|
বধূ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্ !’---- পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে, কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল ! কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথতল ! ছিলাম আনমনে একেলা গৃহকোণে, কে যেন ডাকিল রে ‘জলকে চল্’ | কলসী লয়ে কাঁখে---- পথ সে বাঁকা, বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধূ ধূ, ডাহিনে বাঁশবন হেলায়ে শাখা | দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে, দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা | গভীর থির নীরে ভাসিয়া যাই ধীরে, পিক কুহরে তীরে অমিয়-মাখা | পথে আসিতে ফিরে, আঁধার তরুশিরে সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা | অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি, সেখানে ছুটিতাম সকালে উঠি | শরতে ধরাতল শিশিরে ঝলমল, করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি | প্রাচীর বেয়ে বেয়ে সবুজে ফেলে ছেয়ে বেগুনি-ফুলে-ভরা লতিকা দুটি | ফাটলে দিয়ে আঁখি আড়ালে বসে থাকি, আঁচল পদতলে পড়েছে লুটি | মাঠের পর মাঠ, মাঠের শেষে সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে | এ ধারে পুরাতন শ্যামল তালবন সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায় ঘেঁষে | বাঁধের জলরেখা ঝলসে যায় দেখা, জটলা করে তীরে রাখাল এসে | চলেছে পথখানি কোথায় নাহি জানি , কে জানে কত শত নূতন দেশে | হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া ! বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে ব্যাকুল বালিকারে, নাহিকো মায়া | কোথা সে খেলার মাঠ, উদার পথঘাট, পাখির গান কই, বনের ছায়া ! কে যেন চারি দিকে দাঁড়িয়ে আছে, খুলিতে নারি মন শুনিবে পাছে ! হেথায় বৃথা কাঁদা, দেয়ালে পেয়ে বাধা কাঁদন ফিরে আসে আপন-কাছে | আমার আঁখিজল কেহ না বোঝে, অবাক্ হয়ে সবে কারণ খোঁজে | ‘কিছুতে নাহি তোষ, এ তো বিষম দোষ গ্রাম্য বালিকার স্বভাব ও যে ! স্বজন প্রতিবেশী এত যে মেশামেশি, ও কেন কোণে বসে নয়ন বোজে ? কেহ বা দেখে মুখ কেহ বা দেহ--- কেহ বা ভালো বলে, বলে না কেহ | ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি, পরখ করে সবে, করে না স্নেহ | সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা | কেমন করে কাটে সারাটা বেলা ! ইঁটের ‘পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট --- নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা | কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো ! কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁ গো ! উঠিলে নব শশী ছাদের ‘পরে বসি আর কি রূপকথা বলিবি না গো ! হৃদয়বেদনার শূন্য বিছানায় বুঝি, মা, আঁখিজলে রজনী জাগো ! কুসুম তুলি লয়ে প্রভাতে শিবালয়ে প্রবাসী তনয়ার কুশল মাগো | হেথাও উঠে চাঁদ ছাদের পারে, প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে | আমারে খুঁজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে, যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে | নিমেষতরে তাই আপনা ভুলি ব্যাকুল ছুটে যাই দুয়ার খুলি | অমনি চারি ধারে নয়ন উঁকি মারে, শাসন ছুটে আসে ঝটিকা তুলি | দেবে না ভালোবাসা, দেবে না আলো | সদাই মনে হয় আঁধার ছায়াময় দিঘির সেই জল শীতল কালো, তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো | ডাক্ লো ডাক্ তোরা, বল্ লো বল্ ---- ‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল !’ কবে পড়িবে বেলা, ফুরাবে সব খেলা, নিবাবে সব জ্বালা শীতল জল, জানিস যদি কেহ আমায় বল্ | ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮ সংশোধন-পরিবর্ধন শান্তিনিকেতন | ৭ কার্তিক . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
ব্যক্ত প্রেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ ? হৃদয়ের দ্বার হেনে বাহিরে আনিলে টেনে, শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন ? আপন অন্তরে আমি ছিলাম আপনি--- সংসারের শত কাজে ছিলাম সবার মাঝে, সকলে যেমন ছিল আমিও তেমনি | তুলিতে পূজার ফুল যেতেম যখন সেই পথ ছায়া-করা, সেই বেড়া লতা-ভরা, সেই সরসীর তীরে করবীর বন----- সেই কুহরিত পিক শিরীষের ডালে প্রভাতে সখীর মেলা, কত হাসি কত খেলা--- কে জানিত কী ছিল এ প্রাণের আড়ালে ! বসন্তে উঠিত ফুটে বনে বেলফুল, কেহ বা পরিত মালা, কেহ বা ভরিত ডালা, করিত দক্ষিণবায়ু অঞ্চল আকুল | বরষার ঘনঘটা, বিজুলি খেলায়---- প্রান্তরের প্রান্তদিশে মেঘে বনে যেত মিশে, জুঁইগুলি বিকশিত বিকেল বেলায় | বর্ষ আসে বর্ষ যায়, গৃহকাজ করি--- সুখদুঃখ ভাগ লয়ে প্রতিদিন যায় বয়ে, গোপন স্বপন লয়ে কাটে বিভাবরী | লুকানো প্রাণের প্রেম পবিত্র সে কত ! আঁধার হৃদয়তলে মানিকের মতো জ্বলে, আলোতে দেখায় কালো কলঙ্কের মতো | ভাঙিয়া দেখিলে ছিছি নারীর হৃদয় ! লাজে ভয়ে থর্ থর্ ভালোবাসা-সকাতর তার লুকাবার ঠাঁই কাড়িলে নিদয় ! আজিও তো সেই আসে বসন্ত শরৎ | বাঁকা সেই চাঁপা-শাখে সোনা-ফুল ফুটে থাকে, সেই তারা তোলে এসে---- সেই ছায়াপথ ! সবাই যেমন ছিল, আছে অবিকল --- সেই তারা কাঁদে হাসে, কাজ করে, ভালোবাসে, করে পূজা, জ্বালে দীপ, তুলে আনে জল | কেহ উঁকি মারে নাই তাহাদের প্রাণে --- ভাঙিয়া দেখে নি কেহ হৃদয় গোপন গেহ, আপন মরম তারা আপনি না জানে | আমি আজ ছিন্ন ফুল রাজপথে পড়ি, পল্লবের সুচিকন ছায়াস্নিগ্ধ আবরণ তেয়াগি ধূলায় হায় যাই গড়াগড়ি | নিতান্ত ব্যথার ব্যথী ভালোবাসা দিয়ে সযতনে চিরকাল রচি দিবে অন্তরাল, নগ্ন করেছিনু প্রাণ সেই আশা নিয়ে | মুখ ফিরাতেছ, সখা, আজ কী বলিয়া ! ভুল করে এসেছিলে ? ভুলে ভালোবেসেছিলে ? ভুল ভেঙে গেছে তাই যেতেছ চলিয়া ? তুমি তো ফিরিয়া যাবে আজ বই কাল--- আমার যে ফিরিবার পথ রাখ নাই আর, ধূলিসাৎ করেছে যে প্রাণের আড়াল | একি নিদারুণ ভুল ! নিখিলনিলয়ে এত শত প্রাণ ফেলে ভুল করে কেন এলে অভাগিনী রমণীর গোপন হৃদয়ে ! ভেবে দেখো আনিয়াছ মোরে কোন্ খানে--- শত লক্ষ আঁখিভরা কৌতুককঠিন ধরা চেয়ে রবে অনাবৃত কলঙ্কের পানে ! ভালোবাসা তাও যদি ফিরে নেবে শেষে, কেন লজ্জা কেড়ে নিলে, একাকিনী ছেড়ে দিলে বিশাল ভবের মাঝে বিবসনাবেশে ! ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮ পরিবর্ধন : শান্তিনিকেতন | ৭ কার্তিক . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
নিন্দুকের প্রতি নিবেদন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হউক ধন্য তোমার যশ লেখনী ধন্য হোক , তোমার প্রতিভা উজ্জ্বল হয়ে জাগাক সপ্তলোক | যদি পথে তব দাঁড়াইয়া থাকি আমি ছেড়ে দিব ঠাঁই---- কেন হীন ঘৃণা, ক্ষুদ্র এ দ্বেষ, বিদ্রূপ কেন ভাই ? আমার এ লেখা কারো ভালো লাগে তাহা কি আমার দোষ ? কেহ কবি বলে ( কেহ বা বলে না )---- কেন তাহে তব রোষ ? কত প্রাণপণ, দগ্ধ হৃদয়, বিনিদ্র বিভাবরী, জান কি, বন্ধু, উঠেছিল গীত কত ব্যথা ভেদ করি ? রাঙা ফুল হয়ে উঠিছে ফুটিয়া হৃদয়শোণিতপাত , অশ্রু ঝলিছে শিশিরের মতো পেহাইতে দুখরাত | উঠিতেছে কত কন্টকলতা, ফুলে পল্লবে ঢাকে----- গভীর গোপন বেদনা-মঝারে শিকড় আঁকড়ি থাকে | জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল সে সাধ ফুটিছে গানে ---- মরীচিকা রচি মিছে সে তৃপ্তি, তৃষ্ণা কাঁদিছে প্রাণে | এনেছি তুলিয়া পথের প্রান্তে মর্মকুসুম মম---- আসিছে পান্থ, যেতেছে লইয়া স্মরণচিহ্নসম | কোনো ফুল যাবে দুদিনে ঝরিয়া, কোনো ফুল বেঁচে রবে---- কোনো ছোটো ফুল আজিকার কথা কালিকার কানে কবে | তুমি কেন, ভাই, বিমুখ এমন ---- নয়নে কঠোর হাসি | দূর হতে যেন ফুঁসিছে সবেগে উপেক্ষা রাশি রাশি --- কঠিন বচন জরিছে অধরে উপহাস হলাহলে, লেখনীর মুখে করিতে দগ্ধ ঘৃণার অনলে জ্বলে | ভালোবেসে যাহা ফুটেছে পরানে সবার লাগিবে ভালো, যে জ্যোতি হরিছে আমার আঁধার সবারে দিবে সে আলো---- অন্তরমাঝে সবাই সমান, বাহিরে প্রভেদ ভবে, একের বেদনা করুণাপ্রবাহে সান্ত্বনা দিবে সবে | এই মনে করে ভালোবেসে আমি দিয়েছিনু উপহার--- ভালো নাহি লাগে ফেলে যাবে চলে, কিসের ভাবনা তার ! তোমার দেবার যদি কিছু থাকে তুমিও দাও-না এনে | প্রেম দিলে সবে নিকটে আসিবে তোমারে আপন জেনে | কিন্তু জানিয়ো আলোক কখনো থাকে না তো ছায়া বিনা, ঘৃণার টানেও কেহ বা আসিবে, তুমি করিয়ো না ঘৃণা ! এতই কোমল মানবের মন এমনি পরের বশ, নিষ্ঠুর বাণে সে প্রাণ ব্যথিতে কিছুই নাহিক যশ | তীক্ষ্ণ হাসিতে বাহিরে শোণিত , বচনে অশ্রু উঠে, নয়নকোণের চাহনি-ছুরিতে মর্মতন্তু টুটে | সান্ত্বনা দেওয়া নহে তো সহজ , দিতে হয় সারা প্রাণ, মানবমনের অনল নিভাতে আপনারে বলিদান | ঘৃণা জ্ব’লে মরে আপনার বিষে, রহে না সে চিরদিন---- অমর হইতে চাহ যদি, জেনো প্রেম সে মরণহীন | তুমিও রবে না, আমিও রব না, দুদিনের দেখা ভবে---- প্রাণ খুলে প্রেম দিতে পারো যদি তাহা চিরদিন রবে | দুর্বল মোরা, কত ভুল করি, অপূর্ব সব কাজ | নেহারি আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতা আপনি যে পাই লাজ | তা বলে যা পারি তাও করিব না ? নিষ্ফল হব ভবে ? প্রেমফুল ফোটে, ছোটো হল বলে দিব না কি তাহা সবে ? হয়তো এ ফুল সুন্দর নয়, ধরেছি সবার আগে ---- চলিতে চলিতে আঁখির পলকে ভুলে কারো ভালো লাগে | যদি ভুল হয় ক’ দিনের ভুল | দুদিনে ভাঙিবে তবে | তোমার এমন শাণিত বচন সেই কি অমর হবে ? ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
কবির প্রতি নিবেদন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেথা কেন দাঁড়ায়েছ, কবি, যেন কাষ্ঠপুত্তলছবি ? চারি দিকে লোকজন চলিতেছে সারাখন আকাশে উঠিছে খর রবি | কোথা তব বিজন ভবন , কোথা তব মানসভুবন ? তোমারে ঘেরিয়া ফেলি কোথা সেই করে কেলি কল্পনা, মুক্ত পবন ? নিখিলের আনন্দধাম কোথা সেই গভীর বিরাম ? জগতের গীতধার কেমনে শুনিবে আর ? শুনিতেছ আপনারই নাম | আকাশের পাখি তুমি ছিলে, ধরণীতে কেন ধরা দিলে ? বলে সবে বাহা-বাহা , সকলে পড়ায় যাহা তুমি তাই পড়িতে শিখিলে ! প্রভাতের আলোকের সনে অনাবৃত প্রভাতগগনে বহিয়া নূতন প্রাণ ঝরিয়া পড়ে না গান ঊর্দ্ধনয়ন এ ভুবনে | পথ হতে শত কলরবে ‘গাও গাও’ বলিতেছে সবে | ভাবিতে সময় নাই----- গান চাই, গান চাই, থামিতে চাহিছে প্রাণ যবে | থামিলে চলিয়া যাবে সবে, দেখিতে কেমনতর হবে ! উচ্চ আসনে লীন প্রাণহীন গানহীন পুতলির মতো বসে রবে | শ্রান্তি লুকাতে চাও ত্রাসে, কন্ঠ শুষ্ক হয়ে আসে | শুনে যারা যায় চলে দু-চারিটা কথা ব’লে তারা কি তোমায় ভালোবাসে ? কতমত পরিয়া মুখোশ মাগিছ সবার পরিতোষ | মিছে হাসি আনো দাঁতে, মিছে জল আঁখিপাতে, তবু তারা ধরে কত দোষ | মন্দ কহিছে কেহ ব’সে, কেহ বে নিন্দা তব ঘোষে | তাই নিয়ে অবিরত তর্ক করিছ কত, জ্বলিয়া মরিছ মিছে রোষে | মূর্খ, দম্ভ-ভরা দেহ, তোমারে করিয়া যায় স্নেহ | হাত বুলাইয়া পিঠে কথা বলে মিঠে মিঠে, শাবাশ-শাবাশ বলে কেহ | হায় কবি, এত দেশ ঘুরে আসিয়া পড়েছ কোন দূরে ! এ যে কোলাহলমরু------ নাই ছায়া, নাই তরু, যশের কিরণে মরো পুড়ে | দেখো, হোথা নদী-পর্বত, অবারিত অসীমের পথ | প্রকৃতি শান্তমুখে ছুটায় গগনবুকে গ্রহতারাময় তার রথ | সবাই আপন কাজে ধায়, পাশে কেহ ফিরিয়া না চায় | ফুটে চিররূপরাশি চিরমধুময় হাসি, আপনারে দেখিতে না পায় | হোথা দেখো একেলা আপনি আকাশের তারা গনি গনি ঘোর নিশীথের মাঝে কে জাগে আপন কাজে, সেথায় পশে না কলধ্বনি | দেখো হোথা নূতন জগৎ---- ওই কারা আত্মহারাবৎ যশ-অপযশ-বাণী কোনো কিছু নাহি মানি রচিছে সুদূর ভবিষ্যৎ | ওই দেখো, না পুরিতে আশ মরণ করিল কারে গ্রাস | নিশি না হইতে সারা খসিয়া পড়িল তারা, রাখিয়া গেল না ইতিহাস | ওই কারা গিরির মতন আপনাতে আপনি বিজন ---- হৃদয়ের স্রোত উঠি গোপন আলয় টুটি দূর দূর করিছে মগন | ওই কারা বসে আছে দূরে , কল্পনা-উদয়াচল-পুরে ---- অরুণপ্রকাশ-প্রায় আকাশ ভরিয়া যায় প্রতিদিন নব নব সুরে | হোথা উঠে নবীন তপন, হোথা হতে বহিছে পবন | হোথা চির ভালোবাসা---- নব গান, নব আশা---- অসীম বিরামনিকেতন | হোথা মানবের জয় উঠিছে জগৎময়, ওইখানে মিলিয়াছে নরনারায়ণ| হেথা, কবি, তোমারে কি সাজে ধূলি আর কলরোল-মাঝে ? ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮ . *************************** . সূচিতে . . . মিলনসাগর |
মানসী www.milansagar.com |