প্রতিবাদী কবিতার দেয়ালিকা
|
|
|
এই পাতাটি পাশাপাশি, ডাইনে-বামে ও কবিতাগুলি উপর-নীচ স্ক্রল করে! This page scrolls sideways < Left - Right >. Poems scroll ^ Up - Down v.
|
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ওঠো নারি, বিশ্বরমা, অন্ধ-সিন্ধুতল তেয়াগিয়া
. কল্যানীর বেশে,
নয়নে অমৃত-উত্স, কক্ষে সুধাভাণ্ড ভরি নিয়া
. এসো স্নিগ্ধ হেসে।
আজি যে নিখিল-নর তপ্ত-মরু জ্বালা বহি প্রাণে,
আকণ্ঠ পিপাসা লয়ে সকাতরে তোমারে আহ্বানে,
হে কল্যাণী, প্রাণ-পাত্র ভরো ভরো প্রেম-সুধা দানে
. তৃপ্ত করো তৃষা,---
জীবনে নির্মল উষা ফুটুক তোমার দিব্যগানে
. টুটি অন্ধ-নিশা।
এসো সুকল্যাণী রূপে সমুজ্জ্বল সিন্দুরের টীকা
. আঁকি নম্র-ভালে,
অন্ধকার গৃহপ্রান্তে জ্বালাও মঙ্গলদীপ-শিখা
. নিত্য সন্ধ্যাকালে।
ঘন স্নেহে আমন্থর স্নিগ্ধ তব হৃদয়-সমীর
জুড়াইয়া দিক্ আজি নিখিলের দাহতপ্ত-শির ;
. নরের ক্রন্দন
নিমেষে হউক স্তব্ধ। তব চিত্ত অমরাবতীর
. লভি’ নিমত্রণ।
জাগো জাগো হে সাবিত্রি, বাঁচাও স্বল্পায়ু স্বামী তব,
. সমাগত যম!
উদ্বোধন কবি রাধারাণী দেবী (৩০.১১.১৯০৩ - ৯.৯.১৯৮৯)। কবির ১৯৩৭ সালে
প্রকাশিত, “বনবিহগী” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
নয়নে নামিছে তার মরণের আঁধার নীরব
. স্তিমিত নির্মম!
প্রদীপ্ত-সতীত্বতেজে ওগো দৃপ্তা! মৃত্যুরে জিনিয়া
শমনের পাশ হতে আনো আনো প্রিয়রে ছিনিয়া,
হে নারি সবিতৃকন্যা! জোগো ওঠো আপনা চিনিয়া
. বিশ্বে সব খানে।
সঞ্জীবিত করো দেবি অটুট অন্তর-শক্তি নিয়া
. মৃত-সত্যবানে।
স্বেচ্ছায় ভিক্ষু কণ্ঠে রাজপুত্রী বরমাল্য দিবে
. ত্যজি রত্ন-হেমে,---
হে দক্ষদুহিতা, আজি সন্যাসী শ্মশানচারী শিবে
. লহ বরি’ প্রেমে।
সকল গঞ্জনা গ্লানি তুচ্ছ করি বাধাবিঘ্ন শত
নির্বাচিয়া লহ পতি, হে অপর্ণা! নিজ মনোমত ;
. তেজস্বিনি অয়ি!
দশ-মহাবিদ্যা রূপে মহেশে চরণে করো নত,
. দৃপ্ত-শক্তিময়ি!
সত্য শিব সুন্দরের অপমান ঘটে বিশ্বে আজ
. ---এসো এসো সতি!
ত্রিনেত্রে প্রদীপ্ত-বহ্নি, হস্তে শূল, ভৈরবী সাজ---
. এসো ভগবতি!
অশিবের অন্যায়ের অসত্যের প্রতিবাদ তরে
জীবন উত্সর্গি দাও শিবহীন-যজ্ঞ পণ্ড করে’
আত্মভোলা আশুতোষ যেন মহারুদ্র রূপ ধরে
. মথি মিথ্যা-যাগ,---
অভিজাত-দম্ভ দমি’ আহরে স্বকরে
. যজ্ঞ প্রাপ্যভাগ।
হস্তিনার সভাতলে পৃষ্ঠে লয়ে মুক্ত-মেঘবেণী---
. সরোষ নিঃশ্বাসে
ভীষণ প্রতিজ্ঞা পুনঃ নির্ঘোষি উচ্চার’ যাজ্ঞসেনি,
. জ্বলন্ত-বিশ্বাসে।
নারীত্বের অপমান ঘটাল যে-নীচ দুরাচার
তার তপ্ত রক্তরাগে বিরচিবে বেণী পুনর্বার,
. পশুরে সংহারি
কুরুক্লিষ্ট আর্যাবর্তে আন গর্ব বীর-দয়িতার,
. হে পাণ্ডব নারি!
নিখিল-নরের চিত্তে অপূর্ণতা যাহা কিছু আছে---
. ক্ষোভ মনে মনে ;
হে নারি, তোমারি দ্বারে পূর্ণতার তৃপ্তি তারা যাচে
. বিশ্ব-আবর্তনে।
শুধু কন্যা মাতা ভগ্নী শিষ্যা দাসী সখী তুমি নহ,
আরো কিছু---আরো কিছু---ধ্বনি ওঠে বিশ্বে তৃষাবহ,
আপন স্বরূপে জাগি নিখিলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রহ
. সঞ্চারিয়া প্রাণ ;
আনন্দ জীবন রস দীপ্তি তৃপ্তি বিশ্বে বহি লহ
. প্রকৃতির দান।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
কালের পরিবর্তনে ও যুগের গতিতে মাস্টারদার বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী সমৃদ্ধি-
শালী হয়েছে। যাঁরা স্বাধীনতা-সংগ্রামে আমাদের পথপ্রদর্শক, যাঁদের আদর্শ
নিয়ে মাস্টারদা ও আমরা আগামী দিনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছিলাম
তাঁদের প্রতি কোন প্রকার কটাক্ষ না করে বা কোনরূপ অশ্রদ্ধার মনোভাব
না রেখে অতীতযুগের কথা আমাদের ভাবতে হবে। গৌরবোজ্জ্বল চিত্র-
শোভিত অতীত জীবন-কাহিনীর মূল্যায়ন করতে যেমন আমরা কোনরূপ
দ্বিধা বা সঙ্কোচ বোধ করবো না, ঠিক তেমনিই জীবনের বৈপ্লবিক দুর্বলতা
বা বিচ্যুতির পাতাগুলি সযত্নে অন্ধকারে ঢেকে রেখে ভবিষ্যতের সার্বিক মূল
শিক্ষা হতে বঞ্চিত হওয়ার বা বঞ্চিত করবার চেষ্টাও না করাই ঐতিহাসিক
দায়িত্ব।
জালালাবাদ যুদ্ধক্ষেত্র হতে ফিরে এসে আমরা কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে
পড়েছি স্কুল-কলেজের পড়াশুনা নিয়ে, কেউ-বা সংসার নিয়ে, কেউ-বা
নিরাপত্তার জন্য উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়েছি---পুলিশের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে
---বর্মাদেশের সুদূর প্রান্তরে---লোকালয়-বিহীন গ্রামাঞ্চলে।
তরুণ সাথীদের বৈপ্লবিক চরিত্রের দ্রুত পরিবর্তনে মাস্টারদার মন
আলোড়িত হয়ে উঠলো। অতীত ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তাঁর মনে প্রশ্ন জাগালো
---বছরের পর বছর দেশ-দেশান্তরে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকা বিপ্লবী
মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট কবি বিপ্লবী অনন্ত সিংহ (১.১২.১৯০৩ - ২৫.১.১৯৭৯)। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায়, সেই
ঘটনার অন্যতম নায়ক বিপ্লবী অনন্ত সিংহের আন্দামানের সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরে সাজা হয়। জেলে থাকাকালীন তিনি মার্ক্সবাদী দর্শনে আকৃষ্ট হন। ছাড়া
পাবার পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তাঁর “মহানায়ক সূর্য সেন ও চট্টগ্রাম বিপ্লব” গ্রন্থের ৯২-পৃষ্ঠা থেকে মাস্টারদা সূর্য্য সেনের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট
নিয়ে লেখা থেকে একটি অংশ, কবি অনন্ত সিংহের একটি কবিতা হিসেবে এখানে তুলে ধন্য হলাম। সর্বোপরি এই পাতার ব্যাকগ্রাউণ্ড চিত্রটিতে যে
অলিন্দের ছবি দেখা যাচ্ছে, অনন্ত সিংহ সেই অলিন্দ-সংলগ্ন কোনো কালকুঠরীতে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এসেছিলেন, যাতে আমরা স্বাধীন
দেশে জন্মগ্রহণ করতে পারি। তাই তাঁদের মতো মানুষের কলমের ছোঁয়া আমাদের কাছে কবিতাই!
নায়কদের কি একান্তই প্রয়োজন ছিল? সেই যুগে “বিপ্লব” পরিচালনার
জন্য মাতৃভূমি ছেড়ে কারো রুশদেশে, কারো জাপানে, কারো-বা মার্কিন
দেশে চলে যাওয়া কি নেতৃবৃন্দের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল?
মহানায়ক সূর্য সেন নতুন ও পুরাতনের বৈপ্লবিক চরিত্রের অভিজ্ঞতার
সমন্বয়ে আপোষহীন রক্তাক্ত সংগ্রামের নির্ভীক সেনাপতি। তিনি জানতেন
তার “আদেশ”, “সমর্থন” ও “পরিচালনায়” রাজনৈতিক হত্যা আক্রমণাত্মক
প্রতিটি কার্যকলাপের জন্য সরকারের নিকট তাঁর অপরাধের মাত্রা ক্রমেই
বেড়ে চলেছে---এবং ইংরেজ-কর্তৃপক্ষ ক্রমবর্ধমান হারে তাঁর মস্তকের মূল্য
ধার্য করেছেন। তবু সূর্য সেন দৈন্য বেষ্টিত চট্টলভূমিতে থাকাই শ্রেয় মনে
করলেন। মৃত্যুভয় তাঁকে ভীত করতে পারলো না। নিজের বৈপ্লবিক
হেড-কোয়ারটার পরিত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়ার যৌক্তিকতাও তিনি খুঁজে
পেলেন না। তিনি বুঝেছিলেন বিদেশে গিয়ে বা ভারতের দূরে প্রদেশে
আত্মগোপন করে ভারতীয় গণতন্ত্র বাহিনীর চট্টগ্রাম শাখার নেতৃতের
দায়িত্বভার বহন করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের বৈপ্লবিক দায়িত্ব বহনকারী
সুযোগ্য অধিনায়কের স্থান সৈনিকদের পাশেই। দূর দেশে থাকা বা
হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করে সৈন্যদল পরিচালনা করার অবাস্তব পরিকল্পনায়
সৈন্যদের মনোবল নষ্ট করার দায়িত্ব বহুলাংশে নেতার উপরেই অর্শায়।
এই অভিজ্ঞানের মধ্যেই সূর্য সেনের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
. এই শুধু বলিবারে চাই
সকলের মূল্য আছে মানুষের মূল্য কিছু নাই।
কোন ঋষি খেয়ালের বশে, কবে হায়, গেয়েছিলে গান---
. “অমৃত-স্বরূপ মোরা অমৃত-সন্তান?”
হায় কবি, নিদ্রাহীন চির-নিশি দেখেচ স্বপন---
. তমসার পরপারে করুণ তপন!
ভাবো মনে কেটে গেছে চার-রাত্রি, কিম্বা কেটে যাবে ;---
যুগ যুগ চলে যায়, নব কবি গায় নব ভাবে
. সেই পুরাতন কথা। . . .
রাত্রি নাহি শেষ হয়---না দেখায় ব্যাগ্রতা!
. আমি আজ বলিবারে চাই
শূন্যসম মূল্যহীন এরা---মানুষের আর দাম নাই।
. তাই তার এত হেলাফেলা
মানুষ-জীবন নিয়ে চিরদিন ছিনিমিনি খেলা!
. জীর্ণপত্রে পুঁথির বিধান---
তারো মূল্য আছে, আছে তাহারো সম্মান!
কীট-দষ্ট দলিত পুঁথির আছে দম্ভ, আছে অধিকার,
কোটি কোটি মানুষের জীবনে ব্যর্থতা রচিবার!
যুগজীর্ণ কঙ্কালের নির্দ্দেশের ফেরে
মানুষের প্রেম রদ্ধ, গতি রুদ্ধ---
. মানুষ না ছোঁয় মানুষেরে!
মানুষের মূল্য কবি শিবরাম চক্রবর্তী (১৩.১২.১৯০৩ - ২৮.৮.১৯৮০)। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত, কবির
“মানুষ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।
সনাতন শাস্ত্রের আদেশ---
আলোকের আনন্দের দেশে রমণীর চির-অপ্রবেশ!
ভূবনের রূপে রসে প্রেমে যৌবনেস্বতন্ত্রে নাই দাবী,
জীবনে কেবল তার এক কারাগার হ’তে
. অন্য কারাঘরে পড়ে চাবি!
সেই জীর্ণ পত্র মাঝে জীর্ণতর ছত্র নিয়ে চলে খুনোখুনি ;
মানুষের জীবনের নব নব কুরুক্ষেত্র
. রচে নিত্য নব কৃষ্ণ নূতন ফাল্গুনী!
মানুষের জেদের নিকটে মানুষের জীবনের দাম
লেখে নিত্য অস্ত্রমুখে নব নব ডায়ার ও শ্রীপরশুরাম!
. নির্ব্বিচারে শিশুবৃদ্ধ করিয়া সংহার
দেশে দেশে পূজ্য হয় তারা, খ্যাত হয় নব অবতার!
. রাষ্ট্র-ধর্ম্ম-শাস্ত্র-গুরু-মন্ত্র-তন্ত্রে দিয়া সিংহাসন
. ষড়-যন্ত্রে চলিতেছে মানুষের শোষণ-শাসন!
. আমি আজ চাহি তার নাম---
কোন্ যুগে মানুষের জীবনের কেবা দিল দাম ?
. কে বলিল উচ্চকণ্ঠে ডাকি,
জীবন কেবল সত্য,---শাস্ত্র রাষ্ট্র সব-কিছু ফাঁকি ?
জীবন ভরিতে হবে আলোকে পুলকে প্রেমে প্রাণে
জীবন-বিরুদ্ধ যাহা মিথ্যা তাহা, নাই তার মানে ;
শত শত শাস্ত্র চেয়ে একটি জীবন মূল্যবান---
রাষ্ট্র লাগি নয় কেহ, মানুষের লাগি তার স্থান
সৌন্দর্য্যেরে, সম্পদেরে, রমণীরে করি’ অবরোধ
জীবন জীবন নহে---শুধু প্রকৃতির প্রতিশোধ!
. কোন বুদ্ধ কহিল শুধাই?---
রিক্ত করি’ ব্যর্থ করি’ নহে---পূর্ণ করি’ জীবনেরে চাই?
. যুগে যুগে নব নব ধর্ম্ম-অধিকারী
মানুষেরে করিল কসাই---কিম্বা তারে করিল ভিখারী!
. ক্ষুদ্র শিল নোড়ানুড়ি মাটির পুতুল
মানুষ তাহারো কাছে তুচ্ছ, নহে সে তাহারো সমতুল!
. জীর্ণ ইঁট-কাঠে-গড়া মসজিদ্ মন্দির---
ঝরিলো তাহারো লাগি, বহু রক্ত, বহু অশ্রুনীর!
ওই বুঝি ধর্ম্ম গেলো---মানুষের চোখে নাই নিদ্,
দেখেনা সে ধর্ম্ম তার জীবনের ভীতে কাটে সিঁদ!
মানুষে মানুষ মারি’ ধর্ম্ম রাখে, হয় ধর্ম্মবীর ;---
ধর্ম্ম ঠেলে মরণের পথে নির্ব্বোধ দুর্ভাগাদের ভিড়।
ধর্ম্ম ? হায়, নগ্ন চোখ মেলি’ দেখ তার ভয়াবহ রূপ---
জীবনের রক্ত মাংসে সে যে---মরণের কঙ্কালের স্তূপ!
তার লাগি আত্মদান! নরহত্যা! ব্যর্থতা-বরণ!---
জীবনের সৃষ্টি আজ জীবনের কাছে আবরণ!
. তুচ্ছ মিথ্যা ভাবের ফানুস---
মানুষ সৃজেছে ধর্ম্ম, ধর্ম্ম কভু সৃজেনি মানুষ।
কিন্তু হায় তারো মূল্য আছে---প্রাণ দিয়ে শোধ করা চাই,
. মানুষের কোনো মূল্য নাই!
মানুষের-গড়া মিথ্যা ভৌগলিক সীমা
তাহারো মর্যাদা আছে, রয়েছে মহিমা!
তারো লাগি সৈন্যদল পুষ্ট হয় বন্য বৃত্তি তরে,
. লাঙ্গলের ফাল ভাঙি’ তরবারি গড়ে।
একদল মানুষেরে সর্বভাবে করিয়া বঞ্চিত
জীবন্ত অস্ত্রের মত কেল্লাঘরে রাখে সুসজ্জিত,
. চিরবন্দী হিংস্র পশুদল---
মানুষেরে মারিবার তরে তাহাদের জীবন কেবল।
. দেশের সম্পদ যত, সৃষ্টি যত, যত কিছু ধন
. সব নিয়ে চলে শুধু মানুষ-মারার আয়োজন!
মানুষেরে মারিবার তরে মানুষ যোগায় রাজকর,
. মানুষে খাটায় মাথা,
রচে বসি’ হিংসা-শাস্ত্র, ঘাতকের বীরত্বের গাথা---
. নব নব অস্ত্র গড়ি’ বিজ্ঞানের বলে
. মানুষেরে বানায় বর্ব্বর।
পৃথিবীরে ভাগ-যোগ করি’ মানুষ রচিল নানা দেশ,
. হেথা হ’তে হোথা যদি যাবে
. কেন নাহি যায় বন্ধুভাবে---
কেন পরে ভাতৃরক্ত-মাখা দেশজয়ী জল্লাদের বেশ?
পায়ের মাটিরে দিলো কিনা মানুষ মাথারো বড় ঠাঁই,
মাটিরো রয়েছে কিছু দাম, মানুষের কোনো দাম নাই।
. কখনো শুনেচ কারো মুখে---
বাঘেরে খেয়েছে বাঘ, ভালুক ভালুকে ?
মানুষে মানুষ খায়, খেয়ে বেঁচে থাকে প্রতিদিন---
রক্ত খায়, মাংস খায়, মেদমজ্জা খেয়ে করে ক্ষীণ,
খায় মন-আত্মা, খায় জীবনের অর্দ্ধের নিশ্বাস---
অবশেষ-জীবন্ত-কঙ্কাল ফেলে দেয়, করো কি বিশ্বাস?
যাও---যেথা যেথা কল-কারখানা, যাও গ্রামে গ্রামে,
স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ কর মনুষ্যত্ব চড়েছে নিলামে।
. মনুষের জীবনের হেলাভরে খেলা
. যেথায় চলেছে দুই বেলা।
খনি ভেঙে কুলি বহে শিরে করি’ কয়লার চাপ---
তারি সাথে বহে যেন দুনিয়ার তিক্ত অভিশাপ।
. জঙ্গল কাটিয়া তারা বসায় সহর
তার রক্তে বহে সেথা বিলাসের বিষম বহর।
সে সহরে বিলাসীর লাগি রমণীরা রূপ দেয় ডালি,
নারীর নারীত্ব পায়ে দলি’ পুরুষেরা দেয় করতালি।
অমৃতের মৃতপ্রায় পুত্রগণ দাস হ’য়ে নগরীর পথে,
দুর্ব্বহ জীবন-বোঝা টেনে নিয়ে চলে কোনো মতে।
ফুল্ল ফুল ঝরি’ নিত্য চুমে নগরীর পথ-শিলা,
নিত্য যেথা অত্যাচার অনাচার মদিরার লীলা ;
. রমণীর রূপ রস জীবন যৌবন
বিপণির পথ সেথা ক্ষণিকের তুচ্ছ প্রয়োজন!
আর যারা গড়িল সহর সর্ব্বহারা বঞ্চিতের দল
কোথা তারা, সে সহরে কোথায় তাদের ঠাঁই বল্?
পথ-পাশে---যেই পথ নিজ হস্তে করিল নির্ম্মাণ,
প্রাসাদের নীচে---গড়িল যা বিন্দু বিন্দু রক্ত করি’ দান,
সেথা ঐ দীনহীন মুষ্টি-অন্নে করে মারামারি
কুক্কুরের জ্ঞাতি আজ---ওই তারা পথের ভিখারী।
সহস্রের রক্ত শুষি’ একজন পুষ্ট করে দেহ,
ধনীর প্রাসাদ ওঠে ভাঙি’ লক্ষ দরিদ্রের গেহ।
দৈন্য-দীর্ণ কক্ষ-মাঝে প্রাণ জীর্ণ মানুষের দল
জীবন্ত-কবরে করে জীবনের লাগি কোলাহল!---
তুমি বলো, ইহাদের তবে আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
অন্ন চাই, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু---
ইহাদের বুকে আশা, মূক মুখে ভাষা দেওয়া চাই।
আমি বলি, ইহাদের জীবনের কোনো মূল্য নাই!
. মানুষের মানুষ শিকারী---
নারীরে করেছে বেশ্যা, পুরুষেরে করেছে ভিখারী।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
তেলের শিশি ভাঙল বলে
. খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
. ভারত ভেঙে ভাগ করো !
. তার বেলা?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
. জমিজমা ঘরবাড়ী
পাটের আড়ত্ ধানের গোলা
. করখানা আর রেলগাড়ী !
. তার বেলা?
চায়ের বাগান কয়লাখনি
. কলেজ থানা আপিস-ঘর
চেয়ার টেবিল দেয়ালঘড়ি
. পিয়ন পুলিশ প্রোফেসর !
. তার বেলা?
খুকু ও খোকা
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
সুর - সলিল চৌধুরী, শিল্পী - বাণী ঘোষাল। রচনা ১৯৪৭। ১৯৫৪ সালে রেকর্ড করা গানটি শিশুদের সবচেয়ে
বিখ্যাত ছড়ার অন্যতম। কিন্তু এত সহজ বাংলায় এর চেয়ে প্রতিবাদী লেখা খুবই কমই আছে! ভিডিওটি
সৌজন্যে Gaaner Dali YouTube Channel.
যুদ্ধ জাহাজ জঙ্গী মোটর
. কামান বিমান অশ্ব উট
ভাগাভগির ভাঙাভাঙির
. চলছে যেন হরির-লুট !
. তার বেলা ?
তেলের শিশি ভাঙল বলে
. খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
. বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !
. তার বেলা?
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ভুল হয়ে গেছে
বিলকুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো
নজরুল।
এই ভুলটুকু
বেঁচে থাক
বাঙালী বলতে
একজন আছে
দুর্গতি তার
ঘুচে যাক।
নজরুল
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ঘোষ বোস মিত্তির
চট্টো ও বন্দ্যো
শ্রেণীতে শ্রেণীতে এঁরা
বাধালেন দ্বন্দ্ব।
শ্রেণীশক্র কারা?
কী মহান সত্য!
মুখো আর গঙ্গো
দে আর দত্ত।
পিসিরা বিধবা হন
মাসিরা নির্বংশ
সোনার যাদুরা করে।
যদুকুলধ্বংস।
শ্রেণীযুদ্ধ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
শুনহ ভোটার ভাই,
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
তোমার ভাগ্যে নিত্য ভোগ্য
মৎস মাংস খাজা।
শুনবে আমার নাম?
আমি টুইডেলডাম।
শুনহ ভোটার ভাই,
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
সাত খুন আমি মাপ করে দেব
তোমার হবে না সাজা।
নামটি আমার কী?
আমি টুইডেলডী !
শুনহ ভোটার ভাই
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৭৯। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন
থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
সংসদীয় গণতন্ত্র
যেদিন হবে ধ্বংস
দেখবি সেদিন ধনতন্ত্র
হবেই নির্বংশ।
গণতন্ত্র খতম হলে
দারিদ্র্যও দূর রে
থাকবি সবাই দুধে ভাতে
হিপ হিপ হুররে !
আয় রে তবে ধ্বংস করি
গণতন্ত্র আগে
কাজ কী ভেবে রাজক্ষমতা
পড়বে যে কার ভাগে!
সেই লোকটা স্টালিন কি
সেই লোকটা হিটলার
হয়তো সে এক সেনাপতি
জঙ্গী জোয়ান বিটলার।
সবাই ভালো, খারাপ শুধু
গণতস্ত্রীগুলোই
মেরে তাড়াই ধরে তাড়াই
যাক্ না ওরা চুলোয়।
ওরাই যদি ঘুরে দাঁড়ায়
ওরাই যদি বাঁধে
আমরা তখন দেশ মাতাব
বিষম প্রতিবাদে।
গণতন্ত্রনিপাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)। রচনা ১৯৭৯।
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া।
গণতন্ত্র বিরোধী হঠকারী শক্তির বিরুদ্ধে লেখা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বাইরে কোঁচার পত্তন
ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন।
রাম রাম হরে হরে !
বাইরে ধলা টুপি
ভিতরে কালা রুপী।
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে ভিআই পি
ভিতরে খোলা ছিপি
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে হিল্লী দিল্লী
ভিতরে গ্রাম্য বিল্লী।
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে ও ভিতরে
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৭৫। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়”
সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ইস্কাবনের বিবি রে,
জরুরি তাঁর কেল্লা
বাইরে যে তার বাহার কত
কত রঙের জেল্লা রে, কত রূপের জেল্লা !
---আহা, বেশ বেশ বেশ!
দুষ্টজনের জীবনে তা
সর্বনাশের কেল্লা
শিষ্টজনের জীবনেও
দারুণ ত্রাসের কেল্লা রে, দীর্ঘশ্বাসের কেল্লা !
---আহা বেশ বেশ বেশ!
বিশ্বাসীরা বলে, ও যে
দুর্গাবতীর দুর্গ
আর কিছুদিন সবুর করো
হবে স্বর্গপুর গো, ভূ-ভারতের স্বর্গ !
---আহা, বেশ বেশ বেশ!
জরুরি জারি গান
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)। রচনা ১৯৭৭। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-
সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া। জরুরি অবস্থার পরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পতনের প্রেক্ষিতে
লেখা।
সংশয়ীরা বলে, হবে
দ্বিতীয় ক্রেমলিন
নির্বিচারে বন্দীরা যার
অন্তরালে লীন হে, অন্তরে বিলীন
---নাকি বেশ বেশ বেশ!
ভাগ্যে হঠাৎ পড়ল ধসে
মহৎ ত্রাসের কেল্লা
নয় পাষাণের নয়কো লোহার
ফাঁপা তাসের কেল্লা রে ফাঁকা তাসের কেল্লা !
---হা হা বেশ বেশ বেশ!
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
শেষটা আমি ঠিক করেছি
দেশটা করে বিক্রী
গণ্ডা কয়েক গড়িয়ে দেব
ফতেপুর সিক্রী ।
আয় রে বাঙাল, আয় রে
আয় রে কাঙাল, আয় রে
দেনার দায়ে জন্মভূমি
হলো তোদের ডিক্রী
নাকের বদলে নরুণ পেলি
ফতেপুর সিক্রী।
ফতেপুর সিক্রী
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প
থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
সাম্রাজ্য রামরাজ্য
দেখলি একে একে
বাকী থাকে বামরাজ্য
হয়তো যাবি দেখে।
ত্রিকালদর্শী
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৫২। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-
সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া। সফল ভবিষ্যৎ বাণী!
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আমরা চুনোপুঁটি
হেতের বলতে দুটি
কলম আর গলা।
হেতের হলে ভোঁতা
পাত্তা পাব কোথা?
বৃথাই কথা বলা।
হেতেরে দাও শান্
কোরো না খান্ খান্
তীক্ষ্ণ হোক ফলা।
কে জানে সে কবে
তোমারও দিন হবে
ধন্য হবে বলা।
চুনোপুঁটি
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়”
সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বলছি, সখি, শোন লো তুই
শ্যাম আর কুল রাখব দুই।
বিপ্লবই আমার প্রিয়
সকলরূপে বরণীয়
কিন্তু আমার আলম্বন
বিধানসভার নির্বাচন।
নির্বাচনের ফাঁকে ফাঁকে
শ্যামের বাঁশি আমায় ডাকে
গদী করি বিসর্জন
আসন করি বিবর্জন।
কী হবে ছাই বিধানসভায়
মন্ত্রী হতে কেই বা লাফায়!
দিক ভেঙে ওই সভা মন্দ
নয়তো আমি ডাকব বন্ধ।
আমার দাবী নির্বাচন
নইলে হবে বিপ্লাবন।
শ্যামকুলিজম
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়”
সংকলন থেকে নেওয়া। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যাবল্থার মধ্যে বামপন্থী
দলগুলির অবস্থা নিয়ে লেখা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
কেন এমন ভাগ্যি হলো
সরষের তেল মাগ্গি হলো
কেউ জানে না মাখনের কী খবর
সরষের তেল নাকে দিয়ে
রাজা ঘুমোন নাক ডাকিয়ে
মাখন মাখায় পায়ের তলায় নফর।
টুইডেলডাম রাজা, তোমায়
ছি ছি ছি।
এখন থেকে রাজা হবেন
টুইডেলডী।
কেন এমন ভাগ্যি হলো
শাক সবজি মাগগি হলো
কেউ দেখেনি মাছের এত দর।
সব চলে যায় রাজার পাতে
কেন এমন ভাগ্যি
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৭৭। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র
অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া।
এঁটো কুড়োয় হাড় হাভাতে
কেউ জানে না কী আছে এর পর।
টুইডেলভী রাজা, আরে
রাম রাম রাম !
এখন আবার রাজা হবেন
টুইডেলডাম !
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এক গালে তোর চুণ, ও ভাই
আরেক গালে কালি
এমন করে কে সাজালো!
ডান গালী বাঁ গালী
ডান গালী বাঁ গালী ওরে
ডাঙ্গালী বাঙ্গালী
এমন করে কে বানালো
ভিক্ষার কাঙ্গালী।
কে মেরেছে কে ধরেছে
কে দিয়েছে গালি।
ভায়ে ভায়ে ঝগড়া করে
সংসার হাসালি।
বঙ্গদর্শন
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৫০। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-
সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া। দেশ ভাগ নিয়ে লেখা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ধন্য হে দেশ! ধন্য তোমার গুণ!
সাধুরে করেছ খুন।
এবার তা হলে অসাধুরে নিয়ে থাকো
চোরা কারবারে পাকো।
মৌর্য যুগের চক্র তোমার, ধ্বজায়
মর্যাদা রাখে বজায়
ধনে জনে বাড়ে চৌর্য বংশ
বংশে ধরেছে ঘুণ।
ধন্য হে দেশ! ধন্য তোমার গুণ
নুন খেয়ে করো খুন।
দাসত্ব হতে মুক্তি যে দিল তার
এই তো পুরস্কার !
হিংসার মদে মশগুল হয়ে আছো
ধর্মের নামে নাচো
লজ্জা তো নেই, এক গালে কালি
এক গাল মাখো চুণ !
মা নিষাদ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৪৮। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-
সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া। জাতির পিতার হত্যার
প্রেক্ষিতে রচিত।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
অবাক হতো বিশ্ব যাদের
মেল্ দেখে
হদ্দ হলো নিত্য নতুন
খেল্ দেখে।
মাকে নিয়ে ভাগাভাগি
মড়ার মতন রে
শেয়াল শকুন করে থাকে---
সে কী পতন রে!
সে যদি বা সত্য হলো
এ কী আজব খেল্ !
ভা'য়ের বুকে হানলি সুখে
দারণ শক্তিশেল !
জানলি না যে বাজল সে বাণ
কার বুকে!
দুই জনারি অভাগিনী
মা'র বুকে !
বুক থেকে মা'র রক্ত ঝরে,
স্তন্য কই?
দিকে দিকে শোর উঠেছে,
অন্ন কই?
ঘুঘু-চরানি ছড়া
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
রচনা ১৯৫০। ১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-
সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়” সংকলন থেকে নেওয়া। দেশভাগ নিয়ে লেখা।
ভাইকে মারে, মাকে কাঁদায়,
তারে বাঁচায় কে !
ভিটাতে যার ঘুঘু চরে
তারে নাচায় কে !
অবাক হতো বিশ্ব যাদের
মেল্ দেখে
হদ্দ হলো নিত্য নতুন
খেল্ দেখে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
খবরটা শুনে আমি মুগ্ধ
গণেশজী খেয়েছেন দুগ্ধ।
বিমোহিত হব শুনি যদি
ইঁদুরনী খেয়েছেন দধি।
অবাক দুগ্ধপান
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
ছড়াটি আমরা পেয়েছি বাঙালনামা ওয়েবসাইটের অরণ্য লাহিড়ীর
অন্নদাশঙ্করের ছড়া : জব্দিবে কে শব্দীকে? প্রবন্ধ থেকে . . .।
১৯৯৫ সালের গণেশের দুধ খাওয়ার খবর নিয়ে রচিত।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বাধলে গৃহযুদ্ধ
চক্ষু করি রুদ্ধ।
আমি যেন বুদ্ধ।
বাধলে গৃহযুদ্ধ
কর্ণ করি রুদ্ধ।
আমি যেন শুদ্ধ।
বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় (১৫.৩.১৯০৪ -২৮.১০.২০০২)
১৯৮৫ সালে বাণীশিল্প থেকে প্রকাশিত “ছড়া-সমগ্র অন্নদাশঙ্কর রায়”
সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
নগরের পথে পথে দেখেছ অদ্ভুত এক জীব
ঠিক মানুষের মতো
কিংবা ঠিক নয়,
যেন তার ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রূপ-বিকৃত !
তবু তারা নড়ে চড়ে কথা বলে, আর
জঞ্জালের মত জমে রাস্তায়-রাস্তায়।
উচ্ছিষ্টের আস্তাকূড়ে ব'সে ব'সে ধোঁকে
আর ফ্যান চায়।
রক্ত নয়, মাংস নয়,
নয় কোন পাথরের মতো ঠান্ডা সবুজ কলিজা।
মানুষের সৎ ভাই চায় সুধু ফ্যান;
তবু যেন সভ্যতার ভাঙেনাকো ধ্যান !
একদিন এরা বুঝি চষেছিল মাটি
তারপর ভুলে গেছে পরিপাটি
কত-ধানে হয় কত চাল;
ভুলে গেছে লাঙলের হাল
কাঁধে তুলে নেওয়া যায়।
কোনোদিন নিয়েছিল কেউ,
জানেনাকো আছে এক সমুদ্রের ঢেউ
পাহাড়-টলানো।
ফ্যান
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র (৪.৯.১৯০৪ - ৩.৫.১৯৮৮)। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত কবির “ফেরারী ফৌজ”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
অন্ন ছেঁকে তুলে নিয়ে,
ক্ষুধাশীর্ণ মুখে যেই ঢেলে দিই ফ্যান
মনে হয় সাধি এক পৈশাচিক নিষ্ঠুর কল্যাণ ;
তার চেয়ে রাখি যদি ফেলে,
পচে পচে আপন বিকারে
এই অন্ন হবে না কি মৃত্যুলোভাতুরা
অগ্নি-জ্বালাময় তীব্র সুরা !
রাজপথে এই সব কচি কচি শিশুর কঙ্কাল--মাতৃস্তন্যহীন,
দধীচির হাড় ছিলো এর চেয়ে আরো কি কঠিন?
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
নীলনদীতট থেকে সিন্ধু-উপত্যকা,
সুমের, আক্কাড আর গাঢ়-পীত হোয়ংহোর তীরে,
বার বার নানা শতাব্দীর
আকাশ উঠেছে জ্বলে, ঝলসিতে যাদের উষ্ণীষে,
সেই সব সেনাদের
চিনি, আমি চিনি ;
---সূর্যসেনা তারা
রাত্রির সাম্রাজ্যে আজো
সন্তর্পণে ফিরিছে ফেরারী।
মাঝরাতে একদিন
বিছানায় জেগে উঠে বসে,
সচকিত হয়ে তারা
শুনেছে কোথায় শিঙা বাজে,
সাজো সাজো, ডাকে কোন্ অলক্ষ্য আদেশ।
জনে জনে যুগে যুগে
বার হয়ে এসেছে উঠানে ,
আগামী দিনের সূর্য দেখেছে আঁধারে
গুঁড়ো গুঁড়ো করে সারা আকাশে ছড়ানো।
সহসা জেনেছে তারা,
এই সব সূর্য-কণা তিল তিল করে,
বয়ে নিয়ে যেতে হবে কালের দিগন্তে,
রাত্রির শাসন-ভাঙা
ভয়ংকর চক্রান্তের গুপ্তচর-রূপে।
ফেরারী ফৌজ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র (৪.৯.১৯০৪ - ৩.৫.১৯৮৮)। কবিতা আবৃত্তি - উত্পল দত্ত। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত কবির “ফেরারী ফৌজ” কাব্যগ্রন্থের
কবিতা। ভিডিওটি সৌজন্যে Rajesh Datta YouTube Channel. এই ভিডিওটিতেই উত্পল দত্তর আবৃত্তি রয়েছে পর পর ১) নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উলঙ্গ রাজা, ২)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ফেরারী ফৌজ এবং ৩) নাজিম হিকমতের জেলখানার কবিতা।
এক একটি সূর্য-কণা তুলে নিয়ে বুকে,
দুরাশার তুরঙ্গে সওয়ার
দুর্গম যুগান্ত-মরু পার হবে বলে,
তারা সব হয়েছে বাহির।
সুদূর সীমান্ত হায়
তারপর সরে গেছে প্রতি পায়ে পায়ে ;
গাঢ় কুজ্ঝটিকা এসে
মুছে দিয়ে গেছে সব পথ ;
ভয়ের তুফান-তোলা রাত্রির ভ্রূকুটি
হেনেছে হিংসার বজ্র।
দিগ্বিদিক-ভোলানো আঁধারে
কে কোথায় গিয়েছে হারিয়ে।
রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনো অটুট !
ছড়ানো সূর্যের কণা
জড়ো করে যারা
জ্বালাবে নতুন দিন,
তারা আজো পলাতক,
দলছাড়া ঘুরে ফেরে দেশে আর কালে।
তবু সূর্য-কণা বুঝি হারাবার নয়।
থেকে থেকে জ্বলে ওঠে শাণিত বিদ্যুৎ
কত ম্লান শতাব্দীর প্রহর ধাঁধিয়ে
কোথা কোন্ লুকানো কৃপাণে
ফেরারী সেনার।
এখনো ফেরারী কেন ?
ফেরো সব পলাতক সেনা।
সাত সাগরের তীরে।
ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো।
আনো সব সূর্য-কণা
রাত্রি-মোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে।
---এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারী
ফৌজের।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
মুজিবর রহমান।
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,
জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে ।
বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার।
হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ;
দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,
দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ;
তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি
ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।
মুজিবর রহমান।
তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান।
পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,
বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি।
দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল,
জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।
শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,
মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে।
মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,
তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।
জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,
তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।
বঙ্গ-বন্ধু কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত, কবির “ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা। রচনা ১৬ই মার্চ, ১৯৭১। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ বাংলারকবিতা.কম ওয়েবসাইটের
কাছে কারণ এই কবিতাটি আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়।
ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।
তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার।
অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার।
এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,
সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।
শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান,
মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।
তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,
জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।
সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,
কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস।
তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।
ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে,
সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।
ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে ।
বুলেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে ।
বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,
পড়ে বলে গেলো, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।”
উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে,
ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে।
পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে,
লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে।
মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,
পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।
আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,
দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী।
মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,
বঙ্গ-বঙ্গ শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।
আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,
জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।
মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,
বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি।
মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,
এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রুপালীর তার পরে,
পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে।
আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,
সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতুহলে।
আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,
আমাদরে জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে,
“কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?”
আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরুপ নির্ভয়।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
গীতারা কোথায় গেলো,
আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
আদরি তাহারে কথা না ফুরায়
কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে,
দেখলে তাহারে ছাড়ায় ছড়ায় ছড়ায় যে মন
গড়ায় ধরণী ছেয়ে।
ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।
সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত,
কে মারিল তারে ? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত।
অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি,
কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারে গলায় আঙ্গুল তুলি ?
সে বন-হরিণী নিষ্ঠুর হতে পালাবার লাগি
হেথায় হোথায় কত না ঘুরেছে হায়।
সারা গাঁও করি উথাল পাথাল বাণ-বিদ্ধ যে করিয়াছে ব্যাধ তায়।
আহারে আমার ছোট গীতামণি,
তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে,
মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে
পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।
গীতারা কোথায় গেলো কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত, কবির
“ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ বাংলারকবিতা.কম ওয়েবসাইটের কাছে
কারণ এই কবিতাটি আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর,
কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।
সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।
তারপর এলো নিপুণ পটুয়া, সূক্ষ্ম তুলির ঘায়,
স্বর্গ হতে কত দেবদেবী আনিয়া রথের গায়।
রঙের রেখার মায়ায় বাঁধিয়া চির জনমের তরে,
মহা সান্ত্বনা গড়িয়া রেখেছে ভঙ্গুর ধরা পরে।
কৃষ্ণ চলেছে মথুরার পথে, গোপীরা রথের তলে,
পড়িয়া কহিছে, যেওনা বন্ধু মোদের ছাড়িয়া চলে।
অভাগিনী রাধা, আহা তার ব্যথা যুগ যুগ পার হয়ে,
অঝোরে ঝরিছে গ্রাম্য পোটোর কয়েকটি রেখা লয়ে।
সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন
সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন।
রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল,
দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল।
ধামরাই রথ কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত, কবির “ভয়াবহ সেই
দিনগুলিতে” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ বাংলারকবিতা.কম ওয়েবসাইটের কাছে কারণ এই
কবিতাটি আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ,
লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ।
কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা।
বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা।
শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে,
শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে।
একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে,
আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে।
তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া,
ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া।
এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে,
কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে।
নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে,
নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে।
বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা,
কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা।
কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে।
কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে।
শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা,
কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা।
পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে।
খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে।
কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া,
কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া।
তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি,
রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।
পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ,
এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ।
শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে,
একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বস্তীর বোন, তোমারে আজিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে,
যত দূরে যাব তোমাদের কথা চিরদিন মনে রবে।
মনে রবে, সেই ভ্যাঁপসা গন্ধ অন্ধ-গলির মাঝে,
আমার সে ছোট বোনটির দিন কাটিছে মলিন সাজে।
পেটভরা সে যে পায় না আহার, পরনে ছিন্নবাস,
দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারোমাস।
আরো মনে রবে, সুযোগ পাইলে তার সে ফুলের প্রাণ,
ফুটিয়া উঠিত নানা রঙ লয়ে আলো করি ধরাখান।
পড়িবার তার কত আগ্রহ, একটু আদর দিয়ে,
কেউ যদি তারে ভর্তি করিত কোন ইস্কুলে নিয়ে;
কত বই সে যে পড়িয়া ফেলিত জানিত সে কত কিছু,
পথ দিয়ে যেতে জ্ঞানের আলোক ছড়াইত, পিছু পিছু!
নিজে সে পড়িয়া পরেরে পড়াত, তাহার আদর পেয়ে,
লেখাপড়া জেনে হাসিত খেলিত ধরনীর ছেলেমেয়ে।
হায়রে দুরাশা, কেউ তারে কোন দেবে না সুযোগ করি,
অজ্ঞানতার অন্ধকারায় রবে সে জীবন ভরি।
তারপর কোন মূর্খ স্বামীর ঘরের ঘরনী হয়ে,
দিনগুলি তার কাটিবে অসহ দৈন্যের বোঝা বয়ে।
এ পরিনামের হয় না বদল? এই অন্যায় হতে
বস্তীর বোন, তোমারে বাঁচাতে পারিবনা কোনমতে?
বস্তীর মেয়ে কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত, কবির “মাটির কান্না” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ বাংলারকবিতা.কম ওয়েবসাইটের কাছে কারণ এই কবিতাটি আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
ফুলের মতন হাসিখুশী মুখে চাঁদ ঝিকি মিকি করে,
নিজেরে গলায়ে আদর করিয়া দিতে সাধ দেহ ভরে।
তুমি ত কারুর কর নাই দোষ, তবে কেন হায়, হায়,
এই ভয়াবহ পরিনাম তব নামিছে জীবনটায়।
এ যে অন্যায়, এ যে অবিচার, কে রুখে দাঁড়াবে আজ,
কার হুঙ্কারে আকাশ হইতে নামিয়া আসিবে বাজ।
কে পোড়াবে এই অসাম্য-ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ,
তার তরে আজ লিখিয়া গেলাম আমর আর্তনাদ।
আকাশে বাতাসে ফিরিবে এ ধ্বনি, দেশ হতে আর দেশে,
হৃদয় হইতে হৃদয়ে পশিয়া আঘাত হানিবে এসে।
অশনি পাখির পাখায় চড়িয়া আছাড়ি মেঘের গায়,
টুটিয়া পড়িবে অগ্নি জ্বালায় অসাম্য ধারাটায়!
কেউটে সাপের ফণায় বসিয়া হানিবে বিষের শ্বাস,
দগ্ধ করিবে যারা দশ হাতে কাড়িছে পরের গ্রাস।
আলো-বাতাসের দেশ হতে কাড়ি, নোংরা বস্তী মাঝে,
যারা ইহাদের করেছে ভিখারী অভাবের হীন সাজে;
তাহাদের তরে জ্বালায়ে গেলাম শ্মাশানে চিতার কাঠ,
গোরস্তানেতে খুঁড়িয়া গেলাম কবরের মহা-পাঠ।
কাল হতে কালে যুগ হতে যুগে ভীষণ ভীষণতর,
যতদিন যাবে ততজ্বালা ভরা হবে এ কন্ঠস্বর।
অনাহারী মার বুভুক্ষা জ্বালা দেবে এরে ইন্ধন,
দিনে দিনে এরে বিষায়ে তুলিবে পীড়িতের ক্রন্দন।
দুর্ভিক্ষের স্তন পিয়ে পিয়ে লেলিহা জিহ্বা মেলি,
আকাশ-বাতাস ধরণী ঘুরিয়া করিবে রক্ত কেলি।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বিশ্ববাসীরা শোন,
মোদের কাহিনী শুনিয়া কাঁদিবে নাই কি দরদী কোন?
সীমান্ত পার হয়ে যারা গেছে হয়ত বেঁচেছে যবে,
এখানে যাহারা রয়েছি জানিনে কিবা পরিণাম হবে।
প্রতিদিন শুনি ভীষণ হইতে খবর ভীষণতর,
শিহরিয়া উঠি থাপড়াই বুক জীয়ন্তে মরমর,
রাত্র দিনের দু-খানি পাখায় লিখি অসহ্য গাথা,
চোখের সামনে দোলায় দেশের নিষ্ঠুর শাসন-দাতা।
কবির নিবেদন কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৭২ সালে
প্রকাশিত, কবির “ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে” কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে
কৃতজ্ঞ বাংলারকবিতা.কম ওয়েবসাইটের কাছে কারণ এই কবিতাটি আমরা
সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এইখানে ছিল কালো গ্রামখানি, আম কাঁঠালের ছায়া,
টানিয়া আনিত শীতল বাতাস কত যেন করি মায়া।
তাহারই তলায় ঘরগুলি ভরে মমতা মুরতি হয়ে,
ছিল যে তাহারা ভাইবোন আর বউ ছেলেমেয়ে লয়ে।
সুখের স্বপন জড়ায়ে ঘুরায়েছিল যে তাদের বেড়ে,
আকাশ হইতে আসিত আশিস দেবর ভবন ছেড়ে।
গঞ্জের হটে সওদা বেচিতে বউ যে কহিত কানে,
“আমার জন্য নয়ানজুড়ির শাড়ি যেন কিনে আনে।”
হাটের ফিরতি পিতারে বেড়িয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়ে,
হাসিত নাচিত বিস্কুট আর চিনির পুতুল পেয়ে।
গাজীর গানের বসিত আসর, গায়েনের সুর ধরি,
যুগ যুগান্ত পার হয়ে কত আসিত কাহিনী পরী।
কিসে কী হইল, পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি,
সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খানখান,
পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্তস্নান।
কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়; যূপকাষ্ঠের গায়,
শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়।
দগ্ধ গ্রাম কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬)। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত, কবির “ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ জ্যোতিরজগৎ.ওয়ার্ডপ্রেস.কম ওয়েবসাইটের কাছে কারণ এই কবিতাটি
আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
শত শিখা মেলি অগ্নিদাহন চাহি আকাশের পানে,
হয়তো-বা এর ফরিয়াদ করি ঊর্ধ্বে নিশ্বাস হানে।
আকাশে আজিকে নাহি কোনো পাখি, সুনীল আরোসি তার,
দিগন্তে মেলি এ ভীষণ রূপ দগ্ধি হে অনিবার।
মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল ভস্মাবশেষ গ্রাম,
দাঁড়ায়ে রয়েছে বিষাদ-মলিন দগ্ধ দুটি আধপোড়া খাম।
ওইখানে ছিল কুলের গাছটি, স্খলিত দগ্ধ-শাখ,
পাড়ার যত-না ছেলেমেয়েদের নীরবে পড়িছে ডাক।
আর তো তাহারা ফিরে আসিবে না, নাড়িয়া তাহার ডাল,
পাড়িবে না ফল দস্যু ছেলেরা অবহেলি মার গাল।
সিঁদুরে আমের গাছ ছিল হোথা, বছরের শেষ সনে,
শাখা ভরা আম সিঁদুর পরিয়া সাজিত বিয়ের কনে।
সে গাছে তো আর ধরিবে না আম বোশেখ মাসের ঝড়;
সে ছেলেমেয়েরা আসিবে না পুনঃ আম কুড়াবার তরে।
সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মশান, দমকা হাওয়ার ঘায়,
দীর্ঘনিশ্বাস আকাশে পাতালে ভস্মে উড়িয়া যায়।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি,
মন্দিরে আজ বাজেনাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি।
তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে,
রচে না প্রণাম গাঁয়ের রূপসী মঙ্গল কথা কয়ে।
হাজরাতলায় শেয়ালের বাসা, শেওড়া গাছের গোড়ে,
সিঁদুর মাখান, সেই স্থান আজি বুনো শুয়োরেরা কোড়ে।
আঙিনার ফুর কুড়াইয়া কেউ যতনে গাঁথে না মালা,
ভোরের শিশিরে কাঁদিছে পুজার দুর্বাশীষের থালা।
দোল-মঞ্চ যে ফাটিলে ফাটিছে, ঝুলনের দোলাখানি,
ইঁদুরে কেটেছে, নাটমঞ্চের উড়েছে চালের ছানি।
কাক-চোখ জল পদ্মদীঘিতে কবে কোন রাঙা মেয়ে,
আলতা ছোপান চরণ দুখানি মেলেছিল ঘাটে যেয়ে।
সেই রাঙা রঙ ভোলে নাই দীঘি, হিজলের ফুল বুকে,
মাখাইয়া সেই রঙিন পায়েরে রাখিয়াছে জলে টুকে।
আজি ঢেউহীন অপলক চোখে করিতেছে তাহা ধ্যান,
ঘন-বন-তলে বিহগ কন্ঠে জাগে তার স্তব গান।
এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে,
কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে।
ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি,
গুমরায় বন সবুজ শাড়ীরে দীঘল নিশাসে ফাড়ি।
বাস্তু ত্যাগী কবি জসীমউদ্দীন মোল্লা (১৯০৪ - ১৪.৩.১৯৭৬) । ১৯৫১ সালে প্রকাশিত, কবির “মাটির কান্না”
কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ বাংলা-কবিতা.কম ওয়েবসাইটের কাছে কারণ এই কবিতাটি আমরা সেখান
থেকে পেয়েছি। সেই ওয়েবসাইটে যেতে এখানে ক্লিক করুন . . . ।
ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে,
তোমাদের কত অতীত-দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।
সুপারির বন শুন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ,
নারকেল তরু উর্ধ্বে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ।
বুনো পাখিগুলি এডালে ওডালে, কইরে কইরে কাঁদে,
দীঘল রজনী খন্ডিত হয় পোষা কুকুরের নামে।
কার মায়া পেয়ে ছাড়িলে , এদেশ, শস্যের থালা ভরি,
অন্নপূর্ণা আজো যে জাগিছে তোমাদের কথা স্মরি।
আঁকাবাঁকা রাকা শত নদীপথে ডিঙি তরীর পাখি,
তোমাদের পিতা-পিতামহদের আদরিয়া বুকে রাখি ;
কত নমহীন অথই সাগরে যুঝিয়া ঝড়ের সনে,
লক্ষীর ঝাঁপি লুটিয়া এনেছে তোমাদের গেহ-কোণে।
আজি কি তোমরা শুনিতে পাও না সে নদীর কলগীতি,
দেখিতে পাও না ঢেউএর আখরে লিখিত মনের প্রীতি?
হিন্দু-মুসলমানের এ দেশ, এ দেশের গাঁয়ে কবি,
কত কাহিনীর সোনার সুত্রে গেঁথেছে সে রাঙা ছবি।
এদেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা,
যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা।
বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে,
কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে।
এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা,
রাধিকার পার নুপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা।
অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,
আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সে সব অতীত কথা।
এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নুতন দৃষ্টি দিয়ে,
নুতন রাষ্ট্র গুড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে।
ভাঙ্গা ইস্কুল আবার গড়িব, ফিরে এসো মাস্টার।
হুঙ্কারে ভাই তাড়াইয়া দিব কালি অজ্ঞানতার।
বনের ছায়ায় গাছের তলায় শীতল স্নেহের নীড়ে,
খুঁজিয়া পাইব হারাইয়া যাওয়া আদরের ভাইটিরে।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
গাও তাহাদের গান।
তোমার আমার লাগি
জীবন-রজনী জাগি,
দিয়ে গেল যারা প্রাণ ---
গাও তাহাদের গান।
গাও তাহাদের গান।
তোমার আমার লাগি
জীবন-রজনী জাগি
দিয়ে গেল যারা প্রাণ ---
গাও তাহাদের গান॥
আকাশেতে যবে ছিল না'কো তারা,
চলার সরণী আঁধারেতে ভরা।
আকাশেতে যবে ছিল নাকো তারা,
চলার সরণী আঁধারেতে ভরা।
নিজেরে জ্বালায়ে প্রদীপের মতো
করে গেল আলো দান।
নিজেরে জ্বালায়ে প্রদীপের মতো
করে গেল আলো দান।
গাও তাহাদের গান।
গাও তাহাদের গান॥
কবি নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
|
গাও তাহাদের গান কবি নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৫.১.১৯০৫ ― ২৩.৭.১৯৬৩)। সুর -
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শিল্পী - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বেলা মুখোপাধ্যায়, আভা মুখোপাধ্যায় ও সমরেশ
রায়। রচনা ১৯৪৮। গানটি শুনে লেখা। ভিডিওটি সৌজন্যে Gaaner Dali YouTube Channel.
আন্দামানের অন্ধকারায়,
বুড়িবালামের তীরে,
অকাল বোধন করে গেল যারা
তপ্ত শোণিত নীরে।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা
শিকল ভাঙার গান।
নেতাজীর সাথে কোহিমার রাতে
বিছাইয়া দিল প্রাণ।
ডায়ারী দস্যু-দানব আঘাতে
মাটিতে লুটালো যারা,
পার হয়ে সব গরল-সিন্ধু
ফিরে আসে আজ তারা।
নতুন দিনের এসেছে সূর্য,
দিকে দিকে বাজে বিজয় তূর্য।
নতুন দিনের এসেছে সূর্য,
দিকে দিকে বাজে বিজয় তূর্য।
জগৎমোহিনী জাগিছে জননী,
বিদূরিত অপমান।
গাও তাহাদের গান।
গাও তাহাদের গান॥
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এক মুষ্টি অন্ন তরে যাহারা বাড়ায়ে থাকে হাত,
তাহাদের লুপ্ত কর ধরা থেকে হে জগন্নাথ।
যে দারিদ্র্য মহাপাপ অপরাধ চলেছে বাড়ায়ে,
তাহাকে বরণ করে উহারাই চলেছে আগায়ে।
নিজেদের সত্তা ওরা ভুলে গেছে---আছে জড় হয়,
অমঙ্গল যাহা কিছু ধরায় আনিছে ওরা বয়ে।
দেখেছি ওদের - ওরা আবর্জনা হতে খাদ্য বাছে,
দেখেছি ওদের - ওরা ফেরে ধনীদের আগে পাছে।
শৃগাল কুকুর সাথে করে দ্বন্দ্ব আহার্য্য লাগিয়া,
অতি ক্ষুদ্র দান লভি পরিপূর্ণ হয় ক্ষুদ্র হিয়া।
যুগ যুগান্তর ধরি বংশধর ওরা রেখে যায়,
আশে পাশে রহে ওরা অতি দীন, অতি অসহায়।
পথপার্শে বৃক্ষতলে গড়ে নেয় নিজেদের স্থান,
উদরে অনন্ত ক্ষুধা সম তার মান অপমান।
ইহারা হারায় প্রাণ ধনীদের চালার তলায়,
কে জানিবে সে বারতা, চিহ্ন কিছু রহে না ধরায়।
কেবল গণনা কালে জানা যায়, নাম কিছু নাই,
কেন এরা বেঁচে থাকে,---ভগবান, তোমারে সুধাই।
জাগাও
কবি প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (৫.৩.১৯০৫ - ১৪.৫.১৯৭২)
বঙ্কিমচন্দ্র সেন সম্পাদিত “দেশ” পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৬ (অক্টোবর ১৯৩৯) সংখ্যায় প্রকাশিত।
রণীর আবর্জ্জনা,---সমব্যথী পায় না যাহারা,
বেঁচে থেকে মরে থাকে, সমাজের বহু দূরে তারা ;
কাতর প্রার্থনা বাণী শুধু যাহাদের মুখে ফুটে,
বুদ্বুদের মত তারা মুহূর্ত্তের তরে জেগে ওঠে,
কেন বেঁচে থাকে ওরা এই হীন দীনতা বরিয়া,
দয়াময়, কহ কেন, ইহাদের রেখেছ বাঁধিয়া?
দাও শক্তি জাগাইয়া,--- যে শক্তি ঘুমায়ে রহিয়াছে,
দাও দৃষ্টি---দেখে যেন কিবা আছে আগে আর পাছে।
যে অন্ন ধনীর তরে, আছে তাতে সম অধিকার
মানুষ সে---নয় ঘৃণ্য, শ্রেষ্ঠতম রচনা ধাতার।
কেন করে আত্মদান ধনীর রথের চক্রতলে,
অন্যায় পীড়নে মৃত্যু নহে বিধিলিপি---দাও বলে।
দাও শক্তি, দাও জ্ঞান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াক
সত্য ন্যায্য অধিকার মানুষের মাঝে ফিরে পাক।
একই গৃহতলে ধনী, দরিদ্র্র লভিবে যবে স্থান,
সেই শক্তি লভিবারে ইচ্ছা দাও ওগো ভগবান।
মিথ্যা হয়ে যাক মিথ্যা এই ধনী দরিদ্রের জ্ঞান,
সত্য কর, পূর্ণ কর মানুষেরে তুমি ভগবান।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ক্ষান্ত করো অতীতের পুরাতন অতীতের কথা ;
সে কাহিনী আরবার শুনিবার নাহি কোনো সাধ।
স্মৃতি তার আজ শুধু চিত্ত ভরি জাগায় তিক্ততা
ক্রূর কণ্ঠে বর্তমান তারে শুধু দেয় অপবাদ।
সুদূর অতীতে যদি আমাদের পূর্বপুরুষেরা
ভূবনে রচিয়া থাকে সভ্যতার নব-ইতিহাস,
বঞ্চিত ক্ষুধিত এই দাসত্বের অপমানে ঘেরা
মোদের জীবনে মেলে স্বপ্নেও কি তাহার আভাস
সে-কাহিনী মিথ্যা আজি। মিথ্যা তারে করেছি আমরা।
যে-ঐশ্বর্য ছিল সেথা তারে মোরা করিয়াছি ক্ষয়
আমাদের জীবনের দৈন্য দিয়া তীব্র ক্ষুধা দিয়া।
আপন পৌরুষ দিয়া যদি পারি করিবারে জয়
সে-গৌরব পুনর্বার অন্তরের অনলে দহিয়া
রচিব ভারতবর্ষ মানবের স্বপ্নের আমরা।
ভারতবর্ষ
কবি হুমায়ুন কবীর
২০০৬ সালে প্রকাশিত, গোরা সিংহরায় সম্পাদিত
জননী জন্মভূমি কাব্য সংকলনের কবিতা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বল্লালী খেতাব মারা বঙ্গ ভরা এই যে কৌলিন্য?
ব্যক্তিরে’ সে উলঙ্ঘিয়া এঁকে যায় আভিজাত্য চিহ্ন--
পুরানো বংশের ভিতে। হোক্’না সে মাতাল লম্পট
না থাক ব্যক্তিত্ব তার? বেশ্যাদাস হোক না’ সে ঠক
তবুও জীবনে সেই সাফল্যের মাল্য খানি পাবে--
কিশোরী-বালার পিতা সমর্পিতে কন্যা তার ----,
ওই হীন লম্পটের হাতে। দেখিবেনা ইহ-পরকাল?
কোন্ অতীত বংশের খ্যাতি চক্ষে তার আঁকি স্বপ্নজাল
রচিবে কুহেলি মায়া। সমাজের ভাঙ্গেনা’ এ ভূল !
কন্যাদানি স্ফীতবক্ষ-পিতা ভাবে ধন্য মোর কূল--
-হ’ল আজ জীবন সফল। দীনতার এই আস্ফালন,
সভ্যতারে আবরিয়া মনুষ্যত্বে করিছে পীড়ন,---
নারীত্বের অপমান উড়ায়’ সে কৌলিন্য-নিশান,
হেরি এর ছত্রতলে ভূ’লুন্ঠিত জাতির শ্মশান॥
কৌলিন্য
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৯০৬ - ১৯৪৪)। রচনা - ১০ই বৈশাখ,
১৩৩৪ (এপ্রিল ১৯২৭), বিরূডিহা রাত্রি ৯.৩০। “পূর্ণিমা” পত্রিকার চৈত্র
১৩৩৪ সংখ্যায় (এপ্রিল ১৯২৭) প্রকাশিত।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
চাষী কয় ব্যাকুলিয়া মোর কথা শোন ধনী ভাই?
তোমাদের চাষ করি তবু মোর দানা পেটে নাই।
বরষার কাদা মাখি ভরিয়াছি তোমার ভান্ডার
এক কণা দিলেনা’ক তবু রাখিলেনা একটু আমার?
কহিলে মধুর ভাষে, ওরে মধো’ কি করিবি ধান?
আমার গোলাতে তোল নিয়ে যাবি পরিলেই টান।
লক্ষ্মী নাই তোর ঘরে অলক্ষ্মীর সদা সেথা বাস
সেথায় বিলায়ে লক্ষ্মী করিব কি নিজ সর্ব্বনাশ?
অসহায় আমি হায় পথে পথে শুধু যাই ভাবি
মাটীতে গতর ছেঁচা ও’ ধানে কি নাই মোর দাবি?
যবে ভাবি অনাহার বাছাদের খাবার কি ‘হবে?
গরীবের রক্ত চুষে ধনীরা কি চিরধনী রবে?
ওম্নি বিদ্রোহী-মন জ্বালাবারে বিশ্বখানা চায়
সমস্বরে যত দুঃখী ক্ষুধাতুর যারা মৃত প্রায়
এ’ বিশ্বে বঞ্চিত যারা পায় নাই স্নেহ ভালবাসা
যাহাদের দগ্ধ-বুকে হানিয়াছে শেল্ সর্ব্বনাশা
নিঃস্ব রিক্ত প্রাণ আর যাহাদের ব্যথাহত বুকে
দারিদ্রের জ্বালা যারা জ্বালিয়াছে দরিদ্রের ভূখে
চাষী
কবি কণকভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৯০৬ - ১৯৪৪)। ‘সম্মিলনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
মৃত্যুর কঙ্কাল তাদের কহি ওঠে সবাকার লাগি
সাম্যের শাসনে বিভূ করিয়াছে সবে সম-ভাগী
কেহ নাই রাজা প্রজা বড় ছোট নিখিল ভূবনে
আসে নাই বেঁচে কেহ যেচে নিতে কেবল মরণে
কেহ’ রবে তে’তালায় আরামেতে শুধু বসে বসে !
ভিখারী হইবে কেহ ? দাও দাও ওটা ভেঙ্গে চষে
না’ হলে দুঃখী ও ধনী এস মিলি করি আলিঙ্গন
মিসে যাক্ বিশ্ব হতে দরিদ্রের ব্যথিত ক্রন্দন॥
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ইংরেজ তারপর দেখতে পেলো, দেশের কিষাণ, ছাত্র, নৌসেনা ইংরেজের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে এবং সাড়া দিচ্ছে তারা কংগ্রেস ও গান্ধীজীর
আহ্বানে। বণিকের মানদণ্ডে লাভের চেয়ে ক্ষতির দিক ভারী হ'য়ে পড়লো।
এরই মধ্যে ওদের চেষ্টা ছিলো সাম্প্রদায়িক হলাহল দিয়ে কতোটা সুবিধা করা
যায়। সেইজন্য যে-দ্বিজাতিতত্ত্ব ওরা এতদিন ধ’রে স্থষ্টি ক'রে
এসেছিলো তারই আঘাত হানতে-হানতে চললো একটার-পর-একটা। ঘটলে
নোয়াখালির দাঙ্গা।
নোয়াখালিতে এলেন গান্ধীজী। যুগে-যুগে কতো মহামানবই এই হিংসায় উন্মত্ত
পৃথিবীতে এসেছেন। এসেছিলেন বুদ্ধ, এসেছিলেন যীশু, এসেছিলেন আমাদের
গান্ধীজী। বাপুজী তিনি প্রতিটি মানুষের, পিতা তিনি সমগ্র জাতির।
এই একটি মানুষ কেমন ক'রে যে সকলের চেয়ে সহজ এবং সকলের থেকে
পৃথক তাই আজ ব’সে ভাবি। তাঁর করুণাকোমল দৃষ্টি, তাঁর অহিংসা ও
প্রেমের সভ্যতা আনবার স্বপ্ন জড়িয়ে ছিলো তাঁর প্রতিদিনের প্রেমস্নিগ্ধ
কর্মগুলিতে। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিশ্বাস তাঁর সেই কথাই কইতো, সেই
অর্থ নিয়েই চলতো।
গভীর থেকে গভীরতর মহাপ্রবাহ কবি বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্ত (১১.৩.১৯০৭ - ১৯.৭.২০০০)। তিনি বিপ্লবীদের জন্য বোমা-পিস্তল ইত্যাদি
রাখা ও সরবরাহের কাজে লিপ্ত ছিলেন। বিপ্লবী বীণা দাসকে তিনিই সেই রিভলভার দিয়েছিলেন যা দিয়ে বিপ্লবী বীণা দাস গভর্নর স্ট্যানলে জ্যাকসনের
উপর গুলি চালান। আমরা এখানে তাঁর ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত “রক্তের অক্ষরে” গ্রন্থের শেষ অধ্যায় থেকে একটি অংশ তাঁর কবিতা হিসেবে তুলে দিয়ে ধন্য
হয়েছি। যাঁদের কর্মকাণ্ডের ফলে আমরা স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছি, তাঁদের কলমের ছোঁওয়া আমাদের কাছে কবিতাই।
এমনি ক'রে ব’য়ে চলেছিলে। জাতির মর্মে-মর্মে বিশাল থেকে বিশালতর, গভীর
থেকে গভীরতর মহাপ্রবাহ। এই প্রবাহের গতিবেগকেই আমি শুধু লক্ষ্য ক'রে
চলেছিলাম, বিভিন্ন দিক থেকে আস জলধারাগুলিকে নয়। সেগুলি তখন বড়ো
হ'য়ে চোখে ধরা পড়েনি। ধারাগুলি যেন উপলক্ষ্য, প্রবাহের প্রাবল্য ছিলো লক্ষ্য,
যে-প্রাবল্য আনবে সমুদ্র মস্থন ক'রে অমৃত।
আজ যখন সন্ধ্যা নেমে আসে, যাত্রা আমার শেষ হ'য়ে যায় তখন মনে
পড়ে ক্ষুদ্র এ-জীবনপথে কতো লোক এসেছেন, বলিষ্ঠ রেখা এঁকে রেখে-রেখে
চ'লে গেছেন তাঁরা । তাঁদের সকলের পাশে জলভরা চোখে এসে ধাড়িয়েছিলেন
বাবা আর মা। ফুলের সাজিটি ভরপুর হ'য়ে আছে। আমি কৃতজ্ঞ র’য়ে যাই,
ঋণী-র’য়ে যাই জীবন ভ'রে।
দুর্গমের পথে যাঁরা সাথী হয়েছিলেন তাঁরা আজ কে কোথায়? জীবন ভ’রে
তাঁদের পাওয়ার দিনে মন আনন্দে ছেয়ে গেছে, সমস্ত হৃদয় উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত
হয়ে উঠেছে, বিদায় নেবার বেলায় অপ্রস্তুত মন হাহাকার ক'রে উঠেছে। কেউ
তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না, যে যার আপন গতিতে ছুটে চলেছে। শুধু
চিরকাল ধ’রে নব-নব রূপে ব’য়ে যেতে থাকবে জাতির জীবনের ওই অনন্ত
প্রবাহ।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
প্রিয় মহাশয়,
সবিনয় নিবেদন এই যে, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির জন্য ভারতে বৃটিশ
সরকারের সর্ব্বোচ্চ অধিকারিক ভাইসরয় একটি বিশেষ অর্ডিনান্স বলে এক
ট্রাইবুন্যাল গঠন করেছিলেন। এই ট্রাইবুন্যাল ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। আমার বিরুদ্ধে আনীত সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল, আমি
সম্রাট পঞ্চম জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ট্রাইবুন্যালের এই সিদ্ধান্ত থেকে দুটি বিষয়
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত, ইংরেজ জাতি এবং ভারতীয় জনতার মধ্যে যুদ্ধ চলেছে।
দ্বিতীয়ত, আমি নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। সুতরাং আমি একজন
রাজদ্রোহী যুদ্ধবন্দী। যদিও এই অভিযোগের ব্যাখ্যাকে অতিশয়োক্তির সীমায় টেনে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবুও আমি একথা না বলে পারি না যে, এর দ্বারা আমায়
সম্মানিত করা হয়েছে।
প্রথম বিষয়টির ওপর আমি কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করতে চাই।
আমার ধারণা প্রত্যক্ষভাবে কোন লড়াই এখনো শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরু হবার ব্যাপারে
ট্রইবুন্যালের মতামত কি, তা আমার জানা নেই। তবু আমি বিষয়টি স্বীকার করে
নিচ্ছি এবং সেইসঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা আমি দিতে চাই।
ফাঁসি নয়, গুলি করে আমাদের হত্যা করুন বিপ্লবী কবি শহীদ ভগৎ সিং (২৮.৯.১৯০৭ - ২৩.৩.১৯৩১)। ভগৎ সিং-এর ঐতিহাসিক 'মার্সি
পিটিশন” এর বাংলা ভাষান্তর - মানিক মুখোপাধ্যায়। লেখাটি আমরা পেয়েছি পত্রলেখা প্রকাশনী থেকে ২০০৪ সালে প্রকাশিত, মানিক মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভগৎ সিং
রচনা সংগ্রহ” থেকে। যাঁদের আত্মাহুতির ফলে আমরা স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছি, তাঁদের কথা, বাণী, কলমের ছোঁওয়া আমাদের কাছে কবিতাই।
আমি এই কথা বলতে চাই যে, যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং যতদিন ভারতীয় জনগণ
এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলির ওপর ক্ষমতাশালী ব্যক্তির একাধিপত্য
কায়েম থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে, তা সেই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ইংরেজ
পুঁজিপতি, ইংরেজ শাসকই হোন অথবা পুরোপুরি ভারতীয় হোন। যদি বিশুদ্ধ
ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারাই গরীবের রক্ত শোষণ চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতির
খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। যদি আপনার সরকার কিছু নেতা এবং সমাজের কিছু
প্রধান ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যদি কিছু সুবিধা পাইয়ে দেয় অথবা
উভয়পক্ষে একটা সমঝোতা হয়ে যায়। তাতেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে
পারে না। জনগণের ওপর এসব কথার প্রভাব খুবই কম।
দেশের যুবকদের আরেকবার ঠকানো হয়েছে, একথা ভেবে আমি দুশ্চিন্তায়
আচ্ছন্ন নই। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন এবং ইংরেজের সঙ্গে
আপস আলোচনার সময় তাঁরা গৃহহারা, নিরাশ্রয়, নিবেদিত প্রাণ সেইসব সংগ্রামীদের .
কথা ভুলে গিয়েছেন, যাদের দুর্ভাগ্যক্রমে বিপ্লবী পার্টির সদস্য হিসাবে তাঁরা মনে
করেন---এ কথা ভেবেও আমি ভয় পাই না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা
বিপ্লবীদের শত্র মনে করেন, কারণ তাঁদের বিচারে এরা হিংসায় বিশ্বাসী। আমাদের
বীরাঙ্গনারা নিজেদের সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের স্বামীদের
আত্মদানের বেদীমূলে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে
দিয়েছেন, কিন্তু আপনার সরকার তাঁদের বিদ্রোহী মনে করে। আপনাদের দালালরা
মিথ্যাকাহিনী তৈরি করে ওদের বদনাম দেয় এবং পার্টির সুনামের হানি ঘটাবার চেষ্টা
করে। কিন্তু তবুও যুদ্ধ চলছে!
বিভিন্ন সময় এই যুদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে। কখনো প্রকাশ্য লড়াই চলবে,
কখনো সংগ্রাম চলবে গোপনে। কখনো তা বিক্ষোভের স্তরে থাকবে আবার কখনো
মরণপণ লড়াই শুরু হবে। রক্তাক্ত সংগ্রাম হবে, না তুলনামূলকভাবে শাস্তিপূর্ণ পথে
লড়াই হবে, তা নির্ভর করছে আপনি কোন্ পথে চলবেন তার ওপর। কাজেই পথ
আপনিই বেছে নিন। কিন্তু সংগ্রাম চলবেই, তুচ্ছ বিষয়গুলি অবহেলা করে, অর্থহীন
নীতিবাগীশ আদর্শবাদকে উপেক্ষা করে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই চলবে। নবীন উদ্যম,
অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যতদিন না বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজের অবাধ
সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং এই পথে সমস্ত ধরনের
শোষণের অবসান ঘটানো যায়। এই পথেই মানবসভ্যতা এগিয়ে যাবে স্থায়ী শাস্তির
এক নতুন যুগে। অচিরেই শুরু হবে আখেরি লড়াই এবং তার সব চূড়ান্ত ফয়সালা
হয়ে যাবে।
পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন ফুরিয়ে আসছে। এ সংগ্রাম আমরা শুরু
করিনি, আমাদের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে এ সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে, বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগ্রাম
অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুতে আত্মদানের পুষ্পমাল্যে আর একটি
নতুন ফুল গাঁথা হবে। যতীন দাসের অতুলনীয় আত্মদান, ভগবতীচরণের
হৃদয়বিদায়ক অথচ মহান আত্মদান, এবং আমাদের প্রিয় সংগ্রামী সাথী আজাদের
গৌরবময় আত্মদান ইতিমধ্যেই আত্মদানের পুষ্পমাল্যটিকে বর্ণোজ্জ্বল করেছে।
আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে একথা বললে বোধহয় আপনি দ্বিমত হবেন না যে,
আপনি আমাকে ফাঁসি দিতে কৃতসংকল্প এবং আপনি ফাসি দেবেনই। আপনার হাতে
ক্ষমতা আছে এবং আপনারা মনে করেন, ক্ষমতার জোরেই কৃতকর্মের যৌক্তিকতা
প্রমাণ করা যায়। আমরা জানি, “জোর যার, মুলুক তার*---এই নীতি নিয়েই আপনি
চলেন। আমাদের বিচারের প্রহসন এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
আমরা বলতে চাই, আপনার আদালতের সিদ্ধান্ত হল, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি
অর্থাৎ আমরা যুদ্ধবন্দী। আমরা তাই যুদ্ধবন্দীসুলভ ব্যবহার চাই। আমরা বলতে চাই,
ফাঁসি নয়, আমাদের গুলি করে হত্যা করা হোক। আপনার আদালতের বক্তব্যকে
যে আপনি মূল্য দেন তা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার।
আমাদের অনুরোধ এবং আশা, আপনি অনুগ্রহ করে সেনাদপ্তরে আদেশ দিন,
তারা যেন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের হত্যা করে।
নিবেদক
ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ডিফেন্স কমিটি'র আইনবিদদের সিদ্ধান্ত ছিল ফাঁসি থেকে ভগৎ সিং এবং তাঁর দুই সহকর্মীকে বাঁচাতে ব্যাপক চেষ্টা চালাবার জন্য ফাঁসির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া। এর
একটাই পথ ছিল, গভর্ণরের কাছে দয়া ভিক্ষা করা। কিন্তু সবাই জানত ভগৎ সিংকে দিয়ে কিছুতেই তা করানো যাবে না। ১৯৩১ সালের ১৯শে মার্চ এ্যাডভোকেট প্রাণনাথ মেহেতা জেলে ওঁদের সঙ্গে
দেখা করতে যান। ভগৎ সিং তাঁর কথা শুনতেন। তিনি বারবার “মার্সি পিটিশন” দেবার কথা বলেন এবং পিটিশনের ভাষা অপমানজনক হবে না বলে আশ্বাস দেন। অবশেষে ভগৎ সিং বলেন, “ঠিক
আছে, লিখে আনুন।” পরদিন পিটিশনের খসড়া নিয়ে শ্রীমেহেতা জেলে দেখা করলে ভগৎ সিং বলেন, “মার্সি পিটিশন” তিনি নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটি ভগৎ সিং-এর সেই এতিহাসিক পত্র।---রাজেশ
দত্ত॥
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বন্ধুগণ,
সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আমার ছিল এ-কথা আমি গোপন
করতে চাই না। কিন্তু আমার বেঁচে থাকার একটা শর্ত আছে। কারাবন্ধ, শৃঙ্খলিত
জীবন আমি বহন করতে ইচ্ছুক নই।
আজ আমার নাম বিপ্লবী দলের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বিপ্লবী দলের আদর্শ
এবং আত্মদান আমাকে এক মহৎ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ যেখানে আমার
স্থান, বেঁচে থেকে হয়ত সেই উচ্চতায় আমি কোনদিনই পৌছতে পারতাম না।
আমার কোন দুর্বলতা আছে এ-কথা মানুষ আজ ভাবতে পারে না। আমি যদি
ফাঁসি থেকে রেহাই পেতে চাই তবে আমার দুর্বলতাই প্রকাশিত হবে, বিপ্লবের পতাকা
অবনমিত হবে, হয়ত বা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাবে। আজ আমি সানন্দে, হাসিমুখে
এমনভাবে ফাঁসির রজ্জুকে বরণ করতে চাই যা দেখে ভারতের ঘরে ঘরে মায়েরা
প্রার্থনা করবে তাদের সন্তান যেন ভগৎ সিংয়ের মতো হয়ে ওঠে। আমার দৃষ্টান্ত
অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মদান করতে এত বিপুল সংখ্যক
মানুষ এগিয়ে আসবে যে, সাম্রাজ্যবাদ তার সমস্ত দুষ্ট-শক্তি প্রয়োগ করেও বিপ্লবের
অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না।
সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আমার ছিল। বিপ্লবী সাথীদের উদ্দেশে শেষ চিঠি।
বিপ্লবী কবি শহীদ ভগৎ সিং (২৮.৯.১৯০৭ - ২৩.৩.১৯৩১)। এটি ভগৎ সিং-কে বাঁচাতে চেয়ে সাথীদের দেওয়া চিঠির উত্তর। ২৩শে মার্চ ১৯৩১।
বাংলা ভাষান্তর - মানিক মুখোপাধ্যায়। লেখাটি আমরা পেয়েছি পত্রলেখা প্রকাশনী থেকে ২০০৪ সালে প্রকাশিত, মানিক মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
“ভগৎ সিং রচনা সংগ্রহ” থেকে।
তবে একটা কথা। দেশের জন্য, মানবতার জন্য, যা আমি করতে চেয়েছিলাম
তার কণামাত্রও আমি করে যেতে পারলাম না। বেঁচে থাকলে সেই আকাঙ্খা পূরণ
করার সুযোগ পেতাম। কেবল এইটুকু, এছাড়া আর কোন কারণেই ফাঁসি থেকে
অব্যাহতি পাবার কোন বাসনা আমার হৃদয়ে ঠাঁই পায়নি। আমার চেয়ে বেশি খুশী
আজ কে থাকতে পারে? নিজের জন্য আমি এখন এক গভীর আত্মপ্রসাদ অনুভব
করি। অমিত তেজের সঙ্গে শেষ পরীক্ষার সম্মুখীন হবার প্রতীক্ষায় আছি। সেই
শুভক্ষণ আরও শীঘ্র আসুক, এই আমার প্রার্থনা।
আপনাদের সাথী
ভগৎ সিং
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
চুলো তিনটে ইঁটের, আস্ত ইঁট,
তাতে জ্বলছে আট বছরের ন্যাংটো কাঠকুড়ুনির শ্রম,
ধোঁয়ায় কালো মাটিলেপা মাটির হাঁড়ি,
তাতে পাঁচমেশেলী দুটি চাল----
নেওয়ার বড় থাবার খয়রাতি মুষ্ঠি ছোট।
গাছের ভাঙা ডাল দিয়ে
যজ্ঞের এই চার ঘাঁটছে একটা পেত্নী,
ফোঁড়ায় নিঝুম বাচ্চাটির মুখে
বুকের চুপসানো থলির বোঁটা গুঁজে !
পিপড়ের রাজ্য প্রাচীন আমগাছ,
গুড়িতে ঠেস দিয়ে বুভুক্ষ জন্মদাতা,
বুঝি চুল ছিঁড়ছে উকুনের কামড়ে?
জ্যৈষ্ঠের দুপুরে গায়ে দিয়েছে গরম কোট,
বোতাম ছাড়া, তালিমারা, চলটা তোলা,
ফুটোয় ভরা, ধূলায় ধূসর,
মুহ্যতার মতো ঢোলা গরম কোট।
স্তনাগ্রচূড়ায় ক্ষত-চোষা শিশু কাঁদল ওঁয়াও,
স্ত্রীকন্ঠের ভেরী বাজল পুরুষকে চমক দিয়ে :
বসে কেন? বসে কেন? বসে কেন?
সেই যে এগিয়ে এলো গাছতলা ছেড়ে
ঘটে গেল এক্সিডেন্ট।
গাছতলায় কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)।
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত “মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-সংকলন থেকে।
চিলের নজর ছিল পায়ে,
সিল্কের পকেটাশ্রয়ী তামার বশীকরণে
হাঁটুতক যে পায়ে জীয়ানো ঘা।
সাঁক করে নেমে এল চিল,
ছোঁ মারল সেই ক্ষেতে,
চঞ্চু আর নখে।
হু-হু করে কেঁদনা আমার সোনা
একটি বুলেট তোমায় দেব---
লড়াই থেমে গেলে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
চৈত্রের পরিচয়ে তুমি সূর্য হতে চেয়েছ।
তোমার যক্ষা হয়েছে?
তোমার তরুণ রশ্মি দেখে ভেবেছিলাম,
বাঁচা গেল, কবিও পেয়ে গেছে নতুন যুগ।
তোমার যক্ষা হয়েছে?
এও বুঝি ষড়যন্ত্র রাত্রিজ মেঘের,
ঊষার যারা আজ দুর্যোগ ঘটালো।
বুলেট ছেঁদা করে দিচ্ছে তোমার উলঙ্গ ছেলেটার বুক,
তোমার বুক কুরে খাচ্ছে টি বি কীট।
দুর্যোগের ঘনকালো মেঘ ছিঁড়ে কেটে
আমরা রোদ এনে দেব ছেলেটার গায়ে,
আমরা চাঁদা তুলে মারবো সব কীট।
কবি ছাড়া আমাদের জয় বৃথা।
বুলেটের রক্তিম পঞ্চমে কে চিরবে
ঘাতকের মিথ্যা আকাশ?
কে গাইবে জয়গান?
বসন্তে কোকিল কেসে কেসে রক্ত তুলবে
সে কিসের বসন্ত!
সুকান্ত ভট্টাচার্য কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
এই কবিতাটির রচনাকাল ১৭ এপ্রিল ১৯৪৭, প্রথম প্রকাশ- "দৈনিক স্বাধীনতা" পত্রিকা, রবিবার, ৪ মে,
১৯৪৭ সালে। পরে মিহির আচার্য সম্পাদিত "সুকান্তনামা" নামক সংকলনে পুনর্মুদ্রিত হয়। কবিতাটি
আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা”
কাব্য-সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আমরা শুনেছি তার
পুলিসী ঝঙ্কার,
মিলিটারী হুঙ্কার,
অনেক অনেক বার----
সাদা রাজা কালো দাস
মিলে যিনি অবতার,
স্বাধীনতা হীনতার !
বার বার ফোস্কায়
কড়া পড়ে সেরে যায় ;---
লাঠি ও গুলির ঘায়
জনতার প্রাণটায়
মোটে আর ব্যথা নেই
ভীরুতার ফোস্কায়,
কড়া পড়া একতায়।
ছড়া
কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯৫৩ সালের ঐতিহাসিক আন্দোলনের
প্রেক্ষিতে লেখা ছড়া। প্রথম প্রকাশ ১৭ই জুলাই ১৯৫৩, স্বাধিনতা পত্রিকায়।
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত
“মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এত সুন্দর চাল, সই, দেখেছিস? এত কচি মোটা পুঁই ডগা?
এমন পচা কাদা ভাঁপানো গন্ধের মোটা ভাত,
তেল নুন বিনা এত স্বাদে রাঁধা চচ্চড়ি?
বেঁচেছিনু যতকাল, ততকাল চেয়েছিনু
আজ আর চাই না।
বাপটা মরল, ভাইটাও,
বোনটা ভগবান পেয়েছে টাকা-ওলা গান্ধী-ভাঙানো ব্যবসায়।
ছেলেটা মরেছে, মরেছে !
শুকনো মাই বলে ছেলে বুঝি মরেছে?
দশমাস গর্ভে ছিল যে,
প্রসবের বেদনায় আমি জ্ঞানহারা-প্রায়,
কঠিন দিনক’টা ডালভাতে বাঁচতে চাইলাম।
মরলাম।
স্বপ্নে দেখলাম কাঁকরের মতো চাল,
লেলিহান শিখার মতো পুঁই ডগা !
সুন্দর
কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী
সম্পাদিত “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
খবরের কাগজ নাকি বাংলা ভাগ করতে চায় ?
নেতারা নাকি ভাতের হাঁড়ি ভাগ করতে ইচ্ছুক,
বড়লাটের আজ্ঞায়?
হাঁড়ি ফাটলে যে ভাত পুড়ে ছাই হে উনানের আগুনে,
শ্রমার্ত ক্ষুধার্ত আমরা খাব কি?
কি খাবে আমাদের হাড়গিলে বৌগুলি, ন্যাংটো নচ্ছার ছেলেমেয়ে ?
পঁয়ত্রিশ লক্ষ মরলাম,
মরলাম শুধু ওই নেতাদের লাটেদের খেয়ালে,
আরও কি দু’চার কোটি মরব,
দামী পেনের, এটলির হৃদয়ের মমতায় শোকভরা লেখনীর,
নেহেরুর নখের আঁচড়ে জিন্নার গরিব মুসলমানের প্রতি দরদে,
দাঙ্গা, কারফিউ, ব্যর্থ ও মিথ্যায় ?
নেতাদের নেতারা বাংলা ভাগ করতে চায় !
বাংলা বাঙালীর।
ঈশ্বর আল্লার হাজার বছরের সব জনমন মহামহোদয় বাক্য,
জীবন ফাউ নাকি? মরণ তো জানাশোনা।
মৃত্যুই হল শেষে বিচারক !
বাংলা ভাঙার কবিতা
কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-
সংকলন থেকে।
বাঙালীরা মরছে মরল মরবে,
কিন্তু ভাইরে,
আর মরা যায় না !
যত পারি মরেছি, আর মরা যায় না।
মাইরি বলছি কালীর দিব্যি, খোদার দোহাই,
আর মরা যায় না কিছুতেই।
তাই ঈশ্বর আল্লা নেতা লাটদের বাদ দিয়ে
এবার বাঁচতে চাই,
মানুষ নিয়ে মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।
ঘর ভাগ হোক,
ভাগ হতে দেব না দেহটা, প্রাণটা !
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
শীতে ছেলেমেয়েগুলো কাঁপছে,
কাঁদছে !
শীতে না খিদেয় কে জানে !
তবে বুঝি শীতেই কাঁপছে, খিদেয় কাঁদছে !
ফসল তোলার মাসে মরণ ধোঁয়ার কুয়াশায়
পুবের সূর্য এমন করে ঢাকলো কেন মসলিনে?
পশ্চিমের এই এস্ প্ল্যানেডে রঙিন আলোর বিজ্ঞাপন
ঝিলিক মারা তারার মতো আখর সমাবেশ।
বড় শীত, বড় ঠান্ডা, শহরের অট্টালিকা তৈরী বরফের,
প্রাণহীন লোভের বরফ।
ডিসেম্বর
কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-
সংকলন থেকে।
গেটের পাশের ফুটপাথে,
ঠান্ডায় জমে যাবে মরে যাবে বরফের দেশের এস্কিমোরাও।
ফুটপাথে কে জ্বালায় আলো?
নিওন সাইনকে ব্যঙ্গ করা কিসের আগুন এ?
ঝরা পাতা ছাপা কাগজের?
বেদ বাইবেল কোরান কিনেছে
শিশিবোতলের বিক্রিওলা,
পুঁথির পাতা পুড়িয়ে আরাম করবে শীতের রাতে
ফুটপাথে !
শীতের চাঁদের কলঙ্কও আড়াল হল,
ফুটপাথে পোড়ানো পুঁথির ধোঁয়ায়।
শীত গলে যায়।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ভিক্ষে করা গুড়ের ভাঁড়ে পিঁপড়ে অগণন---
রইল মধু হুল উঁচানো মৌমাছিদের চাকে,
স্বাধীনতার জীবন সুধারস,
শূণ্য গুড়ের ভাঁড়েই লোভী পিঁপড়ে হল খুশি।
সবার কাছেই সস্তা যেন
ভাঁড় চেটেই জীবনটারে মিষ্টি করার সাধ।
ফুলেল তেলের গন্ধ ভয়ানক
জীবনদীপের শিখা নিবু নিবু,
সলতে তারি মোটা,
চরকা থেকে তৈরী করা সুতো।
গুড়ের ভাঁড়
কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (২৯.৫.১৯০৮ - ৩.১২.১৯৫৬)
কবিতাটি আমরা পেয়েছি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা” কাব্য-
সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
“মিথ্যা গর্ব সেবি”---
দেশকে তোমরা স্বর্গ করেছ নারীকে করেছ দেবী।
দেশকে বন্ধু দেশ গড়ে তোল স্বর্গে নাহিক কাজ
মিথ্যা গর্বে সম্মান কোথা? শুধু অপমান লাজ।
নারী আজ তাই আসিয়াছে নামি দেবীর আসন হ'তে---
মানব সে---চায় মানবের সাথে চলিতে জীবন স্রোতে।
পুজা উপচার, থাক দেবতার---দেউল অন্ধকার।
পুজার শাসনে দেবীর আসনে হাঁফ ধরে গেছে তার।
তোমারো তো আজ শ্রান্তি এসেছে একাকী চলিতে পথ।
পশুর মতন চলিছ নীরবে টানিয়া জীবন-রথ।
হাতে হাত রেখে চল দুইজনে ঘুচে যাক অবসাদ।
কর্মে আসুক নূতন প্রেরণা নব আনন্দ স্বাদ।
তোমার শক্তি বাড়াক নারীর অনস্ত উৎসাহ।
সহজ হউক সাধনার সাথে সিদ্ধির উদ্ধাহ।
নারী
কবি আশাপূর্ণা দেবী (৮.১.১৯০৯ - ১৩.৭.১৯৯৫)
২০১৩ সালে সাহিত্যম, কলকাতা থেকে প্রকাশিত, নূপুর গুপ্ত সংকলিত, আশাপূর্ণা দেবীর কবিতা সমগ্র কাব্য
সংকলন গ্রন্থের কবিতা। 'রবিবাসর' স্মৃতিগ্রন্থ-৮, ৩০শে চৈত্র, ১৩৮২।
“চটুল চাহনি” “চকিত দৃষ্টি” “কালো কাজলের ছায়া”
“বাঁকা কটাক্ষ” “অশ্রু আনত সজল চোখের মায়া”
এসবে বন্ধু ভুলোনাকো আর, চেয়ো না নারীর কাছে।
দেখো তার মাঝে শ্রদ্ধা করিতে অনেক মহিমা আছে।
তৃপ্তি পেতেছ তুমিই কি শুধু শয্যাভাগিনী লভি?
ধর্মে কর্মে সঙ্গী যে নয় শুধু কামনার ছবি।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
উনিশশো বিয়াল্লিশের আন্দোলন কালে
ওই শোনো শোনো সাড়া জাগিয়াছে---
কালের ঘূর্ণি পথে!
ভাঙনের গান গেয়ে ছুটে আয়---
মরণের জয়রথে।
ওই দেখ কারা আসে দলে দলে,
দেশজননীর পূজাবেদীতলে ;
অক্লেশে প্রাণ, করে বলিদান
হোমের আহুতি হতে।
তাই দ্বারে দ্বারে ডাক দিয়ে যাই,
চল চল ছুটে চল---
কে ওরা ভাঙিছে বন্দিনী মা'র
চরণের শৃঙ্খল।
ওদের সঙ্গে দে মিলায়ে হাত,
বৃথা পশ্চাতে কর আঁখিপাত,
বাঁধিবে কি তোরে শিশুর হাস্য,
প্রিয়ার অশ্রজল?
এখনো যদি না ভাঙিতে পারিস---
কখনো কি হবে আর?
লৌহনিগড় গড়িবে আবার
প্রবলের কারাগার।
ডাক
কবি আশাপূর্ণা দেবী (৮.১.১৯০৯ - ১৩.৭.১৯৯৫)। ২০১৩ সালে সাহিত্যম, কলকাতা থেকে প্রকাশিত, নূপুর গুপ্ত
সংকলিত, আশাপূর্ণা দেবীর কবিতা সমগ্র কাব্য সংকলন গ্রন্থের কবিতা।
মরণযজ্ঞে ঝাঁপ দিতে এসে,
নতশিরে কী রে ফিরে যাবি শেষে?
মস্তকে বহি কাঁটার মুকুট,
ললাটে অন্ধকার!
বিশ্বজগৎ টিটকারি দেবে,
স্পর্ধিত উপহাসে।
যষ্টি-আহত পশুর সমান
কাপুরুষ ক্রীতদাসে।
ভাবী তনয়ের ললাটে কি ফের
দিয়ে যাবি এই কলঙ্ক জের?
যে কালি এখনো মাখানো রয়েছে---
অতীতের ইতিহাসে?
“কালিমাখা মুখে পৃথিবীর বুকে
টিকে থেকে কি বা ফল?
অকারণ শুধু ধ্বংস করিতে
ধরার অন্ন জল।
যে মাটি আঁকড়ি আছিস বসিয়া,
দাবিদাওয়াহীন সে মাটির ঋণ
শোধ দিবি কিসে বল?
নাড়া দিয়ে ভাঙ পুরনো দেওয়াল,
কতকাল রবে খাড়া?
শাসন রক্ত-ভ্রকুটির তলে
মাথা তুলে আজ দাঁড়া!
বীরদাপে যারা করে অন্যায়,
তারা যেন আজ ভাল জেনে যায়,
বিষবৃক্ষের উচ্ছেদ লাগি,
মাটিতেও জাগে সাড়া!”
ঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
(কৌতুক পর্যায়ের)
“কথা কথা কথা” কেবলই সে “কথা” মাত্র।
কথাসমুদ্রে পাক খায় দিবারাত্র---
কথার জাহাজ।
গাঁথিয়া কথার মালা,
ফেরি করে ফেরে কথাজীবী ফেরি-য়ালা।
এখানে, সেখানে, শহরে, শিখরে,
বৈঠকে আর চায়ের আসরে,
“কথা”র লেহন সাফ করে গাভী,
যত বৎসের গাত্র।
সোনা মহার্ঘ্য?
তাতে কী?
কথার পাতে! কলির রাবণ স্বর্গ সিঁড়ি তো গাঁথে,
কথার ম্যাজিকে দুপুরে দেখায় তারা,
গোবি সাহারায়
গজায় গোলাপচারা।
কথার মহিমা এমন! আগে কে জানতো?
বিকারের রোগী, পায় যেন ভিজে পান্তো!
'অভাব' জ্বরের প্রবল প্রতাপ,
স্বরাজপ্রাপ্তির পরবর্তী অঙ্কে
কবি আশাপূর্ণা দেবী (৮.১.১৯০৯ - ১৩.৭.১৯৯৫)। ২০১৩ সালে সাহিত্যম, কলকাতা থেকে প্রকাশিত, নূপুর গুপ্ত সংকলিত, আশাপূর্ণা দেবীর কবিতা
সমগ্র কাব্য সংকলন গ্রন্থের কবিতা। যদিও কবিতাটি "কৌতুক পর্যায়ের" বলে দেওয়া রয়েছে, এতে প্রতিবাদের তাপ কোনও অংশে কম নেই।
দেশটাকে যদি বকায় প্রলাপ,
কথা হেকিমের পান্তো দাওয়াই---
বিকারটা করে শান্ত।
অন্নবস্ত্র? নাই বা থাকলো রাজ্যে!
রাজ্যপালেরা কথার খৈ তো ভাজছে।
আহা! কথাতেই ভেজে গুমোচিড়ে যদি,
মিছে অপচয় করা কেন দধি?
বড়ো ব্যক্তিরা, মিল রাখে কবে,
কথায় এবং কার্যে?
আমরা মূর্খ, বুঝি না কথার মর্ম,
কোন্ টা অস্থি, কোন্ টা বা তার চর্ম,
হাঁ করিয়া দেখি, মূর্খ মোদের তরে,
বড়ো বড়ো মাথা, ফেলিছে কত না ঘর্ম!
যতো মুণ্ডিত, টিকি আর টাক,
কথা খুঁজে খুঁজে হয়ে গেল ফাঁক,
বে-কায়দা পড়ে, সাজানো আসর পাছে হয়ে যায় মাটি!
ভয় নাই দাদা!
কে লইবে কেড়ে?
একবার যবে বসিয়াছো গেড়ে,
রাজাসন তব বজায় থাকিবে---
তোমারই হাতে তো লাঠি!
বচন ভাঙিয়ে খেয়ে যাও খাশা,
চেঁচাক না দুটো হতভাগা চাষা,
সাগর পারে তো ধন্যি ধন্যি
বিমোহিত দশদিক!
তবে---
আকাট গোঁয়ার, যদি কিছু পাজী,
কেবল “কথা”য় হয় নাকো রাজী,
পুরনো “দাদা”র কাছে তো তোমার, জানা আছে ঢের “ট্রিক”।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
হে আত্মবিস্বৃত জাতি, হে ভারতবর্ষের সন্তান,
জানি না, কী অভিশাপে স্বদেশের খরূপ ভুলেছ ;
ভুলে গেছ ভারতীয় জীবনের আদর্শ মহান,
চেতনা বিভ্রান্ত করি বিচ্ছেদের পন্থায় ভুলেছ
আপনারে, ধর্ম্মনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতির
বিভক্ত-বিভাগ-মাঝে বিরোধেব ক্ষুদ্র গণ্ডী গাঁথি'
এ-কি সঙ্কীর্ণতা তব? এরি মাঝে স্বদেশ প্রীতির
নিশান তুলিতে চাও? ভুলে গেছ কী-সাধনা-সাধি'
ভারতে মুক্তির মন্ত্র কালে কালে হ'ল উচ্চারিত
অসুর নিধন-যুদ্ধে এ মর্ত্ত্যের বন্ধন খণ্ডিয়া?
যুগের দুর্যোগ এল, বসুন্ধরা রুধির প্লাবিত !
সে-মন্ত্র এখনো ওঠে ভারতের অন্তর মন্থিয়া,
শোনে না ভারতবাসী, রুদ্ধ নয় নীতির গণ্ডিতে,
বিভক্ত-বিভাগ-মাঝে দগ্ধ হয় বিদ্বেষ-বহ্নিতে॥
বিস্মৃত
কবি নিশিকান্ত রায়চৌধুরী (২৩.৪.১৯০৯ - ২০,৫,১৯৭৫)
১৯৬০ সালে প্রকাশিত, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ, কাব্য-ব্যাকারণ-পুরাণ-
কৃত্যতীর্থ দ্বারা সঙ্কলিত ও সম্পাদিত “মাতৃবন্দনা দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ও
কবিতার সঙ্কলন (১৭৪১ - ১৯৪৭)” কাব্য সঙ্কলনের কবিতা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
জন্মে তাদের কৃষাণ শুনি কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কৃষাণের বউ পঁইছে বাজু বানায়
যাত্রা তাদের কঠিন পথে রাখী বাঁধা কিশোর হাতে ---
রাক্ষসেরা বৃথাই রে নখ শানায়।
নীলকমলের আগে দেখি লালকমল যে জাগে
তৈরি হাতে নিদ্রাহারা একক তরোয়াল,
লাল তিলকে ললাট রাঙা, ঊষার রক্তরাগে
---- কার এসেছে কাল?
চোরডাকাতে মুখোস পরে, রাক্ষসেরা ছাড়ে
চোরাই মাল ঢাকে কালো কানায়।
মরিয়া যতো রাণীর জ্ঞাতি কঙ্কালী পাহাড়ে
মড়ক পূজা নরবলিতে জানায়।
এদিকে ওড়ে লালকমলের নীলকমলের হাতে
ভায়ের মিলে প্রাণের লাল নিশান।
তাদের কথা হাওয়ায়, কৃষাণ কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কামারশালে মজুর ধরে গান।
জন্মে তাদের কৃষাণ শুনি কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কবি বিষ্ণু দে (১৮.৭.১৯০৯ - ৩.১২.১৯৮২)
সুর - প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত, সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত
“গণসংগীত সংগ্রহ” সংকলন থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
প্রাচীরপত্রে পড়োনি ইস্তাহার?
লাল অক্ষর আগুনের হলকায়
ঝলসাবে কাল জানো !
(আকাশে ঘনায় বিরোধের উত্তাপ---
ভোঁতা হয়ে গেছে পুরনো কথার ধার।)
ষুগান্ত উৎকীর্ণ : এখনি পড়ো
নতুন ইস্তাহার।
ভিড়ে ভিড়ে খোঁজো, ফৌজ আছে তৈয়ার,
প্রস্তুত হাতিয়ার।
শক্ত মুঠোয় স্বর্গ ছিনিয়ে নেওয়া
দেব্ তারা পারে ঠেকাতে আর কি বলো?
শৃঙ্ঘলে এল সৈনিক-শৃঙ্খলা---
উঁচু কপালের কিরীট যে টলোমলো।
নিশ্বাস চাই ; হাওয়া চাই, আরো হাওয়া !
এই হাওয়া যাবে উড়ে---
দেব্ তারা সাবধানী---
ঘোরালো ধোঁয়ায় হাঁপাবে অন্ধকার ;
মানুষেরা, হুঁশিয়ার !
ঘরের জানলা হয়তো বিপদ ডাকে ;
লাল ইস্তাহার কবি অরুণ মিত্র (২.১১.১৯০৯ - ২২.৮.২০০০)। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত কবির
প্রান্তরেখা কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা পেয়েছি ১৯৬০ সালে ভারবি থেকে প্রকাশিত “অরুণ মিত্রর শ্রেষ্ঠ
কবিতা” সংকলন থেকে।
মর্চে-ধরা ও ঝিমোনো গরাদগুলো
গোপন রেখেছে আব্ছা গারদ নাকি?
ঘরের মানুষ, মৃত রাত নয় ভূলো।
প্রাচীরপত্রে অক্ষত অক্ষর
তাজা কথা কয়, শোনো ;
কখন আকাশে ভ্রূকুটি হয় প্রখর
এখন প্রহর গোনো।
উপোসী হাতের হাতুড়িরা উদ্যত,
কড়া-পড়া কাঁধে ভবিষ্যতের ভার ;
দেবতার ক্রোধ কুৎসিত রীতিমতো ;
মানুষেরা, হুঁশিয়ার !
লাল অক্ষরে লট্ কানো আছে দ্যাখো
নতুন ইন্তাহার।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আজভের পিঠের উপরে
চাবুকের শিস শোনো।
দুই হাজার মাইল দুরে
ঝড় উঠে মিলিয়ে গেল সুমেরু-শিখরে,
মিলিয়ে গেল তুন্দ্রার তুষার-শিবিরে,
ভালদাই পাহাড়ে
রক্তের দাগ শুকিয়ে এল বুঝি।
সাঁজোয়া থাবা বাড়িয়ে সেই বুড়ো জানোয়ার
ছিঁড়তে চেয়েছে হৃৎপিণ্ড---
বিশ্বাসঘাতী বাঘনখ প্রতিহত---
মস্কো***মস্কো !
তারপর অগণিত প্রেতমূর্তি নামে
দক্ষিণে
কালো মাটি চিরে---
১৯১৭-র নভেম্বরের সকাল
বিদ্যুৎগতি অন্ধকারে
জারজের উত্তরাধিকারে আচ্ছন্ন আবার।
এবার কসাকের কড়া পাঞ্জায় চূড়ান্ত মীমাংসা।
মজ্জায় মজ্জায় এ কৃষাণকে চেনো :
ইউক্রাইনের গমের চারায় কুলাকের হাড়ের সার,
আর ধমনীতে ডনের স্রোত।
কসাকের ডাক : ১৯৪২ কবি অরুণ মিত্র (২.১১.১৯০৯ - ২২.৮.২০০০)। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত কবির প্রান্তরেখা কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
আমরা পেয়েছি ১৯৬০ সালে ভারবি থেকে প্রকাশিত “অরুণ মিত্রর শ্রেষ্ঠ কবিতা” সংকলন থেকে।
জনসাধারণ অসাধারণ।
কষ্ণসাগরের কাল ফণায় অপূর্ব আক্রোশ---
দুশমন !
আজভের মাথার উপরে ঝাপট,
ডনের রক্তস্রোতে ডাক :
সাথী, কাঁধে কাঁধ মেলাও---
সাদা রুশিয়ার ভাই হো
বড় রুশিয়ার ভাই
সারা দুনিয়ার ভাই হো
এক সাথে দাঁড়াই
দুশমন রুশিয়ার
দুশমন দুনিয়ার
হাতিয়ার দাও ভাই হো
হাতিয়ার।
সমতলের শব্দ পাথরে পাথরে বাজে কঠিন।
উরালে কলকারখানায় ঘর্মস্নান,
দীর্ঘ পদক্ষেপে অগ্রসর সাইবেরিয়া অশ্রান্ত,
পামীরে ককেশাসে কঠিন আওয়াজ---
সাথী, কাঁধে কাঁধ মেলাও।
স্টেপ্-এর আদিগন্ত মায়া মরুবালুতে বিলীন।
সার্থবাহপথে কে যায়---কারা?
উটের কঙ্কালের ছায়ায় অস্পষ্ট কবন্ধের পাল।
খিবা বোখারা সমরকন্দ থেকে লোহার গাড়িতে
আসে মানুষ কাতারে কাতার।
ডনের দুই তীরে অশ্বক্ষুর-স্ফুলিঙ্গ,
খোলা তরোয়ালে রক্তের তাল,
আর ডনের মোহানায় ডাক :
গোলামের দল ফাঁস জড়ায়
পূবে পশ্চিমে বিষ ছড়ায়
সাপের শ্বাস
প্রভু আমাদের চায় মরণ
অগ্রদূতের প্রাণহরণ
সর্বনাশ
ভাই হো
জান দিয়ে গড়লাম রুশিয়া
সোভিয়েট রুশিয়া
জান দিয়ে রাখব এ দুনিয়া
রাখবই
ভাই হো
তোমাদের দুনিয়াকে রাখব
রুখবই দুশমন রুখব
দোসরের মুখ চাই ভাই হো - - - হাতিয়ার।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বসন্তে আহবান এলো : অস্ত্রে অস্ত্রে প্রতিরোধ করো,
তড়িতে আঘাত তীক্ষ অব্যর্থ সন্ধানে হানো দেখি।
শীতের তুষার ক্ষ’য়ে রক্তের প্লাবন খরতর ;
আকাশের শ্যেন দৃষ্টি, জল স্থল ক্ষুরধার যেন।
বসন্ত-বিহবল লোভ ঘিরে নিল ঘরে ও বাহিরে
সর্ব অঙ্গ। অনিবার্য আমন্ত্রণ সকলের কাছে ;
প্রবেশের দ্বার খোলা নিষ্প্রদীপে সশস্ত্র শিবিরে।
শৃঙ্খলার সমারোহে স্তরে স্তরে সংঘাতের বীজ ;
প্রত্যক্ষ মৃত্যুর ফাঁদ দেখে নেওয়া চূড়ান্ত এবারে,
অবিশ্রাম উন্মাদনা বিস্ফোরণ আনুক নিকটে।
বসস্ত-বাণীতে জ্বালা। ধ্বংসের প্রাচীন অধিকারে
একাত্ম অস্ত্রের শানে শেষের অধ্যায় গাঁথা আছে।
বসন্ত-বাণী কবি অরুণ মিত্র (২.১১.১৯০৯ - ২২.৮.২০০০)।
১৯৪৩ সালে প্রকাশিত কবির প্রান্তরেখা কাব্যগ্রন্থের কবিতা।
আমরা পেয়েছি ১৯৬০ সালে ভারবি থেকে প্রকাশিত
“অরুণ মিত্রর শ্রেষ্ঠ কবিতা” সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ধ্যানী বৃক্ষের ছায়া হ'টে গেল---
তেপান্তরের নৃশংস তেজ নীল বিদ্যুৎ---
স্পর্শের মার দিয়েছে শরীরে,
মরযাত্রায় সহিষ্ণু পিঠ হরধনু-ভাঙা,
ললাটপটের লেখা চৌচির, ভ|রতবর্ষ।
কালের গরজ ক্রূরবিভঙ্গ---
গণ্ডূষে ধরা সফরি ভদ্র জীবনকে খোঁজে,
ব্যঙ্গে অকাল মরণ সাগরে মন্থন তোলে ;
দেশবিদেশের কথকেরা দেখি
গলা-জড়াজড়ি, করুণ গল্পে অশ্রুসজল ;
চাঁদোয়া ঢাকা সে আসর ছাড়াই পাগলা ঝোরার
অশান্ত টানে।
আদি গঙ্গায় পাড়ি দিয়ে কোন্
স্তূপ গড়ি? তার শিখরে কেতন উড়বে কখন?
ভস্মলোচন উপসংহারে
দাঁড়ি টেনে দেবে অমর মুষ্টি, ভারতবর্ষ?
মরযাত্রা
কবি অরুণ মিত্র (২.১১.১৯০৯ - ২২.৮.২০০০)
১৯৪৩ সালে প্রকাশিত কবির প্রান্তরেখা কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা পেয়েছি ১৯৬০ সালে
ভারবি থেকে প্রকাশিত “অরুণ মিত্রর শ্রেষ্ঠ কবিতা” সংকলন থেকে।
জুয়াড়ীর দানে দুর্ভিক্ষের
উপহার গাঁথা মুণ্ডমালায়,
কূপমণ্ডূক লালসায় চিতাসজ্জার ঘটা,
অস্তাচলের নিষ্ঠুর ছোপ
রাঙায় কুটীর রাঙায় খামার,
ঊর্ধ্বমুখের যুগ্ম কোটরে
স্থির দৃষ্টির ছুরিকাফলক, গগনস্পর্ধী
সন্ধানী আলো।
দামী কঙ্কালে পথ বাঁধালাম---
জনসঙ্গীর অবিনশ্বর এই মূল্যের
পরিশোধ চাই ;
ইতরজনের জিজ্ঞাসা জমে,
শেষরক্ষার সমস্ত ভার তুলে দিয়ে ছেলে---
ভুলোনো ছড়ার মুখস্থ গানে
নেই তার কোনো উত্তর নেই।
করাল প্রাচীরে সম্মুখ রেখা
ছিন্ন এখনো, ভারতবর্ষ।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আমি এত বয়সে গাছকে বলছি
তোমার ভাঙা ডালে সূর্য বসাও
হাঃ হাঃ আমি গাছকে বলছি...
অন্ধকার হয়েছে আর আমি নদীকে বলছি
তোমার মরা খাতে পরী নাচাও
হাঃ হাঃ আমি নদীকে বলছি...
আর আমি হাঁটছি রক্তপায়ে
যদি দু একটা বীজ ভিজে ওঠে
হাঃ হাঃ যদি দুএকটা...
নিসর্গের বুকে আমি হাড় বাজাচ্ছি
আর মাদারির মতো হেঁকে বলছি
এই আওয়াজ হয়ে যাবে একমাঠ ধান
ঝিঁঝি হুতোম প্যাঁচা শেয়াল
আস্থায়ী আর অন্তরায় রাত ধুনছে
আমি বলছি একমাঠ ধান...
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
তোমার ভাঙা ডালে সূর্য বসাও
কবি অরুণ মিত্র (২.১১.১৯০৯ - ২২.৮.২০০০)
গীতিরূপান্তর, সুর ও কণ্ঠ - প্রতুল মুখোপাধ্যায়। আমরা গানটি পেয়েছি ১৯৯০
সালে প্রকাশিত সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত “গণসংগীত সংগ্রহ” সংকলন থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
সকালে-সন্ধ্যায় কিছু সময় টাটকা হাওয়া পাবার জন্য ডেকে নিয়ে
যাওয়া, এমনি করেই কেটে গেল ৫টা দিন। সমুদ্র শান্ত থাকলে ৪ দিন,
বড়জোড় ৫ দিনে জাহাজ পৌঁছে যায় ; কিন্তু আমাদের জাহাজ ৬ দিনের
দিন ভোর বেলা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মাঝে প্রবেশ করল। কী সুন্দর
অপূর্ব দৃশ্য ! ছোট ছোট দ্বীপ, সবুজের মমতা মাখানো সমারোহ।
আমাদের বাঙলাদেশের মতই নারকেল গাছের সারি। রস (Ross) ও
সেলুলার জেলের দালানকোঠা কি সুন্দরই না দেখা যাচ্ছে! ৬ দিনের
দিন ভোর ৯টায় এবারডিনে “মহারাজ” শেষপর্যস্ত নোঙর করল।
আমাকে গাড়ীতে তুলে পোর্টবেয়ার সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া
হলো। জেল-ফটকে জেলার সাহেব ও সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট উপস্থিত
ছিল। তাদের সম্মুখে উপস্থিত করার পর তারা আমায় হুঁশিয়ার
করে দিল : “সর্বদা মনে রাখবে, এটা বাউলাদেশ নয় এটা
আন্দামান।” মনে হলো, বাঙলার “রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের”
পোষ মানাবার দাপট অনেকটা কমে গেছে।
বন্দী-শিবির - সেলুলার জেল
বহুশ্রুত সেলুলার জেলের বন্দী-শিবিরে শুরু হলো আর এক জীবন।
বিপ্লবী জীবনের এ যেন এক পর্বান্তর।
বন্দী-শিবির - সেলুলার জেল কবি বিপ্লবী নলিনী দাস (১.১.১৯১০ - ১৯.৬.১৯৮২)। ১৯২৯ সনে মেছুয়াবাজার বোমার মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন
করেন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩০ সনে কলকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট সাহেবকে হত্যা-প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হন। বরিশাল, বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত, কবির “স্বাধীনতা সংগ্রামে
দ্বীপান্তরের বন্দী” গ্রন্থের “আলীপুর জেল থেকে আন্দামান যাত্রা” পরিচ্ছেদের শেষের অংশ ও “বন্দী-শিবির - সেলুলার জেল” পরিচ্ছেদের শুরুর অংশ মিলিয়ে আমরা একটি কবিতার রূপে এখানে তুলে ধন্য
হলাম। কবি তাঁর কারাজীবনের মধ্যে, ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। সর্বোপরি এই পাতার ব্যাকগ্রাউণ্ড চিত্রটিতে যে অলিন্দের ছবি দেখা যাচ্ছে, নলিনী দাস সেই অলিন্দ-সংলগ্ন কোনো
কালকুঠরীতে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এসেছিলেন, যাতে আমরা স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করতে পারি। তাই তাঁদের মতো মানুষের কলমের ছোঁয়াই আমাদের কাছে কবিতা!
হাসপাতাল-সংলগ্ন একটা ওয়ার্ডে আমাকে নিয়ে তোলা হলো।
আমার উপর নির্দেশ হলো “কোয়ারেনটাইনে” ( অর্থাৎ, স্বাস্থ্যগত
কারণে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ) এই ওয়ার্ডে ৭ দিন থাকতে হবে। বহু
ঘুরে এক বন্ধুকে দেখতে পেলুম। মনে হলো কোথায় যেন একে
দেখেছি। সে চিৎকার করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
“আসুন, ভাই আসুন, আপনার জন্য খাবার ঠিক করে রেখেছি।”---
এই বলে সে জাঙ্গিয়ার ভিতর থেকে পায়খানা বের করে আমার
মুখের সামনে এনে ধরলো---“খাও, দাদা খাও, এই, এই-ই আন্দামানে
খেতে হবে।” চিনে ফেললুম। এই ছেলেটি আর কেউ নয়, ঢাকার
ভূপেশ ব্যানাজীঁ। আন্দামানের বর্বর অত্যাচারে পাগল হয়ে গেছে।
বুঝলুম, এই হলো আন্দামান।
জেল হাসপাতালে যে-ওয়ার্ডে আমাকে বিচ্ছিন্ন (কোয়ারেনটাইন)
করে রেখেছে সেখান থেকেই খেলার মাঠটা দেখা যায়। ঠিক
খেলার মাঠ নয়, বড় গৃহস্থ বাড়ির সম্মুখে একটা বড় উদ্যান যেন।
একটি জোয়ান লোক কর্নার হতে ছুঁড়ে বলটিকে গোলপোস্টে ফেলে
দিতে পারে। ঐ মাঠের মাঝে ছিল একটি পুরনো দালান। তারই
ধ্বংসাবশেষ চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাথর ও
ইঁটে ভর্তি হয়ে রয়েছে মাঠের একটা অংশ। প্রতিদিন হাত-পা
কাটে। তবু অনশন শেষ হবার কয়েকদিন পর জেলার সাহেব
যখন একটা বল তুলে দিয়েছিল রাজবন্দীদের হাতে এবং বলেছিল,
“তোমরা প্রতিদিন বৈকালে ৫টায় এখানে খেলা করবে”, তখন রাজ-
বন্দীদের আনন্দ আর ধরে নি। আমি খেলোয়াড় ছিলুম, এ সংবাদ
আন্দামান পৌছবার আগেই বন্ধুরা পেয়ে গেছে। ১২টার পর
থেকেই দুই-একজন করে বন্ধু দেখা করতে শুরু করল। তাঁদের
মাঝে অনেক পুরাতন পরিচিত বন্ধুরাও রয়েছে। নতুন বন্ধুদের
কথা, “সাবধান, অন্য কোনো টিমে খেলবেন না, আমাদের টিমে খেলতে
হবে।” জিজ্ঞাসা করলুম, “টিমের নাম কি?” কেউ বললেন “বাঙ্কার্স”,
কেউ বললো, “কুক্লুস ক্লান।” আমি তো এসব নাম শুনে তাজ্জব
বনে গেলুম।
জিজ্ঞাস৷ করলুম, “আপনার! এখানে কি করে খেলেন?” তাঁরা
হেসে উত্তর দিলেন, “খেলা নয়, আনন্দ করি।“ বুঝলুম, অমানুষিক
অত্যাচার, ইট-পাথর আর মহাসমুত্রের মাঝে বিপ্লবী জীবনকে
বাঁচাবার জন্য কী তীব্র সংগ্রাম তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাবাস
আন্দামান রাজবন্দীরা, সাবাস তোমাদের দেশপ্রেম !
একটু পরেই দেখা করতে এলেন আমারই আবাল্য অতিপ্রিয়
বন্ধু ফণীদা (ফণী দাশগুপ্ত)। আলীপুর জেলেই শুনেছিলাম,
অনশন চলাকালীন নিষ্পেষণের পর থেকেই তার একটু মাথার
অসুখের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। বললেন, “সুগা খাবি?” জিজ্ঞাসা
করলুম, “সুগাটি কি?” তিনি বললেন, “সুগা হলো আন্দামানী
ভাষায় খইনি। বিড়ি-সিগারেট জোটে না। দেয়ালে অফুরন্ত চুন
আছে---ব্যাস এটাই খাই।”
বিকালের দিকে এলেন হীরাদা (শচীন করগুপ্ত ), নিরঞ্জনদা
ও খোকাদা। এই তিন জন দীনেশ মজুমদারের কথা প্রথমেই
জিজ্ঞাসা করলেন। আমি মব ঘটনা খুলে বলে শেষ কথা বললুম,
“খুব সম্ভবত ফাঁসি হয়ে গেছে।” তাঁরা কথাটা শুনে নীববে দাঁড়িয়ে
রইলেন। এই তো৷ আমাদের জীবন !
খোকাদা যাবার পূর্বে বললেন, “অন্য কোনো টিমে নাম দিও না---
আমাদের টিমে খেলবে।” নিরঞ্জনদা বললেন, “এই মাঠে তোমার
গোল কুলোবে না।”
সর্বশেষে এলেন অনন্তদা, গণেশদা। বললেন, “শেষ পর্যস্ত
ফাঁসির রশিকে ফাঁকি দিতে পারলেন।” মাস্টারদার ফাঁসি,
চন্দননগরের ঘটনা প্রভৃতি নিয়েও কিছুটা কথা হলো।
সাত দিন পর আমাকে রাজবন্দীদের ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া
হলো।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
সোনার পাহাড় ঘেরা মুখোশের দেশে
মুখোশেরা মঞ্চপতি। মুখোশে আবৃত মুখগুলি
মুখোশের গ্যালারীতে উল্লাসে মুখর!
মুখোশের যুগ এটা! মুখোশ! মুখোশ! চতুর্দিকে!
শূয়োরের চামড়া ঢাকা
মাথায় মোষের শিং ভাঁড়ামীর ক্লীব অঙ্গরাখা
শুচিশুভ্র সভ্যতার সর্বাঙ্গে জড়ানো।
মিহি মিহি বচনের সিকিইঞ্চি অর্ধইঞ্চি অমায়িক বর্বর ভাষণ
মুখোশের মুখে শোনো।
মনুষ্যত্ব কৃকলাস প্রেতায়িত প্রেম
আড়ষ্ট ললিতকলা প্রগল্ভ সঙ্গীত
মুখোশের মঞ্চে মঞ্চে!
উপদংশ গুটিকায় বিচিত্রিত মুখোশের মুখে
আঙ্গিকের অঙ্গভঙ্গী দ্যাখো,
দ্যাখো বিজ্ঞ মুখোশের রসাল রসনা
ঝরায় বিষাক্ত লালা!
নাগরিক জীবনের উচ্চাসনে কৃপালু নাগর
ব্যাঙ্কের ওভারড্রাফ্ টে, হুণ্ডি কেটে, মোটর হাঁকিয়ে,
চোরাগোপ্তা শেয়ারের মহিমায় প্রাসাদ বানিয়ে
অবিশ্রান্ত জন্ম দিয়ে যায়
নিরীহ নির্বোধ অসহায়
গরু ভেড়া ছাগ মহিষের
আভিজাত্য-কলুষিত কচি কচি উদ্ধত মুখোশ!
মুখোশ কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ (১২.১২.১৯১০ - ২২.১০.১৯৮১)। রচনা ২৬শে মার্চ ১৯৪০। শ্রাবণ ১৩৬৩ বা আগস্ট ১৯৫৬ তে প্রকাশিত কবির
“উদাত্ত ভারত” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে কবিতার আবৃত্তি সৌজন্যে Kazi Sabyasachi YouTube Channel.
ক্লেদ-পঙ্ক-তিলকের জয়শ্রীমণ্ডিত
এ যুগের রাজসূয় মহাযজ্ঞশালা
পিশাচের প্রদর্শনী সশঙ্কিত সুরক্ষিত দ্বার
টিকিট লাগে না মুখোশের।
মুখ খোলা নিষিদ্ধ এখানে
খোলাকথা খোলাখুলি বলা অসম্ভব,
মুখোশের আভিজাত্য উচ্চপ্রশংসিত!
বনেদী মুখোশঢাকা মুখোশের মহারঙ্গভূমি
এ সমাজ, এ সংসার! পিতার মুখোশে
অনিচ্ছুক জন্মদাতা পিতৃস্নেহে বিবশ বিহ্বল!
মাতার মুখোশে---
চোখ নেই আলো নেই স্তন্যরস-ক্ষরণের জ্বালা
অন্ধ মূক মাতৃস্নেহ!
প্রেমিক প্রেমিকা প্রিয় প্রিয়া
যৌবনের নিরিন্দ্রিয় অভিশপ্ত চলন্ত মুখোশ,
মুখোশ! মখোশ! চতুর্দিকে!
তোমার মুখোশ দেখে হেসে ওঠে আমার মুখোশ
সৌজন্যে সম্ভ্রমে গদগদ
মুখোশের সুবিনীত মুখভঙ্গী দেখে
খোলাখুলি মনোবিনিময়
অবাস্তব মুখোশের দেশে!
মুখোশের যাদুকর মুখ নেই তবু কথা বলে
হাত নেই সম্পদ বিশাল
যাদুমন্ত্রে ধরে রাখে,
বিনাপায়ে হেঁটে যায় পায় যদি বাধামুক্ত পথ
জঠরে জটিল মনোরথ
অহোরাত্র জ্বেলে রাখে রাবণের চিতা!
দুরন্ত ক্ষুধায় লুব্ধ বিশাল জগত
কখন যে গিলে খাবে বলা অসম্ভব
অতিকায় মুখোশের হাঁয়ে।
মুখোশের আধিপত্যে সুরক্ষিত সোনার পাহাড়
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি।
ভূরিভোজী ভূগর্ভের তলে
কান পেতে শোনো ভূকম্পন
চাপা ক্রোধ জমাট গর্জন
সুবর্ণ-পর্বতচূড়া ভেঙে বুঝি পড়ে!
আতঙ্কে উন্মাদ মুখোশেরা
মুখোশের রঙ্গমঞ্চে ভুলে যায় নাটকীয় ভাষা
আঙ্গিকের অঙ্গভঙ্গী! দুর্বোধ্য হুঙ্কার!
মুখোশ! মখোশ! চতুর্দিকে!
চেয়ে দ্যাখো মুখোশেরা নাচে বিনা পায়ে
আত্মঘাতী বীভত্স তাণ্ডব,
বিনা হাতে তালি দেয়
গলা নেই দোলে মুণ্ডমালা
অনাঙ্গিক হস্তপদ তাথৈ তাথৈ নাচ নাচে!
মুখোশের রঙ্গালয়ে যারা আজো পায়নি টিকিট
অনাহূত উপেক্ষিত অনিমন্ত্রিত
অনন্ত অর্বুদ হস্তপদ
খালি মুখে খোলাখুলি কথা বলে যারা
নিরন্ন নির্জীব পাকস্থলী,
সোনার পাহাড় যারা গড়েছিল ঘামো রক্তে
নোনাঅশ্রুজলে
এ সমাজ এ সভ্যতা এ নগরীপথ
নিষিদ্ধ যাদের কাছে।
খোলা মুখ খোলা বুক, খোলা মন বৈভব উল্লাসে
তা’রা আসে---দলে দলে আসে
কেঁপে ওঠে রঙ্গশালা
ভেঙে পড়ে নিষিদ্ধ তোরণ!
শুয়োরের চামড়া ঢাকা
খসে পড়ে সভ্যতার ক্লীব অঙ্গরাখা,
পরাক্রান্ত মিছিলের দুরন্ত দুর্জয় পদাঘাতে
রাজপথে গড়ায় মুখোশ।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
মাকড়শা
আত্মলালায় জাল বোনে আজো অমর মীর্ জাফর
কায়েমী-সুখের প্রাসাদে প্রাসাদে ঈর্ষায় জর্জর
ব্যারাক-বস্তি-দোতলা-তেতলা-কুটিরের দ্যালে দ্যালে
রসনার রসে চতুর মাক’শা শীকারের জাল ফ্যালে
নর-নারী-শিশুচর্মে কুটিল গরল-চিহ্ন আঁকে
সভ্যনামিক সহরের বুকে আবর্জনার পাঁকে॥
মশক
নর্দমা ড্রেন ডস্টবিন আর ভুতুড়ে ঘরের কোণে
লর্ড ক্লাইভের মুত্সুদ্দীরা অস্ফুট গুঞ্জনে
তাজারক্তের সোঁদালো গন্ধে আনন্দে ভরপুর
দংশনে তেড়ে জ্বর এসে যায় দ্বার খোলে যমপুর
গুন গুন গুন গুঞ্জরণের হি হি হি রাগিনী গায়
মৃত্যুর দূত ম্যালেরিয়া মাতে মশক-বন্দনায়॥
ছারপোকা
জগৎশেঠের রক্তবীজেরা বেঞ্চি চেয়ারে খাটে
গদি-তোষকের তক্ত-তাউসে মশ্ গুল রাজপাটে
কম্বল কাঁথা মশারীর কোণে অনাদিকালের পোষা
ট্রাম-বাস জুড়ে মহাজনী করে চতুর রক্তচোষা
জৈনদেবতা পার্শ্বনাথের খাটমল-দেবতারা,
কানাকড়ি দিয়ে খুনে কিনে খায় বেকুব সর্বহারা॥
প্রাসাদ-নগরীর আনাচে কানাচে কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ (১২.১২.১৯১০ - ২২.১০.১৯৮১)। রচনা
২রা এপ্রিল ১৯৪৮। শ্রাবণ ১৩৬৩ বা আগস্ট ১৯৫৬ তে প্রকাশিত কবির “উদাত্ত ভারত” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।
ইঁদুর
হেস্টিংস আজো মরেও মরেনি কবরের মাটি ফুঁড়ে
ভুঁড়ো গনেশের বাহনের বেশে সারাটা সহর জুড়ে
বণিকরাজের গদিতে গদিতে দোকানে-বাজারে-হাটে
কালোবাজারের মুনাফার লোভে সুরঙ্গপথ কাটে॥
অশন-বসন-খাটিয়া-পালঙ্ কেটে কুটে বিলকুল
প্লেগ মহামারী ছড়ায় সহরে বৈতরণীর কূল॥
মাছি
ধূর্ত বিদেশী বণিকদলের রাজ্যলাভের মতো
সহরে নগরে গ্রাম-জনপদে মক্ষিকা শত শত
কুষ্ঠের ক্ষত কলেরার বিষ যক্ষ্মার থুতু চেটে
ক্ষুধার অন্নে বীজাণু ছড়ায় জনতার ভুখাপেটে
ভন্ ভন্ ভন্ ভনিতায় ভাঁজে ঘ্যানঘেনে রামধূন
মড়কের ঘোড়া দাপাদাপি করে দেশজুড়ে চৌদূন॥
ষাঁড়
অলিতে গলিতে ধর্মের ষাঁড় বেপরোয়া পথ জুড়ে
দু’চোখ বুজিয়ে শুয়ে থাকে যেন অকর্মা যত কুঁড়ে
শিং আছে তবু শত অপমানে ভুলে গেছে শিং-নাড়া
ক্ষিধের জ্বালায় এঁটোপাতা খায় ঘুরে ঘুরে সাতপাড়া
মৃত মানুষের বৃষোত্সর্গ-শ্রাদ্ধের দাগা ষাঁড়
ক্ষেপে গেলে বৃথা মাথা খুঁড়ে করে পথঘাট তোলপাড়॥
ফাটকা বাজার
ক্ষেত্র-খামার-খনি-কারখানা সহরের বহুদূরে !
উত্পাদনের দাম ওঠে নামে নানা বিচিত্র সুরে
পুঁজিপতিদের ফাট্ কা-বাজারে নরশৃগালেরা ডাকে
দেশের ভাগ্য হাবুডুবু খায় শোষণের ভরা পাঁকে
একচেটে যত ব্যবসাদারের শেয়ারের ছলনায়
হাসি ও কান্না ব্যাঘ্র ও গরু একঘাটে জল খায়॥
পানের পিক
পাঞ্জাবী-ধুতি-শার্ট-কোট-প্যান্ট-লুঙ্গী-পিরাণ-শাড়ী
কখন যে কার দফা রফা করে দু’পাশের কোঠাবাড়ী
জান্ লা-দরোজা-বারান্দা থেকে পিকের পিচকারিতে
হাড়ে হাড়ে বোঝে ভূক্তভোগীরা ধিক্কার দিতে দিতে
শুভ্র-দেয়ালে তাম্বুলরাগরঞ্জিত-সভ্যতা
ঘোষণা-মুখর মধ্যযুগের চরম বর্বরতা॥
মহাব্যধিগ্রস্ত
লাটের প্রাসাদ-তোরণের মুখে পথিকের সহযোগী
হামেসাই ঘোরে নাক-কানখসা গলিতকুষ্ঠরোগী
কন্ঠের স্বর যাতনায় কাঁপে দু’টি দাঁতের ফাঁকে
গলিত-জিহ্বা ঘড় ঘড় করে ব্যাধির কুম্ভীপাকে
নারকীয় ক্ষুধা ডাঙস্ চালায়, শহর নির্বিকার
উপনিবেশের ক্রূর-পরিহাস অসাড় কোলকাতার॥
জুতা পালিশ
বেওয়ারিশ যত কিশোর ছেলেরা অর্ধনগ্ন দেহে
পথিকের পদধূলায় মলিন তাকায় না কেউ স্নেহে
জুতা ঝেড়ে মুছে পালিশ লাগায় দুর্বল কচিহাতে
মুখে তবু এক অদ্ভুত হাসি অসীম অজ্ঞতাতে
মহানাগরিক পাদুকাপিষ্ট দুর্ভাগ্য শিশুদল
পালিশের প্রতিযোগিতায় করে কী করুণ কোলাহল॥
মা ও ছেলে
গগনচুম্বী গণ-পরিষদ-প্রাসাদের পদতলে
গাম্ ছায় পেতে ছ’মাসের শিশু অবগুন্ঠনতলে
দু’চোখে নীরব প্রার্থনা জ্বলে অজ্ঞাতকুলশীলা
ভিখারিণী বধূ ভিখ মেগে খায় রামরাজ্যের লীলা
দামী-মোটরের রামশিঙা বাজে কেঁদে উঠে ভুখাশিশু
বৈষম্যের ক্রুশের কাঁটায় বিদ্ধ কত না যীশু॥
গণত্কার
নামাবলী গায়ে কপালে সিঁদুর ভৃগু আর পাঁজী খুলে
গোটা সহরের ভাগ্যের নাড়ী হাতড়ায় মুখ তুলে
খঁড়ি পেতে ব’সে ফুটপাত ঘেঁষে অভাগা গণত্কার
জঠর জ্বালায় দিবস কাটায় বিফল বঞ্চনার
জুয়ারী-দালাল-ভাগ্যান্বেষী-দুঃস্থ বেকারদল
উবু হয়ে বসে দু’হাত বাড়ায় দুরাশায় চঞ্চল॥
ওঝা
এঁদো পচাগলি হুজুগে মুখের তুকতাক্ ঝাড়ফুঁকে
হিষ্টিরিয়ায় মৃতবত্সার পাষাণ চাপায় বুকে
ভূত-প্রেত-দানো-মাম্ দো-পিশাচ-শাঁকচুন্নীর হাসি
সুস্থবুকের পাঁজরা খসায় যক্ষ্মার ঘেয়ো কাশি
খক্ খক্ খক্ বিয়োগান্তক ভাঙাঘরে ছায়া নড়ে
অন্ধগলিতে বিকটোল্লাসে ওঝায় মন্ত্র পড়ে॥
শ্মশানে
মহানগরীর প্রান্তশায়িনী গঙ্গার পূবতটে
চিতার ধোঁয়ায় অপমৃত্যুর ঘোষণা আকাশপটে
লাঞ্ছিত গণজীবনের ব্যথা আঁকে শঙ্কিত ছবি
রাতের চন্দ্র ভয়ে মুখ ঢাকে দিনের দীপ্ত রবি
কোওড়াতলায় নিমতলা আর কাশীমিত্তির ঘাটে
“বলো হরিবল।” অকাল -মৃত্যু আসে চারপায়া খাটে॥
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আজব গণতন্ত্র রে ভাই আজব গণতন্ত্র
গণের জোরেই গণকে ঠকা গণদ্বেষী মন্ত্র॥
নতুন কালের প্রতিশ্রুতি ভাঙতে কোথায় বাধা?
সর্বকালের শাসকদলের এক সুরে সুর সাধা॥
ওপরতলা এমনি করেই কৌটিল্যের পথে
গণপ্রেমের নিশান ওড়ায় অলীক গণরথে॥
ভাবতে ভাবতে ক্ষুদ্ধ কবির অসার অনুভূতি
দেখায় বটে আজব বিচার জয়ের “প্রতিশ্রুতি”॥
চোর ডাকাতও মুক্তি পেলো, মুক্তি পেলো খুনে
বন্দী করে রাখলো শুধু ওদের গুণেগুড়ে॥
কারণ ওরা ধৈর্যহারা তরুণ দেশব্রতী,
ছাড়লে ওদের শাসক শোষক স্বৈরাচারীর ক্ষতি॥
বন্দী করে রাখলো শুধু ওদের কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ
(১২.১২.১৯১০ - ২২.১০.১৯৮১)। ২০১১ সালে প্রকাশিত, সব্যসাচী গোস্বামী
সম্পাদিত "শেকল ভাঙার কবিতা" কবিতা সংকলন গ্রন্থের কবিতা। গ্রন্থটির
প্রকাশক "বন্দীবার্তা" পত্রিকার পক্ষ থেকে শুক্লা ভৌমিক, কলকাতা।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বাবু দেছি নমস্কার
তোমরা হলেন দ্যাশের নেতা গান্ধী অবতার।
গদী আঁটা ঘরৎ বসি কিবা কল্লেন কাম্
ঐ ঠেলাতেই হয়া গেল হের হেন্দু পাকিস্তান।
হামরা মাইয়া ছাওয়া নিয়া মরি,
ভাবি, হিলা-কি ব্যাপার।
তোমার মহিমা অপার, তোমাক্ চিনায় বড় ভার,
তারে বাদে তোমাক্ হামরা দেছি নমস্কার॥
বাবু দেছি নমস্কার
কবি সত্যেন রায় (জন্ম-মৃত্যু অজ্ঞাত)
কথা ও সুর – সত্যেন রায়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত, স্বপন দাসাধিকারী
সম্পাদিত “যুদ্ধ জয়ের গান” থেকে নেওয়া।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
বাবু তোমাক্ চিনায় বড় ভার
তোমাক্ বুঝার বড় ভার
তোমরা হলেন দ্যাশের নেতা
গান্ধী অবতার॥
তোমরা তাইলে ভাতে নিজে খান
হামাক্ উপাস করির কন
তোমায় নয়া জামা কাপ্ ড়া পিনধেন
হামার বেলায় খেতা
আধপেটা খাবার খাই
যদি পুরা প্যাটের কাথা কই
সেলাই লাঠির দ্যাছেন গুতা।
এইলা দেখি মন হামার
তোমার পুখে হয় বেজার
তোমরা নাকি রাম অবতার
তোমার মহিমা অপার
তোমাক্ চিনার বড় ভার॥
তোমরা মুখত্ হলেন হাসিখুশি
হামার পিঠত্ চড়েন আসি
হামার মাথত্ চড়ি তোমরা
কতয় দোখান খেলা।
বাবু তোমাক্ চিনায় বড় ভার
কবি সত্যেন রায় (জন্ম-মৃত্যু অজ্ঞাত)
কথা ও সুর – সত্যেন রায়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত, স্বপন দাসাধিকারী
সম্পাদিত “যুদ্ধ জয়ের গান” থেকে নেওয়া।
তোমার বিশ বছরের জমিনদারী
হামার যতো টারীবাড়ি
তামান তো পেটত্ সেনধাইলেন
বুঝির পায়সি এলা।
তোমরা গান্ ধীবাদী না কন আর
চুরী তোমার খালি সার
এইলা দেখি হাম্ রা সগায়
হইসি যে বেজায়
তোমরা হলেন দ্যাশের নেতা
গান্ ধী অবতার
হিটা দিমেন হুটা দিমেন
কতয় তোমার কাথা
তামান তো ভরেয়া দিলেন
খালি ব্যাঙের ছাতা
তোমার আইসেজে মরণ কাল
সাদা টুপী হইবে নাল
জোড়া বলদ বদলী যাবে
এইটা বুঝেন সার।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আমি মনে করি স্বদেশবাসীর কাছে আমার কিছু কৈফিয়ত দেবার আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এমন অনেকেই আছেন যারা এ কথা
জেনে আঘাত পেতে পারেন যে ভারতীয় নারীত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের মধ্যে লালিত পালিত একজন মহিলা কী করে নরহত্যার
মত একটা বীভৎস কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। আমি ভেবে বিস্মিত হই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী
পুরুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেন? যদি দেশমাতৃকার জন্য ভাইয়েরা ভাবতে পারে এবং লড়াইএ সামিল হতে পারে তবে
বোনেরা নয় কেন? রাজপুত রমণীরা যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়ে দেশের শত্রদের বধ করতে দ্বিধা করেন নি,
ইতিহাসে এর উদাহরণ একেবারে কম নয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ বীরাঙ্গনাদের কাহিনী লেখা আছে। তাহলে আমরা,
আধুনিক ভারতের নারীরা, কেন বিদেশী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার মহাসংগ্রাম থেকে বিরত থাকব? যদি সত্যাগ্রহ
আন্দোলনে বোনেরা ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পারে তাহলে বিপ্লবী আন্দোলনে নয় কেন? এটা কী এই জন্য যে পদ্ধতিটা ভিন্ন,
না কী এই কাজে অংশগ্রহণের পক্ষে মহিলারা অনুপযুক্ত? পদ্ধতিগতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহ কখনই হীন নয়। পৃথিবীর অনেক
দেশেই সাফল্যের সঙ্গে এই পদ্ধতির প্রয়োগ হয়েছে এবং শত শত মহিলা তাতে অংশও নিয়েছে। তাহলে
একমাত্র ভারতবর্ষে তা কেন নিন্দনীয় হবে? স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের প্রশ্নে নারীরা পুরুষের তুলনায় দুর্বল, এরকম মনে
করা নারীদের প্রতি অবিচার নয় কি? এই ভ্রান্ত চিন্তা অবসানের সময় এসেছে। যদি মহিলারা সত্যই কম যোগ্য বলে
বিবেচিত হন তাহলে সেটা ঘটেছে তাদেরকে সর্বদাই পেছনে ফেলে রাখার জন্যেই। যত কঠিন এবং বিপদসঙ্কুলই হোক না
কেন মেয়েরা আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা আর পিছিয়ে না থেকে ভাইদের পাশে দাঁড়াবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার
বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববে না। সমস্তরকম বিপদের মোকাবিলার জন্য তারা নিজেদের তৈরী রাখবে এবং
বিপ্লবী আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল হবে।
কবি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
|
আমার কৈফিয়ৎ কবি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (৫.৫.১৯১১ - ২৪.৯.১৯৩২)। ১৯৩২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণে, ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার আগে পটাসিয়াম সায়েনাইড খেয়ে নিহত শহীদ
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পুরুষবেশ পোষাকের পকেট থেকে “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” শিরেনামের একটি বিবৃতি পাওয়া গিয়েছিল
এবং পুলিশ পরে সেটি নিয়ে যায়। এটি ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা পেয়েছি
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত, শংকর ঘোষ সম্পাদিত “প্রীতিলতা” গ্রন্থ থেকে। আমরা সেই বিবৃত্তির থেকে তাঁর কৈফিয়ৎ জানানো
অংশটি এখানে তাঁর কবিতা হিসেবে তুলে দিলাম। যাঁরা তাঁদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন যাতে আমরা স্বাধীন দেশে জন্মাতে
পারি, তাঁদের লেখা আমাদের কাছে কবিতাই।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
আমার নিশীথের আধার সিন্ধু পাড়ি দিয়ে এল তরী
ফিরদৌস হতে সওগাত লয়ে গগন কিনার ভরি
কত উত্সুক মানব মনের শান্তি কামনা লয়ে,
দ্বিতীয়ার চাঁদ অস্ত গগনে পাবক প্রতীক হয়ে।
মাহে রমজান মোবারক হোক প্রতি মানুষের তরে
সিয়ামের শেষে ঈদের খুশীতে মন আনন্দে ভরে
সাম্যের গানে আকাশে বাতাসে ঝরায়ে সোনালী আভা
উত্সব আনে মাঠে, মসজিদে, মানব হৃদয় কাবা
প্রার্থনা রত! প্রতি মানুষের তরে সুখ ব্যাথা ভার
বহন করিয়া এনেছে ঈদের ক্ষীণ চাঁদ দ্বিতীয়ার।
বার মাস ভুখা, রোজা, তার তরেএনে দিল ইফতার
হে ধনিক! তুমি আজিকার দিনে রুদ্ধ রেখো না দ্বার
মিলনের দিনে আজিকে তোমার মুক্ত হৃদয় হাতে
তুমি মুসলিম! তুমি যে মানুষ! সব মানুষের সাথে
ফিত্রাবিলায়ে, শিরিন শিরনী আতর গোলাপ বাসে
দীন বলে যারে সরায়েছ দূরে তাহারে ডাকিয়া পাশে
কর কোলাকুলি, উঠুক উজলি সিয়াম ক্লান্ত মুখে
প্রীতি মাধুরিমা, দিব্য জ্যোতি আত্মা পরম সুখে
উদার অসীম শান্তিতে ভরি এই হেলালের তলে
সব মানুষের মিলন তীর্থে মিলে এসে দলে দলে
ঈদ
কবি বেগম সুফিয়া কামাল (২০.৬.১৯১১ - ২০.১১.১৯৯১)
ভুখারে খাদ্য, নিঃস্বেরে দিয়ে সঞ্চিত ধনভাগ
সব মানুষের অন্তরে আনো অনন্ত অনুরাগ।
রিক্তের মুঠি ভরিয়া উঠুক, নিঃস্ব লভুক বল
মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াক, আছে আছে সম্বল
একের ব্যাথার অপরে অংশ নিলে তরে লঘু ভার
হৃদয় আবার নতুন করিয়া পথ পাবে বাঁচিবার
যত ঈদগাহে জামাত জমিবে, যতেক মুসলমান
জাতির জীবনে মিলনের গানে উন্নত সুমহান।
ঐক্য, সাম্য, প্রীতি, সেবা দানে হেলালে প্রতীক করি
সারা জাহানের মুসলিম জাগো, আর করিয়ো না দেরী
অমা নিশীথের আধার কেটেছে, হেলাল হাসিছে নভে
সব মুসলিম মানুষ, জামাতে বলিবে সবে।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
পরিপূর্ণ স্বর্গসুখে হানি তীব্র বাজ
অরক্ষিত ক্ষুদ্র নীড়টুকু দোলাইয়া প্রচণ্ড আঘাতে
সারি সর্ব কাজ।
হেথা আজি দাঁড়ায়েছি আসি।
এখানেও কেন আসে ভাসি
চারিদিক হতে শত পরিচিত প্রিয় কণ্ঠস্বর?
পিতার উদ্যত বাহু, জননীর কাতর অন্তর
ঠেলি সর্ব বাধা কেন চাহে হরিবারে
বিশ্রব্ধ বক্ষের মাঝে গৃহছাড়া অশান্ত কন্যারে?
মোরে ডাকিয়ো না হেথা একা রব পড়ি
দুটি ক্ষীণ হস্তে মোর আঁকড়িয়া ধরি
সর্বোত্তম গর্ব মোর সর্বাধিক লাজ
মোর সারাজীবনের কাজ।
জানি তাহা লাগে নাই ভালো তোমাদের
আপনি স্বদেশমাতা ফিরান আনন
তবু হের তারও পরে সাধনার ব্যর্থ জনমের
প্রসন্ন স্নেহের হাসি হাসিছেন মোর নারায়ণ।
পরিপূর্ণ স্বর্গসুখে হানি তীব্র বাজ কবি বিপ্লবী বীণা দাস (২৪.৮.১৯১১ -
২৬.১২.১৯৮৬)। ৬ ডিসেম্বর ১৯৩২ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে
বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর পিস্তল দিয়ে গুলি চালান। এই অপরাধে তিনি
৯ বছর কারাবরণ করেন। ঘটনার দুদিন পরে তাঁর পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হলে
তাঁদের ভগ্নাবস্থা দেখে, পরের দিন তাঁর মাকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিটিই ছিল একটি
কবিতা ! কবিতাটি আমরা এখানে তুলতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছি। কবিতাটি আমরা
পেয়েছি কবির “শৃঙ্খল-ঝঙ্কার” নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ থেকে।
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
এসো মুক্ত কর, মুক্ত কর, অন্ধকারের এই দ্বার,
এসো শিল্পী, এসো বিশ্বকর্মা, এসো শ্রষ্টা
. রসরূপ মন্ত্র দ্রষ্টা,
ছিন্ন কর, ছিন্ন কর বন্ধনের এ অন্ধকার॥
দিকে দিকে ভেঙেছে যে শৃঙ্খল,
দুর্গত দলিতেরা পায় বল।
এ শুভ লগ্নে তাই তোমারে স্মরণ করি
. রূপকার
. এসো মুক্ত কর হে এই দ্বার॥
উঠেছে যে জীবনের লক্ষ্ণী মৃত্যু সাগর মন্থনে,
নূতন পৃথিবী চায় শিল্পীর বরাভয় নব সৃষ্টির
. শুভক্ষণে।
এসো সমিতির সাম্যে ও ঐক্যে,
এসো জনতার মুখরিত সখ্যে,
এসো দুঃখ-তিমির ভেদি দুর্গম ধ্বংসের
নিষ্ঠুর ভয় করি চূর্ণ
. ( এসো ) প্রাণের ভবন কর পূর্ণ॥
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
নবজীবনের গান
প্রথম পর্ব
প্রথম দল :
১
না না না না না।
মানব না মানব না।
কোটি মৃত্যুরে কিনে নেব প্রাণপণে,
ভয়ের রাজ্যে থাকব না।
অভয় পেয়েছি নূতন দিনের কাছে
দিকে দিকে তাই আশার পতাকা নাচে।
পেশীতে পেশীতে রক্তের লাল আলো,
ধুয়ে দেবে অমাবস্যার যত কালো---
জয়ের রাজ্যে ঢুকবই মোরা থামব না।
নবজীবনের গান কথা ও সুর - কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৮.১১.১৯১১ - ২৬.১০.১৯৭৭)। অন্যান্য বহু পুরস্কার
সহ বাংলাদেশের একুশে পদক (১৯৮৫) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯) প্রাপ্ত কলিম শরাফী (মাখদুমজাদা শাহ
সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী) ও সমবেত শিল্পীবৃন্দের কণ্ঠে গানটি শুনুন। কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র রচিত “নবজীবনের
গান”-এর এই সংকলনটিই ইন্টারনেটে প্রকাশিত “নবজীবনের গান”-এর সর্ববৃহৎ সংকলন।
ভিডিওটি সৌজন্যে Raga music YouTube Channel.
ইংরেজী ১৯৪৩, বাংলা ১৩৪৯। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মহামন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিল। চরম
বিপর্যয় ও বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি বাংলার মানুষ পেটের জ্বালায় গ্রাম উত্খাত করে শহরে এসে অন্নদাতা কৃষক ও
কৃষাণী দুই মুঠো অন্ন চাইতেও সাহস পায় না। বলে ফেন দাও। গরুছাগলের খাদ্য নিয়ে মানুষে মানুষে কাড়াকাড়ি।
ডাস্টবিনের পচা এটো নিয়ে কুকুরে মানুষে মারামারি। মনুষ্যত্বের কী প্রচণ্ড অবমাননা! এর প্রচণ্ড অভিঘাত
জ্যোতিরিন্দ্রের গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিল। জ্যোতিরিন্দ্র চিৎকার করে বলে উঠলেন না না না না না। মানুষের
তৈরী এই দুভিক্ষ মানবো না। প্রতিরোধ করবো। উত্তীর্ণ হবো। এভাবে শুরু হলো নবজীবনের গান . . .
দ্বিতীয় দল :
২
থেমো না থেমো না
মেনো না মৃত্যুর গ্লানি
মানি সবই মানি।
ওদিকে শুনতে পাও কি ক্ষুধার কান্না---
তৃতীয় দল :
৩
ফেন দাও প্রাণ দাও
নবজীবনের সমীরণ চোখে মুখে ছড়াও।
গ্রাম ভেঙে আজ এসেছি শহরে
এনেছি দুঃখ
এনেছি মৃত্যু,
এনেছি রোগ,
এনেছি শোক,
ছেঁড়া থলি ভরে ভরে।
অন্ন দাও বস্ত্র দাও
আমাদের মরা বাছাদের এনে ফিরিয়ে দাও।
দ্বিতীয় দল :
৪
কি করে ফিরাব তাদের
মন্ত্র নেই তো মরা বাঁচাবার।
ক্ষুধা-তীর্থের যাত্রীরা
তোরা ফিরে যা
তোরা গ্রামের পথেই ফিরে যা।
হবে না তো কিছু এতে
কি হবে ক্ষুধায় মেতে।
সোনা ফেলে কেন দিয়েছিস
গেরো আঁচলে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দল :
৫
দামামা বেজেছে ! দামামা বেজেছে !!
চারিদিক রণরঙ্গে মেতেছে
কোটি সিংহের ক্রুদ্ধ কেশর
ফুলে ফুলে ওঠে কালো মেঘে ওই
বজ্র মেতেছে।
বিশ্বকর্মা গোপনে জটিল মন্ত্র পড়ে
আকাশে মাটিতে হাজার ঘাঁটিতে যন্ত্র নড়ে !
পিশাচ নৃত্যে মেতেছে কুটিল কংস
ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংস !!
শৌখিনদের দল :
৬
রঙিন আকশের চাঁদের সুধা
( ওরে ) পান করে নে তোরা আয়
পেয়ালা ভরা নব যৌবন।
মধু ফুলে ভরা এই ঘন মৌবন।
তৃতীয় দল :
৭
ভুলব না এ প্রেমের সুরে
ভুলব না আর ভুলব না।
পথে ঘুরে কী-বা করি
রৌদ্রে জ্বলি আর ক্ষুধায় মরি।
ভোর না হতেই মোরা
দোকানের কাছে দিই সারি,
কখনো পথের মাঝে কুকুরের সাথে
করি আহারের লাগি কাড়াকাড়ি।
সকলে :
৮
মুক্তিরণের সাথী ওরে মুক্তিরণের সাথী !
আগুয়ান হও আগুয়ান সবে আগুয়ান।
শত্রু শোণিতে সিক্ত পতাকা মুক্তির সেনাপতি
আগুয়ান হও আগুয়ান সবে আগুয়ান
স্থলে বা জলে নভস্থলে কে দেবে বাধা
মোদের অবাধ গতি কে দেবে বাধা !
অসাধ্য নয় সাধন সাধা।
মানুষের যত বাঁধন ভাঙার
বজ্র রাগিণী গেয়ে ওঠে গান
মৃত্যুরে দিয়ে মৃত্যুর হবে অবসান।
তৃতীয় দল :
৯
এখানে লেগেছে আগুন ও ভাই
মায়া-ঘেরা ঘর বাড়ি পুড়ে হল ছাই।
নিভাও আগুন বাঁচাও এ প্রাণ
( ও ভাই ) নিভাও আগুন বাঁচাও রে।
ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে
( ও ভাই ) আগুন জ্বলে পেটে রে।
আগুন জ্বলে সোনার গোলায়
( ও ভাই ) আগুন জ্বলে মাঠে রে।
খাক্ হয়ে যায় প্রাণের বাজার
( পোড়া ) ফসল কে আর কাটে রে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দল :
১০
ও তোর সাগর শুকায়ে গেল
কপালের কোন্ আগুনে রে
ও অভাগা।
দেখলি নে তুই চেয়ে
পাগল হয়ে ছুটলি কেবল ধেয়ে
নিজের পায়ে লক্ষ্ণী ঠেলে
আজ কি তোর পথেই মরণ রে।
ভাঙা ঘর গড়ার তালে
ওঠ্-না মেতে এই সকালে।
( তোরা সব ) হাত লাগা-না ছেলে মেয়ে
মৃত্যু ছেড়ে লড়তে হবে যে
জীবনের লাল ফাগুনে রে।
দ্বিতীয় দল :
১১
পথে পথে শঙ্কা
মোড়ে মোড়ে বাজে মৃত্যুর জয়ডঙ্কা।
ধনগৌরবে মাখা যুদ্ধের অঙ্গ।
আমরা তো সৈনিক
বুভুক্ষ দৈনিক
আমরা কি দেব রণে ভঙ্গ।
প্রথম দল :
১২
হিংসা হেনেছে কত অস্ত্র
ধর্ষিতা পৃথ্বীরে করেছে বিবস্ত্র।
থেমে যায় গান,
ভেঙে পড়ে সৌধ
ভেঙে পড়ে সুন্দর স্তম্ভ।
নিরীহ শিশুরে মারে নিষ্ঠুরতম,
এই শুধু হিংসার দম্ভ।
প্রথম ও দ্বিতীয় দল:
১৩
মানুষের মুক্তির যুদ্ধে আমরা যে সৈনিক।
মরেছি, মেরেছি লক্ষ শত্রুকে যে দৈনিক।
জীবনের সৌধকে গড়ব
মৃত্যুর সাথে তাই লড়ব।
মানুষের শত্রুকে আকাশের মাটিতে কাটি
দৈনিক।
আমরা যে মুক্তির সৈনিক।
তৃতীয় দল :
১৪
ও শহরের বন্ধু রে !
ঘরের বার করল দেখি আমারে।
নির্দয় এই বন্যা এলো
মাঠ-পোড়ানো আকাল এলো গো
আর যা ছিল মাঠের সোনা
দস্যু এসে লুঠলো রে।
ঘরের বার করল দেখি আমারে।
মরীচিকার ফাঁদে পড়ে
এখন মরি শহরে।
ঘরের বার করল দেখি আমারে।
প্রথম ও দ্বিতীয় দল :
১৫
আমরা আছি কাছাকাছি
ভয় কি তোদের
যা গেছে তা গেছে রে---ভয়
নেই তো মোদের।
আমরা সবাই লড়ছি,
যে যার মতো গড়ছি,
গ্রামের বন্ধু মরলে কোথায়
ভরসা মোদের।
শত্রু প্রবল হলে ততই
মারব ওদের।
চতুর্থ দল :
১৬
হেঁইও হো হেঁইও হো।
ঝড়ে ভাঙা ঘর কত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবেই।
প্রাণের দেউলে কত বঁধুরা প্রদীপ জ্বালাবেই।
মযূরপঙ্খী ভাঙা জোড়া দেয় মাঝি
সারা দিন রাত
হাতুড়ি ও বাটালির শব্দে
মুখর এ নদী প্রান্তর।
হেঁইও হো হেঁইও হো।
চতুর্থ দল:
১৭
সারি সারি নৌকা, সারি সারি নৌকা
বেজেছে কি ছাড়বার ডঙ্কা।
মজবুত হয়ে গেছে হাল
তালি দিয়ে তোলে ঊর্দ্বে
রৌদ্রোজ্জ্বল রাঙা পাল
বদর, বদর, বদর, বদর।
চতুর্থ দল :
১৮
জেলেরা বুনবে নূতন জাল।
মাছের রুপোয় ঝলসে উঠবে
অনাহার মৃত চোখগুলি সব
পল্লীর যত হতাশায় নেভা চোখ।
চতুর্থ দল :
১৯
তাঁতের তালিতে করতালি দেবে এ আকাশ
পল্লীর প্রান্তর।
দস্যুরা হবে বানচাল।
ভুলব রোগ ভুলব শোক
ভুলে যাব যত গ্লানি।
সকলে :
২০
( এসো ) হাত লাগাই হাত লাগাই হাত লাগাই।
ভেঙে পড়া গ্রাম প্রাণের দুর্গ
ফিরে বানাই।
কুমোরে ছুতোরে, চাষীতে তাঁতীতে
জেলেতে মাঝিতে হাত লাগাই।
প্রহরী যে মোরা প্রাণের দুর্গ
ফিরে বানাই।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
নবজীবনের গান
প্রথমপর্ব শেষ॥
ঃঃঃঃঃঃঃ
নবজীবনের গান
দ্বিতীয় পর্ব
পঞ্চম দল :
২১
দূরের বন-গন্ধ নব ছন্দ আনে প্রাণে
কন্ঠে প্রতিরন্ধ্রে প্রতিবন্ধ ভাঙে গানে।
এবার মোরা বাঁধব কটি ঋজুতা ভরি অঙ্গে
সবার সাথে মিতালি হাতে কাটাব নব সঙ্গে।
জয়ের পানে বজ্র বুকে দীপ্ত মুখে যাত্রা।
কে দেবে বাধা মোদের পায়ে প্রবল দ্রুত মাত্রা।
দ্বিতীয় দল :
২২
আবার দেখেছ আবার শুনেছ কি
গান ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠে আসে পথে কঙ্কালসার
ধ্বনি।
পারবে না কি এ দুর্ভিক্ষেরে ঠকাতে
শকুনির মেঘে ছেয়ে গেছে এ আকাশ
লোলুপ চঞ্চু শাণিত বিজুলী হানে
ভুলো না কিছুতে ভুলো না
কঠিন কর্মপন্থা চপল গানে।
প্রথম ও পঞ্চম দল :
২৩
পারব ঠেকাতে পারব,
ধরব চোর, ধরব চোর, ধরব।
পালাবে কি তারা লভ্যের আড়ালে
দুর্ভিক্ষের দূত এরা মৃত্যুর।
যারা শবের বুকের উপরে চালায়
অমিত লাভের নৃত্য
জনগণ আয়ু বেচে কিনে যারা
জমায় প্রচুর বিত্ত
এরা চোর, এরা শত্রু
মরবে টুঁটি-চেপা হাত বাড়ালে
ধরব চোর, ধরব চোর, ধরব।
সকলে :
২৪
এবার মোরা ঠিক করেছি
সবাই মিলে যুঝব,
নিজের গন্ডি পেরিয়ে আমরা
পরস্পরকে বুঝব।
অনেক দুঃক অনেক মৃত্যু বহু লাঞ্ছনা পেরিয়ে
মহামারীর ওই চিতাবহ্নিকে এড়িয়ে
নূতন রাজ্য গড়ব।
যষ্ঠ দল :
২৫
আমরা ফিরি করি পথে বিড়ি পাকাই।
কলে ও কারখানায়
নিজেদের আয়ু বিলিয়ে যাই
আমরা মার খাই, তবু মার দিই
আর বেঘোরে মরি,
যুঝবই তবু গড়বই মোরা কাহারে ডরি।
সকলে :
২৬
আমরা জনসাধারণ, মোরা সাধারণ জনসাধারণ।
আমরা খাটি, আমরা লড়ি, আমরা মরি,
আমরা উঠি আমরা পড়ি আমরা গড়ি।
অনেক দূতের মন্ত্রণা নিই কানে,
তাইতে ফিরি মোরা হাজার টানে,
কেউ বা বলে ভাঙো আগুন জ্বালো,
কেউ বা বলে গড়ো জ্বালাও আলো
হাজার টানে হয়রান মোরা আমরণ !
তৃতীয় দল :
২৭
দেখ্ ছ কি সবই উজার হোলো।
( আহা ) ম্যালেরিয়ায় দেশ ছাইল
( আহা ) মহারোগে দেশ ছাইল
দেখ্ ছ কি সবই উজার হোলো।
এককালে সব ঘরে ঘরে
ছিল প্রাণের হাসি
এখন ঘরের লোককে চিতায় তুলে
হলেম শ্মশানবাসী ।
ভেঙে গেল সোনার হাটে প্রাণের মেলা দেখছ কি
দেখছ কি সবই উজার হোলো ।
প্রথম, দ্বিতীয় ও সপ্তম দল :
২৮
ভাঙ্ তে দেব না সোনার গ্রাম
ভাঙ্ তে দেব না এ শহর
দেব না কিছুতে দেব না
কান্নায় ভরা গ্রামেতে প্রাণের হাসিকে ফোটাব।
প্রথম, দ্বিতীয় ও সপ্তম দল :
২৯
মরে যেতে দেব না
আমার প্রানের অনুচর
ভেঙে গেলে ফের বাঁধি ঘর।
( মরে যেতে দেব না )
আমরা চিকিত্সক
ফুটো আয়ু মোরা জোড়া দিই
আর ছেঁড়া দেহে জুড়ি ত্বক।
সকলেরে দিই আশা
ওষুধের তূণও আছে অসংখ্য
রোগজয়ী বাণে ঠাসা।
( মরে যেতে দেব না )
কত গ্রাম কত জনপদ গেছে মুছে
শকুনিরা সব খেয়ে গেছে চেঁচে পুঁছে।
তবু মরণের মুখে তুড়ি দিয়ে আনি
মৃতপ্রায় মনে আশা
আবার ফোটাব প্রাণের উপনিবেশে
নবজীবনের ভাষা।
তৃতীয় দল :
৩০
ওই বুঝি প্রভাতের প্রথম আলোর চূড়া দেখা
যায়।
তবু দেখো যেতে হবে দূর
পথ হবে খুব বন্ধুর
এখন তো বাঁধনের বোঝা
ঝেড়ে ফেলে যেতে হবে দূর।
ওই বুঝি আলোকের প্রথম তোরণ চূড়া
দূড়ে দেখা যায়।
পঞ্চম দল :
৩১
শুনেছি শুনেছি শুনেছি তো সেই গান
আমরা বাঁধব কি সে সুরে মোদের প্রাণ
একি শুধু মিছে ছলনারই আহ্বান।
প্রথম দল :
৩২
নয় নয় এ তো ছলনা বাঁধন ছিঁড়েছে ওই ;
শিকল ভাঙার আর্তনাদ কি শুনি।
মানুষ জেগেছে বঞ্চিত পদানত
অধিকার তার জাগে বিশ্বের দ্বারে
শিকল ভাঙার মুক্তির ঝংকারে।
সমবেত :
৩৩
অসহ্য অসহ্য অসহ্য !!
ভেঙে ফেল ভেঙে ফেল
ভেঙে ফেল এই কারা,
শত পাকে ঘিরে বাঁধে নিষ্ঠুর লৌহ,
তবু প্রাণ পাক ছাড়া।
শুনেছি আকাশে মুক্ত পাখির গান
শুনেছি আকাশে ঝড়ে ঠাসা মেঘে
বজ্রের স্বরলিপি ।
খন্ড খন্ড করে ফেল বিধিলিপি
( মোদের ) পারবে না, পারবে না আর
বাঁধতে।
ভেঙে ফেল এই কারাগার
প্রাণ কল্লোলে গরজে মুক্তি পারাবার॥
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
নবজীবনের গান
দ্বিতীয় পর্ব শেষ॥
ঃঃঃঃঃঃঃ
এই পাতার পশ্চাৎপটের ছবিটি আন্দামানের সেলুলার জেলের, যা যে কোনো রাষ্ট্র দ্বারা তার জনগণের উপরে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতীক। আবার এই দেয়াল ও গরাদগুলিই স্বাধীনতাকামী মানুষের জীবনপণ করা প্রতিবাদেরও প্রতীক!
|
|
|
ঝঞ্ঝার গান কথা ও সুর - কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র (১৮.১১.১৯১১ - ২৬.১০.১৯৭৭)। দেবাশিস রায়চৌধুরী,
রোহিণী রায়চৌধুরী, শুভজিৎ, সৈকত ও অন্যান্য সমবেত শিল্পীবৃন্দের কণ্ঠে শুনুন এই গানটি। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর জন্ম
শতবার্ষিকীতে হিন্দুস্তান মিউজিকের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য “ধ্যান ভাঙো” অ্যালবামের ভিডিওটি সৌজন্যে HINDUSTHAN
MUSIC YouTube Channel.
কবির মূল “ঝঞ্ঝার গান”-এর ৬টি গান কে মিলিয়ে চারটি গান করে এখানে পরিবেশন করা হয়েছে। ক্রমাঙ্ক অনুসারে না
থাকলেও সব ক’টি গানই পরিবেশিত হয়েছে।
১
উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই, উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই, উন্মাদ ঝঞ্ঝা ওই,
ওই ঝঞ্ঝা বুঝি আসে, ওই ঝঞ্ঝা বুঝি আসে।
উত্তাল তরঙ্গ দোলায়
নিথর মন ভোলায়।
দুরন্ত বাতাসের দুর্জয় আহ্বানে
উলঙ্গ এ আকাশ অট্টহাসে॥
২
ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই।
মরণের পাল তুলে জীবন তো আসবেই, ভয় নেই।
ভাঙাগড়া দ্বন্দ্বের ঢেউ তুলে আসবেই, ভয় নেই।
আমাদের হাতে গড়া জীবন বহন করা
তরণী তো ভাসবেই, ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই।
ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই।
ভাঙা খসা ভেঙে যাক খসে যাক,
ঝরে যাওয়া মরে যাওয়া উড়ে যাক।
ক্ষয়ের পাত্র ভরে জীবন তো আসবেই, ভয় নেই।
৩
আমার একাকী আকাশ,
কি বাঁশি বাজিয়ে গেছে রাত্রি দিনে।
একতারা তান সেধে সেই সুরে পথ রচি ;
নির্জন পাহাড়ী দেশে
বিবাগী বেশে।
কত কথা বলে গেল ধ্যানের মানুষ মোর
কত সুরে ভরে দিল প্রাণ।
প্রবল ঝড়ের ডাকে সে বাঁশির তান
ডুবে গেল হায়------ ডুবে গেল হায়।
একতারা কলরোলে ডুবে গেল হায়।
৪
মিথ্যা এ হাহাকার,
ধ্যান ভাঙো , ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ঙাঙো।
ভেঙে যাক দূর নীল পাহাড়ের স্বপ্নের ঘোর।
ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ভাঙো, ধ্যান ভাঙো।
একাকী থাকার দিন,
ভেঙে গেছে, ভেঙে যাক, ভেঙে গেছে, ভেঙে যাক।
ধ্যানের মানুষে আজ মিশে গেছে হাজার মানুষ।
মিথ্যা এ হাহাকার।
৫
বর্বর বাধা আছে, আসুক-না বাধা
ঝঞ্ঝার আড়ালে।
দৈত্যের দেশ থেকে আসুক বাধা সেনাদল।
সাগরের গান শোনা আমাদের কান, আমাদের প্রাণ,
আমরা প্রবল , আমরা মানি না কোনো বাধা।
৬
বিষাক্ত মন্ত্রণা নাগিনী বাহিনী সম
ঘিরে ফেলে চারিদিক, সাবধান ! সাবধান !! সাবধান !!!
এখনো মনে কি আনো ভয়
মনে মনে রচো সংশয়।
বিষ-মন্ত্রের ডাকে রচে চলো দ্বন্দ্ব, রচে চলো দ্বন্দ্ব।
বর্বর আঘাতে আমাদের জীবনের
সহজ নদীর নীল হয়ে যাবে লাল, হয়ে যাবে লাল।
শোষণের মরুভূমি হাতছানি দেবে,
সাবধান, সাবধান !