*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
একাল ও সেকাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী |
গাঢ় ছায়া সারাদিন,
মধ্যাহ্ন তপনহীন ,
দেখায় শ্যামলতর শ্যাম বনশ্রেণী |

আজিকে এমন দিনে, শুধু পড়ে মনে
সেই দিবা-অভিসার
পাগলিনী রাধিকার
না জানি সে কবেকার দূর বৃন্দাবনে |

সেদিনও এমনি বায়ু রহিয়া রহিয়া---
এমন অশান্ত বৃষ্টি,
তড়িতচকিত দৃষ্টি,
এমনি কাতর হায় রমণীর হিয়া |

বিরহিণী মর্মে-মরা মেঘমন্দ্র স্বরে—
নয়নে নিমেষ নাহি,
গগনে রহিত চাহি,
আঁকিত প্রাণের আশা জলদের স্তরে |

চাহিত পথিকবধূ শূন্য পথপানে |
মল্লার গাহিত কারা,
ঝরিত বরষধারা,
নিতান্ত বাজিত গিয়া কাতর পরানে |

যক্ষনারী বীণা কোলে ভুমিতে বিলীন---
বক্ষে পড়ে রুক্ষ কেশ
অযত্নশিথিল বেশ----
সেদিনও এমনিতরো অন্ধকার দিন |

সেই কদম্বের মূল, যমুনার তীর ,
সেই সে শিখীর নৃত্য
এখনো হরিছে চিত্ত –
ফেলিছে বিরহছায়া শ্রাবণতিমির |

আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে |
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে

এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে |
এখনো প্রেমের খেলা
সারানিশি, সারাবেলা ---
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে |


২১ বৈশাখ ১৮৮৮
.         ***************************     

.                                                                                            
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আকাঙ্ক্ষা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আর্দ্র তীব্র পূর্ণবায়ু বহিতেছে বেগে,
ঢেকেছে উদয়পথ ঘননীল মেঘে |
দূরে গঙ্গা, নৌকা নাই, বালু উড়ে যায়,
বসে বসে ভাবিতেছি ---- আজি কে কোথায় !

শুষ্ক পাতা উড়ে পড়ে জনহীন পথে,
বনের উতল রোল আসে দূর হতে |
নীরব প্রভাতপাখি, কম্পিত কুলায়,
মনে জাগিতেছে সদা---- আজি সে কোথায় !

কত কাল ছিল কাছে, বলি নি তো কিছু–-
দিবস চলিয়া গেছে দিবসের পিছু |
কত হাস্যপরিহাস বাক্য-হানাহানি,
তার মাঝে রয়ে গেছে হৃদয়ের বাণী |

মনে হয় আজ যদি পাইতাম কাছে,
বলিতাম হৃদয়ের যত কথা আছে |
বচনে পড়িত নীল জলদের ছায়,
ধ্বনিতে ধ্বনিতে আর্দ্র উতরোল বায় |

ঘনাইত নিস্তব্ধতা দূর ঝটিকার,
নদীতীরে মেঘে বনে হত একাকার |
এলোকেশ মুখে তার পড়িত নামিয়া,
নয়নে সজল বাষ্প রহিত থামিয়া |

জীবনমরণময় সুগম্ভীর কথা,
অরণ্যমর্মরসম মর্মব্যাকুলতা,
ইহপরকালব্যাপী সুমহান প্রাণ,
উচ্ছ্বসিত উচ্চ আশা, মহত্ত্বের গান---

বৃহৎ বিষাদছায়া, বিরহ গভীর,
প্রচ্ছন্ন হৃদয়রুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা অধীর,
বর্ণন-অতীত যত অস্ফুট বচন---
নির্জন ফেলিত ছেয়ে মেঘের মতন |

যথা দিবা-অবসানে নিশীথনিলয়ে
বিশ্ব দেখা দেয় তার গ্রহতারা লয়ে,
হাস্যপরিহাসমুক্ত হৃদয়ে আমার
দেখিত সে অন্তহীন জগতবিস্তার |

নিম্নে শুধু কোলাহল খেলাধুলা হাস,
উপরে নির্লিপ্ত শান্ত অন্তর-আকাশ |
আলোকেতে দেখো শুধু ক্ষণিকের খেলা,
অন্ধকারে আছি আমি অসীম একেলা |

কতটুকু  ক্ষুদ্র মোরে দেখে গেছে চলে,
কত ক্ষুদ্র সে বিদায় তুচ্ছ কথা ব’লে !
কল্পনার সত্যরাজ্য দেখাই নি তারে,
বসাই নি এ নির্জন আত্মার আঁধারে |

এ নিভৃতে, এ নিস্তব্ধে, এ মহত্ব-মাঝে
দুটি চিত্ত চিরনিশি যদি রে বিরাজে----
হাসিহীন শব্দশূন্য ব্যোম দিশাহারা,
প্রেমপূর্ণ চারি চক্ষু জাগে চারি তারা !

শ্রান্তি নাই, তৃপ্তি নাই, বাধা নাই পথে,
জীবন ব্যাপিয়া যায় জগতে জগতে---
দুটি প্রাণতন্ত্রী হতে পূর্ণ একতানে
উঠে গান অসীমের সিংহাসন-পানে |

২০ বৈশাখ  ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                 
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিষ্ঠুর সৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে হয় সৃষ্টি বুঝি বাঁধা নাই নিয়মনিগড়ে,
আনাগোনা মেলামেশা সবই অন্ধ দৈবের ঘটনা |
.             এই ভাঙে, এই গড়ে,
.             এই উঠে, এই পড়ে---
কেহ নাহি চেয়ে দেখে কার কোথা বাজিছে বেদনা |

মনে হয়, যেন ওই অবারিত শূন্যতলপথে
অকস্মাৎ আসিয়াছে সৃজনের বন্যা ভয়ানক----
.             অজ্ঞাত শিখর হতে
.             সহসা প্রচন্ড স্রোতে
ছুটে আসে সূর্য চন্দ্র, ধেয়ে আসে লক্ষকোটি লোক |

কোথাও পড়েছে আলো, কোথাও বা অন্ধকার নিশি----
কোথাও সফেন শুভ্র, কোথাও বা আবর্ত আবিল---
.              সৃজনে প্রলয়ে মিশি
.              আক্রমিছে দশ দিশি---
অনন্ত প্রশান্ত শূন্য তরঙ্গিয়া করিছে ফেনিল |

মোরা শুধু খড়কুটো স্রোতমুখে চলিয়াছি ছুটি,
অর্ধ পলকের তরে কোথাও দাঁড়াতে নাহি ঠাঁই |
.               এই ডুবি, এই উঠি,
.               ঘুড়ে ঘুড়ে পড়ি লুটি----
এই যারা কাছে আসে এই তারা কাছাকাছি নাই |

সৃষ্টিস্রোতকোলাহলে বিলাপ শুনিবে কেবা কার !
আপন গর্জনে বিশ্ব আপনারে করেছে বধির |
.                শতকোটি হাহাকার
.                কলধ্বনি রচে তার---
পিছু ফিরে চাহিবার কাল নাই, চলেছে অধীর |

হায় স্নেহ, হায় প্রেম, হায় তুই মানবহৃদয়,
খসিয়া পড়িলি কোন্ নন্দনের তটতরু হতে ?
.                যার লাগি সদা ভয়,
.                পরশ নাহিক সয়,
কে তারে ভাসালে হেন জড়ময় সৃজনের স্রোতে ?

তুমি কি শুনিছ বসি হে বিধাতা, হে অনাদি কবি,
ক্ষুদ্র এ মানবশিশু রচিতেছে প্রলাপজল্পনা ?
.                সত্য আছে স্তব্ধ ছবি
.                যেমন ঊষার রবি,
নিম্নে তারি ভাঙে গড়ে মিথ্যা যত কুহককল্পনা |

গাজিপুর
১৩ বৈশাখ, ১৮৮৮

.                ***************************     

.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রকৃতির প্রতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শত শত প্রেমপাশে টানিয়া হৃদয়
একি খেলা তোর ?
ক্ষুদ্র এ কোমল প্রাণ, ইহারে বাঁধিতে
কেন এত ডোর ?
ঘুরে ফিরে পলে পলে
ভালোবাসা নিস ছলে,
ভালো না বাসিতে চাস
হায় মনোচোর !

হৃদয় কোথায় তোর খুঁজিয়া বেড়াই
নিষ্ঠুরা প্রকৃতি !
এত ফুল, এত আলো, এত গন্ধ গান,
কোথায় পিরিতি !
আপন রূপের রাশে
আপনি লুকায়ে হাসে,
আমরা কাঁদিয়া মরি---
এ কেমন রীতি !

শূন্যক্ষেত্রে নিশিদিন আপনার মনে
কৌতুকের খেলা |
বুঝিতে পারি নে তোর কারে ভালোবাসা
কারে অবহেলা |
প্রভাতে যাহার ‘পর
বড়ো-স্নেহ সমাদর,
বিস্মৃত সে ধূলিতলে
সেই সন্ধ্যাবেলা |

তবু তোরে ভালোবাসি, পারি নে ভুলিতে
অয়ি মায়াবিনী !
স্নেহহীন আলিঙ্গন জাগায় হৃদয়ে
সহস্র রাগিণী |
এই সুখে দুঃখে শোকে
বেঁচে আছি দিবালোকে,
নাহি চাহি হিমশান্ত
অনন্ত যামিনী |

আধো-ঢাকা আধো-খোলা ওই তোর মুখ
রহস্যনিলয়
প্রেমের বেদনা আনে হৃদয়ের মাঝে,
সঙ্গে আনে ভয় |
বুঝিতে পারি নে তব
কত ভাব নব নব,
হাসিয়া কাঁদিয়া প্রাণ
পরিপূর্ণ হয় |

প্রাণমন পসারিয়া ধাই তোর পানে,
নাহি দিস ধরা |
দেখা যায় মৃদু মধু কৌতুকের হাসি
অরুণ-অধরা !
যদি চাই দূরে যেতে
কত ফাঁদ থাক পেতে---
কত ছল, কত বল
চপলা-মুখরা !

আপনি নাহিক জান আপনার সীমা,
রহস্য আপন |
তাই, অন্ধ রজনীতে যবে সপ্তলোক
নিদ্রায় মগন,
চুপি চুপি কৌতূহলে
দাঁড়াস আকাশতলে,
জ্বালাইয়া শত লক্ষ
নক্ষত্রকিরণ |

কোথাও বা বসে আছ চির-একাকিনী,
চিরমৌনব্রতা !
চারি দিকে সুকঠিন তৃণতরুহীন
মরুনির্জনতা |
রবি শশী শিরোপর
উঠে যুগ-যুগান্তর,
চেয়ে শুধু চলে যায়,
নাহি কয় কথা |

কোথাও বা খেলা করে বালিকার মতো,
উড়ে কেশ বেশ----
হাসিরাশি উচ্ছ্বসিত উত্সের মতন,
নাহি লজ্জালেশ |
রাখিতে পারে না প্রাণ
আপনার পরিমাণ
এত কথা এত গান
নাহি তার শেষ |

কখনো বা হিংসাদীপ্ত উন্মাদ নয়ন
নিমষনিহত
অনাথা ধরায় বক্ষে অগ্নি-অভিশাপ
হানে অবিরত |
কখনো বা সন্ধ্যালোকে
উদাস উদার শোকে
মুখে পড়ে ম্লান ছায়া
করুণার মতো |

তবে তো করেছ বশ এমনি করিয়া
অসংখ্য পরান |
যুগ-যুগান্ত ধ’রে রয়েছে নূতন
মধুর বয়ান |
সাজি শত মায়াবাসে
আছ সকলেরই পাশে,
তবু আপনারে কারে
কর নাই দান |

যত অন্ত নাহি পাই তত জাগে মনে
মহা রূপরাশি |
তত বেড়ে যায় প্রেম যত পাই ব্যথা,
যত কাঁদি হাসি
যত তুই দূরে যাস
তত প্রাণে লাগে ফাঁস,
যত তোরে নাহি বুঝি
তত ভালোবাসি |

১৫ বৈশাখ ১৮৮৮

.                ***************************              

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মরণস্বপ্ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ |  প্রথম সন্ধ্যায়
ম্লান চাঁদ দেখা দিল গগনের কোণে |
ক্ষুদ্র নৌকা থরথরে             চলিয়াছে পালভরে
কালস্রোতে যথা ভেসে যায়
অলস ভাবনাখানি আধাজাগা মনে |

এক পারে ভাঙা তীর ফেলিয়াছে ছায়া,
অন্য পারে ঢালু তট শুভ্র বালুকায়
মিশে যায় চন্দ্রালোকে---    ভেদ নাহি পড়ে চোখে---
বৈশাখের গঙ্গা কৃশকায়া
তীরতলে ধীরগতি অলস লীলায় |

স্বদেশ পুরব হতে বায়ু বহে আসে
দূর স্বজনের যেন বিরহের শ্বাস |
জাগ্রত আঁখির আগে            কখনো বা চাঁদ জাগে
কখনো বা প্রিয়মুখ ভাসে----
আধেক উলস প্রাণ আধেক উদাস |

ঘনচ্ছায়া আম্রকুঞ্জ উত্তরের তীরে---
যেন তারা সত্য নহে, স্মৃতি-উপবন |
তীব্র, তরু, গৃহ, পথ,          জ্যোত্স্নাপটে চিত্রবৎ----
পড়িয়াছে নীলাকাশনীরে
দূর মায়াজগতের ছায়ার মতন |

স্বপ্নাকুল আঁখি মুদি ভাবিতেছি মনে----
রাজহংস ভেসে যায় অপার আকাশে
দীর্ঘ শুভ্র পাখা খুলি            চন্দ্রালোক-পানে তুলি,
পৃষ্ঠে আমি কোমল শয়নে ;
সুখের মরণসম ঘুমঘোর আসে |

যেন রে প্রহর নাই, নাইক প্রহরী,
এ যেন রে দিবাহারা অনন্ত নিশীথ |
নিখিল নির্জন স্তব্ধ,                  শুধু শুনি জলশব্দ
কলকল-কল্লোল-লহরী---
নিদ্রাপারাবার যেন স্বপ্নচঞ্চলিত |

কত যুগ চলে যায় নাহি পাই দিশা ---
বিশ্ব নিবু-নিবু, যেন দীপ তৈলহীন |
গ্রাসিয়া আকাশ কায়া         ক্রমে পড়ে মহাছায়া,
নতশিরে বিশ্বব্যাপী নিশা
গনিতেছে মৃত্যুপল এক দুই তিন |

চন্দ্র শীর্ণতর হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়,
কলধ্বনি ক্ষীণ হয়ে মৌন হয়ে আসে |
প্রেতনয়নের মতো             নির্নিমেষ তারা যত
সবে মিলে মোর প্রাণে চায়,
একা আমি জনপ্রাণী অখন্ড আকাশে|

চির যুগরাত্রি ধ’রে শতকোটি তারা
পরে পরে নিবে গেল গগনমাঝার |
প্রাণপণে চক্ষু চাহি         আঁখিতে আলোক নাহি,
বিঁধিতে পারে না আঁখিতারা
তুষারকঠিন মৃত্যুহিম অন্ধকার |

অসাড় বিহঙ্গ-পাখা পড়িল ঝুলিয়া,
লুটায় সুদীর্ঘ গ্রীবা -----নামিল মরাল |
ধরিয়া অযুত অব্দ                হুহূ পতনের শব্দ
কর্ণরন্ধ্রে উঠে আকুলিয়া ---
দ্বিধা হয়ে ভেঙে যায় নিশীথ করাল |

সহসা এ জীবনের সমুদয় স্মৃতি
ক্ষণেক জাগ্রত হয়ে নিমেষে চকিতে
আমারে ছাড়িয়া দূরে         পড়ে গেল ভেঙেচুরে,
পিছে পিছে আমি ধাই নিতি---
একটি কণাও আর পাই না লিখিতে |

কোথাও রাখিতে নারি দেহ আপনার
সর্বাঙ্গ অবশ ক্লান্ত নিজ লৌহভারে |
কাতরে ডাকিতে চাহি,       শ্বাস নাহি, স্বর নাহি,
কন্ঠেতে চেপেছে অন্ধকার ----
বিশ্বের প্রলয় একা আমার মাঝারে |

দীর্ঘ তীক্ষ্ম হই ক্রমে তীব্র গতিবলে
ব্যগ্রগামী ঝটিকার আর্তস্বরসম,
সূক্ষ্ম বাণ সূচিমূখ               অনন্ত কালের বুক
বিদীর্ণ করিয়া যেন চলে---
রেখা হয়ে মিশে আসে দেহমন মম |

ক্রমে মিলাইয়া গেল সময়ের সীমা,
অনন্তে মুহূর্তে কিছু ভেদ নাহি আর |
ব্যাপ্তিহারা শূন্যসিন্ধু           শুধু যেন এক বিন্দু
গাঢ়তম অন্তিম কালিমা ----
     আমারে গ্রাসিল সেই বিন্দুপারাবার |

অন্ধকারহীন হয়ে গেল অন্ধকার |
‘আমি’ বলে কেহ নাই, তবু যেন আছে |
অচৈতন্যতলে অন্ধ              চৈতন্য হইল বন্ধ,
রহিল প্রতিক্ষা করি কার----
মৃত হয়ে প্রাণ যেন চিরকাল বাঁচে |

নয়ন মেলিনু, সেই বহিছে জাহ্নবী---
পশ্চিমে গৃহের মুখে চলেছে তরণী |
তীরে কুটিরের তলে         স্তিমিত প্রদীপ জ্বলে,
শূন্যে চাঁদ সুধামুখচ্ছবি |
সুপ্ত জীব কোলে লয়ে জাগ্রত ধরণী  |

১৭ বৈশাখ ১৮৮৮

.                ***************************              

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কুহুধ্বনি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রখর মধ্যাহ্নতাপে            প্রান্তর ব্যপিয়া কাঁপে
বাষ্পশিখা অনলশ্বসনা ---
অন্বেষিয়া দশ দিশা               যেন ধরণীর তৃষা
মেলিয়াছে লেলিহা রসনা |
ছায়া মেলি সারি সারি         স্তব্ধ আছে তিন-চারি
সিসুগাছ পাণ্ডুকিশলয়,
নিম্ববৃক্ষ  ঘনশাখা             গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পে ঢাকা,
আম্রবন তাম্রফলময় |
গোলক-চাঁপার ফুলে             গন্ধের হিল্লোল তুলে,
বন হতে আসে বাতায়নে---
ঝাউগাছ ছায়াহীন                  নিশ্বসিছে উদাসীন
শূন্যে চাহি আপনার মনে |
দূরান্ত প্রান্তর শুধু                তপনে করিছে ধূ  ধূ,
বাঁকা পথ শুষ্ক তপ্তকায়া----
তারি প্রান্তে উপবন,                   মৃদুমন্দ সমীরণ
ফুল গন্ধ, শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া |
ছায়ার কুটিরখানা              দু ধারে বিছায়ে ডানা
পক্ষীসম করিছে বিরাজ,
তারি তলে সবে মিলি            চলিতেছে নিরিবিলি
সুখে দুঃখে দিবসের কাজ |
কোথা হতে নিদ্রাহীন                 রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ দিন
কোকিল গাহিছে কুহুস্বরে |
সেই পুরাতন তান                     প্রকৃতির মর্মগান
পশিতেছে মানবের ঘরে |
বসি আঙিনার কোণে             গম ভাঙে দুই বোনে,
গান গাহে শ্রান্তি নাহি মানি |
বাঁধা কূপ, তরুতল,                বালিকা তুলিছে জল
খরতাপে ম্লানমুখখানি |
দূরে নদী, মাঝে চর----              বসিয়া মাচার ‘পর
শস্যখেত আগলিছে চাষি |
রাখালশিশুরা জুটে                নাচে গায় খেলে ছুটে,
দূরে তরী চলিয়াছে ভাসি |
কত কাজ কত খেলা                কত মানবের মেলা,
সুখদুঃখ ভাবনা অশেষ -----
তারি মাঝে কুহুস্বর                     একতান সকাতর
কোথা হতে লভিছে প্রবেশ |
নিখিল করিছে মগ্ন----                 জড়িত মিশ্রিত ভগ্ন
গীতহীন কলরব কত,
পড়িতেছে তারি ‘পর                   পরিপূর্ণ সুধাক্ষর
পরিস্ফুট  পুষ্পটির মতো |
এত কান্ড, এত গোল,                  বিচিত্র এ কলরোল
সংসারের আবর্তবিভ্রমে ----
তবু সেই চিরকাল                      অরণ্যের অন্তরাল
কুহুধ্বনি ধ্বনিছে পঞ্চমে |
যেন কে  বসিয়া আছে              বিশ্বের বক্ষের কাছে
যেন কোন্ সরলা সুন্দরী,
যেন সেই রূপবতী                      সংগীতের সরস্বতী
সম্মোহন বীণা করে ধরি’-----
সুকুমার কর্ণে তার                     ব্যথা দেয় অনিবার
গণ্ডগোল দিবসে নিশীথে,
জটিল সে ঝঞ্ঝনার                      বাঁধিয়া তুলিতে চায়
সৌন্দর্যের সরল সংগীতে |
তাই ওই চিরদিন                       ধ্বনিতেছে শ্রান্তিহীন
কুহুতান, করিছে কাতর ----
সংগীতের ব্যথা বাজে,               মিশিয়াছে তার মাঝে
করুণার অনুনয়স্বর |
কেহ বসে গৃহমাঝে,                   কেহ বা চলেছে কাজে,
কেহ শোনে, কেহ নাহি শোনে ----
তবুও সে কী মায়ায়                     ওই ধ্বনি থেকে যায়
বিশ্বব্যাপী মানবের মনে |
তবু যুগ-যুগান্তর                                 মানবজীবনস্তর
ওই গানে আদ্র হয়ে আসে,
কত কোটি কুহুতান                      মিশায়েছে নিজ প্রাণ
জীবের জীবন- ইতিহাসে |
সুখে দুঃখে উত্সবে                         গান উঠে কলরবে
বিরল গ্রামের মাঝখানে,
তারি সাথে সুধাস্বরে                    মিশে ভালোবাসাভরে
পাখি-গানে মানবের গানে |
কোজাগর পূর্ণিমায়                        শিশু শূন্যে হেসে চায়,
ঘিরে হাসে জনকজননী----
সুদূর বনান্ত হতে                             দক্ষিণসমীরস্রোতে
ভেসে আসে কুহুকুহু ধ্বনি |
প্রচ্ছায় তমসাতীরে                          শিশু কুশলব ফিরে,
সীতা হেরে বিষাদে হরিষে-----
ঘন সহকারশাখে                         মাঝে মাঝে পিক ডাকে,
কুহুতানে করুণা বরিষে |
লতাকুঞ্জ তপোবনে                             বিজনে দুষ্মন্তসনে
শকুন্তলা লাজে থরথর,
তখনো সে কুহুভাষা                           রমণীর ভালোবাসা
করেছিল সুমধুরতর |
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে তাই                         অতীতের মাঝে ধাই
শুনিয়া আকুল কুহুরব-----
বিশাল মানবপ্রাণ                             মোর মাঝে বর্তমান
দেশ কাল করি অভিভব |
অতীতের দুঃখসুখ,                               দূরবাসী প্রিয়মুখ,
শৈশবের স্বপ্নশ্রুত গান,
ওই কুহুমন্ত্রবলে                              জাগিতেছে দলে দলে
লভিতেছে নূতন পরান |

গাজিপুর
২২ বৈশাখ ১৮৮৮
সংশোধন
শান্তিনিকেতন,  ৫ কার্তিক ১৮৮৮

.                ***************************              

.                                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাসস্থান পরিবর্তন উপলক্ষে

বন্ধুবর,
দক্ষিণে বেধেঁছি নীড়                         চুকেছে লোকের ভিড়,
.                 বকুনির বিড় বিড় গেছে থেমে-থুমে |
আপনারে করে জড়ো                      কোণে বসে আছি দড়ো,
.                 আর সাধ নেই বড়ো আকাশকুসুমে |
সুখ নেই, আছে শান্তি,                     ঘুচেছে মনের ভ্রান্তি,
.                 ‘বিমুখা বান্ধবা যান্তি’ বুঝিয়াছি সার  |
কাছে থেকে কাটে সুখে                    গল্প ও গুড়ুক ফুঁকে,
.                  গেলে দক্ষিণের মুখে দেখা নেই আর |
কাজ কী এ মিছে নাট,                     তুলেছি দোকান-পাট,
.                   গোলমাল চণ্ডীপাঠআছি ভাই ভুলি |
তবু কেন খিটিমিটি,                        মাঝে মাঝে কড়া চিঠি,
.                   কোথা থেকে দু-চারিটি চোখা চোখা বুলি !
‘পেটে খেলে পিঠে সয়’                      এই তো প্রবাদে কয়,
.                   ভুলে যদি দেখা হয় তবু সয়ে থাকি |
হাত করে নিশপিশ,                         মাঝে রেখে পোস্টাপিস
.                    ছাড় শুধু দশ-বিশ শব্দভেদী ফাঁকি |
বিষম উত্পাত এ কী                         হায় নারদের ঢেঁকি !
.                    শেষকালে এ যে দেখি ঝগড়ার মতো |
মেলা কথা হল জমা,                          এইখানে দিই ‘কমা’
.                  আমার স্বভাব ক্ষমা----নির্বিবাদ ব্রত |
কেদারার ‘পরে চাপি                         ভাবি শুধু ফিলজাফি,
.                    নিতান্তই চুপিচাপি মাটির মানুষ |
লেখা তো লিখেছি ঢের,                      এখন পেয়েছি টের
.                    সে কেবল কাগজের রঙিন ফানুস |
আঁধারের কূলে কূলে                           ক্ষীণশিখা মরে দুলে,
.                   পথিকেরা মুখ তুলে চেয়ে দেখে তাই |
নকল নক্ষত্র হায়                                ধ্রুবতারা-পানে ধায়,
.                    ফিরে আসে এ ধরায় একরত্তি ছাই |
সবারে সাজে না ভালো                        হৃদয়ে স্বর্গের আলো
.                     আছে যার সেই জ্বালে আকাশের ভালে---
মাটির প্রদীপ যার                              নিভে-নিভে বার বার
.                     সে দীপ জ্বলুক তার গৃহের আড়ালে !
যারা আছে কাছাকাছি                        তাহাদের নিয়ে আছি---
.                     শুধু ভালোবেসে বাঁচি, বাঁচি যত কাল |
আশা কভু নাহি মেটে                         ভূতের বেগার খেটে----
.                      কাগজে আঁচড় কেটে সকাল বিকাল |
কিছু নাহি করি দাওয়া,                         ছাতে বসে খাই হাওয়া,
.                      যতটুকু পড়ে পাওয়া ততটুকু ভালো ----
যারা মোরে ভালোবাসে                         ঘুরে ফিরে কাছে আসে,
.                      হাসিখুশি আশেপাশে নয়নের আলো |
বাহবা যে জন চায়                               বসে থাক্ চৌমাথায়,
.                      নাচুক তৃণের প্রায় পথিকের স্রোতে----
পরের মুখের বুলি                                ভরুক ভিক্ষার ঝুলি,
.                     নাই চাল চুলি ধূলির পর্বতে |


বেড়ে যায় দীর্ঘ ছন্দ,                         লেখনী না হয় বন্ধ,
.                    বক্তৃতার নামগন্ধ পেলে রক্ষে নেই |
ফেনা ঢোকে নাকে চোখে,                   প্রবল মিলের ঝোঁকে
.                    ভেসে যাই একরোখে বুঝি দক্ষিণেই |
বাহিরেতে চেয়ে দেখি                        দেবতাদুর্যোগ এ কী
.                     বসে বসে লিখিতে কি আর সরে মন !
আর্দ্র বায়ু বহে বেগে,                         গাছপালা ওঠে জেগে
.                     ঘনঘোর স্নিগ্ধ মেঘে আঁধার গগন |     
বেলা যায়, দৃষ্টি বাড়ে,                        বসি আলিসার আড়ে
.                     ভিজে কাক ডাক ছাড়ে মনের অসুখে |
রাজপথ জনহীন,                                 শুধু পান্থ দুই তিন
.                     ছাতার ভিতরে লীন ধায় গৃহমুখে |
বৃষ্টি-ঘেরা চারি ধার,                             ঘনশ্যাম অন্ধকার,
.                     ঝুপ-ঝুপ শব্দ আর ঝড়ঝড় পাতা |
থেকে থেকে ক্ষণে ক্ষণে                         গুরু গুরু গরজনে
.                      মেঘদূত পড়ে মনে আষাঢ়ের গাথা |
পড়ে মনে বরিষার                               বৃন্দাবন-অভিসার
.                      একাকিনী রাধিকার চকিতচরণ -----
শ্যামল তমালতল ,                                 নীল যমুনার জল,
.                      আর দুটি ছল ছল নলিননয়ন !
এ ভরা বাদর দিনে                          কে বাঁচিবে শ্যাম বিনে,
.                      কাননের পথ চিনে মন যেতে চায় |
বিজন যমুনাকূলে                                   বিকশিত নীপমূলে
.                     কাঁদিয়া পরান বুলে বিরহব্যথায় |


দোহাই কল্পনা তোর,                             ছিন্ন কর্ মায়াডোর,
.                     কবিতায় আর মোর নাই কোনো দাবি |
বিরহ, বকুল, আর                               বৃন্দাবন স্তূপাকার----
.                     সেগুলো চাপাই কার স্কন্ধে তাই ভাবি |
এখন ঘরের ছেলে                               বাঁচি ঘরে ফিরে গেলে
.                     দু-দন্ড সময় পেলে নাবার খাবার |
কলম হাঁকিয়ে ফেরা                             সকল রোগের সেরা,
.                     তাই কবি-মানুষেরা অস্থিচর্মসার |
কলমের গোলামিটা                               আর নাহি লাগে মিঠা,
.                     তার চেয়ে দুধ-ঘি’টা বহুগুণে শ্রেয় |
সাঙ্গ করি এইখানে-----                           শেষে বলি কানে কানে ,
.                     পুরানো বন্ধুর পানে মুখ তুলে চেয়ো |


বৈশাখ  ১৮৮৭

.                          ***************************              

.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সিন্ধুতরঙ্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরী –তীর্থযাত্রী তরণীর নিমজ্জন উপলক্ষে

দোলে রে প্রলয় দোলে               অকূল সমুদ্র-কোলে
উত্সব ভীষণ  |
শত পক্ষ ঝাপটিয়া                  বেড়াইছে দাপটিয়া
দুর্দম পবন |
আকাশ সমুদ্র-সাথে                  প্রচন্ড মিলনে মাতে,
অখিলের আঁখিপাতে আবরি তিমির |
বিদ্যুৎ চমকে ত্রাসি,                  হা হা করে ফেনরাশি,
তীক্ষ্ম শ্বেত রুদ্র হাসি জড়-প্রকৃতির |
চক্ষুহীন কর্ণহীন                       গেহহীন স্নেহহীন
মত্ত দৈত্যগণ
মরিতে ছুটেছে কোথা, ছিঁড়েছে বন্ধন |


হারাইয়া চারি ধার                    নীলাম্বুধি অন্ধকার
কল্লোলে, ক্রন্দনে ,
রোষে ত্রাসে, ঊর্দ্ধশ্বাসে,             অট্টরোলে, অট্টহাসে ,
উন্মাদ গর্জমনে,
ফাটিয়া ফুটিয়া উঠে---                চূর্ণ হয়ে যায় টুটেৃ---
খুঁজিয়া মরিছে ছুটে আপনার কূল ------
যেন রে পৃথিবী ফেলি                 বাসুকি করিছে কেলি
সহস্রৈক ফণা মেলি, আছাড়ি লাঙ্গুল |
যেন রে তরল নিশি                        টলমলি দশ দিন
উঠিছে নড়িয়া,
আপন নিদ্রার জাল ফেলিছে ছিঁড়িয়া |


নাই সুর, নাই ছন্দ,                         অর্থহীন, নিরানন্দ
জড়ের নর্তন |
সহস্র জীবনে বেছে                      ওই কি উঠেছে নেচে
প্রকান্ড মরণ ?
জল বাষ্প বজ্র বায়ু                      লভিয়াছে অন্ধ আয়ু
নূতন জীবনস্নায়ু দানিছে হতাশে ----
দিগ্বিদিক নাহি জানে,                     বাধাবিঘ্ন নাহি মানে ,
ছুটেছে প্রলয়-পানে আপনারি ত্রাসে !
হেরো, মাঝখানে তারি                     আট শত নরনারী
বাহু বাঁধি বুকে,
প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ চাহিয়া সম্মুখে  |


তরণী ধরিয়া ঝাঁকে----                   রাক্ষসী ঝটিকা হাঁকে,
‘দাও, দাও, দাও !’
সিন্ধু ফেনোচ্ছল ছলে                    কোটি ঊর্দ্ধকরে বলে,
‘দাও, দাও, দাও !’
বিলম্ব দেখিয়া রোষে                 ফেনায়ে ফেনায়ে ফোঁসে
.          নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে |
ক্ষুদ্র তরী গুরুভার                       সহিতে পারে না আর,
লৌহবক্ষ ওই তার যায় বুঝি টুটে |
অধ ঊর্দ্ধ এক হয়ে                        ক্ষুদ্র এ খেলেনা লয়ে
খেলিবারে চায় |
দাঁড়াইয়া কর্ণধার তরীর মাথায় |


নরনারী কম্পমান                       ডাকিতেছে, ভগবান !
হায় ভগবান !
দয়া করো, দয়া করো !-----             উঠিছে কাতর স্বর----
রাখো রাখো প্রাণ !
কোথা সেই পুরাতন                       রবি শশী তারাগণ
কোথা আপনার ধন ধরণীর কোল !
আজন্মের স্নেহসার                      কোথা সেই ঘরদ্বার,
পিশাচী এ বিমাতার হিংস্র উতরোল !
যে দিকে ফিরিয়া চাই                     পরিচিত কিছু নাই,
নাই আপনার-----
সকল করাল মুখ সহস্র-আকার |


ফেটেছে তরণীতল,                      সবেগে উঠিছে জল,
সিন্ধু মেলে গ্রাস |
নাই তুমি, ভগবান,                       নাই দয়া, নাই প্রাণ---
জড়ের বিলাস |
ভয় দেখে ভয় পায়,                    শিশু কাঁদে উভরায়---
নিদারুণ হায় হায় থামিল চকিতে |
নিমেষেই ফুরাইল,                         কখন জীবন ছিল
কখন জীবন গেল নারিল লখিতে |
যেন রে একই ঝড়ে                      নিবে গেল একত্তরে
শত দীপ আলো,
চকিতে সহস্র গৃহে আনন্দ ফুরালো |


প্রাণহীন এ মত্ততা                      না জানি পরের ব্যথা,
না জানে আপন |
এর মাঝে কেন রয়                        ব্যথাভরা স্নেহময়
মানবের মন !
মা কেন রে এইখানে,                    শিশু চায় তার পানে,
ভাই সে ভায়ের টানে কেন পড়ে বুকে !
মধুর রবির করে                        কত ভালোবাসা-ভরে
কতদিন খেলা করে কত সুখে দুখে !
কেন করে টলমল                       দুটি ছোটো অশ্রুজল,
সকরুণ আশা !
দীপশিখাসম কাঁপে ভীত ভালোবাসা |


এমন জড়ের কোলে                    কেমনে নির্ভয়ে দোলে
নিখিল মানব  !
সব সুখ সব আশ                        কেন নাহি করে গ্রাস
মরণ দানব !
ওই-যে জন্মের তরে                      জননী ঝাঁপায়ে পড়ে
কেন বাঁধে বক্ষ – ‘পরে সন্তান আপন !
মরণের মুখে ধায়,                      সেথাও দিবে না তায়---
কাড়িয়া রাখিতে চায় হৃদয়ের ধন !
আকাশেতে  পারাবারে                 দাঁড়ায়েছে এক ধারে,
এক ধারে নারী---
দুর্বল শিশুটি তার কে লইবে কাড়ি ?

এ বল কোথায় পেলে !                আপন কোলের ছেলে
এত ক’রে টানে !
এ নিষ্ঠুর জড়স্রোতে                    প্রেম এল কোথা হতে
মানবের প্রাণে !
নৈরাশ্য কভু না জানে,                  বিপত্তি কিছু না মানে,
অপূর্ব-অমৃত-পানে অনন্ত নবীন---
এমন মায়ের প্রাণ                      যে বিশ্বের কোনোখান
তিলেক পেয়েছে স্থান, সে কি মাতৃহীন ?
এ প্রলয়-মাঝখানে                           অবলা জননী-প্রাণে
স্নেহ মৃত্যুঞ্জয়ী----
এ স্নেহ জাগায়ে রাখে কোন্ স্নেহময়ী ?
পাশাপাশি এক ঠাঁই                     দয়া আছে, দয়া নাই----
বিষম সংশয় |
মহাশঙ্কা মহা-আশা                       একত্র বেঁধেছে বাসা,
এক-সাতে রয় |
কেবা সত্য, কেবা মিছে,                   নিশিদিন আকুলিছে,
কভু ঊর্দ্ধে কভু নীচে টানিছে হৃদয়|
জড় দৈত্য শক্তি হানে,                    মিনতি নাহিক মানে---
প্রেম এসে কোলে টানে, দূর করে ভয় |
এ কি দুই দেবতার                        দ্যূতখেলা অনিবার
ভাঙাগড়াময় ?
.                চিরদিন অন্তহীন জয়পরাজয় ?

পার্ক স্ট্রীট ,
আষাঢ় ১৮৮৭

.                          ***************************              

.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শ্রাবণের পত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বন্ধু হে,
পরিপূর্ণ বরষায়                  আছি তব ভরসায়,
.       কাজকর্ম করো সায়, এসে চপ্ পট্ !
শাম্ লা আঁটিয়া নিত্য           তুমি কর ডেপুটিত্ব
.        একা প’ড়ে মোর চিত্ত করে ছট্ ফট্ |
যখন যা সাজে, ভাই,           তখন করিবে তাই---
.        কালাকাল মানা নাই কলির বিচার !
শ্রাবণে ডেপুটিপনা             এ তো কভু নয় সনা-
.        তন প্রথা, এ যে অনা-সৃষ্টি অনাচার |
ছুটি লয়ে কোনোমতে       পোট্ মান্টো তুলি রথে
.        সেজেগুজে রেলপথে করো অভিসার |
লয়ে দাড়ি লয়ে হাসি             অবতীর্ণ হও আসি,
.        রুধিয়া জানালা শাসি বসি একবার !
বজ্ররবে সচকিত্                কাঁপিবে গৃহের ভিত,
.        পথে শুনি কদাচিৎ চক্র খড়্ খড়্ |
হা রে রে ইংরাজ-রাজ,       এ গৃহে হানিলি বাজ---
.        শুধু কাজ, শুধু কাজ, শুধু ধড়্ ফড়্ |
আম্ লা-সাম্ লা-স্রোতে         ভাসাইলি এ ভারতে,
.        যেন নেই ত্রিজগতে হাসি গল্প গান ----
নেই বাঁশি, নেই বঁধু,               নেই রে যৌবনমধু,
.        মুচেছে পথিকবঁধু সজল নয়ান !
যেন রে শরম টুটে                কদম্ব আর না ফুটে,
.      কেতকী শিহরি উঠে করে না আকুল----
কেবল জগৎটাকে                 জড়ায়ে সহস্র পাকে
.        গর্বমেন্ট পড়ে থাকে বিরাট বিপুল |
বিষম রাক্ষস ওটা,              মেলিয়া আপিস-কোটা
.        গ্রাস করে গোটা গোটা বন্ধুবান্ধবেরে---
বৃহৎ বিদেশে দেশে           কে কোথা তলায় শেষে
.       কোথাকার সর্বনেশে সর্বিসের ফেরে |
এ দিকে বাদর ভরা,                 নবীন শ্যামল ধরা,
.       নিশিদিন জল-ঝরা সঘন গগন |
এ দিকে ঘরের কোণে              বিরহিণী বাতায়নে,
.       দিগন্তে তমালবনে নয়ন মগন |
হেঁট মুণ্ড করি হেঁট                 মিছে কর  agitate,
.        খালি রেখে খালি পেট ভরিছ কাগজ |
এদিকে যে গোরা মিলে           কালা বন্ধু লুটে নিলে,
.         তার বেলা কী করিলে নাই কোনো খোঁজ |
দেখিছ না আঁখি খুলে             ম্যাঞ্চেষ্ট্র লিভারপুলে
.         দেশী শিল্প জলে গুলে করিলে finish
.’আষাঢ়ে গল্প’ সে কই !            সেও বুঝি গেল ওই
.         আমাদের নিতান্তই দেশের জিনিস |
তুমি আছ কোথা গিয়া,          আমি আছি শূন্যহিয়া,
.          কোথায় বা সে তাকিয়া শোকতাপহরা |
সে তাকিয়া------  গল্পগীতি           সাহিত্যচর্চার স্মৃতি
.          কত হাসি কত প্রীতি কত তুলো-ভরা !
কোথায় সে যদুপতি,                কোথা মথুরার গতি,
.          অথ, চিন্তা করি ইতি কুরু মনস্থির----
মায়াময় এ জগৎ                       নহে সৎ নহে সৎ,
.          যেন পদ্মপত্রবৎ, তদুপরি নীর |
অতএব ত্বরা ক’রে                উত্তর লিখিবে  মোরে,
.          সর্বদা নিকটে ঘোরে কাল সে করাল---
( সুধী তুমি ত্যজি নীর              গ্রহণ করিয়ো ক্ষীর )
.          এই তত্ত্ব এ চিঠির জানিয়ো
moral  |

শ্রাবণ ১৮৮৭

.                          ***************************              

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিষ্ফল প্রয়াস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওই-যে সৌন্দর্য লাগি পাগল ভুবন,
ফুটন্ত অধরপ্রান্তে হাসির বিলাস,
গভীরতিমিরমগ্ন আঁখির কিরণ,
লাবণ্যতরঙ্গভঙ্গ গতির উচ্ছাস,
যৌবনললিতলতা বাহুর বন্ধন,
এরা তো তোমারে ঘিরে আছে অনুক্ষণ----
তুমি কি পেয়েছ নিজ সৌন্দর্য-আভাস ?
মধুরাতে ফুলপাতে করিয়া শয়ন
বুঝিতে পার কি নিজ মধু-আলিঙ্গন ?
আপনার প্রস্ফুটিত তনুর উল্লাস
আপনারে করেছে কি মোহনিমগম ?
তবে মোরা কী লাগিয়া করি হাহুতাশ |
দেখ’ শুধু ছায়াখানি মেলিয়া নয়ন ;
রূপ নাহি ধরা দেয় ----বৃথা সে প্রয়াস |

৪৯ পার্ক স্ট্রীট
অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.                          ***************************              

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com