কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
*
শুশ্রূষা
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

আহত শিবির থেকে ফিরে এলে
শুশ্রূষা দিও তাকে, দিও নিউরণে বিশ্রাম
ঘাম মুছে ক্ষত মুছে, চতুর ভয়াল থাবা নখ
আঁচর কামড় মুছে, কেঁপে ওঠা হাড় মজ্জায়
রেখো সম্ভ্রমের হাত, স্পর্শের নিরাময়
আলতো হাতের ছোঁয়া চপল চিবুকে
লাবণ্য চিকন ত্বকে পিছলে যাচ্ছে যত
নহলা সময়, চোখের ইশারায় যদি
পাতা ছিল ফাঁদ খুঁজে নিও কতটা
শিকার ছিল বিলোল কটাক্ষে
ধর্ষিত হওয়ার আগে শিবিরে শিবিরে বুঝি
বয়ে গিয়েছিল হাওয়া প্ররোচনাময়
স্রোতমুখী ঘূর্ণীতে ভেসে অচেনা সময়
অসংযমী রাতে, ধর্ষিত হওয়ার আগে
লিখে রেখে অকপট আত্মজীবনী
রৌদ্র হিংসা মুছে ফেলে অন্ধকারে
সে নিয়েছে দহলা রাত্রি জীবন |

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
যে রাতে মোর---
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

এ ভাবে ধর্ষিত হতে পারে বুঝি কেউ
এ ভাবে যখন ঠিক নক্ষত্র উজ্জ্বল চোখে
উল্কার ছাই উড়ে আকাশের নীল
ঘাসপাতা ফড়িং-ডানায় মিলেমিশে
শিকারী সবুজ ভয় ওঁত পেতে নিশ্চুপ
পথ কার্নিশে, যখন আঁধার নামে
ওমঘুমে ছিটমহলের অন্ধকারে, বেনোজলে
চাঁদ ভাসে, জ্যোত্স্নার ঢলানি আঁচলে
বাতাসের কুপ্রস্তাব চটুল প্রয়োগে
চুমকুড়ি শিস্ , তীক্ষ্ণ রহিস রাতে
উড়ে যায় চুনরিয়া লাল, উন্মুখ নাভিমূলে
গূঢ় বিভাজিকা ডেকে আনে বিস্ফোরক
যাবতীয় ভুল, খোলা চুলে থ্যাতলানো
শরীরের খাঁজে, পাশুটে রক্তরসে
সন্ধানী মাছি ওড়ে হিংস্র নখর থাবা
আঁচড় কামড়ে খোঁজে কাঁটাওয়ালা
চাবুকের ভয়, ধর্ষণের রাত ছিল কতটা
অসংযমী কতটা প্ররোচনাময়---
ফাঁদ পাতা ছিল বুঝি বিলোল কটাক্ষে
পিচ্ছিল মোম ত্বকে প্রতি রোমকূপে
স্বপ্নালু চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়
মনোবিকারের ঘরে মথিত চিত্কারে
মাথাকুটে হয়রান চর্যাপদের হরিণ
গরাদের ফাঁকে দেখে কপট আকাশে
ধ্রুবতার অসহায় | সাক্ষী বিরূপ
নির্ভুল প্যাবেড়ে যদি চিনে নেয় চোখ
আত্মবিমুখ মুক ও বধির
.               প্রমাণের অপেক্ষায়

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তৃষ্ণা
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’
খুব দূরে দাঁড়িয়েছো একা
যদি পথ এসে তুলে নেয়----
অন্তিম চিকুর হেনে তুমি কী তাকাবে ফিরে
এই যে শ্রাবণমায়া, মালতীলতার ঝংকার
বেজে ওঠে গান বরাবর আলো অভিসারে
তিমিরের স্তুপ হয়ে আছে যে আড়ালের অন্ধকার
তুমি কী ফেরাবে তাকে সুহানা সফরে
মেঘ বর্ষাতি গায়ে বৃষ্টির পথমিছিলে
বুঁদ বুঁদ জল অবিরল----
তৃষ্ণার বুক জুড়ে চোখের তারায় |

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আয় ঘুম
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

ঘুমন্ত পাখার ব্লেডের নীচে আমি নির্ঘুম রাত
গড়িয়ে নামছে জল, চোয়াল চিবুক ভিজে
বুকের আহ্লাদ, স্নায়ুতে শিরায় পিছুডাক
ফোঁটা ফোঁটা নেশার তরল মিলে মিশে
দেহরস মেদমজ্জা অস্থিচূর্ণ শ্মশান কলস
ভরে ওঠে গানে ----‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু-----‘


আর বিরহ দহনে কাটে অক্ষম দিন
নতজানু হয়ে থাকে ময়ালের অবসাদে
ঘুমের ভিতর পর্যটন, ভুলচুকে যৌনতা
গলিসন্ধির বাঁকে পাপলতা জড়িয়ে গোপন
শুনি ছেঁড়া কুসুমের আলাপ-রাগ হংসধ্বনি
নিখাদ জোড় ঝালা লয় তাল দ্রুত চমত্কারী
উড়ে যায় মায়াবতী মেঘ তন্দ্রার ঘুম
ঘুমন্ত পাখার ব্লেডের নীচে-----“জাগরণে যায় বিভাবরী”---

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কণা মাত্রিক
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

যে সব করুণাকণা দিয়ে চলে গেছ তুমি
পথ-বিভূতিতে, সে সব ভস্মমুঠি
হাতের তালুতে রেখে পাঞ্জার ছক কষি
কেল্লাতে পুঁতেছি নিশান অবাধ
আকাশের মনোভূমি বোধির পাতালে
বেঁধেছি শঙ্কার বাধ পাথরের কৃৎকৌশল,
একে একে ডুবে গেছে ঘর বাসস্থান
কাঙ্ক্ষিত বনভূমি স্বপ্নাদ্য মঞ্জিলমহল
তিন সত্যি এক মিথ্যা জলে, বামনের মতো
দাঁড়িয়ে রয়েছি একপাদ স্পর্শভূমি ছুঁয়ে
স্থানাঙ্ক চিহ্নিত ভুবনে, কোথায় যে
অহং নামিয়েছি কোথা যে রেখেছি
মেধাজ্ঞান ধ্যান বৈভব পরাভব
নিহিত অর্জনে প্রতি এক দিন কাটে
ধুলোস্নানে, বালি ও কাঁকর জিভে
চোখে লেগে বেমিশাল ধুলোর রশ্মিজাল,
গোচারণে হেসে ওঠে চতুর গোসাই
করুণার বাঁশি আজও বেজে চলে
অনাহত ধ্বনি অশ্রুত কানে------
মগ্ন কোলাহল, কুড়িয়ে নিয়েছি দয়া
ঈশ্বরকণা ! সোনামুঠি ছাই-আড়ালে |

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বরাত
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

মেহফিল জমে উঠছে আঁধার ঘনত্বে
চুম্বক চোখের সম্মোহনে, জিভের লালায়
পারদচূর্ণ রেখে চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে
জ্বরের তরাস, তাপমান ছুঁয়ে যাচ্ছে
বিপদসীমার লঙ্ঘন, পুড়ে যাচ্ছে সৌরদিন
প্রহরের ঘন আশ্লেষে, রোমকূপ শিহরণ
ঘাম মূর্ছা পুলকে কম্পমান চিহ্নপ্রণয় নিয়ে
স্বৈরিণী রাতপালিকার অভিসার
ফিরিয়ে আনবে দিন মৃচ্ছকটিক শূদ্রক
মুজরোর অভিমানে অমিয় গরল লিরিক |

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চন্দ্রাহত
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

চন্দ্রাহত হতে হতে
সামলে নিয়েছে ঘর
উঠোন দেওয়াল
চারপাসে কাঁটাতার
নিষেধ আগল
যখন পাগলা ঘন্টিতে
বেজে উঠছে শহর
.               নিখোঁজের সন্ধানে
আমূল জ্যোত্স্না কাঁটা
গেঁথে গেল চোখে
খোলাচুলে ঢলানো আঁচলে
ভূত লাগা সন্ধ্যায়
যে পা বাড়ালে
ফিরে এলে
বর্ষণের রাতে
.            মনো-বীক্ষণে

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
গানের ভিতর দিয়ে
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’

এত শান্ত যে আছে চরাচর    যেন
রক্তের ভিতর শুধু ঘুম, মেধার ভিতর অনুদানা
অক্লান্ত কোষ বিভাজনে লালারসে জড়িয়ে কুসুম
অখন্ড কীটের পরমায়ু নিয়ে শান্তি নির্ভর

‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’

এত ক্লান্ত হয়ে আছে পরস্পর    যেন
বিরহের পথ থেকে দূর অনন্ত নক্ষত্র মন্ডল
অথবা অন্ধকার গাঢ় চোখে পেঁচার মতো
মিথুন লগ্ন নিশিকাল, অতৃপ্ত চুম্বন

‘অশান্তি আজ হানল একি দহন জ্বালা’

এত স্তব্ধ হয়ে আছে ঘরদোর যেন
কোথাও বিরোধ নেই গৃহদাহ অথবা
অঙ্গারকণা, ক্রোধহীন দহনের আগে শিরা সুপ্ত
মাংসল প্রণালীময় দাহ দংশন

‘আমার নাই বা হলো পারে যাওয়া’

এত নির্ভার নিখিল পারাপার   যেন
ফেনাময় কফিতে চুমুক তুচ্ছ করে দেয় ক্ষুধা
বিস্ময়, বিভেদরেখা থেকে দূর কাঁটাতারে হাত রেখে
প্রথাসম্মত এই সীমান্ত বিনিময়

‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’

এত নির্বাক শোক, মৃত্যু হাহাকার  যেন
হত্যার পরিধি মেপে মাইল মাইল ব্যাসার্ধ
গোলাপ বাগান, পরিশ্রুত অশ্রুজলে সুগন্ধি সতেজ
নিখিলের কথা বলে জন্ম আত্মার সন্ধিক্ষণ

‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’

এত দূরে তুমি নক্ষত্র শিবিরে নিরাকার    যেন
এক মহা ‘ওম’ গতিশূন্য নিশ্চল গোলক
ক্রমশ গ্রাস করে নেয় স্পর্শদয়াক্ষমাক্ষণক্রোধআনন্দঅভিশাপ
উড়ে যায় ধাবমান মনুষ্যচরিত

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সাইবার ক্রাইম
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

গুগলবিশ্ব থেকে ভেসে আসে সংকেত, বিপরীত কথা বিনিময়
বৈভব বিনিয়োগ, মেধার পচনক্রিয়া, মননের গূঢ় অপচয়
হাওয়া মিঠাইয়ের স্বাদে ভরে ওঠে আলজিভ অনন্ত যুবক ‘চিনিকম’
গুগলবিশ্ব থেকে স্নানছবি নির্জন ভাঁজ খুলে শরীর গোপন
গলে যায় মোমডানা অথচ উড়াল চাই বিন্দাস নওলকিশোর
নক্ষত্রে রেখে চোখে উন্মাদ আইকেরাস মেপে নেয় সূর্যপ্রহর
পাচার প্রণালীময় নকশার কারুকাজ, জটিল রাশিবিজ্ঞান
অপাপ কিশোরী জানে কীভাবে ঋতুভুল, কার হাতে জাদু-সমাধান
আকাশে ভাসমান ক্লোনিং জারজপ্রাণ, অকাতর হিমায়িত ভ্রূণ
গুগলবিশ্ব থেকে মাউস নির্দেশে জরায়ু জন্ম-নির্বাচন
পর্নো পরাগরেণু বিন্দু বিন্দু ওড়ে অন্তর্জাল যৌন ইশারায়
সাইবার স্পেস থেকে গুগলবান্ধব ডাকে, যৌথ সখ্যসমবায়
গুগলের হেরাফেরি রেশমগুটির চাষ, লালায় আত্মঘাতী মথ
গ্রন্থবিহীন সুতো বুনে চলে অবিরত তাঁতঘরে হন্তারক হাত
গুগলের নেশারসে শিরাময় ভাইরাস, দ্রব হয় ভাষাহীন থিম
স্ফুলিঙ্গ অঙ্গার ছাই,  দহনের রসায়নে ব্লগে ব্লগে সাইবার ক্রাইম |

.                    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
উরন্ত ঈগল
কবি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

উড়ে চলেছে  নদী আকাশে আর শহর উড়ছে গ্রামের ভিতর দিয়ে ঢেকে দিয়ে ঘাসপাতা
নরমফুলের চাষ সাপঘুম জলাবাস তুলো কাপাশ শিমূল, উড়ছে ধূলোমুখ মুখোশ মানুষ
বেড়ালের থাবা নখ, রাক্ষস জিনের মানুষ কালোচুল পাকা মাথা, না-মানুষ সব উড়ে চলেছে
এক মহাজাগতিক ঘূর্ণিতে

ঘূর্ণিতে উড়ছে মধ্যরাত, আত্মত্যাগের অবসাদ পূর্ণজন্ম জন্মান্তর যোনিভ্রমনের রসায়ন,
বাহান্ন তাসের খেলা যে জীবন যাপন উড়ে যায় ঋতুবদলের হাওয়ায়, মনোবিকারের
সকালে ঝিম্ দুপুরে শোনে শবযাত্রার সেই ধ্বনি, বীজনাম হয়ে অক্ষর  জপের মালায় শান্ত
সন্ধ্যায়, মন্ত্রের মতো আঙুলে আঙুলে হাজার হাজার মোমবাতি জ্বলে দেয় এক মৌন
পাহাড়ে, অলৌকিক সে পাহাড় ডানা মেলে উড়ে যায় রূপ মহলের অন্ধকারে, স্বপ্নের
স্নায়ুঘরে জ্যোত্স্না গড়ায় উন্মাদ, নিশিরাতে ঘুমপরিকে ডাকে রাত্রিপ্রেমিক  সেই কবি


চন্দ্রাহত রাতে খুলে যায় কপাটভূমি মেঘ-মাইহারে, গানের ভিতর দিয়ে উড়ে যায় একাকী
ভ্রমণ অবাক বিস্মরণ, জেগে ওঠে কবিতার মুখ বৃষ্টি চুমুক জলে ভিজে ওঠা মেঘদর্পণ,
নৌকা কাগজ জলে মেঘডুব চান, মেঘের ভিতর দিয়ে উড়ে যায় চাঁদ, উন্মাদ কক্ষ খুলে
নেমে আসে পরমা বিষাদ অপেক্ষার নারী, স্মৃতিজর্জর সাতাশ উনিশ-কুড়ি বারো সাত
পাঁচ, স্বপ্নের ঘিলু চাটে চাঁদ নেমে এলে বিষ,  মাথারা ভিতর বিষাপোকা বিষহরি মন্ত্র জপে,
মৃত্যুর নীল আলো জ্বেলে লিখে চলে কবিতার ভাষা স্তব্ধতা


এমন এক ছবি-দৃশ্য-আলেখ্য-র মাঝে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন ঘুমের আলোছায়ায় লিখে যায় এক না
বলা কথার যাপন অথবা মৃত্যুর সাথে চেনাশোনা, স্বপ্নের খাতা ভরে হ্যালুসিনেশন, কানায়
কানায় সঙ্গীত মূর্ছনা আনন্দ বেদনাবিস্ময়, স্নায়ু-শিহরনে এক শবানুগমন ছবি ধরে রাখে
স্মৃতি, এক অপার শূন্যতায় গণিত নির্ভুল পিরামিড, মৃতের ভুবন, মমির মতো মৃত মুখ
ছুঁয়ে উড়ে যায় শোকের দীর্ঘ খোলা চুল, উড়তেই থাকে হাওয়ার ভেতরে উড়ো পাতা
দীর্ঘশ্বাস, কবর ছায়ায় বসে লিখে যায় নেশারাত শ্মশান মুগ্ধতা


তীব্র নেশালোকে উড়ে চলে অক্ষর কাগজ ধ্বনি শিস্ মনোলগ, সাইকিক কুয়াশায় উড়ন্ত
গোলক, উড়ে যায় প্রেম ঈর্ষা ঘুম, প্রেমিকার মুখ পুতুল মানুষ ছাউনি ঘর, শূন্যের ভেতর
উল্কা নক্ষত্র ছায়াপথ, আর এক একটি ভুল ঠিকানায় নেমে এলে হাজার হাজার বছর হয়
বরফের দেশে নির্বাসন----

.                                    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর