সাহিত্যকর্ম এবং কবিতা - সূচিতে ফেরত
রামমোহনের প্রধান পরিচয় সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মনায়ক রূপে | সমাজ ও ধর্ম বিষয়ক আলোচনার
প্রয়োজনেই তাঁর লেখার সূত্রপাত | তিনি ফার্সি, ইংরেজী এবং বাংলা, এই তিন ভাষাতেই রচনা করে
গেছেন | তাঁর প্রথম গ্রন্থ "তুহফাৎ-উল-মুত্তহাহিদিন" (১৮০৩-০৪) ফার্সিতে রচিত এবং এর ভূমিকা লেখা
হয়েছিল আরবীতে | এখানে তিনি বহুদেববাদ ও পৌত্তলিকতার সমালোচনা করেন |
তাঁর হাতে বাংলা গদ্য ধর্মালোচনা এবং সমাজ-সংস্কার বিষয়ক তর্ক বিতর্কের বাহন হয়ে উঠেছে |
তাঁর গদ্য শিল্পীর গদ্য নয়, কর্মীর গদ্য | তাঁর বাংলা রচনায় অনুবাদ সাহিত্যে আছে "বেদান্ত গ্রন্থ" (১৮১৫),
"কেন", "ঈশ", "কঠ", "মাণ্ডুক্য" ও "মুণ্ডক" উপনিষদের অনুবাদ (১৮১৬-১৭) | তর্ক বিতর্কমূলক রচনায় আছে
"ভট্টাচার্যের সহিত বিচার" (১৮১৭), "গোস্বামীর সহিত বিচার" (১৮১৮) | একদিকে হিন্দু রক্ষণশীলদের সাথে
শাস্ত্রীয় বিতর্ক, অন্যদিকে খ্রিস্টিয় মিশনারিদের সাথে সংগ্রাম --- এই দুই প্রয়োজনেই তাঁর রচনার বিকাশ |
ইংরেজীতে লিখেছিলেন যীশু খ্রিস্টের উপদেশাবলী নিয়ে "The Precepts of Jesus" (1820) | সহমরণ প্রথার
নিবারণে রচনা করেছেন "সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ" (১৮১৮, ১৮১৯), রামমোহনের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা | "পাদরি-শিষ্য সংবাদ" (১৮১৬) রামমোহনের ব্যঙ্গ ও কৌতুকময় রচনা |
রচনা করেছেন "গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ" (১৮৩৩) নামে একটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ |
রামমোহন অনেক গান রচনা করেন | সেগুলি "ব্রহ্ম সংগীত" (১৮২৮) নামে সংকলিত হয় | ব্রাহ্ম সমাজে
প্রচলিত যেসব গান পরে "ব্রহ্ম সংগীত" নামে একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় রচনা রূপে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করে,
তার সূচনা হয় রামমোহনের রচনায় | আমরা আধুনিক ভারতবর্ষের জনক রাজা রামমোহনের সেই ব্রহ্ম
সংগীত থেকে কয়েকটি গান এখানে তুলে দিচ্ছি |
মিলনসাগরে এই পাতা কবি রাজা রামমোহন রায়ের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ।
উত্স -
দিলীপ কুমার বিশ্বাস, বাংলার মনীষা (প্রথম খণ্ড), শরৎ পাবলিশিং হাউস,
ডঃ শিশির কুমার দাশ, সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩।
কবি রাজা রামমোহন রায়ের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন।
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৭.২০১১।
এই পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১১.৬.২০১৮।
শ্রীনবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের "সঙ্গীত মুক্তাবলী" গ্রন্থের ১৯টি ব্রহ্মসঙ্গীত সহ পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ২৬.৫.২০২২।
দুর্গাদাস লাহিড়ীর “বাঙালীর গান” গ্রন্থের ৯টি ব্রহ্মসঙ্গীত সহ পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ২৮.৫.২০২২।
...
অধিকারের লড়াই - সূচিতে ফেরত
এত সব কাজের মধ্যেও রামমোহন দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন |
সেই সময় জুরি অ্যক্টের অন্তর্গত, বিচার ব্যবস্থায়, হিন্দু মুসলমানের মধ্য থেকে জুরি নির্বাচন করা হত না |
১৮২৬ সালে তিনি হিন্দু মুসলমান উভয়পক্ষের হয়ে তত্কালীন জুরি অ্যাক্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এক
দরখাস্ত করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে | হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের থেকে জুরি নির্বাচনের দাবী এতে করা
হয়েছিল |
পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের পক্ষে এবং বহু বিবাহের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন | তাঁর
ব্যক্তিগত উইলে তিনি শর্ত রেখেছিলেন যে তাঁর পুত্রদের মধ্যে কেউ এক স্ত্রী বর্তমানে আবার বিবাহ করলে
সে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন |
তাঁর ইংল্যাণ্ড সফর কালে ব্রিটিশ সংসদ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ভারতের রাজস্য বিভাগ এবং বিচার
বিভাগীয় শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে সাক্ষ্য দেবার জন্য | এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ১৮৩২ সালে ইংল্যাণ্ড থেকে
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করেছিলেন | সেখানে সে সময়কার ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থায়, ভারতীয় কৃষককূলের
ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কথা তিনি স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছিলেন | তাই, বিশ্বের দরবারে অসহায় ভারতীয়
কৃষককূলের ঐতিহাসিক প্রথম মুখপাত্র রামমোহনই |
রাজা রামমোহন রায়
জন্ম গ্রহণ করেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার খানাকুল-
কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী রাধানগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ
পরিবারে | তাঁদের আদি নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় এবং
কৌলিক পদবী ছিল "বন্দ্যোপাধ্যায়" | রামমোহনের অতিবৃদ্ধ
পিতামহ পরশুরাম অথবা রামমোহনের বৃদ্ধ পিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র
প্রথম নবাব সরকারের চাকুরী গ্রহণ করেন | এই সরকারী চাকরি
গ্রহণের পর থেকেই তাঁরা "বন্দ্যোপাধ্যায়" পদবীর পরিবর্তে
নিজামত প্রদত্ত "রায়" উপাধি দ্বারা পরিচিত হলেন |
রামমোহনের পিতামহ ব্রজবিনোদ যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে নবাব আলিবর্দি খাঁর অধীনে চাকরি করেন | মুঘল
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এর ভাগ্য বিপর্যয়ের পূর্বে ব্রজবিনোদ সম্রাটকে যথেষ্ট সাহায্যও করেছিলেন |
ব্রজবিনোদের পঞ্চম পুত্র রামকান্তের দ্বিতীয়া পত্নি তারিণী দেবীর এক কন্যা ও দুই পুত্রের কনিষ্ঠ পুত্র
রামমোহন | রামমোহনের মাতামহ শ্যাম ভট্টাচার্য ছিলেন শ্রীরামপুরের চাতরা পল্লীর অধিবাসী এবং শাক্ত-
তান্ত্রিক সম্প্রদায়ভুক্ত পুরোহিত | তাই রামমোহন জন্মসূত্রে বাংলার দুই প্রভাবশালী ধর্মীয় ঐতিহ্যেরই
উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন |
পিতা রামকান্ত রায় সিরাজ-উদ-দৌলার অধীনে কিছুকাল চাকরি করার পর অবসর নিয়ে নিজগ্রাম
রাধানগরে এসে বসবাস করতে থাকেন | ১৭৯২ সালে তিনি সপরিবারে পার্শ্ববর্তী গ্রাম লাঙ্গুলপাড়ায় তাঁর
নবনির্মিত বাড়িতে উঠে আসেন | ১৭৯৬ সালে তাঁর অধিকাংশ স্থাবর সম্পত্তি তাঁর তিনপুত্র জগমোহন,
রামমোহন ও রামলোচন-এর মধ্যে ভাগ করে দেন | রামমোহনের ভাগে পড়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোর
বাড়িটি এবং দাদা জগমোহনের সঙ্গে যৌথভাবে লাঙ্গুলপাড়ার বাড়ি | ১৭৯৭ সালে রামমোহন কলকাতায়
তেজারতি ও কোম্পানির কাগজের ব্যবসা শুরু করেন | তিনি স্বোপার্জিত অর্থে ১৭৯৯ সালে বর্ধমান জেলায়
গোবিন্দপুর ও রামেশ্বরপুর নামক দুটি তালুক কিনেছিলেন | ১৮১০ এর মধ্যে তিনি আরও চারটি পত্তনী
তালুক কেনেন | ১৮১৪ সালে তাঁর লাঙ্গুলপাড়ার বাড়ির ভাগ লিখে দেন তাঁর ভাগ্নে গুরুদাস মুখোপাধ্যায়কে
এবং ১৮১৭ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রাম রঘুনাথপুরে নতুন বাড়ি করে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন |
তাঁর মহত্ত্ব এই যে তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন যে দেশে নবপ্রতিষ্ঠিত বিদেশী (ইংরেজ) শাসনের পেছনে
আধুনিক-জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রয়োগবিদ্যা সমৃদ্ধ এক বিরাট সভ্যতা ক্রিয়াশীল এবং ভারতবর্ষকে আধুনিক যুগে
পদার্পণ করতে তার নিজস্ব আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলিকে নবাগত এই জ্ঞানবিজ্ঞানের নিকষে
পরীক্ষা করে কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জনের মাধ্যমে যুগোপযোগী এক ভবিষ্যৎ-মুখী জীবনদর্শন গড়ে নিতে হবে |
তাই তিনি ইংরেজদের অধীনে ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী চাকরি গ্রহণ করেন,
নিজস্ব ব্যবসা ও সম্পত্তি থেকে যথেষ্ট আয় থাকা সত্ত্বেও | ১৮১৫ সালে তিনি ইংরেজ সরকারের দূত রূপে
ভুটান পরিদর্শন করেন |
১৮২৯ সালে তত্কালীন ব্রিটিশ পেনশন ভোগী দিল্লীর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর, তাঁকে ইংল্যাণ্ডে দূত
নিযুক্ত করেন | এই উপলক্ষ্যে সম্রাট তাঁকে "রাজা" উপাধি দান করেন এবং ইংল্যাণ্ডে কতৃপক্ষের সঙ্গে
সম্রাটের পেনশন বৃদ্ধির বিষয়টি আলোচনার ভার তাঁর উপর ন্যস্ত করেন | তাঁর চেষ্টায় সম্রাটের পেনশন ৩
লক্ষ টাকা বৃদ্ধি পায় |
ভগ্ন স্বাস্থ নিয়ে কলকাতা থেকে ১৯ নভেম্বর ১৯৩০ যাত্রা শুরু করে ৮ এপ্রিল ১৮৩১ তিনি ইংল্যাণ্ড পৌঁছান |
সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলে তাঁর জীবনাবসান হয় | তাঁকে ব্রিস্টলের
আর্নস ভ্যালে সিমেটারিতে সমাধিস্থ করা হয় | পরবর্তীতে ব্রিটেনে বসবাসী ভারতীয়রা তাঁর সমাধিতে একটি
স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন |
শিক্ষা - সূচিতে ফেরত
বাল্যকাল থেকেই রামমোহনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল | তাঁর
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রাধানগর গ্রামের পাঠশালায় | এর পর তিনি সেখানেই সেকালের প্রথানুযায়ী ফার্সী
শিক্ষা করেন | পরে ইসলামীয় বিদ্যায়, বিশেষতঃ আরবী ভাষা ও মুসলিম শাস্ত্রে উচ্চ অধিকার অর্জন করেন
তখনকার ইসলামী বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান পাটনায় | সংস্কৃত শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায় এবং তা উত্তরকালে
পরিণতি লাভ করে কাশীতে | কৈশোর ও যৌবনে পাটনা ও কাশীতে শিক্ষালাভের প্রমাণ পাওয়া যায় নানা
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমার নথিপত্র থেকে | রামমোহনের শিক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল টোল-চতুষ্পাঠি-
মক্তব-মাদ্রাসায়, তত্কালীন বিশুদ্ধ ভারতীয় পাঠ্যক্রমের উপর, ইংরেজী ভাষা ও পাশ্চাত্য বিদ্যার রাজ্যে
প্রবেশের আগে | ফলে তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় শাস্ত্রে ও ঐতিহ্যে অসাধারণ অধিকার
অর্জন করেছিলেন |
ধর্মীয় প্রভাব - সূচিতে ফেরত
পাটনায় ইসলাম ধর্মের কোরাণ, হাদিস পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন করার ফলে বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস
জন্মায় | ইসলামের যুক্তিবাদী মগজিলা ও কট্টর বিশুদ্ধিমার্গী মুত্তহাহিদিন সম্প্রদায়ের মতবাদও তাঁকে যথেষ্ট
প্রভাবিত করে | সূফী মরমীয়তাবাদের প্রতি তাঁর অনুরাগও উত্তরোত্তর গভীর হয়ে ওঠে | এর ফলে হিন্দু
ধর্মের মূর্তিপূজায় তাঁর বিশ্বাস চলে যায় | এই নিয়ে পিতার সঙ্গে মতবিরোধ বাড়তে থাকে ১৯৮৮
সালে তিনি গৃহত্যাগ করেন | পরবর্তি তিন চার বছর কেটেছিল ভ্রমণে | এই সময় তিনি নাকি উত্তর ভারতের
নানা স্থান ও তিব্বত পর্যটন করেছিলেন | এর পর পিতার আহ্বানে আবার গৃহে ফিরে আসেন | এর পর
তিনি কাশিতে হিন্দু শাস্ত্রের মোক্ষশাস্ত্র, বেদান্তের প্রস্থানত্রয় উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতা, ভাষ্যটীকা সমেত
অধ্যয়ন করেন | ফলে তাঁর প্রত্যয় জন্মায় যে ঈশ্বরসত্তার অখণ্ডতা এবং ঐক্য প্রতিপাদনই হিন্দুধর্মের
উদ্দেশ্য এবং প্রচলিত প্রতিমা পূজা সেখানে উত্তর কালের এক প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র |
সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ - সূচিতে ফেরত
হিন্দু বিধবা নারী তাঁর মৃত পতির চিতায় জীবন্ত অবস্থায় স্বেচ্ছায় সহমরণে যাবেন, এই প্রাচীন প্রথাটিই
মধ্যযুগীয় হিন্দুসমাজে, বিশেষত বাংলায়, সতীদাহ প্রথা নামে জাঁকিয়ে বসেছিল | রামমোহন এই অমানবিক
প্রথাটিকে নির্মূল করার চেষ্টায় এক সফল সংগ্রাম করেছিলেন |
ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি এই কুপ্রথার উপর আগেই পড়েছিল, কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেবার আগে তারা
এ বিষয়ে শাস্ত্রীয় মত সংগ্রহ করা শুরু করেছিলেন | ১৮০৫ সালে সরকার কতৃক আদিষ্ট হয়ে পণ্ডিত ঘনশ্যাম
শর্মা এবং ১৮১৭ সালে পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার বিধান দেন যে স্বামীর মৃত্যুতে তার চিতায় প্রাণ
বিসর্জ্জন দেওয়া বিধবা স্ত্রীর পক্ষে বাধ্যতামূলক নয় | কিন্তু তাঁরা কেউই প্রকাশ্যে এই প্রথাকে নিন্দা
করতে বা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্রস্তুত ছিলেন না | রামমোহনই প্রথম এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে
বিদ্রোহ ঘোষণা করেন | সম্ভবতঃ ১৮১২ সাল থেকেই তিনি সতীদাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন শুরু
করেন তাঁর দ্বারা প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বিভিন্ন গ্রন্থে লেখালেখি করে জনমত তৈরী করার কাজ দিয়ে |
১৮১৮ সালে কলকাতার কিছু উদারপন্থী মানুষকে সংগঠিত করে সতীদাহের বিরুদ্ধে এক দরখাস্ত দেন
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে | সরকার, জনসাধারণের বিক্ষোভের ভয়ে এই কুপ্রথাকে
নিষিদ্ধ করতে দ্বিধা করছিলেন | অবশেষে রামমোহনের আন্দোলনের দ্বারা তৈরী তীব্র সতীদাহ-বিরোধী
জনমতের আবহাওয়ায়, ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক সতীদাহ উচ্ছেদ আইন
প্রবর্তন করেন | এই আইন চালু হলে রামমোহন ও তাঁর বন্ধুবর্গ, দেশীয় প্রগতিশীল হিন্দু গোষ্ঠির পক্ষ থেকে
বেন্টিংককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন | এর পরে সতীদাহ সমর্থক রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এই আদেশের
বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ডে প্রিভি কাউনসিলে আবেদন করলে রামমোহন স্বয়ং ইংল্যাণ্ডে গিয়ে তার বিরুদ্ধে আর এক
আবেদন পেশ করেন ও সে দেশে সতীদাহ বিরোধী জনমত তৈরী করার জন্য সেখানে এক গ্রন্থ প্রকাশ করেন |
প্রিভি কাউনসিলে এই রক্ষণশীল সমাজের আবেদনের শুনানী চলাকালীন প্রতিদিন তিনি অতন্দ্র প্রহরীর মত
উপস্থিত থাকতেন | শেষ পর্যন্ত ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউনসিল সেই আবেদন খারিজ করে দিলে পরে তিনি
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন |
প্রমাণ সাপেক্ষ : শোনা যায় যে সতীদাহ প্রথার করাল গ্রাস থেকে তিনি তাঁর দাদার মৃত্যুর পর পরম
স্নেহময়ী বৌদিকেও রক্ষা করতে পারেন নি | সে সময় তিনি বাড়ি ছিলেন না | তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ
নিয়ে তাঁর বৌদিকে সহমরণে বাধ্য করা হয় | এর পরই নাকি তিনি এই বর্বর প্রথা লুপ্ত করার শপথ নেন |
(বসন্ত চৌধুরী অভিনীত "রামমোহন" নামক ছায়াছবিতে তেমনই দেখানো হয়েছিল )
সমাজ সংস্কার এবং ব্রাহ্ম সমাজ - সূচিতে ফেরত
১৮১৪ সালে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বসবাসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হাত
দিলেন সমাজ সংস্কারের কাজে | ১৮১৪ ~ ১৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন "আত্মীয় সভা" | সেই সময়
এই সভাই ছিল কলকাতায় সবরকম জনকল্যাণমূলক সংস্কারকর্মের প্রধান উত্স | এই সভার মধ্যে ছিলেন
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, ব্রজমোহন মজুমদার, কৃষ্ণমোহন মজুমদার, হলধর বসু,
রাজনারায়ণ সেন, বৃন্দাবন চন্দ্র মিত্র, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নন্দকিশোর বসু, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ |
পালা করে সদস্যদের বাড়িতে অধিবেশন হত | কর্মসূচিতে থাকতো বেদ, উপনিষদ্ প্রভৃতি শাস্ত্রপাঠ, ব্রহ্ম
সংগীত এবং হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংক্রান্ত নানা আলোচনা --- যেমন প্রতিমা পূজার অসারতা, জাতিভেদের
অনিষ্টকারিতা, সতিদাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক অনাচার উচ্ছেদের উপায়, বালবিধবার পুনর্বিবাহের
আবশ্যকতা | এঁরা বিশ্বাস করতেন যে ধর্মীয় বিশুদ্ধি ও সামাজিক বিশুদ্ধি পরস্পর নির্ভর --- একটিকে বাদ
দিয়ে অন্যটির কল্পনা করা যায় না | সুতরাং ধর্ম সংস্কারকেই এঁরা সমাজ সংস্কারের ভিত্তিরূপে গহণ
করেছিলেন |
তাই ১৮২৮ সালে রামমোহন, একটি সার্বজনীন ধর্মের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন "ব্রাহ্ম সমাজ", যে ধর্ম মানুষের
মধ্যে কোন ভেদ স্বীকার করবে না এবং যার লক্ষ্য হবে এক যোগে সর্বমানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও
আধ্যাত্মিক মুক্তি | যেখানে উপাসনা হবে একমাত্র অদ্বিতীয় নিরাকার পরব্রহ্মের | কোন সৃষ্ট বস্তু, প্রতিমা,
ছবি, মূর্তি বা কোনোপ্রকারের প্রতীক যেখানে পূজিত হবে না | রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজ ১৮০ বছর
অতিক্রান্ত করেছে | আধুনিক ভারতবর্ষের তথা বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণে রামমোহন থেকে
রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ব্রাহ্ম সমাজের মহান অবদান সর্বজনস্বীকৃত |
প্রথম বাংলা সংবাদপত্র - সূচিতে ফেরত
ভারতবর্ষে রামমোহনই প্রথম যিনি জনকল্যাণের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন |
তাঁর প্রেরণায়, বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম সংবাদ পত্র "বঙ্গাল গেজেটি" (সাপ্তাহিক), তাঁর ঘনিষ্ট সহযোগী
"আত্মীয় সভা"-র সদস্য হরচন্দ্র রায় এবং গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রকাশ করেন ১৫ মে ১৮১৮ সালে | এ ছাড়া
রামমোহন পরিচালিত আরও দুটি সংবাদ পত্র হল বাংলা সাপ্তাহিক "সংবাদ-কৌমুদী" (১৮২১) এবং ফার্সী
সাপ্তাহিক "মিরাৎ উল আখবার" (১৮২২) | এ ছাড়া ১৮২৯ সালে অতি অল্প সময়ের জন্য রামমোহন ও তাঁর
কয়েকজন বন্ধু "বেঙ্গল হেরাল্ড" নামক একটি চতুর্ভাষী ( ইংরেজী-বাংলা-হিন্দুস্থানী-ফার্সী ) সাপ্তাহিক পত্রের
স্বত্বাধিকারী হয়েছিলেন | তাঁর সংবাদপত্রের পরিচালনের উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের অভাব, অভিযোগ, দাবী
প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা, সমাজে উদার শিক্ষাসংস্কৃতির এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা, বিশ্বরাজনীতিতে
জনমতকে শিক্ষিত করে তোলা এবং সর্বোপরি সতীদাহ ও অন্যান্য সামাজিক অনাচার ও জাতীয় কলঙ্কের
বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা |