কবি ব্রজসুন্দর সান্ন্যালের কবিতা
*
শ্রেষ্ঠ রণ
কবি ব্রজসুন্দর সান্যাল
নরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্ত্তৃক প্রকাশিত “জন্মভূমি” পত্রিকার বৈশাখ ১৩১০ সংখ্যায় (এপ্রিল ১৯০৩) প্রকাশিত।


(১)
আজি কে তোরা নিশীথে চাহিস্‌ পশিতে
সমর-মাঝে
রুদ্র-সাজে !
ওই শুন্‌ শুন্‌ মধুর বাঁশি
বিশ্ব-বধূর মোহন হাসি
নিঃস্ব-হৃদয়ের বাসনা-রাশি
জাগিছে লাজে ;
আয় আয় ভাঙ্গিয়া স্বপ্ন
আপন কাজে
সমর-সাজে।

(২)
ওগো, ওই হেসে ফিরে ভিভরে বাহিরে
মত্ত-ধ্বনি
শুনা না, শুনি,
নিত্য নিশিতে দীপ্ত-শশীতে
ক্ষিপ্ত করিছে এ রণে মিশিতে
জীবন সনে আপনা বুঝিতে
ডাকিছে ধ্বনি ;
শ্রবণ-রন্ধ্রের রুধিয়া দ্বার
বসেছে শনি
শুন না, শুনি।

(৩)
আর, হেলায় ফেলায় দিস্‌ না ফেলায়ে
জীবন-ধন
আয়রে মন,
চক্র বাসনা করি দে দূর
বাসব-চক্রে সাজিয়া অদূর
শনির চূড়া করিতে চূর
কররে পণ ;
আঁধারে আঁধারে আঁধারে আঁধার
হোক হনন
জীবন পণ।

(৪)
আজি, বিচিত্র আসন রেখেছে কেবা
দ্যুলোক ’পরে
আলোকপুরে,
ভক্ত-রক্ত-সিক্ত ফুলে
অঞ্জলি দেবে চরণ-মূলে,
কোন্‌ এ মোহিনী প্রেমের কোলে
ডাকিছে তোরে?
মত্ত ব্যথা ঠেলিয়া চল্‌
পক্ষ-ভরে
দ্যুলোক ’পরে।

(৫)
হায়, এ রণ শেষে পারিনে ফিরিতে
ঘরেতে কেহ
লইয়া দেহ,
আপন বক্ষ চুষিয়া চুষিয়া
কোমল মন পিশিয়া পিশিয়া
বর্ম্মে অসিতে মিশিয়া মিশিয়া
চির-বিবাহ ;
এত যে মিলন ব্রত-আলিঙ্গন
তবু বিরহ
অশ্রু-সহ!

(৬)
ধর্ রে কৃপাণ
ধর্‌ রে কৃপাণ
কাটিয়া হৃদয় কর্‌ খান্‌ খান্‌
কে তোরা আজি দিবি রে প্রাণ
দেবীরে দান,
ছিঁড়িয়া অস্ত্র বাঁধিয়া যন্ত্র
তুলিবি তান ;
প্রণয়-শেষ---সুখের লেশ
চির-নির্ব্বাণ
মুক্তকণ্ঠে গাহিবি কবে
জীবন-গান?
শোভিবে দিক্‌ লোহিত দৃশ্যে
ছুটিবে রক্ত-গঙ্গা বিশ্বে
টুটিবে ভেদ ধনীতে নিঃস্বে
ঘুচিবে মান্‌
মিথ্যা ভান্‌ ;
জাগিবে নিয়ত নিখিল চিত্ত
সত্য প্রাণ,
উষ্ণার ধরা শোণিত স্রোতে---
করিয়া স্নান,
হবে উর্ব্বর---ফলিবে নিত্য
স্বর্ণ-ধান্‌,
মোহিবে কুসুম-কুঞ্জ পুঞ্জে
বিশ্বখান্‌।
ধর্‌ রে কৃপাণ
ধর্‌ রে কৃপাণ
কাটিয়া হৃদয় কর খান্‌ খান্‌
কে তোরা আজিকে শ্রেষ্ঠ রণে
দিবি রে প্রাণ
দেবীরে দান!

.            ****************              
.                                                                                
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর
*
উত্সাহের নববর্ষ
কবি ব্রজসুন্দর সান্যাল
ব্রজসুন্দর সান্ন্যাল সম্পাদিত “উত্সাহ” পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩০৮ সংখ্যায় (নভেম্বর ১৯০১)
প্রকাশিত কবিতায় কবির নাম দেওয়া নেই। সংখ্যাটি শুরু হচ্ছে এই কবিতাটি দিয়ে। সে
যুগে অনেক সময়, অনেক সম্পাদক নিজের নাম উল্লেখ করতেন না, নিজেদের সম্পাদিত
গ্রন্থে বা পত্রিকায়। অনেক কবিও তাঁদের নাম প্রকাশ করতেন না কবিতার সাথে। এই
পত্রিকার শুরুতে দেওয়া আছে  “এই সংখ্যার লেখকগণের” নামের সঙ্গে অন্যান্য লেখকদের
সঙ্গে রয়েছে  “. . . ও সম্পাদক”। আমরা বিবেচনা করে এই কবিতাটিকে সম্পাদকের
কবিতা বলে প্রকাশিত করছি। এর অন্যথা হলে, প্রমাণ সহ আমাদের জানালে, আমরা
সংশোধন করে দেবো।

অনন্ত কল্লোলাকুল কাল সিন্ধু কূলে
উত্তরিল স্বর্গ তরি ; অব্যহত-গতি,
'অভ্রান্ত-অচল-লক্ষ্য ; হের ফুল্ল ফুলে,
তরুণ প্রভাত করে মঙ্গল আরতি,
মধুপ গুঞ্জনে, বন বিহগের গানে,
আরক্ত-অরুণ-দীপে। অজ্ঞাত নগর
হ’তে, দিল সাজাইয়া কেবা সাবধানে,
বিচিত্র বিপুল পণ্য। তারকা নিকর
দিয়া বিধি লিপি লিখি, দিল উড়াইয়া
অপূর্ব্ব পতাকা ওই তরণীর গায়।
সৌম্য ধীর কর্ণধার কহিছে ডাকিয়া,
“সাগর 'তীর্থের যাত্রী, যাবি যদি আয়”,
নবীন “উৎসাহ” ল’য়ে, বুকে বাঁধি’ বল ;
ভাসাব সোণার তরী চল্‌ তোরা চল্।

.            ****************              
.                                                                                
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর
*
পিপাসা
কবি ব্রজসুন্দর সান্যাল
ব্রজসুন্দর সান্ন্যাল সম্পাদিত “উত্সাহ” পত্রিকার মাঘ ১৩০৮ সংখ্যায় (জানুয়ারী ১৯০২)
প্রকাশিত কবিতায় কবির নাম দেওয়া নেই। সংখ্যাটি শুরু হচ্ছে এই কবিতাটি দিয়ে। সে
যুগে অনেক সময়, অনেক সম্পাদক নিজের নাম উল্লেখ করতেন না, নিজেদের সম্পাদিত
গ্রন্থে বা পত্রিকায়। অনেক কবিও তাঁদের নাম প্রকাশ করতেন না কবিতার সাথে। এই
পত্রিকার শুরুতে দেওয়া আছে “এই সংখ্যার লেখকগণের” নামের সঙ্গে অন্যান্য লেখকদের
সঙ্গে রয়েছে  “. . . ও সম্পাদক”। আমরা বিবেচনা করে এই কবিতাটিকে সম্পাদকের
কবিতা বলে প্রকাশিত করছি। এর অন্যথা হলে, প্রমাণ সহ আমাদের জানালে, আমরা
সংশোধন করে দেবো।

এতদিন কোথাছিলে হে বরললনা!
হে তীত্র পিপাসা! কেন পুনঃ একামনা
কল্পনার কক্ষ হ'তে করিয়া সঞ্চয়,
আবার ভরিয়া দিলে নিস্তব্ধ হৃদয়---
ঝটিকান্তে শান্তনদ সম। মেঘাত্যয়ে
কেন ভার রাজ্যে হেন বাসন্তী মলয়ে
ভরিয়া তুলিলে ; কেন কোকিল কুজনে
আবার জাগালে এই হেমন্ত বিজনে
নানা ফল ফুল! কেন পুনঃ অলিকুল
অশ্রান্ত ঝঙ্কারে করে অন্তর আকুল!
বাসনার বিষদন্ত সর্ববাঙ্গে আবার
হানে শক্তিশেল সম, নাহি শক্তি আর
তুলিতে দু’হাতে। হে তৃষ্ণা, হে মনোরাণি,
বল বল কোথা মম বিশল্যকরণী।

.            ****************              
.                                                                                
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর
*
আহ্বান
কবি ব্রজসুন্দর সান্যাল
ব্রজসুন্দর সান্ন্যাল সম্পাদিত “উত্সাহ” পত্রিকার বৈশাখ ১৩০৯ সংখ্যায় (এপ্রিল ১৯০২) প্রকাশিত কবিতায়
কবির নাম দেওয়া নেই। সংখ্যাটি শুরু হচ্ছে এই কবিতাটি দিয়ে। সে যুগে অনেক সময়, অনেক সম্পাদক
নিজের নাম উল্লেখ করতেন না, নিজেদের সম্পাদিত গ্রন্থে বা পত্রিকায়। অনেক কবিও তাঁদের নাম প্রকাশ
করতেন না কবিতার সাথে। এই পত্রিকার শুরুতে দেওয়া আছে “এই সংখ্যার লেখকগণের” নামের সঙ্গে
অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে রয়েছে  “. . . ও সম্পাদক”। আমরা বিবেচনা করে এই কবিতাটিকে সম্পাদকের
কবিতা বলে প্রকাশিত করছি। এর অন্যথা হলে, প্রমাণ সহ আমাদের জানালে, আমরা সংশোধন করে
দেবো।

তোরা আয়, তোরা আয়---
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
আশার আলোকে ঝকছে দিক্,
কত উৎসাহে ডাকিছে পিক্‌,
দশ দিকৃ নারী                        রজত গাগরী
অ@ ধরিয়া ধায়,
নীরবে হাসিছে                     নীরবে ভাষিছে
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
মলয় বিলাসী চলেছে ব’য়ে
কুসুমে কুসুমে বারতা ক’য়ে,
আঁখি কচালিয়া                    কুসুম জাগিয়া
হাসি চৌধারে চায়,
দীতি-ভঙ্গিতে                        হৃদি-সঙ্গীতে
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
মুখর-ঊর্মি অধীরা নাচে,
তীরে তীরে তীরে কীচক বাজে,
ঘন বন শির                      প্রবাহের নীর
আশায় রাঙিয়া যায়,
সাজিয়া মোহিনী                ভাকিছে ধরণী
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
জ্ঞান নির্ঝর স্বতঃ ঝরিছে,
তৃষিত জনের তৃষা হরিছে,
উঠে বেদগান                        উদাও সান
ঋত্বিক কুল গায়,
বিহগ-কাকলী                  ডাকিছে আকুলি
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
দীপ্ত সোণালী কুহেলী মাঝে
ভবিষ্য স্বপ্ন কত কি আছে,
শান্ত সবিতা                      মুগ্ধ কবিতা
সৌম্য দৃষ্টে চায়,
বিভলা প্রকৃতি                  হাসে নিরবধি
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
সাধক ভক্ত যাজক যত
জীবন যজ্ঞে সতত রত,
করিতেছে দান                   আপনার প্রাণ
জগৎ-কারণ পায়,
পূত হুতাশন                     ডাকিছে সঘন
তোর আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়---
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
ঐ পাদ মূলে বাসনা শেষ,
ও চরণকূল সাধন দেশ,
নিরাকার বেশ                   অশেষ মহেশ
পাষাণ ব্যাপিয়া ভার,
স্বন্ধ নীলিমা                      প্রকাশে মহিমা
তোরা আয়, তোরা আয়!

তোরা আয়, তোরা আয়!
উদয় গিরির কনক শিখর ঐ দূরে দেখা যায়!
দূরে ফেলে রাখ লাজ ও ভান,
বুকে ক’রে আয় প্রেম ও প্রাণ,
ভক্তি কর্ম্ম জ্ঞান                 উড়ায়ে নিশান
চল্‌ তোরা দ্রুত পায়,
অনাদি বিমান                  গাহিতেছে গান
কোরা আয়, তোরা আয়!

@ - অপাঠ্য অক্ষর।

.            ****************              
.                                                                                
সূচীতে . . .    



মিলনসাগর