কবি সৈয়দ মর্তুজা - আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরের বালিয়াঘাটায় সৈয়দ
মর্ত্তুজার জন্ম হয়। উত্তর প্রদেশের বেরেলী জেলায় তাঁহার পূর্ব্বপুরুষের বসবাস ছিল। জন শ্রুতি এই যে ৮০
বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। জঙ্গীপুরের কাছে চড়কায় তিনি রাজাক সাহেবের শিষ্য হয়েছিলেন
এবং সুতীর নিকট ছাপঘাঠিতে নিজের একটি আস্তানা করেন।
সেখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে। আজও তাঁর মাজারকে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে তা প্রকৃত অর্থেই হিন্দু-
মুসলমানের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে। শতকের মুর্শিদাবাদের এই সাধক কবি, বৈষ্ণব পদ-সাহিত্যের এক
দিক্পাল বিশেষ। তিনি অধ্যাত্মতত্ত্ব বিষয়ক যোগ কালন্দর ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ লেখেন।
অন্যদিকে একই নামের কবির বৈষ্ণব পদাবলী পাওয়া গিয়েছে চট্টগ্রামে, যার একটিও মুর্শিদাবাদে বা তার
আশেপাশে পাওয়া যায় নি। তাই প্রশ্ন ওঠে সৈয়দ মর্তুজা কি একজন না দুইজন।
এই পাতায় থাকছে সৈয়দ মর্তুজার মুর্শিদাবাদে প্রাপ্ত পদাবলী।
সৈয়দ মর্তুজা এক না একাধিক ব্যক্তি - পাতার উপরে . . .
সৈয়দ মর্তুজা নামে একাধিক ব্যক্তি ছিলেন কি না তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ করেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে
পাওয়া পুথিতে “সৈয়দ মর্ত্তুজা” ও “মর্ত্তুজা গাজি” ভণিতার পদ পাওয়া গেছে এবং কবি নিজেকে জনমের
ফকির বলেও নিজেকে অভিহিত করেছেনে। মিলনসাগরে তাই সৈয়দ মর্তুজার জন্য দুটি পাতা তৈরী করা
হয়েছে। একটি সৈয়দ মর্তুজার মুর্শিদাবাদে প্রাপ্ত পদাবলীর এবং অন্যটি সৈয়দ মর্তুজার চট্টগ্রামের পদাবলীর।
অন্যথার প্রামাণিক তথ্য না পাওয়া অবধি এভাবেই রাখা সমীচীন হবে বলে মনে হয়।
আবদুল করিম সাহিত্য-বিশারদের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচিত, কলকাতার এন্টালি থেকে প্রকাশিত “গৃহস্থ” পত্রিকার ভাদ্র ১৩২০
সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর ১৯১৩) “বৈষ্ণব সাহিত্যে সৈয়দ মর্তুজা” প্রবন্ধে, কবি সৈয়দ মর্তুজার পরিচয় সম্বন্ধে তাঁর
লেখা থেকে কিছু অংশের উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হলো . . .
“সুবিখ্যাত পদকল্পতরু-গ্রন্থে সৈয়দ মর্ত্তুজার কতিপয় গান দৃষ্ট হয়। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে মুর্শিদাবাদের
জঙ্গীপুর সন্নিহিত বালিয়াঘাটায় সৈয়দ মর্ত্তুজার জন্ম হয়। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে বেরেলী জেলায় (তাঁহার)
পূর্ব্বপুরুষের বাস ছিল। জন শ্রুতি যে ৮০ বত্সর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হয়। জঙ্গীপুরের নিকট চড়কা নামক
স্থানে রাজাক সাহেবের শিষ্য হইয়া অত্রত্য সুতীর নিকট ছাপঘাঠিতে (তিনি) এক আস্তানা করেন। অদ্যপি
তথায় তাঁহার সমাধি আছে। . . .
. . . তিনি (বৈষ্ণবদাস) যে মর্ত্তুজার পদ উদ্ধৃত করিয়াছেন, তিনি এই জঙ্গীপুরজাত বলিয়াই বিশ্বাস হয় কারণ
উভয়ের বাস এক জেলায় (আসলে বৈষ্ণবদাসের বাড়ী ছিল বর্ধমান জেলার টেয়া-বৈদ্যপুরে। তবে দুজনের
বাসস্থানের দূরত্ব খুব বেশী না)। শ্রীহট্টের মর্ত্তুজা যে ইনি নহেন, তাহাও বলা যায় না। ফকির লোকের
নানাদেশে বিশেষতঃ মুসলমান-প্রধান শ্রীহট্টে গমন অসম্ভব নহে। হয় ত শ্রীহট্টে রচিত পদাবলী বৈষ্ণবদাসের
অগোচর ছিল। . . .
. . . রমণী বাবু (রমণীমোহন মল্লিক) সৈয়দ মর্ত্তুজার রচিত ৪টি মাত্র পদ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন। সে
কথা আগেই বলিয়াছি। মৎ-কর্ত্তৃক সৈয়দ মর্ত্তুজার ১৯টি পদ সংগৃহীত হইয়াছে। রমণীবাবুর প্রকাশিত
পদগুলি পদ-কল্প-তরু প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে পরিগৃহীত হইয়াছে। এই সকল পদের মধ্যে একটিও আমি চট্টগ্রামে
পাই নাই। কিন্তু আমার সংগৃহীত পদগুলি সমস্তই চট্টগ্রাম জেলাতে পাওয়া গিয়াছে।
বলিয়া রাখা আবশ্যক, রমণী বাবুর প্রকাশিত পদগুলির মধ্যে যেমন একটিও চট্টগ্রামে পাওয়া যায় নাই,
আমার আবিষ্কৃত পদগুলির মধ্যেও তেমন একটিও চট্টগ্রাম ভিন্ন অন্য কোথাও পাওয়া গিয়াছে বলিয়া
অদ্যাপি শ্রুতিগোচর হয় নাই। সুতরাং প্রমাণান্তর অভাবে ইহা যে রমণী বাবুর ও আমার আবিষ্কৃত সৈয়দ
মর্ত্তুজার অভিন্নতা-কল্পনার সম্পৃর্ণ বিরোধী, তাহা সহজেই অনুমেয়।”
আবদুল কাদিরের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত, আবদুল কাদির ও রেজাউল করীম সম্পাদিত, “কাব্য মালঞ্চ” (১৯৪৫) গ্রন্থে আবদুল
কাদির তাঁর “বাঙলা কাব্যের ইতিহাস” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের ধারণা ছিল যে কবি সৈয়দ মর্তুজা খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে
মুর্শিদাবাদ শহরের সন্নিনিকটস্থ জঙ্গীপুর বালিঘাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা সৈয়দ হোসেন কাদেরী-ও
একজন সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। মর্তুজার বুজুর্গী সম্বন্ধে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। আনন্দময়ী নাম্নী এক ব্রাহ্মণ-
কন্যা ভৈরবী-রূপে তাঁহার সহিত অবস্থিতি করিতেন। ছাপাঘাটিতে তাঁহার আস্তানা ছিল ; অদ্যবধি তথায়
তাঁহার দরগাহে প্রতি রজব মাসে মেলা বসিয়া থাকে।মর্তুজার অনেক পদ পদকল্পতরু প্রভৃতি বৈষ্ণব পদ-
সংগ্রহে পাওয়া যায়। তাঁহার রচনায় তান্ত্রিক-যোগ ও সূফী-সাধনার এ আশ্চর্য্য সমন্বয় রহিয়াছে। তাঁহার
"শ্যাম-বন্ধু চিত নিবারণ তুমি" পদটি চণ্ডীদসকে স্মরণ করাইয়া দেয়।”
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যর উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত, গৌহাটী কটন কলেজের বাঙ্গালা ভাষার প্রধান অধ্যাপক, যতীন্দ্রমোহন
ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত “বাঙ্গালার বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” সংকলনের কবি-পরিচয় তে লিখেছেন . . .
“বৈষ্ণবদাস সংকলিত “পদকল্পতরু” গ্রন্থে মর্ত্তুজা ভণিতাযুক্ত একটি পদ আছে। ঐ ব্যাতীত আরও ২২টি
পদসহ “মুসলমান বৈষ্ণব কবি” (ব্রজসুন্দর সান্যাল সম্পাদিত) প্রথমখণ্ড মুদ্রিত হয় (দুঃখের বিষয়, এই বইটি
আমরা যোগাড় করে উঠতে পারি নি)। পদকল্পতরুর পদটি ব্যতীত অপর সকল পদ চট্টগ্রামে প্রাপ্ত প্রাচীন
হস্তলিখিত রাগ ও তালবিষয়ক কয়েকখানি গ্রন্থহইতে সংগৃহীত হইয়াছে। পদকল্পতরুতে উদ্ধৃত পদের সৈয়দ
মর্ত্তুজা এবং চট্টগ্রামে প্রাপ্ত পদসমূহের সৈয়দ মর্তুজা এক ব্যক্তি কি না, এই সম্বন্ধে সন্দেহ হয়। পদকল্পতরু-
সঙ্কলয়িতা মুসলমান কবিদের যে-সকল পদ তাঁহার সংগ্রহে স্থান দিয়াছেন তাহা বহু প্রচলিত বলিয়াই ধরিয়া
লইতে পারি। সৈয়দ মর্ত্তুজার যে পদটি পদকল্পতরুতে আছে তাহা চট্টগ্রামে পাওয়া যায় নাই। পদকল্পতরুর
কবিতাটি চট্টগ্রামের কবির রচনা হইলে ইহা চট্টগ্রামে না পাওয়া আশ্চর্য্যের বিষয়, সন্দেহ নাই।”
সৈয়দ মর্তুজা ও মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি - পাতার উপরে . . .
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, রাজনৈতিক নেতাদের শত উস্কানী, ভোটের স্বার্থে ঘুষের রাজনীতি, শত দাঙ্গা-
হানাহানি সত্তেও এই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবির স্মৃতি বিজড়িত কৃতকর্মের ফল, বাঙালীর সেই ঘায়ে
যেন মায়ের শীতল-কোমল পরশের প্রলেপ লাগিয়ে যায়।
প্রায় সত্তর বছর পরে, মনিরুদ্দিন খান তাঁর ২০১৪ সালে প্রকাশিত “মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
রূপরেখা” গ্রন্থে সৈয়দ মর্তুজা সম্বন্ধে উল্লেখ করে লিখেছেন . . .
“মুর্শিদাবাদে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির দ্বিতীয় ধাপে আছে মর্তুজা হিন্দ বা সৈয়দ মর্তুজার মতো উদার ব্যক্তিত্ব
। মুসলমান সন্তান হয়েও সৈয়দ মর্তুজা বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাধা-কৃষ্ণ লীলা-বিষয়ক বহু
পদ রচনা করেন। এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে তিনি তাঁর সাধনসঙ্গিনী নির্বাচন করেছিলেন। তাঁর পদগুলির
সাহিত্যমূল্য যাই হোক না কেন, মুর্শিদাবাদের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ক্ষেত্রে সেগুলির মূল্য অপরিসীম।
ধর্মীয় শাসনের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুই সম্প্রদায়ের মিলনের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে সেগুলি ইতিহাসের পাতাকে
আলোকিত করেছে। মর্তুজা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকেই তাঁর শিষ্যত্বে গ্রহণ করেছিলেন।
আজও তাঁর মাজারকে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে তা প্রকৃত অর্থেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।”
মনিরুদ্দিন খানের লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন।