কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা
*
অমর্ত্য গান
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।

সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
.                                অসাধারণের গানে
উতলা হয়ো না, হয়ো না, তোমার
যা কিছু স্বপ্ন সীমা টানো তার,
তুলে দাও খিল হৃদয়ে, নিখিল
.                                বসুধার সন্ধানে
যেয়ো না, তোমার নেই অধিকার
.                                দুর্লভ  তার  গানে |

সাধারণ, তুমি সাধারণ, তাই
.                               ছোট আশা ভালোবাসা
তা-ই দিয়ে ছোট হৃদয় ভরাও,
তার বেশি যদি কিছু পেতে চাও
পাবে না পাবে না, যাকে আজো চেনা
.                               হলো না সর্বনাশা
সেই মায়াবীর গান ভুলে যাও,
.                              ভোলো তার ভালবাসা |

সাধারণ, তুমি সাধারণ, তবু
.                               অসাধারণের গানে
ভুলেছ, পুড়েছে ছোট ছোট আশা,
পুড়েছে তোমার ছোট ভালোবাসা,
ছোট হাসি আর ছোট কান্নার
.                                সব স্মৃতি সেই প্রাণে
বুঝি মুছে যায় যে-প্রাণ হারায়
.                               সেই অমর্ত্য গানে |

.             *************************      
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর   
*
মহাজীবন
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।

মরতে তোমার ভারী সাধ ছিল ; মরা
সহজ নয় তো, আলোছায়া বোনা বিচিত্র জীবনের
ব্যথা-আনন্দ দুঃখ-সুখের নিবিড় পরম্পরা
বাঁচবার আশা জ্বালিয়ে দিয়েছে ফের |

সে তো আশা নয়, নিবিড় বহ্নিজ্বালা
মূর্ছিত ব্যথাবেদনার কোনো গহন সঙ্গোপনে
জ্বলে উঠে বুঝি ছড়িয়ে পড়েছে ঘন তমিস্রা ঢালা
শীতবিবর্ণ মৌনকঠিন মনে |

যে করে নিয়ত মৃত্যুকামনা, তারও
হৃদয়ে অগাধ বাঁচবার সাধ | তাই বুঝি বারেবারে
অযুত মরণে মরেও প্রাণের প্রদীপ জ্বালাতে পারো
ব্যর্থবাসনা অতল অন্ধকারে |

অমরণ সেই মন্ত্রকে জেনে নিয়ে
মৃত্যুর ধুধু ম্লান রাত্রির শূন্য শীতেও বাঁচি,
জীবনের থেকে শতসহস্র যোজন পিছিয়ে গিয়ে
ফিরে আসি মহাজীবনের কাছাকাছি |

.             *************************      
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর   
*
আকাঙ্ক্ষা তাকে
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।

আকাঙ্ক্ষা তাকে শান্তি দেয়নি,
.                      শান্তির আশা দিয়ে বারবার
লুব্ধ করেছে | লোভ তাকে দূর
.                      দুঃস্থ পাপের পথে টেনে নিয়ে
তবুও সুখের ক্ষুধা মেটায়নি,
.                      দিনে দিনে আরো নতুন ক্ষুধার
সৃষ্টি করেছে | সুখলোভাতুর
.                      আশায় দিয়েছে আগুন জ্বালিয়ে |

এই যে আকাশ, আকাশের নীল,
এই যে সুস্থসবল হাওয়ার
আসা-যাওয়া, রূপরঙের মিছিল,
কোনোখানে নেই সান্ত্বনা তার |

বন্ধুরা তাকে যেটুকু দিয়েছে,
.                      শত্রুরা তার সব কেড়ে নিয়ে
কোনো দূরদেশে ছেড়ে দিয়েছিল
.                      কোনো দুর্গম পথে | তারপর
যখন সে প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে,
.                      শোকের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে
প্রেম তাকে দিল সান্ত্বনা, দিল
.                      স্বয়ংশান্তি তৃপ্তির ঘর |

.             *************************      
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর   
*
অন্ত্য রঙ্গ
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।

হা-রে রে রঙ্গীলা, তোর কথার টানে টানে
পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াই ; সমস্ত রাতভোর
কোন্ কামনার আগুন ছুঁয়ে স্বপ্ন দেখি তোর,
কোন্ দুরাশার, রঙ্গীলা ? তুই হঠাৎ কোনোখানে
না ভাঙলে না-দেখার দেয়াল, মিথ্যে এ তোর খোঁজে
দিন কাটানো ; বাঁধন-খোলার স্বপ্নে দিয়ে ছাই
ঘর ছাড়িয়ে পরিয়ে দিলি পথের বাঁধন, তাই
ব্যর্থ হলো রঙ্গীলা তোর সমস্ত রঙ্গ যে |

হা-রে রে রঙ্গীলা, তোর গানের টানে টানে
পার হয়েছি দুঃখ, তবু কেমন করে ভুলি
আজও আমার জীর্ণ শাখার সুখের কুঁড়িগুলি
পাপরি মেলে দেয়নি, আমার শুকনো মরা গাঙে
তরঙ্গ নেই, হৃদয়ধনুর দৃপ্ত কঠিন ছিলা
দিনে দিনে শিথিল হলো, রঙ্গীলা, এইবার
অন্ধকারকে ছিন্ন করে ফুলের মন্ত্র আর
ঢেউয়ের মন্ত্র শেখা আমায়, রঙ্গীলা রঙ্গীলা |

হা-রে রে রঙ্গীলা, তোর সময় নিরবধি
রঙ্গও অনন্ত, আমার সময় নেই যে আর,
কে আমাকে শিখিয়ে দেবে পথের হাহাকার
কী করে শান্ত, আমার প্রাণের শুকনো নদী
উজান বইবে কেমন করে, অমর্ত্য কোন্ গানে
ফুল ফুটিয়ে ব্যর্থ করি শীতের তাড়নায়,---
তুই যদি না শেখাস তবে চলব না আর, না,
রঙ্গীলা তোর কথার টানে, গানের টানে টানে |

.             *************************      
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর   
*
শীত-সায়াহ্ন
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।

অনেক কথা বলেছো তুমি, এবারে সব কথা
সাঙ্গ করো, এবারে নীরবতা
ঝরুক ঝরাপাতার মতো, যতো না শীত আসে
সে আনে দিন বলিরেখার, প্রখর নিঃশ্বাসে
সে আনে আলো-নেভানো রাত, ঘাসের মখমলে
সে করে জড়ো সাদা কঠিন হাড় |
তাহলে আলো জ্বেলে কী লাভ ? যতো না কথা বলো
আমি তো জানি ওঠে না ঢেউ, অথই এই জলে
ঢেউয়েরা মরে নীরবে, তবে অতল ছলোছলো
নয়নে কেন ছলনা টানো আর ?

অনেক কথা বলেছো তুমি, এবারে সব কথা
সাঙ্গ করো | এবারে তবে মনে
শীতের সাদা ঝরাপাতার মতন নির্জনে
ঝরুক ঘনগহন নীরবতা |

.             *************************      
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর