কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর গান ও কবিতা
*
কৌলিন্য
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “সামাজিক ও ব্যাঙ্গ”
অধ্যায় থেকে নেওয়া।

মিছা কেন কুল নিয়া কর আঁটা-আঁটি।
এ যে কুল কুল নয় সার মাত্র আঁটি॥
কুলের গৌরব কর কোন্‌ অভিমানে।
মূলের হইলে দোষ কেবা তারে মানে॥
ঘটকের মুখে সুধু কুলীনের চোপা।
রস নাই যশ কিসে কুল হ'ল টোপা॥
আদর হইত তবে ভাঙ্গিলে অরুচি।
পোকাধরা সোঁকা ভার দেখে যায় রুচি॥
অতএব বৃথা এই এই কুলের আচার।
ইথে নাহি রক্ষা পায় কুলের আচার॥
কুলের সম্ভ্রম বল করিব কেমনে।
শতেক বিধবা হয় একের মরণে॥
বগলেতে বৃষকাষ্ঠ শক্তিহীন যেই।
কোলের কুমারী লয়ে বিয়ে করে সেই॥
দুধে দাঁত ভাঙ্গে নাই শিশু নাম যার।
পিতামহী সম নারী দারা হয় তার॥
নর নারী তুল্য বিনা কিসে মন তোষে।
ব্যভিচায় হয় শুদ্ধ এই সব দোষে॥
কুলকল্পে নয় রূপ সুলক্ষণ যাহা।
অবশ্য প্রামাণ্য করি শিরোধার্য্য তাহা॥
নচেৎ যে কুল তাহা দোষের কারণ।
পাপের গৌরব কেন করিব ধারণ।
হে বিভু করুণাময় বিনয় আমার।
এ দেশের কুলধর্ম্ম করহ সংহার॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
এণ্ডাওয়ালা তপ্স্যামাছ
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “সামাজিক ও ব্যাঙ্গ”
অধ্যায় থেকে নেওয়া।

কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁপ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥
মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥
পাখী নও কিন্তু ধর মনোহর পাথা।
সুমধুর মিষ্ট রস স অঙ্গে মাথা॥
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার।
আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার॥
দৃশ্য মাত্র সর্ব্বগাত্র প্রফুল্লিত হয়।
সৌরভে আমোদ করে ত্রিভুবনময়॥
প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।
ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিই কাঁচা॥
অপরূপ ছেয়ে রূপ পুত্রশোক হয়ে।
মুখে দেওয়া দুরে থাক গন্ধে পেট ভরে॥
কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা।
টপাটপ্ খেয়ে ফেলি ছাঁকাতেলে ভাজা॥
না করে উদরে যেই তোমায় গ্রহণ।
বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন॥
নগরের লোক সব এই কয় মাস।
তোমার কৃপায় করে মহাসুখে বাস॥
গুণেতে সবাই কেনা কে না করে সব।
কেন কেন কেনা কেনা কে না করে সব?
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে হেন আর নেই।
যে দিলে তপস্যা নাম সাধু সাধু সেই॥
সব গুণে বদ্ধ তব আছে সর্ব্বজনে।
লোণাজলে বাস কর এই দুঃখ মনে॥
অমৃত থাকিতে কেন রুচি হয় বিষে।
লুণ-পেড়ো পোড়া জল ভাল লাগে কিসে॥
উলুবেড়ে আলো ক'রে করিছ বিহার।
নগরের উত্তরেতে গতি নাই আর॥
বেনোগাঙ্গে জোর ভাটা তাতেই সন্তোষ।
সমুদ্রের জল খেয়ে বৃদ্ধি কর কোষ॥
জলধি কোরেছে তব বহু উপকার।
লুণ খেয়ে গুণ গেয়ে কাছে থাকো তার॥
ক্ষীরোদমথনকালে অপূর্ব্ব ঘটন।
দেবাসুরে ঘোর দ্বন্দ্ব সুধার কারণ॥
সাগর-সলিলে হয় বিবাদ বিস্তার
গড়াগড়ি ছড়াছড়ি সুধার সুধার॥
সে সময়ে তুমি মীন অতি কুতূহলে।
খেয়েছিলে সেই জল তপস্যার ফলে॥
অমৃত-ভক্ষণে তাই এরূপ প্রকার।
সুমধুর আস্বাদন হয়েছে তোমার॥
এমত অমৃত-ফল ফলিয়াছে জলে।
সাহেবেরা সুখে তাই ম্যাঙ্গোফিস্‌ বলে॥
ব্যয় হেতু কোন মতে না হয় কাতর।
থানায় আনায় কত করি সমাদর॥
ডিস ভোরে কিস লয় মিস বাবা যত।
পিস করে মুখে দিয়ে কিস খায় কত॥
তাদের পবিত্র পেটে তুমি কর বাস।
এই কয় মাস আর নাহি খায় মাস॥
তোমায় অধরে ধরি বাড়ে কত সুখ।
মাঝে মাঝে সেরির গেলাসে দেয় মুখ॥
বেচিলর যারা তারা প্রসাদের তরে।
রান্নাঘরে ধন্না দিয়ে আয়োজন করে॥
হেসে হেসে ঘেঁসে ঘেঁসে কাছে গিয়ে বসে।
পেটে হারামের ছুরি মুখ ভরা রসে॥
টেক্ ফিস ব'লে ডিস কাছে দেয় ঠেলে।
সশরীরে স্বর্গভোগ এঁটো খেতে পেলে॥
বাঙ্গালীর মত তারা রন্ধন না জানে।
আধ সিদ্ধ করি শুধু টেবিলেতে আনে॥
মসলার গন্ধ গায় কিছুমাত্র নাই।
অঙ্গে করে আলিঙ্গন কমলিনী রাই।
হ্যাদে রে নিদয় বিধি ধিক্ ধিক্ তোরে।
কি হেতু বেলাক্‌ হিঁদু কোরেছিস্‌ মোরে॥
গোরা হ'লে হোরা মেরে চ’ড়ে মনোরথে।
টেবিলে যেতেম খেতে ডেবিলের মতে॥
প্রেমানন্দে পিস করি সুখে খায় মিস।
বলি হারি যাই তোরে ওরে ম্যাঙ্গোফিস॥
কিন্তু এক মম মনে এই বড় শোক।
না জানে তোমার গুণ উত্তরের লোক॥
তোমার চরণে করি এই নিবেন।
কর সবে সমভাবে দয়া বিতরণ॥
গোঁৎ করে সোঁৎ ঠেলে ভাটি গাঙ ছেড়ে।
উজানের পথে চল দাড়ি-গোঁপ নেড়ে॥
শাঁক ঘন্টা বাজাইবে বত মেয়ে ছেলে।
ভিটে বেচে পূজা দিব মিঠে জলে এলে॥
যথা ইচ্ছা তথা থাক মনোহর মীন।
পেট ভোরে খেতে যেন পাই এক দিন॥
তোমার তুলনা নহে কোটিকল্পতরু।
লঘু হয়ে হও তুমি সকলে গুরু॥
সব ঠাঁই আদর অমান্য নাই কভু।
শুদ্ধ সত্ত্ব ঠিক যেন খড়দার প্রভু॥
নিরাকার নিত্যানন্দ মীন অবতার।
নিত্য খেলে নিত্যানন্দ লাভ হয় তার॥
খেতে যদি নাহি পাই মুখে লই নাম।
প্রণাম তোমার পদে সহস্র প্রণাম॥
কত জলে থাক তুমি নাহি তার লেখা।
তোমায় আমায় হয় সহজে কি দেখা॥
কতরূপ ভাবসূত্র মানবের মনে।
পেয়েছি তোমায় আমি জেলের কল্যাণে॥
গাভীন হইলে তুমি রস তায় কত।
রাঁড়া হ'লে বাড়া সুখ নাহি. হয় তত॥
তোমার ডিমের স্বাদ সুধার সমান।
গণ্ডা গণ্ডা এণ্ডা খেয়ে ঠাণ্ডা করি প্রাণ॥
প্রসব করিবে যত তবু রবে তাজা।
আমাদের আশীর্ব্বাদে হবে নাক বাঁজা॥
জন্ম-এয়ো হও তুমি রসবতী সতী।
পোয়াতীর গর্ভে থেকে হও গর্ভবতী॥
কোন মতে নাহি মেটে বাসনার ক্ষোভ।
যত পাই তত খাই তবু বাড়ে লোভ॥
ভেজে খাই ঝোলে দিই কিংবা দিই ঝালে।
উদর পবিত্র হয় দিবা মাত্র গালে॥
আচার ছাড়িয়া যদি আচার মিশাই।
সে আচারে কোনরূপে অনাচার নাই॥
কুলাচার কেবা ছাড়ে লয়ে কুলাচার।
আচারে আচার বাড়ে সকল আচার॥
যাতে পাই তাতে খাই করি বাজী ভোর।
হায় রে তপস্যা তোর তপস্যা কি জোর॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিধবা-বিবাহ
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “সামাজিক ও ব্যাঙ্গ”
অধ্যায় থেকে নেওয়া।

বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল।
বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল॥
কত বাদী প্রতিবাদী করে কত রব।
ছেলে বুড়া আদি করি মাতিয়াছে সব॥
কেহ উঠে শাখাপরে কেহ থাকে মূলে।
করিছে প্রমাণ জড়ো পাঁজি পুতি খুলে॥
একদলে যত বুড়ো আর দলে ছোঁড়া।
গোঁড়া হয়ে মাতে সব দেখে নাক গোড়া॥
লাফালাফি দাপাদপি করিতেছে যত।
দুই দলে খাপাখাপি ছাপাছাপি কত॥
বচন বচন করি কত কথা বলে।
ধর্ম্মের বিচাপথে কেহ নাহি চলে॥
“পরাশর” প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ।
কেহ বলে এ যে দেখি সাগরের ঢেউ॥
কোথা বা করিছে লোক শুধু হেউ হেউ।
কোথা বা বাঘের পিছে লাগিয়াছে ফেউ॥
অনেকেই এইমত লতেছে বিধান।
“অক্ষতযোনির" বটে বিধাহ-ধিধান॥
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত কেবা আর বাছে?
একেবারে তরে যাক্‌ যত রাঁড়ী আছে।
কেহ কহে এই বিধি কেমনে হইবে।
হিঁদুর ঘরের রাঁড়ী সিঁ'দুর পরিবে।
বুকে ছেলে কাঁকে ছেলে ছেলে ঝোলে কোলে।
তার বিয়ে বিধি নয় উলু উলু ব'লে॥
গিলে গিলে ভাত থায় দাঁত নাই মুখে।
হইয়াছে আঁত খালি হাত চাপা বুকে॥
ঘাটে যারে নিয়ে যাব চড়াইয়া খাটে।
শাড়ীপরা চুড়ি হাতে তারে নাকি খাটে॥
শুনিয়া বিয়ের নাম “কোনে” সেজে বুড়ী।
কেমনে বলিবে মুখে "থুড়ী থুড়ী থুড়ী”॥
পোড়ামুখ পোড়াইয়া কোন্‌ পোড়ামুখী।
“দুখী” “সুখী” মেয়ে ফেলে কেঁচে হবে খুকী॥
ব্যাটা আছে যার তার বেলগাছ এঁচে।
তুড়ী মেরে থুড়ী ব'লে সে বসিবে কেঁচে॥
গমনের আয়োজন শমনের ঘরে।
বিবাহের সাধ সে কি মনে আর করে॥
যেখানে সেখানে শুনি এই কলরব।
বালার বিবাহ দিতে রাজি আছে সব॥
সকলেই এইরূপ বলাবলি করে।
ছুঁড়ীর কল্যাণে যেন বুড়ী নাহি তরে॥
শরীর পড়েছে ঝুলি চুলগুলি পাকা।
কে ধরাবে মাছ তারে কে পরাবে শাঁখা॥
জ্ঞানহারা হয়ে যাই নাহি পাই ধ্যানে।
ফে পাইবে “সৎবাপ” মায়ের কল্যাণে।

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিধবা-বিবাহ আইন
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “সামাজিক ও ব্যাঙ্গ”
অধ্যায় থেকে নেওয়া।

হিন্দু বিধবার বিয়া আছে অপ্রচার।
বহুকাল হ'তে যার নাহি ব্যবহার॥
সে বিষয়ে ক্ষতাক্ষত না করি বিশেষ।
করিলেন একেবারে নিয়ম নির্দ্দেশ॥
শত শত প্রজা তায় ব্যখা পায় প্রাণে।
তাদের আর্দ্দাশ নাহি শুনিলেন কানে॥
গ্রান্ট করি গ্রাণ্টের সকল অভিলাষ।
কালবিল কাল বিল করিলেন পাস॥
না হইতে শাস্ত্রমতে বিচারের শেষ।
বল করি করিলেন আইন আদেশ॥
যাহাদের ধর্ম্ম এই আর দেশাচার।
পরস্পর তারা আগে করুক বিচার॥
বিধি কি অবিধি তারা ঘরেতে বুঝিবে।
যা হয় উঠিত তাই শেষেতে করিবে॥
করিছে আমার ধর্ম্ম আমাতে নির্ভর।
রাজা হয়ে পরধর্ম্মে কেন দেন কর॥
আগে ভাগে রাজাদেশ করিতে প্রচার।
এত কেন মাথা-ব্যথা হউল রাজার?
যদ্যপি বিধান হয় বিধবার বিয়ে।
আপনারা করুক আপন দল নিয়ে॥
যুক্তি আর বিচারেতে যে হয় বিহিত।
দেশেতে চলিত করা তাই ত উচিত॥
অনিয়মে করি এ কি নিয়মের ছল।
ভুপতি তাহাতে কেন প্রকাশেন বল॥
কোলে কাঁকে ছেলে ঝোলে যে সকল রাঁড়ী।
তাহারা সধবা হবে প’রে শাঁখা শাড়ী॥
এ বড় হাসির কথা শুনে লাগে ভর।
কেমন কেমন করে মনের ভিতর॥
শাস্ত্র নয় যুক্তি নয় হবে কি প্রকারে।
দেশচারে ব্যবহারে বাধো বাধো করে॥
যুক্তি ব'লে বিচার করুন শত শত।
কোনমতে হইবে না শাস্ত্রের সম্মত॥
বিবাহ করিয়া তারা পুনর্ভবা হবে।
সতী ব'লে সন্বোধন কিসে করি তবে?
বিধবার গর্ভজাত যে হবে সন্তান।
বৈধ ব’লে কিসে তার করিবে প্রমাণ?
যে বিষয় সর্ব্ববাদি-সম্মত না হয়।
সে বিষয় সিদ্ধ করা শক্ত অতিশয়॥
কলে আর ছলে বলে যত পার কর।
ফলে সে কিছুই নয় মিছে ব’কে মর॥
শ্রীমান্ ধীমান্‌ নীতি-নির্ম্মাণকারক।
যাঁরা সবে হ’তে চান বিধবাতারক॥
নতভাবে নিবেদন প্রতি জনে জনে।
আইন-বৃক্ষের ফল ফলিবে কেমনে।
বিধবার বিয়ে দিতে যাহারা উদ্যত।
তার মাঝে বড় বড় লোক আছে যত॥
যারে ইচ্ছা তারে হয় ডাকিয়া আনিয়া।
ঘরেতে বিঝবা কত পরিচয় নিয়া॥
গোপনেতে এই কথা বলিবেন তারে।
জননীর বিয়ে দিতে পারে কি না পারে॥
যদি পারে তবে তারে বলি বাহাদুর।
এমনি করিলে সর দুঃখ হয় দুর॥
সহজে যদ্যপি হয় এরূপ ব্যাপার।
করিতে হবে না তবে আইন প্রচার॥
যদি কেহ নাহি পারে সাহস ধরিয়া।
বিফল কি ফল তবে আইন করিয়া॥
পবস্পর আড়ম্বর মুখে কত কয়।
কেহ আর মাথা তুলে অগ্রসর নয়॥
গোলেমালে হরিবোল গণ্ডগোল সার।
নাহি হয় ফলোদয় মিছে হাহাকার॥
বাক্যের অভাব নাই বদন-ভাণ্ডারে।
যত আসে তত বলে কে দূষিবে কারে॥
সাহস কোথায় বল প্রতিজ্ঞা কোথায়।
কিছুই না হ’তে পারে মুখের কথায়॥
মিছামিছি অনুষ্ঠানে মিছে কাল হরা।
মুখে বলা বলা নয় কাজে করা করা॥
সকলেই তুড়ি মারে বুঝে নাক কেউ।
সীমা ছেড়ে নাহি খেলে সাগরের ঢেউ॥
সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন।
তবে বুঝি হ’তে পারে বিবাহ-ঘটন॥
নচেৎ না দেখি কোন সম্ভাবনা আর।
অকারণে হই হই উপহাস সার॥
কেহ কিছু নাহি করে আপনার ঘরে।
যাবে যাবে যায় শত্রু যাক্ পরে পরে॥
তখন এরূপ কবে হ'লে ব্যতিক্রম।
"ফাটায় পড়েছে কলা গোবিন্দায় নম।”
রাজার কর্ত্তব্য কথা রিতে বর্ণন।
এরূপ লিখিতে আর নাহি প্রয়োজন॥
এইমাত্র শেষ কথা কহিব নিশ্চয়।
এ বিষয়ে বিধি দেয়া রাজধর্ম্ম নয়॥
মরুক মরুক বাদ প্রজায় প্রজায়।
কোন্‌ কালে রাজার কি হানি আছে তায়॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মেকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী ল  সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত
“ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “রস-লহরী” অধ্যায় থেকে নেওয়া।

ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত যত,                      সকলেই অনুগত,
অবিরত উপকার পান।
তোমাদের মত হ’লে,             বিধি আছে আছে ব'লে,
এখনই দিবেন বিধান॥
পুঁথি লয়ে রাশি রাশি,            কাছে আসি হাসি হাসি,
কহিবেন হইয়া প্রধান।
হিন্দুবালা বিধবার,                   বিয়ে হবে পুনর্ব্বার,
শাস্ত্রে তার রয়েছে প্রমাণ॥
শাস্ত্র এই, বিধি এই,                    অর্ব্বাচীন মূঢ় যেই,
বলে সেই অথে নাহি বিধি।
বিচার করুন এসে,                   শাস্ত্র তার কত এসে,
দেখিব কেমন বিদ্যানিধি॥
অতিশয় দুরাশয়,                   যারা হয় তারা কয়,
পরিণয় নয় নয় বলে।
কিছু নাই বোধাবোধ,                কথায় কথায় ক্রোধ,
অনুরোধ উপরোধ চলে॥
কেবল মুখেতে জাক,                ভিতরে সকলি ফাঁক,
মিছে হাঁক মিছে ডাক ছাড়ে।
ফেঁদে টোল মারে ঢোল,             মিছামিছি করে গোল,
গোলমালে হরিবোল পাড়ে॥
সব শাস্ত্র আছে পড়া,                শাস্ত্র সব হাতে গড়া,
মতামত আমাদের ঘরে।
আমাদের পোড়ো যারা,              পণ্ডিত হইয়া তারা,
টোল ক'রে গোল কোরে মরে॥
আমার মুখের চোটে,                কার সাধ্য এঁটে ওঠে,
কেটে কুটে করি ছারখার।
তোমার কল্যাণে বাবু,                সকলে করিব কাবু,
দেখ কত ক্ষমতা আমার॥
করিলাম এই পণ,                   স্মার্ত্ত আছে কত জন,
দেখি দেখি কেবা কিবা বলে।
বিচারে যদ্যপি হারি,                প্রমাণ না দিতে পারি,
পুঁথি সব ফেলে দিব জলে॥
কালী কালী মুখে ডাকি,               যত দিন বেঁচে থাকি,
আশীর্ব্বাদ করিব তোমায়।
কোরো এই উপকার,                   যেন কটা পরিবার,
অন্ন বিনা মারা নাহি যায়॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পাঁটা
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার
সংগ্রহের ২য় খণ্ড, সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতা, ৮২-পৃষ্ঠার কবিতা।

কবি ভ্রমণকালে আহার সম্বন্ধে অনেক কষ্ট পাইয়া, পরে একটা পাঁটা পাইয়া তৃপ্তির সহিত
ভোজন পূর্ব্বক এই প্রণয়ন করিয়াছিলেন।

রসভারা রসময়, রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি, হয়েছি পাগল।
স্বর্ণকুঁকী রত্নগর্ভা, জননী তোমার।
উদরে তোমায় ধরে, ধন্য গুণ তার॥
তুমি যার পেটে যাও, সেই পুণ্যবান।
সাধু সাধু সাধু তুমি, ছাগীর সন্তান॥
ত্রিতাপেতে তরে লোক, তব নাম নিয়া।
বাঁচালে দক্ষের প্রাণ, নিজ মুণ্ড দিয়া॥
চাঁদমুখে চাঁপদাড়ি, গালে নাই গোঁপ।
শৃঙ্গ খাড়া ছাড়া ছাড়া লোমে লোমে থোপ॥
সে সময়ে অপরূপ, মনোলোভা শোভা।
দৃষ্টি মাত্র নেড়ে গাত্র, কথা কয় বোবা॥
স্বর্গ এক উপসর্গ, ফল তাহে কলা।
দিবানিশি পোড়ে থাকি, ধোরে তোর গলা॥
চারি পায়ে ছাঁদ দিয়া, তুলে রাখি বুকে।
হাতে হাতে স্বর্গ পাই, বোকা গন্ধ সুঁকে॥
শুধু যায় পেট ভোরে, পাঁটারাম দাদা।
ভোজনের কালে যদি, কাছে থাকো বাঁধা।
শাদা কালো কটারূপ, বলিহারি গুণে।
সাত পাত ভাত মারি, ভ্যা ভা রব শুনে॥
মহিমায় নাম ধর, শ্রীমহাপ্রসাদ।
তোমার প্রসাদে যায়, সকল বিষাদ॥
জ্বাল দিতে কাল যায়, লাল পড়ে গালে।
কাটনা কামাই হয়, বাটনার কালে॥
ইচ্ছা করে কাঁচা খাই, সমুদয় লোয়ে।
হাড়শুদ্ধ গিলে ফেলি, হাড়গিলে হোয়ে॥
মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?
যত চুষি তত খুসি হাড়ে হাড়ে রস॥
গিলে গিলে ঝোল খায় আম্বাদনহত।
তাদের জীবন বৃথা দাঁতপড়া যত॥
এমন পাঁটার মাস নাহি খায় যারা।
মোরে যেন ছাগী-গর্ভে জন্ম লয় তারা॥
দেখিয়া ছাগের গুণ কোরে অভিমান।
হইলেন বরারূপ নিজে ভগবান॥
তথাচ যবন হিন্দু করে অপমান।
ইংরাজে কেবল তাঁর রাখিয়াছে মান॥
হোটেলে বিক্রয় হয় নাম ধরে হ্যাম্‌।
পচাগন্ধে প্রাণ যায় ড্যাম্‌ ড্যাম্‌ ড্যাম্‌॥
অদ্যাপি শ্রীহরি সেই অভিমান লোয়ে।
লুকায়ে আছেন জলে কূর্ম্ম মীন হোয়ে॥
কচ্ছপ সে জুজুবুড়ী তারে কেবা যাচে?
মাচে কিছু আছে মান বাঙ্গালির কাছে॥
কিন্তু মাচ পাঁটার নিকটে কোথা রয়?
দাসদাস তস্য দাস তস্য দাস নয়॥
এক দুই তিন চারি ছেড়ে দেহ ছয়।
পাঁচেরে করিলে হাতে রিপু রিপু নয়॥
তঞ্চ ছাড়া পঞ্চ সেই অতি পরিপাটি।
বাবু সেজে পাটির উপরে রাখি পাটি॥
পাত্র হয়ে পাত্র লয়ে ঢোলে মারি চাটি।
ঝোলমাখা মাস নিয়া চাটি কোরে চাটি॥
টুকি টাকি টুক্ টুক্‌ মুখে দিই মেটে।
যত পাই তত খাই সাধ নাহি মেটে॥
ঝোলের সহিত দিলে গোটা গোটা আলু।
লক্‌ লক্ লোলো লোলো জিব হয় লালু॥
সাবাস্‌ সাবাস্‌ রে সাবাসী তোরে অজা।
ত্রিভুবনে তোর কাছে কিছু নাই মজা॥
কোন অংশে বড় নয় কেহ তোর চেয়ে।
এত গুণ ধরিয়াছ পাতা ঘাস থেয়ে॥
মহতের কার্য্য কর গরিবানা চেলে।
না জানি কি হোতো আরো ঘৃত ক্ষীর খেলে॥
বিশেষ মহিমা তব কি কব জবানী।
জানেন কিঞ্চিৎ গুণ ভাঁড়ে মা ভবানী॥
বৃথায় তিলক ধরে ছাই ভম্ম খেয়ে।
কসাই অনেক ভাল গোঁসায়ের চেয়ে॥
পরম বৈষ্ণবী যিনি দক্ষের দুহিতা।
ছাগ-মাংস-রক্তে তিনি সদাই মোহিতা॥
ছলে এক মন্ত্র বলি বলিদান লোয়ে।
খান দেবী পিতৃ-মাতা বিশ্বমাতা হোয়ে॥
দক্ষযজ্ঞে প্রাণ ত্যজি খণ্ড খণ্ড হোয়ে।
করিলেন ভুষ্টিনাশ কালীঘাটে রোয়ে॥
প্রতি কোপে যত পাঁটা বলিদান করে।
দেবী-বরে জন্মে তারা হালদারের ঘরে॥
এক জন্মে মাংস দিয়া আর জন্মে খায়।
কলীর দেবল হয়ে কালী-গুণ গায়॥
প্রণমামি *  *  তোমার চরণে।
পেটভোরে পাঁটা দিও যত যাত্রিগণে॥
প্রণমামি সুখদাত্রী ছাগপ্রসবিনী॥
অদ্যাবধি না হইবা কন্যার জননী॥
প্রণমামি কালীঘাট যথা মাতা কালী।
প্রণমামি মুদি-পদে বেচে যারা ডালি॥
ধন্য ধন্য কর্মকার ধন্য তুমি খাঁড়া।
প্রণমামি তব পদে দিয়া গাত্র নাড়া॥
এমন সুখের ছাগে করে যেই দ্বেষ।
তাড়াইব তারে আমি ছাড়াইব দেশ॥
বাছিয়া পাঁটার হাড় গেঁথে তার মালা।
বানাইব কুঁড়াজালি দিয়া ছাগ-ছালা॥
নামাবলী বহির্ব্বাস নিয়া করতলে।
ভালকোরে ছোপাইব রুধিরের জলে॥
সাজাইব গোঁড়াগণে দিয়া রক্ত-ছাব।
পশু-গন্ধে পশুদের যাবে পশু-ভাব॥
ফের যদি করে দ্বেষ হোয়ে প্রতিবাদী।
ঘুচাব গৌঁড়ামি রোগ দিয়া ছাগনাদী॥
অনুমতি কর ছাগ উদরেতে গিয়া।
অন্তে যেন প্রাণ যায় তব নাম নিয়া॥
মুখে বলি গঙ্গা-নারায়ণ-ব্রহ্ম-হরি।
পাঁটামাস খেতে খেতে বিছানায় মরি॥
তাহাতেই মুক্তি লাভ মুক্তি নাই আর।
নিতাস্ত কৃতান্ত হয় পদানত তার॥
হায় একি অপরূপ বিধাতার খেলা।
শুদ্ধ গাত্র কিছুমাত্র নাহি যায় ফেলা॥
লোম তুলি করি তুলি রঙ্গে রঙ্গ ভরি॥
শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণ রূপ সুখে চিত্র করি॥
চিত্রকরে চিত্র করে দিয়া সূক্ষ্মরেখা।
দেবমূর্ত্তি অবয়ব সব যায় লেখা॥
নানারূপ যন্ত্র হয় ছাগলের ছালে।
শ্রীহরি-গৌরাঙ্গগুণ বাজে তালে তালে॥
ঢাক কাড়া নহবৎ মৃদঙ্গ মাদোল।
তবলা অবলাপ্রিয় ঢোল আর খোল॥
এক চর্ম্মে বহু যন্ত্র বাদ্য তায় কল।
নেড়ানেড়ী গৌঁড়াদের ভিক্ষার সম্বল॥
কোপ্নীধারী প্রেমদাস সেবাদাসী নিয়ে।
দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাকরে খঞ্জনী বাজিয়ে॥
সাধ্য কার এক মুখে মহিমা প্রকাশে।
আপনি করেন বাদ্য আপনার নাশে॥
হাড়িকাষ্ঠে ফেলে দিই ধোরে দুটী ঠ্যাং।
সে সময়ে বাদ্য করে ছ্যাড্যাং ছ্যাড্যাং॥
এমন পাঁটার নাম যে রেখেছে বোকা।
নিজে সেই বোকা নয় ঝাড়বংশ বোকা॥
ভ্রমণে যে ভাবোদয় নদনদী-পথে।
রচিলাম ছাগ-গুণ যথা সাধ্যমতে॥
প্রতিদিন প্রাতে উঠি কোরে শুদ্ধ মন।
ভক্তিভাবে এই পদ্য পড়িবে যেজন॥
বিচিত্র পুষ্পের রথে পাঁটা পাটা বোলে।
সাতান্ন পুরুষ তার স্বর্গে যায় চোলে॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুর্ভিক্ষ প্রথম গীত
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব
বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড, সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতা, ১২০-
পৃষ্ঠা।

প্রথম গীত।
বাউলচাঁদী সুর।
॥ রাগিণী দেশমোল্লার - তাল আড়খেমটা॥

হয় দুনিয়া ওলট্ পালট্,
আর কিসে ভাই ! রক্ষে হবে?
আর কিসে ভাই ! রক্ষে হবে?
পোড়া আকালেতে নাকাল করে,
ডামাডোল পেড়েছে ভবে।
আমরা হাটের নেঁড়া, শিক্ষে ধোরে,
ভিক্ষে কোরে বেড়াই সবে।
হোলো সকল ঘরে ভিক্ষে মাগা,
কে এখন্‌ আর ভিক্ষে দেবে?
যত কালের যুবো,        যেন সুবো,
ইংরাজী কয় বাঁকা ভাবে।
ধোরে গুরু পুরুত মারে জুতো,
ভিখারী কি অন্ন পাবে?

যদি অনাথ বামুন হাতপেতে চায়,
ঘুসি ধোরে ওঠেন তবে !
বলে, গতোর আছে, খেটে খেগে,
তোর পেটের ভার কেটা ববে?
যাদের পেটে হেড়া,        মেজাজ টেড়া,
তাদের কাছে কেটা চাবে?
বলে, জৌ বাঙালি,        ড্যাম, গো টু হেল,
কাছে এলেই কোঁৎকা খাবে।
আমি স্বপনে জানিনে বাবা,
অধঃপাতে সবাই যাবে।
হোয়ে হিঁদুর ছেলে,        ট্যাঁসের চেলে,
টেবিল পেতে খানা খাবে।
এরা বেদ কোরাণের ভেদ মানে না,
খেদ কোরে আর কে বোঝাবে?
ঢুকে ঠাকুর ঘরে,        কুকুর নিয়ে,
জুতো পায়ে দেখতে পাবে।
হোলো কর্ম্মকাণ্ড,        লণ্ড ভণ্ড,
হিঁদুয়ানী কিসে রবে?
যত দুধের শিশু,        ভোজে ঈশু,
ডুবে মোলো ডবের টবে।
আগে মেয়ে গুলো,        ছিল ভালো,
ব্রত ধর্ম্ম কোর্ত্তো সবে।

একা “বেথুন” এসে, শেষ কোরেছে,
আর কি তাদের তেমন পাবে?
যত ছুঁড়ী গুলো, তুড়ী মেরে,
কেতাব হাতে নিচ্চে যবে।
তখন “এ, বি,” শিখে, বিবি সেজে,
বিলাতী বোল কবেই কৰে॥
এখন্‌ আর কি তারা সাজী নিয়ে,
সাঁজ সেঁজোতির ব্রত গাবে?
সব কাঁটা চাম্ চে        ধোর্ বে শেষে,
পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে?
ও ভাই ! আর কিছু দিন, বেঁচে থাকলে,
পাবেই পাবেই দেখতে পাবে।
এরা আপন হাতে        হাঁকিয়ে বগী,
গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে॥
আছে গোটাকত বুড়ো যদিন,
তদিন কিছু রক্ষা পাবে।
ওভাই ! তারা মোলেই দক্ষা রফা,
এক্ কালে সব ফুরয়ে যাবে॥
যখন আস্ বে শমন, কোরবে দমন,
কি বোলে তায় বুঝাইবে?
বুঝি “ছুট” বোলে, “বুট” পায়ে দিয়ে,
“চুরুট” ফুঁকে স্বর্গে যাবে।

ঘোর পাপে ভরা, হোলো ধরা,
রাঁড়ের বিয়ের হুকুম যবে।
তায় নীলকরেরদের মেজেস্টারি,
কেমন কোরে ধর্ম্মে সবে?
ওভাই ! তত দিন তো খেতে হবে,
যত দিন এ দেহ রবে।
এখন কেমন কোরে পেট চালাবো,
মোরে গেলেম ভেবে ভেবে।
রোজ অষ্ট প্রহর কষ্ট ভুগে,
ভাতে পোড়া জোড়ে সবে॥
তায় তেল জোড়ে তো লুণ জোড়ে না,
কেঁদে মরি হাহারবে।
যে চিরটা কাল মাচ খেয়েছে,
কেমনে সে শুক্ নো  খাবে?
মরি মেগে মেগে,    *    *    *    *
মাচ বিনে প্রাণ বেরিয়ে যাবে,
এই সবে কলির সন্ধ্যা রে ভাই !
কতক্ষণে রাত পোয়াবে?
হোলো নিরামিষে শরীর শষ্ক,
আমিষের মুখ দেখবো কবে?
ওরে “উড়ো খই গোবিন্দায় নম”
এই ব্যবস্থা ধরি সবে।

এস “অক্ষয় দত্তে” গুরু কেড়ে,
“বাহ্য বস্তু” পড়ি তবে।
যত জাত কুটম্ব বেয়রা হোয়ে,
খাটে কোরে ঘাটে লবে।
দেশের কর্ত্তা যত কালা হলেন,
কাণ পাতেন না কান্না রবে।
গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ করি,
বিলাতধামে চল সবে॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুর্ভিক্ষ দ্বিতীয় গীত
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব
বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড, সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতা,
১২৪-পৃষ্ঠা।

দ্বিতীয় গীত।
বাউলের সুর।
॥ রাগিণী ভৈরবী - তাল পোস্তা॥

ওগো মা, বিক্টোরিয়া, কর্ গো মানা,
কর্ গো মানা।
যত তোর, রাঙা ছেলে, আর যেন মা !
চোক রাঙেনা, চোক রাঙে না॥
প্রজা লোকের জাতি ধর্ম্মে,
কেহ যেন জোর করে না।

যেন সেই প্রতিজ্ঞা বজায় থাকে,
দিয়েছ মা, যে ঘোষণা।
ও মা, জাতিভেদে, ভজন সাধন,
ধর্ম্মমতে আরাধনা।
মহা অমূল্য ধন ধর্ম্মরতন,
এমন ধন তো আর পাবে না।
যত মিশনারি এ দেশেতে,
এসে করে কি কারখানা।
তারা ঈশুমন্ত্র কানে ফুঁকে,
শিশুকে দেয় কুমন্ত্রণা।
ফেরে হাটে, ঘাটে, বাটে, মাঠে,
নানা ঠাটে, ফন্দি নানা।
বলে দিশি কৃষ্ণ ছেড়ে তোরা,
ঈশুখ্রীষ্ট কর ভজনা!
ওমা হেদো বনে কেঁদো চরে,
তার ভয়েতে প্রাণ বাঁচে না।
তার পাশে “হুমো” হুতুমথুমো,
ঘুমো ছেলের জাত রাখে না।
যত শাদা জুজু জোটে বুড়ী,
“ছেলেধরা” প্রতি জনা।
এরা জননীর কোল শূন্য কোরে,
কেড়ে নিচ্ছে দুধের ছানা।
সদা ধর্ম্ম ধর্ম্ম কোরে মরে,
ধর্ম্ম-মর্ম্ম কেউ বোঝে না।
হোরে পরের ধর্ম্ম, ধর্ম্ম হবে,
এইটী মনে বিবেচনা॥
যেন আপন ধর্ম্ম আপ্ নি পালে,
পরের ধর্ম্ম নাশ করে না।
এদের ধর্ম্ম-পথের স্বাধীনতা,
রেখোনা মা, আর রেখোনা।
কেমন কুহক জানে এরা,
উপদেশে করে কাণা।
ওমা বংশ পিও ধংস কোরে,
কত ছেলে খেলে খানা।
নয় তোমার অধীন, স্বাধীন এরা,
কেমন কোরে কোর্ব্বে মানা?
ওমা, আমরা সেটা বুঝ্ তে পারি,
খোট্টা লোকে তা বোঝে না।
তুমি সর্ব্বেশ্বরী যদি তাদের,
চোক রাঙায়ে কর মানা।
তবে টুপি খুলে, আড্ডা ভুলে,
পালিয়ে যাবার পথ পাবে না।
নগর কমিশনর যাঁরা,
তাঁদের একি বিবেচনা।
এ কি প্রাণে সহে যাঁড় দিয়ে মা,
ময়লা-ফেলার গাড়ী টানা।
ও মা. দুগ্ধ বিনে মরি প্রাণে,
হিণদু লোকের প্রাণ বাঁচে না।
যত শাদা লোকের অত্যাচারে,
গরু বাছুর আর বাঁচে না।
যত দেশের গরু ভুট কোরেছে,
টেবিল পেতে খেয়ে খানা।
এরা ধাড়ী শুদ্ধ দিচ্ছে পেটে,
আস্ত ভগবতীর ছানা।
একে রামে রক্ষে নাইকো,
সুগ্রীব তার হল সেনা।
যত দিশি ছেলে কোপ্ চে উঠে,
চাল চেলেছে সাহেবানা।
কারে কৰ দুঃখের কথা,
কান পেতে মা কেউ শোনে না।
যারে দেবতা বলে পুজা করি,
তাতেই হোলো বিড়ম্বনা।
যারা লাঙল চষে, গাড়ী টানে,
করে কত হিত সাধনা।
আর দুগ্ধ দিয়ে জীবন বাঁচায়,
তৃণ খেয়ে প্রাণধারণা।
“গরু তরু” কল্পতরু,
এমন তরু আর হবে না।
ফলে “গরুগাছে” দধি, দুগ্ধ,
সর, নবনী, ঘৃত, ছানা।
মনের দুঃখে বুক ফাটে মা,
বোল্ তে গেলে মুখ ফোটে না।
যে গাছের ফলে সৃষ্টি চলে,
এমন গাছে দিচ্ছে হানা।
ওমা, গোহত্যাটা উঠ্ য়ে দেহ,
অতয় পদে এই বাসনা।
মাগো সফল গরু ফুর্ য়ে গেলে,
দুগ্ধ খেতে আর পাব না।
খাবার দ্রব্য অনেক আছে,
তাই নিয়ে মা চলুক খানা।
ওমা, এমন ত নয় গরুর মাংস
না খেলে পর প্রাণ বাঁচে না॥
স্বোণার বাঙাল, করে কাঙাল,
ইয়ং বাঙাল যত জনা।
সদা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে,
কাণে লাগায় ফোঁস ফোঁসনা॥
এরা, না “হিঁন্দু” না “মোছোলমান”,
ধর্ম্মধনের ধার ধারে না।
নয় "মগ”, “ফিরিঙ্গী” বিষম “ধিঙ্গী”,
ভিতর বাহির যায় না জানা।
ঘরের ঢেঁকি, কুমীর হোয়ে।
ঘটায় কত অঘটনা।
এরা লোণা জল, ঢোকালে ঘরে,
আপন হাতে কেটে খানা।
অগাধ বিদ্যার বিদ্যাসাগর,
তরঙ্গ তায় রঙ্গ নানা।
তাতে বিধবাদের “কুলতরী”,
অকুলেতে কুল পেলে না।
কুলের তরী থাকলে কুলে,
কুলের ভাবনা আর থাকে না॥
সে যে অকূল-সাগর, দারুণ ডাগর,
কালা পানি বড় লোণা।
যখন সাগরে ঢেউ উঠেছিলো,
তখনি গিয়েছে জানা॥
এরা দফ্ রা  খেয়ে নফ্ রা  যত,
কোরে বসে কি এক্‌ খানা।
তখন কর্ত্তারা কেউ শুনলেন্‌ না তো,
লক্ষ লক্ষ হিঁদুর মানা॥
এরা বাঘেরে করিলেন শিকার,
কাঁদে করি ইদুঁর ছানা॥
তদবধি রাজ্যে তোমার,
উঠেছে এক কূরটনা।
ওমা, আমরা বুঝি মিছে সেটা,
অবোধে প্রবোধ মানে না॥
“কালবিল”
* কাল্‌ বিল্‌ কোরেছেন,
হিঁদুর তাতে ঘোর যাতনা।
তুমি রাঁড়ের বিয়ে তুলে দিয়ে,
ছিঁড়ে ফেলো আইনখানা॥
ওমা, যে পাপে হোক্ প্রজা মরে,
চার টাকা দর, চাল্ মেলে না।
দেখ অনাহারে, প্রজা মরে,
না খেয়ে আর প্রাণ বাঁচেনা॥
ওমা, যত বাবু, হোলো কাবু,
আর চলে না বাবুয়ানা।
যারা আঙ্গুর পেস্তা দিত ফেলে,
তারা এখন চিবোয় চানা!
বড়মানষী দূরে থাকুক,
ভালো কোরে পেট চলে না।
এখন্‌ কেমন্‌ কোরে চড়বে গাড়ী,
জোটেনাকো ঘোড়া দানা !
শাসন পালন করেন যাঁরা,
হোলেন তাঁরা কালা কাণা।
ওমা, না খেয়ে সব প্রজা মরে,
নাইকো সেটী দেখা শোনা।
কত বার মা পোড়েছিলো,
দরখাস্ত কত খানা।
বলেন “ফিরি টেরেড” বনद কোর্ত্তে,
কোনো কালে কেউ পারে না॥
চেলের বাজার শস্তা কর,
পূরাও গো মা সব বাসনা।
তবে দুঃখী লোকের আশীর্ব্বাদে,
আপদ বিপদ আর রবে না॥
শিব সস্তেন কোর্চ্ছি তোমার,
মহামন্ত্র আরাধনা।
আছে মহারথী সেনাপতি,
ভগবতীর উপাসনা॥
দুর্গানামের দুর্গ গেঁথে,
রেখেছি মা “সেলেখানা”।
তাতে গুলি গোলা, সকল তোলা,
ভক্তি অস্ত্র আছে শাণা॥
আছে মনশিবিরে সজ্জা কোরে,
সংখ্যা হয় না কত সেনা।
আছে জোড়া ঘোড়া সত্য ধর্ম্ম,
উড়ে যাবে ধরে ডেনা॥
এই ভারত কিসে রক্ষা হবে,
ভেবো না মা, সে ভাবনা।
সেই “তাতিয়া তোপির” মাথা কেটে,
আমরা ধোরে দেব “নানা”॥

* Sir J. W. Colville

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
যুদ্ধ-শান্তি
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “যুদ্ধ-বিষয়ক” অধ্যায় থেকে
নেওয়া।

ভয় নাই আর কিছু ভয় নাই আর।
শুভ সমাচার বড় শুভ সমাচার॥
পুনর্ব্বাধার হইয়াছে দিল্লী অধিকার।
“বাদশা বেগম” দোঁহে ভোগে কারাগার॥
অকারণে ক্রিয়াদোষে করে অত্যাচার।
মরিল দুজন তাঁর প্রাণের কুমার॥
ছেলে মেয়ে আদি করি যত পরিবার।
দিবানিশি করিতেছে শুধু হাহাকার॥
কোথা সেই আস্ফালন কোথা দরবার?
হাড়ে মাটী বাড়ে দূর্ব্বা হয়ে গেল সার॥
একেবারে ঝাড়ে বংশে হ'ল ছারখার।
শিশু সব মারা যাবে বিহনে আহার॥
দূরে থাক্‌ সমুদয় সম্পদ-সঞ্চার।
পড়িয়া ব্রিটিশ-কোপে প্রাণে বাঁচা ভার॥
করেছিল যে প্রচার বিষম ব্যাপার।
হাতে হাতে প্রতিফল ফ’লে গেল তার॥
অদ্যপিও রবি শশী হতেছে প্রচার।
অদ্যাপিও হয় নাই সত্যের সংহার॥
অদ্যপিও ধর্ম্ম এক করেন বিহার।
তিনি কি কখনো সন এত পাপভার?
কোথা দীনদয়াময় সর্ব্বামূলাধার।
আহা আহা মরি কিবা করণা তোমার॥
অন্তরীক্ষে থেকে সব করিছ বিচার।
তোমা বিনে জয় দানে সাধ্য আছে কার॥
সমুচিত শাস্তি পেলে যত দুরাচার।
অতএব তব পদে করি নমস্কার॥

যমুনার জল আর পূর্ববৎ নাই যে।
হয়েছে রুধিরে ভরা কেমনেতে নাই রে?
তৃষ্ণায় সে জল আর কেমনেতে খাই রে?
ভাসিছে তাহাতে সব শব ঠাঁই ঠাঁই রে॥
ঝাঁপ দিয়ে মরিতেছে সকল সিপাই রে।
এ কূল ও কূলে তার ভম্ম আর ছাই রে॥
কুকুর শৃগাল হেরি যে দিকেতে চাই রে।
শকুনি গৃধিনী উড়ে শব্দ সাঁই সাঁই রে॥
শা-জাদার শাণিতেতে মিটে গেল খাঁই রে।
খেয়ে সব পরাভব মেনেছে সবাই রে॥
স্থানে স্থানে মৃতদেহ পর্ব্বতের চাঁই রে।
পচাগন্ধে নাক জ্বলে কোথায় দাঁড়াই রে?
মলহীন একটুকু স্থান নাহি পাই রে।
কোথা খেয়ে কোথা শুয়ে সুখে নিদ্রা যাই রে?
সব দিকে সমদশা কোন্‌ দিকে চাই রে?
এ দেশেতে নাহি দেখি হিংসাহীন ঠাঁই রে॥
যমুনার তটে এসে যমুনার ভাই রে।
*
বিকট বদনে এক বিস্তারিল হাই রে॥
সাধু সাধু ধর্ম্মরাজ বলি হারি.যাই রে।
ঘুচাইল যত কিছু আপদ বালাই রে॥
ব্রিটিসের জয় জয় বল সবে ভাই রে।
এসো সবে নেচে কুঁদে বিভূগণ গাই রে॥

* - যম।

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ঋতু
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “ঋতু-বর্ণন” অধ্যায় থেকে নেওয়া।

বসন্ত নিদাঘ বর্ষা শরৎ নীহার।
কাল ক্রমে ক্রমে সব করে অধিকার॥
ছয় কালে ছয় ঋতু ছয় রূপ ভাব।
ছয় কালে ছয় ভাবে শোভিত স্বভাব॥
থাকে না অন্যের বোধ একের সময়।
এইরূপে কত কাল গত করি ছয়॥
এই শীত ক্ষণ পরে গ্রীষ্ম যদি হয়।
শীতের স্বভাব তায় অনুভূত নয়॥
ছয় ঋতু অধিকারে ছয়রূপ যোগ।
নব নব পরাক্রমে নব নব ভোগ॥
কখন কম্পিত কায় শীত-সমীরণে।
লাগসা অধিক হয় রবির কিরণে॥
কখন তপন-তাপ সহ্য নাহি হয়।
সুশীতল স্নিগ্ধ-রসে ইচ্ছা অতিশয়॥
কখন বা ভাসে সৃষ্টি বৃষ্টির ধারায়।
মেঘনাদ অন্ধকার দৃষ্টিহীন তায়॥
জীবের ভোগের হেতু ঋতুর সৃজন।
পৃথকে পৃথক্‌ তাঁর প্রভা প্রকটন॥
প্রতিক্ষণ পায় মন নব পৰিচয়।
পুরাতন নয় যেন পুরাতন নয়॥
হয়েছে নূতন সৃষ্টি এই দৃষ্টি হয়।
পুরাতন নয় যেন পুরাতন নয়॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর