*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
বধূ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘বেলা যে পড়ে এল,   জলকে চল্ !’----
পুরানো সেই সুরে      কে যেন ডাকে দূরে,
কোথা সে ছায়া সখী,   কোথা সে জল !
কোথা সে বাঁধা ঘাট,    অশথতল !
ছিলাম আনমনে       একেলা গৃহকোণে,
কে যেন ডাকিল রে  ‘জলকে চল্’ |

কলসী লয়ে কাঁখে----     পথ সে বাঁকা,
বামেতে মাঠ শুধু             সদাই করে ধূ ধূ,
ডাহিনে বাঁশবন    হেলায়ে শাখা |
দিঘির কালো জলে        সাঁঝের আলো ঝলে,
দুধারে ঘন বন      ছায়ায় ঢাকা |
গভীর থির নীরে         ভাসিয়া যাই ধীরে,
পিক কুহরে তীরে     অমিয়-মাখা |
পথে আসিতে ফিরে,     আঁধার তরুশিরে
সহসা দেখি চাঁদ   আকাশে আঁকা |

অশথ উঠিয়াছে     প্রাচীর টুটি,
সেখানে ছুটিতাম    সকালে উঠি |
শরতে ধরাতল          শিশিরে ঝলমল,
করবী থোলো থোলো      রয়েছে ফুটি |
প্রাচীর বেয়ে বেয়ে            সবুজে ফেলে ছেয়ে
বেগুনি-ফুলে-ভরা      লতিকা দুটি |
ফাটলে দিয়ে আঁখি            আড়ালে বসে থাকি,
আঁচল পদতলে      পড়েছে লুটি |

মাঠের পর মাঠ,      মাঠের শেষে
সুদূর গ্রামখানি    আকাশে মেশে |
এ ধারে পুরাতন         শ্যামল তালবন
সঘন সারি দিয়ে        দাঁড়ায় ঘেঁষে |
বাঁধের জলরেখা          ঝলসে যায় দেখা,
জটলা করে তীরে   রাখাল এসে |
চলেছে পথখানি            কোথায় নাহি জানি ,
কে জানে কত শত   নূতন দেশে |

হায় রে রাজধানী   পাষাণকায়া !
বিরাট মুঠিতলে       চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে,     নাহিকো মায়া |
কোথা সে খেলার মাঠ,      উদার পথঘাট,
পাখির গান কই,    বনের ছায়া !

কে যেন চারি দিকে   দাঁড়িয়ে আছে,
খুলিতে নারি মন   শুনিবে পাছে !
হেথায় বৃথা কাঁদা,     দেয়ালে পেয়ে বাধা
কাঁদন ফিরে আসে    আপন-কাছে |

আমার আঁখিজল   কেহ না বোঝে,
অবাক্ হয়ে সবে    কারণ খোঁজে |
‘কিছুতে নাহি তোষ,       এ তো বিষম দোষ
গ্রাম্য বালিকার      স্বভাব ও যে !
স্বজন প্রতিবেশী    এত যে মেশামেশি,
ও কেন কোণে বসে    নয়ন বোজে ?

কেহ বা দেখে মুখ     কেহ বা দেহ---
কেহ বা ভালো বলে,   বলে না কেহ |
ফুলের মালাগাছি      বিকাতে আসিয়াছি,
পরখ করে সবে,   করে না স্নেহ |

সবার মাঝে আমি   ফিরি একেলা |
কেমন করে কাটে   সারাটা বেলা !
ইঁটের ‘পরে ইঁট,          মাঝে মানুষ-কীট ---
নাইকো ভালোবাসা,  নাইকো খেলা |

কোথায় আছ তুমি    কোথায় মা গো !
কেমনে ভুলে তুই    আছিস হাঁ গো  !
উঠিলে নব শশী        ছাদের ‘পরে বসি
আর কি রূপকথা   বলিবি না গো !
হৃদয়বেদনার                শূন্য বিছানায়
বুঝি, মা, আঁখিজলে  রজনী জাগো !
কুসুম তুলি লয়ে         প্রভাতে শিবালয়ে
প্রবাসী তনয়ার    কুশল মাগো |

হেথাও উঠে চাঁদ   ছাদের পারে,
প্রবেশ মাগে আলো   ঘরের দ্বারে |
আমারে খুঁজিতে সে   ফিরিছে দেশে দেশে,
যেন সে ভালোবেসে   চাহে আমারে |

নিমেষতরে তাই   আপনা ভুলি
ব্যাকুল ছুটে যাই  দুয়ার খুলি |
অমনি চারি ধারে   নয়ন উঁকি মারে,
শাসন ছুটে আসে  ঝটিকা তুলি |

দেবে না ভালোবাসা,   দেবে না আলো |
সদাই মনে হয়    আঁধার ছায়াময়
দিঘির সেই জল   শীতল কালো,
তাহারি কোলে গিয়ে   মরণ ভালো |

ডাক্ লো ডাক্ তোরা,    বল্ লো বল্ ----
‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল !’
কবে পড়িবে বেলা,         ফুরাবে সব খেলা,
নিবাবে সব জ্বালা   শীতল জল,
জানিস যদি কেহ   আমায় বল্ |

১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮
সংশোধন-পরিবর্ধন
শান্তিনিকেতন | ৭ কার্তিক

.         ***************************     

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্যক্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ ?
হৃদয়ের দ্বার হেনে           বাহিরে আনিলে টেনে,
শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন  ?

আপন অন্তরে আমি ছিলাম আপনি---
সংসারের শত কাজে           ছিলাম সবার মাঝে,
সকলে যেমন ছিল আমিও তেমনি |

তুলিতে পূজার ফুল যেতেম যখন
সেই পথ ছায়া-করা,            সেই বেড়া লতা-ভরা,
সেই সরসীর তীরে করবীর বন-----

সেই কুহরিত পিক শিরীষের ডালে
প্রভাতে সখীর মেলা,          কত হাসি কত খেলা---
কে জানিত কী ছিল এ প্রাণের আড়ালে !

বসন্তে উঠিত ফুটে বনে বেলফুল,
কেহ বা পরিত মালা,           কেহ বা ভরিত ডালা,
করিত দক্ষিণবায়ু অঞ্চল আকুল |

বরষার ঘনঘটা, বিজুলি খেলায়----
প্রান্তরের প্রান্তদিশে             মেঘে বনে যেত মিশে,
জুঁইগুলি বিকশিত বিকেল বেলায় |

বর্ষ আসে বর্ষ যায়, গৃহকাজ করি---
সুখদুঃখ ভাগ লয়ে                 প্রতিদিন যায় বয়ে,
গোপন স্বপন লয়ে কাটে বিভাবরী |

লুকানো প্রাণের প্রেম পবিত্র সে কত !
আঁধার হৃদয়তলে               মানিকের মতো জ্বলে,
আলোতে দেখায় কালো কলঙ্কের মতো |

ভাঙিয়া দেখিলে ছিছি নারীর হৃদয় !
লাজে ভয়ে থর্ থর্               ভালোবাসা-সকাতর
তার লুকাবার ঠাঁই কাড়িলে নিদয় !

আজিও তো সেই আসে বসন্ত শরৎ |
বাঁকা সেই চাঁপা-শাখে         সোনা-ফুল ফুটে থাকে,
সেই তারা তোলে এসে---- সেই ছায়াপথ !

সবাই যেমন ছিল, আছে অবিকল ---
সেই তারা কাঁদে হাসে,        কাজ করে, ভালোবাসে,
করে পূজা, জ্বালে দীপ, তুলে আনে জল |

কেহ উঁকি মারে নাই তাহাদের প্রাণে ---
ভাঙিয়া দেখে নি কেহ               হৃদয় গোপন গেহ,
আপন মরম তারা আপনি না জানে |

আমি আজ ছিন্ন ফুল রাজপথে পড়ি,
পল্লবের সুচিকন                      ছায়াস্নিগ্ধ আবরণ
তেয়াগি ধূলায় হায় যাই গড়াগড়ি |

নিতান্ত ব্যথার ব্যথী ভালোবাসা দিয়ে
সযতনে চিরকাল                     রচি দিবে অন্তরাল,
নগ্ন করেছিনু প্রাণ সেই আশা নিয়ে |

মুখ ফিরাতেছ, সখা, আজ কী বলিয়া !
ভুল করে এসেছিলে ?         ভুলে ভালোবেসেছিলে ?
ভুল ভেঙে গেছে তাই যেতেছ চলিয়া ?

তুমি তো ফিরিয়া যাবে আজ বই কাল---
আমার যে ফিরিবার                  পথ রাখ নাই আর,
ধূলিসাৎ করেছে যে প্রাণের আড়াল |

একি নিদারুণ ভুল !  নিখিলনিলয়ে
এত শত প্রাণ ফেলে                 ভুল করে কেন এলে
অভাগিনী রমণীর গোপন হৃদয়ে !

ভেবে দেখো আনিয়াছ মোরে কোন্ খানে---
শত লক্ষ আঁখিভরা                    কৌতুককঠিন ধরা
চেয়ে রবে অনাবৃত কলঙ্কের পানে !

ভালোবাসা তাও যদি ফিরে নেবে শেষে,
কেন লজ্জা কেড়ে নিলে,           একাকিনী ছেড়ে দিলে
বিশাল ভবের মাঝে বিবসনাবেশে !

১২ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮
পরিবর্ধন : শান্তিনিকেতন | ৭ কার্তিক

.         ***************************     

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অপেক্ষা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সকল বেলা কাটিয়া গেল
.       বিকাল নাহি যায় |
দিনের শেষে শ্রান্তছবি
কিছুতে যেতে চায় না রবি,
চাহিয়া থাকে ধরণী-পানে,
.       বিদায় নাহি চায় |

মেঘেতে দিন জড়ায়ে থাকে,
.       মিলায়ে থাকে মাঠে----
পড়িয়া থাকে তরুর শিরে ,
কাঁপিতে থাকে নদীর নীরে,
দাঁড়ায়ে থাকে দীর্ঘ ছায়া
.       মেলিয়া ঘাটে বাটে |

এখনো ঘুঘু ডাকিছে ডালে
.        করুণ একতানে |
অলস দুখে দীর্ঘ দিন
ছিল সে বসে মিলনহীন,
এখনো তার বিরহগাথা
.        বিরাম নাহি মানে |

বধূরা দেখো আইল ঘাটে,
.        এল না ছায়া তবু |
কলস-ঘায়ে ঊর্মি টুটে,
রশ্মিরাশি চূর্ণি উঠে,
শ্রান্ত বায়ু প্রান্তনীর
.       চুম্বি যায় কভু |

দিবসশেষে বাহিরে এসে
.        সেও কি এতখনে
নীলাম্বরে অঙ্গ ঘিরে
নেমেছে সেই নিভৃত নীরে,
প্রাচীরে-ঘেরা ছায়াতে-ঢাকা
.      বিজন ফুলবনে ?

স্নিগ্ধ জল মুগ্ধভাবে
.       ধরেছে তনুখানি |
মধুর দুটি বাহুর ঘায়
অগাধ জল টুটিয়া যায়,
গ্রীবার কাছে নাচিয়া উঠি
করিছে কানাকানি |

কপোলে তার কিরণ প’ড়ে
.       তুলেছে রাঙা করি |
মুখের ছায়া পড়িয়া জলে
নিজেরে যেন খুঁজিছে ছলে,
জলের ‘পরে ছড়ায়ে পড়ে
.       আঁচল খসি পড়ি |

জলের ‘পরে এলায়ে দিয়ে
.     আপন রূপখানি,
শরমহীন আরামসুখে
হাসিটি ভাসে মধুর মুখে,
বনের ছায়া ধরার চোখে
.      দিয়েছে পাতা টানি |

সলিলতলে সোপান—‘পরে
.      উদাস বেশবাস |
আধেক কায়া আধেক ছায়া
জলের ‘পরে রচিছে মায়া,
দেহেরে যেন দেহের ছায়া
.       করিছে পরিহাস |

আম্রবনে মুকুলে ভরা
.      গন্ধ দেয় তীরে !
গোপন শাখে বিরহী পাখি
আপন-মনে উঠিছে ডাকি,
বিবশ হয়ে বকুল ফুল
.      খসিয়া পড়ে নীরে |

দিবস ক্রমে মুদিয়া আসে,
.    মিলায়ে আসে আলো |
নিবিড় ঘন বনের রেখা
আকাশশেষে যেতেছে দেখা,
নিদ্রালস আঁখির ‘পরে
.     ভুরুর মতো কালো |

বুঝি বা তীরে উঠিয়াছে সে
.      জলের কোল ছেড়ে |
ত্বরিত পদে চলেছে গেহে,
সিক্ত বাস লিপ্ত দেহে----
যৌবনলাবণ্য যেন
.      লইতে চাহে কেড়ে |

মাজিয়া তনু যতন ক’রে
.      পরিবে নব বাস |
কাঁচল পরি আঁচল টানি
আঁটিয়া লয়ে কাঁকনখানি
নিপুণ করে রচিয়া বেণী
.      বাঁধিবে কেশপাশ |

উরসে পরি যুথীর হার
.      বসনে মাথা ঢাকি
বনের পথে নদীর তীরে
অন্ধকারে বেড়াবে ধীরে
গন্ধটুকু সন্ধ্যাবায়ে
.     রেখার মতো রাখি |

বাজিবে তার চরণধ্বনি
.     বুকের শিরে শিরে |
কখন, কাছে না আসিতে সে
পরশ যেন লাগিবে এসে,
যেমন ক’রে দখিন বায়ু
.       জাগায় ধরণীরে |

যেমনি কাছে দাঁড়াব গিয়ে
.       আর কি হবে কথা ?
ক্ষণেক শুধু অবশ কায়
থমকি রবে ছবির প্রায়,
মুখের পানে চাহিয়া শুধু
.      সুখের আকুলতা |

দোঁহার মাঝে ঘুচিয়া যাবে
.       আলোর ব্যবধান |
আঁধারতলে গুপ্ত হয়ে
বিশ্ব যাবে লুপ্ত হয়ে,
আসিবে মুদে লক্ষকোটি
.       জাগ্রত নয়ান |

অন্ধকারে নিকট করে,
.      আলোতে করে দূর |
যেমন, দুটি ব্যথিত প্রাণে
দুঃখনিশি নিকটে টানে,
সুখের প্রাতে যাহারা রহে
.      আপনা-ভরপুর |

আঁধারে যেন দুজনে আর
.      দুজনে নাহি থাকে |
হৃদয়মাঝে যতটা চাই
ততটা যেন পুরিয়া পাই,
প্রলয়ে যেন সকল যায়----
.      হৃদয় বাকি রাখে |

হৃদয় দেহ আঁধারে যেন
.       হয়েছে একাকার |
মরণ যেন অকালে আসি
দিয়েছে সব বাঁধন নাশি,
ত্বরিত যেন গিয়েছে দোঁহে
.          জগৎ-পরপার |

দু দিক হতে দুজনে যেন
.     বহিয়া খরধারে
আসিতেছিল দোঁহার পানে
ব্যাকুলগতি ব্যগ্রপ্রাণে,
সহসা এসে মিশিয়া গেল
.       নিশীথপারাবারে |

থামিয়া গেল অধীর স্রোত,
.        থামিল কলতান---
মৌন এক মিলনরাশি
তিমিরে সব ফেলিল গ্রাসি,
প্রলয়তলে দোঁহার মাঝে
.        দোঁহার অবসান |

১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দুরন্ত আশা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মর্মে যবে মত্ত আশা
.       সর্পসম ফোঁসে,
অদৃষ্টের বন্ধনেতে
.       দাপিয়া বৃথা রোষে,
তখনো ভালোমানুষ সেজে
বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে
মলিন তাস সজোরে ভেঁজে
.      খেলিতে হবে কষে !
অন্নপায়ী বঙ্গবাসী
.       স্তন্যপায়ী জীব
জন-দশেক জটলা করি
.       তক্তপোশে ব’সে |

ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,
.     পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নীচে
.     শান্তিতে শয়ান |
দেখা হলেই মিষ্ট অতি
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি---
.      গৃহের প্রতি টান |
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
.      নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোটো বহরে বড়ো
.       বাঙালি সন্তান |

ইহার চেয়ে হতেম যদি
.       আরব বেদুয়িন !
চরণতলে বিশাল মরু
.        দিগন্তে বিলীন |
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,
জীবনস্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি
.      চলেছি নিশিদিন |
বর্শা হাতে, ভর্ সা প্রাণে,
.      সদাই নিরুদ্দেশ,
মরুর ঝড় যেমন বহে
.     সকল বাধা হীন |

বিপদ-মাঝে ঝাঁপায়ে প’ড়ে
.    শোণিত উঠে ফুটে,
সকল দেহে সকল মনে
.   জীবন জেগে উঠে---
অন্ধকারে সূর্যালোতে
সন্তরিয়া মৃত্যুস্রোতে
নৃত্যময় চিত্ত হতে
.     মত্ত হাসি টুটে |
বিশ্বমাঝে মহান যাহা
.    সঙ্গী পরানের,
ঝঞ্ঝা মাঝে ধায় সে প্রাণ
.    সিন্ধুমাঝে লুটে |

নিমেষতরে ইচ্ছা করে
.     বিকট উল্লাসে
সকল টুটে যাইতে ছুটে
.     জীবন-উচ্ছ্বাসে ---
শূন্য ব্যোম অপরিমাণ
মদ্যসম করিতে পান
মুক্ত করি রুদ্ধ প্রাণ
.    ঊর্দ্ধে নীলাকাশে |
থাকিতে নারি ক্ষুদ্র কোণে
.    আম্রবনছায়ে
সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে
.    গুপ্ত গৃহবাসে |

বেহালাখানা বাঁকায়ে ধরি
.    বাজাও ওকি সুর---
তবলা-বাঁয়া কোলেতে টেনে
.    বাদ্য ভরপুর !
কাগজ নেড়ে উচ্চস্বরে
পোলিটিকাল তর্ক করে,
জানালা দিয়ে পশিছে ঘরে
.    বাতাস ঝুরুঝুর |
পানের বাটা, ফুলের মালা,
.     তবলা-বাঁয়া দুটো,
দন্ত-ভরা কাগজগুলো
.     করিয়া দাও দূর |

কিসের এত অহংকার !
.     দম্ভ নাহি সাজে----
বরং থাকো মৌন হয়ে
.     সসংকোচে লাজে |
অত্যাচারে মত্ত-পারা
কভু কি হও আত্মহারা ?
তপ্ত হয়ে রক্তধারা
.     ফুটে কি দেহমাঝে ?
অহর্নিশি হেলায় হাসি
.      তীব্র অপমান
মর্মতল বিদ্ধ করি
.      বজ্রসম বাজে ?

দাস্যসুখে হাস্যমুখ,
.     বিনীত জোড়-কর,
প্রভুর পদে সোহাগ-মদে
 দোদুল কলেবর |
পাদুকাতলে পড়িয়া লুটি
ঘৃণায়-মাখা অন্ন খুঁটি
ব্যগ্র হয়ে ভরিয়া মুঠি
.     যেতেছে ফিরি ঘর |
ঘরেতে ব’সে গর্ব কর
.      পূর্বপুরুষের,
আর্যতেজদর্পভরে
.       পৃথ্বী থরহর !

হেলায়ে মাথা, দাঁতের আগে
.        মিষ্টি হাসি টানি
বলিতে আমি পারিব না তো
.        ভদ্রতার বাণী |
উচ্ছ্বসিত রক্ত আসি
বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি,
প্রকাশহীন চিন্তারাশি
.       করিছে হানাহানি |
কোথাও যদি ছুটিতে পাই
.       বাঁচিয়া যাই তবে---
ভব্যতার গণ্ডিমাঝে
.    শান্তি নাহি মানি |

১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
গুপ্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তবে    পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে
.              রূপ দিলে যদি বিধি হে !
.   পূজার তরে হিয়া         উঠে যে ব্যাকুলিয়া,
.             পূজিব তারে গিয়া কী দিয়ে !

মনে     গোপনে থাকে প্রেম, যায় না দেখা,
.               কুসুম দেয় তাই দেবতায় |
.   দাঁড়ায়ে থাকি দ্বারে        চাহিয়া দেখি তারে
.               কী বলে আপনারে দিব তায়  !

ভালো      বাসিলে ভালো যারে দেখিতে হয়
.                সে যেন পারে ভালো বাসিতে |
.   মধুর হাসি তার                দিক সে উপহার
.                মাধুরী ফুটে যার হাসিতে !

যার       নবনীসুকুমার কপোলতলে
.                কী শোভা পায় প্রেমলাজে গো !
.   যাহার ঢলঢল                       নয়নশতদল
.                তারেই আঁখিজলে সাজে গো !

তাই      লুকায়ে থাকি সদা পাছে সে দেখে,
.                ভালোবাসিতে মরি শরমে |
.    রুধিয়া মনোদ্বার              প্রেমের কারাগার
.                রচেছি আপনার মরমে |

আহা     এ তনু-আবরণ শ্রীহীন ম্লান
.                 ঝরিয়া পড়ে যদি শুকায়ে
.     হৃদয়মাঝে মম                দেবতা মনোরম
.                 মাধুরী নিরুপম লুকায়ে |

যত      গোপনে ভালবাসি পরান ভরি
.                পরান ভরি উঠে শোভাতে---
.      যেমন কালো মেঘে       অরুণ-আলো লেগে
.                 মাধুরী উঠে জেগে প্রভাতে |

আমি     সে শোভা কাহারে তো দেখাতে নারি,
.                  এ পোড়া দেহ সবে দেখে যায়---
.      প্রেম যে চুপে চুপে         ফুটিতে চাহে রূপে,
.                 মনেরই অন্ধকূপে থেকে যায় |

দেখো,    বনের ভালোবাসা আঁধারে বসি
.                কুসুমে আপনারে বিকাশে,
.      তারকা নিজ হিয়া             তুলিছে উজলিয়া
.                আপন আলো দিয়া লিখা সে |

ভবে       প্রেমের আঁখি প্রেম কাড়িতে চাহে,
.                মোহন রূপ তাই ধরিছে |
.      আমি যে আপনায়           ফুটাতে পারি নাই,.      
.                পরান কেঁদে তাই মরিছে |

আমি        আপন মধুরতা আপনি জানি
.                 পরানে আছে যাহা জাগিয়া,
.      তাহার লয়ে সেথা           দেখাতে পারিলে তা
.                 যেত এ ব্যাকুলতা ভাগিয়া |

আমি        রূপসী নহি, তবু আমারো মনে
.                  প্রেমের রূপ সে তো সুমধুর |
.       ধন সে যতনের                    শয়ন-স্বপনের,
.                  করে সে জীবনের তমোদূর |

আমি        আমার অপমান সহিতে পারি,
.                   প্রেমের সহে না তো অপমান |
.        অমরাবতী ত্যেজে            হৃদয়ে এসেছে যে,
.                   তাহারো চেয়ে সে যে মহীয়ান |

পাছে         কুরূপ কভু তারে দেখিতে হয়
.                   কুরূপ দেহ-মাঝে উদিয়া,
.        প্রাণের এক ধারে                দেহের পরপারে
.                    তাই তো রাখি তরে রুধিয়া |

তাই       আঁখিতে প্রকাশিতে চাহি না তারে ,
.                    নীরবে থাকে তাই রসনা |
.        মুখে সে চাহে যত                নয়ন করি নত,
.                   গোপনে মরে কত বাসনা |

তাই        যদি সে কাছে আসে পালাই দূরে,
.                   আপন মনোআশা দলে যাই,
.        পাছে সে মোরে দেখে       থমকি বলে ‘এ কে !’
.                    দুহাতে মুখ ঢেকে চলে যাই |

পাছে       নয়নে বচনে সে বুঝিতে পারে
.                     আমার জীবনের কাহিনী----
.         পাছে সে মনে ভানে,       ‘এও কি প্রেম জানে !
.                      আমি তো এর পানে চাহি নি !’

তবে        পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে
.                      রূপ না দিলে যদি বিধি হে !
.         পূজার তরে হিয়া             উঠে যে ব্যাকুলিয়া,
.                      পূজিব তারে গিয়া কী দিয়ে ?

১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.                     ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
দেশের উন্নতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বক্তৃতাটা লেগেছে বেশ,
.        রয়েছে রেশ কানে ----
কী যেন করা উচিত ছিল,
.        কী করি কে তা জানে !
অন্ধকারে  ওই রে শোন্
ভারতমাতা করেন ‘গ্রোন’,
এ হেন কালে ভীষ্ম দ্রোণ
.        গেলেন কোন্ খানে !
দেশের দুখে সতত দহি
মনের ব্যথা সবারে কহি,
এসো তো করি নামটা সহি
.        লম্বা পিটিশানে |
আয় রে ভাই, সবাই মাতি
যতটা পারি ফুলাই ছাতি,
নহিলে গেল আর্যজাতি
.        রসাতলের পানে |

উত্সাহেতে জ্বলিয়া উঠি
.        দু হাতে দাও তালি |
আমরা বড়ো এ যে না বলে
.        তাহারে দাও গালি |
কাগজ ভরে লেখো রে লেখো,
এমনি করে যুদ্ধ শেখো,
হাতের কাছে রেখো রে রেখো
.        কলম আর কালি !
চারটি করে অন্ন খেয়ো,
দুপুরবেলা আপিস যেয়ো,
তাহার পরে সভায় ধেয়ো
.        বাক্যানল জ্বালি ---
কাঁদিয়া লয়ে দেশের দুখে
সন্ধেবেলা বাসায় ঢুকে
শ্যালীর সাথে হাস্যমুখে
.         করিয়ো চতুরালি |

দূর হউক এ বিড়ম্বনা,
.         বিদ্রূপের ভান |
সবারে চাহে বেদনা দিতে
.         বেদনা-ভরা প্রাণ |
আমার এই হৃদয়তলে
শরম-তাপ সতত জ্বলে
তাই তো চাহি হাসির ছলে
.          করিতে লাজ দান |
আয়-না, ভাই, বিরোধ ভুলি---
কেন রে মিছে লাথিয়ে তুলি
পথের যত মতের ধূলি
.           আকাশপরিমাণ ?
পরের মাঝে ঘরের মাঝে
মহৎ হব সকল কাজে,
নীরবে যেন মরে গো লাজে
.          মিথ্যা অভিমান |

ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে
.          বসায়ে আপনারে
আপন পায়ে না দিই যেন
.          অর্ঘ্য ভারে ভারে |
জগতে যত মহৎ আছে
হইব নত সবার কাছে,
হৃদয় যেন প্রসাদ যাচে
.          তাঁদের দ্বারে দ্বারে |
যখন কাজ ভুলিয়া যাই
মর্মে যেন লজ্জা পাই,
নিজেরে নাহি ভুলাতে চাই
.          বাক্যের আঁধারে |
ক্ষুদ্র কাজ ক্ষুদ্র নয়
এ কথা মনে জাগিয়া রয়,
বৃহৎ ব’লে না মনে হয়
.           বৃহৎ কল্পনারে |

পরর কাছে হইব বড়ো
.          এ কথা গিয়ে ভুলে
বৃহৎ যেন হইতে পারি
.          নিজের প্রাণমূলে |
অনেক দূরে লক্ষ্য রাখি
চুপ করে না বসিয়া থাকি
স্বপ্নাতুর দুইটি আঁখি
.          শূন্যপানে তুলে |
ঘরের কাজ রয়েছে পড়ি,
তাহাই যেন সমাধা করি,
‘কী করি’ বলে ভেবে না মরি
.         সংশয়েতে দুলে |
কবির কাজ নীরবে থেকে,
মরণ যবে লইবে ডেকে
জীবনরাশি যাইব রেখে
.          ভবের উপকূলে |

সবাই বড়ো হইলে তবে
.          স্বদেশ বড়ো হবে,
যে কাজে মোরা লাগাব হাত
.           সিদ্ধ হবে তবে |
সত্যপথে আপন বলে
তুলিয়া শির সকলে চলে,
মরণভয় চরণতলে
.           দলিত হয়ে রবে |
নহিলে শুধু কথাই সার,
বিফল আশা লক্ষবার,
দলাদলি ও অহংকার
.           উচ্চ কলরবে |
আমোদ করা কাজের ভানে----
পেখম তুলি গগন-পানে
সবাই মাতে আপন মানে
.           আপন গৌরবে |

বাহবা কবি !  বলিছ ভালো,
.           শুনিতে লাগে বেশ |
এমনি ভাবে বলিলে হবে
.           উন্নতি বিশেষ |
‘ওজস্বিতা’  ‘উদ্দীপনা’
ছুটাও ভাষা অগ্নিকণা,
আমরা করি’ সমালোচনা
.          জাগায়ে তুলি দেশ !
বীর্যবল বাঙ্গালার
কেমনে বলো টিকিবে আর,
প্রেমের গানে করেছে তার
.         দুর্দশার শেষ |
যাক-না দেখা দিন-কতক
যেখানে যত রয়েছে লোক
সকলে মিলে লিখুক শ্লোক
.        ‘জাতীয়’ উপদেশ |
নয়ন বাহি অনর্গল
ফেলিব সবে অশ্রুজল,
উত্সাহেতে বীরের দল
.        লোমাঞ্চিতকেশ |

রক্ষা করো ! উত্সাহের
.        যোগ্য আমি কই !
সভা-কাঁপানো করতালিতে
.        কাতার হয়ে রই !
দশ জনাতে যুক্তি ক’রে
দেশের যারা মুক্তি করে,
কাঁপায় ধরা বসিয়া ঘরে,
.       তাদের আমি নই |
‘জাতীয়’ শোকে সবাই জুটে
মরিছে যবে মাথাটা কুটে,
দশ দিকেতে উঠিছে ফুটে
.      বক্তৃতার খই----
হয়তো আমি শয্যা পেতে
মুগ্ধহিয়া আলস্যেতে
ছন্দ গেঁথে নেশায় মেতে
.      প্রেমের কথা কই |
শুনিয়া যত বীরশাবক
দেশের যাঁরা অভিভাবক
দেশের কানে হস্ত হানে,
.       ফুকারে হৈ-হৈ !

চাহি না আমি অনুগ্রহ-
..      বচন এত শত |
‘ওজস্বিতা’ ‘উদ্দীপনা’
.       থাকুক আপাতত |
পষ্ট তবে খুলিয়া বলি----
তুমিও চলো আমিও চলি,
পরস্পরে কেন এ ছলি
.        নির্বোধের মতো ?
ঘরেতে ফিরে খেলো গে তাস,
লুটায়ে ভুঁয়ে মিটায়ে আশ
মরিয়া থাকি বারোটি মাস
.         আপন আঙিনায় |
পরের দোষে নাসিকা গুঁজে
গল্প খুঁজে গুজব খুঁজে
আরামে আঁখি আসিবে বুজে
.          মলিনপশুপ্রায় |
তরল হাসি-লহরী তুলি
রচিয়ো বসি বিবিধ বুলি,
সকল কিছু যাইয়ো ভুলি,
.         ভুলো না আপনায় !

আমিও রব তোমারি দলে
.          পড়িয়া এক- ধার !
মাদুর পেতে ঘরের ছাতে
ডাবা হুঁকোটি ধরিয়া হাতে
করিব আমি সবার সাথে
.           দেশের উপকার |
বিজ্ঞভাবে নাড়িব শির.
অসংশয়ে করিব স্থির
মোদের বড়ো এ পৃথিবীর
.            কেহই নহে আর !
নয়ন যদি মুদিয়া থাক
সে ভুল কভু ভাঙিবে নাকো,
নিজেরে বড়ো করিয়া রাখো
.          মনেতে আপনার !
বাঙালি বড়ো চতুর ,তাই
আপনি বড়ো হইয়া  যাই,
অথচ কোন কষ্ট নাই
.          চেষ্টা নাই তার |
হোথায় দেখো খাটিয়া মরে,
দেশে বিদেশে ছড়ায়ে পড়ে,
জীবন দেয় ধরার তরে
.          ম্লেচ্ছসংসার !
ফুকারো তার উচ্চরবে
.           বাঁধিয়া এক-সার -----
মহৎ মোরা বঙ্গবাসী
.           আর্যপরিবার

১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.                     ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বঙ্গবীর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভুলুবাবু বসি পাশের ঘরেতে
নামতা পড়েন উচ্চস্বরেতে ----
হিষ্ট্রি কেতাব লইয়া করেতে
.      কেদারা হেলান দিয়ে
দুই ভাই মোরা সুখে সমাসীন,
মেজের উপর জ্বলে কেরোসিন,
পড়িয়া ফেলেছি চ্যাপ্টার তিন-----
.       দাদা এম-এ, আমি বি-এ  |

যত পড়ি তত পুড়ে যায় তেল,
মগজে গজিয়া ওঠে আক্কেল ,
কেমন করিয়া বীর ক্রোমোয়েল
.         পাড়িল রাজার মাথা,
বালক যেমন ঠেঙার বাড়িতে
পাকা আমগুলো রহে গো পাড়িতে ----
কৌতুক ক্রমে বাড়িতে বাড়িতে
.          উলটি ব’য়ের পাতা |

কেহ মাথা ফেলে ধর্মের তরে,
পরহিতে কারো মাথা খ’সে পড়ে,
রণভূমে কেহ মাথা রেখে মরে
.          কেতাবে রয়েছে লেখা  |
আমি কেদারায় মাথাটি রাখিয়া
এই কথাগুলি চাখিয়া চাখিয়া
সুখে পাঠ করি থাকিয়া থাকিয়া,
.          পড়ে কত হয় শেখা !

পড়িয়াছি বসে জানলার কাছে
জ্ঞান খুঁজে কাবা ধরা ভ্রমিয়াছে,
কবে মরে তারা মুখস্ত আছে
.          কোন্ মাসে কী তারিখে |
কর্তব্যের কঠিন শাসন
সাধ ক’রে কারা করে উপাসন       
গ্রহণ করেছে কন্টকাসন -----
.          খাতায় রেখেছি লিখে |

বড়ো কথা শুনি, বড়ো কথা কই,
জড়ো করে নিয়ে পড়ি বড়ো বই,
এমনি করিয়া ক্রমে বড়ো হই-----
.      কে পারে রাখিতে চেপে !
কেদারায় বসে সারাদিন ধ’রে
বই প’ড়ে প’ড়ে মুখস্ত ক’রে
কভু মাথা ধরে কভু মাথা ঘোরে,
.       বুঝি বা যাইব ক্ষেপে |   

ইংরেজ চেয়ে কিসে মোরা কম !
আমরা যে ছোটো সেটা ভারি ভ্রম ;
আকারপ্রকার রকম-সকম
.       এতেই যা কিছু ভেদ |
যাহা লেখে তারা তাই ফেলি শিখে,
তাহাই আবার বাংলায় লিখে
করি কতমতো গুরুমারা টীকে,
.        লেখনীর ঘুচে খেদ |

মোক্ষমুলর বলেছে ‘আর্য’
সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,
মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য,
.        আরামে পড়েছি শুয়ে |
মনু নাকি ছিল আধ্যাত্মিক ,
আমরাও তাই -----করিয়াছি ঠিক ,
এ যে নাহি বলে ধিক্ তারে ধিক্,
.        শাপ দি’ পইতে ছুঁয়ে |        

কে বলিতে চায় মোরা নাহি বীর.
প্রমাণ যে তার রয়েছে গভীর ,
পূর্বপুরুষ ছুঁড়িতেন তীর
.        সাক্ষী বেদব্যাস |
আর-কিছু তবে নাহি প্রয়োজন ,
সভাতলে মিলে বারো-তেরো জন
শুধু তরজন আর গরজন
.        এই করো অভ্যাস  |

আলো-চাল আর কাঁচকলা-ভাতে
মেখেচুখে নিয়ে কদলীর পাতে
ব্রহ্মচর্য পেত হাতে হাতে
.       ঋষিগণ তপ ক’রে |
আমরা যদিও পাতিয়াছি মেজ,
হোটেলে ঢুকেছি পালিয়ে কালেজ,
তবু আছে সেই ব্রাহ্মণ-তেজ
.       মনু-তর্জমা প’ড়ে |
.          
সংহিতা আর মুর্গি –জবাই
এই দুটো কাজে লেগেছি সবাই,
বিশেষত এই আমরা ক’ ভাই
.       নিমাই নেপাল ভূতো |
দেশের লোকের কানের গোড়াতে
বিদ্যেটা নিয়ে লাঠিম ঘোরাতে,
বক্তৃতা আর কাগজ পোরাতে
.       শিখেছি হাজার ছুতো |

ম্যারাথন আর থর্মপলিতে
কী যে হয়েছিল বলিতে বলিতে
শিরায় শোণিতে রহে গো জ্বলিতে
.        পাটের পলিতে –সম |
মূর্খ যাহারা কিছু পড়ে নাই
তারা এত কথা কী বুঝিবে ছাই----
হাঁ করিয়া থাকে, কভু তোলে হাই----
.         বুক ফেটে যায় মম |

আগাগোড়া যদি তাহারা পড়িত
গারিবাল্ ডির জীবনচরিত
না জানি তা হলে কী তারা করিত
.         কেদারায় দিয়ে ঠেস !
মিল ক’রে ক’রে কবিতা লিখিত,
কিছুদিন তবু কাগজ টিকিত---
.         উন্নত হত দেশ-----

না জানিল তারা সাহিত্যরস,
ইতিহাস নাহি করিল পরশ,
ওয়াশিংটনের জন্ম-বরষ
.         মুখস্ত হলো নাকো |
ম্যাট্ সিনি-লীলা এমন সরেস
এরা সে কথার না জানিল লেশ---
হা অশিক্ষিত অভাগা স্বদেশ,
.         লজ্জায় মুখ ঢাকো |

আমি দেখো ঘরে চৌকি টানিয়ে
লাইব্রেরি হতে হিস্ট্রি আনিয়ে
কত পড়ি,  লিখি বানিয়ে বানিয়ে
.        শানিয়ে শানিয়ে ভাষা |
জ্বলে ওঠে প্রাণ, মরি পাখা করে,
উদ্দীপনায় শুধু মাথা ঘোরে---
তবুও যা হোক স্বদেশের তরে
.        একটুকু হয় আশা |

যাক, পড়া যাক ‘ন্যাস্ বি’ সমর----
আহা ক্রমোয়েল, তুমিই অমর !
থাক্ এইখানে, ব্যথিত কোমর ---
.        কহিল হতেছে বোধ |
ঝি কোথায় গেল, নিয়ে আয় সাবু |
আরে, আরে এসো ! এসো ননীবাবু ,
তাস পেড়ে নিয়ে খেলা যাক গ্রাবু ----
.        কালকের দেব শোধ !

জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সুরদাসের প্রার্থনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন,
 আমি কবি সুরদাস  |
দেবী , আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে ,
 পুরাতে হইবে আশ !
অতি অসহন বহ্নিদহন
মর্মমাঝারে করি যে বহন,
কলঙ্করাহু প্রতি পলে পলে
.     জীবন করিছে গ্রাস |
পবিত্র তুমি, নির্মল তুমি,
.      তুমি দেবী, তুমি সতী----
কুৎসিত দীন অধম পামর
.      পঙ্কিল আমি অতি |

তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই শক্তি,
হৃদয়ে আমার পাঠাও ভক্তি----
পাপের তিমির পুড়ে যায় জ্বলে
.       কোথা সে পুণ্যজ্যোতি !
দেবের করুণা মানবী-আকারে,
আনন্দধারা বিশ্বমাঝারে,
পতিতপাবনী গঙ্গা যেমন
.        এলেন পাপীর কাজে----
তোমার চরিত রবে নির্মল,
তোমার ধর্ম রবে উজ্জ্বল,
আমার এ পাপ করি দাও লীন
.         তোমার পূণ্যমাঝে |

তোমারে কহিব লজ্জাকাহিনী
.      লজ্জা নাহিকো তায় |
তোমার আভায় মলিন লজ্জা
.      পলকে মিলায়ে যায় |
যেমন রয়েছ তেমনি দাঁড়াও,
আঁখি নত করি-আমা পানে চাও,
খুলে দাও মুখ আনন্দময়ী ----
.      আবরণে নহি কাজ |
নিরখি তোমারে ভীষণ মধুর,
আছ কাছে তবু আছ অতিদূর—
উজ্জ্বল যেন দেবরোষানল,
.      উদ্যত যেন বাজ |


জান কি আমি এ পাপ-আঁখি মেলি
.      তোমারে দেখেছি চেয়ে,
গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা
 ওই মুখপানে ধেয়ে !
তুমি কি তখন পেরেছ জানিতে ?
বিমল হৃদয়-আরশিখানিতে
চিহ্ন কিছু কি পড়েছিল এসে
.      নিশ্বাসরেখাছায়া ?
ধরার কুয়াশা ম্লান করে যথা
.      আকাশ ঊষার কায়া !
লজ্জা সহসা আসি অকারণে
বসনের মতো রাঙা আবরণে
চাহিয়াছিল কি ঢাকিতে তোমায়
.      লুব্ধ নয়ন হতে ?
মোহ চঞ্চল সে লালসা মম
কৃষ্ণবরন ভ্রমরের সম
ফিরিতেছিল কি গুন-গুন কেঁদে
.      তোমার দৃষ্টিপথে ?

আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত
.      প্রভাতরশ্মিসম----
লও ; বিধে দাও বাসনাঘন
.      এ কালো নয়ন মম |
এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই,
.      ফুটেছে মর্মতলে ---
নির্বাণহীন অঙ্গারসম
.      নিশিদিন শুধু জ্বলে |
সেথা হতে তারে উপারিয়া লও
.      জ্বালাময় দুটো চোখ,
তোমার লাগিয়া তিয়াষ যাহার
.      সে আঁখি তোমারি হোক |

অপার ভুবন, উদার গগন,
.      শ্যামল কাননতল,
বসন্ত অতি মুগ্ধমুরতি,
.      স্বচ্ছ নদীর জল,
বিবিধবন সন্ধ্যানীরদ,
.     গ্রহতারাময়ী নিশি,
বিচিত্রশোভা শস্যক্ষেত্র
.    প্রসারিত দূরদিশি,
সুনীল গগনে ঘনতর নীল
.    অতিদূর গিরিমালা,
তারি পরপারে রবির উদয়
.     কনককিরণ-জ্বালা,
চকিততড়িৎ সঘন বরষা,
.     পূর্ণ ইন্দ্রধনু,
শরৎ-আকাশে অসীমবিকাশ
.     জ্যোত্স্না শুভ্রতনু---
লও, সব লও, তুমি কেড়ে লও,
.     মাগিতেছে অকপটে,
তিমিরতূলিকা দাও বুলাইয়া
.     আকাশ-চিত্রপটে |

ইহারা আমারে ভুলায় সতত,
.     কোথা নিয়ে যায় টেনে !
মাধুরীমদিরা পান করে শেষে
.     প্রাণ পথ নাহি চেনে |
সবে মিলে যেন বাজাইতে চায়
.     আমার বাঁশরি কাড়ি,
পাগলের মতো রচি নব গান,
.     নব নব তান ছাড়ি |
আপন ললিত রাগিণী শুনিয়া
.     আপনি অবশ মন----
ডুবাইতে থাকে কুসুমগন্ধ
.     বসন্তসমীরণ |
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে,
.     ফুল মোরে ঘিরে বসে,
কেমনে না জানি জ্যোত্স্নাপ্রবাহ
.      সর্বশরীরে পশে |
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
.      ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবন-ভরা বাহুপাশে তার
.      বেষ্টন করে কায়া |
চিরি দিকে ঘিরি ধরে আনাগোনা
.      কল্পমুরতি কত,
কুসুমকাননে বেড়াই ফিরিয়া
.      যেন বিভোরের মতো |
শ্লথ হয়ে আসে হৃদয়তন্ত্রী,
.      বীণা খসে যায় পড়ি,
নাহি বাজে আর হরিনামগান
.      বরষ বরষ ধরি |
হরিহীন সেই অনাথ বাসনা
.      পিয়াসে জগতে ফিরে-----
বাড়ে তৃষা, কোথা পিপাসার জল
.      অকূল লবণনীরে |
গিয়েছিল, দেবী, সেই ঘোর তৃষা
.      তোমার রূপের ধারে----
আঁখির সহিতে আঁখির পিপাসা
.      লোপ করো একেবারে |

ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমার মূর্তি
  পশেছে জীবনমূলে,
এই ছুড়ি দিয়ে সে মুরতিখানি
.       কেটে কেটে লও তুলে |
তারি সাথে হায় আঁধারে মিশাবে
.       নিখিলের শোভা যত ----
লক্ষ্মী যাবেন, তারি সাথে যাবে
.       জগৎ ছায়ার মতো |

যাক, তাই যাক, পারি নে ভাসিতে
.      কেবলি মুরতিস্রোতে !
লহ মোরে তুলে আলোকমগন
.      মুরতিভুবন হতে |
আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে—
.      একাকী অসীম ভরা,
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন
.      মিলাবে সকল ধরা |
আলোহীন সেই বিশাল হৃদয়ে
.      আমার বিজন বাস,
প্রলয়-আসন জুড়িয়া বসিয়া
.      রব আমি বারো মাস |

থামো একটুকু, বুঝিতে পারিনে,
.      ভালো করে ভেবে দেখি—
বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার
.      চিরকাল রবে সে কি ?
ক্রমে ধীরে ধীরে নিবিড় তিমিরে
.      ফুটিয়া উঠিবে নাকি
পবিত্র মুখ মধুর মূর্তি,
.       স্নিগ্ধ আনত আঁখি ?
এখন যেমন রয়েছ দাঁড়ায়ে
.        দেবীর প্রতিমা সম,
স্থিরগম্ভীর করুণ নয়নে
.        চাহিছ হৃদয়ে মম,
বাতায়ন হতে সন্ধ্যাকিরণ
.       পড়েছে ললটে এসে,
মেঘের আলোক লভিছে বিরাম
.       নিবিড়তিমির কেশে,
শান্তিরূপিনী এ, মূরতি তব
.       অতি অপূর্ব সাজে
অনলরেখায় ফুটিয়া উঠিবে
.      অনন্তনিশি-মাঝে |
চৌদিকে তব নূতন জগৎ
.      আপনি সৃজিত হবে,
এ সন্ধ্যাশোভা তোমারে ঘিরিয়া
.      চিরকাল জেগে রবে |
এই বাতায়ন, ওই চাঁপা গাছ,
.      দূর সরযুর রেখা,
নিশিদিনহীন অন্ধ হৃদয়ে
.      চিরদিন যাবে দেখা  |
সে নব জগতে কালস্রোত নাই---
.      পরিবর্তন নাহি----
আজি এই দিন অনন্ত হয়ে
.     চিরদিন রবে চাহি |

তবে তাই হোক, হোয়ো না বিমুখ,
.     দেবী, তাহে কিবা ক্ষতি----
হৃদয়-আকাশে থাক-না জাগিয়া
.     দেহহীন তব জ্যোতি |
বাসনামলিন আঁখিকলঙ্ক
.     ছায়া ফেলিবে না তায়,
আঁধার হৃদয়-নীল-উৎপল
.     চিরদিন রবে পায় |

তোমাতে হেরিব আমার দেবতা,
.      হেরিব আমার হরি----
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিব
.      অনন্ত বিভাবরী |

২২ / ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিন্দুকের প্রতি নিবেদন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হউক ধন্য তোমার যশ
লেখনী ধন্য হোক ,
তোমার প্রতিভা উজ্জ্বল হয়ে
জাগাক সপ্তলোক |
যদি পথে তব দাঁড়াইয়া থাকি
আমি ছেড়ে দিব ঠাঁই----
কেন হীন ঘৃণা, ক্ষুদ্র এ দ্বেষ,
বিদ্রূপ কেন ভাই ?
আমার এ লেখা কারো ভালো লাগে
তাহা কি আমার দোষ ?
কেহ কবি বলে ( কেহ বা বলে না )----
কেন তাহে তব রোষ ?

কত প্রাণপণ, দগ্ধ হৃদয়,
বিনিদ্র বিভাবরী,
জান কি, বন্ধু, উঠেছিল গীত
কত ব্যথা ভেদ করি ?
রাঙা ফুল হয়ে উঠিছে ফুটিয়া
হৃদয়শোণিতপাত ,
অশ্রু ঝলিছে শিশিরের মতো
পেহাইতে দুখরাত |
উঠিতেছে কত কন্টকলতা,
ফুলে পল্লবে ঢাকে-----
গভীর গোপন বেদনা-মঝারে
শিকড় আঁকড়ি থাকে |
জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল
সে সাধ ফুটিছে গানে ----
মরীচিকা রচি মিছে সে তৃপ্তি,
তৃষ্ণা কাঁদিছে প্রাণে |
এনেছি তুলিয়া পথের প্রান্তে
মর্মকুসুম মম----
আসিছে পান্থ, যেতেছে লইয়া
স্মরণচিহ্নসম |
কোনো ফুল যাবে দুদিনে ঝরিয়া,
কোনো ফুল বেঁচে রবে----
কোনো ছোটো ফুল আজিকার কথা
কালিকার কানে কবে |

তুমি কেন, ভাই, বিমুখ এমন ----
নয়নে কঠোর হাসি |
দূর হতে যেন ফুঁসিছে সবেগে
উপেক্ষা রাশি রাশি ---
কঠিন বচন জরিছে অধরে
উপহাস হলাহলে,
লেখনীর মুখে করিতে দগ্ধ
ঘৃণার অনলে জ্বলে |
ভালোবেসে যাহা ফুটেছে পরানে
সবার লাগিবে ভালো,
যে জ্যোতি হরিছে আমার আঁধার
সবারে দিবে সে আলো----
অন্তরমাঝে সবাই সমান,
বাহিরে প্রভেদ ভবে,
একের বেদনা করুণাপ্রবাহে
সান্ত্বনা দিবে সবে |
এই মনে করে ভালোবেসে আমি
দিয়েছিনু উপহার---
ভালো নাহি লাগে ফেলে যাবে চলে,
কিসের ভাবনা তার !
তোমার দেবার যদি কিছু থাকে
তুমিও দাও-না এনে |
প্রেম দিলে সবে নিকটে আসিবে
তোমারে আপন জেনে |
কিন্তু জানিয়ো আলোক কখনো
থাকে না তো ছায়া বিনা,
ঘৃণার টানেও কেহ বা আসিবে,
তুমি করিয়ো না ঘৃণা !
এতই কোমল মানবের মন
এমনি পরের বশ,
নিষ্ঠুর বাণে সে প্রাণ ব্যথিতে
কিছুই নাহিক যশ |
তীক্ষ্ণ হাসিতে বাহিরে শোণিত ,
বচনে অশ্রু উঠে,
নয়নকোণের চাহনি-ছুরিতে
মর্মতন্তু টুটে |
সান্ত্বনা দেওয়া নহে তো সহজ ,
দিতে হয় সারা প্রাণ,
মানবমনের অনল নিভাতে
আপনারে বলিদান |
ঘৃণা জ্ব’লে মরে আপনার বিষে,
রহে না সে চিরদিন----
অমর হইতে চাহ যদি, জেনো
প্রেম সে মরণহীন |
তুমিও রবে না, আমিও রব না,
দুদিনের দেখা ভবে----
প্রাণ খুলে প্রেম দিতে পারো যদি
তাহা চিরদিন রবে |

দুর্বল মোরা, কত ভুল করি,
অপূর্ব সব কাজ |
নেহারি আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতা
আপনি যে পাই লাজ |
তা বলে যা পারি তাও করিব না ?
নিষ্ফল হব ভবে ?
প্রেমফুল ফোটে, ছোটো হল বলে
দিব না কি তাহা সবে ?
হয়তো এ ফুল সুন্দর নয়,
ধরেছি সবার আগে ----
চলিতে চলিতে আঁখির পলকে
ভুলে কারো ভালো লাগে |
যদি ভুল হয় ক’ দিনের ভুল |
দুদিনে ভাঙিবে তবে |
তোমার এমন শাণিত বচন
সেই কি অমর হবে ?

২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
কবির প্রতি নিবেদন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হেথা কেন দাঁড়ায়েছ, কবি,
যেন  কাষ্ঠপুত্তলছবি ?
চারি দিকে লোকজন               চলিতেছে সারাখন
আকাশে উঠিছে খর রবি |

কোথা তব বিজন ভবন ,
কোথা তব মানসভুবন ?
তোমারে ঘেরিয়া ফেলি          কোথা সেই করে কেলি
কল্পনা, মুক্ত পবন ?

নিখিলের আনন্দধাম
কোথা সেই গভীর বিরাম ?
জগতের গীতধার                 কেমনে শুনিবে আর ?
শুনিতেছ আপনারই নাম |

আকাশের পাখি তুমি ছিলে,
ধরণীতে কেন ধরা দিলে ?
বলে সবে বাহা-বাহা ,                 সকলে পড়ায় যাহা
তুমি তাই পড়িতে শিখিলে !

প্রভাতের আলোকের সনে
অনাবৃত প্রভাতগগনে
বহিয়া নূতন প্রাণ                     ঝরিয়া পড়ে না গান
ঊর্দ্ধনয়ন এ ভুবনে |

পথ হতে শত কলরবে
‘গাও গাও’ বলিতেছে সবে |
ভাবিতে সময় নাই-----                 গান চাই, গান চাই,
থামিতে চাহিছে প্রাণ যবে |

থামিলে চলিয়া যাবে সবে,
দেখিতে কেমনতর হবে !
উচ্চ আসনে লীন                         প্রাণহীন গানহীন
পুতলির মতো বসে রবে |

শ্রান্তি লুকাতে চাও ত্রাসে,
কন্ঠ শুষ্ক হয়ে আসে |
শুনে যারা যায় চলে                   দু-চারিটা কথা ব’লে
তারা কি তোমায় ভালোবাসে ?

কতমত পরিয়া মুখোশ
মাগিছ সবার পরিতোষ |
মিছে হাসি আনো দাঁতে,             মিছে জল আঁখিপাতে,
তবু তারা ধরে কত দোষ |

মন্দ কহিছে কেহ ব’সে,
কেহ বে নিন্দা তব ঘোষে |
তাই নিয়ে অবিরত                     তর্ক করিছ কত,
জ্বলিয়া মরিছ মিছে রোষে |

মূর্খ, দম্ভ-ভরা দেহ,
তোমারে করিয়া যায় স্নেহ |
হাত বুলাইয়া পিঠে                 কথা বলে মিঠে মিঠে,
শাবাশ-শাবাশ বলে কেহ |

হায় কবি, এত দেশ ঘুরে
আসিয়া পড়েছ কোন দূরে !
এ যে কোলাহলমরু------             নাই ছায়া, নাই তরু,
যশের কিরণে মরো পুড়ে |

দেখো, হোথা নদী-পর্বত,
অবারিত অসীমের পথ |
প্রকৃতি শান্তমুখে                          ছুটায় গগনবুকে
গ্রহতারাময় তার রথ |

সবাই আপন কাজে ধায়,
পাশে কেহ ফিরিয়া না চায় |
ফুটে চিররূপরাশি                       চিরমধুময় হাসি,
আপনারে দেখিতে না পায় |

হোথা দেখো একেলা আপনি
আকাশের তারা গনি গনি
ঘোর নিশীথের মাঝে            কে জাগে আপন কাজে,
সেথায় পশে না কলধ্বনি |

দেখো হোথা নূতন জগৎ----
ওই কারা আত্মহারাবৎ
যশ-অপযশ-বাণী                  কোনো কিছু নাহি মানি
রচিছে সুদূর ভবিষ্যৎ |

ওই দেখো, না পুরিতে আশ
মরণ করিল কারে গ্রাস |
নিশি না হইতে সারা                 খসিয়া পড়িল তারা,
রাখিয়া গেল না ইতিহাস |

ওই কারা গিরির মতন
আপনাতে আপনি বিজন ----
হৃদয়ের স্রোত উঠি                   গোপন আলয় টুটি
দূর দূর করিছে মগন |

ওই কারা বসে আছে দূরে ,
কল্পনা-উদয়াচল-পুরে ----
অরুণপ্রকাশ-প্রায়                    আকাশ ভরিয়া যায়
প্রতিদিন নব নব সুরে |

হোথা উঠে নবীন তপন,
হোথা হতে বহিছে পবন |
হোথা চির ভালোবাসা----             নব গান, নব আশা----
অসীম বিরামনিকেতন |
হোথা মানবের জয়                       উঠিছে জগৎময়,
ওইখানে মিলিয়াছে নরনারায়ণ|

হেথা, কবি, তোমারে কি সাজে
ধূলি আর কলরোল-মাঝে ?

২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com