বিড়াল জন্মের ভূমিকা কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
কিছুদিন বাড়িতে না থাকলে টের পাই আমার মধ্যে অনেক বিড়াল বাস করে। বিড়ালের মধ্যে অনেক আমি। ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখামাত্র আমার কোলে লাফ দিয়ে উঠবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন। কিছু কিছু প্রশ্ন আর উত্তর গা জড়াজড়ি করে থাকে। বিড়াল আদরের পর জামা আর লোমের সম্পর্কের মত অবিচ্ছেদ্য জেদী একগুঁয়ে। অন্তরমহলের দৃষ্টি বিশ্বদর্শন বুঝে গেলে মাত্র সাতদিনেই বদলে যেতে পারে অভ্যাস। অভ্যাস বদলে দিতে পারে শ্রেণী। এরকম সময়েই তো জন্মবদলের খেলায় মেতে ওঠে একঘর নির্দোষ প্রানী। অনায়াসে বদল করে নেয় ভূমিকা। . **************** . সূচীতে . . .
একটি মার্জার ও ক্ষুধা কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
(১) অবশেষে একটি মার্জার ডিঙাইয়া গেল আমার লেখা। আমার কবিতাগাড়ির কতটা বিপদ হইতে পারে তাহা দেখিবার জন্য আমিও উন্মুখ হইয়া আছি বহুকাল হইতে। একটি খতরনাক পরিবেশনার জন্য আমার মনন আমাকে বেপথে চালিত করে। ক্রমশ একটি দুর্ঘটনার দিকে একটি ঘাট হইতে আঘাটার দিকে অচেনা তড়িৎ চুম্বকীয় বলের দ্বারা আমি পরিচালিত হইতে লাগিলাম। আমার আজীবন শব্দ সঞ্চয় নিজেরাই যুক্ত ও বিযুক্ত হইতে আরম্ভ করিলে আমার চালিকাশক্তি ক্ষীন হইয়া আসে। অদৃষ্টের উপর ছাড়িয়া দিলেও স্টিয়ারিং কোনোক্রমে তখনো হাতে। ভাবিয়া চলিতেছি যাহা এতদিন আমার কব্জির মোচড় দিয়া তুলিয়া আনিতাম কিংবা আছাড় মারিতাম তাহা আসলে আমার ছিল না।
(২) ক্রীড়াক্ষেত্রে লুকিয়ে থাকা অবয়বহীন খেলোয়াড় ও রেফারিরা হঠাৎ প্রকট ও দৃশ্যমান হইলে আমি ধস্ত ও প্রস্তর হইয়া গিয়াছিলাম। সচল গাড়ির অচল স্টিয়ারিং লইয়া কৃষ্ণ গহবর ডিঙাইয়া আরও একটি গহবরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। এই পাথর শরীর হইতে শব্দের বিচ্ছুরণ হইতে লাগিল। ক্রমশ শব্দেরা শব্দ করিতে শিখিল। ঝংকারের ডেসিবেল ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল ব্রহ্মাস্ত্র হইয়া। কালো হৃদয়ের মানুষ খুঁজিয়া বাহির করিয়া বারুদ বর্ষণ করিতে করিতে আরও একটি কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে চলিয়া গেল আমার যাবতীয় সঞ্চয়।
৩) আমার শরীর পুনরায় প্রস্তর হইতে সজীব হইয়া উঠিল তখনি যখন এ যাবত চুপ করিয়া থাকা মার্জারটি মুখ ঘুরাইয়া স্তব্ধতাপূর্বক আমার কোলে আসিয়া বসিল। আমি তাহার মাথায় হাত রাখিতেই প্রিয় মার্জার মিউ শব্দে বুঝাইয়া দিল তাহাকে দীর্ঘ সময় অভুক্ত রাখিয়াছি । তাহার আহারের বন্দোবস্ত করিয়া ফিরিয়া আসিলাম লেখায়। পাঠ্যক্রমের বাহিরে চোখ রাখিলে হদয়-তন্তুগুলি অধিক জাগরূক হয় । শব্দরা কেবল শব্দরূপ পায় তাহা নহে স্রষ্টা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিজের অস্তিত্ব প্রমান দেয়। নিজের অস্তিত্ব ও স্বাক্ষর রাখিবার সুদীর্ঘ প্রয়াসের কোন শর্টকাট থাকিতে পারে না। নিরন্তর আদান প্রদান তাহার চলনের একটি অঙ্গ ।
(৪) সকল প্রকার শিল্প ও কাজের জন্য ক্ষুধা একটি চাবি। আমাদের হৃদয়ের তালাটি ভাঙিবার প্রকরণ তারই কেবল জানা থাকে। ‘হা অন্ন’ আসলে পৃথিবীর যাবতীয় সফল বিপ্লবের স্লোগান। পাঠকগন আসুন আজ হইতে আমরা আমাদের পাঠ্যক্রম বহির্ভূত ক্ষুধার সন্ধান করি। আমাদের ক্ষুধা বাড়াইবার প্রয়াস ও লালন করিবার যাবতীয় ইচ্ছাকে স্বাগত জানাই। . **************** . সূচীতে . . .
ভিতরবিড়ালী কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
(এক) ভাবনার ক্লোরফিল দৃশ্য বোনে উল ও কাঁটায়। পড়ে যাওয়া ঘর তুলে নেয় আলগোছে। বাফারিং থেমে গেলে সটান ঢুকে পড়ে সিমুলেসান থিওরিতে। বিরাট শিশুর কাছে মন কৃষি কথা শোনে আর পতিত জমি খোঁজে। খোঁজা সাঙ্গ হলে জৈব ও অজৈব পান্ডুলিপি লেখে। লেখে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কোরিওগ্রাফ। উজান ভাটা উপেক্ষা করে চলা আলো ভেঙে যায় অনন্তের পথে।
(দুই) গোটা আপেল আর একটুখানি কামড়ে খাওয়া আপেল , নববধুর কপালে অক্ষত গোল টিপ ও লেপ্টে যাওয়া সিঁদুর সময়ের টোটেম। প্রবাদ ও পরিখা টপকে দল ও দলিতদের জন্য যারা খেটে মরে, একদা রামরাজ্য থেকে অবসর নিয়ে এখন স্বর্গরাজ্যের দিকে যাচ্ছে যারা তাদের জন্যে মেঘের থেকে বজ্র নামিয়ে আনেন ইন্দ্রনাথ। হ্যাঁ সেই মেঘ যে মেঘে কালিদাস রমনীরূপ দেখেন।
(চার) অসুস্থ লালি বিড়ালী শুশ্রূষা নেবে বলে ফিরে এসেছে। তার হারানোর গল্প ও প্রতিদিনের দেখা দৃশ্যাবলীও কবিতায় আশ্রয় চায়। টুকরো দৃশ্যগুলি জোড়া দিতে দিতে একটা গোটা কলোনি রচনা করে ফেলি নিজেরই অজান্তে। তারপর পাখি উড়িয়ে দিই। গোরু মোষ চরাই। ঝোপ ঝাড় জঙ্গলময় জীবনে বাধাপ্রাপ্ত ওঠা আর গোত্যা খেয়ে পড়ার দৃশ্য জুড়তে জুড়তে কত মিথ্যে সত্যি হয়ে যায়। আর সত্যি উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত মিথ্যে হতে চেয়ে এক গৃহত্যাগী বিড়ালী হয়ে যায়। . **************** . সূচীতে . . .
তবু একবার কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
যে নদীটি ফিরবে বলে কথা দিয়েছিল, সে ফিরেছে কিনা খোঁজ নেয়নি কেউ অথচ তার ফেরার খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই রোদ্দুর কিছু অন্ধকারকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। ঘাসের ডগায় লেগে থাকা লাজুক শিশির বিন্দুগুলো পাতায় ছড়িয়ে পড়লো আবীরের রঙে। প্রজাপতি উড়ে যায় স্মৃতির ভিতর। বুঝে নিচ্ছে তন্দ্রা কিছুর শব্দের আদলে। কাক দুটো ভাতের দানার সন্ধানে ঠোঁট গুজে দেয় টালির ফাঁকে । বেজী পরিবার এ চাল ও চাল করে ক্লান্ত। চিকন বাঁশি বেজে যায় পাতার ফাঁকে। আনমনা নদী জলজ বেদনার খোঁয়ারি ভাঙে। গোটানো আস্তিন খুলে যায় স্নায়ুর তারে। শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে চলে যাওয়া জীবনের এনট্রপিগুলো নিতে শিখে গেছে। অনিচ্ছের হাওয়ায় বন্দিশ ভেসে আসে। শূন্য করোটির নৈঃশব্দে সমাধি ফলক ছুঁয়ে থাকা নদীটির সামনে তবু একবার সে এসে দাঁড়াক। জীবনের অর্থ খুঁজে নিক। চূড়ান্ত যা কিছু ভুল সব স্রোতে ভেসে যাক। . **************** . সূচীতে . . .
দেজা ভু কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
আমার নিজস্ব কোনও প্রশ্ন ছিল না তবু তোমার উত্তর লেখা চোখ দেখতে পাই নাগরিক ভিড়েও। সারাদিন আঁকিবুকি কাটা সাদা পাতার থেকে উঠে আসে সমস্ত দেজা ভু ঘটনাপ্রবাহের শব্দবন্ধ। তার প্রতিটি কৌনিক বিন্দু জুড়ে দিলে যে ছবিটি ভাসে তা অনেকটা তোমার মতই নির্ভীক। শুধু অবয়ব বদলে যায় সময়ের চলনাঙ্কে। কখনও সে শ্রমন, কখনও ধর্মযাজক কখনও গর্বিত পিতা , কখনও আউল বাউল ফকির আবার কখনও সে কবিতার অনুচ্চারিত ভাষার মত কুয়াশাময়। দেজা ভু ভাবনাগুলো আপন করে নেয় ক্রমশ আবিষ্কৃত একাধিক চরিত্রদের। তোমার চিরকালীন কবিতার থেকে চয়ন করে নেওয়া একটি ধ্রুবপদ পুনর্বার ফিরিয়ে আনে সদ্য প্রস্ফুটিত কবিতার নিঃশর্ত সমর্পণ। . **************** . সূচীতে . . .
পাথুরে চার্চ ও হৃদয় ভাষা কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
ব্যস্ততা থেকে সময় চুরি করে সমাধিক্ষেত্রে জব চার্নকের পাশে কিছু সময় বসে থাকি। রক্তকাঞ্চন ফুল লেডি ক্যানিং-এর কানে কানে কি বলে যায় সে আমি বুঝি না। চার্চে ট্যুরিস্ট আসার অপেক্ষা না করেই জন পূর্তির আঙুল পাইপ অরগানে ক্যারলের সুর তোলে। ‘দ্য লাস্ট সাপার’ থেকে জুডাস নেমে এসে যীশুর প্রার্থনায় বসে ! কাচের বাক্স থেকে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের শূন্য চেয়ারটি বুঝি মাঝে মাঝে দুলে ওঠে । মুঠো ফোনে কাজের ঘন্টা বেজে উঠলেই লাল মোরামের রাস্তায় ঝরে যাওয়া লাল ফুল হয়ে পড়ে থাকে আমার খোলা হৃদয় ও অব্যক্ত ভাষা। প্রকৃতি পাঠক হয়ে সে ভাষা কুড়িয়ে নেয় । . **************** . সূচীতে . . .
কোটরের কবিতাগাছ কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
সাদা মরুভূমির আদিবাসী গ্রাম ভিরিন্ডিয়ারা। পনেরো ষোলটি মাটির বাড়ি শঙ্কু আকৃতির। কর্তার অনুমতি নিয়ে একটা বাড়ীতে ঢুকে পড়লাম, হাতের জাদু দু-একটা সংগ্রহে নেবার ইচ্ছা। সেখানে দেবীবেন সুঁচসুতোয় যেন কবিতা ফোটাচ্ছেন কাঁথায়। ঘাগরা চোলীর ছোট ছোট মেয়ে লছমি, গীতা একে একে লুকিয়ে পড়ল থামের আড়ালে। রুটি সেঁকতে সেঁকতে বহুরা ঘোমটায় ঢেকে নিল মুখ। আমিও বরাবর লুকাতে ভালোবাসি। নিজের ভেতরে লুকানো। লুকাতে লুকাতে একটা নিজস্ব কোটর তেরী করেছি। এই আরটিসানদের মতই কাঠ, মাটি, মাইকা আর রঙ দিয়ে চিত্রিত ছাদ। বার বার লুকিয়ে পড়ি চেনা সমাজ থেকে দূরে এই ছাদের তলায়। পর্দা ঝুলিয়ে দিই। শুধু পর্দা ভেদ করে আসতে পারে কুয়াশা। ওদের আমি জমিয়ে রাখি। কুয়াশা জমাট বেঁধে গেলে একদিন কোটরের কবিতাগাছ হয়ে যায়। . **************** . সূচীতে . . .
বহুমুখী কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
আমার ভিতরে এতগুলো ভুলভুলাইয়া রাস্তা। আমিও কি ঠিক জানি কোন রাস্তা কোন দিকে যায়! সব রাস্তাই রোমে যায় কি? সব রাস্তার শেষে তোমার দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। তাহলে বাকী সব রাস্তার শেষে কারা দাঁড়িয়ে আছে ! একথা জানার আগেই জীবন ফুরিয়ে যায়... . **************** . সূচীতে . . .
গাছ ভাষা কবি শীলা বিশ্বাস কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “নির্বাচিত শূন্য” -এর কবিতা।
এখানে একদিন জলপাই রঙের গ্রাম ছিল। তখনও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সবুজ খসে পড়েনি। এখন যুদ্ধের রক্তচিহ্ন নিয়ে হাওয়া উড়ে বেড়ায় অন্ধগলিতে। গুপ্তহত্যার ইতিহাস লেখা গাছের পাতারা কুঁকড়ে আছে। অশ্মখুরে ভস্ম ওড়ে ; ধীবরের জালে উঠে আসে মানুষের অস্থি। বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স টাঙানো অন্ধদের রাস্তায়। জিভকাটাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া মাইক্রোফোন। সবুজের হাহাকার পৃথিবী জুড়ে। সৈন্যদের ব্যুহ ভেদ করে চলে যাচ্ছে শ্যেল। আবার সবুজ ফিরিয়ে আনতে গ্রাম ছাড়িয়ে দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে গাছেরা ঝরে পড়তে চায় সভ্যতার বুকে। চলো আমরা গাছ ভাষা শিক্ষা করি। সে ভাষা পড়তে শিখুক আমাদের সন্ততি। . **************** . সূচীতে . . .