*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
ভুলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া,
এসেছি ভুলে |
তবু একবার চাও মুখপানে
নয়ন তুলে|
দেখি, ও নয়নে নিমেষের তরে
সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,
সজল আবেগে আঁখিপাতা দুটি
পড়ে কি ঢুলে |
ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না,
এসেছি ভুলে |

বেল-কুঁড়ি দুটি করে ফুটি ফুটি
অধর খোলা |
মনে পড়ে গেল সেকালের সেই
কুসুম তোলা |
সেই শুকতারা সেই চোখে চায়,
বাতাস কাহারে খুঁজিয়া বেড়ায়,
ঊষা না ফুটিতে হাসি ফুটে তার
গগনমূলে |
সেদিন যে গেছে ভুলে গেছি, তাই
এসেছি ভুলে |

ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে
পড়ে না মনে,
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে
নাই স্মরণে |
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি
লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয়-উছাস
নয়নকূলে |
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই
এসেছি ভুলে |
কাননের ফুল, এরা তো ভোলে নি,
আমরা ভুলি ?
সেই তো ফুটেছে পাতায় পাতায়
কামিনীগুলি !
চাঁপা কোথা হতে এনেছে ধরিয়া
অরুণকিরণ কোমল করিয়া,
বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায়
কাহার চুলে ?
কেহ ভোলে, কেউ ভোলে না যে, তাই
এসেছি ভুলে |

এমন করিয়া কেমনে কাটিবে
মাধবী রাতি ?
দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে
সাথের সাথি !
চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়,
সুখে আছে যারা তারা গান গায়----
আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে,
বিকচ ফুলে,
এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ
আসিলে ভুলে ?

.                                                 বৈশাখ,   ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                            
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভুল-ভাঙা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর |
মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর |
নেই আর সেই চুপি-চুপি চাওয়া,
ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া---
চেয়ে আছে আঁখি, নাই ও আঁখিতে
প্রেমের ঘোর |
বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ
বাহুতে মোর

হাসিটুকু আর পড়ে না তো ধরা
অধরকোণে |
আপনারে আর চাহ না লুকাতে
আপন মনে |
স্বর শুনে আর উতলা হৃদয়
উথলি উঠে না সারা দেহময়,
গান শুনে আর ভাসে না নয়নে
নয়নলোর |
আঁখিজলরেখা ঢাকিতে চাহে না
শরম চোর |

বসন্ত নাহি এ ধরায় আর
আগের মতো,
জ্যোত্স্নাযামিনী যৌবনহারা
জীবনহত |
আর বুঝি কেহ বাজায় না বীণা,
কে জানে কাননে ফুল ফোটে কি না---
কে জানে সে ফুল তোলে কি না কেউ
ভরি আঁচোর !
কে জানে সে ফুলের মালা গাঁথে কি না
সারা প্রহর !

বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু যেই
থামিল বাঁশি----
এখন কেবল চরণে শিকল
কঠিন ফাঁসি |
মধু নিশা গেছে, স্মৃতি তারি আজ
মর্মে মর্মে হানিতেছে লাজ—
সুখ গেছে, আছে সুখের ছলনা
হৃদয়ে তোর |
প্রেম গেছে, শুধু আছে প্রাণপণ
মিছে আদর |

কতই না জানি জেগেছ রজনী
করুণ দুখে,
সদয় নয়নে চেয়েছ আমার
মলিন মুখে |
পরদুখভারসহে নাকো আর,
লতায়ে পড়িছে দেহ সুকুমার----
তবু আসি আমি পাষাণহৃদয়
বড়ো কঠোর |
ঘুমাও, ঘুমাও, আঁখি ঢুলে আসে
ঘুমে কাতর |

৪৯, পার্ক স্ট্রীট
বৈশাখ,  ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                            
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিরহানন্দ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই ছন্দে যে যে স্থানে ফাঁক সেইখানে দীর্ঘযতিপতন আবশ্যক


ছিলাম নিশিদিন   আশাহীন   প্রবাসী
বিরহতপোবনে    আনমনে   উদাসী |
আঁধারে আলো মিশে   দিশে  দিশে  খেলিত,
অটহী বায়ুবশে     উঠিত সে    উছাসি |
কখনো ফুল দুটো   আঁখিপুট   মেলিত,
কখনো পাতা ঝরে   পড়িত  রে   নিশাসি |

তবু সে ছিনু ভালো   আধা-আলো-    আঁধারে,
গহন শত-ফের   বিষাদের     মাঝারে |
নয়নে কত ছায়া     কত মায়া    ভাসিত,
উদাস বায়ু সে তো    ডেকে যেত    আমারে |
ভাবনা কত সাজে      হৃদিমাঝে    আসিত,
খেলিত অবিরত       কত শত    আকারে !    
                                              
বিরহপরিপূত    ছায়াযুত   শয়নে
ঘুমের সাথে স্মৃতি    আসে নিতি   নয়নে |
কপোত দুটি ডাকে     বসি শাখে   মধুরে,
দিবস চলে যায়    গলে যায়     গগনে |
কোকিল কুহুতানে    ডেকে আনে   বধূরে,
নিবিড় শীতলতা      তরুলতা   গহনে |

আকাশে চাহিতাম    গাহিতাম   একাকী,
মনের যত কথা    ছিল সেথা    লেখা কি ?
দিবসনিশি ধ’রে   ধ্যান ক’রে     তাহারে
নীলিমা-পরপার     পাব তার    দেখা কি ?
তটিনী অনুখন    ছোটে কোন্   পাথারে,
আমি যে গান গাই      তারি ঠাঁই   শেখা কি ?

বিরহে তারি নাম   শুনিতাম   পবনে,
তাহারি সাথে থাকা     মেঘে ঢাকা    ভবনে |
পাতার মরমর    কলেবর   হরষে,
তাহারি পদধ্বনি   যেন গনি    কাননে |
মুকুল সুকুমার   যেন তার      পরশে,
চাঁদের চোখে ক্ষুধা    তারি সুধা  -স্বপনে |

করুণা অনুখন     প্রাণ মন    ভরিত,
ঝরিলে ফুলদল    চোখে জল    ঝরিত |
পবন হু হু ক’রে   করিত রে   হাহকার,
ধরার তরে যেন     মোর প্রাণ   ঝুরিত |
হেরিলে দুখে শোকে      কারো চোখে    আঁখিধার
তোমারি আঁখি কেন       মনে মনে     পড়িত |

শিশুরে কোলে নিয়ে      জুড়াইয়ে     যেত বুক,
আকাশে বিকশিত      তোরি মতো    স্নেহমুখ |
দেখিলে আঁখি-রাঙা     পাখা-ভাঙা     পাখিটি
‘আহাহা’ ধ্বনি তোর      প্রাণে মোর     দিত দুখ |
মুছালে দুখনীর      দুখিনীর  আঁখিটি,
জাগিত মনে ত্বরা     দয়া-ভরা     তোর সুখ |

সারাটা দিনমান      রচি গান     কত-না !
তোমারি পাশে রহি    যেন কহি      বেদনা |
কানন মরমরে      কত স্বরে    কহিত,
ধ্বনিত যেন দিশে     তোমারি সে      রচনা |
সতত দূরে কাছে      আগে পাছে     বহিত
তোমারি যত কথা      পাতা-লতা     ঝরনা |

তোমারে আঁকিতাম,     রাখিতাম   ধরিয়া
বিরহ ছায়াতল     সুশীতল    করিয়া |
কখনো দেখি যেন     ম্লান-হেন    মুখানি,
কখনো আঁখিপুটে     হাসি উঠে     ভরিয়া |
কখনো সারা রাত     ধরি হাত     দুখানি
রহি গো বেশবাসে     কেশপাশে    মরিয়া |

বিরহ সুমধুর    হল দূর    কেন রে ?
মিলনদাবানলে     গেল জ্বলে    যেন রে |
কই সে দেবী কই ?  হেরো ওই     একাকার,
শ্মশানবিলাসিনী    বিবাসিনী   বিহরে |
নাই গো দয়ামায়া    স্নেহছায়া    নাহি আর---
সকলি করে ধুধু,    প্রাণ শুধু    শিহরে  |

জ্যৈষ্ঠ, ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                          
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ক্ষণিক মিলন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একদা এলোচুলে      কোন্ ভুলে   ভুলিয়া
আসিল সে আমার   ভাঙা দ্বার    খুলিয়া |
জ্যোত্স্না অনিমিখ,  চারি দিক     সুবিজন,
চাহিল একবার       আঁখি তার    তুলিয়া |
দখিনবায়ুভরে        থরথরে       কাঁপে বন,
উঠিল প্রাণ মম        তারি সম     দুলিয়া |

আবার ধীরে ধীরে     গেল ফিরে    আলসে,
আমার সব হিয়া       মাড়াইয়া      গেল  সে |
আমার যাহা ছিল      সব নিল       আপনায়,
হরিল আমাদের        আকাশের    আলো সে |
সহসা এ জগৎ           ছায়াবৎ      হয়ে যায়,
তাহারি চরণের         শরণের       লালসে |

যে জন চলিয়াছে      তারি পাছে    সবে ধায়,
নিখিলে যত প্রাণ      যত গান    ঘিরে তায় |
সকল রূপহার     উপহার    চরণে,
ধায় গো উদাসিয়া    যত হিয়া    পায় পায় |
যে জন পড়ে থাকে     একা ডাকে    মরণে,
সুদূর হতে হাসি      আর বাঁশি    শোনা যায় |

শবদ নাহি আর,     চারি ধার    প্রাণহীন---
কেবল ধুক্ ধুক্       করে বুক   নিশিদিন |
যেন গো ধ্বনি এই    তারি সেই   চরণের
কেবলি বাজে শুনি,   তাই গুনি   দুই তিন |
কুড়ায়ে সব-শেষ     অবশেষ   স্মরণের
বসিয়া একজন     আনমন    উদাসীন |

জোড়াসাঁকো
৯ ভাদ্র, ১৮৮৯

.         ***************************     

.                                                                          
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শূন্য হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আবার মোরে           পাগল করে
দিবে কে  ?
হৃদয় যেন              পাষাণ-হেন
বিরাগ-ভরা বিবেক |
আবার  প্রাণে         নূতন টানে
প্রেমের নদী
পাষাণ হতে         উছল স্রোতে
বহায় যদি !
আবার দুটি           নয়নে লুটি
হৃদয় হরে নিবে কে ?
আবার মোরে      পাগল করে
দিবে কে ?

আবার কবে          ধরণী হবে
তরুণা ?
কাহার প্রেমে      আসিবে নেমে
স্বরগ হতে করুণা ?
নিশীথনভে           শুনিব কবে
গভীর গান,
যে দিকে চাব      দেখিতে পাব
নবীন প্রাণ,
নূতন প্রীতি       আনিবে নিতি
কুমারী ঊষা অরুণা---
আবার কবে         ধরণী হবে
তরুণা ?

কোথা এ মোর       জীবন—ডোর
বাঁধা রে ?
প্রেমের ফুল           ফুটে আকুল
কোথায় কোন্ আঁধারে ?
গভীরতম                বাসনা মম
কোথায় আছে ?
আমার গান         আমার প্রাণ
কাহার কাছে ?
কোন্ গগনে       মেঘের কোণে
লুকায়ে কোন্ চাঁদা রে ?
কোথায় মোর          জীবন-ডোর
বাঁধা রে ?

অনেক দিন               পরানহীন
ধরণী |
বসনাবৃত            খাঁচার মতো
তামসঘনবরনী |
নাই সে শাখা,       নাই সে পাখা,
নাই সে পাতা,
নাই সে ছবি,          নাই সে রবি,
নাই সে গাথা----
জীবন চলে            আঁধার জলে
আলোকহীন তরণী |
অনেক দিন                পরানহীন
ধরণী |

মায়াকারায়            বিভোর-প্রায়
সকলি,
শতেক পাকে          জড়ায়ে রাখে
ঘুমের ঘোর শিকলি |
দানব-হেন            আছে কে যেন
দুয়ার আঁটি |
কাহার কাছে         না জানি আছে
সোনার কাঠি ?
পরশ লেগে             উঠিবে জেগে
হরষ-রস-কাকলি !
মায়াকারায়             বিভোর-প্রায়
সকলি  |

দিবে সে খুলি            এ ঘোর ধূলি
আবরণ
তাহার হাতে            আঁখির পাতে
জগতজাগা জাগরণ |
সে হাসিখানি            আনিবে টানি
সবার হাসি ,
গড়িবে গেহ,             জাগাবে স্নেহ
জীবনরাশি |
প্রকৃতিবধূ                 চাহিবে মধু,
পরিবে নব আভরণ |
সে দিবে খুলি           এ ঘোর ধূলি-
আবরণ |

পাগল করে            দিবে সে মোরে
চাহিয়া,
হৃদয়ে এসে                মধুর হেসে
প্রাণের গান গাহিয়া |
আপনা থাকি          ভাসিবে আঁখি
আকুল নীরে,
ঝরনা-সম                   জগৎ মম
ঝরিবে শিরে |
তাহার বাণী           দিবে গো আনি
সকল বাণী বাহিয়া |
পাগল করে            দিবে সে মোরে
চাহিয়া  |

৪৯, পার্ক স্ট্রীট
আষাঢ়, ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আত্মসমর্পণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি     এ কেবল মিছে বলি,
শুধু        আপনার মন ছলি |
কঠিন বচন শুনায়ে তোমারে
আপন মর্মে জ্বলি |
থাক্ তবে থাক্ ক্ষীণ প্রতারণা,
কী হবে লুকায়ে বাসনা বেদনা,
যেমন আমার হৃদয়-পরান
তেমনি দেখাব খুলি |

আমি     মনে করি যাই দূরে,
তুমি     রয়েছ বিশ্ব জুড়ে |
যত দূরে যাই ততই তোমার
কাছাকাছি ফিরি ঘুরে |
চোখে চোখে থেকে কাছে নহ তবু,
দূরেতে থেকেও দূর নহ কভু,
সৃষ্টি ব্যাপিয়া রয়েছ তবুও
আপন অন্তপুরে |

আমি    যেমনি করিয়া চাই,
আমি      যেমনি করিয়া গাই,
বেদনাবিহীন ওই হাসিমুখ
সমান দেখিতে পাই
ওই রূপরাশি আপনা বিকাশি
রয়েছে পূর্ণ গৌরবে ভাসি ,
আমার ভিখারি প্রাণের বাসনা
হোথায় না পায় ঠাঁই |

শুধু       ফুটন্ত  ফুলমাঝে
দেবী,      তোমার চরণ সাজে |
অভাবকঠিন মলিন মর্ত
কোমল চরণে বাজে  |
জেনে শুনে তবু কী ভ্রমে ভুলিয়া
আপনারে আমি এনেছি তুলিয়া,
বাহিরে আসিয়া দরিদ্র আশা
লুকাতে চাহিছে লাজে |

তবু      থাক্ পড়ে ওইখানে,
চেয়ে     তোমার চরণপানে |
যা দিয়েছি তাহা গেছে চিরকাল,
আর ফিরিবে না প্রাণে |
তবে ভালো করে দেখো একবার
দীনতা হীনতা যা আছে আমার,
ছিন্ন মলিন অনাবৃত হিয়া
অভিমান নাহি জানে |

তবে     লুকাব না আমি আর
এই    ব্যথিত হৃদয়ভার
আপনার হাতে চাব না রাখিতে
আপনার অধিকার |
বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিয়া লাজ,
বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ,
আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি
জানাইনু শত বার |

জোড়াসাঁকো,
১১ ভাদ্র, ১৮৮৯

.         ***************************     

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিষ্ফল কামনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৃথা এ ক্রন্দন !
বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা !

রবি অস্ত যায় |
অরণ্যতে অন্ধকার, আকাশেতে আলো |
সন্ধ্যা নত-আঁখি
ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে |
বহে কি না বহে
বিদায়বিষাদশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস
দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে
চেয়ে আছি দুটি আঁখি-মাঝে |
খুঁজেতেছি, কোথা তুমি,
কোথা তুমি !
যে অমৃত লুকানো তোমায়
সে কোথায় !
অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,
ওই নয়নের
নিবিড়তিমিরতলে কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্যশিখা |
তাই চেয়ে আছি |
প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবেতেছি
অতল আকাঙ্ক্ষা-পারাবারে |
তোমার আঁখির মাঝে,
হাসির আড়ালে,
বচনের সুধাস্রোতে,
তোমার বদনব্যাপী
করুণ শান্তির তলে
তোমারে কোথায় পাব---
তাই এ ক্রন্দন !

বৃথা এ ক্রন্দন !
হায় রে দুরাশা !
এ রহস্য এ আনন্দ তোর তরে নয় |
যাহা পাস তাই ভালো,
হাসিটুকু, কথাটুকু,
নয়নের দৃষ্টিটুকু,
প্রেমের আভাস |
সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,
এ কী দুঃসাহস !
কী আছে বা তোর,
কী পারিবি দিতে !
আছে কি অনন্ত প্রেম ?
পারিবি মেটাতে
জীবনের অনন্ত অভাব ?
মহাকাশ-ভরা
এ অসীম জগৎ-জনতা,
এ নিবিড় আলো অন্ধকার,
কোটি ছায়াপথ, মায়াপথ,
দুর্গম উদয়-অস্তাচল,
এরই মাঝে পথ করি
পারিবি কি নিয়ে যেতে
চিরসহচরে
চিররাত্রিদিন
একা অসহায় ?
যে জন আপনি ভীত, কাতর, দুর্বল,
ম্লান, ক্ষুধাতৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা,
আপন হৃদয়ভারে পীড়িত জর্জর,
সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন-তরে ?

ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব,
কেহ নহে তোমার আমার
অতি সযতনে,
অতি সংগোপনে,
সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে,
বিপদে সম্পদে,
জীবনে মরণে,
শত ঋতু-আবর্তনে
বিশ্বজগতের তরে, ঈশ্বরের তরে
শতদল উঠিতেছে ফুটি ;
সুতীক্ষ্ম বাসনা-ছুরি দিয়ে
তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে ?
লও তার মধুর সৌরভ,
দেখো তার সৌন্দর্যবিকাশ,
মধু তার করো তুমি পান,
ভালোবাসো,  প্রেমে হও বলী,
চেয়ো না তাহারে |
আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের |
শান্ত সন্ধ্যা স্তব্ধ কোলাহল
নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে,
চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই |

১৩ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সংশয়ের আবেগ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালোবাস কি না বাস বুঝিতে পারি নে,
তাই কাছে থাকি |
তাই তব মুখপানে রাখিয়াছি মেলি
সর্বগ্রাসী আঁখি |
তাই সারা রাত্রিদিন   শ্রান্তি-তৃপ্তি-নিদ্রাহীন
করিতেছি পান---
যতটুকু হাসি পাই, যতটুকু কথা,
যতটুকু গান |

তাই কভু ফিরে যাই, কভু ফেলি শ্বাস,
কভু ধরি হাত |
কখনো কঠিন কথা, কখনো সোহাগ,
কভু অশ্রুপাত |
তুলি ফুল দেব ব’লে,     ফেলে দিই ভূমিতলে
করি’ খান খান |
কখনো আপন মনে আপনার সাথে
করি অভিমান |

জানি যদি ভালোবাস চির-ভালোবাসা
জনমে বিশ্বাস,
যেথা তুমি যেতে বল সেথা যেতে পারি---
ফেলি নে নিশ্বাস |
তরঙ্গিত এ হৃদয়    তরঙ্গিত সমুদয়
বিশ্বচরাচর
মুহূর্তে হইবে শান্ত, টলমল প্রাণ
পাইবে নির্ভর |

বাসনার তীব্র জ্বালা দূর হয়ে যাবে,
যাবে অভিমান---
হৃদয়দেবতা হবে, কবির চরণে
পুষ্প-অর্ঘ্য দান |
দিবানিশি অবিরল       লয়ে শ্বাস অশ্রুজল
লয়ে হাহুতাশ
চির ক্ষুধাতৃষা লয়ে আঁখির সম্মুখে
করিব না বাস |

তোমার প্রেমের ছায়া আমারে ছাড়ায়ে
পড়িবে জগতে,
মধুর আঁখির আলো পড়িবে সতত
সংসারের পথে |
দূরে যাবে ভয় লাজ,     সাধিব আপন কাজ
শতগুণ বলে----
বাড়িবে আমার প্রেম পেয়ে তব প্রেম,
দিব তা সকলে |

নহে তো আঘাত করো কঠোর কঠিন
কেঁদে যাই চলে |
কেড়ে লও বাহু তব, ফিরে লও আঁখি,
প্রেম দাও দ’লে |
কেন এ সংশয়ডোরে   বাঁধিয়া রেখেছ মোরে,
বহে যায় বেলা |
জীবনের কাজ আছে----- প্রেম নহে ফাঁকি,
প্রাণ নহে খেলা |

১৫ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
তবু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তবু মনে রেখো, যদি দূরে যাই চলি,
সেই পুরাতন প্রেম যদি এক কালে
হয়ে আসে দূরস্মৃত কাহিনী কেবলি—
ঢাকা পড়ে নব নব জীবনের জালে |
তবু মনে রেখো, যদি বড়ো কাছে থাকি,
নূতন এ প্রেম যদি হয় পুরাতন,
দেখে না দেখিতে পায় যদি শ্রান্ত আঁখি---
পিছনে পড়িয়া থাকি ছায়ার মতন |
তবু মনে রেখো, যদি তাহে মাঝে মাঝে
উদাস বিষাদভরে কাটে সন্ধ্যাবেলা,
অথবা শারদ প্রাতে বাধা পড়ে কাজে,
অথবা বসন্ত-রাতে থেমে যায় খেলা |
তবু মনে রেখো, যদি মনে প’ড়ে আর
আঁখিপ্রান্তে দেখা নাহি দেয় অশ্রুধার |

১৫ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                  
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিচ্ছেদের শান্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সেই ভালো, তবে তুমি যাও |
তবে আর কেন মিছে করুণনয়নে
আমার মুখের পানে চাও !
এ চোখে ভাসিছে জল,       এ শুধু মায়ার ছল,
কেন কাঁদি তাও নাহি জানি |
নীরব আঁধার রাতি,         তারকার ম্লানভাতি
মোহ আনে বিদায়ের বাণী |
নিশিশেষে দিবালোকে    এ জল রবে না চোখে,
শান্ত হবে অধীর হৃদয়----
জাগ্রত জগতমাঝে          ধাইব আপন কাজে,
কাঁদিবার রবে না সময় |

দেখেছি আনেক দিন          বন্ধন হয়েছে ক্ষীণ,
ছেঁড় নাই করুণার বশে |
গানে লাগিত না সুর,    কাছে থেকে ছিলে দূর ---
যাও নাই কেবল আলসে |
পরান ধরিয়া তবু          পারিতাম না তো কভু
তোমা ছেড়ে করিতে গমন |
প্রাণপণে কাছে থাকি        দেখিতাম মেলি আঁখি
পলে পলে প্রেমের মরণ |
তুমি তো আপনা হতে      এসেছ বিদায় ল’তে---
সেই ভালো, তবে তুমি যাও |
যে প্রেমেতে এত ভয়           এত দুঃখ লেগে রয়
সে বন্ধন তুমি ছিঁড়ে দাও |

আমি রহি এক ধারে,          তুমি যাও পরপারে,
মাঝখানে বহুক বিস্মৃতি ---
একেবারে ভুলে যেয়ো,       শতগুণে ভালো সেও,
ভালো নয় প্রেমের বিকৃতি |
কে বলে যায় না ভোলা!       মরণের দ্বার খোলা,
সকলেরই আছে সমাপন |
নিবে যায় দাবানল,                শুকায় সমুদ্রজল,
থেমে যায় ঝটিকার রণ |
থাকে শুধু মহা শান্তি,          মৃত্যুর শ্যামল কান্তি,
জীবনের অনন্ত নির্ঝর---
শত সুখ দুঃখ দ’লে              কালচক্র যায় চলে
রেখা পড়ে যুগ-যুগান্তর |

যেখানে যে এসে পড়ে          আপনার কাজ করে
সহস্র জীবন-মাঝে মিশে---
কত যায় কত থাকে,        কত ভোলে কত রাখে,
চলে যায় বিষাদে হরিষে |
তুমি আমি যাব দূরে---           তবুও জগৎ ঘুরে,
চন্দ্র সূর্য জাগে অবিরল,
থাকে সুখ দুঃখ লাজ,         থাকে শত শত কাজ,
এ জীবন হয় না নিষ্ফল |
মিছে কেন কাটে কাল,         ছিঁড়ে দাও স্বপ্নজাল,
চেতনার বেদনা জাগাও---
নূতন আশ্রয়-ঠাঁই,          দেখি পাই কি না পাই---
সেই ভালো তবে তুমি যাও !


১৪ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************        

.                                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com