মধুসূদন দাশগুপ্ত( মধুবাবু ) ১লা মাঘ ১২৮৭ ~ ২৩ ফাল্গুন ১৩৭০ 15 January 1881 ~ 6 March 1964
মধুসূদন দাশগুপ্ত ঢাকা জেলার অন্তর্গত শুয়াপুর গ্রামের জমিদার বংশের সপ্তম পুরুষ, শ্রী ফণিভূষণ দাশগুপ্তর পুত্র | ফণিভূষণের পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা ছিল | মধুসূদন দাশগুপ্ত ছিলেন তৃতীয় সন্তান । পিতা-মাতার পরলোক গমনের পরে মধুসূদন, তাঁর ছোট দুই ভাই গিরীজাভূষণ এবং অমূল্যভূষণ কে নিয়ে ঢাকা থেকে চলে আসেন উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়িতে | জলপাইগুড়িতে তাঁদের ছোট বোনের শ্বশুরবাড়ী ছিল - নিয়োগী বাড়ী |
পরোপকারীতাই যেন তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল | কার বাড়ীতে মৃতের সৎকার করতে কেউ নেই, সেখানে তিনি দলবল নিয়ে হাজির হতেন | কোথায় টি.বি. রুগি মারা গেছে, সে বাড়ী তখনকার দিনে অচ্ছুৎ হিসাবে পরিগনিত হতো, সে বাড়ীর ধারে কাছেও কেউ যেত না | সেখানে তিনি উপস্থিত হতেন | হয়তো অন্য পাড়াতে আগুন লেগেছে, সে যে কোন সময়ই হোক না কেন! শীত গ্রীষ্ম যখনই হোক তিনি উপস্থিত হতেন |
প্রথমে মধুসূদন তাঁর দুই ভাই কে নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের করলা নদীর পারে রায়কত পাড়ায় ভাড়া বাড়ীতে থাকতেন | নিজেরাই রান্না করে খেতেন | গিরীজাভূষণ আসামে চাকুরী নিয়ে চলে যান | গিরীজাভূষণই ছিলেন তিন ভাইএর ভিতর খুব বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন | আসামে চাকুরি শুরু করেই গিরীজাভূষণ শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ী করার কথা ভাবতে থাকেন | তারপর তাঁরই প্রচেষ্টায় শিল্পসমিতি পাড়ায় বাড়ী তৈরী হয় | খুবই অল্প বয়সে, বিয়ের এক বছরের মাথাতেই গর্ভবতী পত্নীকে রেখে উনি পরলোক গমন করেন | সন্তানের মুখ দর্শনও করতে পারেন নি তিনি | গিরীজাভূষণ হঠাৎ চলে যাওয়াতে মধুসূদন প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন | ভাইয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি বাড়ীতে একটা লাইব্রেরী তৈরী করেছিলেন | ভাইয়ের নামে ‘গিরীজা পাঠাগার’ |
৪০ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন সুপ্রীতি দেবীর সঙ্গে |
সম্ভবত এই সময় তাঁদের শিল্পসমিতি পাড়ার বাড়ীর পেছন দিকে তিনি তৈরী করেন একটি চিড়িয়াখানা | করলা নদীর পার থেকে প্রাচীর গেঁথে ওঠান হয়েছিল | চিড়িয়াখানায় অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে ছিল প্রচুর ক্যানারিজ পাখী, ৯টা ময়ুর-ময়ুরী আর দুটো প্রকান্ড ময়াল সাপ, উত্তরবঙ্গে যা বিখ্যাত |
এই সময়েই তিনি কিনে নেন, গড়াল বাড়ীর ৩০০ বিঘা জমি, যেখানে আজ লক্ষ্মীর ধাম অবস্থিত |
পঞ্চাশের দশকে, তিনি জলপাইগুড়ির একটি চাবাগানের কোষাধ্যক্যের চাকরি করার সময়ে, তাঁরে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়। জনসমক্ষে আসল অপরাধির সম্মান রক্ষার্থে তিনি টাকা তছরূপকারীর নাম গোপন করেন এবং অভিযোগের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দেন। এই টাকা যোগাড় করতে তাঁর শহরের বাড়ী, মোটর গাড়ী এবং অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রী করতে হয়। এর পর থেকে তিনি জলপাইগুড়ির উপকণ্ঠে পাণ্ডাপাড়া কালীবাড়ী গ্রামে এসে, তাঁরই এক সময়ের বাগানবাড়ীতে এসে বসবাস শুরু করেন।
১৯৩৫ সাল নাগাদ, মধুসূদনের গড়ালবাড়ীর জোতের দেবারু নামের এক মুসলমান প্রজা তাঁকে বলেন যে তিনি নাকি ওই এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর ধারে হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর মতো কাউকে ঘুরতে দেখেছিলেন, যাঁর সঙ্গে আরো দুজন মেয়ে ছিল ! একথা শোনার পরই মধুবাবু সেই গড়াল বাড়ীতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা করার মনস্থীর করেন। তখন থেকেই সেখানে প্রতিবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সময় একটি মেলারও পরিচালনা শুরু করেন। এই মেলা আজও চলে আসছে এবং এলাকার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই এই পূজো ও মেলার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করেন। ভারতে বছর বছর ঘটা করে দাঙ্গা, দেশভাগ, মন্দির ও মসজিদ ধ্বংস, কোনো কিছুই এই মেলাকে প্রভাবিত করতে পারে নি!
মধুবাবু ১৯৬৪ সালে পরলোক গমন করেন। তিনি রেখে যান এক পুত্র, সাত কন্যা, অসংখ্য উপকৃত শুভানুধ্যায়ী মানুষ এবং খণ্ডিত ভারতের বুকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর স্মৃতিতে গড়ালবাড়ীর মেলার মাঠের অঞ্চলটিকে আজ “মধুবাবুর ধাম” নামেই সবাই একডাকে চেনে।
বিংশ শতকের ষাঠের দশকে এই মধুবাবুর ধামের অনতিদূরে, নকশালবাড়ীতে শুরু হয় চারু মজুমদার ও কানু সান্যালদের নেতৃত্বে, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়া (মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী) দলের কৃষক আন্দোলন, যা কিছুকালের মধ্যেই ভারতের রাজনীতির বিবর্তনের পথে তার দাগ রাখতে সক্ষম হয় এবং জোতদার ও জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয় এক দীর্ঘ সংগ্রাম।
কিন্তু তা সত্বেও মধুবাবুর ধামে কেউ থাবা বসাতে পারে নি। এমন কি এই জমির বর্তমান মালিকানা যারই থাকুক, মেলা মেলার মতই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কি এমন গুণ ছিল এই জোতদার মধুসূদন দাশগুপ্তর মধ্যে যে, নকশালবাড়ী থেকে ঢিল-ছোঁড়া-দূরত্বে তাঁর জমিদারীতে বসবাসকারী মানুষ আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়ে থাকেন?
আমাদের অনুরোধে মধুবাবুর জীবন এবং তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর কন্যা দীপালী সেনগুপ্ত, পান্না গুপ্তা, পর্ণা দাশগুপ্ত প্রমুখ।
আমরা মিলনসাগরের, এইভাবে মানুষটিকে আজ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে পেরে আনন্দিত। আমরা জানি যে বহু মানুষ মধুবাবুকে চিনতেন বা তাঁর দ্বারা কোনো না কোনো সময়ে উপকৃত হয়েছিলেন। তাই আমরা সবার কাছে অনুরোধ করছি যাতে তাঁরা যদি কিছু লিখে পাঠান বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন আমাদের নিচের ই-মেলে।
আমরা আরো বহুলোকের সাক্ষাত্কার নিয়ে এখানে ধীরে ধীরে প্রকাশিত করার পরিকল্পনা নিয়েছি। মধুবাবুর মতন মানুষ পৃথিবীতে রোজ রোজ জন্মান না।