কবি রসরাজ অমৃতলাল বসু - বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট, মঞ্চপরিচালক এবং নাট্যকার ছিলেন।
১৯০৫ সালে, “বাঙ্গালীর গান” সংকলনে দুর্গাদাস লাহিড়ী লিখেছেন, “১২৬০ সালের ছয়ই বৈশাখ পূর্ণিমা
তিথিতে কলিকাতা নগরীতে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। কলিকাতায় ইঁহারা ৩/৪ পুরুষ ধরিয়া বাস করিতেছেন”।
তাঁদের আদি বাড়ি চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের অন্তর্গত দণ্ডিরহাট গ্রামে ছিল। পিতার নাম
কৈলাসচন্দ্র বসু।
কবি, জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ১৮৬৯ সালে উত্তীর্ণ হয়ে দু-বছর
মেডিকেল কলেজে পড়ার পর কাশীর হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সক ডঃ লোকনাথ মৈত্রের কাছে হোমিওপ্যাথি
চিকিত্সা শিক্ষালাভ করে কলকাতায় প্র্যাকটিস শুরু করেন।
তিনি কিছুকাল শিক্ষকতাও করেন। ১৮৭৩ সালে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন,
ব্রাহ্মনিকেতন নামে ছাত্রাবাস গঠন করলে, অমৃতলাল তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
এর পর তিনি সরকারী চিকিত্সক হিসাবে আন্দামান নিকোবরের রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে কিছুদিন কাজ
করেছিলেন। তিনি কিছু দিন পুলিশ বিভাগেও চাকরি করেছিলেন।
৭ই ডিসেম্বর ১৮৭২ তারিখে, জোড়াসাঁকোর মধুসূদন সান্যালের বাড়ির প্রাঙ্গণে, দীনবন্ধু মিত্রর “নীলদর্পণ”
নাটকে অভিনয় করে তাঁর নাট্যজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী
প্রমুখদের নির্দেশনায় ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল অপেরা কোম্পানি, বেঙ্গল, স্টার, মিনার্ভা প্রভৃতি
রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর নাট্য-প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি নাট্যকার ও
নাট্যশালার অধ্যক্ষ হিসাবেও কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন।
অমৃতলালের প্রথম নাটক “হীরকচূর্ণ নাটক” (১৮৭৫) বরোদার ইংরেজ রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও
গায়কোয়াড়ের রাজ্যচ্যুতির চাঞ্চল্যকর ঘটনাভিত্তিক কাহিনী। “বিমাতা” বা “বিজয়বসন্ত”
(১৮৯৩), “হরিশচন্দ্র” ১৮৯৯, “যাজ্ঞসেনী” (১৯২৫) প্রভৃতি পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর নাটক রচনা করলেও
অমৃতলালের কৃতিত্ব এবং খ্যাতি মূলত হাস্যরসাত্মক ও বিদ্রুপমেশা নাটক-প্রহসন রচনায়। “চোরের উপর
বাটপাড়ি” (১৮৭৫), “ডিসমিস” (১৮৮২), “বিবাহ-বিভ্রাট” (১৮৮২), “চাটুজ্যে ও বাঁড়ুজ্যে” (১৮৮৬), “বাবু”
(১৮৯৩), “বৌমা” (১৮৯৬), প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রহসন। তাঁর রচিত চল্লিশটির গ্রন্থের মধ্যে চৌত্রিশটিই
নাটক। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে “তিলতর্পণ”, “তরুবালা”, “খাসদখল” প্রভৃতি।
“পুরাতন পঞ্জিকা”, “ভূবনমোহন নিয়োগী” তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক রচনা। তিনি ছিলেন কিছুটা রক্ষণশীল মনের
মানুষ। সেই জন্য স্ত্রী স্বাধীনতা, পাশ্চাত্যায়ন প্রভৃতির প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন অনেক সময়েই প্রতিবাদমুখর।
ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা, রাজনেতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহকর্মীরূপে,
স্বদেশী যুগের কর্মী ও বাগ্মী হিসাবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি শ্যামবাজার অ্যাংলো-ভার্নাকুলার স্কুলের
সেক্রেটারি, সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্যও ছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদকে ভূষিত করেন। হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতার জন্য তিনি
দেশবাসীর কাছে রসরাজ নামে খ্যাত হন। এই হাসি কখনও কখনও অনাবিল বিশুদ্ধ, কখনও তার সঙ্গে
ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপ ও ধিক্কার মিশেছে। সমাজ সমালোচনায় রঙ্গ-ব্যাঙ্গকে একটি শাণিত অস্ত্র হিসাবে
তিনি ব্যবহার করেছেন।
ইংল্যাণ্ডের যুবরাজের আগমন উপলক্ষ্যে উকিল জগদানন্দের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ঘটনাকে ব্যাঙ্গ করে রচিত
নাটিকা পরিচালনা করার জন্য তিনি আদালতে দণ্ডিত হন। এই ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬ সালে
মঞ্চাভিনয়ের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন।
নাটকে তাঁর রচিত গান যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। কলকাতার বাইজীদের আসরেও তাঁর গানের চল ছিল।
আমরা মিলনসাগরে কবি রসরাজ অমৃতলাল বসুর গান ও কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে
দিতে পারলে এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স - দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত বাঙালীর গান, ১৯০৫।
. শিশিরকুমার দাশ, সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী, ২০০৩।
. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, ১৯৭৬।
. দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বেশ্যাসংগীত বাইজিসংগীত” ( ২০০১ )।
কবি রসরাজ অমৃতলাল বসুর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৭.৩.২০১৬
...