কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা |
বর্ষার বর্ণনাছলে দম্পতির রসালাপ কবি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত “বঙ্কিম রচনাবলী” ২য় খন্ড, ( ১৯৫৫ ) থেকে নেওয়া | ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৫৩ সালে “সংবাদ প্রভাকরে” প্রকাশিত | কামিনী ত্রিপদী দেখি কি হে ভয়ঙ্কর, গরজিয়ে গর গর, ব্যাপিল গগনে নবঘনে | নবনীল নিরুপম, অর্দ্ধ তমস্বিনী সম, দুলিছে দামিনী ক্ষণে ক্ষণে || ঘন ঘোর গরজনে, বিদারে গগনে বনে, তীক্ষ্ম তীর সম বরিষয় | বল বল প্রাণনাথ, কেন কেন অকস্মাৎ, গরজন বরিষণ হয় || পতি প্রাণেশ্বরি শুন শুন, যে কারণে পুন পুন, গরজন বরিষণ হয় | অতিশয় দম্ভভরে, বর্ষা আগমন করে, সঙ্গে সব সহচর হয় || ভেবেছিল যুবরাজ, নাহি ভুবনের মাঝ, রূপবান তাহার সমান | সে গর্ব্ব হইল নাশ, হারিল তোমার পাশ, বরষার পূর্ণ অপমান || নিবিড় চাঁচর তব, তাহে কাদম্বিনী নব, রূপেতে কিরূপে তোমা সমা | তব মৃদু হাসি স্থানে, পদে পদে অপমানে, দুখিনী দামিনী নিরুপমা || মরি কি সুন্দর পশি, মুদিতা সুন্দরাবাসি, কোমল কমল কলি জলে | তাহে পরাজিত করে, তোমার হৃদয়োপরে, নব কুচ কলিকা যুগলে || বর্ষার পল্লব নব, তাহাতে অধর তব, শতগুণে সুকোমল শোভা | নদ নদী জলে টলে, তাহাতে যৌবন জলে, তব দেহ কিবা মনোলোভা || আরো দেখ করিবরে, বরষায় মত্ত করে, দ্বিগুণ উন্মত্ত তুমি কর | হেরিয়া তোমার করে, হেরি তব পয়োধরে চিত্কার করিছে কুঞ্জর || যে দাড়িম্ব বরষার, সকল গর্ব্বের সার, তব কুচে পূর্ণ মান নাশ | মেঘে রবি ঢাকা ঢাকি, কেশেতে সিন্দূর মাখি, তাহা হতে লাবণ্য প্রকাশ || পদে পদে এইরূপে হারিয়া তোমার রূপে, কত অপমান বরষার | এত দুখ সহিবারে, বরষা নাহিক পারে, রোদন করিছে অনিবার || সে রোদনে অনিবার, পড়ে বৃষ্টিধার তার, ঘননাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে | তাই প্রাণ নিরন্তর, বরষিছে জলধর, তাই মেঘ গর্জ্জে অনিবারে || কামিনী বিঘোর নীরদোপরে, কত হাব ভাব ভরে, চপলা চঞ্চলা চমকায় | কেন কেন ক্ষণপ্রভা, ক্ষণেক প্রকাশি প্রভা, ক্ষণ পরে বারিদে লুকায় || পতি গিরির শিখর পরে, থাকে যত জলধরে, দেখিল তোমার কুচগিরি | পরিহরি সে ভূধরে, রৈতে পয়োধর পরে, আসিতে লাগিল ধিরি ধিরি || এসে দেখে হায় হায়, নীলবস্ত্র মেঘে তায়, বসিয়াছে মনের পুলকে | ক্রুদ্ধে মেঘ নাহি রক্ষে, অগ্নিশিখে উঠে চক্ষে, তাই সখি বিদ্যুৎ চমকে || জলধর ক্রোধমনে, আদেশিল সমীরণে, উড়াইতে বুকের বসন | তাই বায়ু আসে ডেকে, যাবে বুক খুলে রেখে, ধরিয়ে রাখিবে কতক্ষণ || কামিনী আগে ছিল সুধাকর, বিমল কোমল কর, নিরমল গগন মন্ডল | এমন কেন গো শশী, গগন মন্ডলে পশি, ঢাকিয়াছে জলদ সকলে || পতি তোমার সমান হতে, শশধর বিধিমতে, বাঞ্ছা করে আকাশে থাকিয়া | দেখে তুমি কর মান, জেনে সে মানের মান, মুখমেঘ বসনে ঢাকিয়া || বৃষ্টিধারে ধীরে ধীরে, ফেলিয়া অশ্রুর নীরে, ম্লানমুখে করিয়াছে মান | হলো কিনা তোমা মত, দেখিবারে অবিরত, ক্ষণে ক্ষণে হয় দৃশ্যমান || কামিনী খর কর ধরি রবি, মেঘে ঢাকা দেখে ছবি, নহে প্রকাশিত প্রভাকর | না হেরি পতির মুখে, নয়ন মুদিয়া দুখে, কমলিনী কতই কাতর || সাধে কি সকলে কয়, পুরুষ পরস ময়, কি কঠিন তাদের হৃদয় | এই দেখ দিনকর, কেমন নিদয়ান্তর, রমণীরে কেমন নির্দ্দয় || কমলিনী যায় তরে, সতত বিলাপ করে, মৌনমুখী মুদিত নয়ন | দয়া করি সেও তায়, ফিরিয়া নাহিক চায়, সদা করে প্রাণে জ্বালাতন || পতি গুণমণি দিনমণি, কেন লো রমণি মণি, না বুঝিয়ে দোষ দিবাকরে | নলিনীর পেয়ে দোষ, দিনেশ করেছে রোষ, তার সনে দেখা নাহি করে || তব মুখে কমলিনী, কোলে ধরে বিনোদিনী, সিন্দূরের বিন্দু প্রভাকর | কোলে অন্য দিবাকর, কমলিনী কলেবর, দেখিয়ে ম্লান দিনেশ ঈশ্বর || মনে জানিলেন দড়, নলিনী অসতী বড়, নাহি করে মুখ দরশন | গুণমণি, দিনমণি, কেন লো রমণি মণি, না জানিয়া দোষ লো তপন || কামিনী এ সময় মধুকরে, কি জ্বালায় জ্বলে মরে, মুদিত সকল শতদল | যদি কোন পদ্ম পায়, অপ্রফুল্ল দেখে তায়, মধুহীন যতন বিফল || ভ্রমে ভ্রমি সে ভ্রমরে, যদ্যপি গমন করে, অন্য কমলিনী নিকেতন | মৃণাল কন্টকে লেগে, ছিন্ন অঙ্গ হয়ে রেগে, অন্য পদ্মে করিলো গমন || অপ্রকাশ্য সেই কলি, বাতাস লাগিল বলি, হেলে দুলে ফেরে তাহা হতে | নিরুপায় নিরাশায়, শেষে মধুকর যায়, কলিকা উপরে স্থান লতে || পতি আ মরি লো এ অধীনে, সেই মত এক দিনে, ঘটাইলে প্রাণের রতন | তুমি লো কমলবন, ছয় পদ্ম সুশোভন, কর পদ হৃদয় বদন || যবে প্রিয়ে মান করি, মজাইলে প্রাণেশ্বরি, লক্ষ্য করি মুখ শতদল | গিয়ে তার মুখপানে, তৃপ্ত করিবারে প্রাণে, অপ্রফুল্ল দেখি সে কমল || তাহাতে বঞ্চিলে ছলে, যাই কর শতদলে, হাতে ধরে ঘুচাইতে মান | গহনা মৃণালে কাঁটা, অঙ্গুলি যাইল কাটা, পরে পাদ পদ পড়ি প্রাণ || হেলে দুলে সে কমলে, লুটাইয়া শতদলে, ফিরাইলে প্রাণের ললনা | শেষে যাই কলিপুরে, শোভিছে যা হৃদিপুরে, দূরে গেলে মানের ছলনা || কামিনী বল বল তারাচয় কেন কেন ম্লান হয়, ছিল কিবা শোভাকর কর | পতি যামিনী কামিনী সতী, লইয়ে যামিনী পতি, বিলাসিছে মেঘের ভিতর || পাছে বা দেখিতে পাই, নিভাইয়ে দেছে তাই, আকাশের দীপ তারাগণে | তবুও তো নিরন্তর, স্থির নহে শশধর, উঁকি মেরে দেখে ক্ষণে ক্ষণে || কামিনী পেয়ে নীরধর নীর, পূর্ণাকার ধরে নীর, আহা মরি শোভা তার কত | জলপূর্ণ সরোবর, যদ্যপি হে মোহকর, কমলিনী বিনে শোভা হত || পতি না লো প্রাণ মনোহর, দেখিতেছি সরোবর, সরোজিনী সহ শোভা পায় | ধরণী সলিলাবৃতা, যেন সরো সুশোভিতা, তুমি প্রাণ কমলিনী তায় || কামিনী এর বা কারণ কিবা, এই বরষার দিবা, দীর্ঘ দেহ করেছে ধারণ | কমে গেছে তমস্বিনী, তবু তাহে বিষাদিনী, বিরহিণী বিনোদিনী গণ || পতি সুমেরু শিখর আর, ও কুচ ভূধরাকার, এ তিন শিখর নিরখিয়া | হইল তপন ব্যস্ত, কোন্ টায় যাবে অস্ত, তাই ভাবে বিলম্ব করিয়া || ঘন ঘোর ঘন অতি, ঢেকেছে যামিনী পতি, বিরহিনী বিষাদে রজনী | কেঁদে কেঁদে বুক ফাঁটি, দুখে দেহ করে মাটি, যৌবনেই মরে গেল ধনী || . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |