চতুরঙ্গে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া।
খুব বেশি দিন বাঁচবো না আমি শস্য ফুটলে আমি নেবো তার মুগ্ধ দৃশ্য নিজস্ব গৃহে প্রজা বসিয়েছি প্রায়ান্ধকার কিছু কিছু নেবো কিছুদিন বেশি বাঁচতে চাইনা |
এই অপরূপ পৃথিবী, সেদিকে যাবো না মিথ্যা বাসনা যেমন চঞ্চল তার নিশানা জানি না রমণী কখন প্রিয় করে হা রে হৃদয় জানে কি ? তবু বেশি দিন বাঁচবো না আমি বাঁচতে চাই না |
শুধু যা দৃশ্য, অন্তঃস্থল যে খোঁড়ে খুঁড়ুক ভাসমন নদী ভাসাও নৌকা ভাসাও নৌকা যৌবন যায়, চ’লে যাবো আমি ; চাষা বা ডুবুরি ক্ষেতে সংসারে অক্ষয় বাঁচো দৃঢ় জলৌকা |
আহা বেশি দিন বাঁচবো না আমি বাঁচতে চাই না কে চাইবে রোদ আচিতা অনল, কে চিরবৃষ্টি ? অনভিজ্ঞতা বাড়ায় পৃথিবী, বাড়ায় শান্তি প্রাচীন বয়সে দুঃখশ্লোক গাইবো না আমি গাইতে চাই না |
যখন বৃষ্টি নামলো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া।
বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল নেই নিকটে --- হয়তো ছিলো বৃষ্টি আসার আগে চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে পোড়োবাতির স্মৃতি ? আমার স্বপ্নে-মেশা দিনও ? চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন |
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে কিন্তু তুমি নেই বাহিরে --- অন্তরে মেঘ করে ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে !
যেতে যেতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া।
যেতে-যেতে এক-একবার পিছন ফিরে তাকাই, আর তখনই চাবুক আকাশে চিড়, ক্ষেত-ফাটা-হাহা-রেখা তার কাছে ছেলেমানুষ ! ঠাট্টা-বট্ কেরা নয় হে যাবেই যদি ঘন-ঘন পিছন ফিরে তাকানো কেন ?
সব দিকেই যাওয়া চলে অন্তত যেদিকে গাঁ-গেরাম-গেরস্থালি পানাপুকুর, শ্যাওলা-দাম, হরিণমারির চর— সব দিকেই যাওয়া চলে শুধু যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকানো যাবে না তাকালেই চাবুক আকাশে চিড়, ক্ষেত-ফাটা হাহা-রেখা তার কাছে ছেলেমানুষ ! ঠাট্টা-বট্ কেরা নয় হে যাবেই যদি ঘন-ঘন পিছন ফিরে তাকানো কেন ?
হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।
হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিলো ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন কতকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে . ওই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি আমি দেখেছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে . বকের মতো নিভৃতে মাছ এমন অসম্ভব রহস্যপূর্ণ সতর্ক ব্যস্ততা ওদের— আমাদের পোস্টম্যানগুলির মতো নয় ওরা যাদের হাত হতে অবিরাম বিলাসী ভালোবাসার চিঠি আমাদের . হারিয়ে যেতে থাকে |
আমরা ক্রমশই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমরা ক্রমশই চিঠি পাবার লোভে সরে যাচ্ছি দূরে আমরা ক্রমশই দূর থেকে চিঠি পাচ্ছি অনেক আমরা কালই তোমাদের কাছ থেকে দূরে গিয়ে ভালোবাসা-ভরা চিঠি . ফেলে দিচ্ছি পোস্টম্যানের হাতে এরকমভাবে আমরা যে-ধরনের মানুষ সে ধরনের মানুষের থেকে . সরে যাচ্ছি দুরে এরকমভাবে আমরা প্রকাশ করতে যাচ্ছি নিজেদের আহাম্মুক দুর্বলতা . অভিপ্রায় সবই আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখতে পাচ্ছি না আর বিকেলের বারান্দার জনহীনতায় আমরা ভাসতে থাকছি কেবলি এরকমভাবে নিজেদের জামা খুলে রেখে আমরা একাকী . ভেসে যাচ্ছি বস্তুত জ্যোত্স্নায় অনেকদিন আমরা পরস্পরে আলিঙ্গন করিনি অনেকদিন আমরা ভোগ করিনি চুম্বন মানুষের অনেকদিন গান শুনিনি মানুষের অনেকদিন আবোল-তাবোল শিশু দেখিনি আমরা আমরা অরণ্যের চেয়েও আরো পুরোনো অরণ্যের দিকে চলেছি ভেসে অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন তেমনই ভুবনছাড়া যোগাযোগের দেশে ভেসে চলেছি কেবলই— হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছে ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন কতকালের পুরনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছ অই . হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি ||
আমরা সকলেই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া।
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের-গল্প বলে গেলো সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের উঠতে বললো না কেবল বললো বসে বসে শোনো তোমরা তোমাদের সেই দিনগুলি যা তোমরা পিছনে ফেলে রেখে এসেছিলে . তা কেউ কুড়িয়ে নেয়নি আর তুমি টাকা হারিয়ে এসো, পিছন থেকে কুড়িয়ে নেয় অনেকে পথ হারিয়ে এসো তুমি, সে-পথেই সারিবদ্ধ পথিক চলেছে মৃতদেহ ফেলে রেখে এসো তুমি, --- শকুন শৃগালে ভোগ করেছে মাংস দরজা খুলে রেখে এসো তুমি—ত্রস্ত মেয়েমানুষ নিয়েছে পিতলের বাসন বাড়ি ফেলে রেখে এশো তুমি--- সমস্ত নৈরেকার, সকলি নৈরেকার ! তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা— . সবই কুড়িয়ে নেবার জন্যে আছে কেউ তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবে না তোমরা আর | তোমরা যতো যাবে ততোই যাবে মৃত্যুর দিকে বোঝাবে সকলে – ঐ তো জীবন, ঐ তো পূর্ণতা, ঐ তো সর্বাঙ্গীন সর্বাবয়ব ঐ তো যাকে বলে সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, ধ্যান, পরমার্থ বিষাদ—
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের গল্প বলে গেলো তারা কোথা থেকে পেয়েছো বলে গেলো না স্বীকার করলো না তারা পথ থেকে চুরি করেছে কিনা আমাদের . সেই হারানো স্বপ্নগুলি, স্মৃতিগুলি তারা আমাদের বলে গেলো হারানো দিনের সেই অনুপম স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি আমরা অনুভব করলাম আবার—সেইসব হারানো গল্প . যা আমরা এতাবত্কাল হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি বনে-প্রান্তরে পুরানো খাতার শ্লেটে রাসতলায় নদীসমুদ্রে বেলাভূমিতে পথে ডালে-ডালে টকি হাউসে হারিয়ে এসেছি ইস্টিশানে খেয়াঘাটে কলকাতার গ্রামে গ্রামে কারুর চুলে কারুর মুখে চোখে কারুর অঙ্গীকারে— হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি – ফিরে পাবো না . জেনে কখনো আর কখনো ফিরে পাবো না সেইসব দিন যা ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্রে হেমন্তে ভরা সেইসব বাল্যকালের নগ্নতার কান্নার পয়সা-পাবার-দিন . ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর কাগজের নৌকা ভাসাবার দিন উঠানের . ক্ষণিক সমুদ্রের কলরোলে ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর সেইসব জ্যোত্স্নার ঝরাপাতার কথকতার দিন ফিরে পাবো না আর | সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের সেইসব হারানো দিনগুলির . কথা বলে গেলো সকালবেলা তাই আমাদের কোনও কাজ হয়নি করা আমরা অনন্তকাল এমনি চুপচাপ হারানো দিনের গল্প শুনছিলাম . পুলিশের মতো আমরা আমাদের কর্তব্য স্থির করছিলাম পুলিশের মতো আমরা ভাবছিলাম সেইসব হারানো দিনগুলি ফিরে পাবার জন্য . লাকি মিতাকে পাঠিয়ে দেখবো একবার আমরা বসে বসে এলোমেলো উত্তাল সম্ভাবনার স্বপ্নে এমনি করে . ব্যস্ত রাখছিলাম আমাদের আমরা এমনি করে সময়ের একের পর এক চড়াই-উৎরাই হচ্ছিলাম পার এমন সময় তারা বললো—‘গাড়ি’ এসে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো – এখানে থাকলে বাঘে খাবে তোমাদের’ আমরা তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে . ভবিষ্যৎ-গাড়ির দিকে চলে গেলাম আমরা সকলেই এখানে বাঘের জিহ্বা এড়িয়ে গিয়ে ওখানের বাঘের . জিহ্বার দিকে চলে গেলাম |
অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডঃ ঝুমা রায়চৌধুরী সম্পাদিত “প্রিয় কবিতা-২” থেকে নেওয়া।
দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে চরের বালিতে তাকে চিকিচিকি মাছের মতন মনে হয় মনে হয় হৃদয়ের আলো পেলে সে উজ্জ্বল হতো |
সারারাত ধরে তার পাখাখসা শব্দ আসে কানে মনে হয় দূর হতে নক্ষত্রের তামাম উইল উলোট-পালোট হয়ে পড়ে আছে আমার বাগানে |
এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন পৃথিবীর সমস্ত রঙিন পর্দাগুলি নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো শেফালির চারা গোলাবাড়ি থেকে কিছু দূরে রবে সূর্যমুখী-পাড়া এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন |
যদি কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকো ভালো যদি কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানালার আলো দেখে যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে— আমাকে যাবার আগে বলো তা-ও, নেবো সঙ্গে করে |
ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে |