|
একাল ও সেকাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী | গাঢ় ছায়া সারাদিন, মধ্যাহ্ন তপনহীন , দেখায় শ্যামলতর শ্যাম বনশ্রেণী | আজিকে এমন দিনে, শুধু পড়ে মনে সেই দিবা-অভিসার পাগলিনী রাধিকার না জানি সে কবেকার দূর বৃন্দাবনে | সেদিনও এমনি বায়ু রহিয়া রহিয়া--- এমন অশান্ত বৃষ্টি, তড়িতচকিত দৃষ্টি, এমনি কাতর হায় রমণীর হিয়া | বিরহিণী মর্মে-মরা মেঘমন্দ্র স্বরে— নয়নে নিমেষ নাহি, গগনে রহিত চাহি, আঁকিত প্রাণের আশা জলদের স্তরে | চাহিত পথিকবধূ শূন্য পথপানে | মল্লার গাহিত কারা, ঝরিত বরষধারা, নিতান্ত বাজিত গিয়া কাতর পরানে | যক্ষনারী বীণা কোলে ভুমিতে বিলীন--- বক্ষে পড়ে রুক্ষ কেশ অযত্নশিথিল বেশ---- সেদিনও এমনিতরো অন্ধকার দিন | সেই কদম্বের মূল, যমুনার তীর , সেই সে শিখীর নৃত্য এখনো হরিছে চিত্ত – ফেলিছে বিরহছায়া শ্রাবণতিমির | আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে | শরতের পূর্ণিমায় শ্রাবণের বরিষায় উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে | এখনো প্রেমের খেলা সারানিশি, সারাবেলা --- এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে | ২১ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শত শত প্রেমপাশে টানিয়া হৃদয় একি খেলা তোর ? ক্ষুদ্র এ কোমল প্রাণ, ইহারে বাঁধিতে কেন এত ডোর ? ঘুরে ফিরে পলে পলে ভালোবাসা নিস ছলে, ভালো না বাসিতে চাস হায় মনোচোর ! হৃদয় কোথায় তোর খুঁজিয়া বেড়াই নিষ্ঠুরা প্রকৃতি ! এত ফুল, এত আলো, এত গন্ধ গান, কোথায় পিরিতি ! আপন রূপের রাশে আপনি লুকায়ে হাসে, আমরা কাঁদিয়া মরি--- এ কেমন রীতি ! শূন্যক্ষেত্রে নিশিদিন আপনার মনে কৌতুকের খেলা | বুঝিতে পারি নে তোর কারে ভালোবাসা কারে অবহেলা | প্রভাতে যাহার ‘পর বড়ো-স্নেহ সমাদর, বিস্মৃত সে ধূলিতলে সেই সন্ধ্যাবেলা | তবু তোরে ভালোবাসি, পারি নে ভুলিতে অয়ি মায়াবিনী ! স্নেহহীন আলিঙ্গন জাগায় হৃদয়ে সহস্র রাগিণী | এই সুখে দুঃখে শোকে বেঁচে আছি দিবালোকে, নাহি চাহি হিমশান্ত অনন্ত যামিনী | আধো-ঢাকা আধো-খোলা ওই তোর মুখ রহস্যনিলয় প্রেমের বেদনা আনে হৃদয়ের মাঝে, সঙ্গে আনে ভয় | বুঝিতে পারি নে তব কত ভাব নব নব, হাসিয়া কাঁদিয়া প্রাণ পরিপূর্ণ হয় | প্রাণমন পসারিয়া ধাই তোর পানে, নাহি দিস ধরা | দেখা যায় মৃদু মধু কৌতুকের হাসি অরুণ-অধরা ! যদি চাই দূরে যেতে কত ফাঁদ থাক পেতে--- কত ছল, কত বল চপলা-মুখরা ! আপনি নাহিক জান আপনার সীমা, রহস্য আপন | তাই, অন্ধ রজনীতে যবে সপ্তলোক নিদ্রায় মগন, চুপি চুপি কৌতূহলে দাঁড়াস আকাশতলে, জ্বালাইয়া শত লক্ষ নক্ষত্রকিরণ | কোথাও বা বসে আছ চির-একাকিনী, চিরমৌনব্রতা ! চারি দিকে সুকঠিন তৃণতরুহীন মরুনির্জনতা | রবি শশী শিরোপর উঠে যুগ-যুগান্তর, চেয়ে শুধু চলে যায়, নাহি কয় কথা | কোথাও বা খেলা করে বালিকার মতো, উড়ে কেশ বেশ---- হাসিরাশি উচ্ছ্বসিত উত্সের মতন, নাহি লজ্জালেশ | রাখিতে পারে না প্রাণ আপনার পরিমাণ এত কথা এত গান নাহি তার শেষ | কখনো বা হিংসাদীপ্ত উন্মাদ নয়ন নিমষনিহত অনাথা ধরায় বক্ষে অগ্নি-অভিশাপ হানে অবিরত | কখনো বা সন্ধ্যালোকে উদাস উদার শোকে মুখে পড়ে ম্লান ছায়া করুণার মতো | তবে তো করেছ বশ এমনি করিয়া অসংখ্য পরান | যুগ-যুগান্ত ধ’রে রয়েছে নূতন মধুর বয়ান | সাজি শত মায়াবাসে আছ সকলেরই পাশে, তবু আপনারে কারে কর নাই দান | যত অন্ত নাহি পাই তত জাগে মনে মহা রূপরাশি | তত বেড়ে যায় প্রেম যত পাই ব্যথা, যত কাঁদি হাসি যত তুই দূরে যাস তত প্রাণে লাগে ফাঁস, যত তোরে নাহি বুঝি তত ভালোবাসি | ১৫ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
মরণস্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ | প্রথম সন্ধ্যায় ম্লান চাঁদ দেখা দিল গগনের কোণে | ক্ষুদ্র নৌকা থরথরে চলিয়াছে পালভরে কালস্রোতে যথা ভেসে যায় অলস ভাবনাখানি আধাজাগা মনে | এক পারে ভাঙা তীর ফেলিয়াছে ছায়া, অন্য পারে ঢালু তট শুভ্র বালুকায় মিশে যায় চন্দ্রালোকে--- ভেদ নাহি পড়ে চোখে--- বৈশাখের গঙ্গা কৃশকায়া তীরতলে ধীরগতি অলস লীলায় | স্বদেশ পুরব হতে বায়ু বহে আসে দূর স্বজনের যেন বিরহের শ্বাস | জাগ্রত আঁখির আগে কখনো বা চাঁদ জাগে কখনো বা প্রিয়মুখ ভাসে---- আধেক উলস প্রাণ আধেক উদাস | ঘনচ্ছায়া আম্রকুঞ্জ উত্তরের তীরে--- যেন তারা সত্য নহে, স্মৃতি-উপবন | তীব্র, তরু, গৃহ, পথ, জ্যোত্স্নাপটে চিত্রবৎ---- পড়িয়াছে নীলাকাশনীরে দূর মায়াজগতের ছায়ার মতন | স্বপ্নাকুল আঁখি মুদি ভাবিতেছি মনে---- রাজহংস ভেসে যায় অপার আকাশে দীর্ঘ শুভ্র পাখা খুলি চন্দ্রালোক-পানে তুলি, পৃষ্ঠে আমি কোমল শয়নে ; সুখের মরণসম ঘুমঘোর আসে | যেন রে প্রহর নাই, নাইক প্রহরী, এ যেন রে দিবাহারা অনন্ত নিশীথ | নিখিল নির্জন স্তব্ধ, শুধু শুনি জলশব্দ কলকল-কল্লোল-লহরী--- নিদ্রাপারাবার যেন স্বপ্নচঞ্চলিত | কত যুগ চলে যায় নাহি পাই দিশা --- বিশ্ব নিবু-নিবু, যেন দীপ তৈলহীন | গ্রাসিয়া আকাশ কায়া ক্রমে পড়ে মহাছায়া, নতশিরে বিশ্বব্যাপী নিশা গনিতেছে মৃত্যুপল এক দুই তিন | চন্দ্র শীর্ণতর হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়, কলধ্বনি ক্ষীণ হয়ে মৌন হয়ে আসে | প্রেতনয়নের মতো নির্নিমেষ তারা যত সবে মিলে মোর প্রাণে চায়, একা আমি জনপ্রাণী অখন্ড আকাশে| চির যুগরাত্রি ধ’রে শতকোটি তারা পরে পরে নিবে গেল গগনমাঝার | প্রাণপণে চক্ষু চাহি আঁখিতে আলোক নাহি, বিঁধিতে পারে না আঁখিতারা তুষারকঠিন মৃত্যুহিম অন্ধকার | অসাড় বিহঙ্গ-পাখা পড়িল ঝুলিয়া, লুটায় সুদীর্ঘ গ্রীবা -----নামিল মরাল | ধরিয়া অযুত অব্দ হুহূ পতনের শব্দ কর্ণরন্ধ্রে উঠে আকুলিয়া --- দ্বিধা হয়ে ভেঙে যায় নিশীথ করাল | সহসা এ জীবনের সমুদয় স্মৃতি ক্ষণেক জাগ্রত হয়ে নিমেষে চকিতে আমারে ছাড়িয়া দূরে পড়ে গেল ভেঙেচুরে, পিছে পিছে আমি ধাই নিতি--- একটি কণাও আর পাই না লিখিতে | কোথাও রাখিতে নারি দেহ আপনার সর্বাঙ্গ অবশ ক্লান্ত নিজ লৌহভারে | কাতরে ডাকিতে চাহি, শ্বাস নাহি, স্বর নাহি, কন্ঠেতে চেপেছে অন্ধকার ---- বিশ্বের প্রলয় একা আমার মাঝারে | দীর্ঘ তীক্ষ্ম হই ক্রমে তীব্র গতিবলে ব্যগ্রগামী ঝটিকার আর্তস্বরসম, সূক্ষ্ম বাণ সূচিমূখ অনন্ত কালের বুক বিদীর্ণ করিয়া যেন চলে--- রেখা হয়ে মিশে আসে দেহমন মম | ক্রমে মিলাইয়া গেল সময়ের সীমা, অনন্তে মুহূর্তে কিছু ভেদ নাহি আর | ব্যাপ্তিহারা শূন্যসিন্ধু শুধু যেন এক বিন্দু গাঢ়তম অন্তিম কালিমা ---- আমারে গ্রাসিল সেই বিন্দুপারাবার | অন্ধকারহীন হয়ে গেল অন্ধকার | ‘আমি’ বলে কেহ নাই, তবু যেন আছে | অচৈতন্যতলে অন্ধ চৈতন্য হইল বন্ধ, রহিল প্রতিক্ষা করি কার---- মৃত হয়ে প্রাণ যেন চিরকাল বাঁচে | নয়ন মেলিনু, সেই বহিছে জাহ্নবী--- পশ্চিমে গৃহের মুখে চলেছে তরণী | তীরে কুটিরের তলে স্তিমিত প্রদীপ জ্বলে, শূন্যে চাঁদ সুধামুখচ্ছবি | সুপ্ত জীব কোলে লয়ে জাগ্রত ধরণী | ১৭ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
কুহুধ্বনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রখর মধ্যাহ্নতাপে প্রান্তর ব্যপিয়া কাঁপে বাষ্পশিখা অনলশ্বসনা --- অন্বেষিয়া দশ দিশা যেন ধরণীর তৃষা মেলিয়াছে লেলিহা রসনা | ছায়া মেলি সারি সারি স্তব্ধ আছে তিন-চারি সিসুগাছ পাণ্ডুকিশলয়, নিম্ববৃক্ষ ঘনশাখা গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পে ঢাকা, আম্রবন তাম্রফলময় | গোলক-চাঁপার ফুলে গন্ধের হিল্লোল তুলে, বন হতে আসে বাতায়নে--- ঝাউগাছ ছায়াহীন নিশ্বসিছে উদাসীন শূন্যে চাহি আপনার মনে | দূরান্ত প্রান্তর শুধু তপনে করিছে ধূ ধূ, বাঁকা পথ শুষ্ক তপ্তকায়া---- তারি প্রান্তে উপবন, মৃদুমন্দ সমীরণ ফুল গন্ধ, শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া | ছায়ার কুটিরখানা দু ধারে বিছায়ে ডানা পক্ষীসম করিছে বিরাজ, তারি তলে সবে মিলি চলিতেছে নিরিবিলি সুখে দুঃখে দিবসের কাজ | কোথা হতে নিদ্রাহীন রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ দিন কোকিল গাহিছে কুহুস্বরে | সেই পুরাতন তান প্রকৃতির মর্মগান পশিতেছে মানবের ঘরে | বসি আঙিনার কোণে গম ভাঙে দুই বোনে, গান গাহে শ্রান্তি নাহি মানি | বাঁধা কূপ, তরুতল, বালিকা তুলিছে জল খরতাপে ম্লানমুখখানি | দূরে নদী, মাঝে চর---- বসিয়া মাচার ‘পর শস্যখেত আগলিছে চাষি | রাখালশিশুরা জুটে নাচে গায় খেলে ছুটে, দূরে তরী চলিয়াছে ভাসি | কত কাজ কত খেলা কত মানবের মেলা, সুখদুঃখ ভাবনা অশেষ ----- তারি মাঝে কুহুস্বর একতান সকাতর কোথা হতে লভিছে প্রবেশ | নিখিল করিছে মগ্ন---- জড়িত মিশ্রিত ভগ্ন গীতহীন কলরব কত, পড়িতেছে তারি ‘পর পরিপূর্ণ সুধাক্ষর পরিস্ফুট পুষ্পটির মতো | এত কান্ড, এত গোল, বিচিত্র এ কলরোল সংসারের আবর্তবিভ্রমে ---- তবু সেই চিরকাল অরণ্যের অন্তরাল কুহুধ্বনি ধ্বনিছে পঞ্চমে | যেন কে বসিয়া আছে বিশ্বের বক্ষের কাছে যেন কোন্ সরলা সুন্দরী, যেন সেই রূপবতী সংগীতের সরস্বতী সম্মোহন বীণা করে ধরি’----- সুকুমার কর্ণে তার ব্যথা দেয় অনিবার গণ্ডগোল দিবসে নিশীথে, জটিল সে ঝঞ্ঝনার বাঁধিয়া তুলিতে চায় সৌন্দর্যের সরল সংগীতে | তাই ওই চিরদিন ধ্বনিতেছে শ্রান্তিহীন কুহুতান, করিছে কাতর ---- সংগীতের ব্যথা বাজে, মিশিয়াছে তার মাঝে করুণার অনুনয়স্বর | কেহ বসে গৃহমাঝে, কেহ বা চলেছে কাজে, কেহ শোনে, কেহ নাহি শোনে ---- তবুও সে কী মায়ায় ওই ধ্বনি থেকে যায় বিশ্বব্যাপী মানবের মনে | তবু যুগ-যুগান্তর মানবজীবনস্তর ওই গানে আদ্র হয়ে আসে, কত কোটি কুহুতান মিশায়েছে নিজ প্রাণ জীবের জীবন- ইতিহাসে | সুখে দুঃখে উত্সবে গান উঠে কলরবে বিরল গ্রামের মাঝখানে, তারি সাথে সুধাস্বরে মিশে ভালোবাসাভরে পাখি-গানে মানবের গানে | কোজাগর পূর্ণিমায় শিশু শূন্যে হেসে চায়, ঘিরে হাসে জনকজননী---- সুদূর বনান্ত হতে দক্ষিণসমীরস্রোতে ভেসে আসে কুহুকুহু ধ্বনি | প্রচ্ছায় তমসাতীরে শিশু কুশলব ফিরে, সীতা হেরে বিষাদে হরিষে----- ঘন সহকারশাখে মাঝে মাঝে পিক ডাকে, কুহুতানে করুণা বরিষে | লতাকুঞ্জ তপোবনে বিজনে দুষ্মন্তসনে শকুন্তলা লাজে থরথর, তখনো সে কুহুভাষা রমণীর ভালোবাসা করেছিল সুমধুরতর | নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে তাই অতীতের মাঝে ধাই শুনিয়া আকুল কুহুরব----- বিশাল মানবপ্রাণ মোর মাঝে বর্তমান দেশ কাল করি অভিভব | অতীতের দুঃখসুখ, দূরবাসী প্রিয়মুখ, শৈশবের স্বপ্নশ্রুত গান, ওই কুহুমন্ত্রবলে জাগিতেছে দলে দলে লভিতেছে নূতন পরান | গাজিপুর ২২ বৈশাখ ১৮৮৮ সংশোধন শান্তিনিকেতন, ৫ কার্তিক ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
সিন্ধুতরঙ্গ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরী –তীর্থযাত্রী তরণীর নিমজ্জন উপলক্ষে দোলে রে প্রলয় দোলে অকূল সমুদ্র-কোলে উত্সব ভীষণ | শত পক্ষ ঝাপটিয়া বেড়াইছে দাপটিয়া দুর্দম পবন | আকাশ সমুদ্র-সাথে প্রচন্ড মিলনে মাতে, অখিলের আঁখিপাতে আবরি তিমির | বিদ্যুৎ চমকে ত্রাসি, হা হা করে ফেনরাশি, তীক্ষ্ম শ্বেত রুদ্র হাসি জড়-প্রকৃতির | চক্ষুহীন কর্ণহীন গেহহীন স্নেহহীন মত্ত দৈত্যগণ মরিতে ছুটেছে কোথা, ছিঁড়েছে বন্ধন | হারাইয়া চারি ধার নীলাম্বুধি অন্ধকার কল্লোলে, ক্রন্দনে , রোষে ত্রাসে, ঊর্দ্ধশ্বাসে, অট্টরোলে, অট্টহাসে , উন্মাদ গর্জমনে, ফাটিয়া ফুটিয়া উঠে--- চূর্ণ হয়ে যায় টুটেৃ--- খুঁজিয়া মরিছে ছুটে আপনার কূল ------ যেন রে পৃথিবী ফেলি বাসুকি করিছে কেলি সহস্রৈক ফণা মেলি, আছাড়ি লাঙ্গুল | যেন রে তরল নিশি টলমলি দশ দিন উঠিছে নড়িয়া, আপন নিদ্রার জাল ফেলিছে ছিঁড়িয়া | নাই সুর, নাই ছন্দ, অর্থহীন, নিরানন্দ জড়ের নর্তন | সহস্র জীবনে বেছে ওই কি উঠেছে নেচে প্রকান্ড মরণ ? জল বাষ্প বজ্র বায়ু লভিয়াছে অন্ধ আয়ু নূতন জীবনস্নায়ু দানিছে হতাশে ---- দিগ্বিদিক নাহি জানে, বাধাবিঘ্ন নাহি মানে , ছুটেছে প্রলয়-পানে আপনারি ত্রাসে ! হেরো, মাঝখানে তারি আট শত নরনারী বাহু বাঁধি বুকে, প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ চাহিয়া সম্মুখে | তরণী ধরিয়া ঝাঁকে---- রাক্ষসী ঝটিকা হাঁকে, ‘দাও, দাও, দাও !’ সিন্ধু ফেনোচ্ছল ছলে কোটি ঊর্দ্ধকরে বলে, ‘দাও, দাও, দাও !’ বিলম্ব দেখিয়া রোষে ফেনায়ে ফেনায়ে ফোঁসে . নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে | ক্ষুদ্র তরী গুরুভার সহিতে পারে না আর, লৌহবক্ষ ওই তার যায় বুঝি টুটে | অধ ঊর্দ্ধ এক হয়ে ক্ষুদ্র এ খেলেনা লয়ে খেলিবারে চায় | দাঁড়াইয়া কর্ণধার তরীর মাথায় | নরনারী কম্পমান ডাকিতেছে, ভগবান ! হায় ভগবান ! দয়া করো, দয়া করো !----- উঠিছে কাতর স্বর---- রাখো রাখো প্রাণ ! কোথা সেই পুরাতন রবি শশী তারাগণ কোথা আপনার ধন ধরণীর কোল ! আজন্মের স্নেহসার কোথা সেই ঘরদ্বার, পিশাচী এ বিমাতার হিংস্র উতরোল ! যে দিকে ফিরিয়া চাই পরিচিত কিছু নাই, নাই আপনার----- সকল করাল মুখ সহস্র-আকার | ফেটেছে তরণীতল, সবেগে উঠিছে জল, সিন্ধু মেলে গ্রাস | নাই তুমি, ভগবান, নাই দয়া, নাই প্রাণ--- জড়ের বিলাস | ভয় দেখে ভয় পায়, শিশু কাঁদে উভরায়--- নিদারুণ হায় হায় থামিল চকিতে | নিমেষেই ফুরাইল, কখন জীবন ছিল কখন জীবন গেল নারিল লখিতে | যেন রে একই ঝড়ে নিবে গেল একত্তরে শত দীপ আলো, চকিতে সহস্র গৃহে আনন্দ ফুরালো | প্রাণহীন এ মত্ততা না জানি পরের ব্যথা, না জানে আপন | এর মাঝে কেন রয় ব্যথাভরা স্নেহময় মানবের মন ! মা কেন রে এইখানে, শিশু চায় তার পানে, ভাই সে ভায়ের টানে কেন পড়ে বুকে ! মধুর রবির করে কত ভালোবাসা-ভরে কতদিন খেলা করে কত সুখে দুখে ! কেন করে টলমল দুটি ছোটো অশ্রুজল, সকরুণ আশা ! দীপশিখাসম কাঁপে ভীত ভালোবাসা | এমন জড়ের কোলে কেমনে নির্ভয়ে দোলে নিখিল মানব ! সব সুখ সব আশ কেন নাহি করে গ্রাস মরণ দানব ! ওই-যে জন্মের তরে জননী ঝাঁপায়ে পড়ে কেন বাঁধে বক্ষ – ‘পরে সন্তান আপন ! মরণের মুখে ধায়, সেথাও দিবে না তায়--- কাড়িয়া রাখিতে চায় হৃদয়ের ধন ! আকাশেতে পারাবারে দাঁড়ায়েছে এক ধারে, এক ধারে নারী--- দুর্বল শিশুটি তার কে লইবে কাড়ি ? এ বল কোথায় পেলে ! আপন কোলের ছেলে এত ক’রে টানে ! এ নিষ্ঠুর জড়স্রোতে প্রেম এল কোথা হতে মানবের প্রাণে ! নৈরাশ্য কভু না জানে, বিপত্তি কিছু না মানে, অপূর্ব-অমৃত-পানে অনন্ত নবীন--- এমন মায়ের প্রাণ যে বিশ্বের কোনোখান তিলেক পেয়েছে স্থান, সে কি মাতৃহীন ? এ প্রলয়-মাঝখানে অবলা জননী-প্রাণে স্নেহ মৃত্যুঞ্জয়ী---- এ স্নেহ জাগায়ে রাখে কোন্ স্নেহময়ী ? পাশাপাশি এক ঠাঁই দয়া আছে, দয়া নাই---- বিষম সংশয় | মহাশঙ্কা মহা-আশা একত্র বেঁধেছে বাসা, এক-সাতে রয় | কেবা সত্য, কেবা মিছে, নিশিদিন আকুলিছে, কভু ঊর্দ্ধে কভু নীচে টানিছে হৃদয়| জড় দৈত্য শক্তি হানে, মিনতি নাহিক মানে--- প্রেম এসে কোলে টানে, দূর করে ভয় | এ কি দুই দেবতার দ্যূতখেলা অনিবার ভাঙাগড়াময় ? . চিরদিন অন্তহীন জয়পরাজয় ? পার্ক স্ট্রীট , আষাঢ় ১৮৮৭ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
মানসী www.milansagar.com |