*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
হৃদয়ের ধন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাছে যাই, ধরি হাত, বুকে লই টানি-----
তাহার সৌন্দর্য লয়ে আনন্দে মাখিয়া
পূর্ণ করিবারে চাহি মোর দেহখানি,
আঁখিতলে বাহুপাশ কাড়িয়া রাখিয়া |
অধরের হাসি লব করিয়া চুম্বন,
নয়নের দ়ৃষ্টি লব নয়নে আঁকিয়া
কোমল পরশখানি করিয়া বসন
রাখিব দিবসনিশি সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া |
নাই, নাই, কিছু নাই, শুধু অন্বেষণ---
নীলিমা লইতে চাই আকাশ ছাঁকিয়া |
কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন,
দেহ শুধু হাতে আসে ---- শ্রান্ত করে হিয়া |
প্রভাতে মলিনমুখে ফিরে যাই গেহে,
হৃদয়ের ধন কভু ধরা যায় দেহে ?

১৮ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিভৃত আশ্রম  
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সন্ধ্যায় একেলা বসি বিজন ভবনে
অনুপম জ্যোতির্ময়ী মাধুরীমুরতি
স্থাপনা করিব যত্নে হৃদয়-আসনে |
প্রেমের প্রদীপ লয়ে করিব আরতি |
রাখিব দুয়ার রুধি আপনার মনে,
তাহার আলোকে রব আপন ছায়ায়---
পাছে কেহ কুতূহলে কৌতুকনয়নে
হৃদয়দুয়ারে এসে দেখে হেসে যায় |               
ভ্রমর যেমন থাকে কমলশয়নে,
সৌরভসদনে, কারো পথ নাহি চায়,
পদশব্দ নাহি গণে, কথা নাহে শোনে,
তেমনি হইব মগ্ন পবিত্র মায়ায় |
লোকালয়-মাঝে থাকি রব তপোবনে,
একেলা থেকেও তবু রব সাথি-সনে |

১৮ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                               
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নারীর উক্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মিছে তর্ক---- থাক্ তবে থাক্  |
কেন কাঁদি বুঝিতে পার না  ?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি ?      এই মুছিলাম আঁখি---
এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা |

আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে
ওই তব আঁখি-তুলে চাওয়া---
ওই কথা, ওই হাসি,              ওই কাছে আসা-আসি,
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে যাওয়া ?


কেন আন বসন্তনিশীথে
আঁখিভরা আবেশ বিহ্বল ---
যদি বসন্তের শেষে                  শ্রান্তমনে ম্লান হেসে
কাতরে খুঁজিতে হয় বিদায়ের ছল ?

আছি যেন সোনার খাঁচায়
একখানি পোষ-মানা প্রাণ |
এও কি বুঝাতে হয়                    প্রেম যদি নাহি রয়
হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান ?

মনে আছে সেই এক দিন
প্রথম প্রণয় সে তখন |
বিমল শরতকাল,                       শুভ্র ক্ষীণ মেঘজাল,
মৃদু শীতবায়ে স্নিগ্ধ রবির কিরণ |

কাননে ফুটিত শেফালিকা,
ফুলে ছেয়ে যেত তরুমূল |
পরিপূর্ণ সুরধুনী,                         কুলুকুলু ধ্বনি শুনি,
পরপারে বনশ্রেণী কুয়াশা-আকূল |

আমা-পানে চাহিয়ে তোমার
আঁখিতে কাঁপিত প্রাণখানি |
আনন্দে বিষাদে মেশা                  সেই নয়নের নেশা
তুমি তো জানো না তাহা, আমি তাহা জানি |

সে কি মনে পড়িবে তোমার----
সহস্র লোকের মাঝখানে
যেমনি দেখিতে মোরে               কোন্ আকর্ষণডোরে
আপনি আসিতে কাছে জানে কি অজ্ঞানে |

ক্ষণিক বিরহ-অবসানে
নিবিড় মিলন-ব্যাকুলতা
মাঝে মাঝে সব ফেলি                  রহিতে নয়ন মেলি,
আঁখিতে শুনিতে যেন হৃদয়ের কথা |

কোনো কথা না রহিলে তবু
শুধাইতে নিকটে আসিয়া |
নীরবে চরণ ফেলে                     চুপিচুপি কাছে এলে
কেমনে জানিতে পেতে, ফিরিতে হাসিয়া |

আজ তুমি দেখেও দেখ না,
সব কথা শুনিতে না পাও |
কাছে আস আশা ক’রে                আছি সারাদিন ধ’রে
আনমন পাশ দিয়ে তুমি চলে যাও |

দীপ জ্বেলে দীর্ঘ ছায়া লয়ে,
বসে আছি সন্ধ্যায় ক’জনা ----
হয়তো বা কাছে এসে,                    হয়তো বা দূরে বস,
সে সকলই ইচ্ছাহীন দৈবের ঘটনা |

এখন হয়েছে বহু কাজ,
সতত রয়েছ অন্যমনে |
সর্বত্র ছিলাম আমি-----                      এখন এসেছি নামি
হৃদয়ের প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে !

দিয়েছিলে হৃদয় যখন
পেয়েছিলে প্রাণমন দেহ ----
আজ সে হৃদয় নাই,                          যতই সোহাগ পাই
শুধু তাই অবিশ্বাস বিষাদ সন্দেহ |

জীবনের বসন্তে যাহারে
ভালোবেসেছিলে একদিন,
হায় হায় কী কুগ্রহ ,                       আজ তারে অনুগ্রহ ---
মিষ্ট কথা দিবে তারে গুটি দুই-তিন !

অপবিত্র ও করপরশ
সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে |
মনে কি করেছ, বধূ                           ও হাসি এতই মধু
প্রেম না দিলেও চলে, শুধু হাসি দিলে |

তুমিই তো দেখালে আমায়
( স্বপ্নেও ছিল না এত আশা )
প্রেমে দেয় কতখানি                      কোন্ হাসি কোন্ বাণী,
হৃদয় বাসিতে পারে কত ভালোবাসা  |

তোমারি সে ভালোবাসা দিয়ে
বুঝেছি আজি এ ভালোবাসা---
আজি এই দৃষ্টি হাসি,                         এ আদর রাশি রাশি,
এই দূরে চলে-যাওয়া, এই কাছে আসা |

বুক ফেটে কেন অশ্রু পড়ে
তবুও কি বুঝিতে পার না ?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি !                    এই মুছিলাম আঁখি—
এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা |

২১ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পুরুষের উক্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যেদিন সে প্রথম দেখিনু
সে তখন প্রথম যৌবন |
প্রথম জীবনপথে                বাহিরিয়া এ জগতে
কেমনে বাঁধিয়া গেল নয়নে নয়ন |

তখন ঊষার আধো আলো
পড়েছিল মুখে দুজনার |
তখন কে জানে কারে,       কে জানিত আপনারে,
কে জানিত সংসারের বিচিত্র ব্যাপার !

কে জানিত শ্রান্তি তৃপ্তি ভয়,
কে জানিত নৈরাশ্যযাতনা |
কে জানিত শুধু ছায়া            যৌবনের মোহমায়া,
আপনার হৃদয়ের সহস্র ছলনা !

আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে
তাহারেই ভালো বলে জানি |
সব প্রেম প্রেম নয়             ছিল না ত সে সংশয়,
যে আমারে কাছে টানে তারে কাছে টানি |

অনন্ত বাসরসুখ যেন
নিত্যহাসি প্রকৃতিবধূর---
পুষ্প যেন চিরপ্রাণ,              পাখির অশ্রান্ত গান,
বিশ্ব করেছিল ভান অনন্ত মধুর |

সেই গানে, সেই ফুল্ল ফুলে,
সেই প্রাতে প্রথম যৌবনে,
ভেবেছিনু এ হৃদয়                 অনন্ত অমৃতময়,
প্রেম চিরদিন রয় এ চিরজীবনে |

তাই সেই আশার উল্লাসে
মুখ তুলে চেয়েছিনু মুখে |
সুধাপাত্র  লয়ে হাতে             কিরণকিরীট মাথে
তরুণ দেবতাসম দাঁড়ানু সম্মুখে |

পত্রপুষ্প-গ্রহতারা-ভরা
নীলাম্বরে মগ্ন চরাচর,
তুমি তারি মাঝখানে        কী মূর্তি আঁকিলে প্রাণে ----
কি ললাট, কী নয়ন , কী শান্ত অধর !

সুগভীর কলধ্বনিময়
এ বিশ্বের রহস্য অকূল,
মাঝে তুমি শতদল                 ফুটেছিলে ঢলঢল ----
তীরে আমি দাঁড়াইয়া সৌরভে আকুল |

পরিপূর্ণ পূর্ণিমার মাঝে
ঊর্ধ্বমুখে চকোর যেমন
আকাশের ধারে যায়,             ছিঁড়িয়া দেখিতে চায়
অগাধ–স্বপন-ছাওয়া জ্যোত্স্না-আবরণ ----

তেমনি সভয়ে প্রাণ মোর
তুলিতে যাইত কত বার
একান্ত নিকটে গিয়ে,                     সমস্ত হৃদয় দিয়ে
মধুর রহস্যময় সৌন্দর্য তোমার |

হৃদয়ের কাছাকাছি সেই
প্রেমের প্রথম আনাগোনা,
সেই হাতে হাতে ঠেকা ,          সেই আধো চোখে দেখা,
চুপিচুপি প্রাণের প্রথম জানাশোনা !

অজানিত সকলি নূতন,
অবশ চরণ টলমল !
কোথা পথ কোথা নাই,       কোথা যেতে কোথা যাই,
কোথা হতে উঠে হাসি কোথা অশ্রুজল !

অতৃপ্ত বাসনা প্রাণে লয়ে
অবারিত প্রেমের ভবনে
যাহা পাই তাই তুলি,            খেলাই আপনা ভুলি----
কী যে রাখি কী যে ফেলি বুঝিতে পারি নে |

ক্রমে আসে আনন্দ-আসল ---
কুসুমিত ছায়াতরুতলে
জাগাই সরসীজল,                   ছিঁড়ি বসে ফুলদল
ধূলি সেও ভালো লাগে খেলাবার ছলে |

অবশেষে সন্ধ্যা হয়ে আসে,
শ্রান্তি আসে হৃদয় ব্যাপিয়া---
থেকে থেকে সন্ধ্যাবায়            করে ওঠে হায়-হায়,
অরণ্য মর্মরি ওঠে কাঁপিয়া কাঁপিয়া !

মনে হয় একি সব ফাঁকি !
এই বুঝি, আর কিছু নাই !
অথবা যে রত্ন-তরে              এসেছিনু আশা করে
অনেক লইতে গিয়ে হারাইনু তাই !

সুখের কাননতলে বসি
হৃদয় মাঝারে বেদনা ----
নিরখি কোলের কাছে       মৃৎপিণ্ড পড়িয়া আছে
দেবতারে ভেঙে ভেঙে করেছি খেলনা |

এরই মাঝে ক্লান্তি কেন আসে,
উঠিবারে করি প্রাণপণ !
হাসিতে আসে না হাসি,     বাজাতে বাজে না বাঁশি,
শরমে তুলিতে নারি নয়নে নয়ন |

কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে,
রহিলে না ধ্যান-ধারণায় |
সেই মায়া উপবন                  কোথা হল অদর্শন,
কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকালো পাথার !

স্বপ্নরাজ্য ছিল ও হৃদয়---
প্রবেশিয়া দেখিনু সেখানে
এই দিবা এই নিশি                 এই ক্ষুধা এই তৃষা,
প্রাণপাখি কাঁদে এই বাসনার টানে !

আমি চাই তোমারে যেমন
তুমি চাও তেমনি আমারে-----
কৃতার্থ হইব আশে             গেলেম তোমার পাশে,
তুমি এসে বসে আছ আমার দুয়ারে !

সৌন্দর্যসম্পদ-মাঝে বসি
কে জানিত কাঁদিছে বাসনা !
ভিক্ষা ভিক্ষা সব ঠাঁই -----      তবে আর কোথা যাই
ভিখারিণী হল যদি কমল-আসনা !

তাই আর পারি না সঁপিতে
সমস্ত এ বাহির অন্তর |
এ জগতে তোমা ছাড়া         ছিল না তোমার বাড়া,
তোমারে ছেড়েও আজ আছে চরাচর |


কখনো যে চাঁদের আলোতে
কখনো বসন্তসমীরণে
সেই ত্রিভুবনজয়ী                      অপাররহস্যময়ী
আনন্দমুরতিখানি জেগে ওঠে মনে |

কাছে যাই তেমনি হাসিয়া
নবীন যৌবনময় প্রাণে---
কেন হেরি অশ্রুজল                    হৃদয়ের হলাহল,
রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে অভিমানে |

প্রাণ দিয়ে সেই দেবীপূজা
চেয়ো না চেয়ো না তবে আর |
এসো থাকি দুই জনে              সুখে দুঃখে গৃহকোণে
দেবতার তরে থাক পুষ্প-অর্ঘ্যভার |

পার্ক স্ট্রীট
২৩ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শূন্য গৃহে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কে তুমি দিয়েছ স্নেহ মানবহৃদয়ে,
কে তুমি দিয়েছ প্রিয়জন !
বিরহের অন্ধকারে                কে তুমি কাঁদাও তারে,
তুমিও কেন গো সাথে কর না ক্রন্দন  !

প্রাণ যাহা চায় তাহা দাও বা না দাও,
তা বলে কি করুণা পাব না ?
দুর্লভ ধনের তরে                   শিশু কাঁদে সকাতরে,
তা বলে কি জননীর বাজে না বেদনা ?

দুর্বল মানবহিয়া বিদীর্ণ যেথায়,
মর্মভেদী যন্ত্রণা বিষম,
জীবন নির্ভরহারা                         ধুলায় লুটায় সারা,
সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম !

সেথাও জগৎ তব চিরমৌনী কেন,
নাহি দেয় আশ্বাসের সুখ |
ছিন্ন করি অন্তরাল                        অসীম রহস্যজাল
কেন না প্রকাশ পায় গুপ্ত স্নেহসুখ !

ধরণী জননী কেন বলিয়া উঠে না
------ করুণমর্মর কন্ঠস্বর----
‘আমি শুধু ধূলি নই,                    বত্স, আমি প্রাণময়ী
জননী, তোদের লাগি অন্তর কাতর !

‘নহ তুমি পরিত্যক্ত অনাথ সন্তান
চরাচর নিখিলের মাঝে----
‘তোমার ব্যাকুল স্বর                  উঠিছে আকাশ-‘পর,
তারায় তারায় তার ব্যথা গিয়ে বাজে |’

কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই----
নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ ?
তোমার বিচিত্র ভবে                 কত আছে কত হবে----
কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত ?

আছে সেই সূর্যালোক , নাই সেই হাসি----
আছে চাঁদ, নাই চাঁদমুখ |
শূন্য পড়ে আছে গেহ,                নাই কেহ, নাই কেহ ---
রয়েছে জীবন, নেই জীবনের সুখ |

সেইটুকু মুখখানি, সেই দুটি হাত.
সেই হাসি অধরের ধারে---
সে নহিলে এ জগৎ                        শুষ্ক মরুভূমিবৎ----
নিতান্ত সামান্য এ কি এ বিশ্বব্যাপারে?

এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট
চৌদিকের চিরনীরবতা ?
সমস্ত মানবপ্রাণ                         বেদনায় কম্পমান,
নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা !

গাজিপুর
২১ বৈশাখ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
জীবনমধ্যাহ্নে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জীবন আছিল লঘু প্রথম বয়সে,
চলেছিনু আপনার বলে
সুদীর্ঘ জীবনযাত্রা নবীন প্রভাতে
আরম্ভিনু খেলিবার ছলে |
অশ্রুতে ছিল না তাপ, হাস্যে উপহাস,
বচনে ছিল না বিষানল ---
ভাবনাভ্রুকুটীহীন সরল ললাট
সুপ্রশান্ত আনন্দ উজ্জ্বল |

কুটিল হইল পথ, জটীল জীবন,
বেড়ে গেল জীবনের ভার ----
ধরণীর ধূলিমাঝে গুরু আকর্ষণ ,
পতন হইল কত বার |
আপনার ‘পরে আর কিসের বিশ্বাস,
আপনার মাঝে আশা নাই----
দর্প চূর্ণ হয়ে গেছে, ধূলি-সাথে মিশে
লজ্জাবস্ত্র জীর্ণ শত ঠাঁই |

তাই আজ বার বার ধাই তব পানে,
ওহে তুমি নিখিলনির্ভর !
অনন্ত এ দেশকাল আচ্ছন্ন করিয়া
আছ তুমি  আপনার ‘পর |
ক্ষণেক দাঁড়ায়ে পথে দেখিতেছি চেয়ে
তোমার ব্রহ্মাণ্ড বৃহৎ----
কোথায় এসেছি আমি, কোথায় যেতেছি,
কোন্ পথে চলেছে জগৎ !

প্রকৃতির শান্তি আজি করিতেছি পান
চিরস্রোত সান্ত্বনার ধারা----
নিশীথ-আকাশ-মাঝে নয়ন তুলিয়া
দেখতেছি কোটি গ্রহতারা---
সুগভীর তামসীর ছিদ্রপথে যেন
জ্যোতির্ময় তোমার আভাস,
ওহে মহা-অন্ধকার, ওহে মহাজ্যোতি,
অপ্রকাশ, চির-স্বপ্রকাশ !

যখন জীবনভার ছিল লঘু অতি,
যখন ছিল না কোনো পাপ,
তখন তোমার পানে দেখি নাই চেয়ে,
জানি নাই তোমার প্রতাপ----
তোমার অগাধ শান্তি, রহস্য অপার,
সৌন্দর্য অসীম অতুলন |
স্তব্ধভাবে মুগ্ধনেত্রে নিবিড় বিস্ময়ে
দেখি নাই তোমার ভুবন |

কোমল সায়াহ্নলেখা বিষণ্ণ উদার
প্রান্তরের প্রান্ত-আম্রবনে,
বৈশাখের নীলধারা বিমলবাহিনী
ক্ষীণগঙ্গা সৈকতশয়নে,
শিরোপরি সপ্ত ঋষি যুগ-যুগান্তের
ইতিহাসে নিবিষ্ট-নয়ান,
নিদ্রাহীন পূর্ণচন্দ্র নিস্তব্ধ নিশীথে
নিদ্রার সমুদ্রে ভাসমান---

নিত্যনিশ্বসিত বায়ু, উন্মেষিত উষা,
কনকে শ্যামলে সম্মিলন,
দূরদূরান্তশায়ী মধ্যাহ্ন উদাস,
বনচ্ছায়া নিবিড় গহন,
যতদূর নেত্র যায় শস্যশীর্ষরাশি
ধরার অঞ্চলতল ভরি---
জগতের মর্ম হতে মোর মর্মস্থলে
আনিতেছে জীবনলহরী |

বচন-অতীত ভাবে ভরিছে হৃদয়
নয়নে উঠিছে অশ্রুজল,
বিরহবিষাদ মোর গলিয়া ঝরিয়া
ভিজায় বিশ্বের বক্ষস্থল |
প্রশান্ত গভীর এই প্রকৃতির মাঝে
আমার জীবন হয় হারা,
মিশে যায় মহাপ্রাণসাগরের বুকে
ধূলিম্লান পাপতাপধারা |

শুধু জেগে উঠে প্রেম মঙ্গল মধুর,
বেড়ে যায় জীবনের গতি,
ধূলিধৌত দুঃখশোক শুভ্রশান্ত বেশে
ধরে যেন আনন্দমুরতি |
বন্ধন হারায়ে গিয়ে স্বার্থ ব্যাপ্ত হয়
অবারিত জগতের মাঝে,
বিশ্বের নিশ্বাস লাগি জীবনকুহরে
মঙ্গল-আনন্দধ্বনি বাজে |

১৪ বৈশাখ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শ্রান্তি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কত বার মনে করি                 পূর্ণিমানিশীথে
স্নিগ্ধ সমীরণ,
নিদ্রালস আঁখি-সম         ধীরে যদি মুদে আসে
এ শ্রান্ত জীবন |
গগনের অনিমেষ             জাগ্রত চাঁদের পানে
মুক্ত দুটি বাতায়নদ্বার ----
সুদূরে প্রহরে বাজে,        গঙ্গা কোথা বহে চলে,
নিদ্রায় সুষুপ্ত দুই পার  |
মাঝি গান গেয়ে যায়                 বৃন্দাবনগাথা
আপনার মনে,
চিরজীবনের স্মৃতি          অশ্রু হয়ে গ’লে আসে
নয়নের কোণে |
স্বপ্নের সুধীর স্রোতে          দূরে ভেসে যায় প্রাণ
স্বপ্ন হতে নিঃস্বপ্ন অতলে,
ভাসানো-প্রদীপ যথা           নিবে গিয়ে সন্ধ্যাবায়ে
ডুবে যায় জাহ্নবীর জলে |

১৬ বৈশাখ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিচ্ছেদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্যাকুল নয়ন মোর, অস্তমান রবি,
সায়াহ্ন মেঘাবনত পশ্চিম গগনে,
সকলে দেখিতেছিল সেই মুখচ্ছবি---
একা সে চলিতেছিল আপনার মনে |

ধরণী ধরিতেছিল কোমল চরণ,
বাতাস লভিতেছিল বিমল নিশ্বাস,
সন্ধ্যার-আলোক-আঁকা দুখানি নয়ন
ভুলায়ে লইতেছিল পশ্চিম আকাশ |

রবি তারে দিতেছিল আপন কিরণ,
মেঘ তারে দিতেছিল স্বর্ণময় ছায়া,
মুগ্ধহিয়া পথিকের উত্সুক নয়ন
মুখে তার দিতেছিল প্রেমপূর্ণ মায়া |

চারি দিকে শস্যরাশি চিত্রসম স্থির,
প্রান্তে নীল নদীরেখা, দূর পরপারে
শুভ্র চর, আরো দূরে বনের তিমির
দহিতেছে অগ্নিদীপ্তি দিগন্ত-মাঝারে |

দিবসের শেষ দৃষ্টি ---- অন্তিম মহিমা----
সহসা ঘেরিল তারে কনক-আলোকে,
বিষণ্ণ কিরণপটে মোহিনী প্রতিমা
উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে অনিমেষ চেখে |

নিমেষে ঘুরিল ধরা, ডুবিল তপন,
সহসা সম্মুখে এল ঘোর অন্তরাল----
নয়নের দৃষ্টি গেল, রহিল স্বপন,
অনন্ত আকাশ, আর ধরণী বিশাল |

১৯ বৈশাখ  ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মানসিক অভিসার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে হয় সেও যেন রয়েছে বসিয়া
চাহি বাতায়ন হতে নয়ন উদাস----
কপোলে, কানের কাছে, যার নিশ্বসিয়া
কে জানে কাহার কথা বিষণ্ণ বাতাস |

ত্যজি তার তনুখানি কোমল হৃদয়
বাহির হয়েছে যেন দীর্ঘ অভিসারে,
সম্মুখে অপার ধরা কঠিন নিদয়----
একাকিনী দাঁড়ায়েছে তাহারি মাঝারে |

হয়তো বা এখনি সে এসেছে হেথায়,
মৃদুপদে পশিতেছে এই বাতায়নে,
মানসমুরতিখানি আকুল আমায়
বাঁধিতেছে দেহহীন স্বপ্ন-আলিঙ্গনে |

তারি ভালোবাসা, তারি বাহু সুকোমল ,
উত্কন্ঠ চকোর-সম বিরহতিয়াষ,
বহিয়া আনিছে এই পুষ্পপরিমল----
কাঁদায়ে তুলিছে এই বসন্তবাতাস |

২১ বৈশাখ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পত্রের প্রত্যাশা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চিঠি কই ! দিন গেল !            বইগুলো ছুঁড়ে ফেলো
আর তো লাগে না ভালো ছাঁইপাশ পড়া |
মিটায়ে মনের খেদ                গেঁথে গেছে অবিচ্ছেদ,
পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদ মিছে মন-গড়া |
কাননপ্রান্তের কাছে                ছায়া পড়ে গাছে গাছে,
ম্লান আলো শুয়ে আছে বালুকার তীরে |
বায়ু উঠে ঢেউ তুলি,                    টলমল পড়ে দুলি
কূলে বাঁধা নৌকাগুলি জাহ্নবীর নীরে |

চিঠি কই ! হেথা এসে                একা বসে দূর দেশে
কী পড়িব দিনশেষে সন্ধ্যার আলোকে !
গোধূলি ছায়াতলে                 কে বলে গো মায়াবলে
সেই মুখ অশ্রুজলে এঁকে দেবে চোখে !
গভীর গুঞ্জনস্বনে                      ঝিল্লিরব  উঠে বনে,
কে মেশাবে তারি সনে স্মৃতিকন্ঠস্বর !
তীরতরু-ছায়ে–ছায়ে                কোমল সন্ধ্যার বায়ে
কে আনিয়া দিবে গায়ে সুকোমল কর !

পাখি তরুশিরে আসে,               দূর হতে নীড়ে আসে
তরীগুলি তীরে আসে, ফিরে আসে সবে----
তার সেই স্নেহস্বর                        ভেদি দূর দূরান্তর
কেন এ কোলের ‘পর আসে না নীরবে !
দিনান্তে স্নেহের স্মৃতি                  একবার আসে নিতি
কলরব-ভরা প্রীতি লয়ে তার মুখে----
দিবসের ভার যত                         তবে হয় অপগত,
নিশি নিমেষের মতো কাটে স্বপ্নসুখে |

সকলই তো মনে আছে                 যতদিন ছিল কাছে
কত কথা বলিয়াছে কত ভালোবেসে ----
কত কথা শুনি নাই,                      হৃদয়ে পায় নি ঠাঁই,
মুহূর্ত শুনিয়া তাই ভুলেছি নিমেষে |
পাতা পোরাবার ছলে                আজ সে যা-কিছু বলে,
তাই শুনে মন গলে, চোখে আসে জল----
তারি লাগি কত ব্যথা                   কত মনোব্যাকুলতা,
দু-চারিটি তুচ্ছ কথা জীবনসম্বল !

দিবা যেন আলোহীন                      এই দুটি কথা বিনা
‘তুমি ভালো আছ কি না’ ‘আমি ভালো আছি’ |
স্নেহ যেন নাম ডেকে                  কাছে এসে যায় দেখে,
দুটি কথা দূর থেকে করে কাছাকাছি |
দরশ পরশ যত                               সকল বন্ধন গত,
মাঝে ব্যবধান কত নদীগিরিপারে---
স্মৃতি শুধু স্নেহ বয়ে                        দুঁহু করস্পর্শ লয়ে
অক্ষরের মালা হয়ে বাঁধে দুজনারে |

কই চিঠি ! এল নিশা,                     তিমিরে ডুবিল দিশা,
সারা দিবসের তৃষা রয়ে গেল মনে----
অন্ধকার নদীতীরে                     বেড়াতেছি ফিরে ফিরে,
প্রকৃতির শান্তি ধীরে পশিছে জীবনে |
ক্রমে আঁখি ছলছল্ ,                      দুটি ফোঁটা অশ্রুজল
ভিজায় কপোলতল, শুকায় বাতাসে----
ক্রমে অশ্রু নাহি বয়,                          ললাট শীতল হয়
রজনীর শান্তিময় শীতল নিশ্বাসে |

আকাশে অসংখ্য তারা                   চিন্তাহারা ক্লান্তিহারা,
হৃদয় বিস্ময়ে সারা হেরি একদিঠি-----
আর যে আসে না আসে                    মুক্ত এই মহাকাশে
প্রতি সন্ধ্যা পরকাশে অসীমের চিঠি |
অনন্ত বারতা বহে------                      অন্ধকার হতে কহে,
‘যে রহে যে নাহি রহে কেহ নহে একা----
সীমাপরপারে থাকি                       সেথা হতে সবে ডাকি
প্রতি রাত্রে লিখে রাখি জ্যোতিপত্রলেখা |’

২৩ বৈশাখ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com