরলা,
ছুটে যাব হেসে হেসে,                        আবার জুটিব এসে,
পরাব সোহাগ-ভরে ফুলের মালা।
একেলা পুলিনে বসি                          বাজাব মোহন বাঁশী,
এতেও কি ভুলিবে না ও মন ভোলা?
ঝরা পাতা বিছাইয়া,                            চুলগুলি ছড়াইয়া,
ঘুমাব গাছের তলা করিয়া আলা।
চারি পাশে গুন্ গুন্,                       ডেকে ডেকে হবে খুন,
আমার সে রূপ দেখি ভ্রমরাগুলা,
পাগল ভোলা!
দূরে অতি দূরে থাকি                       তুমিও দেখিবে নাকি,
সে মুখ সে কালো চুল বাতাসে দোলা?
অমনি ছুটিয়া এসে                            আদরে নিকটে বসে
ডাকিবে সোহাগ-ভরে---ওঠ সরলা!
একধারে বসে থেকে                        লয়েছি আলস্য শিখে,
এবার লাগিব কাজে র’ব না তোলা।
কখন সরলা-সাজ,                            কখন কর্ত্তব্য কাজ,
কখন কাঠিন্য-ভাব কভু কোমলা,
কখন পুতুল করে,                             কখন দুঃখীর ঘরে,
ধন ধান্যে নিবারিতে দরিদ্র-জ্বালা।
যদিও সামান্য নারী,                          তবুও কি নাহি পারি
পূরাইতে এ তোমার বাসনা গুলা?
সতীর যেমন স্বামী,                        আমারো তেমনি তুমি,
এস এস কাছে এস পাগল ভোলা!

.    ***************  

.                                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
গোপিকা
কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা
বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে
কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


ফুলবনে কে রমণী বাঁশরী বাজায়?
সুনীল কুন্তল খোলা,
উরসে কুসুমমালা,
সরলা কোমলা বালা প্রেম-গীতি গায় ;
ফুলবনে কে রমণী বাঁশরী বাজায়?
তীখণ কটাক্ষে তার
কার হিয়া চূরমার?
এ কে রে! কাহার ছেলে ঘন ঘন চায়?
ফুলবনে কে রমণী বাঁশরী বাজায়?
অধরে তাম্বুল-রাগ,
চরণে অলক্ত-দাগ,
স্বর্গীয়-মদিরা-মাখা আঁখি-নীলিমায়,
ফুলবনে কে রমণী বাঁশরী বাজায়?
এ কে রে! কাহার সুত,
আহত মৃতের মত?
সবলে চলিতে নারে টলে পায় পায়,
ফুলবনে কে রমণী মুরলী বাজায়?
কুসুম-চয়ন-ছলে
নূপুর বাজায়ে চলে
কার ছেলে আড়ি পাতে বকুল তলায়?
ফুলবনে কে রমণী বাঁশরী বাজায়?

.    ***************  

.                                                                                               
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মহিমা
কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা
বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা"
গ্রন্থে কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


পরমাত্মা!---পরমেশ!---চিন্ময় অমৃত-ধারা!
নিখিল জগত তব মহাপ্রেমে মাতোয়ারা।
পর্ব্বত-মেখলা শস্য-শ্যামলা ভারত-ভূমি,
জাহ্নবী যমুনা সিন্ধু অনন্তসাগরগামী ;
স্তিমিত-অস্ফুট-জ্যোতিঃ নক্ষত্র সরল-প্রাণ,
সমুদ্র উছলি ব’য়,---কি মহান্, গরীয়ান্।---
অযুত-তরঙ্গময়---সুবিশাল করপুটে
মণিদাম মরকত ঢালিয়া দিতেছে তটে ;
সুনিবিড় বনরাজি অভ্রভেদী ধরাধর,
অবিচলা দিগঙ্গনা ;---মহাশূন্য অনম্বর ;
বিচিত্র নক্ষত্র-খণ্ড মহাসুর-বর্ত্মে ভাসে,
বরষ অজ্ঞাতসারে কি সুন্দর যায় আসে ;
স্বর্গের সোণালী দূতী---পূর্ণিমা---আলোক-মাখা,
উন্নত বিটপী শত প্রসারি প্রশাখা-শাখা ;
মধ্যাহ্ন-আকাশে রবি---জীবন্ত দেবতা প্রায়,
গ্রহ-উপগ্রহ-বিশ্ব---এক সূত্রে গাঁথা তায় ;
মানব-হৃদয় রাজ্য কত ভাবে ভাবময়,
সকলের রচয়িতা হে মহামহিমালয়!
পরম পুরুষ!---ধাতা!---অদ্বিতীয়!---অনশ্বর!
তোমারি করুণা-কণা এ অনন্ত চরাচর।
বসন্তের শান্ত সন্ধ্যা-সমীর সধীরে ব’য়,
কোকিল কুহরে কুঞ্জে, ‘চোখ্ গেল’ কথা কয় ;
তোমারি সৌন্দর্য্যে নাথ! বসুন্ধরা সুশোভনা,
যেখানে যতই দেখি,---তোমারি করুণা-কণা।

.    ***************  

.                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
স্বর্গ
কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা
বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে
কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮।


স্বরগ স্বরগ নাম শুনি সর্ব্বক্ষণ ;
কোথায় স্বরগ ধাম,                        স্বরগ কাহার নাম,
ভেবেছি করিব আমি তাহার বর্ণন।


পুণ্যাত্মা জনের পুণ্যময় হৃদি-তল,
রহে যথা নিরমল                        ধর্ম্ম-নীর সুশীতল,
প্লাবিত করিয়া ধরা, সেই স্বর্গ-স্থল।


বহে যথা নিরন্তর ধর্ম্মের সুবাস ;
চিরদিন যার গুণে,                        চিরসুখী সর্ব্বজনে,
শান্তিতে বিধৌত সদা যাহার আবাস।


সেই স্বর্গধাম ভবে সেই স্বর্গধাম,
পাপ-সঙ্গ পরিহরি                        চল মন ত্বরা করি,
পবিত্র স্বরগরাজ্যে লভিতে বিশ্রাম।

.    ***************  

.                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রার্থনা
কবি অম্বিকাসুন্দরী দাশগুপ্তা
অধ্যাপক বিধুভূষণ গোস্বামী ও অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র সম্পাদিত “সম্মিলন” (ঢাকা
রিভিউ ও সম্মিলন) পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩১৮ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯১১) সংখ্যায়
প্রকাশিত। আমাদের অনুমান এই যে, অম্বিকাসুন্দরী দাশগুপ্তা ও অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা
একই ব্যক্তি এবং মুদ্রণ-প্রমাদের কারণে এই নাম-বিভ্রাটের সূচনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত,
কবির পরিচিতির পাতায় দেখুন।


অন্তর্যামী জানিছ সকল
.        প্রয়োজন কিবা বলিবার
কি বলিব বুঝিনা যখন
.        চাহিব কি বিপুল ব্যাপার!
পরাহত বচন অক্ষর
.        ভাষা নাই করিতে ব্যকত
হৃদয়ের আকুল উচ্ছ্বাস
.        চিরদিন ও চরণে নত।
দিও নাথ এমন দর্শন
.        যে দর্শনে পুরে সব সাধ
পৃথিবীর দৃশ্য আখি মেলে
.        দেখিবারে ঘটায় বিবাদ!
শুনাইও সে সুধা শ্রবণে
.        যাহে হয় বধির শ্রবণ
পৃথিবীর বৃথা কোলাহল
.        নাহি পশে শ্বরণে কখন।
দিও প্রাণে এমন আলোক
.        ঘুচে যাহে প্রাণের আঁধার
অপরূপ চিন্ময় সুন্দর---
.        উজলিবে হৃদয় আগার।
দিও নাথ এমন রতন
.        যাহা পেলে তুচ্ছ সমুদয়
ত্রিলোকের সৌভাগ্য সম্পদ---
.        শ্রীচরণ দিওগো আমায়,
কর মোরে নির্ব্বোধ অজ্ঞান
.        দিয়ে সেই অচিন্ত্য চিন্ত।
যে চিন্তায় চিন্তামণি লভি
.        বৃথা চিন্তা করে পলায়ন।
দিও মোরে সেই নিত্য প্রেম
.        যাহে হয় সব একাকার
তোমা ময় হেরিয়া জগত
.        বিলাইব মমতা আসার।
কি আর বলিব প্রভু
.        জানিতেছ অন্তর বাসনা
তোমাময় কর এ জীবন
.        নাহি মম অপর সাধনা।

.                        অম্বিকাসুন্দরী দাশ গুপ্তা

.    ***************  

.                                                                             
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*