কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতা
*
রাজা
সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
মার্টিন লুথার কিং স্মরণে লেখা।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত “দেশ সুবর্ণ জয়ন্তী কবিতা সংকলন
১৯৩৩-১৯৮৩” কাব্য সংকলনের কবিতা।

গান্ধীজীর সময়েই আমাদের চোখের সমস্ত জল শুকিয়ে গেছে
এখন তোমার জন্য চোখ দিয়ে শুধু রক্ত পড়ছে রাজা | আমি
টেলিপ্রিন্টার দূরত্বের এক কালো মানুষ, অসহ
অনুতাপে পুড়তে-পুড়তে
বোবা মানুষগুলোর পাশে আমার সতীর্থ মুখ
বারবার তুলে দেখছি, তোমার
অহেতুক অন্যায় নিদ্রার দুইপাশে
সারা আমেরিকার বাগান থেকে ফুল হয়ে উঠে আসছে প্রকৃতি | কিন্তু
তোমার বুকের উপর তো এই
নানাবর্ণ কুসুম সম্মিলনের কোন প্রয়োজন
ছিল না! কেননা তুমি সাদা আর কালো এই দুই মূল বর্ণ
কেবল মেলাতে চেয়েছিলে ; চেয়েছিলে মানুষের পূণ্য নিঃশ্বাসের সঙ্গে
একই পৃথিবীর নাগরিকতায় মানুষের বিশ্বাস মেলাতে!

এখন গভীর প্রশান্তিতে চোখ মেলে আছ তাই
দেখছ না কখন আকাশ আমাদের বিবর্ণ মুখের থেকেও
অনেক ব্শী নীল হয়ে গেছে
আর দু-চোখের চেয়ে বড় এবং গভীর দর্পণ নেই বলে
আমরা কেউই কারো দিকে তাকাতে পারছি না | হায় ভালবাসা!
মানুষের অভিধানে আর তোমার জন্য কোনো জায়গা রইল না |

.           ****************          
.                                                                        
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর
*
মানুষ পারে   
সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত “দেশ সুবর্ণ জয়ন্তী কবিতা সংকলন
১৯৩৩-১৯৮৩” কাব্য সংকলনের কবিতা।

না, আর কখনো আমি ব্যবহার করব না তোমাকে
শিশুকে মধুর মিথ্যাও শেখানো পাপ
তাই আমি আকাশ শেখাতে গিয়ে
আর কখনোই পুনর্বিবেচনা করব না পূর্ণিমা |
পূর্ণিনা শব্দটি বড় মুগ্ধকর, কেননা সেখানে আজও এক
"মা" মিশে রয়েছে |
একদিন, সেই কবে বহুদিন
আগে, আমার মা প্রতি চান্দ্র-সন্ধ্যাবেলা সংসার থামিয়ে এসে
মল্লিকা, টগর, করবীর সমবেত সুগন্ধের
ভিতর আমাকে কোলে নিয়ে বাইরে দাঁড়াতেন ; আমি
মাকে ভীষণ বিশ্বাস করে ভাবতাম
একদিন নিশ্চয়ই চাঁদ টিপ দিয়ে যাবে |
অথচ এখনও আমার কপাল খালি পড়ে আছে,
শুধু খণ্ড-খণ্ড কলকাতার নীলিমায় তাকিয়ে ভাবছি আমার শিশুকে
আমি কোন নতুন খেলার সঙ্গী খুঁজে দেবো শূণ্যে!

শিশুকে মধুর মিথ্যা শেখানো পাপ
না হলে বলতাম দেবতা যা পারে না, মানুষ
তা পারে | আনন্দে পদানত জ্যোত্স্নাকে কাঁপিয়ে তীব্র
শেষ বলে উঠতে পারে, "কোথায় কোখায়
তুমি হে দেবতাশ্রেষ্ঠ ঈশ্বর? আমরা
পাথর, গহ্বর, ধূলো ছাড়া
কেন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না এখানে?"

.        ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
কোনো শিশুর প্রতি
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার আশ্বিন ১৩৭০ (সেপ্টেম্বর ১৯৬৩)
সংখ্যার কবিতা।
মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।

এসো, তোমায় আদর করি আদর করি
শরীর ছুঁয়ে বলি খোকন কেমন আছ?
তোমার কি তা কষ্ট হবে---অচেনা হাত!
বহুদিনের দিনান্তে যে জন্মদিন
হারিয়ে গেছে ফুরিয়ে গেছে পালিয়ে গেছে
অচেনা ফুল নবীন পাখি, অনেক দূর
জন্ম কার জাতিস্মর তেমনি ছিল ;
যেন এখন বুকের মাঝে ধরতে গিয়ে
ক্লান্ত হয়ে ব্যর্থ হয়ে যাবার আগে
হঠাৎ মা মা শব্দে যদি কেঁদেই ওঠো ;
তোমার মুখে শুনব আমি শুনব আমি
---দশজন্ম হারিয়ে যাওয়া মায়ের নাম।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
শেষ ডাক
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার আশ্বিন ১৩৭০ (সেপ্টেম্বর ১৯৬৩)
সংখ্যার কবিতা।
মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।

পাহাড়ে চিতার থাবা, উচ্চতার মাংসাশী সংহারে
জেগে ওঠে নদী, নারী, নীতি, সৌরব্যবহার। তুমি
তখনো নিসর্গ নও ওস্তাদ পয়ার কিংবা মাত্রাবৃত্তে লঘু ;
তবু যৌবন চুরমার করে যৌবন গম্ভীর করে
.                                মধ্যরাত্রে দেবতা বা দানবের মতো
“সমর, সমর, সমরেন্দ্র আছ?" বলে গোলাপের অবিশ্বাস
কেন তুমি ডেকে ওঠো, জেগে ওঠো পড়োশির স্বাস্থাহীন ঘুমের শ্মশানে।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
একটি নামহীন কবিতা
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সংখ্যার কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।



ছিল নীল, মেঘে ভরা, বর্ষণ তোমার
কোথায় হারিয়ে গেল চোখের সজলে!
তুমি কি চোখের কাছে এতদিনে সমস্ত যৌনতা
সাজালে পূজার ধূপে, গন্ধ পাই, এখনো স্মৃতির মতো
জন্মান্ধ দুঃখের মতো নিশ্বাসে নিশ্বাসে গন্ধ পাই

ভালোবাসা, তুমি ভালোবাসা।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
ভ্রমণকাহিনী
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত ““কৃত্তিবাস”” পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সংখ্যার কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।



তিনটি পথের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী মুখগুলি লিখে রেখে আসি।
তিনটি পথের কাছে একমাস সান্ধ্য ভ্রমণের ফোটোগ্রাফ জমা ছিল বলে
হায় স্মৃতি! তুমি স্মৃতি! বলতে-বলতে দশহাজার ভৌম কঠস্বর
জলোচ্ছ্বাসের মতন আমার নিদ্রার দুঃখ বন্ধুত্ব বিশ্বাস
.                ভাসিয়ে কখন আকাশের দিকে উঠে গেল।
কলকাতা থেকে বহুদূর তিন স্তব্ধতার মধ্যবর্তিতায়
অনেকগুলি সুখদুঃখ প্রেম ও বিরহ, ততোধিক
চায়ের পেয়ালা, চিনি কম নিয়ে গভীর তর্কের মব্যে আমি
ত্রিকালপুরুষ ঈগলের নীলের চিৎকার ডুবে যেতে দেখে
খাতার ফুটন্ত শব্দগুলিকে থামিয়ে
তিনটি পথের মোড়ে সমবেত ইচ্ছামৃত্যুর ভিতর
ছুটে গেছি ; কিন্তু তার আগেই আকাশ
জননীর মতো স্থির, শুধু স্বাস্থ্য-উদ্ধারের ছলে ভীষণ সতর্ক হাওয়া
এলোমেলো করে দিল চুল।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার মে ১৯৬৪ সংখ্যার কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।



এবার ভারতবর্ষে রাষ্ট্র আর সমাজের কাছে
নেমে এসে দাঁড়াবেন বুঝি ধর্মরাজ।

এবার ভারতবর্ষে মনুষ্যত্ববিরোধী উৎকোচে
শৃগালের রৈ রৈ দলসংঘবদ্ধতা চিৎকার
স্পষ্ট শোনা যাবে বাশবাগানের জমানো আঁধারে।

আমি নিস্পুহ যুগের মতো সারারাত জানলা খোলা রাখব ভাবি ;
আমি জানলা খুলে শুধুমাত্র প্যাঁচায় সাহসী ওই
নৈশ প্রেতলোকভরা দীর্ঘ দীর্ঘ লোলুপ উদ্ভিদে
জ্যোত্সনাতিরস্কার এনে দেখতে চাই কোন
অলীক ঈর্ষার শোক সমাধিক্ষেত্রের কাছে হতে পারে প্রস্তুত চণ্ডাল।

দেশ বা বিদেশে আজ ভারতবর্ষের
আত্মসংগঠনছলে এ-ধরন জাতীয়তাবাদী রক্তপাত
কেন ইতিহাসে যোগ্য পাতা পৃথক সাজাতে পারছে না, সেই
অন্বেষণ আমার বুকের মধ্যে এবার জাগাতে হবে জেনে,
চলি কবিতার মতো দূরে, কাশ্মীর থেকেও দূর
ব্যগ্র অমরনাথের শৈলচূড় বরফের হিম
দিল্লীর উত্তাপে চাই তৃষ্ণা মেটাবার জন্য জল করে নিতে।
আমার শিয়রে কোনো অদীন দণ্ডাজ্ঞা জেগে নেই ;
আমি ইচ্ছে হলে পাখিদের, শাপলাপাতার নিচে মৌরালার
ফুল ফোটানো বা ঝরানোর ছলে আমি
এনে দিতে পারি. বাগানের প্রয়োজনীয় বাঁতাস ;
---আমার জীবনে মনে কোনো জেল নেই।

হে ভারতবর্ষ, হায় ভারতবর্ষ, এ-রকম শোচনা
মনীষীর বাণী হয়ে আজ শুধু স্কুলপাঠ্য মুখস্থ অক্ষরে
বালকের মুখ ভরা দেবালয় নষ্ট করে, এ কি
আত্মহত্যা নয়, যৌবন, জাতির নামে
এ কি গানের সহজ কণ্ঠ চেপে ধরা নয়?

নালন্দায় সেবার আশ্বিনে আমি ক্ষমা খুঁজতে গিয়ে
আযত্ন জঙ্গলে ঘেরা বুদ্ধের পায়ের কাছে ফোটা এক ফুল
ভীষণ নিঃসঙ্গ তবু অনুতপ্ত দেখে বুকে তুলে নিয়েছিলাম।

চোখের লবণ তাকে করেছিল ম্লান,
সন্ধ্যার বাতাস তাকে করেছিল গান ;
যুগ থেকে যুগান্তের শব্দবিবর্তনে
বালকের কাছে কোনো মহিমার পাঠতেদ নেই।

মহিমা? মিনতি করি মহিমার কথা তুমি আর শিখিয়ো না।
বাবার মহিমা ছিল, পরীক্ষার আগে ইতিহাসে
নেপোলিয়নের ছিল কম কি মহিমা!

বালক ভালোই শেখে পরবশ “সদা সত্য কথাগুলি” বলে যেতে যেতে
কখন অস্থির গন্ধে শরীর চৌকস হয়,
.                        হঠাৎ হৃদয়ে লাগে গোলাপের জ্বালা ;
যৌবন সমস্ত জানে, জানে ওই যৌথ যৌনমন্ত্রণায় ভরা,
মুহূর্তপ্রবাসগুলি, মহিমারও চাই আজ তেমন প্রবাস।

কেন না মুদ্রিত হলে মন্ত্রীদের চরিত্রচর্চার
স্বাদু রিপোর্টের নেশা ইংলণ্ডের মতন দেশেও
রাজনীতি থেকে কত প্রিয় হতে পারে,
‘কিলার’, তুখড় বেশ্যা কয়েকবার ঊরুর ব্যাদানে
তুমি দেখিয়ে দিয়েছ কেন মানুষের মুক্তি নেই
মহিমার যুক্তি নেই টেলিগ্রামের মতো সুস্থ সাজানো অক্ষরে।

এ-বিষয়ে সংবাদপত্রের কিছু স্বাধীনতা ছিল
শুধু বালকের জন্য নয় --- ভারতের আত্মার পরুষ
প্রকৃত কোথায়? জীবনীর ছল মেখে যন্ত্রণার জ্বালা দিয়ে
তাকে স্পষ্ট গভীর জানানো গেলে, দেশ, কাল, সমসাময়িক
.                                                        বেদনা --- বিদ্রোহ

কিছুটা সাবধান হত ; গোলন্দাজ কামানের হাত
রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র সরিয়ে ক্রমশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতাদখলে
পর্যবসিত হত না, বিশেষত দক্ষিণ বা পূর্ব-এশিয়ার এ-উতরোল আগুনে

আরো একবার প্রয়োজন প্রকৃতির ঐশী সত্ত্বে নিজস্ব ক্ষমতাগুলি
ঝড়ে উদ্ভিদের দেহে, ক্ষিপ্ত জলে নদীর বন্যায়
মানুষকে তার সামগ্রিক স্থিতি আর ধ্বংস মধ্যবর্তী অনিশ্চিত ভূমি
ম্পষ্ট না দেখালে সূর্য কোনোদিন বুঝি
জনসাধারণভাবে তত উজ্জ্বল হবে না।
আমিও দেখব না চুম্বনের আগে মুখ
অচেনা রেখার ভিড়ে ভরে ওঠে কিনা? যেন রূপ
রচিত হয়নি শুধু ধর্মাধিকরণ কবিতার
প্রাণান্ত অক্ষরগুলি শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে শেষে বোঝা গেল
প্রেম কোনো জাতি নয়, বুঝি রাজনীতি, তাই শৃগালক্ষুধায়
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে ব্রিটেনের সঙ্গী আমেরিকা।

মনে হয় সংবাদপত্রের যুগ এইভাবে বিবেকের দৈনিক হত্যার
বিবরণ বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠে, ক্রমে
এক লাভজনক ব্যাবসা দাঁড়িয়ে গিয়েছে বলে
কবির সংবাদদাতা নিজস্ব সংকেতে
বিছ্যুৎবিক্ষোভ ছেড়ে, আকাশের কাছে ফের ফেরত পাঠায় ;
আর জানুময় মলিনতাগুলি সব ক্লেদের প্রমেহ ভরা গর্ভের উদ্যমে
অনৃত আঁধার এনে জন্মের শুদ্ধতা পেতে চায়।

জন্মদিন থেকে কান খোলা থাকে, থাকাই নিয়ম বলে বুঝি
মানুষ শুনতে বাধ্য মৃত্যুর সংবাদ,
চোখ খোলা আছে বলে দশ-কলাম বোল্ড-টাইপে

রাজনৈতিক হত্যার লাল পড়ে যেতে হবে।
আমি গত বছরের
প্রেস-ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত
ছবিটি দেখেছি --- এক শ্বেত পাদরি, গুলিতে আহত
নিগ্রোর দেহকে টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চাইছেন।
ক্যামেরার ও-রকম অবিস্মরণীয় উত্তরণ
দেখে সেই নিমন্ত্রিত ভিড়ের সন্ধ্যায়
আমি আফ্রিকার মতো একা, রুমালের অস্থির আড়ালে দুটি
দগ্ধ চোখ মুছে নিয়েছিলাম।
মনে হয়েছিল আরো একবার পৃথিবীকে নিশ্বাসের যোগ্য করে দিতে
সংবাদপত্রের যেন সঠিক ভূমিকা ছিল ; আজো যাকে রোজ
সুর্যবরণের ছলে পাখির ডাকের সঙ্গে খুলে পাঠ করি
সে কি জন্মের বিরুদ্ধযাত্রা, শুধু কলামে-কলামে খোঁজা নিজের কবর?
এবার ভারতবর্ষে রাষ্ট্র আর সমাজের কাছে
প্রকৃতির নিজস্ব ক্ষমতা ভূমিকম্প, জলে বন্যা, মেঘে বজ্র
অক্ষরে একত্র করে তাই বুঝি নেমে এসে দাঁড়াবেন দৃশ্যে ধর্মরাজ্জ।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
বোধন
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
অশোককুমার সরকারের সম্পাদনা ও সাগরময় ঘোষের সহসম্পাদনায় প্রকাশিত ১৩৬৮
(১৯৬১) সালের “শারদিয়া দেশ” পত্রিকার কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।



ভাঙো, চুরমার করো ওই তৃষ্ণাহীন শব্দের পাহাড়
এমন নিস্তব্ধ আমি বাংলাদেশ কখনো দেখিনি।
যত সুর গান হয় সব যেন শ্রদ্ধায় প্রাচীন
কবির নিদ্রিত বুক দগ্ধ করা প্রতিজ্ঞার নীরব প্রহার।
কোন আভিমান নেই, অন্ধকারে বিপরীত ভয়াল ভ্রমণে
হিংস্র কোন আবিষ্কার শরীরে চিহ্নিত আর করে না ফাল্গুন।
আজ ব্যবহৃত সব শব্দের ওপর অপলক
রয়েছে নিশ্চল বসে শতাব্দীর স্থবির শকুন।

আকাশ অম্লান উঁচু এত মৃতদেহের দ্বিধায়
এত স্মৃতি হে বিষাদ, নিসর্গে, নারীর প্রেমে : অথচ গরিমা
কখনো পারবে না ছুঁতে ততদূর স্থির উচ্চতায়
মেঘে রৌদ্রে অস্থির নীলিমা : শুধু তুমি প্রতীক্ষায় থাকো, তুমি
শিল্পের অদেখা দুঃখে চীৎকার করে ওঠো : তুমি
এত স্তব্ধ বাংলাদেশ কখনো দেখিনি এর আগে।

ভাঙো, চুরমার করো,
.                যদি ধ্বংসের ভেতরে কোন শব্দের দেবতা জাগে॥

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
ধ্বনির দূরত্বে
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
অশোককুমার সরকারের সম্পাদনা ও সাগরময় ঘোষের সহসম্পাদনায় প্রকাশিত ১৩৬৯
(১৯৬২) সালের “শারদিয়া দেশ” পত্রিকার কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।



হয়তো দেবতা পারে, আমাদের কণ্ঠে নেই বৃক্ষের সাহস
দাঁড়িয়ে থাকার মত বৎসর বৎসর প্রতারণা।
কোথায় রাজার রথ দূরত্বের দীর্ঘ অবেলায়
জাগাবে যুগল রেখা---আমি যখনি নিঃসঙ্গ থাকি
ভাঙি ডালপাল্লা, ফুল, সাজাই মুকুট
পাখির পালক গুঁজে প্রাণপণ রমণীয় করি : তবু আলো
যথেষ্ট ফোটে না বলে দেখা যায় না গুপ্ত ক্ষতগুলি।

তোমাকে শব্দের শ্রমে ধ্বনির দূরত্বে তবু কাছে চাই রাজা!
এখন বয়স ভীরু উদযাপিত উৎস থেকে রচিত উৎসাহে।
তুমি উদাসীন থাকো প্রেমে, প্রকৃতিতে, তুমি প্রতিটি ঋতুর
প্রত্যাবর্তনের পথে ধংস কর মনীষার অযুত অক্ষর।
আম পারবো না, জানি, পারবো না বৃক্ষের মতন
লক্ষ প্রত্যাশায় শ্যাম অন্তহীন পরাগে পল্লবে
বাতাসে, ব্যাপ্তির বৃন্তে উত্তরীয় খুলে নগ্ন দাঁড়াতে সম্মাট।

বাতাস, বাতাস, এত চতুর্দিকে বাতাসের গাঢ় তৃপ্তি তবু
শ্বাসকষ্টে আমি আজো একাকী, উন্মাদ।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর
*
শর্ত ছিল
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে সম্পাদিত “কৃত্তিবাস” পত্রিকার একবিংশ সংকলন ১৯৬৫ এর কবিতা।

মিলনসাগরে প্রকাশকাল - ২৮.১২.২০২০।


প্রথম শব্দটি লিখি---'রমণীয়’। কিন্ত তৎক্ষণাৎ
মনে পড়ে তোমার বুকের কাছে সর্ত ছিল যে আমি কখনো
রমণী অর্থে তা লিখতে পারব না। তাই
দুঘণ্টা পূজারী সেজে ধ্যানী বসে রইলাম। কিন্ত বসে থাকার পরেও
যখন অন্যান্য শব্দ আর সাজাতে এলো না স্বাধিকার। আমি
'রমণীয়' এই স্পর্শকাতর শব্দটি থেকে খুব সন্তর্পণে
'র’ অক্ষরটিকে কেটে লিখলাম ‘ক্ষ’। অর্থাৎ শব্দটি
‘ক্ষমণীয়' হয়ে উঠল প্রকাশ্যে তখন---যেমন শরীর বহু
নিয়োজিত অন্ধকারে ভালোবাসার বিবিধ উপলক্ষগুলি
শুধু সহ্য করে যায় অথচ জানে না
কখন যৌবন পারে শর্তহীন স্কটিকে ফোটাতে
দুচোখে ক্ষমার মতো ব্যবধানপ্রিয় শূন্যে নক্ষত্র-আঁধার ;
অথচ আঁধারে তখন নিকটতম মুখ আর দেখা যায় না, মুখে যে
রেখাগুলি ছিল তাদের ছন্দের মতো পড়া যায় না, কেবল
সান্নিধ্যশায়িত দুটি পৃথক হৃদয়
‘ক্ষমা’ ‘ক্ষমা’ অসমাপ্ত তৃষ্ণার সমান শব্দের অন্তিম দুঃখ উদ্বোধন করে।

.           ****************           
.                                                                            
সূচীতে . . .   



মিলনসাগর