নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত, রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা ; আমার সংকীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা, ছুটছে দক্ষিণাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ||
সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকন্ঠে বিতর্ক, বিচার, প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর ; জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর ; তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার ||
যারা ছিল এক দিন ; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা ; যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয় ; স্বয়ম্ভু সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয় আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ||
তবু অন্তরে থামে না বৃষ্টিধারা : আর্দ্র, ধূসর, বিদেহ নগর, মত্সর প্রেত-পারা, প্রকৃতির লীলা আরবি কুহেলিকানাতে, ইঙ্গিতে যেন চায় অভিযোগ জানাতে ; তন্ময় ধ্যান ভেঙে যায় তার হানাতে | প্রচ্ছদে ওই ছায়াপাত করে কারা ? কী নাম শুধাই ---উত্তর নাই ; ঝরে শুধু বারিধারা ||
মুখে এক বার তাকায়ে নির্নিমেষে, শূন্যোদ্ভব দেব, না দানব, আবার শূন্যে মেশে | বুঝি তারা শুধু কুজ্ ঝটিকার চাতুরী : তবু তুলনায় ধন্ধ জাগায় মাথুরই ; প্রতীকপ্রতিম তাদের কাস্তে, হাতুড়ি ফসল মুড়ায়, মানমন্দির পেষে | মূর্ত নিষেধ, মূক নির্বেদ তাকায় নির্নিমেষে ||
কখনও কখনও মনে হয় যেন চিনি— বিদ্যুতে লেখা হেন রূপরেখা চীনে পটে বন্দিনী | স্পেনেও হয়তো অমনই অঙ্গভঙ্গি চিত্রার্পিত অসংহতির সঙ্গী ; সেখানেও আজ নিভৃত বিলাস লঙ্ঘি, পশে উপবনে পরদেশী অনীকিনী | স্পেন থেকে চীন প্রদোষে বিলীন ; অথচ তাদের চিনি ||
ভালোবেসেছিল তারাও, আমার মতো, সীমাহীন মাঠ, আকাশ স্বরাট, তারারাশি বাতাহত | গড্ডালিকার সহবাসে উত্যক্ত, তারা খুঁজেছিল সাযুজ্য সংরক্ত ; কল্পতরুর নত শাখে সংসক্ত শুক্ল শশীরে ভেবেছিল করগত | নগরে কেবল সেবিল গরল তারাও, আমার মতো ||
কিন্তু শূন্যে ছড়ায়ে ঊর্ণাজাল, মধুমক্ষীরে উপহাসে ঘিরে জাগ্রত মহাকাল | জনপ্রাণীও পারে না তা থেকে পলাতে ; পোড়ে মৌচাক আধিদৈবিক অলাতে ; নৈমিত্তিক সব্যসাচীর শলাতে অপসৃত হয় গুপ্তির জঞ্জাল | কানামাছি উড়ে ; ত্রিভুবন জুড়ে কালের ঊর্ণাজাল ||
তাই আমাদের সমাহিত অভিসারে ঘটে দুর্গতি, মৌন অরতি সংকেত প্রতিহারে ; বিপ্রলব্ধ বিশ্বমানের বিষাদে অঙ্গুলি তুলি, দেখায় অলখ নিষাদে | বুঝেও বুঝি না নিরাকার আঁখি কী সাধে, প্ররোচিত করে ত্যাগে, না অঙ্গীকারে | মাগে প্রতিশোধ, মানায় প্রবোধ, অনিকেত অভিসারে ||
তার স্বাধিকার আগে ফিরে দিতে হবে ; নতুবা নগর, তথা প্রান্তর, ভ’রে রবে বাসী শবে | অশক্য পিতা ; বলীর কন্ঠলগ্ন মাতা বসুমতী ব্যভিচারে আজ মগ্ন ; ক্ষাত্র শোণিতে অবগাহি, জামদগ্ন্য তবু পাতিবে না স্বর্গরাজ্য ভবে | স্বীয় শক্তিতে হবে যোগ দিতে শুদ্ধির তাণ্ডবে ||
জেসন্ কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত “বাংলা আধুনিক কবিতা ” ১ (১৯৯২ ) থেকে নেওয়া |
বহু কষ্টে শিখেছি সাঁতার ; অন্তত স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়া শক্ত নয় আর | নদীতেও নানা বাঁক আছে ; সেগুলোর কোনোটাতে ঠেকে গিয়ে বাঁচে এমন লোকেও যারা সাঁতারের স-টুকু জানে না | সমুদ্র তো তাদের টানে না | শরে বা শৈবালে কিংবা মত্স্যনারীদের সবুজ চুলের ঊর্ণাজালে জড়ায় না তারা কানামাছির মতন ||
কঞ্চুকী কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত “বাংলা আধুনিক কবিতা ” ১ (১৯৯২ ) থেকে নেওয়া
নাটকী নায়ক-রূপে আজীবন দেখেছি নিজেকে ; ভেবেছি আমার সঙ্গে অদৃষ্টের দ্বৈরথসমর : মর্ত্যের প্রতিভূ আমি, প্রতিপক্ষ সন্ত্রস্ত অমর, কাজেই নিস্তার নেই পরিণামী সর্বনাশ থেকে ;
তবু যবনিকাপাত দেবে ম্লান পরাজয় ঢেকে ; প্রতিলোম অভিযানে লোকযাত্রা হবে অগ্রসর, আমাকে হৃত্পদ্মে ধ’রে, ব্যর্থ বীর্যে যীশুর দোসর, আমি যাব আত্মৌপম্য সমাহিত সন্ততিতে রেখে ||
উপস্থিত পঞ্চমাঙ্ক : প্রাক্ নির্বাণ দীপের উদ্ভাসে সমবেত পাত্র-পাত্রী করে স্ব স্ব বিধিলিপি পাঠ ; নেপথ্যে আমার স্থান ; অন্ধকারে অধিকারী হাসে ; সে রঙ্গরসিক ব’লে, আমি ভ্রান্তিবিলাসে সম্রাট ||
কদাচ দৈবাৎ যদি বাস্তবিক ভূমিকায়ও ঢুকি, কামাখ্যার ষড়যন্ত্রে সাজি তবে ঘুমন্ত কঞ্চুকী ||
যযাতি কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত “বাংলা আধুনিক কবিতা ” ১ (১৯৯২ ) থেকে নেওয়া।
উত্তীর্ণ পঞ্চাশ : বনবাস প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে অতঃপর অনিবারণীয় ; এবং বিজ্ঞানবলে পশ্চিম যদিও আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে ইদানীং, তবু সেখানেই মৃত্যুভয় যৌবনের প্রভু, বার্ধক্যের আত্মাপহারক | আশ্রুত তারক অন্যত্রও অনাগত ; জ্ঞাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ ; নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা | কিন্তু তারা প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচর ঘেরা প্রাসাদেও উন্নিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্ন সেতু নদীতে নদীতে, মরু নগরে নগরে | পক্ষান্তরে অতিবেল কারা তথা সংক্রমিত মেরু ব্যক্তির ধ্বংসাবশেষ : দ্বেষে পুষ্ট চীন থেকে পেরু ; প্রতিহিংসা মানে না সিন্ধুর মানা | নৈশ হানা, আত্মঘাতী অঙ্গীকার, বিচারের সম্মত বিকার বা স্বস্হ ধিক্কার অড়িয়ে যে যায় ভাগ্যগুণে, চোখে চোখে তাকে অদৃশ্য শকুনে প্রবাসেও অহরহ : যথাকালে অমৃতের দায় সাশ্রু সন্ততিকে সঁপে, অন্তিম শয্যায় নিকামত পারে না আশ্রয় নিতে ; ঊষর ধূলিতে নিষ্পিষ্ট সে, ইতিহাসনিষ্ক্রান্তও বটে | অর্থাৎ কৃতান্ত আজ ব্যক্ত সর্ব ঘটে ; এবং, প্রৌঢ়ের কেন, সকলেরই কর্তব্য যেমন অরণ্যে রোদন, তেমনই সম্প্রতি সাধ্য লোকালয়ে সে-বৃথা বিলাপ ||
. অবশ্য আমার পক্ষে সংগত যে নয় অনুতাপ, সে-কথা স্বীকার করি ; কারণ যদিচ মগ্ন শৈলে আমার মাতাল নৌকা বানচাল হয়ে, বর্তমান বিশ্লিষ্ট কঙ্কাল— অপ্রাপ্তসত্কার শব প’চে প’চে অস্থিসার যেন— তথাপি যেকালে নিরুদ্দেশ যাত্রার সংজ্ঞায় হেন দুরবস্থা শুধু সম্ভাব্যই নয়, অবশ্যম্ভাবীও বটে, অশোভন তখন নির্বেদ | তা ছাড়া স্বকীয় সিদ্ধি প্রার্থনীয় নয় সূত্রধার গণেশের কাছে ; অকূল পাথারে অযাচিত সাম্রাজ্য একদা বাচে যারা জিতেছিল, অন্তত তাদের অনন্য সম্বল ছিল প্রাণপাত পৌরুষ এবং রুদ্র কৌতুহল--- নিতান্ত নিরুপলক্ষ | তরল অনলে পরিণত ঝলমল জল ; গলিত অম্বরতল ; অনুগত দিগ্বধূর আঁখি ছলছল কষ্টকল্পনায় ; মেঘে অন্তর্হিত চূড়া, পদান্ত ঊর্মির মুখর উদ্বেগে প্রতিষ্ঠিত অস্তগিরি, ইত্যাদি বিবাদী লক্ষণের অলৌকিক নির্বিরোধ তথা সে-সমন্বয়ের জের স্মিত বিদেশিনীর অভয়ে, এবং সোনার তরী তাদের ডাকে নি অজানার অভিসারে | হিংস্র অরি বন্দরে বন্দরে, অবিশ্বাস্য অনুচর, অবহেলা চরমে নিশ্চিত জেনেই, বেরিয়েছিল তারা ||
. ভেলা আমি ভাসিয়েছিলুম একদা তাদেরই মতো, আজ এটুকুই আমার পরম পরিচয় | আমাকেও লক্ষ্যভেদী নিষাদের উল্বণ উল্লাস উদাসীন নদীর উজানে দিয়েছিল অব্যাহতি মাল্লাদের গুণটানা থেকে | গাঁঠ গাঁঠ বিলাতী বস্ত্রের ভার, রাশি রাশি মার্কিনী গমের ভাবনা ও প্রতিযোগী ব্যাপারীর বাদ-বিসংবাদ সঙ্গে গিয়েছিল চুকে ; এবং হঠাৎ অধোগতি অনুকূল স্রোতে ; হয়েছিল অবারিত | অন্তরীক্ষ বিদীর্ণ বিদ্যুতে ; ভ্রমি ; ভঙ্গ জলস্তম্ভ ; সমুখ প্রত্যষ কপোতের পক্ষবিধূনন ; সন্নত সবিতা বেগুনী শোণিতে লুপ্ত রহস্যের বীভত্স প্রতীক ; ফুটন্ত জলার জালে জর্জরিত তিমি ; শেষনাগ শিথিলকুণ্ডলী, মত্কুণের উপজীব্য ; অপ্রেময় নির্বাতমণ্ডলে বিধ্বস্ত সলিল ; ঊর্ধ্বশ্বাস বরুণের বিপরীত রতি---সবই দেখেছিলুম আমিও, না দেখে দেখেছি ব’লে ভাবি নি অথবা অস্বীকার করি নি দেখার পরে ; এবং এখন স্বভাবের অনুমোদনেই আমার অনন্য স্বপ্ন প্রাচীন প্রাকারে সুরক্ষিত জনপদ, স্নিগ্ধ, সান্দ্র সন্ধ্যায় যেখানে খিন্ন শিশু ভঙ্গুর তরণী-সহ মুকুরিত নিকষ গোষ্পদে ||
কিন্তু গত শতকেও উল্লিখিত গ্রামের সন্ধান পায় নি স্বয়ং ব়্যাঁবো, সার্বজন্য রসের নিপান মৃগতৃষ্ণানিবারণে অসমর্থ ব’লে, সে যদিও ছুটেছিল জনশূন্য পূর্ব আফ্রিকায়, পরকীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রায়শ্চিত্তকল্পে যেন ( সাকী আর কবিতা সেখানে যেমন অভাবনীয়, মদিরার অপার্যাপ্তি তেমনি দারুণ ) | আমি বিংশ শতাব্দীর সমানবয়সী ; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে ; বীর নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনষ্যধর্মের স্তবে নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে যত না পশ্চাত্পদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে | কারণ ভূতের নির্বন্ধাতিশয়ে, তথা ভবিষ্যের নিষেধে, অধুনা ত্রিশঙ্কু, এবং সে-খণ্ডে বিশ্বের মধ্যে দ্বৈপায়ন আমরা সকলে, জানি কি না জানি, নাস্তিরই বিবর্তবাদ | এমনকি উপস্থিত হানি সম্ভবত অবাস্তব সুললিত সে-পদ্যের মতো, যাতে রেণু, বেণু, কদাচ ধেনুও, মিলে, ক্রমাগত অভিভাবে আত্মোপলব্ধির অভাব লুকিয়ে রাখে ; এবং অলীক ভেবে, উচ্ছ্বসিত স্বপ্নরচনাকে যখন করেছি ত্যাগ, সেকালে স্বকপোলকল্পিত সর্বনাশে হাহুতাশ অবৈধ ও সাফল্যবর্জিত ||
উপরন্তু, দেবযানী-শর্মিষ্ঠার কলহকলাপে আমার অদ্বৈতসিদ্ধি পণ্ড হয়ে থাক বা না থাক, অকাল জরায় আমি অবরূদ্ধ নই শুক্রশাপে ; অজাত পুরুর সঙ্গে ব্যতিহার্য নয় দুর্বিপাক | অর্থাৎ প্রকট ব’লে সম্ভোগের অনন্ত বঞ্চনা, পঞ্চাশে পা না দিতেই, অন্তর্যামী নৈমিষে নির্বাক : এবং রটায় বটে মাঝে মাঝে আজও উদ্ভাবনা পরিপূর্ণ মহাশূন্য ভস্মীভূত জ্যোতিষ্কের প্রেতে, প্রাক্তন অভ্যাসদোষে ভুলে যায় মৌনের মন্ত্রণা উন্নীত অমর কাব্যে কাগজের সুকুমার শ্বেতে ; কিন্তু চিত্তবিক্ষেপেও অভিব্যাপ্ত বর্তুল সংসার যেখানে আসক্তি, ঘৃণ্য ভিন্ন শুধু প্রাগ্বর্তী সংকেতে, এবং চক্রান্তভুক্ত পূর্বাপর নিপাত, উদ্ধার যেহেতু, আমাকে তাই অনুযোগ, শোচনা, ঈর্ষ্যাদি ক্ষেপাতে পারে না আর | চরাচরে নেতির বিস্তার নির্বিকার, হয়তো বা নিরাকার ব্রহ্মের সমাধি : অন্তত এ-পরিবেশে মানুষের প্রার্থনাসমূহ জাতিস্মর অভিমন্যু ; তবু স্তব্ধ বিধাতাকে সাধি--- মেনে নিতে পারি যেন অপ্রতর অসীমের ব্যূহ, স্বপ্নে, জাগরণে যেন মনে রাখি নয় কল্পতরু ঊর্ধ্বমূল, অধঃশাখ, দুর্নিরীক্ষ্য সেই মহীরুহ, যাকে কেন্দ্র ক’রে ছোটে দিগ্ বিদিকে সমুদ্র--- না মরু ?