*
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কবিতা
এক টুকরো জমি দাও
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

এক টুকরো জমি দাও
কবির উজ্জীবনে।
হাতে-খাটা খেতে
প্রত্যেক গাছের বীজে শস্যের কণায়
কবিতার নিটোল দেহে
ঘর্মের বিপুল সুষমা
দেখি আর বুনে যাই শেষ কটা দিন।

শুধু এক মুঠো মন মাটির আসরে,
দূরে দূর পাহাড়ের যতি,
সহজ পাহাড়ি লোক,
প্রতিধ্বনি সুরের পাথরে
মেষপালকের বাঁশি-গান
এনে দেবে অনবদ্য ছন্দ্র আকৃতি।

শুধু একটুকরো জমি
পাহাড়ের ধারে,
তন্বী নদী ঘিরে ধরে পাহাড়ের কটি।
এখানেই ভাস্কর্য আনি
খেটে গড়া ফসলের উজ্জিবন
আনি বারে বারে
যেখানে মৃত্যুই বীজ
জীনের ক্ষেতের কিনারে।

যে কোন কথা যে কোন কীর্তি
একটা কোন প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলে
এক পা এগিয়ে যাই বিপ্লবের দিকে
মানুষকে কেন্দ্র করেই বিপ্লব, দলকে নয় -
বিজ্ঞান যন্ত্র বিদ্যুত্ অনুভূতির কেন্দ্রে
পৌঁছে যাওয়া চাই।

সেখানে দেখবে সুবিন্যস্ত সাজানো রয়েছে
মানবিক প্রয়াসের বিভিন্ন কারুশিল্প।
সংঘর্ষের সংবাদে সাহ্ত্য রচিত -
শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্নসফল -
নির্লোভ সত্যভাষণে
লাভক্ষতির উর্ধ্বে পেশল কর্মসাধনে
অনলস আত্মসমীক্ষায়।
যেখানে প্রতিরোধ, সেখানে ক্ষমা নেই।
যেখানে প্রতিবাদ, সেখানে আপস নেই।

.             ****************               
.                                                                                             
সূচীতে    




মিলনসাগর
কয়েকটি বিকৃত প্রশ্ন
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

কয়েকটি বিকৃত প্রশ্নে প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত।
নিঃস্বপ্ন নায়ক নিয়ে ইতিহাস জরিষ্ণু হয়েছে
নিঃসঙ্গ পাথর করোটি আর নগ্ন শবদেহ নিয়ে
সমাজশরীর,
একই শয্যাশায়ী সব ভাবনার নথরে আহত।
বিভিন্ন জটিল মন। শহর। মানুষ। পথ
গ্রামে বা শহরে।
এরই মধ্যে এক দেশ অন্য দেশে লীন। হতাহত।
এই সব কুরুক্ষেত্রে,
আমাকে স্বদেশ দেয় আবরণ, বিবর্ণ দর্জির,
লজ্জিত মমতায় -,
মহার্ঘ রুটির আর মাখনের দিগ্বিজয়ে আয়ুর শুশ্রুষা
তবু খেটে চলা, আর সংঘর্ষের অপঘাত, বিতণ্ডা আঘাত,
বিতর্কিত লম্পটের লুব্ ধ অন্ধকারে।
ভগ্নিহীন মাতৃহীন ভাতৃহীন পিশাচনগরে
অসংখ্য মৈথুনের কারুকার্যে অবিন্যস্ত সংকেত গুহায়
বিপর্যস্ত বসন্তের অশ্লীল প্রলাপ
পানের দোকানে পথে বিবস্ত্র নাটকে।
পথে আজ, অনিবার্যভাবে কাল হয়
বঞ্চনার স্তোত্র গেয়ে-গেয়ে।

ভাদ্রের কুকুর খোঁজে নরের যৌবন নিয়ে,
নারী কুক্কুরীকে।
এ সব চালচিত্রে কোথা সেই সব প্রতিশ্রুত বিবেকেরা ?
যারা বার বার চেয়েছিল সম্মিলিত বিস্ফোরণে,
পরিষ্কৃত পৃথিবীর পথ, -
যারা, চর্মের নির্মোকে ঢাকা কঙ্কালকে চেয়েছিল দিতে
প্রাণের আকাশ আর সততার আবিশ্ব বৈভব ?

.             ****************               
.                                                                                             
সূচীতে    




মিলনসাগর
ডাক্ সাজ প্রতিমায় রং দেয় অভিরাম পাল
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

বাড়ী ভাড়া বাকি কয় মাস, তবু
রুগ্ন ক্লান্ত দেহটুকু ঘিরে
অত্যাশ্চর্য আবরণ নিয়ে, ঘোরে
তালি দেওয়া অস্তিত্বের সামগ্রী সংগ্রহে--
অভিরাম পাল |
লগ্ন-জ্বরী কন্যা তার |
স্ত্রীও ধোঁকে শ্বাস রোগে |
রেশন আনার কড়ি বারন্ত, সংসারে |
বাঁচবার অধিকার ধার করে
কয়েক দিন চলে |
তারপর অনিবার্য শেষ হয়ে যাওয়া |
এই তো সেদিন,
ছোট ভাই মারা গেল গুলি খেয়ে
রাস্তার মোড়ে |
ওদিকে, অনেক রাত্রে ফেরে,
একদা সুন্দরী তার বোন--
তনিমাকে চেনে সব পাড়ার ম'স্তান্ |
অত্যন্ত পঙ্কিল ঘৃণ্য জীবনের ফেন পুঞ্জ
প্ণ্য-দেহ ঘিরে,
অবিরাম ঘূর্ণাবর্ত রচে |
ইতি মধ্যে আকাশ কি ফরশা হয়ে ওঠে !
নীল নীল আকাশের গায়ে লাগে
কাশ-ফুল মেঘ !
ছোট ছোট সারি সারি আশ্বিনের বাত্সরিক সমারোহ
ভেসে ওঠে চোখে |
ঢাকীরা বায়না নেয় |
স্কুলের উদ্গ্রীব ছেলে-মেয়েদের শির দাঁড়া বেয়ে
ছুটি শির্ শিরিয়ে ওঠে |,
খেলা-খেলা অন্ধকারে-আলো,
ভাঙ্গা দালানের কোনে,
উঠোনের ঘাস-ওঠা বুকে |
স্টেশন, ট্রেনের বাঁশী, পোড়া কয়লার ধোঁয়া-গন্ধ, আর
হঠাত্ দূরের দেশ পাহাড়ের বাঁক ঘুরে পদ্ম-বিল |
এই সব চালচিত্র নিয়ে,
গহনার নৌকা করে প্রতিমারা পিতৃগৃহে আসে |
দ্রুত টোকা পড়ে যায় ভাঙা দরজায়--
সামন্ত বাড়ীর ঢ্যাঙা পেয়াদাটা
বায়না নিয়ে আনে, -- মোটাথাম্ পূজার দালান |
ভুলে গেল,
আজ কাল পরশুর কথা ভুলে গেল |
অনশন অর্ধাশন বিরোধ বিদ্রোহ আর মিছিলের সং |
সব ভুলে গিয়ে,
আশ্বিনের সোনার সকাল |
ডাক সাজ প্রতিমায় রং দেয় অভিরাম পাল ||

.             ****************               
.                                                                                  
সূচীতে    




মিলনসাগর
অজন্তা
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

যেখানে প্রাণের মৃগ অরণ্য মাতায়
উজ্জীবন সম্মিলিত শিকড়ের গভীর গহনে--
আনন্দের কলনাদ বসন্তের অজস্র পাতায়
সেখানে সাক্ষর পাই অস্তিত্বের বিচিত্র বিলাসে,
সুরে--বর্ণে রেখা-রংএ অপূর্ব্ব লীলা সে !

আমাদের প্রাচীর প্রান্তে বন্দীর বন্ধন নেই |
আছে শুধু মনের আকুতি--
সহস্র জাতের কথা, গেয়ে যায় সম্মেলক গান--
সহস্র মনের সূর্য, প্রান্তরের শস্যের সোনায়--
ভরে যায় মাধুর্য-ভাণ্ডার |

আমাদেরই কথা লেখে ইতিহাস,
      অজন্তা-পাতায়
আমাদেরই ফাল্গুনী বসন্তের
      অরণ্য মাতায় ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    




মিলনসাগর
রাখুরাম এক তথাকথিত মানুষ
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির
উলটো দিকের জীব |
অবহেলা আর প্রবঞ্চনায় পুষ্ট
নিষ্প্রভ শরীরটাকে নিয়ে এগিয়ে চলে
শামুকের মতো |
খাবার চায় |
সমস্ত দেশ একটা অসমাপ্ত হত্যাকান্ডের
গল্পের শেষ পাতা |
বৈদগ্ধ্য কাব্য সূক্ষ্ম শিল্পসত্তা গ্রন্থিল
সেমিনারিস্ট বৃহৎ কর্মকান্ড পিচ্ছিল
বিপ্লবী পথ বিস্ফোরণ হরতাল বন্ ধ
আর কালোবাজার
এই সবের অজস্র ফাঁক দিয়ে গলিয়ে
জীবন পালিয়ে যাচ্ছে রাখুরামকে নিয়ে  |
কারণ জীবন তো একটা শাশ্বত অমোঘ তথ্য |
যে-পথেই যাও---
মিলবে এসে এই মেলায় |
আত্মা নিয়ে জ্বলে উঠেছে বারুদের মতো  |
সেই পথ দিয়ে নতুন জীবন নিয়ে |
খেলা করছে ছেলেমেয়ের দল,
পথে ঝড়ে ভেঙে-পড়া গাছগুলো তাদের
পা আটকে ধরে |
তবু কিছু ছেঁড়া ফুল, কিছু ছেঁড়া সূর্যের আলো নিয়ে
তারা আসে দেশান্তরী পাখিদের মতো |
তারপর বড়-বড় লিমুসনের রাস্তা-----
লরি বাস স্টেশন ওয়াগানের রাস্তা |
এর দু-ধারে ভূরিভোজের ভুক্তাবশেষের নিচে
দুর্ভিক্ষের বীজে মৃত্যুর শস্য লকলকিয়ে ওঠে |
সে পথ দৃপ্ত পায়ে মাড়িয়ে
চলে আসে লক্ষ মিছিল |
এই পথ দিয়ে মিলতে হবে মেলায় |

অন্য পাড়ায় শহরের পোশাকি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র |
উদ্দাম ফোয়ারা আর ফুলঝুরিগুলির ভন্ড
আলোটাকে এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে চলে এসো----
স্তব্ধ ইতিহাস তাকিয়ে-থাকা এই ক্লিষ্ট
আর্তনাদপুষ্ট শহর  থেকে বেরিয়ে
রুক্ষ উট-চলা প্রান্তরের দিকে |
চলে এসো এই পথে----
দেখবে, তীব্র প্রতিবাদ আর শপথগুলি
ফুল হয়ে, গান হয়ে
কলকোলাহলের উচ্চ চূড়ায়
হাহাকারগুলোকে জীবনের উদ্দাম হাসিতে
পরিণত করে-----
সহস্রবাহু হয়ে ডাকছে তোমাকে এই মেলায়
যে-পথ দিয়েই যাও |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
গুহার গান
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

প্রভু!
তোমার মাথায় পড়ে স্বচ্ছ শুভ্র রাতের কণিকা |
তোমাকে রয়েছে ঘিরে আঁধারের নীরব আলোক |
আমি আছি অতল গুহায় |
বুকের উপর চেপে রয়েছে অজ্ঞতা,
গভীর সে রাত,
স্তুপীকৃত পাহাড়ের সমাধির মতো |
আমি যেন শুনতে পাই আমার এ-সমাহিতি থেকে
নরম রাতের চূর্ণ বিন্দু-বিন্দু ঝরে,
কালো আঙুরের মতো গুচ্ছ-গুচ্ছ
তোমার ও-চুলে |

প্রভু!
তোমার বিশাল হাত আমাকে ফিরেছে খুঁজে, জানি,
শিকারি হাতের ছায়া কেঁদে গেছে দেহের উপর |
আমার বুকের রক্ত হয়নিকো এখনো তো হিম |
এক বিন্দু উষ্ণতায় যদি জলে জীবন আমার,
এক বিন্দু চোখের আভায়,
এ-বন্ধন বন্ধুই আমার |

প্রভু!
তোমার মাথার 'পরে অর্ঘ্য পড়ে
অনাদি রাতের!
তারা ঘন সুরভির ঝড়
আমার অসাড় দ্বারে করে করাঘাত,
চ'লে যায় গ্রহলোক-পানে |
আমি থাকি প'ড়ে অসহায় |
পক্ষাঘাত দুর্ভেদ্য প্রহরী |
তোমার কুঠারে করো বিচূর্ণ আমায় |
দু-হাত ছড়িয়ে দাও রাতের আকাশে |
আমার এ-গুহাকাশে বজ্র হানো, প্রভু,
দগ্ধ হোক আমার এ-শব |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
রাজধানী
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

ইতিহাসই জানে, আর তুমি জানো নাজির হাসান,
দরিবা কালানে এক পুরোনো দালানে বসে---
আঁধিলাগা দিল্লীর ঘোলা-আকাশ চোখে
তুরুক্-সওয়ার ঘোড়া খুরে খুরে শব্দের স্বপ্নই দেখো |
এখন হঠাৎ টুক্ রো বর্তমান নিয়ে,
টাঙ্গাওয়ালা,স্কুটারের শব্দ ধাবমান,
মন্ সবদার কোনো বাস থেকে নামে---
ফর্ সীর নল মুখে চম্ কে ওঠো নাজির হাসান ||

অনেক দূরের পথ--- ইন্দ্রপ্রস্থ পার হয়ে,
অতিবৃদ্ধ পিতামহ রাজধানী পাশা খেলা হেরে,
যুগে যুগে পাঠান মুঘল্ রাজ্যে যুধিষ্ঠির হয়ে
মিশে গেছে ইংরাজের কালে |
এখন পান্ডব-পন্ড ইন্দ্রপ্রস্থে, পান্ডুর বাতাসে,
বিবস্ত্র বেপথু কোনো দ্রৌপদীর কান্না নিয়ে,
আধুনিক রেডিওর গান, আর রাস্তায়
বরাত্-মিছিলে, মেশে সিনেমার ধুন্ |
শ্রদ্ধা হয় তোমাকেই, তোমার এই বিচিত্র কেলাসে,
সময়ের মদ পান করে মত্ত সুচারু গেলাসে,
রাজধানী ছিলে তুমি সিপাহী বিদ্রোহেও---|
রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে ফাঁসীকাঠ, খুনী দরয়াজা
হুঁশিয়ার  চীৎকার !--- ক্ষুধিত পাষাণ !

একটি প্রবল ইচ্ছা সমবেত হয়ে,
মরে মরে ধূলি হয়ে গেছে সব দিল্লীর রাস্তায় |
তবু, কতখানি সব মনে আছে তোমার জানি না
নাজির হাসান,
সেদিনও যেমন,
এখনও অগুণ্ তি সব সবুজ টিয়ার ঝাঁক
ময়ূরের বর্ণালী বিলাস,
সন্ধ্যার আরক্ত আকাশ আর লাল কেল্লা ছুঁয়ে
যমুনার পারে উড়ে যায়, বর্ণাঢ্য পাখায়---
লাল-নীল-সবুজের শামিয়ানা
ঢেকে রাখে আকাশের চোখ |
শাহ্ জাহান আলম্ গীর বাহাদুর শাহেরাও
দেখে গেছে সব---
হাতির পায়ের তলে অপরাধী পেষা |
ঘাম আর গায়ের রক্ত জল করে করে,*
গড়ে তোলে সাধারণ লোক,
ভাস্কর কামার,
নিষ্ঠুর প্রতিমা সব
প্রাসাদ মঞ্জিলে |
এরই নর্ম বিচিত্র আড়ালে
চাঁদ্ নি চকের কোনো অন্ধকার গলির গহনে
তোমাকেও টেনেছিল, নাজির হাসান,
সুরমাটানা মৃত্যু হানা চোখ
তুর্কী সুন্দরীর |
তোমার যৌবন ছিল আঙুরের মত,
নিটোল, মদির ||

আজ সবই ইতিহাস---
অথচ তুমি  ও আমি, আমরা সবাই
এখানেই আছি, এই রাজধানীতেই
মিলে মিশে এক গালিচায় |
ওপরে,  পালাম্  থেকে জেট্ প্লেন্
পুরনো আকাশটাকে  ছিঁড়ে চলে যায় |
সন্ধ্যা নামে, শবাচারী শকুনের ভিড়ে---
আগুনের আলো জ্বলে, হল্লা শোনা যায় দূরে,
রাস্তার মোড়ে |
আমি সেই মন্ সবদার ,দিল্লীর বাস থেকে নেমে
জানাই সেলাম---|
পুরোনো কালের ঢুলু ঢুলু চোখে
চারপাইএ উবু হয়ে বসে,
ফর্ সীর নল মুখে চম্ কে ওঠো নাজির হাসান ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
মধুবংশীর গলি
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

তোমারই প্রেরণা পেয়েছি
বারে বারে আনন্দে পেয়েছি
নিরঙ্কুশ এ জীবনের কলনাদে ভরেছে অম্বর |
হে পঁচিশ নম্বর
মধুবংশীর গলি,
তোমাকেই আমি বলি |
রৌদ্রস্নাত খাটুনির পর সমস্ত দিন
মেরুদন্ডহীন
মানুষগুলিকে সন্মান করে,
ঘৃণা করে আর হিংসা করে,
নগ্ন নগন্য সন্ধ্যাকে পাই
---তোড়াবাঁধা শ্মশানে পাঠাবার ফুল---
একটা অন্যায় শৌখিনতায় মন হারায় কুল,
ঘ্রাণ নিই প্রাণ ভরে |
হলদে আকাশ থেকে কার আশীর্বাদ যেন পড়ে ঝরে |
ছারপোকার দৈনিক খাদ্য হিসাবে তাই
খাটিয়ার ওপর বসি, বিড়ি ধরাই
আর, মনে মনে প্রতিজ্ঞা রোজ করি---
দোহাই পতিতপাবন হরি,
আর নয়, আমার লম্পট প্রবৃত্তিগুলিকে,
দস্যু লোভগুলিকে,
চালান করো আন্দামানে |
তার মানে,
স্বার্থ, অর্থ,
জমিদারী অনর্থ,
টাকা, টাকা আর টাকা,
সমস্ত দিনের হীন বাণিজ্যটাই ফাঁকা |
শ্রান্ত শ্লথপদে তাই
তোমার দিকে ফিরবার প্রেরণা পাই,
হে অনবগুন্ঠিতা,
অকুন্ঠিতা,
পঁচিশ নম্বর মধুবংশীর গলি,
তোমার চুপি চুপি বলিঃ
আকর্ষণ? অনেক অনেক আছে,
তোমার শীতে ঠাসা
অমাবস্যার বাসা
ইট বের করা দেয়ালের কোণে কোণে |
তেলমাখা পাঁচ আঙুলের দাগ, বোনে
পুরনো স্বপ্নের জাল,
মলিন জীবন মহীরুহের ডাল |
তারই নিচে ---শ্রীহরি সহায়---আঁকাবাঁকা
কাঠকয়লায় আঁকা,
জগন্নাথের পট পেরেক দিয়ে আঁটা,
কোনো সিনেমা-বনিতার জঘন্য সুন্দর মুখ
আঠা দিয়ে সাঁটা
অপর দেয়ালে | এই আবহাওয়াই সার
অধমর্ণ অস্তিত্বের সাধু টঙ্কার |


কোনো কোনো ছুটির দিনে অবশ্য স্ত্রীর চিঠি পাই,
দেশান্তরের নিবিড় বাহুর আশ্লেষে সময় হারাই,
অক্ষম মিনতির সুর---পড়ি আর তুলি হাই |
তবু চিঠি পাই আততায়ী জীবনের
যখন চাল কিনি চল্লিশ টাকায়,
চায়ে চিনি খুঁজে পাওয়া দায় |
এরই অন্তরালে দ্বিপ্রহর দগ্ধ মরে শুকিয়ে
যাওয়া খড়খড়ে দিনগুলির উপর দিয়ে
দুর্মর বসন্তের দ্বিধাকম্পিত পদধ্বনি শুনি |
দশ আঙুলের নিংড়ে নেওয়া আয়ুর শেষ প্রহর গুণি |
হঠাৎ চিঠি আসে,
কোনো তন্ময় মুহূর্তে |
জানলা গলিয়ে পিয়ন দেয়, কাশে
একটু জানানি হিসাবে | হলদে খামে পোরা
শ্রান্ত বিকেলের রং! ছোরা
শানিয়ে আসে রাত্রি,
ধীরে ধীরে বড়ো রাস্তার চৌমাথা পেরিয়ে,
হিংস্র আগ্নেয় কামনা নিয়ে---
মত্ত আততায়ী আসে ---রাত্রি
অনন্ত পথযাত্রী,---
মিলিটারী লরীর ঘর্ঘর,
রিকশ’র নূপুর, সুদূর ট্রামের মর্মর,
ধাবমান মোটরের ক্ল্যাক্ সন্ হর্ণ, আর
মেঘে মেঘে এরোপ্লেনের শব্দের ভার
আকাশ ছেঁড়ে ; পঁচিশটা,---
হবে,---চট্টগ্রাম ফেরতা ত্রিশটা,
হবেও বা,--- কিন্তু হে অনন্তযাত্রী !
হয় নাই এখনও, হয় নাই শেষ তোর রাত্রি |
আতঙ্কের ঘোমটাপরা রাস্তার আলো |
অতিকৃত কালো কালো,
নৈশজীবনের ছায়াদের ডাকে,
ঘরে বাইরে জানালার ফাঁকে ফাঁকে |
নিরুদ্ধ তৃষ্ণার তাই খুলে যায় খিল,
চলে রণদগ্ধ জীবনের ছায়ার মিছিল,
ক্ষুদার হুঙ্কারে ডোবে উন্মার্গের গান |
বাঁকা টুপিপরা কোনো আমেরিকান
কাপ্তেনের লোলুপ শিস
তরুণী রাত্রির গালে চাবুক মারে | সামরিক আশিস
ঝরে পড়ে বিধ্বস্ত মাথায়,
চালে ডালে কাপড়ে ও মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রায় |
কিন্তু ওরা আছে বেশ !
( এ যাত্রাই অবশ্য শেষ)
যারা মধ্যরাত্রে অগাধ নীলিমা চষে নিরীহ ঘুম ভাঙায়,
যারা তোমার আমার অবসরের গান ভেঙে চুরমার করে |
মুক্ত প্রাণে মুক্ত ইচ্ছার সিন্দুকে তালা পড়ে,
শ্লোগানমুখী মন শানানো সঙীনের মতো ঝলক দিয়ে ওঠে,
ফ্যাশিস্ট-বিরোধী সঙ্ঘে যোগ দেয়,
নুখে মুখে ফোটে বিদ্রোহের দন্ত্তর হাসি,
আর,বুকে সামাজিক যক্ষার কাশি |
তবু এক ফালি চাঁদের পিঠে ভর করে রাত্রির আকাশ,
আর সপ্তব্যহৃতি মন্থন করে অসীম নীল বাতাস,
উঠে আসে শ্রান্ত অন্যমনস্ক পৃথিবীর  উপর |
ছিন্নভিন্ন অস্তিত্বের  ক্লিষ্টগতি ভঙ্গী আনে তারই মর্মর |
পারিশ্রমিকহীন শ্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আয়ু
নিয়ে, রুগ্নস্বপ্ন দেখি, দীর্ঘশ্বাসে ভরে যায় বায়ু |
তবু, তোমার চিঠির উত্তর দিয়ে যাচ্ছি ঠিক, প্রতি সপ্তাহে
.                                                     একটা করে
মল্লিক বাগানের চুরিকরা ফুল খামের ভিতর দিই ভরে |
তারপর, বর্গীরা আসে |
আকাশে বাতাসে স্থলে জলে দস্যুদের দুরন্ত পদধ্বনি !  ত্রাসে
প্রকম্পিত মৃগীদের মন | অলস দুর্বল স্নেহ কুড়িয়ে নেয়
.                                                      প্রচন্ড সূর্য |


অগ্নিবর্ষী সকাল বাজালো তূর্য |
মনে হয়, জীবনের যুদ্ধ এল |
কলোনিতে কেরানীরক্তে প্রচন্ড দোলা,
গম্ভীর স্থির প্রতিজ্ঞাগুলি সারি দিয়ে দাঁড়ায়
ত্রস্ত মনের সামনে প্রহরীর মতোঃ
আমাদের প্রত্যেকের ইঁদুরের মতো মরাই শেষ নয়,
তারপরেও নহত্তম ভবিষ্যৎ |
আপাতত তার আগে পলাশ-রজনীগন্ধা-কিংশুকের
পাঁপড়িগুলি ছিঁড়ে  কুটি কুটি
ঝড়ের নখরাঘাতে ; মেঘে মেঘে বজ্রের ভ্রূকুটি |
তা হোক অস্ত্রোপচারও আরোগ্য এই ভরসায়
সকালে উঠি, মাটির ভাঁড়ে চা খাই,
চালের দোকানের সামনে সারি দিই,
সন্ধ্যায় সমীকরণ সমিতির মিটিং থেকে ফিরি |
পাগলেরা বলে কি ! সমীকরণ আপনিই হবে
কোনো এক অনিবার্য অমোঘ মুহূর্তে |
ইতিমধ্যে হাত পা ছুঁড়ে যাও,
অদৃশ্য অস্ত্র শানাও
কিছু কিছু  মারকাটও চলুক,
যে যাই বলুক
গূঢ় স্বর্থের খেয়ালী আবহাওয়ায় পাল তুলে দাও |
অর্বাচীন ! অর্বাচীন !
জানে না সে দুর্ধর্ষ জাপান আর পর্যুদস্ত চীন |
অর্থাৎ কে  যে শত্রু  ঠিক নেই, নিজেরাই মারামারি করছি,
ঘরে বাইরে মরছি |
শেষে বঙ্কু পালের নির্বোধ চিৎকারে  সভা ভাঙে,
আমার মনও | সাময়িক যুদ্ধবিরতি |  মরা গাঙে
বান ডাকার দিনান্তের পরিচ্ছন্ন মর্ষিত মন
অবসন্ন শান্তির স্রোতে |
তাই নিরঙ্কুশ, পবিত্র, নির্মমন অস্তিত্বের পৌরাণিক সুরে,
বাইরেকে ভুলি, ঘরকে ডাকি
একটা বিশুদ্ধ বিশ্রম্ভালাপের ডিকাডেন্ট সুরে,
শোনো,
তুমি কোনো,
বরযাত্রার মিছিলে কখনো
বাঁশী-পতাকায় আলোতে মাখানো
নবযাত্রার মিছিলে দেখেছ রূঢ় বিধাতার হাসি |
দূরে,
অতিদূরে,
শ্যামলিম কোন্ মেদুর সুদূরে
চেন নাই বুঝি পরাণ বঁধুরে
স্বল্প আলোকে  কান্নায় ঢাকা ব্যথা মুকুলিত হাসি |
উদ্দাম ভালবাসি
তোমার তন্ময় ধ্যান হয়েছে আকাশ পৃথ্বী
পর্বত প্রাকার ---
ধরো, এই ভাবেই  যদি বা বুঝাই তোমাকে
তোমার মুখেই বাঙ্ময় এই পাইন বন---
শুনে বলেছ হেসে,
রূঢ় বন্ধুর ধারালো চূড়ার  এ সমাবেশে,
চলে যাই  দূরে, পার হয়ে যাই ঘুমের শেষে---
বলেছ হেসে |
কিংবা, তোমাকে করেছি লক্ষ্য হে অনন্য গতি
রৌদ্রের মুকুটপরা  প্রাণঃপুত দিন |
বিচক্ষণ বণিকের  অন্যায়ের আভা
আর মুগ্ধ করে না অগণিত মন |
সম্রাটের অনুকম্পা, প্রভুহীন করুণ কুক্কুর,
পথে পথে ফেরে, দুস্থ শহরে শহরে
শেষঅপমৃত্যুর প্রহরে |
কাহারও পরার্থপ্রজ্ঞা সভাতে সঙ্গতে
ছিটায় শান্তির কণা, গলিত তুষার |
বক্তব্য আমার
এই, যে আমি বহুবার
শিল্পিত মনের চারু বনেদী ভঙ্গীতে
প্রেম নিবেদন করেছি | সঙ্গীতে
ফুটো ঘর ভরিয়েছি কিংবা কূট কবিতার
মহিমায় আত্মপ্রসন্ন হয়েছি |
কিন্তু মন পেলাম কই,
কর্মের প্রভায় উজ্জ্বল, এই করুণ গানের উপনিবেশে |
কাউকে তো দেখি না বেশ বলিষ্ঠ হেসে
জীবনের দ্বিধান্বিত মুঠোয় চাপ দিয়ে
শক্ত করে ধরে পৃথিবীর কঠিন জাগ্রত পিঠের উপর
চলে ফিরে বেড়ায় |


পট যায় ঘুরে |
অন্ধীকৃত রাত্রির শহরে,
পথে পথে সুগম্ভীর ছায়ার বহর,
ষড়যন্ত্র সঙ্কুল ত্রস্ত কবন্ধের ভিড় |
সুর-রিয়ালিস্ট কবিতার দেশে |
পিকাসো বা যামিনী রায়ের আঁকা
পথঘাট গাছপালা বাড়ী |
ঊর্ধ্বে নীলে আঁকাবাঁকা  চাঁদ,
তারই নীচে নিরন্ন বুড়োবুড়িদের চাপা আর্তনাদ,
ক্লিষ্ট চলাফেরা |

অতঃপর ব্রাহ্ম মুহূর্তে, ঘর্মস্রাবী রাত্রির ওপারে
আলোকসম্ভবা উষার ওষ্ঠপুটে ভৈঁরোর অস্ফুট আলাপ |
ক্ষুধার গর্জনে ছিন্ন প্রশান্ত গৈরিক |
অগণন বালকবালিকাদের
বুভুক্ষা মুখর যাত্রা লেক মার্কেটের দিকে|
নিশ্চিন্ত অবিবেকী মনের শৌখিন গান
তিরস্কৃত,পলাতক দিশাহীন দূরে |
তবু ভাল, আমি এই মধুবংশীরপুরে
আছি বেশ ; এ বেলা  ও বেলা
কেটে যায় ব্যর্থ অন্বেষায় |
তোমার মহিম্ন স্তোত্রে মুখরিত আকাশ বাতাস
হে স্বর্ণবণিক ! তুমি দীপ্ত হিরন্ময় |
তোমারই হোক ক্ষয়, হোক ক্ষয় |
(আজ শুনি এক ভরি সোনা একশো ছয়
টাকা|) বুভুক্ষারই জয় |
এ স্বর্ণসন্ধ্যায়
কাতারে কাতারে জমে হিরণ্য শকুন
ডানার ঝাপটে কাঁপে আদিগন্ত স্থবির আকাশ
প্রচ্ছন্ন শবের দেশে |


হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি আর এক কথা |
এই তো সেদিন, ট্রেন থেকে দিলো নামিয়ে,
হাতের তলায় সযত্নে চাপা অচল পুরনো টিকিট,---
দিলো কে নানিয়ে অচেনা স্টেশনে
জীবনের ট্রেন থেকে |
তাই সেই থেকে
বারবারই অক্ষম প্রয়াস,
চলন্ত রথের পানে খঞ্জের দুরন্ত অভিলাষ
ব্যর্থ হয়, চূর্ণ হয় ঘৃণার পাহাড়ে |
দূরে চলে ট্রেন
দ্রুত--- টক্রকঙ্কন ঝঙ্কারে |
সম্রাজ্ঞীর মতো উপেক্ষায়, ফেলে চলে যায় |
আমি থাকি পড়ে কোনো বিষন্ন সন্ধ্যায়
শেষহীন চাঁদছত্র উপত্যকায় |
চলেছি কোথায় ?
একাকী ? ইশারায়
মনে পড়ে দিয়েছিল কেউ এ প্রশ্নের উত্তরও |
একাকীত্বের শৌখিনতায়
সমীক্ষার ক্রূর শ্লেষ হেনেছিল সেও |
(তখন অবশ্য বড় জোর
শ্মশ্রুহীন কৈশোর,)
শিল্পকে কাব্যকে বাঁচাবার জন্যে তবু
বলেছিলাম, তুমি তো আজো এই মুখেরই প্রভু,
হে অনন্ত প্রেম!
এই জীবনের সান্ধ্যসভায়
তোমার আসর শূন্য হলো
হে প্রেম শূন্য হলো, বিরস গানে
ভরলো আকাশ ---(লাগছে না ভালো বলছ?
থামা যাক তবে |)
একাকীত্বের দুস্তর প্রান্তর থেকে কবে
উত্তীর্ণ হলাম উদ্দাম শহরে |
ব্যবহারে, বাণিজ্যে
গ্রন্থিতে জোট বাঁধে মনে প্রাণে |
নির্জন শীর্ণ একতারা ডোবে সহস্রের ঐকতানে |
এখন চিনেছি যদিও,আরো অনেককে চিনেছি এবার,
অজ্ঞাতবাসের কঠিন আস্তরণ ভেদ করে
বুঝেছি এবার |
দ্বৈপায়ন হ্রদে ডোবা ভগ্নজানু মন,
তোমাকে দেখেছি বারবার এ শহরে হে দুর্যোধন |
লালসার জতুগৃহে ভস্মীভূত তোমার চক্রান্ত
এনেছে যুগান্ত |
অর্জুন, অর্জুন আজ লক্ষ লক্ষ জনগনমন
দোর্দন্ড গান্ডীব তাই অতি প্রয়োজন,
বৃহন্নলা ছিন্ন করো ক্লীব ছদ্মসজ্জার ব্যসন |
বিদ্রোহের শমীবৃক্ষে সব্যসাচী অর্থ খোঁজে আজ |
ঘুণগ্রস্ত এই যুগ মৃত্যুজ্বরে কাঁপে হাড়ে হাড়ে,
আরক্ত সূর্যের অস্ত পশ্চিমের রক্তিম পাহাড়ে |


এই বার্তা তৃপ্তি দেয় আমাদের
য়াদের,
মন রাঙিয়েছে আগামী যুগের রাঙা আলোয়,
আগত যুগের ‘কামারাদেরিতে’ যারা মুখর,
আমরা তো জানি স্থির বিশ্বাস করি সবে ---
ইতিহাসই দেয় আগুনের রঙে সে স্বাক্ষর |
শোনো শোনো তাই,
হে নবীন, হে প্রবীন, মজদুর, ওহে কৃষাণ,
ওহে মোটা সোটা বেঁটে খেটেখাওয়া কেরানীদল,
হে কাব্যেপাওয়া পালাতক ক্ষীণ কবির দল,
শিল্পীর দল,
হে ধনিক, আর্য, অনার্য
করো শিরোধার্য---
বৃদ্ধযুগের গলিত শবের পাশে
প্রাণকল্লোলে ঐ নবযুগ আসে |
প্রস্তুত করো তোমাদের সেই সব দিনগুলির জন্য
যখন প্রত্যেক সূর্যোদয়ে পাবে নবজীবনের স্তোত্র,
প্রখর প্রাণরৌদ্রের পানীয় তোমাদের আনন্দিত করবে,
(দুর্বলদের নয়|)
শতধা সভ্যতার পাশে,
লক্ষ কোটি ভগ্নস্তুপের পাশে,
বিদীর্ণ আকাশের নিচে,
উপদ্রুত ঘুমের শিয়রে,
ছিন্নভিন্ন পৃথিবীর  বসন্তের পাশে,
লক্ষ লক্ষ নির্জন নিষ্পত্র কৃষ্ণচূড়ার পাশে,
দ্বিধাদীর্ণ জনগনমনে
মহা-আবির্ভাব |
স্বপ্ন জেগে উঠেছে, উঠেছে
স্টালিনগ্রাদে, মস্কোভায়, টিউনিসিয়ায়,
মহাচীনে |
মহা আশ্বাসের প্রবল নিঃশ্বাসে
দুর্দমনীয় ঝড় উঠেছে সৃষ্টির ঈশান কোণে |
উড়িয়ে দেবে দিগ্বিদিকে
শুকনো ধুলো
শুকনো পাতা
ঝরিয়ে দেবে |
অন্ধকারের দুর্গের সিংহতোরণ
গুড়িয়ে দেবে |
ইতিমধ্যে প্রস্তুত থাকো সবাই
যখন অত্যাচারীদের পতন---
চরম পতন হবে |
প্রাসাদে, বন্দরে,
বাহিরে, অন্দরে,
প্রতি গ্রামে, নগরে,
লক্ষ লক্ষ মনে, দেশে দেশান্তরে,
নীরন্ধ্র নির্মম পতন |


তারপর,  অবকাশ |
রাত্রি উঠে আসবে গাঢ় নীল,
স্তব্ধ ডানা পৃথিবীর নীড়ে আসবে নেমে
সুস্থকামনার স্বর্ণচিল,
প্রতিদিনের জলন্ত অস্তের পর,
শ্রম বিরতির পর |
তারপর সুস্থ মুক্ত অনর্গল প্রাণসঙ্গিনীদের নিয়ে
আবিশ্ব প্রাণ-নৃত্যের আসরে
জমবে ভাল, জমবে তখন
মধুবংশীর গলি,
বজ্রনিনাদে তোমাকেও ডেকে বলি ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
অনেক সপ্তমী
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

মনে মনে ভেবে দেখে
ঠিক কবে আশ্বিন আকাশ,
ওড়ায় চিলের ঘুড়ি---
আনন্দ উড্ডিন্ সূত্রে,
ছেলে-মেয়ে, খেলা-মেলা, দোকান-দোকানী সব,
ঘোরে ফেরে দিনাবর্তে নাগর দোলায় |
নতুন জলের স্রোত,
শৈবাল-মাটির মত্স্যগন্ধী জল,কাশফুল-বন,
আবর্তিত নতুন উল্লাসে |
শহরে প্রবাসী বুকে অবিভক্ত বাংলার
শান্ত শ্যামল কথাগুলো---
বার বার ফিরে আসা শরতের খঞ্জনের দল |
মন-দর্পণিত চাল-চিত্র দূর মোহনা পেরিয়ে
বাঁক, নৌকা সারি সারি |
ডিমি ডিমি ঢোল কাঁসি উলুধ্বনি---
বাঁশঝাড় ঘেরা গ্রাম
আশ্বিন আকাশ আর
চলন বিলের পার -আলোক-দুয়ার |
কেমন অদ্ ভুত সব -আগমনী পূজা-পূজা ভাব !
গলার নীচেই ঠিক কাঁপতে থাকা আবেগের  মত !

আজ সেই আবার আশ্বিন,
আর অনেক অনেক বার ঘুরে আসা আমি,
পৌঁছে গেছি পার হয়ে অনেক সপ্তমী ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
পরে হয়ত প্রেমে ডুবে যাবে        
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র


.    আপাতত ব্যক্তিত্বের ভ্রূণে
ছোট শিশু হাতে, চড়ুই বা পায়ারার দিকে
.           চঞ্চল দৃষ্টি হানে |
.       এখন শরৎ-শিশু
.                  আধো-বুলি- অনুভবে
.            আশ্চর্যের রসে মগ্ন |
.কালো কোঁকড়া চুলের গভীরে
.        নভোচারী মনেদের বাসা |
.অভিযান আছে  সামনে  প্রান্তরের মত
.         কিশোরের বিজয়া দশমী---
.         অনাগত যৌবনের আগামী বাসর |
.         আপাতত নান্দীমুখ---,
.         আবোল কাকলি হাসে
.            রৌদ্র-ছায়া-- আকাশ
.        ও পাখীর ডানায় হাততালি দেয় |
.পরে হয়ত প্রেমে ডুবে যাবে ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
একটি সনেট
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র

স্বপ্ন-প্রলাপ-মেদুর করেছে গতি |
স্বদেশ আমার, বিদেশ আমার,নতি
জানাই তোমাকে | আরক্ত ঋতু-রঙে
হিংস্র-কোমল কঠোর করুণ ঢঙে
বিচিত্র দিন, তবু তোমাকেই নতি---
বিদেশী স্বদেশ, স্বদেশী বিদেশ প্রতি |
জীবন ধারণে চক্র-ঘষার জ্বালা---
আশ্বিন দিনে তবু প্রেয়সীর মালা |
তোমার আমার পয়ারে পয়ারে মিলে
জ্বলে ওঠে গান, ছন্দের এ নিখিলে |
কত না দেশের প্রভাতে সন্ধ্যা এসে
আকাশে আকাশে নীল বাহু মেলে মেশে |
ধ্বংসের পাশে তোমারই কোমল যতি |
সারা মানুষের স্বদেশ তোমায় নতি ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
আরোগ্যেই যেন শেষ হয়
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
(বিষ্ণু দে -কে)

এখন কবির কাল শেষ যদি হয়,
অনুপস্থিত ছন্দ বাণপ্রস্থে লীন
যদি ভীরু থ্রাস্, গানের কলিকে ভুলে
নেমে যায় অরণ্যের নীড়ে,
যদি হয় আমার মুখের ছবি
তোমার মুখের মত শহরে শহরে,
সাহিত্যের রঙ্গনাট্যে কথাকলি মুদ্রার মৃদঙ্গ নর্তনে,
আমার আরোগ্য যেন
তোমার বুকেতে বাঁধে বাসা
পরিপূর্ণ সূর্যমুখী দিনের আলোয় ||

অশ্লীল কুটিল এই  জীবনের ওপারেই পলাশের বন |
শিমূলতলার গান, পাহাড়ের ছায়ায় ছায়ায় |
ওখানেই চলো, সেই প্রতিশ্রুত নিমন্ত্রণে,
ছায়ায় নিঝুম,
আলাপের রাগিনীর বর্ণচ্ছদে নীল |
অনেক দূরের পথ পায়ের পয়ারে ভেঙে
সাঁওতাল-রঙ দুম্ কা কেলাসিত ডিগ্ রিয়ার
ছন্দের গভীরে ||
তোমার সুদূর উচ্চ স্বপ্নচূড়া বাসা থেকে
আমাকে ডানার স্বাদ দিয়েছ কখনও |
কখনও বা সমুদ্র-গর্জন শুনি সে উত্তাল মনের মিছিলে,
বেটোফেন প্যাস্টোরাল পুরীর সৈকতে---
সেখানে তোমার মন ব্রেকারের সহস্র ভঙ্গে
আমাকে ছুঁয়েছে |
এখনও অনেক দিন প্রবল বন্ধুর মত
উত্তবায়ণ সূর্য দেবে আরোগ্য সংবাদ |
ততক্ষণ তুমি থেকো কাব্যের সত্তায়
সুস্থ আয়ু নিয়ে |
তোমার প্রগল্ ভ গান প্রজ্ঞাপারমিতা
পৃথিবীর বসন্তের স্তব---
আরোগ্যেই যেন শেষ হয় ||

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
*
ঝঞ্ঝার গান
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
       

১.        উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই, উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই, উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই,
.        ওই ঝঞ্ঝা বুঝি আসে, ওই ঝঞ্ঝা বুঝি আসে |
.        উত্তাল তরঙ্গ দোলায়
.        নিথর মন ভোলায় |
.        দুরন্ত বাতাসের দুর্জয় আহ্বানে
.        উলঙ্গ এ আকাশ অট্টহাসে ||


২.        ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই |
.        মরণের পাল তুলে জীবন তো আসবেই, ভয় নেই |
.        ভাঙাগড়া দ্বন্দ্বের ঢেউ তুলে আসবেই, ভয় নেই |
.        আমাদের হাতে গড়া জীবন বহন করা
.        তরণী তো ভাসবেই, ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই |
.        ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই |
.        ভাঙা খসা ভেঙে যাক খসে যাক,
.        ঝরে যাওয়া মরে যাওয়া উড়ে যাক |
.        ক্ষয়ের পাত্র ভরে জীবন তো আসবেই, ভয় নেই |


৩.        আমার একাকী আকাশ,
.        কি বাঁশি বাজিয়ে গেছে রাত্রি দিনে |
.        একতারা তান সেধে সেই সুরে পথ রচি ;
.        নির্জন পাহাড়ী দেশে
.        বিবাগী বেশে |
.        কত কথা বলে গেল ধ্যানের মানুষ মোর
.        কত সুরে ভরে দিল প্রাণ |
.        প্রবল ঝড়ের ডাকে সে বাঁশির তান
.        ডুবে গেল হায়------ ডুবে গেল হায় |
.        একতারা কলরোলে ডুবে গেল হায় |


৪.        মিথ্যা এ হাহাকার,
.        ধ্যান ভাঙো , ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ঙাঙো |
.        ভেঙে যাক দূর নীল পাহাড়ের স্বপ্নের ঘোর |
.        ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ভাঙো |
.        একাকী থাকার দিন,
.        ভেঙে গেছে, ভেঙে যাক,  ভেঙে গেছে, ভেঙে যাক |
.        ধ্যানের মানুষে আজ মিশে গেছে হাজার মানুষ |
.        মিথ্যা এ হাহাকার |


৫.        বর্বর বাধা আছে, আসুক-না  বাধা
.        ঝঞ্ঝার আড়ালে |
.        দৈত্যের দেশ থেকে আসুক বাধা সেনাদল |
.        সাগরের গান শোনা আমাদের কান, আমাদের প্রাণ,
.        আমরা প্রবল , আমরা মানি না কোনো বাধা |


৬.        বিষাক্ত মন্ত্রণা নাগিনী বাহিনী সম
.        ঘিরে ফেলে চারিদিক, সাবধান !  সাবধান !!  সাবধান !!!
.        এখনো মনে কি আনো ভয়
.        মনে মনে রচো সংশয় |
.        বিষ-মন্ত্রের ডাকে রচে চলো দ্বন্দ্ব,  রচে চলো দ্বন্দ্ব |
.        বর্বর আঘাতে আমাদের জীবনের
.        সহজ নদীর নীল হয়ে যাবে লাল, হয়ে যাবে লাল |
.        শোষণের মরুভূমি হাতছানি দেবে,
.        সাবধান,  সাবধান !

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
গাজন
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     


.        ওঁ জয়  জয় দুর্গে মা দুর্গে |
.        ভবদুখে জ্বলি মাগো তরাও গো পার্বতী,
.        পাপের সাথী হয়ে মাগো সব কাজে কুমতি |
.        জয় জয় দুর্গে মা দুর্গে |


.        ওই নাচিছে ভূতনাথ খ্যাপা মহেশ্বর,
.        ( আর ) তালে-তালে নাচে গৌরী নাচিছে ভূধর |
.        ( যুগল নাচে রে )
.        নন্দী নাচে, ভৃঙ্গী নাচে, নাচে ভূতের দল,
.        ( আর ) ডাকিনী যোগিনী নাচে, শিবারা সকল
.        ( যুগল নাচে রে )
.        আবৃত্তি :  ( খসিয়া পড়েছে শিবের ওই বাঘছাল,
.        রাঙাজবা হেন নেত্র ঘুরিছে ভয়াল |
.        আলুথালু কেশপাশ শিবের ঘরণী-----
.        শ্মশান ভীষণ হল, কাঁপিছে ধরণী | )
.        ( যুগল নাচে রে ) |
.        ( পার্বতীর দলের হাস্য )

.শিবের অনুচর :
.                লাজ ডর নাই দেখেন প্রভু হাসিছে প্রেতিনী,
.        আজের হাসি কালের কান্না হইবে এখনি |


পার্বতীর দল :
.               আবৃত্তি : [  নাচো কেমন কোঁদো কেমন কী গো মহাশয়
.        ( এই ) ধিঙ্গি নাচের রঙ্গ দেখে হাস্য রাখা দায় |
.        হা হা হাস্য  রাখা দায় | ]

শিবের অনুচর :
.              তবে রে !
.        আবৃত্তি: ( এতই যদি মনে গরব থাকে
.        তবে নাচেরই পরীক্ষা হোক, )
.        কে বা জেতে কে বা হারে দেকবে সকল লোক |

পার্বতীর দল :

.                 আবৃত্তি : ( তবে তাই হোক  )

শিবের দল :

.                 তোদের পা নাচে না নাচবি তোরা কী,
.        আবৃত্তি : ( এঁকেবেঁকে ক্যাঁকড়া চলে খোঁড়ায় বুড়ি ঝি |
.        খ্যাংরাকাঠি, পোড়ামাটি, চালকুমড়োর ছা,
.        কুমড়ো গড়ায় ডিগবাজি খায় বদ্যিবাড়ি যা রে
.        তোরা বদ্যিবাড়ি যা | )

পার্বতীর দল :
.                আবৃত্তি :  ( আকাশপানে দলে-দলে হাতি উড়ে যায়,
.        গ্রামের যত পাগলা বাছুর শিবের গাজন গায় | )
.        হায় হায় কী হবে উপায়,
.        ঘরের বাতি তৈল বিনা বুঝি নিভে যায় |

শিবের দল :

.                 ঘোর-ঘোর আন্ধার রাতে,
.        গর-গর ডম্বরু বাজে সাথে,
.        আবৃত্তি : ( খট খট খটাখট কঙ্কাল বাজে,
.        দ্রিম দ্রিম ধামাদ্রিম ধুপ
.        খল খল খল খল অট্টহাসি
.        হা  হা  হা  হা হা  | )

পার্বতীর দল :
.              নব ঠমকে নাচিছে রাই,
.        নব-জলধর-শ্যাম-সোহাগিনী
.        মরি বলিহারি যাই |
.        আখর : যেমন কালো মেঘ দেখে-দেখে ময়ূর নাচে,
.        কৃষ্ণ কালো মেঘ দেখে ওই ময়ূর নাচে |
.        নবশৃঙ্গার রঙে রঞ্জিত রাধা
.        ভাবে ঢুলুঢুলু আঁখি |
.        শ্যামবনানী অঞ্চলে যেন নিদ্রিত দুটি পাখি |

শিবের দল :

.              আবৃত্তি : ( উর জাগ্ জাগ্ জাগ্ জাগিন ঘিনা
.        জার ঘিনিনা,
.        নাচছে খ্যাপা দিগম্বর, নাচছে খ্যাপা |
.        ধিগ ধিগিতা ধিগিন ঘিতা ধিগিন ঘিতা,
.        দপ দপ দপ জ্বলছে কপাল শ্মশানচিতা | )


পার্বতীর দল :
.              পোড়া ভালে এই কি রে ছিল |
.        ভাঙখোর বুড়া শিব লাজডর নাই রে,
.        নিষ্ঠুর পিতা মোর দিলা হেন পতিরে |
.        সতীর অঙ্গে দিলা চুনকালি
.        বীভত্স রঙ্গে দেয় হাততালি |

সকলে :
.                  আবৃত্তি : ( কত্তা ধাগিনে কত্তা,
.        বেঁকে পড়ে যায় ধেত্তা,
.        আবার ঝেড়েঝুড়ে মারে গোঁত্তা |  )

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বর্ণতপস্যা
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

সৌরলোক থেকে বর্ণতপস্যায় স্নাত হয়ে
বর্ণনার ভিক্ষা নিয়ে আসে কৃষ্ণচূড়া |
তুমি কি তখন মনোলৌল্য নিয়ে ব্যস্ত থেকে-থেকে
বলবে তাকে অসংলগ্ন অশ্লীল প্রলাপ ?
অথবা এ সাম্প্রতিক হয়েও বাহবামুক্ত স্পষ্ট প্রেমে বিগলিত
বিজ্ঞাপিত হবে কৃষ্ণচূড়া ?

অধুনা যা পরিবেশ ঐতিহ্যের যতি রেখে-রেখে
পৌঁছে গেছে অফিসের লিফটের কাছে---
কৃষ্ণসার ---- চক্ষু তনু শাড়ি শালীনতা
খাজুরোহো ----- স্মৃতি-ঘেরা পীন পয়োধরা
লিপস্টিক-ঠোঁটে ফিকে নীল ধোঁয়া কুন্ডলিত
সিগারেট কাঁপে, কাঁপে অতল মৃত্যুর মতো----
তুমি কি প্রমত্ত শুঁড়িখানার লোলুপ স্তব
মুখে এলে আবৃত্তির পার হয়ে যাবে ?

হঠাৎ বিকেলে এল ধূলিঝড় ধূম্র নীল আকাশের নিচে
পার্কের সময় কেঁপে থর-থর স্থির হয়ে যায়----
অবাক সূর্যাস্ত ----সোনা মুঠি-মুঠি বাতাসের হাতে |
গৃহান্ত প্রাণের পাশে রাস্তার বাঁক ঘুরে ( ভুল করে
ন্যু-অর্ক ভেবে---) ভীষণ প্রাণান্ত বেগে যৌবনের
মোটর উধাও-----
ব্যসনের অমেয় মূর্তি প্রপাতের গভীর পতনে
থমকে থেকে কোন্ বর্ণে তুলি ভরে নেবে ?
বেগের ? ধূলির ? শষ্প-শ্যাম নীল
সোনা-গলা আকাশ নদীর ?

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
বসন্তের চিঠি
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।    

সমস্ত সকাল বসে
কুয়াশাকে পাকে -পাকে আকাশে জড়াই----
বসন্তের ভ্রূণে
অনাগত অরণ্যের শিকড়ে-শিকড়ে
সমস্ত সকাল বসে |
এখনও হাত-পাগুলো  ঠান্ডা মরা ডালের মতন------
আগুনে সেঁকে নিয়েই        
জানি না কোথায় যাব ---- ঠিক দিশা নেই-----
( আঃ, চুপ করো---- একটু তোমরা চুপ করবে ?
প্লিজ !--- যত সব বেল্লেলাপনা-----|
বেহায়া, দেহের ছায়া----সংখ্যাহীন প্রতিধ্বনি |---- )

ঠিক নেই দিশা নেই-----শহরে পথের শেষ-----
চায়ের কাপের শেষ অবশিষ্ট কালো-কালো গুঁড়ো নিয়ে,
স্বপ্ন নয়, জাল নয় বোনা নয়-----
ঠিকাদার  পাওনাদার অনুদার ছেঁড়া শাল
ঋতুর মজলিশ----- |
( দিলে আবার দুলিয়ে !-----  চোপ রও উল্লুক !
হালি দিয়ে হল্লাবাজগুলোর উর্বর খিস্তি-----
এরাই দেয়ালে-দেয়ালে আলকাতরা-রং সব
মিথ্যাগুলোকে কলঙ্কিত ইতিহাস করে তোলে-----
চুপ রও শ্--শালা !----  )

হ্যাঁ--- যা বলছিলাম--- স্বপ্ন নয় জাল নয় বোনা নয়
ঋণ নয় ধন নয়---- সব কিছু রোমন্থন মন্থনেই
কালীয়দমন হলাহল কোলাহল কলনিঃস্বনে গান----
আর, অরণ্যে বসন্ত আসে কোন্ সেই
প্রাগৈতিহাসিক লাল ট্রোগনের জটিল পাখায়-----
অপ্রাকৃত অসম্ভব নেশার মতন |
তবু জানালাগুলো খোলা দূর-দূর দুমকার দিকে
ধলভূম সিংভূম সুবর্ণরেখার মতো স্মরণের চাইবাসা---
নির্জন অরণ্যে ঘুঘু বাসা করে ডাকে---- বাসা
মধ্যবিত্ত মননের রূপশালি--- নকশালি ধানের ওপারে
কয়লাখনি কুলিদের বস্তির নায়িকা
পলাস-মহুয়াগোঁজা বসন্তের বাসন্তী কবরী |

সমস্ত সকাল বসে
বসন্তের চিঠি এই কুয়াশাকে পাকে-পাকে আকাশে জড়াই
আনন্দের ভ্রূণে
অনাগত অরণ্যের শিকড়ে-শিকড়ে
সমস্ত সকাল বসে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
সমস্ত বৃষ্টির পরে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।     

সমস্ত বৃষ্টির পরে,
বর্ষণের সব কিছু, ভেঙেচুরে ধুয়ে-মুছে
একাকার করে দেওয়া----
এর পরও আমাকে অন্য মনে থাকতে দাও |
পুরনো আকাশটাকে ধুয়ে-মুছে চকচকে করো
তারপর পৌরাণিক কথা |
অন্নদামঙ্গল মনসামঙ্গল আর চন্ডীর কথা
সপ্তডিঙা সাজায়ে চলেন চাঁদ সদাগর |
ভাঙা কুঁড়ে ফাটা আঙিনায়
আলপনা পেতে হবে ঢাকের বোধন |
আমার ছোট মেয়েটি লাল ফ্রক চেয়েছিল
বুড়ো চুলে কলপ দিয়ে বিয়ের টোপর-পরা
আর কিছু নেই---- তাই সই, তাই উলুধ্বনি
দাও----- হবে আশার পূরণ |
তারপর পৌরাণিক কথা মঙ্গল শ্রবণ
অন্নদামঙ্গল মনসামঙ্গল চন্ডীর কথন
ঢাকির পালক লাফিয়ে ওঠে
.                  সপ্ত কাঠির নাচে
খেয়ে বা না-খেয়ে তোমার
.                  প্রাণটা তবু বাঁচে |
সপ্তডিঙা সাজি চলেন চাঁদ সদাগর |
মনসারানির বিয়ে, বরের সোনার টোপর |
এখন আর ক্লান্তি নেই |
অনেক গানের পালা পার্বণের বাজনা বাজিয়ে |
এখন আর ক্লান্ত নই |
বার বার তেহাইয়ে বা সমে
এখন আর ক্লান্তি নেই |
শ্লথনীবি সান্নিধ্যের যৌবনের গান
অনেকের মুখে-মুখে অন্তরঙ্গ শরীরের পরিধি ছাড়িয়ে
সমুদ্রের মতো সব
ছড়িয়ে পড়েছে দূর দেশে-দেশান্তরে |
এখন এ কথা ভাবি,
নতুন সুরের রাষ্ট্রে মঞ্চাধীশ জীবনের কথা |
বিদ্রোহের ভগ্নস্তূপে সৃষ্টির কুশীলব
সংখ্যাতীত ব্যঞ্জনার বীজ নিয়ে ঘোরে
নূতন ফসল, মাঠ----সারি-সারি ঢাক-ঢোল,
নবনাট্যসূত্রে সব অভিনায়ন, নান্দীমুখ পাঠ |
পরিপূর্ণ জীবনের ওপারে প্রয়াণ
পরিপূর্ণ মানুষের জীবনের ফসলের গান
বিপুল প্রয়াস----
সমস্ত রাত্রির শেষে স্বর্ণ-গর্ভ ঊষার কোরাস |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
মেঘের রং হলদে
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।     

বৃষ্টির শ্যাওলা,  পান্নারং গ্রামগুলোকে
.        নিয়ে শহরের শরীরকে পিচ্ছিল করে দেয়
তারপর অন্যমনস্ক বলাকার শাদা-মেঘ পাখাগুলো
.        নিচের মাটিকে অন্য দেশ অন্য প্রান্তরের
.        কথা বলে রাখে---- |
.        আমার মানুষ-মন অন্নময় কোষে
.        ঘুরে-ফিরে ঘ্রাণ নেয়------
সেই বৃষ্টির শতদল অনুভবের প্রস্ফুটিত পান্নারং বনের
.        আর দৈনন্দিন দেহরক্ষার রান্নাঘর উঠোনের
.                সামগ্রীর আবর্জনাস্তুপে |

এখানেও নয় |  আরও দূর আশ্লেষের হাত
অন্য দেশ
অন্য রাজনীতি, অন্যরং মেঘ |
এই আশ্বিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে
শিরশিরে শিউলি সকাল আর বিকালের
.                হৃদয়ের কাছে ঘেঁষা ছুটি-ছুটি মন
সব কিছু নিয়ে সগৌরবে বাঁচতে হবে-----
যখন আরক্ত হবে প্রাণের উচ্ছাস
আর হবে নীলমাখা আকাশের গায়ে
.                   মেঘের রং হলদে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
আকাশ মেঘ স্বপ্ন
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।     

পাখিদের শাদা পালক খুঁজে পেলে
আমিও হতাম মেঘ |
হাওয়ার হাতে হাত দিয়ে চলে
আমিও হতাম বেগ |
আর আকাশ হত অসীম নীল স্বপ্ননামাবলি,
গহন মনের রূপকথা-রং পূর্ণিমারই গলি |
কিন্তু এখন এ সব কিছুই নেই
সপ্তডাঙা নদী সাগর ভাসছে ভাদরেই |
আমি তাই প্রাণের বন্ধু যৌবনকে বলি-----
জীবনটাকে ছুঁড়লে কোথায় বোমার মতো মেরে ?
না--বুঝে কোন পাশের বন্ধু পশুর মতো তেড়ে
মা দুর্গার অসুর হয়ে আসে |
সুরাসুরের দ্বন্দ্ব অট্টহাসে |
ওদিকে দেখি বিস্ফোরণের মুখভর্তি রক্ত থলো-থলো  |
হঠাৎ-লাগা গুলির ঘায়ে
ফুটপাতের ঐ যক্ষ্মারোগী বুড়োই বুঝি ম’ল |
হয়তো কোন আশা নিয়ে তপ্ত আগুন দিন
হঠাৎ ছুটে আসে |
এসে দেখে যৌবনকে মারছে ইতিহাস,
অনেক দিনের টুকরো কথা বানের জলে ভাসে |
কিন্তু কোন আশা নেই এখন আপাতত |
শুনছ, কোন ষষ্ঠীর ঢাক বাজছে বোধনে |
সমাজ দেশ ইতিহাস কাঁপছে ঝোড়ো হাওয়ায় |
লক্ষ্ণীর পা আলপনা নেই গ্রাম-মানুষের মনে |
ডানাভাঙা ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্ন-পালকগুলো
রক্ত মেখে লাল |
( উদ্ধত রাবণযুগ, আহত জটায়ু, আর মর্মাহত কাল )
যা-ই হোক, অন্য কিছু না-ই বা যদি থাকে,
তুমি আমি নাচব শেষে বিসর্জনের ঢাকে |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর
*
একটি শুভ্র ফুলের জন্য
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র     
"যে পথেই যাও" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।    

পথ খুঁজে পাবে না কোথাও |
হয়তো কোথাও কোন গ্রামের ভগ্নাংশ নিয়ে
শহরের পঞ্জর গড়েছে----
সেখানেও নেই |
আহারবিহার সাজসজ্জা সেই তনুরক্ষা,
শহরের পর শহরের কর্কশ গণিত
যোগবিয়োগের ফলে,
অনেক , স্বপ্নেরা সব অরণ্যের সাথে
ফুল ফল পাখি নিয়ে শহিদ হয়েছে |
এখন প্রতিটি দিন বিস্ফোরণে আসে |
তবু পথ খুঁজতে থাকো |
শিশু ঘুমপাড়ানিয়া কুসমি দাসীর মুখে
গল্পগুলো যুদ্ধ করে মরে |
একটা বীরের মতো গল্প যদি বেঁচে উঠে আসে
সেই হবে বীজ |
নূতন উত্সব নিয়ে, সে দেখাবে পথ |
লক্ষ্মীর পায়ে-পায়ে আলপনা উঠে এসে
ভরাবে আঙিনা |
উত্সবের ঋতু নেই |
একানেই উত্সব নন্দনে আনন্দিত |
মনের সংকট ভুলে, পথে-পথে জীবনকে আলিঙ্গন কোর |
কারণ, এ জীবনই তো জীবনের আততায়ী হবে,
কোন একদিন |
কেবল একটু খুঁজো কাঁটা স্তূপ আবর্জনা পাথরের আনাচেকানাচে
অঞ্জলির একটি শুভ্র ফুল |

.             ****************               
.                                                                                      
সূচীতে    


মিলনসাগর