কবি অকিঞ্চন দাসের বৈষ্ণব পদাবলী
*
প্রভাতে উঠিয়া শচী গৌরাঙ্গের মুখ মুছি
ভণিতা অকিঞ্চন দাস
১৮৭০ সাল নাগাদ চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা সংগৃহীত এবং তাঁর পুত্র রাজেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা ১৯২২ সালে প্রকাশিত “শ্রীশ্রীপদামৃতসিন্ধু”, ১২-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া
রয়েছে।


গৌরচন্দ্র।

প্রভাতে উঠিয়া শচী, গৌরাঙ্গের মুখ মুছি, চাঁদমুখে করয়ে চুম্বন।
স্তনদিয়া শ্রীবদনে, চাহে চাঁদমুখ পানে, কহে মোর সরবস ধন॥
আমার অন্ধের লড়ি, যেন কৃপণের কড়ি, দরিদ্র জনের তুমি ধন।
তুমি ধন নাহি যার, মিছা সে সংসার তার, বৃথা তার জনম জীবন॥
( তুমি যে নয়নের তারা, নিমিষেতে হই হারা )
দিব লাড়ু খৈ কলা, আঙ্গিনাতে কর খেলা, না যাইও বাহির চত্ত্বরে।
শুনিয়াছি লোকে কয়, তাহা মনে করি ভয়, ছেলেধরা এসেছে নগরে॥
হাসিয়া গৌরাঙ্গ কয়, যা বলহ মিছা নয়, বাহিরে যাইতে ভয় লাগে।
তাহাতে ভরসা আর, হিংসিতে শকতি কার, শিবা কি করিবে সিংহ আগে॥
অকিঞ্চন দীন কয়, গৌরাঙ্গ করুণাময়, জননীরে প্রবোধিয়া কয়।
নদিয়াতে সিংহোদয়, তাহে কি করিব ভয়, সেই হরি যে করে সে হয়॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   
      

মিলনসাগর
*
শচী ঠাকুরাণী আভরণ আনি মহানন্দে কুতূহলে
ভণিতা অকিঞ্চন দাস
১৮৭০ সাল নাগাদ চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা সংগৃহীত এবং তাঁর পুত্র রাজেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা ১৯২২ সালে প্রকাশিত “শ্রীশ্রীপদামৃতসিন্ধু”, ৮-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া
রয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা।
গৌরচন্দ্র।

শচী ঠাকুরাণী আভরণ আনি মহানন্দে কুতূহলে।
এসরে নিমাই, ভূষণ পরাই, সবাই নাচিতে বলে॥
শচী পরান ভূষণ যেখানে যেমন সাজে।
লোনার ঘুঙ্ঘুর, অতি সুমধুর, রুণু রুণু করি বাজে॥
করে টাড় বালা, কনকের মালা, গোরাগলে ভাল দোলে।
শ্রীমণিকুণ্ডল, কর্ণে ঝল্ মল্, চন্দন তিলক ভালে॥
চাঁচর চিকুরে, তাহার উপরে, বেঢ়ি কুসুমের ফুলে।
মুছি শ্রীবদন, নয়নে অঞ্জন, যাহাতে যুবতী ভুলে॥
শচী চরণে নুপূর পরাইয়া।
সাজায়ে আপন সুতে, বদন হেরিতে, শচী পড়ে মূরছিয়া॥
চৈতন্য-চাতুরী, লাবণ্য-লহরী, নদীয়া-নাগরী দেখি।
নাহি চলে মন, সহিত জীবন, লাগিয়া রহিল আঁখি॥
কেহ বলে বিধি, এ যে রূপনিধি, গঠিল যতন করি।
কিয়ে ইহাধিক, বুঝি সে রসিক, বধিতে কুলের নারী॥
কহে কোন ধনি, যে শুনিনু বাণী, বটে গোরা মনোহরা।
অকিঞ্চন বলে, এই যে গোকুলে, নন্দের নবনীচোরা॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   
     

মিলনসাগর
*
জয় জয় শচীর নন্দন গোরারায়
ভণিতা অকিঞ্চন দাস
কবি রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত, নবদ্বীপ চন্দ্র ব্রজবাসী ও খগেন্দ্রনাথ মিত্রের মহাজন পদাবলী
সংকলন “শ্রীপদামৃতমাধুরী”, ৬০৮-পৃষ্ঠা। রায় বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত সংকলনে
এই পদটি পেয়েছি বলেই আমরা এই পদটি তাঁর পাতায় এখানে তুলেছি। কিন্তু আমরা
প্রামাণিক ভাবে বলতে পারছি না যে পদটি তাঁরই রচনা। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি
বসু সম্পাদিত "সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান", ১ম খণ্ডের ১৭৫-পৃষ্ঠায় রয়েছে যে তিনি
অকিঞ্চন দাস নাম ব্যাবহার করতেন।

বসন্ত পঞ্চমী
শ্রীগৌরচন্দ্র।

॥ বসন্তরাগ - তেওট॥

জয় জয় শচীর নন্দন গোরারায়।
প্রথম ঝতু বিহরে নদীয়ায়॥
নিত্যানন্দ অদ্বৈত গদাধর সঙ্গ।
দামোদর নরহরি মাধব তরঙ্গ॥
মুকুন্দ মুরারী বসু রামানন্দ গায়।
মধুর মৃদঙ্গ জগদানন্দ বায়॥
নাচত রঙ্গে শ্রীনবদ্বীপ রায়।
দূরে রহি অকিঞ্চন দাস গুণ গায়॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   
   

মিলনসাগর
*
অতঃপর কিছু পরে রাধা বিনোদিনী
ভণিতা অকিঞ্চন দাস
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩১, ৮১৩-পৃষ্ঠা।


অতঃপর কিছু পরে রাধা বিনোদিনী।
চলিলা মন্দিরে নিজ লইয়া সঙ্গিনী॥
আয়ানের বেশ ধরি শ্রীহরি তখন।
জটিলা নিকটে ত্বরা করিলা গমন॥
কহিলা শনহ মাতা সে লম্পট হরি।
আসিবে রাধার গৃহে মম বেশ ধরি॥
কদাচ তোমরা তারে পশিতে না দিবে।
যদি না নিষেধ মানে ইষ্টক মারিবে॥
বহিদ্বরি বন্ধ করি বৈসহ উপরে।
চলিলাম আমি এখন রাধার মন্দিরে॥
এত বলি চলিলেন মনেতে উল্লাস।
আনন্দিত হৈল অতি অকিঞ্চন দাস॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   
 

মিলনসাগর
*
অভিমন্যু বেশে হরি যথা
ভণিতা অকিঞ্চন
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩২, ৮১৩-পৃষ্ঠা।


অভিমন্যু বেশে হরি যথা।
তুরিতে কুটিলা গিয়া তথা॥
মালা দুটি করেতে সঁপিল।
রোখভরে নিকটে দাঁড়াইল॥
নিরখি কপট ক্রোধে জ্বলি।
কহিছে চতুর বনমালী॥
আজি আমি মথুরায় যাব।
কংসে কহি সাজা দেওয়াইব॥
তুমি চলি যাও ভবনেতে।
আমি আসি মথুরা হইতে॥
এত বলি করিল গমন।
অকিঞ্চন আনন্দিত মন॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আয়ান আসিয়া ডাকিছে হাঁকিয়া
ভণিতা দ্বিজ অকিঞ্চন
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩৩, ৮১৪-পৃষ্ঠা।


আয়ান আসিয়া ডাকিছে হাঁকিয়া
.                দাঁড়িয়ে বাহির দ্বারে।
দ্বার খোল বলি মাতা ও ভগ্নীরে
.                ঘন ঘন ডাক ছাড়ে॥
উপরে থাকিয়া কুটিলা কহিছে
.                রাঙা করি দুটি আঁখি।
তোর চতুরতা আজ বুঝিয়াছি
.                নিতি নিতি দাও ফাঁকি॥
উপরে যেমন বরণ কালিম
.                ভিতরে তেমনই কালি।
দূর হ রাখাল কূল মজানিয়া
.                নতুবা খাইবি গালি॥
স্রমেতে কাতর আয়ান তখন
.                রক্তিম নয়নে চায়।
বলে দ্বার খোল নতুবা কুটিলা
.                মরিবি পাঁচনি ঘায়॥
শুনিয়া কুটিলা দ্বিগুণ কুপিল
.                ইষ্টক লইয়ে হাতে।
যত পারে মুখে দেয় গালাগালি
.                মারে আয়ানের মাথে॥
ভুতে ধরিয়াছে ভাবিয়া আয়ান
.                ওঝা ডাকিবারে গেল।
দ্বিজ অকিঞ্চন আয়ান প্রহার
.                হরসিতে বিরচিল॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
আয়ানের বেশে বাহির হইলা
ভণিতা অকিঞ্চন
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩৪, ৮১৪-পৃষ্ঠা।


আয়ানের বেশে বাহির হইলা।
কুটিলা নিকটে গিয়া তুরিতে ভেটিলা॥
আয়ানের স্বরে তারে বলিছেন বাণী।
কুটিলে বিজন বনে কেন একাকিনী॥
আমি ভ্রমিতেছি করি বৃষ অন্বেষণ।
তুমি কোন অভিপ্রায় কৈলে আগমন॥
কুটিলা কহিছে করি বধু অন্বেষণে।
করিয়ে স্নানের ছলা এসেছে এ বনে॥
হরি কহেন মুখে রোষ করিয়া প্রকাশ।
আমি হেথা বসি তুমি করহ তল্লাস॥
যদি কৃষ্ণ সহ তারে একত্র দেখিবে।
নিকটে না যাবে আসি আমারে ডাকিবে॥
যদি একাকিনী থাকে ছল প্রকাশিয়া।
আমার নিকটে তারে আনিবে ডাকিয়া॥
শুনিয়া কুটিলা বড় হরষিত মন।
কুটিলার অন্বেষণ ভণে অকিঞ্চন॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
একদিন একাকিনী ভাগ্যবতী নন্দরাণী
ভণিতা দীন অকিঞ্চন
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩৫, ৮১৪-পৃষ্ঠা।


একদিন একাকিনী                                ভাগ্যবতী নন্দরাণী
করিছে মঞ্জুষা সাজন।
হেনকালে তথা হরি                             সুবলেরে সঙ্গে করি
উপজিয়া জননীরে কন॥
এ পেটিকা কার তরে                             সাজাইছ যত্ন করে
দিবে মা দাদায় কি আমারে।
রাণী কহে উত্কৃষ্ট                             তোমাদের আছে কৃষ্ণ
এ মঞ্জুষা দিব রাধিকারে॥
বলি রাণী আন কাজে                         গেলে নানা করি ব্যাজে
সুবলেরে বান্ধিতে কহিলা।
সেই অবকাশে হরি                                নিভৃতে মন্ত্রণা করি
মঞ্জুষা ভিতরে লুকাইলা॥
সুবল পেটিকা আঁটিল                          হেনকালে রাণী আইল
কৃষ্ণ কোথা জিজ্ঞাসে তখন।
সুবল কহয়ে মাই                                 পথপানে গেছে ভাই
ভণয়ে দীন অকিঞ্চন॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
কুটিলা তখন হরষিত মন
ভণিতা অকিঞ্চন
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩৬, ৮১৫-পৃষ্ঠা।


কুটিলা তখন হরষিত মন
.                প্রবেশিল কুঞ্জগৃহ।
কৃত্তিদাতনয়া আছেন বসিয়া
.                যথা সখীগণ সহ॥
দেখি কুটিলায় ললিতা সুধায়
.                এসেছ কি স্নান তরে।
কহিছে কুটিলা কত জান ছলা
.                শিখাইব ভাল কোরে॥
স্নানের লাগিয়া বধূরে আনিয়া
.                লম্পট কালায় দিলি।
মোর পিতৃকুলে কালি দিলি ঢেলে
.                তোর মুখে চুণ কালি॥
এত বলি রুষি সদলে প্রবেশি
.                চায় চারিদিক পানে।
দেখে বনমালা রাইয়ের মতিমালা
.                পড়ে আছে এক স্থানে॥
ক্রোধে কাঁপে অঙ্গ করিয়ে ভ্রুভঙ্গ
.                রাধা পানে চায় ঘন।
রাধা পেয়ে ভয় সবিনয় কয়
.                ক্রোধ কর কি কারণ॥
যেই মালা দেখে চাহিতেছ রোখে
.                করিতেছ সংশয়।
তোমার দাদার মাথা খাই যদি
.                ঐ মালা মোর হয়॥
শুনি কোপে জ্বলে মালা লয়ে চলে
.                কুটিলা কুটিলমতি।
ভণে অকিঞ্চন রাধিকা তখন
.                ভয়ে চাই ইতি উতি॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
খেলাতে হারিলে বাঁশী রমণীর মাঝে
ভণিতা অকিঞ্চন দাস
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত, কাঞ্চন বসু সম্পাদিত পদাবলী সংকলন “বৈষ্ণব পদাবলী”,
পদসংখ্যা-২৯৩৭, ৮১৫-পৃষ্ঠা।


খেলাতে হারিলে বাঁশী রমণীর মাঝে।
বাঁশীটি হারায়ে ঘরে যাবে কোন লাজে॥
না দিব না দিব বন্ধু তোমারে ছাড়িয়ে।
মদন কুটীর ঘরে রাখিব বান্ধিয়ে॥
জলকেলি করেছিলে যমুনার জলে।
বসন কাড়িয়ে মোরে কত দুখ দিলে॥
একদিন রাজপথে দানী হয়েছিলে।
দান দেহ বলি তুমি পথ আগুলিলে॥
এই বাঁশী দিবানিশি করে অপমান।
এই বাঁশীর স্বরে হরে যুবতীর প্রাণ॥
এই বাঁশী বৃন্দাবনে করে নানা রস।
যার স্বরে ব্রজপুরের নারী তোমার বশ॥
যার গানে ভুলাইলে এ তিন সংসার।
এ বাঁশী হারায়ে শ্যাম কি হবে তোমার॥
এই বাঁশী দংশে মোরে হয়ে কাল ফণী।
সাগরে ভাসাব বাঁশী করি দুইখানি॥
শুকাইল শ্যামের বদন মলিন হৈল শশী।
অকিঞ্চন দাস কহে দিতে হৈল বাঁশী॥

.           *************************         
.                                                                             
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর