এই পাতার কবিতার ভণিতা - যদুনাথ, যদুনাথ দাস
|
যদু, যদুনন্দন দাস ও যদুনাথ - পাতার উপরে . . .
কর্ণানন্দ গ্রন্থ সম্পূর্ণ করতে গিয়ে শেষ ভণিতায় যদুনন্দন দাস নিজের নাম যদুনাথ দাস লিখেছেন। ছন্দের
ত্রুটি এড়াতে তিনি এরকম করে থাকলেও তিনি যে যদুনাথ নামেও রচনা করেছেন এই তার প্রমাণ। সুতরাং
পদকর্তা যদুনাথের পদের সঙ্গে এই যদুনন্দন দাসের পদ যে মিশতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। . . .
শ্রীআচার্য্য প্রভুর কন্যা শ্রীল হেমলতা।
প্রেম কল্পবল্লী কি বা নিরমিল ধাতা॥
সেই দুই চরণ পদ্ম হৃদয়ে বিলাসে।
কর্ণানন্দ কথা কহে যদুনাথ দাসে॥ ---যদুনন্দন দাস, কর্ণানন্দ গ্রন্থের সপ্তম তথা শেষ নির্যাসের ভণিতা॥
কৃষ্ণদাস কবিরাজের সংস্কৃতে লেখা গোবিন্দ লীলামৃত গ্রন্থের, যদুনন্দন দাস কৃত বঙ্গানুবাদের ১ম সর্গে,
আমরা “যদুনাথ দাস” ভণিতা পাই। এই গ্রন্থে “যদুনাথ” ভণিতার পদও রয়েছে। সুতরাং “যদুনাথ দাস”
ভণিতা যুক্ত, প্রাপ্ত পদাবলীতে কিছু পদ যে এই যদুনন্দনের তাতে সন্দেহের নেই . . .
নিকুঞ্জে নিশান্তে কেলি মধুর বিলাস।
সংক্ষেপে কহয়ে কিছু যদুনাথ দাস॥
“গোবিন্দ লীলামৃত” গ্রন্থের, যদুনন্দন দাস কৃত বঙ্গানুবাদের ২১শ সর্গে, “দেখিয়া উজোর রাতি” পদটি “যদু”
ভণিতাযুক্ত। সুতরাং “যদু” ভণিতা যুক্ত প্রাপ্ত পদাবলীতে কিছু পদ যে এই “যদুনন্দনের” তাতে সন্দেহের
অবকাশ নেই . . .
জয় প্রভু শ্রীচৈতন্য, শ্রীগোপাল ভট্ট ধন্য, জয় জয় আচার্য্য ঠাকুর।
মোর প্রভু জয় জয়, শ্রী ঠাকুজ্ঝি মহাশয়, যদু যার উচ্ছিষ্ট কুক্কুর॥
যদুনন্দন ও যদুনাথ সম্বন্ধে রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
অধ্যাপক রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর পদামৃতমাধুরী, ৪র্থ খণ্ডে যদুনন্দনের সম্বন্ধে লিখেছেন . . .
“পদকর্ত্তা যদুনন্দনের নামান্তর ছিল যদুনাথ। যদুনাথ নামে স্বতন্ত্র এক পদকর্ত্তা ছিলেন, ইহাও জানা গিয়াছে।
যদুনন্দনও একাধিক ছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে একজন হইতেছেন অদ্বৈতশাখাভুক্ত যদুনন্দনাচার্য্য। ইনি গদাধর
পণ্ডিতের শিষ্য ও শ্রীগৌরাঙ্গের চরিত-লেখক। কাটোয়ায় আর একজন যদুনন্দন ছিলেন। ‘ভক্তিরত্নাকরে’
তিনি পদরচয়িতা রূপে উক্ত হইয়াছেন। তৃতীয় যদুনন্দন মালিহাটী নিবাসী বৈদ্যবংশীয় বিখ্যাত পদকর্ত্তা
ছিলেন। তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কর্ণানন্দের’ প্রণেতা। তিনি রূপগোস্বামী প্রণীত বিদগ্ধমাধবের এবং কবিরাজ
গোস্বামীর সংস্কৃত কাব্য গোবিন্দলীলামৃত গ্রন্থের বাংলা পদ্যানুবাদ করিয়া গিয়াছেন। ইঁহার নামান্তর ছিল
যদুনাথ।”
যদুনন্দন ও যদুনাথ সম্বন্ধে সুকুমার সেনের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
সুকুমার সেন তাঁর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদাবলী” গ্রন্থে যদুনন্দন সম্বন্ধে লিখেছেন . . .
“যদুনন্দন দাস ছিলেন স্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য এবং আচার্য-কন্যা হেমলতার অনুচর। যদুনন্দন আচার্য ও
আচার্যকন্যার জীবনী অবলম্বনে “কর্ণানন্দ” লিখেছিলেন। ইনি রূপগোস্বামীর বিদগ্ধ-মাধব নাটক ও কৃষ্ণদাস
কবিরাজের গোবিন্দলীলামৃত কাব্য বাংলায় রূপান্তরিত করেছিলেন।”
সেই গ্রন্থেই সুকুমার সেন যদুনাথদাস সম্বন্ধে লিখেছেন . . .
“পদকর্তা যদুনাথের পরিচয় অজ্ঞাত। নিত্যানন্দের এক অনুচর ছিলেন যদুনাথ কবিচন্দ্র নামে। যদুনন্দন
নামে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে একাধিক বৈষ্ণ ভক্ত ও পদকর্তা ছিলেন। ছন্দের প্রয়োজনে তাঁরা ‘যদুনাথ’
নামও ব্যবহার করেছেন।
যদুনাথদাস নামে একাধিক বৈষ্ণব মহান্ত ছিলেন ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে। নামটি যদুনন্দনের রূপান্তর
হতে পারে।”
যদুনন্দন ও যদুনাথ সম্বন্ধে দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদসঙ্কলন” গ্রন্থে যদুনাথদাস সম্বন্ধে লিখেছেন . . .
“সপ্তদশ শতকের কবি যদুনন্দন দাস কাটোয়ার নিকটবর্তী মালিহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি জাতিতে
বৈদ্য। কবি শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য এবং শ্রীনিবাসের কন্যা হেমলতাদেবীর অনুচর ছিলেন। রূপগোস্বামীর
বিদগ্ধমাধব নাটক, বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের গোবিন্দলীলামৃত ইত্যাদি গ্রন্থ
অনুবাদ করে যদুনন্দন বিখ্যাত হন। মূলতঃ অনুবাদক হলেও তাঁর রচনা নিছক অনুবাদ নয়।
এ ছাড়া ষোড়শ শতকে অদ্বৈত গণভুক্ত আর এক যদুনন্দনাচার্য গৌরাঙ্গের ‘অদ্ভুত চরিত’ লেখেন এবং
নিত্যানন্দ পার্ষদ যদুনন্দন চক্রবর্তীর নামেও কিছু পদ পাওয়া যায়।”
ঐ গ্রন্থেই যদুনাথ দাস সম্বন্ধে দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখেছেন . . .
“যদুনাথ দাস নামে যিনি গৌরাঙ্গ ও রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন সেই যদুনাথ চক্রবর্তী ছিলেন
নিত্যানন্দের সমসাময়িক এবং নিত্যানন্দ শিষ্য গদাধরের অনুচর বলে প্রসিদ্ধ।”
যদুনন্দন দাসের রচনাসম্ভার - পাতার উপরে . . .
তাঁর অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণদাস কবিরাজের “গোবিন্দ লীলামৃত”, রূপ গোস্বামীর “হংস দূত” ও
“বিদগ্ধমাধব” নাটক, রঘুনাথ দাসের “মুক্তাচরিত”, রামানন্দ রায়ের “জগন্নাথ বল্লভ” নাটক প্রভৃতি।
তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে রয়েছে “হরিভক্তি চন্দ্রামৃত”, “কর্ণানন্দ”, “শ্রীচৈতন্য চন্দ্রামৃত” প্রভৃতি এবং প্রায়
দুইশতাধিক রাধা-কৃষ্ণ ও গৌর বিষয়দ পদ।
এক যদুনাথ দাসের অজ্ঞাত রচনাকালের "শাখানির্ণয়ামৃত" নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে যাতে
চৈতন্যমঙ্গল রচয়িতা কবি জয়ানন্দের উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থটি ছাড়া বৈষ্ণব সাহিত্য ও
ইতিহাসের কোনও গ্রন্থেই জয়ানন্দের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।
কবি যদুনন্দন দাস - পাতার উপরে . . .
যদুনন্দন নামে একাধিক কবি ছিলেন। নিশ্চিতভাবে তাঁদের মধ্য থেকে অন্তত একজন (মালিহাটীর
যদুনন্দন), তাঁর কোনো কোনো পদে যদুনাথ ভণিতাযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া যদুনাথ নামেও কবির পদ
পাওয়া গিয়েছে। তাঁই খুব স্বাভাবিকভাবে যদুনন্দন ও যদুনাথের পদ মিশে রয়েছে। আমরা যদুনন্দন ও
যদুনাথের পদ আলাদা করে এখানে তুলেছি। এ ছাড়া নিশ্চিতভাবে যদুনন্দনের “যদুনাথ” ভণিতার পদও
আলাদা করে তুলেছি। শ্রীনিবাস আচার্য্যর ভ্রাতুষ্পুত্র সুবলচন্দ্রের এক শিষ্য যদুনন্দন দাসের কোনো পদ
আমরা এখনই মিলনসাগরে তুলছি না।
জগবন্ধু ভদ্র সংকলিত ও মৃণালকান্তি ঘোষ সম্পাদিত গৌরপদতরঙ্গিণী (২য় সংস্করণ, ১৯৩৪) খেকে আমরা
৫জন যদুনন্দন এবং ১জন যদুনাথের উল্লেখ করেছেন। সতীশচন্দ্র রায় তাঁর পদকল্পতরু গ্রন্থের ভূমিকায়
৩জন যদুনন্দনের কথা বলেছেন। এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শান্তিলতা রায় তাঁর ১৯৬০ সালে
প্রকাশিত “বৈষ্ণব সাহিত্য ও যদুনন্দন” গ্রন্থে।
যদুনন্দন নামে যাঁদের পাওয়া যাচ্ছে . . .
১) চৈতন্যচরিতামৃতের চৈতন্য-শাখায় বর্ণিত যদুনন্দন। এনার কবিত্ব নিয়ে কিছু উল্লেখ করা নেই।
ভাগবতাচার্য্য, চিরঞ্জীব, রঘুনন্দন।
মাধবাচার্য্য, কমলাকান্ত, শ্রীযদুনন্দন॥
---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত(জগদীশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত), আদিলীলা, ১১শ পরিচ্ছেদ, ২৮৫-পৃষ্ঠা॥
২) চৈতন্যচরিতামৃতের অদ্বৈত-শাখায় বর্ণিত যদুনন্দনাচার্য্য, যিনি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর পিতা ও পিতৃব্যের
কুলগুরু ছিলেন। এঁকেও কবি বলে উল্লেখ করা হয়নি। চৈতন্যচরিতামৃতে এঁর উল্লেখ রয়েছে . . .
শ্রীযদুনন্দনাচার্য্য অদ্বৈতের শাখা।
তাঁর শাখা উপশাখাগণের নাহি লেখা॥
---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত(জগদীশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত), আদিলীলা, ১২শ পরিচ্ছেদ, ৩০৪-পৃষ্ঠা॥
৩) দক্ষিণেশ্বরের নিকটবর্তী আড়িয়াদহে গদাধর দাসের শিষ্য যদুনন্দন চক্রবর্তী যাঁর শ্রীপাট ছিল কাটোয়া বা
কণ্টকনগরে। ইনি গৌরাঙ্গের “অদ্ভুত চরিত” রচনা করেছিলেন এবং কবি রূপে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। ইনি
যদুনাথ দাস নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। ভক্তিরত্নাকরে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। এক যায়গায় তাঁকে যদু বলেও
উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রীযদুনন্দন চক্রবর্তী বিজ্ঞবর।
যাঁর ইষ্টদেব প্রভু দাস গদাধর॥
নিজ ইষ্ট সঙ্গোপন-দুঃখে দগ্ধ হিয়া।
হইলা অধৈর্য্য তেঁহো আচার্য্যে দেখিয়া॥
শ্রীনিবাসাচার্য্য চেষ্টা গেখিয়া তাহার।
স্থির হৈতে নারে নেত্রে বহে অশ্রুধার॥
প্রভু গদাধর গুণ করিয়া কীর্ত্তন।
দোঁহে কান্দে ফুকরি কান্দয়ে সর্ব্বজন॥
* * * * *
হেনই সময় যদু কহে ধীরে ধীরে।
সবে আস্ প্রবেশিলা কণ্টকনগরে॥
* * * * *
এথা যদুনন্দাদি সাধি সর্ব্বকার্য্য।
যদুনন্দনের চেষ্টা পরম আশ্চর্য্য॥
দীন প্রতি দয়া যৈছে কহিল না হয়।
বৈষ্ণবমণ্ডলে যার প্রশংসাতিশয়॥
যে রচিল গৌরাঙ্গের অদ্ভুত চরিত।
দ্রবে দারু পাষাণাদি শুনি যার গীত॥
---নরহরি চক্রবর্তী ঘনশ্যাম, ভক্তিরত্নাকর, ৯ম তরঙ্গ, শ্রীকাটোয়া যাজিগ্রাম শ্রীখণ্ড মহোত্সব বর্ণনা॥
৪) প্রভু নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের শ্বশুর ঝামটাপুর নিবাসী, পিপ্পলীবংশজাত যদুনন্দন আচার্য্য যিনি
বীরভদ্রেরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
৫) শ্রীনিবাস আচার্য্যর ভ্রাতুষ্পুত্র সুবলচন্দ্রের এক শিষ্য যদুনন্দন দাস যিনি "কৃষ্ণকর্ণামৃত" গ্রন্থের বাংলায়
অনুবাদ করেছিলেন। "কৃষ্ণকর্ণামৃত" কবি বিল্বমঙ্গগলের সংস্কৃত ভাষায় রচনা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ এর
"রসিকরঙ্গদা" নামক টীকা লিখেছিলেন সংস্কৃতেই। এই গ্রন্থে, শেষের প্রার্থনা সহ ১১২টি শ্লোকের ১১২টি
অনূদিত পদ রয়েছে। সম্ভবত স্বাধীনভাবে পদ রচনা করেননি বলে, কোনো পদেই এই যদুনন্দন তাঁর ভণিতা
দেন নি। গ্রন্থের কোনো পদেই রাগ-তাল উল্লেখ করা নেই। এই যদুনন্দনের এই গ্রন্থ থেকে কোনো পদ
আমরা এখনই মিলনসাগরে তুলছি না।
৬) শ্রীনিবাস আচার্য্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরাণীর এক শিষ্যের নাম ছিল যদুনন্দন, যিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ
ছিলেন। তাঁর রাগানুগা সাধনমার্গ বিষয়ক গ্রন্থ সংগ্রহ-তোষণী তে তাঁর নিজের আত্মপরিচয়ে, এক জায়গায়
জানান . . .
হেমলতার শিষ্য হই পালি গ্রামে বাস।
---শান্তিলতা রায়, বৈষ্ণব সাহিত্য ও যদুনন্দন, ৩-পৃষ্ঠা॥
অন্যত্র লিখেছেন . . .
হেমলতার শিষ্য আমি বিপ্রকুলে জন্ম।
---শান্তিলতা রায়, বৈষ্ণব সাহিত্য ও যদুনন্দন, ৩-পৃষ্ঠা॥
সেই গ্রন্থে ব্রজলীলার সূত্র বর্ণনায় লিখেছেন . . .
সুদীপ্ত মধুর রস সর্বমতে লাগে।
যৈছে বীজ ইক্ষু রস গোসাই লেখেন আগে॥
তার তত্ত্ব কমল বিচারিয়া এ তত্ত্ব বর্ণন।
কাতরে কহিল কিছু এ যদুনন্দন॥
---শান্তিলতা রায়, বৈষ্ণব সাহিত্য ও যদুনন্দন, ৩-পৃষ্ঠা॥
৭) শ্রীনিবাস আচার্য্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরাণীর আরও এক শিষ্যের নাম ছিল যদুনন্দন দাস। ইনি
জাতিতে বৈদ্য ছিলেন এবংঅনুবাদক রূপেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ইনি কৃষ্ণদাস কবিরাজের গোবিন্দ
লীলামৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। গ্রন্থের শেষে তাঁর পরিচয়ে লিখেছেন . . .
চৈতন্য দাসের দাস, ঠাকুর শ্রীশ্রীনিবাস, আচার্য্যজা শ্রীল হেমলতা।
তাঁর পাদপদ্ম আশ, এ যদুনন্দন দাস, অম্বুষ্ঠ প্রাকৃতে কহে কথা॥---যদুনন্দন দাস, গোবিন্দ লীলামৃত॥
অর্থাৎ শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা শ্রীল হেমলতার শ্রীচরণের আশায়, যদুনন্দন দাস, যিনি অম্বুষ্ঠ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ
পতি ও বৈশ্য পত্নীর বংশজ অর্থাৎ বৈদ্যকুলজাত, প্রাকৃতে, এক্ষেত্রে বাংলা ভাষায়, বলছেল।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত, শান্তিলতা রায়ের “বৈষ্ণব সাহিত্য এ যদুনন্দন” গ্রন্থ থেকে যানা যায় যে এই যদুনন্দন
দাসই রঘুনাথ গোস্বামী রচিত সংস্কৃত গ্রন্থ “মুক্তাচরিত”-এরও অনুবাদ করেছিলেন। এই অনুবাদ গ্রন্থে তাঁর
ভণিতায় লিখেছেন . . .
মুক্তাচরিত কথা অমৃত হইতে পরামৃতা
. গায় দীন এ যদুনন্দন।
এই মুক্তাচরিত গ্রন্থেও তিনি নিজের, হেমলতা ঠাকুরাণীর শিষ্য বলে পরিচয় দিয়েছেন।
শ্রীচৈতন্য কৃপান্বিত শ্রীগোপাল ভট্ট খ্যাত
. তার কৃপাপাত্র শ্রীআচার্য্য।
ঠাকুর মোর দয়াময় তার কন্যা মহাশয়
. হেমলতা আমার আচার্য্য॥
---যদুনন্দন দাস, মুক্তাচরিত॥ বরাহ নগর গ্রন্থ মন্দির পুঁথি সংখ্যা ২২৭৫/২৬, পৃষ্ঠা ৯৮ক।
সেখানে তিনি থাকলেও তাঁর বাড়ী ছিল কাটোয়ার অন্তর্গত মালিহাটি গ্রামে। তাও কর্ণানন্দ গ্রন্থ থেকেই জানা
যায়। কর্ণানন্দ গ্রন্থের ২য় নির্যাসে রয়েছে . . .
এবে কহি ঠাকুরঝি শ্রীল হেমলতা।
শ্রীমতীর শিষ্যগণে আছে যার কথা॥
* * * * *
দীনহীন যদুনন্দন বৈদ্যদাস তার।
মালিহাটি গ্রামে স্থিতি প্রেমহীন ছার॥
তাঁর রচিত কর্ণানন্দ গ্রন্থের রচনাকাল সম্বন্ধে সেই গ্রন্থের ৬ষ্ঠ নির্যাস থেকে জানা যায় যে তিনি তাঁর
দীক্ষাগুরু হেমলতা ঠাকুরাণীর থেকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। হেমলতা ঠাকুরাণীর পাট বুঁধই পাড়ায়
তিনি ছিলেন। গ্রন্থ শুনে হেমলতা দেবীই গ্রন্থের নাম রাখেন কর্ণানন্দ। . . .
বুঁধই পাড়াতে রহি শ্রীমতী নিকটে।
সদাই আনন্দে ভাসি জাহ্নবীর তটে॥
পঞ্চদশ শত আর বত্সর উনত্রিশে।
বৈশাখ মাসেতে আর পূর্ণিমা দিবসে॥
নিজ প্রভুর পাদপদ্ম মস্তকে ধরিয়া।
সম্পূর্ণ করিলাঙ গ্রন্থ শুন মন দিয়া॥
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভুর দাসের দাস।
তার দাসের দাস এ যদুনন্দন দাস॥
গ্রন্থ শুনি ঠাকুরাণীর মনের আনন্দ।
শ্রী মুখে রাখিলা নাম গ্রন্থ কর্ণানন্দ॥
১৫২৯ শকাব্দে অর্থাৎ ১৬০৭ খৃষ্টাব্দে বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে যদুনন্দন দাস কর্ণানন্দ গ্রন্থ রচনা শেষ
করেন। সতীশচন্দ্র রায় পদকল্পতরুতে বলেছেন যে যদুনন্দন দাস ৭০ বছর বয়সে তাঁর কর্ণানন্দ গ্রন্থ শেষ
করেন। তা হলে তাঁর জন্ম ১৫৩৭ খৃষ্টাব্দে বলে ধরে নেওয়া যায়। সতীশচন্দ্র অবশ্য তাঁর এই তথ্যের উত্স
উল্লেখ করেন নি।
কবি যদু দাস - পদকর্তা যদুনন্দনের “যদুনন্দন”, “যদুনন্দন দাস”, “যদুনাথ”, “যদুনাথ দাস” “যদু দাস”
এবং “যদু” ভণিতার পদ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে যদুনন্দন ও যদুনাথ ভণিতার পদ আলাদা করা সহজ
হলেও “যদু দাস” এবং “যদু” ভণিতার পদগুলি যদুনন্দন বা যদুনাথ উভয় পদকর্তার পদ হতে পারে বলে
অনুমান করা যেতে পারে।
তাই যদু, যদুনাথ ও যদুনন্দন এই তিন কবির পাতা থেকেই এঁদের সব পদাবলী পড়া সম্ভব যাতে হয়, সেই
ব্যবস্থা করা হয়েছে মিলনসাগরে।
জানিয়েছেন। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে অথবা কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে যে কবিদের
উল্লেখ রয়েছে তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই চৈতন্য সমকালীন কবি।
এই যদুনাথের উল্লেখ পাই বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে। তাঁর “কবিচন্দ্র” উপাধি থেকে বোঝা যায় কবি
হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ইনি চৈতন্য সমকালীন কবি। . . .
যদুনাথ কবিচন্দ্র প্রেমরসময়।
নিরবধি নিত্যানন্দ যাঁহারে সদয়॥
---বৃন্দাবন দাস, চৈতন্যভাগবত (রাধানাথ কাবাসী সম্পাদিত), অন্ত্যলীলা, ৫ম অধ্যায়, নিত্যানন্দ বিলাস বর্ণন,
৩৯৮-পৃষ্ঠা॥
কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে দুইজন যদুনাথের উল্লেখ রয়েছে। একজন “মহাভাগবত” প্রভু
নিত্যানন্দের শাখা এবং অপরজন “কুলীন গ্রামবাসী” শ্রীচৈতন্যের মূল শাখার অন্তর্গত। . . .
মহা ভাগবত যদুনাথ কবিচন্দ্র।
যাঁহার হৃদয়ে নৃত্য করে নিত্যানন্দ॥
---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত(জগদীশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত), আদিলীলা, ১১শ পরিচ্ছেদ, মূলস্কন্ধশাখা
বর্ণন, ২৯৪-পৃষ্ঠা॥
এবং
কুলীন গ্রামবাসী সত্যরাজ রামানন্দ।
যদুনাথ পুরুষোত্তম শঙ্কর বিদ্যারত্ন॥
বাণীনাথ বসু আদি যত গ্রামী জন।
সবেই চৈতন্য ভৃত্য চৈতন্য প্রাণধন॥
প্রভু কহে ‘কুলীন গ্রামের যে হয় কুক্কুর।
সেহ মোর প্রিয় অন্য জন বহুদূর’॥
কুলীন গ্রামীর ভাগ্য কহনে না যায়।
শূকর চরায় ডোম, সেহ কৃষ্ণ গায়॥
---কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত(জগদীশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত), আদিলীলা, ১১শ পরিচ্ছেদ, মূলস্কন্ধশাখা
বর্ণন, ২৮০-পৃষ্ঠা॥
কর্ণানন্দের রচয়িতা, মালিহাটির যদুনন্দন দাস “যদুনাথ দাস” ভণিতাতেও পদ রচনা করেছেন। এই কারণেই
আমরা যদুনাথ এবং যদুনন্দনের পরিচিতি একত্রে দিয়েছি।
এক যদুনাথ দাসের অজ্ঞাত রচনাকালের "শাখানির্ণয়ামৃত" নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে যাতে
চৈতন্যমঙ্গল রচয়িতা কবি জয়ানন্দের উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থটি ছাড়া বৈষ্ণব সাহিত্য ও
ইতিহাসের কোনও গ্রন্থেই জয়ানন্দের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।
যদুনাথ দাস - নামে যিনি গৌরাঙ্গ ও
রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন সেই
যদুনাথ চক্রবর্তী ছিলেন নিত্যানন্দের সমসাময়িক
এবং নিত্যানন্দ শিষ্য গদাধরের অনুচর বলে
প্রসিদ্ধ। দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ১৯৫৭ সালে
প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদসঙ্কলন” গ্রন্থে এ কথা
নরহরি চক্রবর্তী ঘনশ্যামের ভক্তিরত্নাকরে যদু - পাতার উপরে . . .
নরহরি চক্রবর্তী ঘনশ্যাম বিরচিত “ভক্তিরত্নাকর” গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে দক্ষিণেশ্বরের নিকটবর্তী
আড়িয়াদহে গদাধর দাসের শিষ্য যদুনন্দন চক্রবর্তীর নাম, যাঁর শ্রীপাট ছিল কাটোয়া বা কণ্টকনগরে। ইনি
গৌরাঙ্গের “অদ্ভুত চরিত” রচনা করেছিলেন এবং কবি রূপে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। ইনি যদুনাথ দাস নামেও
প্রসিদ্ধ ছিলেন। নীচের পদে, এক যায়গায় তাঁকে যদু বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রীযদুনন্দন চক্রবর্তী বিজ্ঞবর।
যাঁর ইষ্টদেব প্রভু দাস গদাধর॥
নিজ ইষ্ট সঙ্গোপন-দুঃখে দগ্ধ হিয়া।
হইলা অধৈর্য্য তেঁহো আচার্য্যে দেখিয়া॥
শ্রীনিবাসাচার্য্য চেষ্টা গেখিয়া তাহার।
স্থির হৈতে নারে নেত্রে বহে অশ্রুধার॥
প্রভু গদাধর গুণ করিয়া কীর্ত্তন।
দোঁহে কান্দে ফুকরি কান্দয়ে সর্ব্বজন॥
* * * * *
হেনই সময় যদু কহে ধীরে ধীরে।
সবে আস্ প্রবেশিলা কণ্টকনগরে॥
* * * * *
এথা যদুনন্দাদি সাধি সর্ব্বকার্য্য।
যদুনন্দনের চেষ্টা পরম আশ্চর্য্য॥
দীন প্রতি দয়া যৈছে কহিল না হয়।
বৈষ্ণবমণ্ডলে যার প্রশংসাতিশয়॥
যে রচিল গৌরাঙ্গের অদ্ভুত চরিত।
দ্রবে দারু পাষাণাদি শুনি যার গীত॥
---নরহরি চক্রবর্তী ঘনশ্যাম, ভক্তিরত্নাকর, ৯ম তরঙ্গ, স্রীকাটোয়া যাজিগ্রাম শ্রীখণ্ড মহোত্সব বর্ণনা॥