কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর গান ও কবিতা |
মাতৃভাষা কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় সম্পাদিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ এবং কবিতা সংগ্রহ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ৫ম খণ্ডের বিবিধ বিষয়ক কবিতা। মায়ের কোলেতে শুয়ে, উরুতে মস্তক থুয়ে, খল খল সাহাস্য বদন। অধরে অমৃত ক্ষরে, আধো আধো মৃদুস্বরে, আধো আধো বচনরচন। কহিতে অন্তরে আশা, মুখে নহি কটূভাষা, ব্যাকুল হোয়েছ কত তায়। মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা বা-বা, আবো, আবো, আবা, আবা, সমুদয় দেববাণী প্রায়॥ ক্রমেতে ফুটিল মুখ, উঠিল মনের সুখ, একে একে শিখিলে সকল। মেসো, পিশে, খুড়া, বাপ, জুজু, ভূত, ছুঁচো, সাপ, স্থল, জল, আকাশ, অনল॥ ভাল মন্দ জানিতেনা, মলমূত্র মানিতেনা, উপদেশ শিক্ষা হোলো যত। পঞ্চমেতে হাতে খড়ি, খাইয়া গুরুর ছড়ি, পাঠশালে পড়িয়াছ কত। যৌবনের আগমনে, জ্ঞানের প্রতিভা মনে, বস্তু বোধ হইল তোমার। পুস্তক করিয়া পাঠ, দেখিয়া ভবের নাট, হিতাহিত করিছ বিচার॥ যে ভাষায় হোয়ে প্রীত, পরমেশ-গুণ-গীত, বৃদ্ধকালে গান কর মুখে। মাতৃ সম মাতৃভাষা, পুরালে তোমার আশা, তুমি তার সেবা কর সুখে॥ . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
স্বদেশ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ৫ম খণ্ডের বিবিধ বিষয়ক কবিতা। জাননা কি জীব তুমি, জননী জনমভূমি, যে তোমার হৃদয়ে রেখেছে। থাকিয়া মায়ের কোলে, সন্তানে জননী ভোলে, কে কোথায় এমন দেখেছে? ভূমিতে করিয়া বাস, ঘুমেতে পূরাও আশ, জাগিলে না দিবা বিভাবরী। কত কাল হরিয়াছ, এই ধরা ধরিয়াছ, জননী-জঠর পরিহরি॥ যার বলে বলিতেছ, যার বলে চলিতেছ, যার বলে চালিতেছ দেহ। যার বলে তুমি বলী, তার বলে আমি বলি, ভক্তি ভাবে কর তারে স্নেহ॥ প্রসূতী তোমারে যেই, তাহার প্রসূতী এই, বসুমাতা মাতা সবাকার। কে বুঝে ক্ষিতির রীতি, তোমার জননী ক্ষিতি, জনকের জননী তোমার॥ কত শস্য ফলমূল, না হয় যাহার মূল, হীরকাদি রজত কাঞ্চন। বাঁচাতে জীবের অসু, বক্ষেতে বিপুল বসু, বসুমতী করেন ধারণ॥ সুগভীর রত্নাকর, হইয়াছে রত্নাকর, রত্নময়ী বসুধার বরে। শূন্যে করি অবস্থান, করে করে কর দান, তরণি ধরণীরাণী-করে॥ ধরিয়া ধরার পদ, পেয়ে পদ নদী, নদ, জীবনে জীবন রক্ষা করে। মোহিনী মহীর মোহে, বহ্নি বারি বন্ধু দোঁহে, প্রেমভাবে চরে চরাচরে॥ প্রকৃতির পূজা ধর, পুলকে প্রণাম কর, প্রেমময়ী পৃথিবীর পদে। বিশেষতঃ নিজদেশে, প্রীতি রাখ সবিশেষে, মুগ্ধ জীব যার মোহমদে॥ ইন্দ্রের অমরাবতী, ভোগেতে না হয় মতি, স্বর্গভোগ উপসর্গ সার। শিবের কৈলাসধাম, শিবপূর্ণ বটে নাম, শিবধাম স্বদেশ তোমার॥ মিছা মণি মুক্তা হেম, ম্বদেশের প্রিয়প্রেম, তার চেয়ে রত্ন নাই আর। সুধাকরে কত সুধা, দূর করে তৃষ্ণা ক্ষুধা, স্বদেশের শুভ সমাচার॥ ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশ্ববাসীগণে, প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া। কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া॥ স্বদেশের প্রেম যত, সেই মাত্র অবগত, বিদেশেতে অধিবাস যার। ভাব তুলি ধ্যানে ধরে, চিত্তপটে চিত্র করে, স্বদেশের সকল ব্যাপার। স্বদেশের শাস্ত্রমতে, চল সত্য ধর্ম্মপথে, সুখে কর জ্ঞান আলোচন। বুদ্ধি কর মাতৃভাষা, পূরাও তাহার আশা, দেশে কর বিদ্যাবিতরণ॥ দিন গত হয় ক্রমে, কেন আর ভ্রম ভ্রমে, স্থির প্রেমে কর অবধান। বাস করি এই বর্ষে, এই ভাবে এই বর্ষে, হর্ষে কর বিভুগুণগান। উপদেশ বাক্য ধর, দেশে কেন দ্বেষ কর, শেষ কর মিছে সুখ-আশা। তোমার যে ভালবাসা, সে হোলনা ভালবাসা, আর কোথা পাবে ভালবাসা? এ বাসা ছাড়িবে যবে, আর কি হে আশা রবে? প্রাপ্ত হয়ে আশা-নাশা বাসা। কেবা আর পায় দেখা, এলে একা, যাবে একা, পুনর্ব্বার নাহি আর আসা। . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
ভারতের ভাগ্যবিপ্লব কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত “ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “বিবিধ” অধ্যায় থেকে নেওয়া। জননী ভারতভূমি, আর কেন থাক তুমি, ধর্ম্মরূপ ভুষাহীন হয়ে? তোমার কুমার যত, সকলেই জ্ঞানহত, মিছে কেন মর ভার বয়ে? পূর্ব্বকার দেশাচার কিছুমাত্র নাহি আর অনাচারে অবিরত রত। কোথা পূর্ব রীতি নীতি, অধর্মের প্রতি প্রীতি, শ্রুতি হয় শ্রুতিপথহত॥ দেশের দারুণ দুখ দেখিয়া বিদরে বুক, চিন্তায় চঞ্চল হয় মন। লিখিতে লেখনী কাঁদে ম্লানমুখ মসীছাঁদে শোক-অশ্রু করে বরিষণ॥ কি ছিল কি হ'ল, আহা, আর কি হইবে তাহা, ভারতের ভবভরা যশ। ঘুচিবে সকল রিষ্টি হবে সদা সুখ-বৃষ্টি, সর্ব্বাধারে সঞ্চারিবে রস॥ ভবভূপ-প্রিয়ারাণী, বাণীর প্রকৃত বাণী, মৃতপ্রায় পুরাতন ভাষা। সচেতন হয়ে পুন, গাইবে বিভুর গুণ, রসনায় নিত্য করি বাসা॥ সভ্যতা সরোজলতা, প্রাপ্ত হবে প্রবলতা, মানুষের মনসরোবরে। প্রমোদ প্রফুল্ল কায়, সুখ-শতদল তায়, ফুটিবেক জ্ঞানসূর্য্য-করে॥ সুরব সৌরভ হয়ে, দশদিকে যশ লয়ে, প্রকাশিবে শুভ সমাচার। স্বাধীনতা মাতৃস্নেহে, ভারতের জরা-দেহে, করিবেন শোভার সঞ্চার॥ দুর হবে সব ক্লান্তি, পলাবে প্রবলা ভ্রান্তি, শান্তিজল হবে বরিষণ। পুণ্যভূমি পুনর্ব্বার, পূর্বসুখ সহকার, প্রাপ্ত হবে জীবন যৌবন॥ প্রবীণা নবীনা হয়ে, সন্তানসমূহ লয়ে, কোলে করি করিবে পালন। সুধা সম স্তনপানে, জননীর মুখপানে, একদৃষ্টে করিবে ঈক্ষণ॥ এরূপ স্বপনমত, কত হয় মনোগত, মনোমত ভাবের সঞ্চার। ফলে তাহা কবে হবে, প্রসূতির হাহারবে, সূত সবে করে হাহাকার॥ . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |