*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
পরিত্যক্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বন্ধু,
মনে আছে সেই প্রথম বয়স,
নূতন বঙ্গভাষা
তোমাদের মুখে জীবন লভিছে
বহিয়া নূতন আশা |
নিমেষে নিমেষে আলোকরশ্মি
অধিক জাগিয়া উঠে,
বঙ্গহৃদয় উন্মীলি যেন
রক্তকমল ফুটে |
প্রতিদিন যেন, পূর্বগগনে
চাহি রহিতাম একা,
কখন ফুটিবে তোমাদের ওই,
লেখনী-অরুণ-লেখা |
তোমাদের ওই প্রভাত-আলোক
প্রাচীন তিমির নাশি
নবজ্রাগত নয়নে আনিবে
নূতন জগৎরাশি |

একদা জাগিনু, সহসা দেখিনু
প্রাণমন আপনার----
হৃদয়ের মাঝে জীবন জাগিছে
পরশ লভিনু তার |
ধন্য হইল মানবজনম,
ধন্য তরুণ প্রাণ -----
মহৎ আশায় বাড়িল হৃদয়,
জাগিল হর্ষগান |
দাঁড়ায়ে বিশাল ধরণীর তলে
ঘুচে গেল ভয়লাজ ,
বুঝিতে পারিনু এ জগৎমাঝে
আমারও রয়েছে কাজ |
স্বদেশের কাছে দাঁড়ায়ে প্রভাতে
কহিলাম জোরকরে,
‘এই লহো, মাতঃ , এ চিরজীবন
সঁপিনু তোমারি তরে |’

বন্ধু, এ দীন হয়েছে বাহির
তোমাদেরই কথা শুনে |
সেইদিন হতে কন্টকপথে
চলিয়াছি দিন গুণে |
পদে পদে জাগে নিন্দা ও ঘৃণা
ক্ষুদ্র অত্যাচার,
একে এরে সব পর হয়ে যায়
ছিল যারা আপনারা |
ধ্রুবতারা-পানে রাখিয়া নয়ন
চলিয়াছি পথ ধরি,
সত্য বলিয়া জানিয়াছি যাহা
তাহাই পালন করি |

কোথা গেল সেই প্রভাতের গান ,
কোথা গেল সেই আশা !
আজিকে, বন্ধু, তোমাদের মুখে
এ কেমনতর ভাষা !
আজি বলিতেছি, ‘বসে থাকো, বাপু,
ছিল যাহা তাই ভালো |
যা হবার তাহা আপনি হইবে,
কাজ কি এতই আলো !’
কলম মুছিয়া তুলিয়া রেখেছ,
বন্ধ করেছ গান,
সহসা সবাই প্রাচীন হয়েছ
নিতান্ত সাবধান |
আনন্দে যারা চলিতে চাহিছে
ছিঁড়ি অসত্যপাশ,
ঘর হতে বসি করিছ তাদের
উপহাস পরিহাস |
এত দূরে এনে ফিরিয়া দাঁড়ায়ে
হাসিছ নিঠুর হাসি,
চিরজীবনের প্রিয়তম ব্রত
চাহিছ ফেলিতে নাশি |

তোমরা আনিয়া প্রাণের প্রবাহ
ভেঙেছ মাটির আল,
তোমরা আবার আনিছ বঙ্গে
উজান স্রোতের কাল |
নিজের জীবন মিশায়ে যাহারে
আপনি তুলেছ গড়ি
হাসিয়া হাসিয়া আজিকে তাহারে
ভাঙিছ কেমন করি !
তবে সেই ভালো, কাজ নেই তবে,
তবে ফিরে যাওয়া যাক----
গৃহকোণে এই জীবন-আবেগ
করি বসে পরিপাক !
সানাই বাজিয়ে ঘরে নিয়ে আসি
আট বরষের বধূ,
শৈশবকুঁড়ি ছিঁড়িয়া বাহির
করি যৌবনমধু !
ফুটন্ত নবজীবনের ‘পরে
চাপায়ে শাস্ত্রভার
জীর্ণ যুগের ধূলিসাথে তারে
করে দিই একাকার !

বন্ধু , এ তব বিফল চেষ্টা,
আর কি ফিরিতে পারি ?
শিখরগুহায় আর ফিরে যায়
নদীর প্রবল বারি ?
জীবনের স্বাদ পেয়েছি যখন,
চলেছি যখন কাজে,
কেমনে আবার করিব প্রবেশ
মৃত বরফের মাঝে ?
সে নবীন আশা নাইকো যদিও
তবু যাব এই পথে,
পাব না শুনিতে আশিস্–বচন
তোমাদের মুখ হতে |
তোমাদের ওই হৃদয় হইতে
নূতন পরান আনি
প্রতি পলে পলে আসিবে না আর
সেই আশ্বাসবাণী |
শত হৃদয়ের উত্সাহ মিলি
টানিয়া লবে না মোরে,
আপনার বলে চলিতে হইবে
আপনার পথ ক’রে |
আকাশে চাহিব, হায়, কোথা সেই
পুরাতন শুকতরা !
তোমাদের মুখ ভ্রূকুটিকুটিল ,
নয়ন আলোকহারা |
মাঝে মাঝে শুধু শুনিতে পাইব
হা- হা- হা অট্টহাসি,
শ্রান্ত হৃদয়ে আঘাত করিবে
নিঠুর বচন আসি |
ভয় নাই যার কী করিবে তার
এই প্রতিকূল স্রোতে  !
তোমারি শিক্ষা করিবে রক্ষা
তোমারি বাক্য হতে |

২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ভৈরবী গান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওগো,    কে তুমি বসিয়া উদাসমুরতি
.                বিষাদশান্ত শোভাতে !
ওই      ভৈরবী আর গেয়ো নাকি এই
.                প্রভাতে-----
মোর     গৃহছাড়া এই পথিক-পরান
.                তরুণ হৃদয় লোভেতে |

ওই       মন-উদাসীন ওই আশাহীন
.                ওই ভাষাহীন কাকলি
দেয়      চরণে বাঁধিয়া প্রেমবাহু-ঘেরা
.                অশ্রুকোমল শিকলি |
হায়      মিছে মনে হয় জীবনের ব্রত,
.                মিছে মনে হয় সকলি |

যারে     ফেলিয়া এসেছি, মনে করি, তারে
.                ফিরে দেখে আসি শেষ বার |
ওই       কাঁদিছে সে যেন এলায়ে আকুল
.                 কেশভার |
যারা      গৃহছায়ে বসি সজলনয়ন
.                 মুখ মনে পড়ে সে সবার |

এই        সংকটময় কর্মজীবন
.                  মনে হয় মরু সাহারা,
দূরে       মায়াময় পুরে দিতেছে দৈত্য
.                  পাহারা |
তবে      ফিরে যাওয়া ভাল তাহাদের পাশে
.                  পথ চেয়ে আছে যাহারা |

সেই       ছায়াতে বসিয়া সারা দিনমান
.                  তরুমর্মর পবনে,
সেই       মুকুল-আকুল  বকুল গঞ্জ-
.                  ভবনে
সেই      কুহুকুহরিত বিরহরোদন
.                  থেকে থেকে পশে শ্রবণে |

সেই      চিরকলতান উদার গঙ্গা
.                  বহিছে আঁধার আলোকে,
সেই      তীরে চিরদিন খেলিছে বালিকা-
.                  বালকে |
ধীরে     সারা দেহ যেন মুদিয়া আসিছে
.                   স্বপ্নপাখির পালকে |


হায়,       অতৃপ্ত যত মহৎ বাসনা
.                   গোপনমর্মদাহিনী,
এই        আপনা-মাঝারে শুষ্ক জীবন-
.                   বাহিনী !
ওই        ভৈরবী দিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া
.                   রচিব নিরাশাকাহিনী |

সদা        করুণ কন্ঠ কাঁদিয়া গাহিবে----
.                    ‘হল না, কিছুই হবে না |
এই         মায়াময় ভবে চিরদিন কিছু
.                    রবে না |
কেহ       জীবনের যত গুরুভার ব্রত
.                    ধূলি হতে তুলি লবে না |

‘ এই      সংশয়মাঝে কোন পথে যাই,
.                    কার তরে মরি খাটিয়া !
আমি       কার মিছে দুখে মরিতেছি বুক
.                    ফাটিয়া !
ভবে        সত্য মিথ্যা কে করেছে ভাগ,
.                    কে রেখেছে মত আঁটিয়া !

‘যদি         কাজ নিতে হয়, কত কাজ আছে,
.                    একা কি পারিব করিতে !
কাঁদে        শিশিরবিন্দু জগতের তৃষা
.                    হরিতে !
কেন        অকূল সাগরে জীবন সঁপিব
.                   একেলা জীর্ণ তরীতে !

‘শেষে      দেখিব ----- পড়িল সুখযৌবন
.                   ফুলের মতম খসিয়া,
হায়         বসন্তবায়ু মিছে চলে গেল
.                    শ্বসিয়া,
সেই        যেখানে জগৎ ছিল এক কালে
.                    সেইখানে আছে বসিয়া !


‘শুধু       আমারি জীবন মরিল ঝুরিয়া
.                    চিরজীবনের তিয়াষে |
এই        দগ্ধ হৃদয় এত দিন আছে
.                    কী আশে !
সেই       ডাগর নয়ন, সরস অধর
.                   গেল চলি কোথা দিয়া সে !’

ওগো,     থামো, যারে তুমি বিদায় দিয়েছ
.                  তারে আর ফিরে চেয়ো না |
ওই       অশ্রুসজল ভৈরবী আর
.                  গেয়ো না |
আজি    প্রথম প্রভাতে চলিবার পথ
.                  নয়নবাষ্পে ছেয়ো না |

ওই       কুহকরাগিণী এখনি কেন গো
.                 পথিকের প্রাণ বিবশে !
পথে      এখনো উঠিবে প্রখর তপন
.                  দিবসে |
পথে       রাক্ষসী সেই তিমিররজনী
.                  না জানি কোথায় নিবসে !

থামো,    শুধু একবার ডাকি নাম তাঁর
.                  নবীন জীবন ভরিয়া---
যাব       যাঁর বল পেয়ে সংসারপথ
.                  তরিয়া,
যত        মানবের গুরু মহত্জনের
.                  চরণচিহ্ন ধরিয়া |

যাও      তাহাদের কাছে ঘরে যারা আছে
.                  পাষাণে পরান বাঁধিয়া,
গাও      তাদের জীবনে তাদের বেদনে
.                   কাঁদিয়া |
তারা     প’ড়ে ভূমিতলে ভাসে অশ্রুজলে
.                  নিজ সাধে বাদ সাধিয়া |


হায়       উঠিতে চাহিছে পরান, তবুও
.                  পারে না তাহারা উঠিতে |
তারা      পারে না ললিতলতার বাঁধন
.                   টুটিতে  |
তারা      পথ জানিয়াছে, দিবানিশি তবু
.                    পথপাশে রহে লুটিতে
তারা      অলস বেদন করিবে যাপন
.                   অলস রাগিণী গাহিয়া,
রবে       দূর আলো-পানে আবিষ্টপ্রাণে
.                  চাহিয়া |
ওই        মধুর রোদনে ভেসে যাবে তারা
.                  দিবসরজনী বাহিয়া |

সেই       আপনার গানে আপনি গলিয়া
.                  আপনারে তারা ভুলাবে,
স্নেহে     আপনার দেহে সকরুণ কর
.                 বুলাবে |
সুখে       কোমল শয়নে রাখিয়া জীবন
.                  ঘুমের দোলায় দুলাবে |

ওগো,     এর চেয়ে ভালো প্রখর জীবন
.                  নিঠুর আঘাত চরণে |
যাব        আজীবন কাল পাষাণকঠিন
.                  সরণে |
যদি        মৃত্যুর মাঝে নিয়ে যার পথ,
.                  সুখ আছে সেই মরণে |

২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ধর্মপ্রচার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
কলিকাতার এক বাসায়

ওই শোনো ভাই বিশু,
পথে শুনি ‘জয় যিশু’ !
কেমনে এ নাম করিব সহ্য
আমরা আর্যশিশু !

কূর্ম, কল্কি, স্কন্ধ
এখন করো তো বন্ধ |
যদি যিশু ভজে রবে না ভারতে
পুরাণের নাম গন্ধ |

ওই দেখো ভাই, শুনি----
যাজ্ঞবল্ক্য মুনি ,
বিষ্ণু , হারীত, নারদ, অত্রি
কেঁদে হল খুনোখুনি !

কোথায় রহিল কর্ম,
কোথা সনাতন ধর্ম !
সম্প্রতি তবু কিছু শোনা যায়
বেদ-পুরাণের মর্ম !

ওঠো, ওঠো ভাই জাগো,
মনে মনে খুব রাগো !
আর্যশাস্ত্র উদ্ধার করি,
কোমর বাঁধিয়া লাগো !

কাছাকোঁচা লও আঁটি,
হাতে তুলে লও লাঠি |
হিন্দুধর্ম করিব রক্ষা,
খৃস্টানি হবে মাটি |

কোথা গেল ভাই ভজা
হিন্দুধর্মধ্বজা ?
ষণ্ডা ছিল সে, সে যদি থাকিত
আজ হত দুশো মজা !

এসো মোনো, এসো ভুতো,
প’রে লও বুট জুতো |
পাদ্রি বেটার পা মাড়িয়ে দিয়ো
পাও যদি কোনো ছুতো !

আগে দেব দুয়ো তালি,
তার পরে দেব গালি  |
কিছু না বলিলে পড়িব তখন
বিশ-পঁচিশ বাঙালি |

তুমি আগে যেয়ো তেড়ে,
আমি নেব টুপি কেড়ে |
গোলেমালে শেষে পাঁচজন পঁড়ে
মাটিতে ফেলিয়া পেড়ে |

কাঁচি দিয়ে তার চুল
কেটে দেব বিলকুল
কোটের বোতাম আগাগোড়া তার
করে দেব নির্মূল |

তবে উঠ, সবে উঠ-----
বাঁধো কটি, আঁটো মুঠো !
দেখো, ভাই, যেন ভুলো না, আপনি
সাথে নিয়ো লাঠি দুটো !

দলপতির  শিষ  ও গান

প্রাণসই   রে,
মনেজ্বালা কারে কই রে !

কোমরে চাদর বাঁধিয়া, লাঠি হস্তে, মহোত্সাহে সকলের প্রস্থান
পথে বিশু হারু মোনো ভূতোর সমাগম |
গেরুয়াবস্ত্রাচ্ছাদিত অনাবৃতপদ মুক্তিফৌজের প্রচারক  ;

ধন্য হউক তোমার প্রেম,
ধন্য তোমার নাম,
ভুবনমাঝারে হউক উদয়
নূতন জেরুজিলাম |
ধরণী হইতে যাক ঘৃণাদ্বেষ,
নিঠুরতা দূর হোক-----
মুছে দাও, প্রভু , মানবের আঁখি,
ঘুচাও মরণশোক |
তৃষিত যাহারা, জীবনের বারি
করো তাহাদের দান !
দয়াময় যিশু, তোমার দয়ায়
পাপীজনে করো প্রাণ |

‘ওরে ভাই বিশু, এ কে,
জুতো কোথা এল রেখে !
গোরা বটে, তবু হতেছে ভরসা
গেরুয়া বসন দেখে |’

‘হারু, তবে তুই এগো !
বল---- বাছা, তুমি কে গো !
কিচিমিচি রাখো, খিদে পেয়েছে কি ?
দুটো কলা এনে দে গো !’

বধির নিদয় কঠিন হৃদয়
তারে প্রভু দাও কোল !
অক্ষম আমি কি করিতে পারি---
‘হরিবোল হরিবোল !’

‘আরে, রেখে দাও খৃষ্ট !
এখনি দেখাও পৃষ্ঠ !
দাঁড়ে উঠে চড়ো, পড়ো বাবা পড়ো
.                             হরে হরে হরে কৃষ্ট !’

তুমি যা সয়েছ তাহাই স্মরিয়া
সহিব সকল ক্লেশ,
ক্রুস গুরুভার করিব বহন ---
‘বেশ, বাবা, বেশ বেশ  !’

দাও ব্যথা, যদি কারো মুছে পাপ
আমার নয়ননীরে |
প্রাণ দিব, যদি এ জীবন দিলে
পাপীর জীবন ফিরে |
আপনার জন—আপনার দেশ –
হয়েছি সর্ব-ত্যাগী |
হৃদয়ের প্রেম সব ছেড়ে যায়
তোমার প্রেমের লাগি |

সুখ, সভ্যতা, রমণীর প্রেম,
বন্ধুর কোলাকুলি---
ফেলি দিয়া পথে তব মহাব্রত
মাথায় লয়েছি তুলি |
এখনো তাদের ভুলিতে পারি নে,
মাঝে মাঝে জাগে প্রাণে----
চিরজীবনের সুখবন্ধন
সেই গৃহমাঝে টানে |
তখন তোমার রক্তসিক্ত
ওই মুখপানে চাহি,
ও প্রেমের কাছে স্বদেশ বিদেশ
আপনা ও পর নাহি |
ওই প্রেম তুমি করো বিতরণ
আমার হৃদয় দিয়ে,
বিষ দিতে যারা এসেছে তাহারা
ঘরে যাক সুধা নিয়ে |
পাপ লয়ে প্রাণে এসেছিল যারা
তাহারা আসুক বুকে----
পড়ুক প্রেমের মধুর আলোক
ভ্রূকুটিকুটিল মুখে !

‘আর প্রাণে নাহি সহে,
আর্যরক্ত দহে ?’
‘ওহে হারু, ওহে মাধু, লাঠি নিয়ে
ঘা-কতক দাও তো হে !’
‘যদি চাস তুই ইষ্ট
বল্ মুখে বল্ কৃষ্ট |’

ধন্য হউক তোমার নাম
দয়াময় যিশুখৃষ্ট !
‘তবে-রে ! লাগাও লাঠি
কোমরে কাপড় আঁটি |’
‘হিন্দুধর্ম হউক রক্ষা
খৃষ্টানি হোক মাটি |’

প্রচারকের মাথায় লাঠি প্রহার |  মাথা ফাটিয়া রক্তপাত |  রক্ত মুছিয়া :

প্রভু  তোমাদের করুণ কুশল,
দিন তিনি শুভমতি |
আমি তাঁর দীন অধমের ভৃত্য,
তিনি জগতের পতি |

‘ওরে শিবু, ওরে হারু,
ওরে ননি, ওরে চারু,
তামাশা দেখার এই কি সময়----
প্রাণে ভয় নেই কারু !’

‘পুলিস আসিছে গুঁতা উঁচাইয়া,
এইবেলা দৌড় !’
‘ধন্য হইল আর্য ধর্ম,
ধন্য হইল গৌড় !’

ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন |   বাসায় ফিরিয়া ;

সাহেব মেরেছি ! বঙ্গবাসীর
কলঙ্ক গেছে ঘুচি  |
মেজোবউ কোথা ডেকে দাও তারে---
কোথা ছোকা, কোথা লুচি !
এখনো আমার তপ্ত রক্ত
উঠিতেছে উচ্ছ্বসি ----
তাড়াতাড়ি আজ লুচি না পাইলে
কী জানি কি ক’রে বসি !
স্বামী ঘরে এল যুদ্ধ সারিয়া
ঘরে নেই লুচি ভাজা !
আর্যনারীর এ কোন প্রথা,
সমুচিত দিব সাজা |
যাজ্ঞবল্ক্য অত্রি হারীত
জলে গুলে কেলে সবে ----
মার্ ধোর করে হিন্দুধর্ম
রক্ষা করিতে হবে   |
কোথা পুরাতন পাতিব্রত্য,
সনাতন লুচি ছোকা----
বত্সরে শুধু সংসারে আসে
একখানি করে খোকা |

এই কবিতায়  বর্ণিত  ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়

৩২ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাসরশয়নে

বর |   জীবনে জীবন                       প্রথম মিলন,
সে সুখের কোথা তুলা নাই |
এসো, সব ভুলে         আজি আঁখি তুলে
শুধু দুঁহু দোঁহা মুখ চাই  |
মরমে মরমে                  শরমে ভরমে
জোড়া লাগিয়াছে এক ঠাঁই |
যেন এক মোহে         ভুলে আছি দোঁহে,
যেন এক ফুলে মধু খাই |
জনম অবধি                    বিরহে দগধি
এ পরান হয়ে ছিল ছাই----
তোমার অপার               প্রেমপারাবার,
জুড়াইতে আমি এনু তাই |
বলো একবার,           ‘আমিও তোমার,
তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই |’
ওঠ কেন, ওকি,        কোথা যাও সখী ?

সরোদনে

কনে |                       আইমার কাছে শুতে যাই !

দু-দিন  পরে

বর |      কেন, সখী , কোণে            কাঁদিছ বসিয়া
চোখে কেন জল পড়ে ?
ঊষা কি তাহার              শুকতারা- হারা,
তাই কি শিশির ঝরে ?
বসন্ত কি নাই                    বনলক্ষ্মী তাই
কাঁদিছে আকুল স্বরে ?
উদাসিনী , স্মৃতি             কাঁদিছে কি বসি
আশার সমাধি—‘পরে ?
খ’সে-পড়া তারা              করিছে কি শোক
নীল আকাশের তরে ?
কী লাগি কাঁদিছ ?
কনে |                                        পুষি মেনিটিরে
ফেলিয়া এসেছি ঘরে |

অন্দরের বাগানে

বর |      কী করিছ বনে                     শ্যামল শয়নে
আলো করে বসে তরুমূল ?
কোমল কপোলে                যেন নানা ছলে
উড়ে এসে পড়ে এলোচুল |
পদতল দিয়া                     কাঁদিয়া কাঁদিয়া
বহে যায় নদী কুলুকুল্ |
সারা দিনমান                       শুনি সেই গান
তাই বুঝি আঁখি ঢুলঢুল্ |
আঁচল ভরিয়া                       মরমে মরিয়া
পড়ে আছে বুঝি ঝুরো ফুল ?
বুঝি মুখ কার                    মনে পড়ে, আর
মালা গাঁথিবারে হয় ভুল ?
কার কথা বলি                     বায়ু পড়ে ঢলি,
কানে দুলাইয়া যায় দুল ?
গুন্ গুন্ ছলে                      কার নাম বলে
চঞ্চল যত অলিকুল ?
কানন নিরালা,                  আঁখি হাসি-ঢালা,
মন সুখস্মৃতি-সমাকুল---
কী করিছ বনে                         কুঞ্জভবনে ?
কনে |         খেতেছি বসিয়া টোপাকুল |
বর |       আসিয়াছি কাছে                মনে যাহা আছে
বলিবারে চাহি সমুদয় |
আপনার ভার                      বহিবারে আর
পারে না ব্যাকুল এ হৃদয় |
আজি মোর মন                   কী জানি কেমন
বসন্ত আজি মধুময়,
আজি প্রাণ খুলে                      মালতীমুকুলে
বায়ু করে যায় অনুনয় |
যেন আঁখি দুটি                    মোর পানে ফুটি
আশা-ভরা দুটি কথা কয়,
ও হৃদয় টুটে                          যেন প্রেম উঠে
নিয়ে আধো-লাজ আধো-ভয় |
তোমার লাগিয়া                       পরান জাগিয়া
দিবসরজনী সারা হয়,
কোন্ কাজে তব                    দিবে তারে সব
তারি লাগি যেন চেয়ে রয় |
জগৎ  ছানিয়া                       কী দিব আনিয়া
জীবন যৌবন করি ক্ষয় ?
তোমা তরে, সখী,                 বলো করিব কী ?
কনে |            আরে কুল পাড়ো গোটা ছয় |
বর |      তবে যাই সখী ,                          নিরাশাকাতর
শূন্য জীবন নিয়ে |
আমি চলে গেলে                     এক ফোঁটা জল
পড়িবে কি আঁখি দিয়ে ?
বসন্তবায়ু                                   মায়ানিশ্বাসে
বিরহ জ্বালাবে হিয়ে ?
ঘুমন্তপ্রায়                                  আকাঙ্ক্ষা যত
পরানে উঠিবে জিয়ে ?
বিষাদিনী বসি                            বিজন বিপিনে
কী করিবে তুমি প্রিয়ে ?
বিরহের বেলা                       কেমনে কাটিবে ?
কনে |                                         দেব পুতুলের বিয়ে |


গাজিপুর
২৩ আষাঢ় ১৮৮৮

.         ***************************          

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রকাশবেদনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আপন প্রাণের গোপন বাসনা
টুটিয়া দেখাতে চাহি রে---
হৃদয়বেদনা হৃদয়েই থাকে,
ভাষা থেকে যায় বাহিরে |

শুধু     কথার উপরে কথা,
নিষ্ফল ব্যাকুলতা |
বুঝিতে বোঝাতে দিন চলে যায়,
ব্যথা থেকে যায় ব্যথা  |

মর্মবেদন আপন আবেগে
স্বর হয়ে কেন ফোটে না ?
দীর্ণ হৃদয় আপনি কেন রে
বাঁশি হয়ে বেজে ওঠে না ?

আমি       চেয়ে থাকি শুধু মুখে
ক্রন্দনহারা দুখে-----
শিরায় শিরায় হাহাকার কেন
ধ্বনিয়া উঠে না বুকে ?

অরণ্য যথা চিরনিশিদিন
শুধু মর্মর স্বনিছে,
অনন্ত কালের বিজন বিরহ
সিন্ধুমাঝারে ধ্বনিছে---

যদি      ব্যাকুল ব্যথিত প্রাণ
তেমনি গাহিত গান
চিরজীবনের বাসনা তাহার
হইত মূর্তিমান !

তীরের মতন পিপাসিত বেগে
ক্রন্দনধ্বনি ছুটিয়া
হৃদয় হইতে হৃদয়ে পশিত,
মর্মে রহিত ফুটিয়া |

আজ      মিছে এ কথার মালা
মিছে অশ্রু ঢালা !
কিছু নেই পোড়া ধরণীমাঝারে
বোঝাতে মর্মজ্বালা !

সোলাপুর
৬ বৈশাখ ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মায়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৃথা এ বিড়ম্বনা !
কিসের লাগিয়া                      এতই তিয়াস,
কেন এত যন্ত্রণা !
ছায়ার মতন                       ভেসে চলে যায়
দরশন পরশন-----
এই যদি পাই                         এই ভুলে যাই,
তৃপ্তি না মানে মন |
কত বার আসে,                   কত বার ভাসে,
মিশে যায় কত বার ----
পেলেও যেমন                      না পেলে তেমন
শুধু থাকে হাহাকার |
সন্ধ্যাপবনে                                  কুঞ্জভবনে
নির্জন নদীতীরে
ছায়ার মতন                              হৃদয়বেদন
ছায়ার লাগিয়া ফিরে |
কত দেখাশোনা                    কত আনাগোনা
চারি দিকে অবিরত,
শুধু তারি মাঝে                    একটি কে আছে
তারি তরে ব্যথা কত !
চিরদিন ধ’রে                           এমনি চলিছে,
যুগ- যুগ গেছে চ’লে |
মানবের মেলা                      করে গেছে খেলা
এই ধরণীর কোলে  !
এই ছায়া লাগি                         কত নিশি জাগি
কাঁদায়েছে কাঁদিয়াছে ----
মহাসুখ মানি                              প্রিয়তনুখানি
বাহুপাশে বাঁধিয়াছে !
নিশিদিন কত                          ভেবেছে সতত
নিয়ে কার হাসিকথা !
কোথা তারা আজ---                    সুখ দুখ লাজ,
কোথা তাহাদের ব্যথা ?
কোথা সেদিনের                           অতুলরূপসী
হৃদয়প্রেয়সীচয় ?
নিখিলের প্রাণে                        ছিল সে জাগিয়া ,
আজ সে স্বপনও নয় !
ছিল সে নয়নে                           অধরের কোণে
জীবন মরণ কত-----
বিকচ সরস                                    তনুর পরশ
কোমল প্রেমের মতো |
এত সুখ দুখ                                   তীব্র কামনা
জাগরণ হাহুতাশ
যে রূপজ্যোতিরে                        সদা ছিল ঘিরে
কোথা তার ইতিহাস ?
যমুনার ঢেউ                                     সন্ধ্যারঙিন
মেঘখানি ভালোবাসে-----
এও চলে যায়,                              সেও চলে যায়,
অদৃষ্ট বসে হাসে |


রোজ্ ব্যাঙ্ক | খিরকি
১ জ্যৈষ্ঠ  ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বর্ষার দিনে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায় !
এমন মেঘস্বরে                      বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় |

সে কথা শুনিবে না কেহ আর ,
নিভৃত নির্জন চারি ধার |
দুজনে মুখোমুখি                  গভীর দুখে দুখী,
আকাশে জল ধরে অনিবার |
জগতে কেহ যেন নাহি আর |

সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব|
কেবল আঁখি দিয়ে               আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব |
আঁধারে  মিশে গেছে আর সব |

বলিতে বাজিবে না নিজ কানে,
চমক লাগিবে না নিজ প্রাণে |
সে কথা আঁখিনীরে               মিশিয়া যাবে ধীরে
এ ভরা বাদলের মাঝখানে |
সে কথা মিশে যাবে দুটি প্রাণে |

তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার ?
শ্রাবণবরিষণে                          একদা গৃহকোণে
দুকথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ?

আছে তো তার পরে বারো মাস,
উঠিবে কত কথা কত হাস |
আসিবে কত লোক                   কত-না দুখশোক,
সে কথা কোন্ খানে পাবে নাশ |
জগৎ চলে যাবে বারো মাস |

ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায় |
যে কথা এ জীবনে                       রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় |

রোজ্ ব্যাঙ্ক | খিরকি
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মেঘের খেলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্বপ্ন যদি হ’ত জাগরণ,
সত্য যদি হ’ত কল্পনা,
তবে এ ভালোবাসা               হ’ত না হত-আশা
কেবল কবিতার জল্পনা |

মেঘের খেলা-সম হ’ত সব
মধুর মায়াময় ছায়াময় |
কেবল আনাগোনা,              নীরবে জানাশোনা,
জগতে কিছু আর কিছু নয় |

কেবল মেলামেশা গগনে,
সুনীল সাগরের পরপারে
সুরের ছায়াগিরি                   তাহারে ঘিরি ঘিরি,
শ্যামল ধরণীর ধারে ধারে |

কখনো ধীরে ধীরে ভেসে যায়,
কখনো মিশে যায় ভাঙিয়া ----
কখনো ঘননীল                       বিজুলি-ঝিলমিল,
কখনো ঊষারাগে রাঙিয়া |

যেমন প্রাণপণ বাসনা
তেমনি বাধা তার সুকঠিন ----
সকলি লঘু হয়ে                     কোথায় যেত বয়ে,
ছায়ার মতো হ’ত কায়াহীন |

চাঁদের আলো হ’ত সুখহাস,
অশ্রু শরতের বরষন |
সাক্ষী করি বিধু                          মিলন হ’ত মৃদু
কেবল প্রাণে প্রাণে পরশন |

শান্তি পেত এই চিরতৃষা
চিত্ত চঞ্চল সকাতর,
প্রেমের থরে থরে                  বিরাম জাগিত রে ---
দুখের ছায়া মাঝে রবিকর |

রোজ্ ব্যাঙ্ক | খিরকি
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ধ্যান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নিত্য তোমার চিত্ত ভরিয়া
স্মরণ করি,
বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া
বরণ করি ;
তুমি আছ মোর জীবন-মরণ
হরণ করি |

তোমার পাই নে কুল-----
আপনা-মাঝারে আপনার প্রেম
তাহারো পাই নে তুল |
উদয়শিখরে সূর্যের মতো
সমস্ত প্রাণ মম
চাহিয়া রয়েছে নিমেষনিহত
একটি নয়ন-সম---
অগাধ অপার উদাস দৃষ্টি,
নাহিকো তাহার সীমা |
তুমি যেন ওই আকাশ উদার,
আমি যেন এই অসীম পাথার,
আকুল করেছে মাঝখানে তার
আনন্দপূর্ণিমা
তুমি প্রশান্ত চিরনিশিদিন,
আমি অশান্ত বিরামহীন
চঞ্চল অনিবার---
যত দূর হেরি দিক্ দিগন্তে
তুমি আমার একাকার |

জোড়াসাঁকো
২৬ শ্রাবণ ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
পূর্বকালে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রাণমন দিয়ে ভালোবাসিয়াছে
এত দিন এত লোক,
এত কবি এত গেঁথেছে প্রেমের শ্লোক,
তবু তুমি ভবে চিরগৌরবে
ছিলে না কি একেবারে
হৃদয় সবার করি অধিকার !
তোমা ছাড়া কেহ কারে
বুঝিতে পারি নে ভালো কি বাসিতে পারে !
গিয়েছে এসেছে কেঁদেছে হেসেছে
ভালো তো বেসেছে তারা,
আমি তত দিন কোথা ছিনু দলছাড়া ?
ছিনু বুঝি বসে কোন্ এক পাশে
পথপাদপের ছায়,
সৃষ্টিকালের প্রত্যুষ হতে
তোমারি প্রতীক্ষায় ---
চেয়ে দেখি কত পথিক চলিয়া যায় |

অনাদি বিরহবেদনা ভেদিয়া
ফুটেছে প্রেমের সুখ
যেমনি আজিকে দেখেছি তোমার মুখ |
সে অসীম ব্যথা অসীম সুখের
হৃদয়ে হৃদয়ে রহে,
তাই তো আমার মিলনের মাঝে
নয়নে সলিল বহে !
এ প্রেম আমার সুখ নহে, দুখ নহে |

জোড়াসাঁকো
২ ভাদ্র ১৮৮৯

.         ***************************          

.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com