কবিআশিস সান্যাল-এর কবিতা
*
দিয়েছ ভোরের ফুল
কবি আশিস সান্যাল
জন্মে প্রতিজন্মে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭৪

আশ্চর্য ভোরের ফুল একদিন দিয়েছিলে তুমি |
বিনিময়ে তার
দিয়েছি তোমার হাতে স্নেহময় সর্বস্ব আমার |

তাই আজ রিক্ত আমি,
তুমি দৃর অবেলার নির্মল আকাশে
হেমন্তের অশ্রুপাত ;
আর আমি ভেসে যাই
প্রত্যাশী নীলিমা ছুঁয়ে দিগন্তের বাউল বাতাসে |

কেননা নীরব স্পর্শে
এই সব প্রতিশ্রুতি করে গেছ স্মৃতিচিহ্নময় ;
যেখানেই কান পাতি
এক-ই ধ্বনিময়
কোমল বুকের শব্দ অবসাদহীন ----
আজ তুমি ক্লান্ত মেঘ,
আমি দৃপ্ত মধ্যাহ্নের দুরন্ত স্বাধীন |

আমার সর্বস্ব নিয়ে
পরিণামে তার
দিয়েছ সমগ্র বিশ্বে মৃত্যুঞ্জয়ী এই অভিসার |
চোখের বিমল জলে
ভাসমান এ আঁধারে দেখ মধুময়----
দিয়েছ ভোরের ফুল,
আকাশে প্রাঙ্গণে তার
অবিরাম আন্দোলিত সার্বিক বিজয় |

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
এ দেশের গ্রাম
কবি আশিস সান্যাল
বারুদ পারে না কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৯২

এ-দেশের মাঠে ঘাটে শ্যামলবরণী
দেখেছি রমণী এক----
নাম তার কোনদিন করিনি জিজ্ঞাসা |
কারণ জেনেছি আমি
এ-দেশের সব গ্রামে
আছে তার পাতা-ছাওয়া পরিচিত বাসা |

যে নারী দু’চোখ মেলে দেখিয়েছে ডেকে----
ভোরের আকাশ গাঢ়
ছড়ায় বাতাস এসে কী গভীর মায়া !

অথচ দুয়ারে তার
প্রত্যহ  নবীন রোদে
হেঁটে যায় অতর্কিতে দুর্ভাগ্যের ছায়া |

বুকের রুধিরে স্নাত নন্দিত ফসল
কঠিন আঘাতে আজো
লুঠে নেয় দেখি সব কুটিল দুর্বাসা |
জেনেছে অনেক তবু
পায়নি চোখের জল
আজো তার চেতনার যোগ্যতর ভাষা |

আজ তাই সেই সব রমণীর মনে
নবীন প্রত্যয়ে চাই
আরো দূরে এগোবার জন্য অভিরাম
রঙিন পতাকা শুধু----
প্রত্যাশায় চাই আর
নিরাময় আলোচিত এ-দেশের গ্রাম |

.            *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
ভারতবর্ষ
কবি আশিস সান্যাল
বারুদ পারে না কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭২

ভারতবর্ষ কেবল মানচিত্র নয় |
কালির আঁচড়ে
বার বার বিক্ষত করলেও
বুকের ভেতরে
কোন ক্ষতের চিহ্ন পড়ে না |
শুধুই বদলে যায়
তার চারিদিকের
প্রসারিত প্রান্তিক রেখাগুলি |

.             বেদের ভারতবর্ষ
.             পুরাণের ভারতবর্ষ
.             বুদ্ধের ভারতবর্ষ
.             অশোকের ভারতবর্ষ
.             আকবরের ভারতবর্ষ
.             ক্লাইভের ভারতবর্ষ
.             স্বাধীন ভারতবর্ষ
.             এক নয়----
.             মানচিত্রে পড়েছে বার বার কালির দাগ |

এর-ই মধ্যে
প্রাগৈতিহাসিক মুকুট মাথায়
মৌনী হিমালয়ের মতো
দাঁড়িয়ে আছে এক ভারতবর্ষ |
জন্মের মুহূর্তে
যার বুকে মাথা রেখে
কেঁদে উঠেছিলাম -----
সেই ভারতবর্ষ নয়
আজকের এই নদী প্রান্তর খচিত জন্মভূমি |

ভারতবর্ষ এক আশ্চর্য বোধ
এক প্রশান্ত অনুভূতি,
অনেক মানুষের প্রবহমান পদচারণায়
অনুপ্রাণিত
এক নির্মল বিবেক |

কেবল মানচিত্র নয় এ ভারতবর্ষ |

.          *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
বিজয়া
কবি আশিস সান্যাল
স্রোতের অবিরল শব্দে কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৯৫

উড়ে যায়
আজো সেই নীলকন্ঠ পাখি
দুর্গম আকাশ পথে----
চোখে তার প্রতিভাত মৌনী হিমালয় |
ডানার নন্দিত ধ্বনি
আমাদের প্রাত্যহিক ধূসর আবাসে
যেন স্নিগ্ধ মিলনের
প্রণয়-স্পন্দিত বাণী দ্রুত নিয়ে আসে |

ছড়ায় স্বপ্নের মতো
প্রত্যহের ঘরে
মিলনের প্রতিধ্বনি
গ্রামে ও শহরে |
সর্বত্র ধ্বনিত শুনি
সেই এক-ই গান :
বিবিধের মাঝে স্নিগ্ধ মিলন মহান |

বিজয়া বিষাদ নয়
অন্য এক আরম্ভের দিন ;
মিলনের স্বপ্নে যেন
জাগতিক সব কিছু নীরবে বিলীন |
এখন ভারতবর্ষে
বহমান কঠিন সময়----
বিভেদের গ্লানি মুছে
এসো করি প্রস্ফুটিত প্রেমের বিজয় |

.          *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
সুন্দর
কবি আশিস সান্যাল
নিজের বিরূদ্ধে যুদ্ধ কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৯৯

কেবল সুন্দর থাকে
পৃথিবীতে
আর সব ঝরে যায়
পৃথিবীর যাবতীয় উত্সারিত সচ্ছলতা সব |
ঝরে যায় ঝাউপাতা,
ফুল মেঘ,
চৈত্রের মুখর মনে হাওয়ার উত্সব |

নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয় |
রমণীও  একদিন
খুলে যায় তার ব্যবহৃত সমস্ত পোশাক |
ডুব দেয় অন্ধকারে----
ইতিহাসে পড়ে থাকে
বিচূর্ণ স্মৃতির মতো
শুধু তার ইতস্তত আদিম কঙ্কাল |
প্রজাপতি উড়ে যায়
ছিন্ন করে সময়ের সব বেড়াজাল |

সুন্দরের হাতে তাই
পরাজিত হতে নেই কিছুমাত্র গ্লানি |
ভোরের পলাশ বনে
রঙিন পতাকা নিয়ে যত রাহাজানি
পড়ে থাকে সব তার
স্মৃতির ভেতরে
সুন্দর উজ্জ্বল হয়
অথচ প্রত্যহ এই রক্তিম প্রহরে |

.          *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর   
*
রক্ত ঝরে
কবি আশিস সান্যাল
কাছেই রয়েছে নদী কাব্যগ্রন্থ থেকে, ২০০৩

রক্ত ঝরে অবিরাম |
রক্ত
ছড়িয়ে যায়
.         পথের ধুলায় |
রাতের জঠর থেকে
.         শোনা যায়
.         নিহত নারীর কন্ঠ |
শৃগালেরা চেটে খায়
আজো দেখি
অন্ধকারে গলিত শরীর |
কান্নার করুণ শব্দ
শুনি আজো
যতদূর শোনা যায় এই পৃথিবীর |

বিপন্ন বাতাসে শুনি
.         বেদনার্ত স্বর
পৃথিবীর সবখানে অশুভ বর্বর
অভুক্ত সিংহের মতো
.         অজস্র দানব
খোঁজে আজো অতর্কিতে
রক্তের লবণ স্বাদ
পড়ে আছে চারিদিকে
.        মুণ্ডহীন শব |

হায় পিতা !
একদিন দিয়েছিলে
.   অমৃতের স্বপ্ন যত
.       আমাদের বুকে
অথচ এখন দেখি
সঞ্চারিত কৃমি-কীট
.      কেবল অসুখে |
রক্তেভেজা ধ্বজা তুলে
মানচিত্র
ছিঁড়ে খায় ঘাতক উন্মাদ,
শুনি না কোথাও তার
সংঘবদ্ধ
.         তীব্র প্রতিবাদ |

প্রস্তর যুগের নারী
কাঁদে আজো
রক্ত ঝরে
.          অবিরাম পথের ধুলায় |
মেধার মননে রক্ত----
চোখ মেলে
.          যতদূর শুধু দেখা যায় |

অমৃতের মন্ত্র দাও
হায় পিতা
উর্বরতা দাও আজ
.          নিভৃত মননে
দাও ঝঞ্ঝা বারিপাত
.          অন্ধকার বনে |
শোনাও ধূসর শেষে
প্রত্যাশার গান
পৃথিবীতে বেঁচে থাক
.           পরিশুদ্ধ মানব সন্তান |

.          *************************            
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর