কবি আরকুম-এর বৈষ্ণব পদাবলী ও কবিতা
*
আজ নিশাকালে রে সাম, আজ নিশাকালে
ভণিতা পাগল আরকুম
কবি আরকুম
বৈষ্ণব পদাবলী
এই পদটি ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত “বাঙ্গালার বৈষ্ণব-
ভাবাপন্ন মুসলমান কবি” গ্রন্থের ৪৪-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া রয়েছে।

॥ গান হকিকত দুপাদি - বিরহ॥

আজ নিশাকালে রে সাম, আজ নিশাকালে
আমারে ছাড়িয়া কালা কার কুঞ্জে রহিলে॥ ধুয়া॥
মোমের বাতি, সারা রাত্রি, ষেড় পালঙ্গে জ্বলে,
দয়া গুণে প্রাণ বন্ধু আইস রাধার কোলে।
চুয়া চন্দন, করিয়া যতন, রাখিয়াছি বোতলে,
গাথিয়া বনফুলের মালা দিতাম তোমার গলে।
আরসি পড়সি লোক, প্রভাতে জাগিলে,
ছাপাইয়া রাখিমু বন্ধু নিরালা মহলে।
পাগল আরকুম বলে, শিশুকালে, প্রেম না করিলে,
না আসিব প্রাণবন্ধু রাত্রি নিশাকালে॥

.            *************************             
.                                                                           
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর
*
দেখা দিয়া কইলায় মোরে প্রেমের দেওয়ানা
ভণিতা পাগল আরকুম
কবি আরকুম উল্লা
বৈষ্ণব পদাবলী
এই পদটি ১৯৬৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত, গুরুসদয় দত্ত ও ডঃ
নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত, “শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত” সংকলন, বাউল, ১৫৮-পৃষ্ঠায় এইরূপে
দেওয়া রয়েছে। গানটি এই গ্রন্থে, বাউল গানের মধ্যে সন্নিবেশ করা হয় থাকলেও আমরা
এই গানটিকে বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যেই রাখছি।

দেখা দিয়া কইলায়১ মোরে প্রেমের দেওয়ানা২।
হায়রে, রইল দেহার কল্পনা---
দরশন দেও নাথ, ---প্রাণ বাঁচে না॥

আর একদিন গেছিলাম রে বন্ধু,
যমুনার জলে ;
শ্যাম-রূপ দেখিলাম আমি কদম্বের তলে।
ওরে, সে অবধি দুই আঙ্খির জল
বারণ হইল না :
হায়রে, আমার কালিয়ার সোনা॥

আর বন্ধুয়ার রূপখানি
দিলে থইলাম লেখি' ৩ ;
মনে হইলে দুই আঙ্খি মুজিয়া রূপ দেখি।
হায়রে, চন্দ্র-সূর্য না হয় তার
রূপের তুলনা :
হায়রে, ও রূপ পাইয়া পাইলাম না॥

আর রূপ হইতে বাহির হইয়া
রূপে রূপ ধরিত৪ চায় ;
গোকুল নগরে ও রূপ ধুড়িয়া৫ না পায়।
ওরে, বাতাইয়া দেও মুরশিদ
রূপের নিশানা :
হায়রে, ও রূপের কিরূপ নমুনা॥

পাগল আরকুমে কয়---
প্রেমেতে মধুর
নাইরে ও তার কুল-কিনারা কাম-সমদুর৬ |
ওরে, যে পড়িয়াছে__ভাসিয়! গেছে
হইছে দেওয়ানা :
নাইরে ও তার জাতের ঠিকানা ॥

১ - করিলে, ২ - প্রেমের পাগল, ৩ - লিখিয়া রাখিলাম, ৪ - ধরিতে, ৫ - খুঁজিয়া,
৬ - কামসমুদ্র

.            *************************             
.                                                                           
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর
*
নিরানব্বই সনের গিরাইর কবিতা
কবি আরকুম উল্লা
১৯৬৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত, গুরুসদয় দত্ত ও ডঃ নির্মলেন্দু
ভৌমিক সম্পাদিত, “শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত” সংকলন, পরিশিষ্ট, ৪০৫-পৃষ্ঠায় এইরূপে দেওয়া
রয়েছে। শেষ স্তবকে কবি আরকুম উল্লা তাঁর পরিচয় দিয়েছেন।

॥ নিরানব্বই সনের১ গিরাইর২ কবিতা॥

আল্লা বল ভাই যত মছলমান।
লইবায় আল্লার নাম দেখিয়া কোরান॥
তারপরে নবির বাত রাখিবায় আমল।
মউতের৩ বাদে ভাই তরিবায় সকল ॥
দেখ ভাই মুসলমান করিয়া খিয়াল।
আখেরি জবানায়৪ বড় ঘটিল জঞ্জাল ॥
কতদিন হইল আজি জান সবলোকে।
বার সেরি নিদান ভাই হইয়াছিল মুলুকে॥
দিলের৫ দৈশতে৬ লোক হইয়াছিল আকুল।
দানা বিনে কত লোকের গেছে জাতি-কুল॥
তারপরে খোদা-তায়লার হুকুম হইল।
আট পারি, ধান টাকায় বিকিতে লাগিল॥
আট পারি, সাত পারি, ছয় পারি বিকে।
পাঁচ পারি বিকি এবে চারি পারি লাগে॥
ফরামিশ৭ করিয়া দেখ দিলের ভিতর।
এই যে জবানার হালে দিলে লাগে ডর॥
এমন গিরাই দিন ভাই টাকায় চাউলের পারি।
চাষা লোকে আশা করে আর পাইতে পারি॥
চারি আনা গুড়ের সের সাত আনা সুপারি।
আট আনা খরচের সের দশ পয়সা খাসারি॥
কেমনে বাঁচিব লোকে উপায় নাই পায়।
সোনা, রূপা, জা’গা, জমিন বেচিয়া লোকে খায়॥
সোনা, বূপা, জা’গা, জমিন শতেক টাকার হইলে।
বন্ধক দিয়া কোনরূপে পঁচিশ টাকা মিলে॥
আর যারা যারা পয়সা-আলা পূর্ব ছিলেটের মাঝে।
টাকায় লয় চারি পয়সা সুদ গরীব কেমনে বাঁচে॥
শ্রীহট্টি আর পদ্মার পারি ধান কাটিবার আশে।
প’রে-প'রে হইছিল নৌকা ভাটি রাজ্যের মাঝে॥
আগে বরু ধানেরে করতা অপমান।
এই বারের বরু ধানে রাখল লোকের জান॥
কিছু-কিছু পয়সা-কড়ি ছিল যারার হাতে।.
আর কিছু মুনাফা কইলা ধানের বেপারেতে৮।
যার হাতে পয়সা আছে দিলে তার ডর।
সিঁদ দিয়া চুরাইয়া৯ লইয়া যায় ঘর॥
গুর১০ -গাট্টা আছে যার টাকার নাই কমি।
জোরে ছিনাইয়া নেইন গরীবের জমি॥
মিছা সাক্ষী দেইন আর কাছারীতে গিয়া।
গুয়া চুরি, কলা চুরি, রাত হানা দিয়া॥
কেহ কার কর্জ নিলে দিত নাহি কয়।
হাতের পয়সা দিয়া দেখ মাইর১১ করা হয়॥
এ ছাই আওয়াল১২ ভাই হৈয়াছে দেশেতে।
দিলেতে দৈশত লাগে বাঁচিমু কিমতে॥
এই সব বাতে জান ইমামি হয় খলল১৩।
নির্বল হইয়া গেল নেকির আমল॥
বদির আমলে লোক ফিরে হামেহাল।
কিছমত১৪ কমিয়া গেল জীব যত কাল॥
খোদারে না দিয়ো দোষ, না দিল খোদায়।
আপনার আকলে১৫ আপনে হারিলায়॥
মিছা সাক্ষী, জুট বাত, ছাড় এই সব।
জোয়াব না পারিবায় দিতে পড়িলে তলব।
দুরুদ পড়িয়া ভেজ নবির উপরে।
তাঁহার ইজ্জতে খোদায় উদ্ধারে সবারে॥
কি আর বলিমু ভাই দুছরা কালাম।
ছোট-বড় সবার আগে অধমের ছালাম॥
৯৯ সালে ভাই এই সব হাল।
সাক্ষাতে কি আছে আর ভাবি সে খিয়াল॥

নালায়েক১৬ সায়েরি১৭ আমি জুনাবে সবার
অধমের খাতা চাহি মাফ করিবার॥
ধরাধরপুর ঘর আমার খিত্তা পরগণায়।
বাপের নাম মাং আছিম সবে জানিবায়॥
আরকুম উল্লা নাম আমার সবারে জানাই।
ছোট-বড় সবার কাছে দোয়া কিছু চাই॥
অধিক লেখিলে ভাই নাহি হয় খুবি১৮।
তামাম হইয়া গেল নিদানের কবি॥*

১ - বঙালা ১২৯৯ সাল, ২ - দুর্মূল্যের, ৩ - মৃত্যুর, ৪ - ভবিষ্য্যৎকালে,  ৫ - মনের, ৬
- ভয়ে, ৭ - পরামর্শ, ৮ - ব্যবসাতে, ৯ - চুরি করিয়া, ১০ - দল, ১১ - মারামারি, ১২ -
বিবরণ, ১৩ - দুর্বল, ১৪ - ভাগ্য, ১৫ - বুদ্ধিতে, ১৬ - অযোগ্য, ১৭ - রচক, ১৮ সুন্দর।

* আরকুম উল্লা-রচিত। শ্রীহট্ট সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা (মাঘ, ১৩৫৬, পৃ ১৩ হইতে উদ্ধৃত।
মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন-কর্তৃক সঙ্কলিত। বানান আমাদের (“শ্রীহট্টের
লোকসঙ্গীত” গ্রন্থের সম্পাদকের)।

.            *************************             
.                                                                           
সূচীতে . . .      



মিলনসাগর