কবি মউলি মিশ্রর কবিতা
*
সমতলের চিঠি
কবি মউলি মিশ্র

এবার পাহাড়ে উঠে তোকে কী বলব, চূর্ণি
অদ্ভুত সবুজ এক মানুষ দেখেছি আমি। আমার
হাত ধরে পেরিয়ে গেছে সে সঙ্কীর্ণ চড়াই-উতরাই
নীল ওড়নার মতো এলানো যমুনার বুক খুঁড়ে সে
এনে দিয়েছে অলৌকিক সাতরঙা নুড়ি। আমার জন্য
সবুজ সেই মানুষ মৃত্যুকে ডানহাতে মুঠো করে
দক্ষ বাহতে কেটে এনে দিয়েছে প্রশস্ত বৃক্ষের ছাল
তাতে নাকি চিঠি লেখা যায়!
আমার জন্য, চূর্ণি, আমারই জন্য।
বিনিময়ে কিছুই চায়নি সে

সমতলে নেমে এক রাত্রিও পোহায়নি,
এসেছিল মানুষ, সবুজ রং নেই একফোঁটা
সর্বাঙ্গ হলুদ আমারই মতোন
ক্রূর দৃষ্টি হেনে ডান হাত মেলল সে
পাওনা অনেক বাকি!

পাহাড়ে ওই হাতেই ধরা ছিল তার মৃত্যু, চূর্ণি,
আমারই জন্যে তো!

.        *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অমোঘ নিউক্লিয়াস
কবি মউলি মিশ্র

আমি আপাতত
.        তোমার শরীরের দিকে তাকাচ্ছি না
দেখতে চাই না
.        কত ফুট উচ্চতা তোমার
রং কেমন
.        নাক টিকোলো কিংবা বোঁচা
তার চেয়ে
.        আমি এখন খুঁজে দেখি
.        তোমার মন . . .
কোন কেন্দ্রাতিগ বলে পাক খাচ্ছে
.        তার চারদিকে ইলেক্ট্রন কণা
এইভাবে মনের কক্ষপথ ধরে
.        একদিন যখন
খুঁজে পাব সেই অমোঘ নিউক্লিয়াস---
.        তখন দেখা হয়ে যাবে
আমার থেকে ঠিক কতটা বেশি লম্বা ছিলে তুমি . . .

.           *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চিঠি
কবি মউলি মিশ্র

টিনের চালের দেড়খীনি ঘর, মধ্যিখানে উঠোন।
বারো মাস সেই উঠোনে এক শালিক আর রাত বাড়লেই
ঘাম-ঘাম উথালপাথাল ; ওরা আঁচড়ায়,
রক্ত চোষে ; এসব শেষ হলে ফের ঝড় ওঠে বিছানায়।
সকাল হলেই নর্দমা বেয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে অভাব
লোকটা অসহায় রাক্ষসের মতো গজরাতে গজরাতে বেরোয়,
বইটা দেওয়ালে মাথা ঠোকে, আট বছরের মেয়ের গলায়
বঁটি চেপে ধরে বলে : মরে যা এক্ষুনি
যাকে বলে, সে ততক্ষণে আধখানা ঘরের জানালায়
রেলিংয়ে গলিয়ে দিয়েছে ঘা-ওঠা ন্যাড়া মাথা
দূর রাস্তায় ভাসিয়ে দিয়েছে তার ডাক : সুজন বন্ধু হে
কবে আসবে তুমি, কবে ?

আমার কোনো শৈশব ছিল না ; জন্ম থেকে
আমি তোমাকেই খুঁজেছি সুজন
এই রুক্ষ লালমাটির দেশে আমার জন্যে
দু’একটা কালবৈশাখী আর মুঠোভর শৈশব আনবে, তাই

বন্ধু তুমি সেই এলে, মুঠি শূন্য করে!
তোমার-আমার সংসারে দেখি সেই পুরনো উঠোন,
নর্দমা, এক শালিক . . . গুমোট দিন ভারী হয়ে চেপে বসে বুকে
দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে আজ দেখো, মরে যাচ্ছি আমি
নাভি-বন্ধন ছিঁড়ে
আমাদের দুঃখী উঠোনে রেখে যাচ্ছি যাকে,
সুজন বন্ধু হে, তার জন্য বন্ধু খুঁজে রেখো
যে অন্তত জানে জোড়া শালিকের হদিশ . . .

.           *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিজ্ঞাপন
কবি মউলি মিশ্র

এছবির মধ্যে সুখ
.        দিগন্তজোড়া নীল প্রেমে সুখ স্হির হয়ে আছে।
.        দম্পতির মধ্যিখানে শিশু
.        সুসাস্থ্যের পাত্রে সুখ নিয়ে বসে।
.        নারী ও পুরুষটির হাসিতে সাত জন্মের স্বস্তি,
.        প্রেম স্থগিত হয়ে আছে।
.        পেছনে অনেকটা সবুজ, নীল
.        কিংবা জীবনের অন্য সব রঙ।
আমরা অবশ্য সেটা খেয়াল করিনি।
ঠিক হল, ভোর হবে তোমার রেওয়াজে
দিন গড়াবে যত, রাগসঙ্গীত ভাষা খুঁজে পাবে
রাত হলে যৌথ গান আকাশ ঢেকে দেবে।
.                শূন্য জমিতে বসে সুখ-ছবিকে চ্যালেঞ্জ ছোড়া হল।

এই শহরের সবকিছু ঠিকঠাক, আগেরই মতন।
মরসুমী মেলায় মাঠ ভরে যাচ্ছে বছর বছর
নীল ফ্রেমে সুখ স্থির।
তুমি আড়চোখে তাকাচ্ছ সে দিকে।
আমাদের দারুণ বিপন্ন করে
দিগন্ত ছোঁয়া অতিকায় ছবি থেকে
লাফিয়ে এক বিদেশী গাড়ি!

.      *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অনন্ত দূর
কবি মউলি মিশ্র

চুল বাঁধি, ফের খুলি
কি কি রঙ আছে তোলা ? পরি আর খুলে ফেলি।

কলঘরে অবিশ্রাম জল পড়ে
গা মুছি, ভিজিয়ে নিই আবার . . .

তোমাকে ভুলতে চেয়ে অনন্ত কোনো দূরত্ব খুঁজে চলি
দূর খুঁজি . . . আর

ঘরের দেওয়ালগুলো চেপে আসে ক্রমে
আরও সব কাছাকাছি হয়ে যায়---
ছাদটা পৌঁছে যায় মেঝের বুকে
ডান দিকের দেওয়াল আছড়ে পড়ে বাঁদিকের উপর . . .
মধ্যিখানে আমি

একটা পাথুরে নদী কিংবা জঙ্গুলে পাহাড়
কেউ যায় না সেখানে, ধরো খোক্কসের দেশ---
দূরে যাব বলে পা বাড়িয়েছি

তখন শোবার ঘরের মধ্যে এসে পড়ে নদী
ড্রয়িংরুমে পাহাড়, কলঘরে জঙ্গল
নদী-পাহাড়-সাগর বড়ো কাছাকাছি
এসে পড়ে, একোবারে ঘরের মধ্যে

কত ভিড়, দুমড়ে যেতে যেতে দেখি ওই যে---
তুমি!

অনন্ত সেই দূর কোথায় খুঁজব আমি ?

.         *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মত্সগন্ধা
কবি মউলি মিশ্র
(
প্রথম প্রকাশ "একদিন", ৩০.০৬.২০১৩)

রোজ রোজ বস্তা ভর্তি গেঁড়ি চাপাতে পারি না, এত ভারী
এই বয়ে বয়ে মরে গেছি কে জানে কবে থেকে
শরীরের সব সুগন্ধ উধাও---
নখ পচে পচে আসে, গোড়ালি অবধি দুর্গন্ধ ছড়ায়।
মরা মানুষের যেমনটা হয়।
শরীরের সব সুখগন্ধ, মুনিপ্রবর কেউ পেল না,
তার আগেই শরীরের মৃত্যু ঘটে গেল।
যোনি আজ আঁশ-গন্ধ লাগা, বাহুমুল, তা-ও।
স্তন-যতিতে কেউ মরা মাছ পুঁতে দিয়ে গেছে---

অথচ সারা দিন এ-পার ও-পার।
মুনিশ্রেষ্ঠ! এ-ই তো জীবিকা
মৃত শরীরও জীবিকার জন্য পারাপার করে
শুনেছেন আগে ?

এবার বেশ বর্ষা ঘনাল। কালো মেঘ নেমে এল
আমাদের ধাতব ডিঙি ভেদ করে। সেই মেঘ আপনাকে
আবৃত করেছে। আমাকেও, সম্ভবত। কাঁচুলি খসে গেছে।
অসহ্য টান স্তন-বৃন্ত ছুঁয়ে
মুনিশ্রেষ্ঠ, আপনার দুচোখে বিদ্যুৎ চমকাল।
সত্যি! সে কি সত্যি!

ধরে নিন মরেই গেছি। তবু পারাপার করি
আপনিো সুদৃশ্য নন তেমন। দৃশ্যে কী-ই বা যায় আসে
সে এক পলক-মাত্র, আমূল কেশ-স্তন-যোনি ধুয়ে গেল
কীসের সত্কারে! এমনটা হয়নিতো আগে!

তখনও বুঝিনি কিছু। আঁশ-গন্ধ মেয়ে, মরা মানুষের দেহ
বয়েই চলেছি। লোকালে প্রচণ্ড ভীড়, বস্তা আগলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছি
মৃত্যুরই দিকে। আচমকা সব ফাঁকা হয়ে গেল।
কীসের সম্ভ্রমে হঠাৎ তাকাল শান্তনু ?

অতিমানবী আমি ? আপনিই বানালেন। ঘামগন্ধ,
আঁশগন্ধ, মৃত্যুগন্ধ মুছে গেছে। এবার তবে স্বীকার করুন!
স্বীকার করুন আজ আমি পদ্মগন্ধা হলাম
আপনারই কল্যাণে!

.       
      *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর