কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর গান ও কবিতা
*
প্রেম
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের
৫ম খণ্ডের বিবিধ বিষয়ক কবিতা।

যথার্থ প্রেমের পথে, পথিক যে জন।
নির্ম্মল জলের প্রায়, স্নিগ্ধ তার মন॥
শুদ্ধভাবে থাকে শুদ্ধ, আপনার ভাবে।
প্রিয়জনে প্রিয় ভাবে, আপনার ভাবে॥
সরল স্বভাবে পায়, সস্তোষের সুখ।
ভ্রমে কভু নাহি দেখে, ছলনার মুখ॥
রসের রসিক সেই, পরিপূর্ণ রসে।
ভূবন ভুলায় নিজ, প্রণয়ের বশে॥
ভাৰ তুলি স্নেহে তুলি, রঙ্গে রঙ্গ ঘটে।
মিত্ররূপ চিত্র করে, হৃদয়ের পটে॥
সুখময় শুকপক্ষী, ভাল ভালবাসা।
মানস বৃক্ষেতে তার, মনোহর বাসা॥
প্রতিক্ষণ প্রতীক্ষণ, অনুরাগ ফলে॥
পড়া পাখী না পড়াতে, কত বুলি বলে॥
আঁখির উপরে পাখী, পালক নাচায়।
প্রতিপক্ষ প্রীতিপক্ষ, বিপক্ষ নাচায়॥
প্রেমের বিহঙ্গ সেই, ভালবাসি মনে।
আদরে পুষেছি তারে, হৃদয় সদনে॥
পোষমানা পড়া পাখী, দরিদ্রের ধন।
সাবধানে রাখি কত, করিয়া যতন॥
পোড়া লোকে পাপচক্ষে, দৃষ্টি করে তারে।
আর আমি কোনমতে, দেখাবনা কারে॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রণয়ের প্রথম চুম্বন
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় রচিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার সংগ্রহের
৫ম খণ্ডের বিবিধ বিষয়ক কবিতা।

প্রণয় সুখের সার, প্রথম চুম্বন।
অপার আনন্দপ্রদ, প্রেমিকের ধন॥
আছে বটে অমৃত, অমরাবতী পুরে।
প্রেমোদিত করে যাহে, যত সব সুরে॥
উথলয় সুখসিন্ধু, পানে এক বিন্দু।
যার আশে গ্রাসে রাহু, পৃর্ণিমার ইন্দু॥
সে ক্ষুধার সুধা মাত্র, নাহি একক্ষণ।
যদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুম্বন॥
.        ________________

অশুরের প্রিয় পেয়, সুরারস মাত্র।
রসনা সরস গাত্র, পরশিলে পাত্র॥
যার লাগি হলো ধ্বংস, যদুবংশগণ।
স্বভাবে অভাব সদা, রেবতীরমণ॥
অদ্যাবধি মদ্যমাত্র, পানীয় প্রধান।
বিদ্যজন খাদ্য মাঝে, সদ্য বিদ্যমান॥
এমন মধুরা সুরা, নাহি চায় মন।
যদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুম্বন॥
.        ________________

অমল কমল সম, কবিতার শোভা।
ভাবুকের মন তাহে, মত্ত মধুলোভা॥
দুগ্ধপানে মুগ্ধ যথা, ভাবকের মন॥
কবিতায় তৃপ্ত তথা, হয় সর্ব্বজন॥
যাহার প্রসাদে পরিহত, পুক্রশোক।
পুলক আলোক পায়, ভাগ্যহীন লোক॥
হেন কবিতার শক্তি, নাহি প্রয়োজন।
বদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুম্বন॥
.        ________________

গলকুণ্ড দেশে আছে, হীরক-আকর।
রজত কাঞ্চনময়, সুমেরু শেখর॥
নানা রত্ন পরিপূর্ণ, রত্নাকর জলে।
গজমুক্তা মূল্যযুক্তা, অনেক সিংহলে॥
কুবের লইয়া যদি, এই সমুদয়।
আমারে প্রদান করে, হইয়া সদয়॥
ক্ষেপণ করিব দূরে, প্রহারি চরণ।
যদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুম্বন॥
.        ________________

তন্ত্র মন্ত্র পুরাণাদি, সর্বশাস্ত্রে শুনি।
পুন পুন এই বাক্যে, কহে যত মুনি॥
ইহধরা দুখভরা, অসার সংসার।
নহেক তিলেক সুখ, সুধার সাঞ্চার॥
মুনীনাঞ্চ, মতিভ্রম, এইস্থলে ঘটে॥
নতুবা অযুক্তি হেন, কি কারণ রটে॥
দেখাইব কত সুখ, এ তিন ভূবন।
যদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুম্বন॥
.        ________________

নয়নে নিরখি প্রকটিত পদ্মবন।
সুমধুর গীত শ্রুতি, করয়ে শ্রবণ॥
হৃদয়ে আনন্দে প্রভা, হয় সন্দীপন।
সহস্র সহস্র সুখ, প্রাপ্ত হয় মন॥
রসনায় রসবারি, খর স্রোতে বয়।
শিহরে সর্ব্বাঙ্গ ভঙ্গ, দেয় লজ্জাভয়॥
এইরূপ স্বর্গভোগ, লতি সর্বক্ষণ।
যদি পাই প্রণয়ের, প্রথম চুত্বন॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
জরা অপেক্ষা মরণ ভাল
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “পারমার্থিক ও নৈতিক” অধ্যায়
থেকে নেওয়া।

জরা এসে শরীর করেছে অধিকার।
বল করি বাড়িতেছে বিষম বিকার॥
রাখে না রাখে না আর বলের সঞ্চার।
থাকে না থাকে না দেহ থাকে নাকো আর॥
ফুরায়েছে সমুদায় কিছু নাহি বাকি।
কেবল অপেক্ষা আছে মুদিতে দু আঁখি॥
তুলিতে না হবে মুখ খুলিতে নয়ন।
আর না উঠিতে হবে করিলে শয়ন॥
কলসী হইল শূন্য দেখে পাই ভয়।
গড়াতে গড়াতে জল কত দিন রয়?
কলেবর-সরোবর করিয়া শোষণ।
কালরূপ নিদাঘেতে খেতেছে জীবন॥
অহরহ দাহ করে জ্বালিয়া অনল।
জরা হতে মরা ভাল বেঁচে কিবা ফল?

.        কি ছিলে কি হলে এসে ভবের ভবনে
আর বা কি হতে হয় ভাব না কি মনে?
হ’ল শেষ ধ’রে কেশ টানিছে শমন।
উপায় না পাবে আর করিলে গমন॥
এমন অমর আর তখন কি লাগে।
শমন দমন কর গমনের আগে॥
হবে না বিহিত কিছু অজ্ঞানেতে মলে।
হারাবে পরম নিধি জ্ঞানহারা হলে॥
দড়ী দিয়া বাঁধিয়াছে ভাঙ্গিয়াছে রথ।
পরিত্রাণ কিসে পাবে দেখ তার পথ॥
হেলা ক'রে বেলাটুকু কাটায়ো না আর।
ভাঙ্গিয়া অসার খেলা সত্য কর সার॥
তব-রোগ ঘোর ভোগ নাশ নাই তার।
সত্যরূপ পথ্য হ'লে হয় প্রতীকার॥
অতএব জীব ভাই আর কেন মজ।
ভাবভরে ভক্তিরসে ভগবানে ভজ॥
কালকরী-অরি হরি হরি হরি বল।
হরিণাম বল আর পথের সম্বল॥
পরিণামে পরিণামে না থাকিবে ভয়।
শমন দমন হবে গমন-সময়॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
মানুষ কে?
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “পারমার্থিক ও নৈতিক” অধ্যায়
থেকে নেওয়া।

নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব।
জগতের সুখ দুখে সুখ-দুখ লাভ॥
পরপীড়া পরিহরি, পুর্ণ পরিতোষ।
সদানন্দে পারিপূর্ণ স্বভাবের কোষ॥
নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ।
রাজ্যের কুশলকার্য্যে সদা হাস্যমুখ॥
কেবল পরেব হিতে প্রেম লাভ যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?
.        নাহি চায় রাজ্যপদ নাহি চায় ধন।
স্বর্গের সমান দেখে বন উপবন॥
পৃথিরীর সমুদয় নিজ পরিজন।
সন্তোষের সিংহাসনে বাস করে মন॥
আত্মার সহিত সব সমতুল্য গণে।
মাতা পিতা জ্ঞাতি ভাই ভেদ নাহি মনে॥
সকলে সমান মিত্র শত্রু নাই যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?
.        অহঙ্কার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী॥
ভূবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্ব্বত সলিল হয় রসনার রসে॥
মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার“অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে॥
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্য যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?
.        মঙ্গলের প্রতি শুধু প্রেম অতিশয়।
কদাচ না করে তাহে জীবনের ভয়॥
পরিবার পরিহত আশা পরিক্রমে।
জীবের কল্যাণ হেতু নানা স্থানে ভ্রমে॥
দুর্গম সুগম স্থল বিবেচনা নাই।
চিন্তার সঠিত নিদ্রা থাকে এক ঠাঁই॥
সতত গলায় পরে করুণার হার॥
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?
.        চেষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব।
আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব॥
ইঙ্গিতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।
পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে॥
চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে সমুদয় আশা।
যতনে হৃদয়েতে বাসনার বাসা॥
স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যা’র।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বাক্য অপেক্ষা কার্য্য ভাল
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “পারমার্থিক ও নৈতিক” অধ্যায়
থেকে নেওয়া।

কাজে যদি করা হয় কর তবে ভাই।
মিছামিছি মুখে বলে কোন ফল নাই॥
শরতের মিছা মেঘ ডাকডোক্‌ সার।
ছিটে-ফোঁটা নাহি তায় জলের সঞ্চার॥
সেইরূপ মিছা তব মুখে আড়ম্বর।
ফলে যদি না হইলে কার্য্য হিতকর॥
তখনি করিবে তাহা যখন যা হয়।
বিলম্ব-বিধান তায় কোনমতে নয়॥
কল্পনায় কর যদি আলস্য এখন।
কখন হবে না আর সুফল সাধন॥
অতএব কর ভাই সাধ্য হয় যত।
কল্পনা না হয় যেন রাবণের মত॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিদ্রাকালে শঠ উপকারী
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১০ সালে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “কবিবর স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের গ্রন্থাবলী এর “পারমার্থিক ও নৈতিক” অধ্যায়
থেকে নেওয়া।

পরের অহিতকারী নীচ যেই খল।
নিজ লাভ বিনা শুধু খুঁজে মরে ছল॥
কখন জানে না মনে হিত বলে কারে।
উপকার লাভ করে পর অপকারে॥
সদা ভাবে কার কবে কিসে মন্দ হবে।
মুষলের সাজা পায় কুশলের রবে॥
নিয়তই মনে পায় অতিশয় দুখ।
শয়নে ভোজনে নাই কিছুতেই সুখ॥
মিছে আঁখি মুদে থাকে ঘুম যায় চ’ড়ে।
ছটফট করে রেতে বিছানায় পড়ে॥
দৈবাধীন চখে ষদি ঘুম এসে তার।
তবেই সে খল করে পর-উপকার॥
জেগে থেকে কেবল অধর্ম্মে কাটে কাল।
যতক্ষণ নিদ্রা যায় ততক্ষণ ভাল॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
পৌষ-পার্ব্বণ
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় সম্পাদিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ এবং কবিতা সংগ্রহ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের
কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড সামাজিক ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা।

সুখের শিশির কাল, সুখে পূর্ণ ধরা।
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গভরা॥
ধনুর তনুর শেষ, মকরের যোগ।
সন্ধিক্ষণে তিন দিন, মহা সুখ ভোগ॥
মকর সংক্রান্তি স্নানে, জন্মে মহাফল।
মকর মিতিন সই, চল্ চল্ চল্॥
সারানিশি জাগিয়াছি, দেখ দব বাসি।
গঙ্গাজলে গঙ্গাজল, অঙ্গ ধুয়ে আসি॥
অতি ভোরে ফুল নিয়ে গিয়েছেন মাসী।
একা আমি আসিয়াছি, সঙ্গে লয়ে দাসী॥
এসেছি বাপের কাছে, ছেলে মেয়ে ফেলে।
রাঁধাবাড়া হবে সব, আমি নেয়ে এলে॥
ঘোর জাঁক বাজে শাঁক, ষত সব রামা।
কুটিছে তণ্ডুল সুখে, করি ধাম ধামা॥
বাউনি আউনি ঝাড়া, পোড়া আখ্যা আর।
মেষ্বেদেয় নব শাস্ত্র, অশেষ প্রকার॥
তুক্‌ তাক্‌ মন্ত্রতন্ত্র কৃতরূপ খ্যাল্‌।
পাঁদাড়ে ফুলিচে শ্যল্, শ্যাল্ শ্যাল্ শ্যাল্॥
খোলায় পিটুলি দেন, হোয়ে অতি শুচি।
ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হয়, ঢাকা দেন মুচি॥
উনুনে ছাউনি করি, বাউনি বাঁধিয়া।
চাউনি কর্ত্তার পানে, কাঁদুনি কাঁদিয়া॥
চেয়ে দেখ সংসারেতে, কতগুলি ছেলে।
বল দেখি কি হইবে, নয় রেখ চেলে?
ক্ষুদকুঁড়া গুঁড়া করি, কুটিলাম ঢেঁকি।
কেমনে চালাই সব তুমি হোলে ঢেঁকি।
আড় করি পার্ দিতে, সিকি গেল গড়ে।
লেখা করি নাহি হয়, আদ্‌ পোয়া গড়ে॥
ছাঁই কোরে রাখিলাম, অর্দ্ধভাগ কেটে।
হাতে হাতে গেল তিল, তিল তিল বেটে॥
ঝোলাগুড় তোলা ছিল, শিকের উপরে।
তোলা তোলা খেতে দিয়া ফুরাইল ঘরে॥
পোয়া কাঁচ্চা কি করিবে, নহে এক মন।
বাড়ীর লোকের তাহে, নহে এক মণ॥
একমনে খায়া যদি, আদ মণে সারি।
একমনে না খাইলে, দশ মণে হারি॥
ভাঙ্গামণে পুরোমণ, মন যদি খোলে।
পূরোমণে কি হইবে, ভাঙ্গামন হোলে॥
তুমি ভাব ঘরে আছে, কত মণ তোলা।
জাননা কি ঘরে আছে, কত মন তোলা?
কারে বা কহিব আর, বোঝা হলো দায়।
খুলে দিলে, মন কিহে, তুলে রাখা যায়?
বিষম দুরন্ত ওটা, মেজোবোর ব্যাটা।
কোনমতে শুনেনাকো, ছোঁড়া বড় ঠ্যাটা॥
না দিলে, ধমক্‌ দেয়, দুই চক্ষু রেঙ্গে।
ঘট বাটি হাঁড়ি কুঁড়ি, সব ফ্যালে ভেঙে॥
পুলি সব উঠে গেল, কিছু নাই ছাঁই।
নারিকেল তেল গুড়, ফের সব চাই॥
অদৃষ্টের দোষ সব, মিছে দেই গালি।
চর্ব্বণে উঠিয়া গেল, পার্ব্বণের চালি॥
আমি লই মোটা চাল, সরু চেলে চেলে।
বুঝিতে না পারি তুমি, চল কোন্‌ চেলে॥
ও বাড়ীর মেয়েদের, বলিয়াছি খেতে।
নূতন জামাই আজ, আসিবেন রেতে॥
তোমার কি ঘর পানে, কিছু নাই টান।
হাবাতের হাতে যায়, অভাগীর প্রাণ॥
কি বলিব বাপ্ মায়, কেন দিলে বিয়ে।
এক দিন সুখ নাই, ঘরকন্না নিয়ে॥
কোন দিন না করিলে, সংসারের ক্রিয়ে।
দিবেনিশি ফেরো শুধু, গোঁপে তেল দিয়ে॥
সবে মাত্র দুই গাছা, খাড়ু ছিল হাতে।
তাহাও দিয়াছি বাঁধা, মেয়াটির ভাতে॥
সুদে সুদে বেড়ে গেল, কে করে খালাস?
বাঁচিবার সাধ নাই, মলেই খালাস॥
রাত্রিদিন খেটে মরি, এক সন্ধ্যা খেয়ে।
এত জ্বালা সহ্য করি, আমি যাই মেয়ে॥
এইরূপ প্রাতি ঘরে, দৃশ্য মনোহর।
গিন্নির কাঁড়ুনী হয়, কর্ত্তার উপর॥
মাগীদের নাছি আর, তিন রাত্রি ঘুম।
গড়াগড়ি ছড়াছড়ি, রন্ধনের ধূম॥
সবিকাশ নাই মাত্র, এলোচুল বাঁধে।
ডাল্ ঝোল্ মাচ ভাত, রাশি রাশি রাঁধে॥
কত তার কাঁচা থাকে, কত যায় পুড়ে।
সাধে রাঁধে পরমাক্স নলেনের গুড়ে॥
বধূর রন্ধনে যদি যায় তাহা এঁকে।
শ্বাশুড়ী ননদ কত, কথা কয় বেঁকে॥
হ্যালো বউ, কি করিলি, দেখে মন চটে।
এই রান্না শিখেছিস, মায়ের নিকটে?
সাতজন্ম ভাত বিনা, যদি মরি দুখে।
তথাচ এমন রান্না, নাহি দিই মুখে॥
বধূর মধুর খনি, মুখ শতদল।
সলিলে ভাসিয়া যায়, চক্ষু ছল ছল॥
আহা তার হাহাকার, বুঝিবার নয়।
ফুটিতে না পারে কিছু, মনে মনে রয়॥
ভাগ্যফলে রান্না সব, ভাল হয় যাঁর।
ঠ্যাকারেতে মাটিতে পা, নাহি পড়ে তাঁর॥
হাসি হাসি মুখ খানি, অপরূপ আড়া।
বেঁকে বেঁকে যান গিন্নী, দিয়ে নথ নাড়া॥
হ্যাঁগা দিদি এই শাক, রাঁধিযাছি রেতে।
মাথা খাও সত্তি বল, ভাল লাগে খেতে॥
দিব্বি দিস কেন বোন, হেন কথা কোয়ে?
ষাট্ ষাট্ বেঁচে থাক, জন্ম এয়ো হোয়ে॥
পুরুষেরা ভাল সব, বলিয়াছে খেয়ে।
ভাল রান্না রেঁধেছিস্ ধন্য তুই মেয়ে॥
এইরূপ ধুমধাম, প্রতি ঘরে ঘরে।
নানা মত অনুষ্ঠান, আহারের তরে॥
তাজা তাজা ভাজাপুলি, ভেজে ভেজে তোলে।
সারি সারি হাঁড়ি হাণড়ি কাঁড়ি করে কোলে॥
কেহ বা পিটুলি মাখে, কেহ কাই গোলে।
*        *        *
আলু তিল গুড় ক্ষীর, নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিটেপুলি, অশেষ প্রকার॥
বাড়ী বাড়ী নিমন্ত্রণ কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা॥
কামিনী যামিনীযোগে, শয়নের ধরে।
স্বামীর খাবার দ্রব্য আয়োজন করে॥
আদরে খাওয়াবে সব, মনে সাধ আছে।
ঘেঁসে ঘেঁসে বসে গিয়া, আসনের কাছে॥
মাথা খাও, খাও বলি, পাতে দেয় পিটে।
না খাইলে বাঁকা মুখে, পিটে দেয় পিটে॥
আকুলি বিকুলি কত, চুকুলির লাগি।
চুকুলি গড়িয়া হন্‌, চুকুলির ভাগী॥
প্রাণে আর নাহি সয়, ননদের জ্বালা।
বিষমাখা বাক্যবাণে, কাণ হলো কালা॥
মেজো বউ মন্দ নয়, সেই গোড়ে গোড়।
কুমারের পোনে যেন, পোড়ে পোড়ে পোড়॥
মনোদুখে প্রাতে আজ, কুটি নাই থোড়।
এখনো রয়েছে তাই, কোন্দলোর তোড়॥
শ্বাশুড়ী আলাদা রেখে, ছাই তিন হাঁড়ী।
চুপি চুপি পাঠালেন, কন্যাটির বাড়ী॥
ঠাকুর্ঝির ছেলে গুলো, খায় ঠেসে ঠেসে।
আমার গোপাল যেন, আসিয়াছে ভেসে॥
মরি মরি ষাট্ ষাট্, কেঁদেছিল রেতে।
বাছা মোর পেটপুরে, নাহি পায় খেতে॥
শক্তিভক্তিপরায়ণ হন যেই নর।
তখনি এসব বাক্যে, ভেঙ্গে দেন ঘর॥
উপাদেয় দ্রব্য সব, গড়িয়াছে চেলে।
সদ্য হয় কর্ম্ম শেষ, গোটা দুই খেলে॥
কামিনী-কুহকে পড়ি, খায় যেই হাবা।
নিজে সেই হাবা নয়, হাবা তার বাবা॥
বুকে পিটে গুড়াপিটে, গুড়পিটে গড়ে।
হিঁদুর দেবতা সম, ঠাট্ তাঁর ধড়ে॥
ভিতরে পুরিয়া ছাঁই, আলু দেয় ঢাকা।
*        *        *
লোভ নাহি থেমে থাকে, খাই তাই চোটে।
পিটে পুলি পেটে যেন, ছিটে গুলি ফোটে॥
পায়েসে পিটুলি দিয়া, করিয়াছে চুসি।
গৃহিণীর অনুরাগে, শুদ্ধ তাই চুষি॥
যুবো সব সুবো প্রায়, থুবো নাছি নড়ে।
কাছে বোসে খায় কোসে, রোসে নাহি পড়ে॥
ধন্য ধন্য পল্লীগ্রাম, ধন সব লোক।
কাহনের হিসাবেতে, আহারের ঝোঁক॥
প্রবাসী পুরুষ যত, পোষড়ার রবে।
ছুটি নিয়া ছুটাছুটি, বাড়ী এসে সবে॥
সহরের কেনা দ্রব্যে, বেড়ে যায় জাঁক।
বাড়ী বাড়ী নিমন্ত্রণ, মেয়েদের ডাক॥
কর্ত্তাদের গালগল্প, গুড়ুক টানিয়া।
কাঁটালের গুঁড়ি প্রায়, ভুঁড়ি এলাইয়া॥
দুই পার্শ্বে পরিজন, মধ্যে বুড়া বোসে।
চিট্ গুড় ছিটে দিয়ে, পিটে খান কোষে॥
তরুণী রমণী যত, একত্র হইয়া।
তামাসা করিছে সুখে, জামাই লইয়া॥
আহারের দ্রব্য লয়ে, কৌশল কৌতুক।
মাজে মাজে হাস্যরবে, সুখের যৌতুক॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছদ্ম মিশনারি
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৮৮৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় সম্পাদিত ও সংগৃহীত “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
জীবনচরিত ও কবিত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ এবং কবিতা সংগ্রহ” গ্রন্থের পাঁচ খণ্ডে ঈশ্বর গুপ্তের
কবিতার সংগ্রহের ২য় খণ্ড সামাজিক ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা।

ভূজঙ্গ হিংস্রক বটে, তারে কিবা ভয়?
মণি মন্ত্র মহৌষধে, প্রতীকার হয়॥
মিশনরি রাঙ্গা নাগ, দংশে ভাই যারে।
একেবারে বিষদাঁতে, সেরে ফ্যালে তারে॥
ব্যাঘ্র-ভয়ে ব্যগ্র হই, যদি পায় বাগে।
লাঠি অস্ত্র থাকিলে কি, ভয় করি বাঘে?
হেদো বনে
* কেঁদো বাঘ, রাঙ্গামুখ যার।
বাপ্‌ বাপ্‌ বুক ফাটে, নাম শুনে তার॥
বাগ করা বাঘ আছে, হাত দিয়া শিরে।
ধরিয়া ধর্মের গলা, নখে ফ্যালে চিরে॥
ছেলে কালে ছেলেধরা, শুনিয়াছি কাণে।
এখন হইল বোধ, বিশেষ প্রমাণে॥
কহিতে মনের খেদ, বুক ফেটে যায়।
মিশনরি ছেলেধরা, ছেলে ধয়ে খায়॥
মাতৃমুখে জুজু কথা, আছি অবগত।
এই বুঝি সেই জুজু, রাঙ্গামুখ যত॥
চুপ চুপ ছেলে সব, হও সাবধান।
কাণ কাটা
- - - কেটে নেবে কাণ॥
ঘুমাও ঘুমাও বাপ, থাক শান্ত ভাবে।
বাটা ভরে পান দেব, গালভরে খাবে॥
চিনি দিব ক্ষীর দিব, দিক গুড়পিটে।
বাপধন বাছা মোর, ছেড়নারে ভিটে॥
কি জানি কি ঘটে পাছে, বুদ্ধি তোর কাঁচা।
ওখানে জুজুর ভয়, যেওনারে বাছা॥
মূর্খ হয়ে ঘরে থাক, ধর্ম্মপথ ধরে।
কাজ নাই ইস্কুলেতে, লেখা পড়া করে॥
হ্যাদেহে ছেলের বাপ, মন্দ বড় ফাল।
আপন আপন ছেলে, সামাল সামাল॥
মিষ্টভাষী শুত্রাকার, মিশনরি যত।
আমাদের পক্ষে তাঁরা দয়া-ধর্ম্মহত॥
পিতার সুখের নিধি, তনয় রতন।
কিছু নাহি বুঝে তার, মনের মতন॥
শূন্য করি জননীর, হৃদয়ভাণ্ডার।
হরণ করিয়া লয়, সাধের কুমার॥
বাক্যের কুহক যোগে, ঈশুমন্ত্র ছেড়ে।
যুবতীর বুক চিরে পতি লয় কেড়ে॥
কামিনীর কোলশূন্য ক্ষুন্ন মন তায়।
এ খেদ কহিব কারে হায় হায় হায়॥
বিদ্যাদান ছল করি, মিশনরি ডব।
পাতিয়াছে ভাল এক বিধর্ম্মের টব॥
মধুর বচন ঝাড়ে, জানাইয়া লব্‌।
ঈশুমন্ত্রে অভিষিক্ত করে শিশু সব॥
শিশু সবে ত্রাণকর্ত্তা, জ্ঞান করে ডবে।
বিপরীত লবে পোড়ে, ডুব দেয় টবে॥


* হেদুয়া পুষ্করিণীর পার্শ্বস্থ, এই অর্থ।

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বর্ষা
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত “ঈশ্বরগুপ্তের
গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “ঋতু বর্ণন” অধ্যায় থেকে নেওয়া।

করিয়া সমর-সাজ,                খতুপতি বর্ষারাজ,
অবনীমণ্ডলে উপনীত।
রণস্থল করি রুদ্ধ,                ব্যাপিল পৃথিবী শুদ্ধ,
ঘোর যুদ্ধ গ্রীষ্মের সহিত॥
দেখিয়া বিপক্ষ দল,                 গ্রীষ্মের টুটিল বল,
পরাজয় করিল স্বীকার।
পলাইল পেয়ে ভয়,                     বর্ষার মহাজয়,
ত্রিভুবন করে অধিকার॥
গগনের সিংহাসনে,                 বসিলেন হৃষ্ট-মনে,
তিমিরের মুকুট মাথায়।
পবন প্রবল অতি,                পূর্ব্বদিকে করে গতি,
দিবানিশি চামর ঢুলায়॥
গুডুনি জলের জাল,                লেটের উড়ুনি ভাল,
মাঝে মাঝে লাগিয়াছে খোঁচা।
বারির বসন পরা,                  লুটাইয়া পড়ে ধরা,
বাতাসেতে উড়ে যায় কোঁচা॥
সবুজ মেঘের দল,                     ঢল ঢল ছল ছল,
হতবল প্রবল অনিলে।
স্থিরচক্ষে দেখা যায়,               সাটিনের কাবা গায়,
আস্তিন হয়েছে তার ঢিলে॥
সোণার দামিনী-হার,                গলায় দুলিছে তার,
আহা মরি কত শোভা তায়।
সেফালিকা প্রস্ফুটিত,              অতিশয় সুশোভিত,
জরির লপেটা লতা পায়॥
ঝিল বিল নদী নদ,                     সরোবর সিন্ধু হ্রদ,
আর যত পারিষদ গণ।
সকলের একবোল,                প্রেমানন্দে দিয়ে কোল,
পরস্পর করে আলিঙ্গন॥
তরুকুল নত শাখা,                 প্রতি পত্রে জল মাখা,
সারি সারি সরস অন্তরে।
নজর ধরিয়া ছলে,                      বরষার পদতলে,
যোড়করে প্রণিপাত করে॥
ভেকপাল কোতোয়াল,              করে করি খাঁড়া ঢাল,
জলে স্থলে কত সুখ লোটে।
দেখিয়া ভেকের ভেক,              বিয়োগীর বাড়ে ভেক,
ইচ্ছা হয় ডেক নিয়া ছোটে॥
নকিব চাতকচয়,                       জয় ভূপতির জয়,
প্রঠিক্ষণ এই রব হাঁকে॥
জল দে রে জল দে রে.              প্রাণ যায় জল দেরে,
জলদেরে আর নাহি ডাকে॥
কোন্‌ তুচ্ছ থিয়েটর,                     বরষার নাচ-ঘর,
মনোহর শিখর সমাজ।
দৃশ্য অতি অপরূপ,                   চিত্র করা নানারূপ,
সমুদয় স্বভাবের সাজ॥
নিজ স্বরে জলধর,                     গান করে বহুতর,
নানা স্বরে রাগ ভাজে মুখে।
বৃষ্টির বাজনা ভাল,                  ঝম্‌ ঝম্‌ বাজে তাল,
শিখী নিত্য নৃত্য করে সুখে॥
কেমন কালের ধারা,                  অবিশ্রান্ত বারিধারা
সুধার সুধার বরিষণ।
সদাই প্রফুল্ল মন,                        চাতক চাতকীগণ,
শুভক্ষণ করে সুভক্ষণ॥
জাঁকিল ভেকের দল,                  মাগিল স্বর্গের জল,
রাখিল ভুবনে তাল যশ।
ডাকিল মেঘের পাল,                হাঁকিল ঠুকিয়া তাল,
ঢাকিল তিমিরে দিগদশ॥
করিল উত্তম কর্ম,                      হরিল গাত্রের ঘর্ম্ম,
মরিল পিপাসা দাহ জ্বর।
তরিল যুবক যারা,                   ধরিল যুবতী দারা,
পরিল পোষাক বহুতর॥
চারিদিক্ অন্ধকার,                  দৃষ্টিরোধ সবাকার,
জলে স্থলে একাকারময়।
হেরি শুদ্ধ নীরাকার,                   নিরঞ্জন নিরাকার,
এই বুঝি চিহ্ন তার হয়॥
হায় হা এ কি দায়,                    মহাপ্রলরের প্রায়,
সকল পৃথিবী ভাসে জলে।
অধরা হইল ধরা,                    জল নাহি যায় ধরা,
একেবারে যায় ধরাতলে॥
ক্রোধযুক্ত ধরাধর,                     ডুবে গেল ধরাধর,
কেবল মস্তক দেখা যায়।
ভূজঙ্গ বিহঙ্গ যত,                     কত শত ছয় হত,
পশু যত করে হায় হায়॥
রাজার বাজার জাঁক,               গরবেতে গোঁপে পাক,
ছাড়ে হাঁক ঐরাবতে চড়ি।
বাজে লোকে বাজ কয়,              ফলতঃ সে বাজ নয়,
বরষার দন্ত-কড়মড়ি॥
বিষম বজ্রের শব্দ,                     ত্রিলোক হইল স্তব্ধ,
থর থর ভয়ে কাঁপে সব।
হড় মড় কড় মড়,                      সদা করে মড় মড়,
চড় চড় কড় কড় রব॥
শুনি ধ্বনি বজ্রাঘাত,                      গর্ভিণীর গর্ভপাত,
প্রমোদে প্রমাদ সদা গণে।
পতঙ্গ পতঙ্গ সম,                       নিজাঙ্গ করিল তম,
মাতঙ্গ আতঙ্গ পায় মনে॥
হুড় হুড় দুড় দুড়,                        মেঘনাদ গুড় গুড়,
জলদ জুটেছে ভাল যুটি।
লোকে বলে এ কি কাল,                উড়িয়া স্বর্গের চাল,
ভেঙে পড়ে আকাশের খুঁটি॥
নাশিতে মকল রিষ্টি,                     বরষার কোপ-দৃষ্টি,
নয়নে অনল তার জ্বলে।
সেই অগ্নি দৃশ্য হয়,                       ভ্রমেতে মনুষ্যচয়,
চপলা বিদ্যুৎ তারে বলে॥
কেহ কেহ এই কয়,                      এ ভাব যথার্থ হয়,
কেহ কয় তাহা নয় ভাই।
রণে হয়ে পরিশ্রান্ত,                      মহাবল-পরাক্রান্ত,
ঘন তোলে ঘন ঘন হাই॥
কেহ কহে সৌদামিনী,                  বরষার প্রিয় রাণী,
সুরূপসী মুনি-মনোহরা।
তাহার মুখের হাসি,                   প্রকাশিয়া প্রভারাশি,
অন্ধকারে আলো করে ধরা॥
বুদ্ধিবলে কেহ বলে,                      গ্রীষ্ম অন্বেষণ ছলে,
পাতিয়াছে ঘোর ষড়জাল।
কোপে অঙ্গ জরজর,                      যুক্তি করি জলধর,
জ্বালিয়াছে তড়িৎ মশাল॥
সুবিমল শশধর,                         গোপন করিয়া কর,
অন্ধকারে লুকাইল আসি।
দেখিয়া বন্ধুর দুখ,                     বিষাদে বিদরে বুক,
রজনীর মুখে নাই হাসি॥
সপত্নী সকল তারা,                        মুদিয়া নয়নতারা,
তারা শুদ্ধ তারা তারা বলে।
ডাকে তারা তারাকান্ত,             কোথা তারা তারাকান্ত,
অবিশ্রান্ত ভাসে শোক-জলে॥
কুমুদের মনে খেদ,                        অস্তর হুইল ভেদ,
চকোর করিছে হাহাকার।
ক্ষুধায় সুধায় তারে,                সুধায় তুষিতে পারে,
তার পক্ষে কেবা আছে আর॥
দিনপতি অতি দীন,                     দিন দিন প্রভাহীন,
কোন দিন সুদিন না হয়।
কেমন কুদিন তাঁর.                   দুর্দ্দিন না যায় আর,
রাতদিন একভাবে রয়॥
রাত্রিমান দিনমান,                      নাহি হয় অনুমান,
পরিমাণ মনে পায় দুখ।
কমলের মহামান,                       অপমানে ম্রিয়মাণ
অভিমানে নাহি তুলে মুখ॥
সংযোগীর অভিলাষ,                 উভয়ে একত্রে বাস,
কোনরূপো না হয় বিচ্ছেদ।
বুঝে সার অভিমত,                     তাই বর্ষা এইমত,
রাত্রিদিন করিল অভেদ॥
ফুটেছে অনেক ফুল,                ছুটেছে ভ্রমরকুল,
জুটেছে কাননে শত শত।
টুটেছে বিরহী জনে,                উঠেছে বিচ্ছেদ মনে,
ঘটেছে বিপদ্‌ তার কত॥
গেল সব নিরানন্দ,                      কুসুমে মধুর গন্ধ,
বহে মন্দ মুখে মন্দ গান।
অলিবৃন্দ সদানন্দ,                আানন্দে হইয়া অন্ধ,
করে সুখে মকরন্দ পান॥
বিষম চক্ষের শূল,                       কদম্ব কদম্ব-ফুল,
দোলে পেয়ে বাতাসের দোলা।
বিরহী করিতে বধ,                    সেনাপতি ষট্ পদ,
কামের কামানে ছোড়ে গোলা॥
সংযোগীর মহাযোগ,              যুক্তযোগে বাড়ে যোগ,
যোগবলে বাড়ে ভোগবল।
কোন্‌ তুচ্ছ চতুর্ব্বর্গ,                    স্বর্গ এক উপসর্গ,
হাতে হাতে পায় স্বর্গফল ॥
কান্তাগণ সহ কান্ত,                করে ক্রীড়া অবিশ্রান্ত,
রতিকান্ত হারাইল দিশা।
বর্ষা তাহে অন্তরঙ্গ,                   ক্ষণ নহে তালভঙ্গ,
অনঙ্গ-প্রসঙ্গে সাঙ্গ নিশা॥
যে প্রকার শারী শুক,                সুখের বাড়ায় সুখ,
সদাকাল থাকে মুখে মুখে।
ধরাতলে সেই ধন্য,                কে আর তেমন অন্য,
যুবতী রমণী যার বুকে॥
যার ঘরে বেড়াছিটে,             যদি গায়ে লাগে ছিটে,
অমৃত সমান জ্ঞান করে।
পড়ে বৃষ্টি ছিটে ফোঁটা,           পড়ে মন্ত্র ছিটে ফোঁটা,
প্রাণনাথে ভুলাবার তরে॥
সংযোগীর এইরপ,                  উথলে আনন্দ-কূপ,
আহার বিহার যথোচিত।
বিরহীর বুকে বর্শা,                 মারিয়া নির্দ্দয় বর্ষা,
বর্ষানামে হইল বিদিত॥
প্রবাসী পুরুষ যত,                  একেবারে জ্ঞানহত,
প্রেয়সীর প্রেম মনে হয়।
মদন বাড়ায় রোষ,                 স্বপনে অধিক দোষ,
কোনরূপে পরিতোষ নয়॥
কি কব দুখের দশা,              দিনে মাছি রেতে মশা,
দুই কালে বন্ধু দুই জন।
শয্যায় ভার্য্যার প্রায়,                ছারপোকা উঠে গায়,
প্রতিক্ষণ করে আলিঙন॥
খুক্‌ খুক্ তুলে কাস,                বার বার ফেরে পাশ,
দহে মন কামের আগুনে।
বিছেনায় লট্ পট্,                     প্রাণ ঘায় ছট্ ফট্,
বাঁচে শুদ্ধ বালিসের গুণে।
যেমন মুষলধার,                      পড়ে বৃষ্টি অনিবার,
বাহিরেতে নাহি যায় চলা।
রসিকা রমণী যেই,                     অনুমান করে এই,
আকাশের ফুটিয়াছে তলা॥
বিমানে বাড়িল জাঁক,                বারিদ বাজায় শাঁক,
বজ্রছলে উলু উলু ধ্বনি।
বর্ষার বিষম গুণ,                      বিবাহ করিয়ে পুন,
পুরোহিত ভেক শিরোমণি॥
ময়ূর নেড়ীর দলে,                    খেঁউড় গাইছে ছলে,
নাচিছে চপলা সব এয়ো।
আনন্দের পরিপাটী,                সুখে করে কাটামাটী,
চাতক জুটেছে ভাল রেয়ো॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
নানা সাহেব
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
১৯১৯ সালে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে
প্রকাশিত “ঈশ্বরগুপ্তের গ্রন্থাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ একত্রে)” এর “যুদ্ধ বিষয়ক” অধ্যায়
থেকে নেওয়া।

নানার কি নানাকেলে, আজো আছে ধন?
নানার কি নানাকেলে, আজো আছে জন?
নানার কি নানাকেলে, আজো আছে মন?
নানার কি নানাকেলে, আজো আছে পণ?
নানান্ব কি নানাকেলে, আজো আছে ডাক?
নানার কি নানাকেলে, আজো আছে জাঁক?
শ্রকাশিছে পাপপন্থা, হয়ে পন্থী “ঢুঢু?”
“ঢ” মারিতে জানে শুধু, ঘটে তার "ঢুঢু”॥
নানা পাপে পটু নানা, নাহি শুনে না, না।
অধর্ম্মের অন্ধকারে হইয়াছে কাণা।
ভাল-দোষে ভাল তুমি, ঘটালে প্রমাদ।
আগেতে দেখেছ ঘুঘু, শেষ দেখ ফাঁদ॥

.              ****************              
.                                                                            
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর