কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর গান ও কবিতা |
মেকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী ল সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত “ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “রস-লহরী” অধ্যায় থেকে নেওয়া। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত যত, সকলেই অনুগত, অবিরত উপকার পান। তোমাদের মত হ’লে, বিধি আছে আছে ব'লে, এখনই দিবেন বিধান॥ পুঁথি লয়ে রাশি রাশি, কাছে আসি হাসি হাসি, কহিবেন হইয়া প্রধান। হিন্দুবালা বিধবার, বিয়ে হবে পুনর্ব্বার, শাস্ত্রে তার রয়েছে প্রমাণ॥ শাস্ত্র এই, বিধি এই, অর্ব্বাচীন মূঢ় যেই, বলে সেই অথে নাহি বিধি। বিচার করুন এসে, শাস্ত্র তার কত এসে, দেখিব কেমন বিদ্যানিধি॥ অতিশয় দুরাশয়, যারা হয় তারা কয়, পরিণয় নয় নয় বলে। কিছু নাই বোধাবোধ, কথায় কথায় ক্রোধ, অনুরোধ উপরোধ চলে॥ কেবল মুখেতে জাক, ভিতরে সকলি ফাঁক, মিছে হাঁক মিছে ডাক ছাড়ে। ফেঁদে টোল মারে ঢোল, মিছামিছি করে গোল, গোলমালে হরিবোল পাড়ে॥ সব শাস্ত্র আছে পড়া, শাস্ত্র সব হাতে গড়া, মতামত আমাদের ঘরে। আমাদের পোড়ো যারা, পণ্ডিত হইয়া তারা, টোল ক'রে গোল কোরে মরে॥ আমার মুখের চোটে, কার সাধ্য এঁটে ওঠে, কেটে কুটে করি ছারখার। তোমার কল্যাণে বাবু, সকলে করিব কাবু, দেখ কত ক্ষমতা আমার॥ করিলাম এই পণ, স্মার্ত্ত আছে কত জন, দেখি দেখি কেবা কিবা বলে। বিচারে যদ্যপি হারি, প্রমাণ না দিতে পারি, পুঁথি সব ফেলে দিব জলে॥ কালী কালী মুখে ডাকি, যত দিন বেঁচে থাকি, আশীর্ব্বাদ করিব তোমায়। কোরো এই উপকার, যেন কটা পরিবার, অন্ন বিনা মারা নাহি যায়॥ . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
দুর্ভিক্ষ প্রথম গীত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড, সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতা, ১২০- পৃষ্ঠা। প্রথম গীত। বাউলচাঁদী সুর। ॥ রাগিণী দেশমোল্লার - তাল আড়খেমটা॥ হয় দুনিয়া ওলট্ পালট্, আর কিসে ভাই ! রক্ষে হবে? আর কিসে ভাই ! রক্ষে হবে? পোড়া আকালেতে নাকাল করে, ডামাডোল পেড়েছে ভবে। আমরা হাটের নেঁড়া, শিক্ষে ধোরে, ভিক্ষে কোরে বেড়াই সবে। হোলো সকল ঘরে ভিক্ষে মাগা, কে এখন্ আর ভিক্ষে দেবে? যত কালের যুবো, যেন সুবো, ইংরাজী কয় বাঁকা ভাবে। ধোরে গুরু পুরুত মারে জুতো, ভিখারী কি অন্ন পাবে? যদি অনাথ বামুন হাতপেতে চায়, ঘুসি ধোরে ওঠেন তবে ! বলে, গতোর আছে, খেটে খেগে, তোর পেটের ভার কেটা ববে? যাদের পেটে হেড়া, মেজাজ টেড়া, তাদের কাছে কেটা চাবে? বলে, জৌ বাঙালি, ড্যাম, গো টু হেল, কাছে এলেই কোঁৎকা খাবে। আমি স্বপনে জানিনে বাবা, অধঃপাতে সবাই যাবে। হোয়ে হিঁদুর ছেলে, ট্যাঁসের চেলে, টেবিল পেতে খানা খাবে। এরা বেদ কোরাণের ভেদ মানে না, খেদ কোরে আর কে বোঝাবে? ঢুকে ঠাকুর ঘরে, কুকুর নিয়ে, জুতো পায়ে দেখতে পাবে। হোলো কর্ম্মকাণ্ড, লণ্ড ভণ্ড, হিঁদুয়ানী কিসে রবে? যত দুধের শিশু, ভোজে ঈশু, ডুবে মোলো ডবের টবে। আগে মেয়ে গুলো, ছিল ভালো, ব্রত ধর্ম্ম কোর্ত্তো সবে। একা “বেথুন” এসে, শেষ কোরেছে, আর কি তাদের তেমন পাবে? যত ছুঁড়ী গুলো, তুড়ী মেরে, কেতাব হাতে নিচ্চে যবে। তখন “এ, বি,” শিখে, বিবি সেজে, বিলাতী বোল কবেই কৰে॥ এখন্ আর কি তারা সাজী নিয়ে, সাঁজ সেঁজোতির ব্রত গাবে? সব কাঁটা চাম্ চে ধোর্ বে শেষে, পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে? ও ভাই ! আর কিছু দিন, বেঁচে থাকলে, পাবেই পাবেই দেখতে পাবে। এরা আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী, গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে॥ আছে গোটাকত বুড়ো যদিন, তদিন কিছু রক্ষা পাবে। ওভাই ! তারা মোলেই দক্ষা রফা, এক্ কালে সব ফুরয়ে যাবে॥ যখন আস্ বে শমন, কোরবে দমন, কি বোলে তায় বুঝাইবে? বুঝি “ছুট” বোলে, “বুট” পায়ে দিয়ে, “চুরুট” ফুঁকে স্বর্গে যাবে। ঘোর পাপে ভরা, হোলো ধরা, রাঁড়ের বিয়ের হুকুম যবে। তায় নীলকরেরদের মেজেস্টারি, কেমন কোরে ধর্ম্মে সবে? ওভাই ! তত দিন তো খেতে হবে, যত দিন এ দেহ রবে। এখন কেমন কোরে পেট চালাবো, মোরে গেলেম ভেবে ভেবে। রোজ অষ্ট প্রহর কষ্ট ভুগে, ভাতে পোড়া জোড়ে সবে॥ তায় তেল জোড়ে তো লুণ জোড়ে না, কেঁদে মরি হাহারবে। যে চিরটা কাল মাচ খেয়েছে, কেমনে সে শুক্ নো খাবে? মরি মেগে মেগে, * * * * মাচ বিনে প্রাণ বেরিয়ে যাবে, এই সবে কলির সন্ধ্যা রে ভাই ! কতক্ষণে রাত পোয়াবে? হোলো নিরামিষে শরীর শষ্ক, আমিষের মুখ দেখবো কবে? ওরে “উড়ো খই গোবিন্দায় নম” এই ব্যবস্থা ধরি সবে। এস “অক্ষয় দত্তে” গুরু কেড়ে, “বাহ্য বস্তু” পড়ি তবে। যত জাত কুটম্ব বেয়রা হোয়ে, খাটে কোরে ঘাটে লবে। দেশের কর্ত্তা যত কালা হলেন, কাণ পাতেন না কান্না রবে। গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ করি, বিলাতধামে চল সবে॥ . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
দুর্ভিক্ষ দ্বিতীয় গীত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড, সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতা, ১২৪-পৃষ্ঠা। দ্বিতীয় গীত। বাউলের সুর। ॥ রাগিণী ভৈরবী - তাল পোস্তা॥ ওগো মা, বিক্টোরিয়া, কর্ গো মানা, কর্ গো মানা। যত তোর, রাঙা ছেলে, আর যেন মা ! চোক রাঙেনা, চোক রাঙে না॥ প্রজা লোকের জাতি ধর্ম্মে, কেহ যেন জোর করে না। যেন সেই প্রতিজ্ঞা বজায় থাকে, দিয়েছ মা, যে ঘোষণা। ও মা, জাতিভেদে, ভজন সাধন, ধর্ম্মমতে আরাধনা। মহা অমূল্য ধন ধর্ম্মরতন, এমন ধন তো আর পাবে না। যত মিশনারি এ দেশেতে, এসে করে কি কারখানা। তারা ঈশুমন্ত্র কানে ফুঁকে, শিশুকে দেয় কুমন্ত্রণা। ফেরে হাটে, ঘাটে, বাটে, মাঠে, নানা ঠাটে, ফন্দি নানা। বলে দিশি কৃষ্ণ ছেড়ে তোরা, ঈশুখ্রীষ্ট কর ভজনা! ওমা হেদো বনে কেঁদো চরে, তার ভয়েতে প্রাণ বাঁচে না। তার পাশে “হুমো” হুতুমথুমো, ঘুমো ছেলের জাত রাখে না। যত শাদা জুজু জোটে বুড়ী, “ছেলেধরা” প্রতি জনা। এরা জননীর কোল শূন্য কোরে, কেড়ে নিচ্ছে দুধের ছানা। সদা ধর্ম্ম ধর্ম্ম কোরে মরে, ধর্ম্ম-মর্ম্ম কেউ বোঝে না। হোরে পরের ধর্ম্ম, ধর্ম্ম হবে, এইটী মনে বিবেচনা॥ যেন আপন ধর্ম্ম আপ্ নি পালে, পরের ধর্ম্ম নাশ করে না। এদের ধর্ম্ম-পথের স্বাধীনতা, রেখোনা মা, আর রেখোনা। কেমন কুহক জানে এরা, উপদেশে করে কাণা। ওমা বংশ পিও ধংস কোরে, কত ছেলে খেলে খানা। নয় তোমার অধীন, স্বাধীন এরা, কেমন কোরে কোর্ব্বে মানা? ওমা, আমরা সেটা বুঝ্ তে পারি, খোট্টা লোকে তা বোঝে না। তুমি সর্ব্বেশ্বরী যদি তাদের, চোক রাঙায়ে কর মানা। তবে টুপি খুলে, আড্ডা ভুলে, পালিয়ে যাবার পথ পাবে না। নগর কমিশনর যাঁরা, তাঁদের একি বিবেচনা। এ কি প্রাণে সহে যাঁড় দিয়ে মা, ময়লা-ফেলার গাড়ী টানা। ও মা. দুগ্ধ বিনে মরি প্রাণে, হিণদু লোকের প্রাণ বাঁচে না। যত শাদা লোকের অত্যাচারে, গরু বাছুর আর বাঁচে না। যত দেশের গরু ভুট কোরেছে, টেবিল পেতে খেয়ে খানা। এরা ধাড়ী শুদ্ধ দিচ্ছে পেটে, আস্ত ভগবতীর ছানা। একে রামে রক্ষে নাইকো, সুগ্রীব তার হল সেনা। যত দিশি ছেলে কোপ্ চে উঠে, চাল চেলেছে সাহেবানা। কারে কৰ দুঃখের কথা, কান পেতে মা কেউ শোনে না। যারে দেবতা বলে পুজা করি, তাতেই হোলো বিড়ম্বনা। যারা লাঙল চষে, গাড়ী টানে, করে কত হিত সাধনা। আর দুগ্ধ দিয়ে জীবন বাঁচায়, তৃণ খেয়ে প্রাণধারণা। “গরু তরু” কল্পতরু, এমন তরু আর হবে না। ফলে “গরুগাছে” দধি, দুগ্ধ, সর, নবনী, ঘৃত, ছানা। মনের দুঃখে বুক ফাটে মা, বোল্ তে গেলে মুখ ফোটে না। যে গাছের ফলে সৃষ্টি চলে, এমন গাছে দিচ্ছে হানা। ওমা, গোহত্যাটা উঠ্ য়ে দেহ, অতয় পদে এই বাসনা। মাগো সফল গরু ফুর্ য়ে গেলে, দুগ্ধ খেতে আর পাব না। খাবার দ্রব্য অনেক আছে, তাই নিয়ে মা চলুক খানা। ওমা, এমন ত নয় গরুর মাংস না খেলে পর প্রাণ বাঁচে না॥ স্বোণার বাঙাল, করে কাঙাল, ইয়ং বাঙাল যত জনা। সদা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে, কাণে লাগায় ফোঁস ফোঁসনা॥ এরা, না “হিঁন্দু” না “মোছোলমান”, ধর্ম্মধনের ধার ধারে না। নয় "মগ”, “ফিরিঙ্গী” বিষম “ধিঙ্গী”, ভিতর বাহির যায় না জানা। ঘরের ঢেঁকি, কুমীর হোয়ে। ঘটায় কত অঘটনা। এরা লোণা জল, ঢোকালে ঘরে, আপন হাতে কেটে খানা। অগাধ বিদ্যার বিদ্যাসাগর, তরঙ্গ তায় রঙ্গ নানা। তাতে বিধবাদের “কুলতরী”, অকুলেতে কুল পেলে না। কুলের তরী থাকলে কুলে, কুলের ভাবনা আর থাকে না॥ সে যে অকূল-সাগর, দারুণ ডাগর, কালা পানি বড় লোণা। যখন সাগরে ঢেউ উঠেছিলো, তখনি গিয়েছে জানা॥ এরা দফ্ রা খেয়ে নফ্ রা যত, কোরে বসে কি এক্ খানা। তখন কর্ত্তারা কেউ শুনলেন্ না তো, লক্ষ লক্ষ হিঁদুর মানা॥ এরা বাঘেরে করিলেন শিকার, কাঁদে করি ইদুঁর ছানা॥ তদবধি রাজ্যে তোমার, উঠেছে এক কূরটনা। ওমা, আমরা বুঝি মিছে সেটা, অবোধে প্রবোধ মানে না॥ “কালবিল”* কাল্ বিল্ কোরেছেন, হিঁদুর তাতে ঘোর যাতনা। তুমি রাঁড়ের বিয়ে তুলে দিয়ে, ছিঁড়ে ফেলো আইনখানা॥ ওমা, যে পাপে হোক্ প্রজা মরে, চার টাকা দর, চাল্ মেলে না। দেখ অনাহারে, প্রজা মরে, না খেয়ে আর প্রাণ বাঁচেনা॥ ওমা, যত বাবু, হোলো কাবু, আর চলে না বাবুয়ানা। যারা আঙ্গুর পেস্তা দিত ফেলে, তারা এখন চিবোয় চানা! বড়মানষী দূরে থাকুক, ভালো কোরে পেট চলে না। এখন্ কেমন্ কোরে চড়বে গাড়ী, জোটেনাকো ঘোড়া দানা ! শাসন পালন করেন যাঁরা, হোলেন তাঁরা কালা কাণা। ওমা, না খেয়ে সব প্রজা মরে, নাইকো সেটী দেখা শোনা। কত বার মা পোড়েছিলো, দরখাস্ত কত খানা। বলেন “ফিরি টেরেড” বনद কোর্ত্তে, কোনো কালে কেউ পারে না॥ চেলের বাজার শস্তা কর, পূরাও গো মা সব বাসনা। তবে দুঃখী লোকের আশীর্ব্বাদে, আপদ বিপদ আর রবে না॥ শিব সস্তেন কোর্চ্ছি তোমার, মহামন্ত্র আরাধনা। আছে মহারথী সেনাপতি, ভগবতীর উপাসনা॥ দুর্গানামের দুর্গ গেঁথে, রেখেছি মা “সেলেখানা”। তাতে গুলি গোলা, সকল তোলা, ভক্তি অস্ত্র আছে শাণা॥ আছে মনশিবিরে সজ্জা কোরে, সংখ্যা হয় না কত সেনা। আছে জোড়া ঘোড়া সত্য ধর্ম্ম, উড়ে যাবে ধরে ডেনা॥ এই ভারত কিসে রক্ষা হবে, ভেবো না মা, সে ভাবনা। সেই “তাতিয়া তোপির” মাথা কেটে, আমরা ধোরে দেব “নানা”॥ * Sir J. W. Colville . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |