|
নারীর উক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিছে তর্ক---- থাক্ তবে থাক্ | কেন কাঁদি বুঝিতে পার না ? তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই মুছিলাম আঁখি--- এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা | আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে ওই তব আঁখি-তুলে চাওয়া--- ওই কথা, ওই হাসি, ওই কাছে আসা-আসি, অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে যাওয়া ? কেন আন বসন্তনিশীথে আঁখিভরা আবেশ বিহ্বল --- যদি বসন্তের শেষে শ্রান্তমনে ম্লান হেসে কাতরে খুঁজিতে হয় বিদায়ের ছল ? আছি যেন সোনার খাঁচায় একখানি পোষ-মানা প্রাণ | এও কি বুঝাতে হয় প্রেম যদি নাহি রয় হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান ? মনে আছে সেই এক দিন প্রথম প্রণয় সে তখন | বিমল শরতকাল, শুভ্র ক্ষীণ মেঘজাল, মৃদু শীতবায়ে স্নিগ্ধ রবির কিরণ | কাননে ফুটিত শেফালিকা, ফুলে ছেয়ে যেত তরুমূল | পরিপূর্ণ সুরধুনী, কুলুকুলু ধ্বনি শুনি, পরপারে বনশ্রেণী কুয়াশা-আকূল | আমা-পানে চাহিয়ে তোমার আঁখিতে কাঁপিত প্রাণখানি | আনন্দে বিষাদে মেশা সেই নয়নের নেশা তুমি তো জানো না তাহা, আমি তাহা জানি | সে কি মনে পড়িবে তোমার---- সহস্র লোকের মাঝখানে যেমনি দেখিতে মোরে কোন্ আকর্ষণডোরে আপনি আসিতে কাছে জানে কি অজ্ঞানে | ক্ষণিক বিরহ-অবসানে নিবিড় মিলন-ব্যাকুলতা মাঝে মাঝে সব ফেলি রহিতে নয়ন মেলি, আঁখিতে শুনিতে যেন হৃদয়ের কথা | কোনো কথা না রহিলে তবু শুধাইতে নিকটে আসিয়া | নীরবে চরণ ফেলে চুপিচুপি কাছে এলে কেমনে জানিতে পেতে, ফিরিতে হাসিয়া | আজ তুমি দেখেও দেখ না, সব কথা শুনিতে না পাও | কাছে আস আশা ক’রে আছি সারাদিন ধ’রে আনমন পাশ দিয়ে তুমি চলে যাও | দীপ জ্বেলে দীর্ঘ ছায়া লয়ে, বসে আছি সন্ধ্যায় ক’জনা ---- হয়তো বা কাছে এসে, হয়তো বা দূরে বস, সে সকলই ইচ্ছাহীন দৈবের ঘটনা | এখন হয়েছে বহু কাজ, সতত রয়েছ অন্যমনে | সর্বত্র ছিলাম আমি----- এখন এসেছি নামি হৃদয়ের প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে ! দিয়েছিলে হৃদয় যখন পেয়েছিলে প্রাণমন দেহ ---- আজ সে হৃদয় নাই, যতই সোহাগ পাই শুধু তাই অবিশ্বাস বিষাদ সন্দেহ | জীবনের বসন্তে যাহারে ভালোবেসেছিলে একদিন, হায় হায় কী কুগ্রহ , আজ তারে অনুগ্রহ --- মিষ্ট কথা দিবে তারে গুটি দুই-তিন ! অপবিত্র ও করপরশ সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে | মনে কি করেছ, বধূ ও হাসি এতই মধু প্রেম না দিলেও চলে, শুধু হাসি দিলে | তুমিই তো দেখালে আমায় ( স্বপ্নেও ছিল না এত আশা ) প্রেমে দেয় কতখানি কোন্ হাসি কোন্ বাণী, হৃদয় বাসিতে পারে কত ভালোবাসা | তোমারি সে ভালোবাসা দিয়ে বুঝেছি আজি এ ভালোবাসা--- আজি এই দৃষ্টি হাসি, এ আদর রাশি রাশি, এই দূরে চলে-যাওয়া, এই কাছে আসা | বুক ফেটে কেন অশ্রু পড়ে তবুও কি বুঝিতে পার না ? তর্কেতে বুঝিবে তা কি ! এই মুছিলাম আঁখি— এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা | ২১ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
পুরুষের উক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেদিন সে প্রথম দেখিনু সে তখন প্রথম যৌবন | প্রথম জীবনপথে বাহিরিয়া এ জগতে কেমনে বাঁধিয়া গেল নয়নে নয়ন | তখন ঊষার আধো আলো পড়েছিল মুখে দুজনার | তখন কে জানে কারে, কে জানিত আপনারে, কে জানিত সংসারের বিচিত্র ব্যাপার ! কে জানিত শ্রান্তি তৃপ্তি ভয়, কে জানিত নৈরাশ্যযাতনা | কে জানিত শুধু ছায়া যৌবনের মোহমায়া, আপনার হৃদয়ের সহস্র ছলনা ! আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে তাহারেই ভালো বলে জানি | সব প্রেম প্রেম নয় ছিল না ত সে সংশয়, যে আমারে কাছে টানে তারে কাছে টানি | অনন্ত বাসরসুখ যেন নিত্যহাসি প্রকৃতিবধূর--- পুষ্প যেন চিরপ্রাণ, পাখির অশ্রান্ত গান, বিশ্ব করেছিল ভান অনন্ত মধুর | সেই গানে, সেই ফুল্ল ফুলে, সেই প্রাতে প্রথম যৌবনে, ভেবেছিনু এ হৃদয় অনন্ত অমৃতময়, প্রেম চিরদিন রয় এ চিরজীবনে | তাই সেই আশার উল্লাসে মুখ তুলে চেয়েছিনু মুখে | সুধাপাত্র লয়ে হাতে কিরণকিরীট মাথে তরুণ দেবতাসম দাঁড়ানু সম্মুখে | পত্রপুষ্প-গ্রহতারা-ভরা নীলাম্বরে মগ্ন চরাচর, তুমি তারি মাঝখানে কী মূর্তি আঁকিলে প্রাণে ---- কি ললাট, কী নয়ন , কী শান্ত অধর ! সুগভীর কলধ্বনিময় এ বিশ্বের রহস্য অকূল, মাঝে তুমি শতদল ফুটেছিলে ঢলঢল ---- তীরে আমি দাঁড়াইয়া সৌরভে আকুল | পরিপূর্ণ পূর্ণিমার মাঝে ঊর্ধ্বমুখে চকোর যেমন আকাশের ধারে যায়, ছিঁড়িয়া দেখিতে চায় অগাধ–স্বপন-ছাওয়া জ্যোত্স্না-আবরণ ---- তেমনি সভয়ে প্রাণ মোর তুলিতে যাইত কত বার একান্ত নিকটে গিয়ে, সমস্ত হৃদয় দিয়ে মধুর রহস্যময় সৌন্দর্য তোমার | হৃদয়ের কাছাকাছি সেই প্রেমের প্রথম আনাগোনা, সেই হাতে হাতে ঠেকা , সেই আধো চোখে দেখা, চুপিচুপি প্রাণের প্রথম জানাশোনা ! অজানিত সকলি নূতন, অবশ চরণ টলমল ! কোথা পথ কোথা নাই, কোথা যেতে কোথা যাই, কোথা হতে উঠে হাসি কোথা অশ্রুজল ! অতৃপ্ত বাসনা প্রাণে লয়ে অবারিত প্রেমের ভবনে যাহা পাই তাই তুলি, খেলাই আপনা ভুলি---- কী যে রাখি কী যে ফেলি বুঝিতে পারি নে | ক্রমে আসে আনন্দ-আসল --- কুসুমিত ছায়াতরুতলে জাগাই সরসীজল, ছিঁড়ি বসে ফুলদল ধূলি সেও ভালো লাগে খেলাবার ছলে | অবশেষে সন্ধ্যা হয়ে আসে, শ্রান্তি আসে হৃদয় ব্যাপিয়া--- থেকে থেকে সন্ধ্যাবায় করে ওঠে হায়-হায়, অরণ্য মর্মরি ওঠে কাঁপিয়া কাঁপিয়া ! মনে হয় একি সব ফাঁকি ! এই বুঝি, আর কিছু নাই ! অথবা যে রত্ন-তরে এসেছিনু আশা করে অনেক লইতে গিয়ে হারাইনু তাই ! সুখের কাননতলে বসি হৃদয় মাঝারে বেদনা ---- নিরখি কোলের কাছে মৃৎপিণ্ড পড়িয়া আছে দেবতারে ভেঙে ভেঙে করেছি খেলনা | এরই মাঝে ক্লান্তি কেন আসে, উঠিবারে করি প্রাণপণ ! হাসিতে আসে না হাসি, বাজাতে বাজে না বাঁশি, শরমে তুলিতে নারি নয়নে নয়ন | কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে, রহিলে না ধ্যান-ধারণায় | সেই মায়া উপবন কোথা হল অদর্শন, কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকালো পাথার ! স্বপ্নরাজ্য ছিল ও হৃদয়--- প্রবেশিয়া দেখিনু সেখানে এই দিবা এই নিশি এই ক্ষুধা এই তৃষা, প্রাণপাখি কাঁদে এই বাসনার টানে ! আমি চাই তোমারে যেমন তুমি চাও তেমনি আমারে----- কৃতার্থ হইব আশে গেলেম তোমার পাশে, তুমি এসে বসে আছ আমার দুয়ারে ! সৌন্দর্যসম্পদ-মাঝে বসি কে জানিত কাঁদিছে বাসনা ! ভিক্ষা ভিক্ষা সব ঠাঁই ----- তবে আর কোথা যাই ভিখারিণী হল যদি কমল-আসনা ! তাই আর পারি না সঁপিতে সমস্ত এ বাহির অন্তর | এ জগতে তোমা ছাড়া ছিল না তোমার বাড়া, তোমারে ছেড়েও আজ আছে চরাচর | কখনো যে চাঁদের আলোতে কখনো বসন্তসমীরণে সেই ত্রিভুবনজয়ী অপাররহস্যময়ী আনন্দমুরতিখানি জেগে ওঠে মনে | কাছে যাই তেমনি হাসিয়া নবীন যৌবনময় প্রাণে--- কেন হেরি অশ্রুজল হৃদয়ের হলাহল, রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে অভিমানে | প্রাণ দিয়ে সেই দেবীপূজা চেয়ো না চেয়ো না তবে আর | এসো থাকি দুই জনে সুখে দুঃখে গৃহকোণে দেবতার তরে থাক পুষ্প-অর্ঘ্যভার | পার্ক স্ট্রীট ২৩ অগ্রহায়ণ ১৮৮৭ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
শূন্য গৃহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে তুমি দিয়েছ স্নেহ মানবহৃদয়ে, কে তুমি দিয়েছ প্রিয়জন ! বিরহের অন্ধকারে কে তুমি কাঁদাও তারে, তুমিও কেন গো সাথে কর না ক্রন্দন ! প্রাণ যাহা চায় তাহা দাও বা না দাও, তা বলে কি করুণা পাব না ? দুর্লভ ধনের তরে শিশু কাঁদে সকাতরে, তা বলে কি জননীর বাজে না বেদনা ? দুর্বল মানবহিয়া বিদীর্ণ যেথায়, মর্মভেদী যন্ত্রণা বিষম, জীবন নির্ভরহারা ধুলায় লুটায় সারা, সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম ! সেথাও জগৎ তব চিরমৌনী কেন, নাহি দেয় আশ্বাসের সুখ | ছিন্ন করি অন্তরাল অসীম রহস্যজাল কেন না প্রকাশ পায় গুপ্ত স্নেহসুখ ! ধরণী জননী কেন বলিয়া উঠে না ------ করুণমর্মর কন্ঠস্বর---- ‘আমি শুধু ধূলি নই, বত্স, আমি প্রাণময়ী জননী, তোদের লাগি অন্তর কাতর ! ‘নহ তুমি পরিত্যক্ত অনাথ সন্তান চরাচর নিখিলের মাঝে---- ‘তোমার ব্যাকুল স্বর উঠিছে আকাশ-‘পর, তারায় তারায় তার ব্যথা গিয়ে বাজে |’ কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই---- নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ ? তোমার বিচিত্র ভবে কত আছে কত হবে---- কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত ? আছে সেই সূর্যালোক , নাই সেই হাসি---- আছে চাঁদ, নাই চাঁদমুখ | শূন্য পড়ে আছে গেহ, নাই কেহ, নাই কেহ --- রয়েছে জীবন, নেই জীবনের সুখ | সেইটুকু মুখখানি, সেই দুটি হাত. সেই হাসি অধরের ধারে--- সে নহিলে এ জগৎ শুষ্ক মরুভূমিবৎ---- নিতান্ত সামান্য এ কি এ বিশ্বব্যাপারে? এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট চৌদিকের চিরনীরবতা ? সমস্ত মানবপ্রাণ বেদনায় কম্পমান, নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা ! গাজিপুর ২১ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
জীবনমধ্যাহ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন আছিল লঘু প্রথম বয়সে, চলেছিনু আপনার বলে সুদীর্ঘ জীবনযাত্রা নবীন প্রভাতে আরম্ভিনু খেলিবার ছলে | অশ্রুতে ছিল না তাপ, হাস্যে উপহাস, বচনে ছিল না বিষানল --- ভাবনাভ্রুকুটীহীন সরল ললাট সুপ্রশান্ত আনন্দ উজ্জ্বল | কুটিল হইল পথ, জটীল জীবন, বেড়ে গেল জীবনের ভার ---- ধরণীর ধূলিমাঝে গুরু আকর্ষণ , পতন হইল কত বার | আপনার ‘পরে আর কিসের বিশ্বাস, আপনার মাঝে আশা নাই---- দর্প চূর্ণ হয়ে গেছে, ধূলি-সাথে মিশে লজ্জাবস্ত্র জীর্ণ শত ঠাঁই | তাই আজ বার বার ধাই তব পানে, ওহে তুমি নিখিলনির্ভর ! অনন্ত এ দেশকাল আচ্ছন্ন করিয়া আছ তুমি আপনার ‘পর | ক্ষণেক দাঁড়ায়ে পথে দেখিতেছি চেয়ে তোমার ব্রহ্মাণ্ড বৃহৎ---- কোথায় এসেছি আমি, কোথায় যেতেছি, কোন্ পথে চলেছে জগৎ ! প্রকৃতির শান্তি আজি করিতেছি পান চিরস্রোত সান্ত্বনার ধারা---- নিশীথ-আকাশ-মাঝে নয়ন তুলিয়া দেখতেছি কোটি গ্রহতারা--- সুগভীর তামসীর ছিদ্রপথে যেন জ্যোতির্ময় তোমার আভাস, ওহে মহা-অন্ধকার, ওহে মহাজ্যোতি, অপ্রকাশ, চির-স্বপ্রকাশ ! যখন জীবনভার ছিল লঘু অতি, যখন ছিল না কোনো পাপ, তখন তোমার পানে দেখি নাই চেয়ে, জানি নাই তোমার প্রতাপ---- তোমার অগাধ শান্তি, রহস্য অপার, সৌন্দর্য অসীম অতুলন | স্তব্ধভাবে মুগ্ধনেত্রে নিবিড় বিস্ময়ে দেখি নাই তোমার ভুবন | কোমল সায়াহ্নলেখা বিষণ্ণ উদার প্রান্তরের প্রান্ত-আম্রবনে, বৈশাখের নীলধারা বিমলবাহিনী ক্ষীণগঙ্গা সৈকতশয়নে, শিরোপরি সপ্ত ঋষি যুগ-যুগান্তের ইতিহাসে নিবিষ্ট-নয়ান, নিদ্রাহীন পূর্ণচন্দ্র নিস্তব্ধ নিশীথে নিদ্রার সমুদ্রে ভাসমান--- নিত্যনিশ্বসিত বায়ু, উন্মেষিত উষা, কনকে শ্যামলে সম্মিলন, দূরদূরান্তশায়ী মধ্যাহ্ন উদাস, বনচ্ছায়া নিবিড় গহন, যতদূর নেত্র যায় শস্যশীর্ষরাশি ধরার অঞ্চলতল ভরি--- জগতের মর্ম হতে মোর মর্মস্থলে আনিতেছে জীবনলহরী | বচন-অতীত ভাবে ভরিছে হৃদয় নয়নে উঠিছে অশ্রুজল, বিরহবিষাদ মোর গলিয়া ঝরিয়া ভিজায় বিশ্বের বক্ষস্থল | প্রশান্ত গভীর এই প্রকৃতির মাঝে আমার জীবন হয় হারা, মিশে যায় মহাপ্রাণসাগরের বুকে ধূলিম্লান পাপতাপধারা | শুধু জেগে উঠে প্রেম মঙ্গল মধুর, বেড়ে যায় জীবনের গতি, ধূলিধৌত দুঃখশোক শুভ্রশান্ত বেশে ধরে যেন আনন্দমুরতি | বন্ধন হারায়ে গিয়ে স্বার্থ ব্যাপ্ত হয় অবারিত জগতের মাঝে, বিশ্বের নিশ্বাস লাগি জীবনকুহরে মঙ্গল-আনন্দধ্বনি বাজে | ১৪ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
শ্রান্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত বার মনে করি পূর্ণিমানিশীথে স্নিগ্ধ সমীরণ, নিদ্রালস আঁখি-সম ধীরে যদি মুদে আসে এ শ্রান্ত জীবন | গগনের অনিমেষ জাগ্রত চাঁদের পানে মুক্ত দুটি বাতায়নদ্বার ---- সুদূরে প্রহরে বাজে, গঙ্গা কোথা বহে চলে, নিদ্রায় সুষুপ্ত দুই পার | মাঝি গান গেয়ে যায় বৃন্দাবনগাথা আপনার মনে, চিরজীবনের স্মৃতি অশ্রু হয়ে গ’লে আসে নয়নের কোণে | স্বপ্নের সুধীর স্রোতে দূরে ভেসে যায় প্রাণ স্বপ্ন হতে নিঃস্বপ্ন অতলে, ভাসানো-প্রদীপ যথা নিবে গিয়ে সন্ধ্যাবায়ে ডুবে যায় জাহ্নবীর জলে | ১৬ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাকুল নয়ন মোর, অস্তমান রবি, সায়াহ্ন মেঘাবনত পশ্চিম গগনে, সকলে দেখিতেছিল সেই মুখচ্ছবি--- একা সে চলিতেছিল আপনার মনে | ধরণী ধরিতেছিল কোমল চরণ, বাতাস লভিতেছিল বিমল নিশ্বাস, সন্ধ্যার-আলোক-আঁকা দুখানি নয়ন ভুলায়ে লইতেছিল পশ্চিম আকাশ | রবি তারে দিতেছিল আপন কিরণ, মেঘ তারে দিতেছিল স্বর্ণময় ছায়া, মুগ্ধহিয়া পথিকের উত্সুক নয়ন মুখে তার দিতেছিল প্রেমপূর্ণ মায়া | চারি দিকে শস্যরাশি চিত্রসম স্থির, প্রান্তে নীল নদীরেখা, দূর পরপারে শুভ্র চর, আরো দূরে বনের তিমির দহিতেছে অগ্নিদীপ্তি দিগন্ত-মাঝারে | দিবসের শেষ দৃষ্টি ---- অন্তিম মহিমা---- সহসা ঘেরিল তারে কনক-আলোকে, বিষণ্ণ কিরণপটে মোহিনী প্রতিমা উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে অনিমেষ চেখে | নিমেষে ঘুরিল ধরা, ডুবিল তপন, সহসা সম্মুখে এল ঘোর অন্তরাল---- নয়নের দৃষ্টি গেল, রহিল স্বপন, অনন্ত আকাশ, আর ধরণী বিশাল | ১৯ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
মানসিক অভিসার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে হয় সেও যেন রয়েছে বসিয়া চাহি বাতায়ন হতে নয়ন উদাস---- কপোলে, কানের কাছে, যার নিশ্বসিয়া কে জানে কাহার কথা বিষণ্ণ বাতাস | ত্যজি তার তনুখানি কোমল হৃদয় বাহির হয়েছে যেন দীর্ঘ অভিসারে, সম্মুখে অপার ধরা কঠিন নিদয়---- একাকিনী দাঁড়ায়েছে তাহারি মাঝারে | হয়তো বা এখনি সে এসেছে হেথায়, মৃদুপদে পশিতেছে এই বাতায়নে, মানসমুরতিখানি আকুল আমায় বাঁধিতেছে দেহহীন স্বপ্ন-আলিঙ্গনে | তারি ভালোবাসা, তারি বাহু সুকোমল , উত্কন্ঠ চকোর-সম বিরহতিয়াষ, বহিয়া আনিছে এই পুষ্পপরিমল---- কাঁদায়ে তুলিছে এই বসন্তবাতাস | ২১ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
পত্রের প্রত্যাশা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি কই ! দিন গেল ! বইগুলো ছুঁড়ে ফেলো আর তো লাগে না ভালো ছাঁইপাশ পড়া | মিটায়ে মনের খেদ গেঁথে গেছে অবিচ্ছেদ, পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদ মিছে মন-গড়া | কাননপ্রান্তের কাছে ছায়া পড়ে গাছে গাছে, ম্লান আলো শুয়ে আছে বালুকার তীরে | বায়ু উঠে ঢেউ তুলি, টলমল পড়ে দুলি কূলে বাঁধা নৌকাগুলি জাহ্নবীর নীরে | চিঠি কই ! হেথা এসে একা বসে দূর দেশে কী পড়িব দিনশেষে সন্ধ্যার আলোকে ! গোধূলি ছায়াতলে কে বলে গো মায়াবলে সেই মুখ অশ্রুজলে এঁকে দেবে চোখে ! গভীর গুঞ্জনস্বনে ঝিল্লিরব উঠে বনে, কে মেশাবে তারি সনে স্মৃতিকন্ঠস্বর ! তীরতরু-ছায়ে–ছায়ে কোমল সন্ধ্যার বায়ে কে আনিয়া দিবে গায়ে সুকোমল কর ! পাখি তরুশিরে আসে, দূর হতে নীড়ে আসে তরীগুলি তীরে আসে, ফিরে আসে সবে---- তার সেই স্নেহস্বর ভেদি দূর দূরান্তর কেন এ কোলের ‘পর আসে না নীরবে ! দিনান্তে স্নেহের স্মৃতি একবার আসে নিতি কলরব-ভরা প্রীতি লয়ে তার মুখে---- দিবসের ভার যত তবে হয় অপগত, নিশি নিমেষের মতো কাটে স্বপ্নসুখে | সকলই তো মনে আছে যতদিন ছিল কাছে কত কথা বলিয়াছে কত ভালোবেসে ---- কত কথা শুনি নাই, হৃদয়ে পায় নি ঠাঁই, মুহূর্ত শুনিয়া তাই ভুলেছি নিমেষে | পাতা পোরাবার ছলে আজ সে যা-কিছু বলে, তাই শুনে মন গলে, চোখে আসে জল---- তারি লাগি কত ব্যথা কত মনোব্যাকুলতা, দু-চারিটি তুচ্ছ কথা জীবনসম্বল ! দিবা যেন আলোহীন এই দুটি কথা বিনা ‘তুমি ভালো আছ কি না’ ‘আমি ভালো আছি’ | স্নেহ যেন নাম ডেকে কাছে এসে যায় দেখে, দুটি কথা দূর থেকে করে কাছাকাছি | দরশ পরশ যত সকল বন্ধন গত, মাঝে ব্যবধান কত নদীগিরিপারে--- স্মৃতি শুধু স্নেহ বয়ে দুঁহু করস্পর্শ লয়ে অক্ষরের মালা হয়ে বাঁধে দুজনারে | কই চিঠি ! এল নিশা, তিমিরে ডুবিল দিশা, সারা দিবসের তৃষা রয়ে গেল মনে---- অন্ধকার নদীতীরে বেড়াতেছি ফিরে ফিরে, প্রকৃতির শান্তি ধীরে পশিছে জীবনে | ক্রমে আঁখি ছলছল্ , দুটি ফোঁটা অশ্রুজল ভিজায় কপোলতল, শুকায় বাতাসে---- ক্রমে অশ্রু নাহি বয়, ললাট শীতল হয় রজনীর শান্তিময় শীতল নিশ্বাসে | আকাশে অসংখ্য তারা চিন্তাহারা ক্লান্তিহারা, হৃদয় বিস্ময়ে সারা হেরি একদিঠি----- আর যে আসে না আসে মুক্ত এই মহাকাশে প্রতি সন্ধ্যা পরকাশে অসীমের চিঠি | অনন্ত বারতা বহে------ অন্ধকার হতে কহে, ‘যে রহে যে নাহি রহে কেহ নহে একা---- সীমাপরপারে থাকি সেথা হতে সবে ডাকি প্রতি রাত্রে লিখে রাখি জ্যোতিপত্রলেখা |’ ২৩ বৈশাখ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
মানসী www.milansagar.com |