কবি সুশীল মালতীর কবিতা |
বালিকা-বাসনা সুশীল মালতী কেন জোছনা সাগরে ডুবে তুলিনা তারকা ফুলে অঞ্চল ভরিয়া লোয়ে আসিব এ গৃহকুলে | গাঁথিয়া চিকণ হার হরষে পরিব গলে, কোথা পথ ? কার সাথে যাব ও গগন তলে | কাড়িয়া চাঁদের হাসি ও হাসি ধরিব আমি, এসহে সুধাংশুনিধি, আমার ভূতলে নামি | কুসুমের পরিমল কোথা বা লুকায়ে থাকে, লব হরি কেমনেতে মাখিব উরসে তাকে | ধরিব ভ্রমর দুটী কাণেতে দোলাব দুল, বালা হার সিঁতি তরে জোনাকী জ্বলিয়া নেবে, কেমনে ধরিব আমি কে মোরে শিখায়ে দেবে | তটিনী তরঙ্গমালা ছেনিয়ে করিব মল, করে তুলে ধরিলে হায় কেন হয় বিঞ্চল | সূক্ষ্ণ কাল নাগিনীরে কবরীতে জড়াইব, গর্জ্জিয়া দংশিবে সে যে কেমনে তাহারে নিব | চপলা লতিকা ধরি বলয় গড়ায়ে পরি, সাধ আছে, শক্তি নাই কেমনে তাহারে ধরি | মেঘেরে কাটিয়া তায় করিব মধুর সাটী অঞ্চলের ভাগে দিব প্রভাতী অরুণ আঁটি | কেমনে প্রভাতী রবি ধরিব সে কোন পথে ? যেতে হবে কার সনে সে কেমন পুষ্পরথে | এত সুন্দরতা সনে সদাই মিশিয়ে রব লো সখি ! বলনা মোরে পাব কোথা, কারে কব ? শ্যামল লতিকা ঢাকা নিকুঞ্জে করিব বাস, ফুটিবে বিটপী পরে নিতি ফুল রাশ রাশ | প্রহরী পাপিয়া পিক রহিবে তমাল পরি, নদী বুকে কুসুমিত, সাজান রহিবে তরী | কর্ণধার হব তায় প্রভাতে, মধুর সাঁজে, গাহিয়া মধুর গীতি ভ্রমিব তটিনী মাঝে | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
যৌতুক সুশীল মালতী ( ১ ) আত্মপর পুরজন, ছল ছল দুনয়ন, ক’নে বরে আশীষে এসে রাজবেশী বর পাশে, শোভি অলঙ্কার বাসে, যায় মম দু’আঁখি ভেসে | ( ২ ) আসিলেন পিতা মোর, হৃদয়ে যাতনা ঘোর, স্নেহে মম দু’পাণি যার ; বরের লইয়া কর, যাতনা-জড়িত স্বর, চারি কর মিলিত করি | ( ৩ ) “আমার এ আত্মজারে, বিভু ইচ্ছা অনুসারে, আজি অপি তোমার করে ; দীর্ঘায়ু নির্ব্যাধি হও, মম জননীরে লও, রাখ ভক্তি জগদীশ্বরে |” ( ৪ ) জননীর আঁখি ধার, থামেনাক আজি আর, কত আকুলিত হৃদিতল ; আনন্দ আলয়ে কেন , অশ্রু বরষণ হেন, সুখ সনে মিলিত এ জল | ( ৫ ) মা----- . জন্মশোধ একেবারে, অর্পিলেন তনয়ারে, নিঃসম্পর্ক জাগতিক জীবে ; পৌরাণিক প্রথা স্মরি, রহিলেন ধৈর্য্য ধরি, গিরিরাণী উমা অর্পি শিবে | ( ৬ ) মম বুক ভেসে যায়, হইনু পাগলী প্রায়, কান্না দেখে কেঁদে সারা পতি ; এত রোদনেতে হায়, কষ্ট বুঝি বিধাতায়, ( তাই ) জন্মবাসে চির বাসী আজি এ মালতী | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
বালিকার ফুলশয্যা সুশীল মালতী ( ১ ) ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন, মধুর নিশীথ কোলে, কে ডাকিল মধু বোলে, চমকি সভয়ে আমি শিহরি কেমন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ২ ) বুকে মুখে চোখে ফুল সুবাসে করে আকুল, ঘুমে আঁখি ঢুল ঢুল মেলি দুনয়ন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৩ ) পুষ্পময় সে মন্দির, পতিদেব সশরীর, মধু আলো কৌমুদীর সুন্দর কেমন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৪ ) যতন কহা’তে কথা, পান বুঝি মন ব্যথা, করিলাম নির্দ্দয়তা “হু না” বিসর্জ্জন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৫ ) নীরবে পোহালে রাতি, ফুটিল রবির ভাতি, কোথা স্বপনের সাথী একাত এখন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৬ ) প্রভাতে শয্যায় একা, কারেও না গেল দেখা, একা আমি দু’করেতে মুছিনু নয়ন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৭ ) জীবনের এ অধ্যায়, স্বপন সমান হায়, সে সুখ সোহাগ বায় না হোলে স্পর্শন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৮ ) পূর্ণ প্রাণ প্রেম রাশি, পদে পোড়ে হল বাসি, বুঝিতে নারিনু, ছিনু জড়ের মতন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ৯ ) গ্রহণ হোলোনা আর, দান কটু ব্যবহার, অশ্রুজল হোল সার, সারা সম্মিলন, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | ( ১০ ) এমন নিয়তি সই, কোথাও দেখিনি কেউ, ফুটিত ফুটিবে খই আজি অকারণ, ফুলের শয্যায় শুয়ে দেখিনু স্বপন | . ************************* . সূচি মিলনসাগর |
বালিকা-বৈধব্য সুশীল মালতী ( ১ ) এল শ্যাম সুমধুর শরৎ সুন্দর----- সেফালি চামেলি ফোটে, মধু সমীরণ ছোটে, শ্যামল প্রতিভাটুকু লতিকা ভিতর ; সাজাইয়ে ফুলপাতি, ধরণী হরষে মাতি, প্রকৃতির গলে ধরি হাসে মনোহর | ( ২ ) সারাটা বরষ পরে, সন্তানের ঘরে ঘরে, আসিলেন নগবালে শৈলসূতা শিবে ; জননীর আগমনে, শুভদিনে শুভক্ষণে, সুখানন্দ উপভোগ করে বিশ্বজীবে | ( ৩ ) সুখ শান্তি প্রাণে লয়ে. পিতার ভবনে রোয়ে, বিলাসের দ্রব্য কত কিনিতে হরষে ; দিনে দিনে দিন গেল, ক্রমশঃ পঞ্চমী এল, কত আশা বাঙ্গালীর সারাটা বরষ | ( ৪ ) পঞ্চমীর দিনে হায়, পিতা পাগলের প্রায়, মাতারে শোনান এক ভীষণ পত্রিকা লেখা আছে সেই পত্রে, শুধু তিন চারি ছত্রে, শয্যাগত পতি মম হ’য়ে বিসূচিকা | ( ৫ ) যাহ আমি সেইক্ষণে, “বিজনেরে” ল’য়ে সনে, কেমন উধাও মন নিরানন্দময় ; গিয়ে যাহা নেহারিনু, অন্তরেতে শিহরিনু, যাতনা নেহারি দুঃখে ভরিল হৃদয় | ( ৬ ) গৃহপূর্ণ বহুলোকে, বারেক হেরিয়া চোখে, ভগ্নহিয়া অশ্রু-চোখে বাহিরে আসিয়ে ; মনে পড়ে কাতরতা, জাগে মনে ঘোর ব্যথা, কাঁদিলাম দরদর নীরবে বসিয়ে | ( ৭ ) কতই ভিষক হায়, আসে দেখে চ’লে যায়, আসিলেন পিতা মম উন্মাদ সমান ; আসিলেন ভগ্নী ভ্রাতা, বিষাদে ভরিয়ে মাতা, চিন্তে ভয়ে কাঁপিতেছে সবার পরাণ | ( ৮ ) শ্বশ্রুমাতা লোয়ে মোরে, বসালেন করে ধ’রে, পীড়িত ব্যথিত পতি চরম শয্যায় ; ফুটন্ত গৌরব রবি, অস্ত যায় শেষ ছবি, সংসার সমাজ হায় রয়েছে আশায় | ( ৯ ) আহা সে যে কি চাহনি, কি সাধ্য তব লেখনি ! বর্ণিবারে দৃষ্টি তাঁর নীরব কথন, মম এ পাষাণ প্রাণ, ফেটে হোলো খান খান, মর্ম্মরক্ত অশ্রুরূপে বর্ষে দুনয়ন | ( ১০ ) লেখনী য়ে পড়ে খসি, ( আমি কি কাঁদিব বসি ! ) পূর্ণ বর্ষ ক্ষুদ্র শিশু কুমার “বিজন” এক পা, এক পা, কোরে, উপাধান করে ধ’রে, মা মা কোরে ডাকে, আধ সে বচন | ( ১১ ) কাঁদিয়া হুকর তুলি, সে রোগ যাতনা ভুলি, করস্পর্শ করিলেন বিজনের পিঠে ; ঘোর যাতনায় র’ন, মাঝে মাঝে কথা কন, “জল জল” মহা তৃষা মিনিটে মিনিটে ( ১২ ) সারা দিবা নিশা গত, যাতনা বাড়িছে তত, দ্বিতীয় দিবসে আসি দেব “বন্ধুবর” খুলি হৃদি উজ্জ্বলতা, দেখান স্নেহ মমতা মহা সেবা সযতনে বসি অতঃপর | ( ১৩ ) আবার রজনী এল, আবার প্রভাত হোল, দুই দিনগত এবে তৃতীয় দিবস ; কাটিল তৃতীয় দিন, দিনে দিনে তনু ক্ষীণ, চতুর্থ দিবস এল বিকট কর্কশ | ( ১৪ ) কড় কড় ভীমনাদে, ঘন বৃষ্টি ধারে কাঁদে, অষ্টমী রজনী ভোর পোহায় পোহায়; অঘোরে ঘুমায়ে থাকি, হবে হেন, জানি বা কি ? ভ্রাতা মম ডেকে তুলে আনেন ত্বরায় | ( ১৫ ) কি করুণ ঊর্দ্ধ আঁখি, দারুণ যন্ত্রণা মাখি, তারপর কি লিখিব ? লেখনী অচল ; সকলে বসিয়া পাশে, পূর্ণচন্দ্র রাহুগ্রাসে, ঘন ঘন শ্বাস, দেহ নিথর নিচল | ( ১৬ ) তারপর, তারপর, ( থর থর কাঁপে কর ) হাহাকার ভীমধ্বনি শুনিনু কেবল ; নবীন পিঞ্জর পড়ি, পাখী তারা গেছে উড়ি, শ্বশ্রু মাতা পাগলিনী পড়ি ধরাতল | ( ১৭ ) আমি কোথা, আমি কই, আমিত সেখানে নই, ভেঙ্গে গেল, যেন এক মধুর স্বপন ; বিষাদে নিশ্বাসে আসি, প্রাণেতে রহিল ভাসি, চেয়েছিনু ভয়ে ধীরে মুদিনু নয়ন, ( মনে পড়ে অতীতের সে দিন ভীষণ | ) . ************************* . সূচি মিলনসাগর |