*
মানসী
সূচনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাল্যকাল থেকে পশ্চিম-ভারত আমার কাছে রোম্যান্টিক কল্পনার বিষয় ছিল | এইখানেই নিরবচ্ছিন্নকাল
বিদেশীয়দের সঙ্গে এ দেশের সংযোগ ও সংঘর্ষ ঘটে এসেছে | বহু শতাব্দী ধরে এইখানেই ইতিহাসের
বিপুল পটভূমিকায় বহু সাম্রাজ্যের উত্থান পতন এবং নব নব ঐশ্বর্যের বিকাশ ও বিলয় আপন বিচিত্র
বর্ণের ছবির ধারা অঙ্কিত করে চলেছে | অনেক দিন ইচ্ছা করেছি এই পশ্চিম-ভারতের কোনো এক
জায়গায় আশ্রয় নিয়ে ভারতবর্ষের বিরাট বিক্ষুব্ধ অতীত যুগের স্পর্শলাভ করব মনের মধ্যে | অবশেষে
এক সময়ে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলুম | এত দেশ থাকতে কেন যে গাজিপুর বেছে নিয়েছিলুম তার দুটো
কারণ আছে | শুনেছিলুম গাজিপুরে আছে গোলাপের খেত | আমি যেন মনের মধ্যে গোলাপবিলাসী
সিরাজের ছবি এঁকে নিয়েছিলুম | তারই মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল | সেখানে গিয়ে দেখলুম
ব্যাবসাদারের গোলাপের খেত, এখানে বুলবুলের আমন্ত্রণ নেই, কবিরও নেই | হারিয়ে গেল সেই ছবি |
অপর পক্ষে, গাজিপুরে মহিমান্বিত প্রাচীন ইতিহাসের স্বাক্ষর কোথাও বড়ো রেখায় ছাপ দেয় নি | আমার
চোখে এর চেহারা ঠেকল সাদা-কাপড় পরা বিধবার মতো, সেও কোনো বড়োঘরের ঘরণী নয় |

তবু গাজিপুরেই রয়ে গেলুম, তার একটা কারণ এখানে ছিলেন আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় গগনচন্দ্র
রায়, আফিম-বিভাগের একজন বড়ো কর্মচারী | এখানে আমার সমস্ত ব্যবস্থা সহজ হল তাঁরই সাহায্যে |
একখানা বড়ো বাংলা পাওয়া গেল, গঙ্গার ধারেও বটে, ঠিক গঙ্গার ধারেও নয় | প্রায় মাইলখানেক চর
পড়ে গেছে, সেখানে যবের ছোলার শর্ষের খেত ; দূর থেকে দেখা যায় গঙ্গার জলধারা, গুণ-টানা নৌকা
চলেছে মন্থর গতিতে | বাড়ির সংলগ্ন অনেকখানি জমি, অনাদৃত, বাংলাদেশের মাটি হলে জঙ্গল হয়ে
উঠত | ইঁদারা থেকে পূর চলছে নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে কলকল শব্দে | গোলকচাঁপার ঘনপল্লব থেকে কোকিলের
ডাক আসত রৌদ্রতপ্ত প্রহরের ক্লান্ত হাওয়ায় | পশ্চিম কোণে প্রাচীন একটা মহানিম গাছ, তার বিস্তীর্ণ
ছায়াতলে বসবার জায়গা | সাদা ধুলোর রাস্তা চলেছে বাড়ির গা ঘেঁষে, দূরে দেখা যায় খোলার-চালওয়ালা
পল্লী |

গাজিপুর আগ্রা-দিল্লীর সমকক্ষ নয়, সিরাজ-সমরখন্দের সঙ্গেও এর তুলনা হয় না---- তবু মন নিমগ্ন হল
অক্ষুণ্ণ অবকাশের মধ্যে | আমার গানে আমি বলেছি, আমি সুদূরের পিয়াসী | পরিচিত সংসার থেকে
এখানে আমি সেই দূরত্বের দ্বারা বেষ্টিত হলুম, অভ্যাসের স্থূলহস্তাবলেপ দূর হবামাত্র মুক্তি  এল
মনোরাজ্যে | এই আবহাওয়ায় আমার কাব্যরচনার একটা নতুন পর্ব আপনি প্রকাশ পেল | আমার
কল্পনার উপর নূতন পরিবেষ্টনের প্রভাব বার বার দেখেছি | এইজন্যেই আলমোড়ায় যখন ছিলুম আমার
লেখনী হঠাৎ নতুন পথ নিল  ‘শিশু’র কবিতায়, অথচ সে-জাতীয় কবিতার কোনো প্রেরণা কোনো
উপলক্ষই সেখানে ছিল না | পূর্বতন রচনাধারা থেকে স্বতন্ত্র এ একটা নূতন কাব্যরূপের প্রকাশ ‘মানসী’ও
সেই রকম | নূতন আবেষ্টনে এই কবিতাগুলি সহসা যেন নবদেহ ধারণ করল | পূর্ববর্তী ‘কড়ি ও কোমল’
-এর সঙ্গে এর বিশেষ মিল পাওয়া যাবে না | আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে
ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি | মানসীতেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছে |  কবির
সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল |

উদয়ন | শান্তিনিকেতন
২৮/ ২/ ১৯৪০


.                                     ******************************************      


.                                                                                  
মানসীর সূচির পাতায় . . .    


মিলনসাগর
মানসী
www.milansagar.com
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
উপহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নিভৃত এ চিত্তমাঝে            নিমেষে নিমেষে বাজে
জগতের তরঙ্গ-আঘাত ,
ধ্বনিতে হৃদয়ে তাই                মুহূর্ত বিরাম নাই
নিদ্রাহীন সারা দিনরাত |
সুখ দুঃখ গীতস্বর                 ফুটিতেছে নিরন্তর
ধ্বনি শুধু, সাথে নাই ভাষা |
বিচিত্র সে কলরোলে          ব্যাকুল করিয়া তোলে
জাগাইয়া বিচিত্র দুরাশা |
এ চিরজীবন তাই              আর কিছু কাজ নাই,
রচি শুধু অসীমের সীমা |
আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে,      তাহে ভালোবাসা দিয়ে
গড়ে তুলি মানসী-প্রতিমা |

বাহিরে পাঠায় বিশ্ব                  কত গন্ধ গান দৃশ্য
সঙ্গীহারা সৌন্দর্যের বেশে,
বিরহী সে ঘুরে ঘুরে                ব্যথাভরা কত সুরে
কাঁদে হৃদয়ের দ্বারে এসে |
সেই মোহমন্ত্র গানে                   কবির গভীর প্রাণে
জেগে ওঠে বিরহী ভাবনা,
ছাড়ি অন্তঃপুরবাসে                 সলজ্জ চরণে আসে
মূর্তিমতী মর্মের কামনা |
অন্তরে বাহিরে সেই                  ব্যাকুলিত মিলনেই
কবির একান্ত সুখোচ্ছাস
সেই আনন্দমুহূর্তগুলি                তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ |

জোড়াসাঁকো
৩০ বৈশাখ, ১৮৯০ [ খৃষ্টাব্দ ]

.         ***************************     
.                                                                                            
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।