মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা
*
দ্বেষ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া



শত ধিক্ সে মনেরে, কাতর যে মনঃ
পরের সুখেতে সদা এ ভব- ভবনে !
মোর মতে নর-কুলে কলঙ্ক সে জন
পোড়ে আঁখি যার যেন বিষ-বরিষণে.,
বিকশে কুসুম যদি, গায় পিক-গণে
বাসন্ত আমোদে পূরি ভাগ্যের কানন
পরের !  কি গুণ দেখে, কব তা কেমনে,
প্রসাদ তোমার, রমা, কর বিতরণ
তুমি ? কিন্তু এ প্রসাদ, নমি যোড় করে
মাগি রাঙা পায়ে, দেবি ; দ্বেষের অনলে
( সে মহ নরক ভবে ! ) সুখী দেখি পরে,
দাসের পরাণ যেন কভু নাহি জ্বলে,
যদিও না পাত তুমি তার ক্ষুদ্র ঘরে
রত্ন-সিংহাসন, মা গো, কুভাগ্যের বলে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দ্বেষ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া



বসন্তে কানন-রাজি সাজে নানা ফুলে,
নব বিধুমুখী বধূ যাইতে বাসরে
যেমতি ;  তবু সে নদ, শোভে যার কূলে
সে কানন, যদপিও তার কলেবরে
নাহি অলঙ্কার, তবু সে দুখ সে ভুলে
পড়শীর সুখ দেখি ; তবুও সে ধরে
মূর্ত্তি তার হিয়া-রূপ দরপণে তুলে
আনন্দে ! আনন্দ-গীত গায় মৃদু স্বরে !---
হে রমা, অজ্ঞান নদ, জ্ঞানবান্ করি,
সৃজেছেন দাসে বিধি ;  তবে কেন আমি
তব মায়া,  মায়াময়ি, জগতে বিস্মরি,
কু-ইন্দ্রিয়-বশে হব এ কুপথ-গামী ?
এ প্রসাদ যাচি পদে, ইন্দিরা সুন্দরি,
দ্বেষ-রূপ ইন্দ্রিয়ের কর দাসে স্বামী |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
যশঃ
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

লিখিনু কি নাম মোর বিফল যতনে
বালিতে, রে কাল, তোর্ সাগরের তীরে ?
ফেন-চূড় জল-রাশি আসি কি রে ফিরে,
মুছিতে তুচ্ছেতে ত্বরা এ মোর লিখনে ?
অথবা খোদিনু তারে যশোগিরি-শিরে,
গুণ-রূপ যন্ত্রে কাটি অক্ষর সুক্ষণে,--
নারিবে উঠাতে যাহে, ধুয়ে নিজ নীরে,
বিস্মৃতি, বা মলিনিতে মলের মিলনে ?----
শূন্য-জল জল-পথে জলে লোক স্মরে ;
দেব-শূন্য দেবালয়ে অদৃশ্য নিবাসে
দেবতা ; ভস্মের রাশি ঢাকে বৈশ্বানরে |
সেই রূপে, ধড় যবে পড়ে কাল-গ্রাসে,
যশোরূপাশ্রমে প্রাণ মর্ত্ত্যে বাস করে ;----
কুযশে নরকে যেন, সুযশে --- আকাশে !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভাষা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া


.                লো সুন্দরী জননীর
.                সুন্দরীতর দুহিতা !---
মূঢ় সে, পণ্ডিত-গণে তাহে নাহি গণি,
কহে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি
ভাষা !--- শত ধিক্ তারে ! ভুলে সে কি করি
শকুন্তলা তুমি, তব মেনকা জননী ?
রূপ-হীনা | দুহিতা কি, মা যার অপ্সরী ?---
বীণার রসনা-মূলে জন্মে কি কুধ্বনি ?
কবে মন্দ-গন্ধ শ্বাস শ্বাসে ফুলেশ্বরী
নলিনী ? সীতার গর্ভে ধরিলা ধরণী
দেব-যোনি মা তোমার ; কাল নাহি নাশে
রূপ তাঁর ; তবু কাল করে কিছু ক্ষতি |
নব রস-সুধা কোথা বয়েসের হাসে ?
কালে সুবর্ণের বর্ণ ম্লান, লো যুবতি !
নব শশিকলা তুমি ভারত-আকাশে,
নব-ফুল বাক্য-বনে, নব মধুমতী |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সাংসারিক জ্ঞান
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

“কি কাজে বাজায়ে বীণা ; কি কাজ জাগায়ে
“সুমধুর প্রতিধ্বনি কাব্যের কাননে ?
“কি কাজ গরজে ঘন কাব্যের গগনে
“মেঘ-রূপে, মনোরূপ ময়ূরে নাচায়ে ?
“স্বতরিতে তুলি তোরে বেড়াবে কি বায়ে
“সংসার-সাগর-জলে, স্নেহ করি মনে
“কোন জন ? দেবে অন্ন অর্দ্ধ মাত্র খায়ে,
“ক্ষুধায় কাতর তোরে দেখি রে তোরণে ?
“ছিঁড়ি তার-কুল, বীণা ছুড়ি ফেল দূরে !”---
কহে সাংসারিক জ্ঞান --- ভবে বৃহস্পতি |
কিন্তু চিত্ত-ক্ষেত্রে যবে এ বীজ অঙ্কুরে,
উপাড়ে ইহায় হেন কাহার শকতি ?
উসাসীন-দশী তার সদা জীব-পুরে,
যে অভাগা রাঙা পদ ভজে, মা ভারতি !

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পুরুরবা
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

যথা ঘোর বনে ব্যাধ বধি অজাগরে,
চিরি শিরঃ তার, লভে অমূল রতনে ;
বিমুখি কেশীরে আজি, হে রাজা, সমরে,
লভিলা ভুবন-লোভ তুমি কাম-ধনে !
হে সুভগ, যাত্রা তব বড় শুভ ক্ষণে !
ঐ যে দেখিছ এবে, গিরির উপরে,
আচ্ছন্ন, হে মহীপতি, মূর্চ্ছা-রূপ ঘনে
চাঁদেরে, কে ও, তা জান ? জিজ্ঞাস সত্বরে,
পরিচয় দেবে সখী,  সমুখে যে বসি
মানসে কমল, বলি, দেখেছে নয়নে ;
দেখেছে পূর্ণিমা-রাত্রে শরদের শশী ;
বধিয়াছ দীর্ঘ-শৃঙ্গী কুরঙ্গে কাননে ;---
সে সকলে ধিক্ মান !  ওই হে উর্ব্বশী !
সোণার পুতলি যেন, পড়ি অচেতনে |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

স্রোতঃ-পথে বহি যথা ভীষণ ঘোষণে
ক্ষণ কাল, অল্পায়ুঃপয়োরাশি চলে
বরিষার জলাশয়ে  দৈব-বিড়ম্বনে
ঘটিল কি সেই দশা সুবঙ্গ-মণ্ডলে
তোমার, কোবিদ বৈদ্য ? এই ভাবি মনে,--
নাহি কি হে কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে ?
আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য ব্রজধামে
জীবে তুমি ; নানা খেলা খেলিলা হরষে ;
যমুনা হয়েছ পার ; তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা ?  স্মরণ-নিকষে,
মন্দ-স্বর্ণ-রেখা-সম এবে তব নামে
নাহি কি হে জ্যোতিঃ, ভাল স্বর্ণের পরশে ?

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
শনি
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কেন মন্দ গ্রহ বলি নিন্দা তোমা করে
জ্যোতিষী ?  গ্রহেন্দ্র তুমি, শনি মহামতি !
ছয় চন্দ্র রত্নরূপে সুবর্ণ টোপরে
তোমার ;  সুকটিদেশে পর, গ্রহ-পতি
হৈম সারসন, যেন আলোক-সাগরে !
সুনীল গগন-পথে ধীরে তব গতি |
বাখানে নক্ষত্র-দল ও রাজ-মূরতি
সঙ্গীতে, হেমাঙ্গ বীণা বাজায়ে অম্বরে |
হে চল রশ্মির রাশি, সুধি কোন জনে,---
কোন জীব তব রাজ্যে আনন্দে নিবাসে ?
জন-শূন্য নহ তুমি, জানি আমি মনে,
হেন রাজা প্রজা-শূন্য, ---- প্রত্যয়ে না আসে !---
পাপ, পাপ-জাত মৃত্যু, জীবন-কাননে,
তব দেশে, কীট-রূপে কুসুম কি নাশে ?

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সাগরে তরি
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

হেরিনু নিশায় তরি অপথ সাগরে,
মহাকায়া, নিশাচরী, যেন মায়া-বলে,
বিহঙ্গিনী-রূপ ধরি, ধীরে ধীরে চলে,
রঙ্গে সুধবল পাখা বিস্তারি অম্বরে !
রতনের চড়া-রূপে শিরোদেশে জ্বলে
দীপাবলি, মনোহরা নানা বর্ণ করে,---
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, মিশ্রিত পিঙ্গলে |
চারি দিকে ফেনাময় তরঙ্গ সুস্বরে
গাইছে আনন্দে যেন, হেরি এ সুন্দরী
বামারে, বাখানি রূপ, সাহস, আকৃতি |
ছাড়িতেছে পথ সবে আস্তে ব্যস্তে সরি,
নীচ জন হেরি যথা কুলের যুবতী |
চলিছে গুমরে বামা পথ আলো করি,
শিরোমণি-তেজে যথা ফণিনীর গতি |

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
“চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

সুরপুরে সশরীরে, শূর-কুল-পতি
অর্জ্জুন, স্বকাজ যথা সাধি পুণ্য-বলে
ফিরিলা কানন-বাসে ; তুমি হে তেমতি,
যাও সুখে ফিরি এবে ভারত-মণ্ডলে,
মনোদ্যানে আশা-লতা তব ফলবতী!----
ধন্য ভাগ্য, হে সুভগ, তব ভব-তলে!
শুভ ক্ষণে গর্ভে তোমা ধরিলা যে সতী,
তিতিবেন যিনি, বৎস, নয়নের জলে
( স্নেহাসার ! ) যবে রঙ্গে বায়ু-রূপ ধরি
জনরব, দূর বঙ্গে বহিবে সত্বরে
এ তোমার কীর্ত্তি-বার্ত্তা | --- যাও দ্রুতে, তরি,
নীলমণি-ময় পথ অপথ সাগরে |
অদৃশ্যে রক্ষার্থে সঙ্গে যাবেন সুন্দরী
বঙ্গ-লক্ষ্মী! যাও, কবি আশীর্ব্বাদ করে!

.                  ****************                                   
.                                                                                 
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর