তাঁর স্কুলজীবন কাটে কলকাতার সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলে। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে
ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনের জগতে। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞাপন-কপিরাইটার। আশির দশকে
বাংলা বিজ্ঞাপনের জগতে বেশ কিছু জনপ্রিয় এক লাইনের শ্লোগান লিখে দিয়েছিলেন তিনি। বোরোলিনের
একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্লোগান "বঙ্গ জীবনের অঙ্গ" ছিল তাঁরই সৃষ্টি।
ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচিত্রে অভিনয় ও ব্যক্তিগত জীবন - পাতার উপরে . . .
পিতা সুনীল ঘোষ, চলচিত্র জগতের মানুষ থাকার সুবাদে ঋতুপর্ণ যে সেদিকে এগোবেন তা প্রায় ঠিক হয়েই
ছিলো। এ ছাড়া "বাংলা এখন" টিভি চ্যানেলে একটি সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন যে ছবি তৈরীর কথা ১২-১৩
বছর বয়সেই, কলকাতায় টিভি সেন্টার খোলার পরে, সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছায়াছবি এক এক করে
টিভিতে দেখার পরে তিনি স্থির করে ফেলেন যে তিনি ফিল্ম মেকারই হবেন।
তাঁর সিনেমাতে অভিনয় জীবন শুরু হয় হিমাংশু পারিজা পরিচালিত ওড়িয়া ছবি “কথা দেইথিল্লি মা কু”-তে
২০০৩ সালে। ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের “আরেকটি প্রেমের গল্প” এবং সঞ্জয় নাগের
“মেমরিজ ইন মার্চ” ছবিতে অভিনয় করেন। “আরেকটি প্রেমের গল্প” যা তাঁর নিজের লেখা, “মেমোরিস ইন
মার্চ” যা তে তিনি চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন এবং তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি “চিত্রাঙ্গদা”-য়
(২০১২) তিনি রূপান্তরকামী চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এই তিনটি ছায়াছবি কি আঁর আত্মজীবনীমূলক আলেখ্য ছিল? এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-বিশ্লেষণের শেষ নেই।
এই পৃথিবীতে আবহমানকাল থেকে, অসংখ্য মানুষ জন্মেছেন যাঁদের পুরুষ হয়ে জন্মেও যেন সেই দেহে
নিজেদের নারী হিসেবে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয় সারা জীবন। নারী হয়ে জন্মানো শরীরে পুরুষ হয়ে বন্দী
মানুষের সংখ্যাও ততধিক। সারা জীবন তাঁদের গুমরে মরতে হয় অসহায়ভাবে, সমাজের ব্রিদ্রূপ
প্রতিনিয়ত সহ্য করে।
নিজের অন্তরের কথা বলতে গিয়ে, খৃতুপর্ণ ঘোষ সেই সব মানুষের কথা সমাজের সামনে দৃঢ়তার সঙ্গে
বোমা ফাটানোর মতো করে বলে গিয়েছেন, আধুনিক কালের অন্যতম সর্বাধিক শক্তিমান গণমাধ্যম -
সিনেমার মাধ্যমে। কবি যদি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের “মানুষের কর্তব্য কি?” প্রশ্নের বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তর
“আহার নিদ্রা মৈথুন” @-এ তে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতেন, তাহলে ভ্রুকুঞ্চন করার অবকাশ থাকতো। কিন্তু
আমরা দেখতে পাই যে ঋতুপর্ণ তাঁর অসামান্য মেধার প্রভাবে এর বহু ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন প্রেমের
সোপান বেয়ে, যা তাঁর রচিত বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সেখানে আমরা দেখতে পাই
তাঁর রাধা-ভাবে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিখাদ প্রেম ও আত্মসমর্পণ।
@ - “উদ্বোধন” কার্যালয় থেকে ১৪২১ বঙ্গাব্দে (২০১৪) প্রকাশিত “শ্রী ম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত”,
২য় খণ্ড, ১১১৮-পৃষ্ঠা, ১৮৮৪, ৬ই ডিসেম্বর।
বৈষ্ণব পদাবলী সম্বন্ধে আবদুল করিমের উদ্ধৃতি - পাতার উপরে . . .
শিক্ষাবীদ, সাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাচীন পুথির সংগ্রাহক, শ্রী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সুরেশচন্দ্র
সমাজপতি সম্পাদিত “সাহিত্য” পত্রিকার পৌষ, ১৩২৫ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯১৮), তাঁর “সঙ্গীত শাস্ত্রের
একখানি প্রাচীন গ্রন্থ” প্রবন্ধে লিখেছেন . . .
“. . . বৈষ্ণব পদাবলীর মত সুন্দর জিনিস বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। কাণের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া প্রাণ
আকুল করিয়া তুলিতে পারে, এমন সুধাস্রাবী ঝঙ্কার বৈষ্ণব পদাবলী ভিন্ন বাঙ্গালায় আর কিছুতে নাই।”
ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচিত্র পরিচালনা - পাতার উপরে . . .
ঋতুপর্ণ ঘোষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁর চলচিত্র পরিচালনার জন্যই। সে বিষয়ে তথ্য ও আলোচনা
রয়েছে ইনটারনেট জুড়ে শত শত ওয়েবসাইট, ব্লগ ও সোসিয়াল মিডিয়ায়। তাই তাঁর ছায়াছবির আলোচনা
মিলনসাগরের এই পাতায় বিস্তারিতভাবে না ক’রে, আমরা কেবল তা উল্লেখ ক’রে তাঁর করা চলচিত্রের
একটি সারণী এখানে উপস্থাপন করছি।
পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি “হিরের আংটি” ১৯৯২। এরপর আসে “উনিশে এপ্রিল” (১৯৯৪), “দহন”
(১৯৯৭), বাড়িওয়ালি (১৯৯৯), “অসুখ” (১৯৯৯), “উৎসব” (২০০০), তিতলি (২০০২), আগাথা ক্রিস্টির দ্য
মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড অবলম্বনে “শুভ মহরত” (২০০৩), “অন্তরমহল” (২০০৫), দোসর (২০০৬),
“খেলা” (২০০৮), “সব চরিত্র কাল্পনিক” (২০০৮), আবহমান (২০০৯), নৌকাডুবি (২০১০)। তাঁর
শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি “চিত্রাঙ্গদা” (২০১২)। তাঁর শেষ ছায়াছবি “সত্যান্বেষী”-র (২০১৩) শুটিং চলাকালীন
তাঁর আকস্মিক মৃত্য ঘটে।
তৈরী করেন রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী অবলম্বনে তথ্যচিত্র “জীবনস্মৃতি” (২০১২)।
তাঁর অন্য ভাষার ছায়াছবির মধ্যে রয়েছে হিন্দী ছায়াছবি “রেইনকোট” (পরিচালনা ও গীতিকার, ২০০৪) ও
“সানগ্লাস” (২০১২) যা রিলিজ হয় নি। ইংরেজী ছায়াছবির মধ্যে রয়েছে “দ্য লাস্ট লিয়ার” (২০০৭) এবং
“মেমোরিস ইন মার্চ” (চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার, ২০১০)।
ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রাপ্ত চলচিত্র পুরস্কার - পাতার উপরে . . .
ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রাপ্ত চলচিত্র পুরস্কারের তালিকা দীর্ঘ। তাঁর তৈরী প্রায় সব ক'টি চলচিত্রের জন্যই
তিনি কিছু না কিছু পুরস্কারের ভূষিত হয়েছিলেন। নমিনেশন ছাড়া তিনি যে যে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন,
আমরা এখানে তার একটি সূচী তুলে ধরলাম . . .
তাঁর পদে কোনও ভণিতা নেই।
ঋতুপর্ণ ঘোষের টিভি শো এবং পত্রিকার সম্পাদনা - পাতার উপরে . . .
অনের কম বয়স থেকেই তিনি কলকাতা টিভির সঙ্গে যুক্ত থেকে নানান কাজ করে দিয়েছেন। সেই সময়ে
অন্য কোনও চ্যানেলের সূচনা হয়নি। ঋতুপর্ণ ঘোষ দুটি সেলিব্রিটি চ্যাট্ শো সঞ্চালনা করেন। প্রথমটি হল
ইটিভি বাংলার “এবং ঋতুপর্ণ” এবং স্টার জলসার “ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি”। তিনি আনন্দবাজার গোষ্ঠির
প্রকাশিত, বাংলা চলচিত্র জগতের পত্রিকা “আনন্দলোক” সম্পাদনা করেন ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
ঋতুপর্ণ ঘোষের কবিতা ও বৈষ্ণব পদাবলী - পাতার উপরে . . .
কবিতায় ছিল তাঁর সহজ বিচরণ। আমরা মনে করি যে, যদি ঋতুপর্ণ চলচিত্র পরিচালক না হতেন, তাহলে
অবশ্যই তিনি কবি হিসেবে ততটাই প্রতিষ্ঠা পেতেন, সিনেমার পরিচালক হয়ে তিনি যতটা পেয়েছিলেন।
দৈনন্দিন জীবনে, কর্মক্ষেত্রে এবং একান্ত ব্যক্তিগত ও সম্ভবত তাঁর আধ্যাত্মিক দিকেও তিনি কবিতার
প্রয়োগ করেছেন সফলভাবে। আবেগপ্রবণ বাঙালীর মতো তিনিও রচনা করে গিয়েছেন তাঁর কবিতা।
তাঁর রচিত ভীষণভাবে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে তিতলি ছায়াছবির “মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর মন
খারাপের দিস্তা”, হিন্দী রেনকোট ছায়াছবির “सुबह-सुबह, मथुरा नगरपति काहे तुम गोकुल जाओ”, প্রভৃতি।
ঋতুপর্ণ মারা যাবার পরে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও বিশিষ্ট নাগরিক অপর্ণা সেন, তাঁর সম্পাদিত “প্রথমা এখন”,
মাসিক পত্রিকার ১৫ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায়, "আমাদের ঋতু", প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমার বড় মেয়ে ডোনার
বিয়ের তত্ত্ব সাজানোর সময়ে প্রত্যেকটা ডালার উপরে ছড়া লিখে দিয়েছিল ঋতু। ডোনার শ্বশুরমশাই আর
শাশুড়িমা'র জন্যে আমার নাম করে ছড়ায় চিঠিও লিখে দিয়েছিল। ওর হাতের লেখায় সেসব ছড়া যত্ন করে
রাখা ছিল আমার দেরাজে। আজ ঋতু চলে যাওয়ার পর পাঠকদের হাতে তুলে দিলাম বাছাই করা অনবদ্য
কিছু ছড়া।"
আমরা কৃতজ্ঞ “আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে” নামক ফেসবুকের পাতার সদস্যের কাছে, যাঁর পাতা
থেকে আমরা এই তথ্য এবং ঋতুপর্ণার ছড়া পেয়ে আমাদের কবিতার পাতায় তুলতে সমর্থ হয়েছি।
সংখ্যায় অগণিত না হলেও, তাঁর নিজের পরিচালিত এবং অন্যভাবে যুক্ত এমন একাধিক চলচিত্রের জন্য
তিনি গান লিখেছিলেন। বাংলা, হিন্দী এবং ইংরেজী চলচিত্রের জন্য তাঁর লেখা গান যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন
করে। তেমন কয়েকটি গানও আমরা সকৃতজ্ঞচিত্তে, তাদের উৎস জানিয়ে, কবিতার পাতায় দিয়েছি।
মূলত তিনি বাংলা ও হিন্দী ভাষায় গান রচনা করেছেন, যা মিলনসাগরে আমরা সর্বাগ্রে “কবিতা” মনে করি।
হিন্দী গান লিখতে গিয়ে তিনি বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছেন যার মধ্যে ব্রজবুলীতেও অন্তত দুটি ভণিতাহীন
বৈষ্ণব পদাবলী রয়েছে। তাঁর পদাবলী শুধু কাব্যিক বৈশিষ্টের দিক দিয়ে বৈষ্ণব পদাবলী নয়, শ্রীচৈতন্য
পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব তাতে পুরোমাত্রায় বিরাজ করছে। “রাধা-ভাবে” শ্রীকৃষ্ণের কাছে ভক্ত-
প্রেমিকের সমর্পণ তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে খুব সুন্দর ভাবে। এই উত্কৃষ্ট, ভক্তের প্রেম-ভক্তি ভাব, তাঁর
ব্যক্তিগত জীবনে নারী-পুরুষ সত্তার টানাপোড়েনে নারী-সত্তার জয়ের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আমরা কবি ঋতুপর্ণ ঘোষের এই পাতাকে মিলনসাগরের বৈষ্ণব পদাবলীর সূচীতেও রেখেছি এবং এই
পাতাটি তৈরী করেছি মিলনসাগরের বৈষ্ণব-পদাবলীর পাতার মতন করে। “ভানুসিংহ” ও “ভানু” ভণিতার
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুগ্ধ-অনুসারী ঋতুপর্ণ ঘোষ, তাঁর পদে কোনও ভণিতা দেন নি। বৈষ্ণব পদাবলীর
পাঠককুলের এই দুঃখ আর ঘোচার নয় যে, ঋতুপর্ণ যদি তাঁর পদে ভণিতা দিতেন তাহলে তাঁর ভণিতা কি
হতো!
কবি ঋতুপর্ণ ঘোষ, হিন্দী এবং ব্রজবুলিতে পদ রচনা করে পদাবলী সাহিত্যে গর্বের স্থান অধিকার করেছেন,
বলে আমরা মনে করছি। আমরা তাঁর ব্রজবুলিতে রচিত মাত্র দুটি পদ পেয়েছি। হিন্দী ভাষায় তাঁর বৈষ্ণব
পদাবলীর সংখ্যা আমাদের হাতে ২টি।
আমরা সব মিলিয়ে তাঁর লেখা বাংলায় মাত্র ২৫টি ছড়া/কবিতা/গান এবং ২টি ব্রজবুলিতে বৈষ্ণব পদাবলী,
সংগ্রহ করে তুলতে পেরেছি। কবি গীতিকার ঋতুপর্ণ ঘোষ, আরও ছড়া, কবিতা ও গান লিখেছিলেন কি না
বা তিনি কোনও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন কি না, তা আমাদের জানা নেই। যেটুকু যোগাড় করতে সক্ষম
হয়েছি, ইনটারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ ও ফেসবুকের কল্যাণে, তাঁদের প্রতি আমরা পূর্ণমাত্রায়
কৃতজ্ঞতা জানাই এই পাতাটি তৈরী করার পেছনে তাঁদের অবদানের জন্য।
এ ছাড়া আমরা অনুরোধ করছি যে কবির আরও কবিতা যদি কেউ আমাদের পাঠান তাহলে আমরা
আনন্দের সঙ্গে তা এই পাতায় তুলে প্রেরকের প্রতি এই পাতায় কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করবো।
কবি ঋতুপর্ণ ঘোষ - জন্মগ্রহণ করেন
কলকাতায়। পিতা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্য
চিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। মা ও ছিলেন
চিত্রকর-শিল্পী।