কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর গান ও কবিতা |
বর্ষা কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত “ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “ঋতু বর্ণন” অধ্যায় থেকে নেওয়া। করিয়া সমর-সাজ, খতুপতি বর্ষারাজ, অবনীমণ্ডলে উপনীত। রণস্থল করি রুদ্ধ, ব্যাপিল পৃথিবী শুদ্ধ, ঘোর যুদ্ধ গ্রীষ্মের সহিত॥ দেখিয়া বিপক্ষ দল, গ্রীষ্মের টুটিল বল, পরাজয় করিল স্বীকার। পলাইল পেয়ে ভয়, বর্ষার মহাজয়, ত্রিভুবন করে অধিকার॥ গগনের সিংহাসনে, বসিলেন হৃষ্ট-মনে, তিমিরের মুকুট মাথায়। পবন প্রবল অতি, পূর্ব্বদিকে করে গতি, দিবানিশি চামর ঢুলায়॥ গুডুনি জলের জাল, লেটের উড়ুনি ভাল, মাঝে মাঝে লাগিয়াছে খোঁচা। বারির বসন পরা, লুটাইয়া পড়ে ধরা, বাতাসেতে উড়ে যায় কোঁচা॥ সবুজ মেঘের দল, ঢল ঢল ছল ছল, হতবল প্রবল অনিলে। স্থিরচক্ষে দেখা যায়, সাটিনের কাবা গায়, আস্তিন হয়েছে তার ঢিলে॥ সোণার দামিনী-হার, গলায় দুলিছে তার, আহা মরি কত শোভা তায়। সেফালিকা প্রস্ফুটিত, অতিশয় সুশোভিত, জরির লপেটা লতা পায়॥ ঝিল বিল নদী নদ, সরোবর সিন্ধু হ্রদ, আর যত পারিষদ গণ। সকলের একবোল, প্রেমানন্দে দিয়ে কোল, পরস্পর করে আলিঙ্গন॥ তরুকুল নত শাখা, প্রতি পত্রে জল মাখা, সারি সারি সরস অন্তরে। নজর ধরিয়া ছলে, বরষার পদতলে, যোড়করে প্রণিপাত করে॥ ভেকপাল কোতোয়াল, করে করি খাঁড়া ঢাল, জলে স্থলে কত সুখ লোটে। দেখিয়া ভেকের ভেক, বিয়োগীর বাড়ে ভেক, ইচ্ছা হয় ডেক নিয়া ছোটে॥ নকিব চাতকচয়, জয় ভূপতির জয়, প্রঠিক্ষণ এই রব হাঁকে॥ জল দে রে জল দে রে. প্রাণ যায় জল দেরে, জলদেরে আর নাহি ডাকে॥ কোন্ তুচ্ছ থিয়েটর, বরষার নাচ-ঘর, মনোহর শিখর সমাজ। দৃশ্য অতি অপরূপ, চিত্র করা নানারূপ, সমুদয় স্বভাবের সাজ॥ নিজ স্বরে জলধর, গান করে বহুতর, নানা স্বরে রাগ ভাজে মুখে। বৃষ্টির বাজনা ভাল, ঝম্ ঝম্ বাজে তাল, শিখী নিত্য নৃত্য করে সুখে॥ কেমন কালের ধারা, অবিশ্রান্ত বারিধারা সুধার সুধার বরিষণ। সদাই প্রফুল্ল মন, চাতক চাতকীগণ, শুভক্ষণ করে সুভক্ষণ॥ জাঁকিল ভেকের দল, মাগিল স্বর্গের জল, রাখিল ভুবনে তাল যশ। ডাকিল মেঘের পাল, হাঁকিল ঠুকিয়া তাল, ঢাকিল তিমিরে দিগদশ॥ করিল উত্তম কর্ম, হরিল গাত্রের ঘর্ম্ম, মরিল পিপাসা দাহ জ্বর। তরিল যুবক যারা, ধরিল যুবতী দারা, পরিল পোষাক বহুতর॥ চারিদিক্ অন্ধকার, দৃষ্টিরোধ সবাকার, জলে স্থলে একাকারময়। হেরি শুদ্ধ নীরাকার, নিরঞ্জন নিরাকার, এই বুঝি চিহ্ন তার হয়॥ হায় হা এ কি দায়, মহাপ্রলরের প্রায়, সকল পৃথিবী ভাসে জলে। অধরা হইল ধরা, জল নাহি যায় ধরা, একেবারে যায় ধরাতলে॥ ক্রোধযুক্ত ধরাধর, ডুবে গেল ধরাধর, কেবল মস্তক দেখা যায়। ভূজঙ্গ বিহঙ্গ যত, কত শত ছয় হত, পশু যত করে হায় হায়॥ রাজার বাজার জাঁক, গরবেতে গোঁপে পাক, ছাড়ে হাঁক ঐরাবতে চড়ি। বাজে লোকে বাজ কয়, ফলতঃ সে বাজ নয়, বরষার দন্ত-কড়মড়ি॥ বিষম বজ্রের শব্দ, ত্রিলোক হইল স্তব্ধ, থর থর ভয়ে কাঁপে সব। হড় মড় কড় মড়, সদা করে মড় মড়, চড় চড় কড় কড় রব॥ শুনি ধ্বনি বজ্রাঘাত, গর্ভিণীর গর্ভপাত, প্রমোদে প্রমাদ সদা গণে। পতঙ্গ পতঙ্গ সম, নিজাঙ্গ করিল তম, মাতঙ্গ আতঙ্গ পায় মনে॥ হুড় হুড় দুড় দুড়, মেঘনাদ গুড় গুড়, জলদ জুটেছে ভাল যুটি। লোকে বলে এ কি কাল, উড়িয়া স্বর্গের চাল, ভেঙে পড়ে আকাশের খুঁটি॥ নাশিতে মকল রিষ্টি, বরষার কোপ-দৃষ্টি, নয়নে অনল তার জ্বলে। সেই অগ্নি দৃশ্য হয়, ভ্রমেতে মনুষ্যচয়, চপলা বিদ্যুৎ তারে বলে॥ কেহ কেহ এই কয়, এ ভাব যথার্থ হয়, কেহ কয় তাহা নয় ভাই। রণে হয়ে পরিশ্রান্ত, মহাবল-পরাক্রান্ত, ঘন তোলে ঘন ঘন হাই॥ কেহ কহে সৌদামিনী, বরষার প্রিয় রাণী, সুরূপসী মুনি-মনোহরা। তাহার মুখের হাসি, প্রকাশিয়া প্রভারাশি, অন্ধকারে আলো করে ধরা॥ বুদ্ধিবলে কেহ বলে, গ্রীষ্ম অন্বেষণ ছলে, পাতিয়াছে ঘোর ষড়জাল। কোপে অঙ্গ জরজর, যুক্তি করি জলধর, জ্বালিয়াছে তড়িৎ মশাল॥ সুবিমল শশধর, গোপন করিয়া কর, অন্ধকারে লুকাইল আসি। দেখিয়া বন্ধুর দুখ, বিষাদে বিদরে বুক, রজনীর মুখে নাই হাসি॥ সপত্নী সকল তারা, মুদিয়া নয়নতারা, তারা শুদ্ধ তারা তারা বলে। ডাকে তারা তারাকান্ত, কোথা তারা তারাকান্ত, অবিশ্রান্ত ভাসে শোক-জলে॥ কুমুদের মনে খেদ, অস্তর হুইল ভেদ, চকোর করিছে হাহাকার। ক্ষুধায় সুধায় তারে, সুধায় তুষিতে পারে, তার পক্ষে কেবা আছে আর॥ দিনপতি অতি দীন, দিন দিন প্রভাহীন, কোন দিন সুদিন না হয়। কেমন কুদিন তাঁর. দুর্দ্দিন না যায় আর, রাতদিন একভাবে রয়॥ রাত্রিমান দিনমান, নাহি হয় অনুমান, পরিমাণ মনে পায় দুখ। কমলের মহামান, অপমানে ম্রিয়মাণ অভিমানে নাহি তুলে মুখ॥ সংযোগীর অভিলাষ, উভয়ে একত্রে বাস, কোনরূপো না হয় বিচ্ছেদ। বুঝে সার অভিমত, তাই বর্ষা এইমত, রাত্রিদিন করিল অভেদ॥ ফুটেছে অনেক ফুল, ছুটেছে ভ্রমরকুল, জুটেছে কাননে শত শত। টুটেছে বিরহী জনে, উঠেছে বিচ্ছেদ মনে, ঘটেছে বিপদ্ তার কত॥ গেল সব নিরানন্দ, কুসুমে মধুর গন্ধ, বহে মন্দ মুখে মন্দ গান। অলিবৃন্দ সদানন্দ, আানন্দে হইয়া অন্ধ, করে সুখে মকরন্দ পান॥ বিষম চক্ষের শূল, কদম্ব কদম্ব-ফুল, দোলে পেয়ে বাতাসের দোলা। বিরহী করিতে বধ, সেনাপতি ষট্ পদ, কামের কামানে ছোড়ে গোলা॥ সংযোগীর মহাযোগ, যুক্তযোগে বাড়ে যোগ, যোগবলে বাড়ে ভোগবল। কোন্ তুচ্ছ চতুর্ব্বর্গ, স্বর্গ এক উপসর্গ, হাতে হাতে পায় স্বর্গফল ॥ কান্তাগণ সহ কান্ত, করে ক্রীড়া অবিশ্রান্ত, রতিকান্ত হারাইল দিশা। বর্ষা তাহে অন্তরঙ্গ, ক্ষণ নহে তালভঙ্গ, অনঙ্গ-প্রসঙ্গে সাঙ্গ নিশা॥ যে প্রকার শারী শুক, সুখের বাড়ায় সুখ, সদাকাল থাকে মুখে মুখে। ধরাতলে সেই ধন্য, কে আর তেমন অন্য, যুবতী রমণী যার বুকে॥ যার ঘরে বেড়াছিটে, যদি গায়ে লাগে ছিটে, অমৃত সমান জ্ঞান করে। পড়ে বৃষ্টি ছিটে ফোঁটা, পড়ে মন্ত্র ছিটে ফোঁটা, প্রাণনাথে ভুলাবার তরে॥ সংযোগীর এইরপ, উথলে আনন্দ-কূপ, আহার বিহার যথোচিত। বিরহীর বুকে বর্শা, মারিয়া নির্দ্দয় বর্ষা, বর্ষানামে হইল বিদিত॥ প্রবাসী পুরুষ যত, একেবারে জ্ঞানহত, প্রেয়সীর প্রেম মনে হয়। মদন বাড়ায় রোষ, স্বপনে অধিক দোষ, কোনরূপে পরিতোষ নয়॥ কি কব দুখের দশা, দিনে মাছি রেতে মশা, দুই কালে বন্ধু দুই জন। শয্যায় ভার্য্যার প্রায়, ছারপোকা উঠে গায়, প্রতিক্ষণ করে আলিঙন॥ খুক্ খুক্ তুলে কাস, বার বার ফেরে পাশ, দহে মন কামের আগুনে। বিছেনায় লট্ পট্, প্রাণ ঘায় ছট্ ফট্, বাঁচে শুদ্ধ বালিসের গুণে। যেমন মুষলধার, পড়ে বৃষ্টি অনিবার, বাহিরেতে নাহি যায় চলা। রসিকা রমণী যেই, অনুমান করে এই, আকাশের ফুটিয়াছে তলা॥ বিমানে বাড়িল জাঁক, বারিদ বাজায় শাঁক, বজ্রছলে উলু উলু ধ্বনি। বর্ষার বিষম গুণ, বিবাহ করিয়ে পুন, পুরোহিত ভেক শিরোমণি॥ ময়ূর নেড়ীর দলে, খেঁউড় গাইছে ছলে, নাচিছে চপলা সব এয়ো। আনন্দের পরিপাটী, সুখে করে কাটামাটী, চাতক জুটেছে ভাল রেয়ো॥ . **************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |