*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
অনন্ত  প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার,
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার |
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার |

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী ,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতিপুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে |

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উত্স হতে |
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে---
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে |

আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে |
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি ,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি----
সকল কালের সকল কবির গীতি |

জোড়াসাঁকো
২ ভাদ্র ১৮৮৯

.         ***************************     

.                                                                                
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আশঙ্কা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

        কে জানে এ কি ভালো !
আকাশ-ভরা কিরণধারা
আছিল মোর তপন-তারা,
আজিকে শুধু একেলা তুমি
        আমার আঁখি-আলো---
        কে জানে এ কি ভালো !

কত-না শোভা, কত-না সুখ,
কত-না ছিল অমিয়-মুখ,
নিত্য-নব পুষ্পরাশি
           ফুটিত মোর দ্বারে ----
ক্ষুদ্র আশা ক্ষুদ্র স্নেহ
মনের ছিল শতেক গেহ,
আকাশ ছিল, ধরণী ছিল
             আমার চারি ধারে------
কোথায় তারা, সকলে আজি
         তোমাতেই লুকালো |
         কে জানে এ কি ভালো !

কম্পিত এ হৃদয়খানি
তোমার কাছে তাই |
দিবানিশি জাগিয়া আছি,
         নয়নে ঘুম নাই |
সকল গান সকল প্রাণ
তোমারে আমি করেছি দান----
তোমারে ছেড়ে বিশ্বে মোর
         তিলেক নাহি ঠাঁই |
সকল পেয়ে তবুও যদি
তৃপ্তি নাহি মেলে ,
তবুও যদি চলিয়া যাও
         আমারে পাছে ফেলে,
নিমেষে সব শূন্য হবে
তোমারি এই আসন ভবে,
চিহ্নসম কেবল রবে
        মৃত্যুরেখা কালো |
        কে জানে এ কি ভালো !


জোড়াসাঁকো
১৪ ভাদ্র ১৮৮৯

.         ***************************     

.                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ওগো ভালো করে বলে যাও
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


.                  ওগো,     ভালো করে বলে যাও |
.                       বাঁশরি বাজায়ে যে কথা জানাতে
.                                সে কথা বুঝায়ে দাও |
যদি                 না বলিবে কিছু , তবে কেন এসে
.                                মুখপানে শুধু চাও |

.                  আজি      অন্ধতামসী নিশি  |
.                        মেঘের আড়ালে গগনের তারা
.                                  সব গুলি গেছে মিশি |
শুধু                    বাদলের বায় করি হায়-হায়
.                                  আকুলিছে দশ দিশি !

.                   আমি       কুন্তল দিব খুলে |
.                          অঞ্চলমাঝে ঢাকিব তোমার
.                                   নিশীথনিবিড় চুলে |
দুটি                    বাহুপাশে বাঁধি নত মুখখানি
.                                   বক্ষে লইব তুলে |

.                    সেথা        নিভৃতনিলয়সুখে
.                          আপনার মনে বলে যেয়ো কথা
.                                   মিলনমুদিত বুকে |
আমি                   নয়ন মুদিয়া শুনিব কেবল,
.                                    চাহিব না মুখে মুখে |

.                   যবে         ফুরাবে তোমার কথা
.                          যে যেমন আছি রহিব বসিয়া
.                                    চিত্রপুতলি যথা |
শুধু              শিয়রে দাঁড়ায়ে করে কানাকানি
.                                     মর্মর তরুলতা |

.                   শেষে          রজনীর অবসানে
.                           অরুণ উদিলে, ক্ষণেকের তরে
.                                     চাব দুঁহু দোঁহা-পানে |
ধীরে                 ঘরে যাব ফিরে দোঁহে দুই পথে
.                             জলভরা দু’নয়ানে |

.                 তবে       ভালো করে বলে যাও |
.                      আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে
.                              সে কথা বুঝায়ে দাও |
শুধু                   কম্পিত সুরে আধো ভাষা পুরে
.                              কেন এসে গান গাও ?


শান্তিনিকেতন
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মেঘদূত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত ! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জিভূত করে |

সেদিন সে উজ্জয়িনী প্রাসাদশিখরে
কী না জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উত্সব,
উদ্দামপবনবেগ, গুরুগুরু রব |
গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘসংঘর্ষের
জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের
অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন
এক দিনে | ছিন্ন করি কালের বন্ধন
সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোকরাশি |
সেদিন কি জগতের যতেক প্রবাসী
জোড়হস্তে মেঘপানে শূন্যে তুলি মাথা
গেয়েছিল সমস্বরে বিরহের গাথা
ফিরি প্রিয়গৃহপানে ? বন্ধনবিহীন
নবমেঘপক্ষ-- ‘পরে করিয়া আসীন
পাঠাতে চাহিয়াছিল প্রেমের বারতা
অশ্রুবাষ্প-ভরা----দূর বাতায়নে যথা
বিরহিণী ছিল শুয়ে ভূতলশয়নে
মুক্তকেশে, ম্লান বেশে, সজল নয়নে ?

তাদের সবার গান তোমার সংগীতে
পাঠায়ে কি দিলে, কবি, দিবসে নিশীথে
দেশে দেশান্তরে, খুঁজি’ বিরহিণী প্রিয়া ?
শ্রাবণে জাহ্নবী যথা যায় প্রবাহিয়া
টানি লয়ে দিশ-দিশান্তরে বারিধারা
মহাসমুদ্রের মাঝে হতে দিশাহারা |
পাষাণশৃঙ্খলে যথা বন্দী হিমাচল
আষাঢ়ে অনন্ত শূন্যে হেরি মেঘদল
স্বাধীন-গগনচারী, কাতারে নিশ্বাসি
সহস্র কন্দর হতে বাষ্প রাশি রাশি
পাঠায় গগন-পানে ; ধায় তারা ছুটি
উধাও কামনা-সম ; শিখরেতে উঠি
সকলে মিলিয়া শেষে হয় একাকার,
সমস্ত গগনতল করে অধিকার |

সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস স্নিগ্ধ নববরষার |
প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের ‘পরে করি বরিষন
নববৃষ্টিবারিধারা, করিয়া বিস্তার
নবঘনস্নিগ্ধচ্ছায়া, করিয়া সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের,
স্ফীত করি স্রোতোবেগ তোমার ছন্দের
বর্ষাতরঙ্গিণীসম |

.                   কত কাল ধরে
কত সঙ্গীহীন জন, প্রিয়াহীন ঘরে,
বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী
আষাঢ়সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি
ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ
নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন !
সে সবার কন্ঠস্বর কর্ণে আসে মম
সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি-সম
তব কাব্য হতে |

.                   ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আজি ; যে শ্যামল বঙ্গদেশে
জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে
দেখেছিলো দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর |

আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টির ঝরঝর্ ,
দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার |
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার
খরতের বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া |
অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পড়িতেছি মেঘদূত ; গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন,
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে | কোথা আছে
সানুমান আম্রকূট ; কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধ্যপদমূলে
উপলব্যথিতগতি ;  বেত্রবতীকূলে
পরিণতফলশ্যাম জম্বুবনচ্ছায়ে
কোথায় দশার্ণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে
প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা ;
পথতরুশাখে কোথা গ্রামবিহঙ্গেরা
বর্ষায় বাঁধিছে নীড়, কলরবে ঘিরে
বনস্পতি ; না জানি সে কোন্ নদীতীরে
যূথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে,
তপ্ত কপোলের তাপে ক্লান্ত কর্ণোত্পল
মেঘের ছায়ার লাগি হতেছে বিকল ;
ভ্রূবিলাস শেখে নাই কারা সেই নারী
জনপদবধূজন, গগনে নেহারি
ঘনঘটা, ঊর্দ্ধনেত্রে চাহে মেঘপানে,
ঘননীল ছায়া পড়ে সুনীল নয়ানে ;
কোন্ মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা
স্নিগ্ধ নবঘন হেরি আছিল উন্মনা
শিলাতলে, সহসা আসিতে মহা ঝড়
চকিত চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড়
সম্বরি বসন ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি,
বলে, ‘মা গো, গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি !’
কোথায় অবন্তীপুরী ; নির্বিন্ধ্যা তটিনী ;
কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী
স্বমহিমচ্ছায়া ---- সেথা নিশিদ্বিপ্রহরে
প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে
সুপ্ত পারাবত, শুধু বিরহবিকারে
রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে
সূচিভেদ্য অন্ধকারে  রাজপথ-মাঝে
ক্কচিৎ-বিদ্যুতালোকে ;  কোথা সে বিরাজে
ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র ; কোথা কন্ খল,
যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল,
গৌরীর ভ্রূকুটিভঙ্গি করি অবহেলা
ফেনপরিহাসচ্ছলে করিতেছে খেলা
লয়ে ধূর্জটির জটা চন্দ্রকরোজ্জ্বল |

এইমতো মেঘরূপে ফিরি দেশে দেশে
হৃদয় ভাসিয়া চলে উত্তরিতে শেষে
কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে,
বিরহিণী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে
সৌন্দর্যের আদিসৃষ্টি | সেথা কে পারিত
লয়ে যেতে, তুমি ছাড়া, করি অবারিত
লক্ষ্মীর বিলাসপুরী---- অমর ভুবনে !
অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে
নিত্য চন্দ্রালোকে, ইন্দ্রনীলশৈলমূলে
সুবর্ণরোজফুল্ল সরোবরকূলে
মণিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা |
মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা
শয্যাপ্রান্তে লীনতনু ক্ষীণ শশীরেখা
পূর্বগগনের মূলে যেন অন্তপ্রায় |
কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায়
রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যথা ;
লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক, যেথা
চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিণী প্রিয়া
অনন্তসৌন্দর্যমাঝে একাকী জাগিয়া |

আবার হারায়ে যায়---- হেরি চারি ধার
বৃষ্টি পড়ে অবিশ্রাম ; ঘনায়ে আঁধার
আসিছে নির্জননিশা ; প্রান্তরের শেষে
কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকূল-উদ্দেশে |
ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রনয়ান,
কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান ?
কেন ঊর্দ্ধে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ ?
সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে,
মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে,
রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে !


শান্তিনিকেতন
৭ / ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯০
অপরাহ্নে | ঘনবর্ষায়

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
অহল্যার প্রতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কী স্বপ্নে কাটালে তুমি দীর্ঘ দিবানিশি,
অহল্যা, পাষাণরূপে ধরাতলে মিশি,
নির্বাপিত-হোম-অগ্নি তাপসবিহীন
শূন্যে তপোবনচ্ছায়ে ? আছিলে বিলীন
বৃহৎ পৃথ্বীর সাথে হয়ে এক-দেহ,
তখন কি জেনেছিলে তার মহাস্নেহ ?
ছিল কি পাষাণতলে অস্পষ্ট চেতনা  ?
জীবধাত্রী জননীর বিপুল বেদনা,
মাতৃধৈর্যে মৌন মূক সুখদুঃখ যত
অনুভব করেছিলে স্বপনের মতো
সুপ্ত আত্মা মাঝে ? দিবারাত্রি অহরহ
লক্ষ কোটি পরানীর মিলন, কলহ,
আনন্দবিষাদক্ষুদ্ধ ক্রন্দন গর্জন,
অযুত পান্থের পদধ্বনি অনুক্ষণ---
পশিত কি অভিশাপ-নিদ্রা ভেদ করে
কর্ণে তোর ? জাগাইয়া রাখিত কি তোরে
নেত্রহীন মূঢ় রূঢ় অর্ধজাগরণে ?
বুঝিতে কি পেরেছিল আপনার মনে
নিত্যনিদ্রাহীন ব্যথা মহাজননীর ?
যেদিন বহিত নব বসন্তসমীর,
ধরণীর সর্বাঙ্গের পুলকপ্রবাহ
স্পর্শ কি করিত তোরে ? জীবন-উত্সাহ
ছুটিত সহস্র পথে মরুদিগ্ বিজয়ে
সহস্র আকারে, উঠিত সে ক্ষুব্ধ হয়ে
তোমার পাষাণ ঘেরি করিতে নিপাত
অনুর্বর অভিশাপ তব, সে আঘাত
জাগাত কি জীবনের কম্প তব দেহে ?
যামিনী আসিত যবে মানবের গেহে
ধরণী লইত টানি শ্রান্ত তনুগুলি
আপনার বক্ষ—‘পরে ; দুঃখশ্রম ভুলি
ঘুমাত অসংখ্য জীব --- জাগিত আকাশ—
তাদের শিথিল অঙ্গ, সুষুপ্ত নিশ্বাস
বিভোর করিয়া দিত ধরণীর বুক----
মাত-অঙ্গে সেই কোটিজীবস্পর্শসুখ
কিছু তার পেয়েছিলে আপনার মাঝে ?
যে গোপন অন্তঃপুরে জননী বিরাজে,
বিচিত্রিত যবনিকা পত্রপুষ্পজালে
বিবিধ বর্ণের লেখা, তারি অন্তরালে
রহিয়া অসূর্যস্পশ্য নিত্য চুপে চুপে
ভরিছে সন্তানগৃহ ধনধান্যরূপে
জীবনে যৌবনে, সেই গূঢ় মাতৃকক্ষে
সুপ্ত ছিলে এতকাল ধরণীর বক্ষে
চিররাত্রিসুশীতল বিস্মৃতি-আলয়ে
যেথায় অনন্তকাল ঘুমায় নির্ভয়ে
লক্ষ জীবনের ক্লান্তি ধূলির শয্যায় ;
নিমেষে নিমেষে যেথা ঝরে পড়ে যায়
দিবসের তাপে শুষ্ক ফুল, দগ্ধ তারা,
জীর্ণ কীর্তি, শ্রান্ত সুখ, দুঃখ দাহহারা |

সেথা স্নিগ্ধ হস্ত দিয়ে পাপতাপরেখা
মুছিয়া দিয়াছে মাতা ; দিলে আজি দেখা
ধরিত্রীর সদ্যোজাত কুমারীর মতো
সুন্দর, সরল, শুভ্র ; হয়ে বাক্যহত
চেয়ে আছে প্রভাতে জগতের পানে |
যে শিশির পড়েছিল তোমার পাষাণে
রাত্রিবেলা, এখন সে কাঁপিছে উল্লাসে
আজানুচুম্বিত মুক্ত কৃষ্ণ কেশপাশে |
যে শৈবাল রেখেছিল ঢাকিয়া তোমায়
ধরণীর শ্যামশোভা অঞ্চলের প্রায়
বহু বর্ষ হতে, পেয়ে বহু বর্ষাধারা
সতেজ সরস ঘন, এখনো তাহারা
লগ্ন হয়ে আছে তব নগ্ন গৌর দেহে
মাতৃদত্ত বস্ত্রখানি সুকোমল স্নেহে |

হাসে পরিচিত হাসি নিখিল সংসার |
তুমি চেয়ে নির্নিমেষ ; হৃদয় তোমার
কোন্ দূর কালক্ষেত্রে চলে গেছে একা
আপনার ধূলিলিপ্ত পদচিহ্নরেখা
পদে পদে চিনে চিনে | দেখিতে দেখিতে
চারি দিক হতে সব এল চারি ভিতে
জগতের পূর্ব পরিচয় ;  কৌতূহলে
সমস্ত সংসার ওই এল দলে দলে
সম্মুখে তোমার ; থেমে গেল কাছে এসে
চমকিয়া | বিস্ময়ে রহিল অনিমেষে |

অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসন,
নবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবন----
পূর্ণস্ফুট পুষ্প যথা শ্যামপত্রপুটে
শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে
এক বৃন্তে | বিস্মৃতিসাগরনীলনীরে
প্রথম ঊষার মতো উঠিয়াছ ধীরে |
তুমি বিশ্ব-পানে চেয়ে মানিছ বিস্ময়,
বিশ্ব তোমা-পানে চেয়ে কথা নাহি কয় ;
দোঁহে মুখোমুখি | অপাররহস্যতীরে
চিরপরিচয়-মাঝে নব পরিচয় |


শান্তিনিকেতন
১১ / ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
গোধূলি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অন্ধকার তরুশাখা দিয়ে
.      সন্ধ্যার বাতাস বহে যায় |
আয়, নিদ্রা, আয় ঘনাইয়ে
.      শ্রান্ত এই আঁখির পাতায় |
কিছু আর নাহি যায় দেখা,
কেহ নাই, আমি শুধু একা----
মিশে যাক জীবনের রেখা |
.      বিস্মৃতির পশ্চিমসীমায় |
নিষ্ফল দিবস অবসান-----
কোথা আশা, কোথা গীতগান !
শুয়ে আছে সঙ্গীহীন প্রাণ
.      জীবনের তটবালুকায় |
দূরে শুধু ধ্বনিছে সতত
অবিশ্রাম মর্মরের মতো,
হৃদয়ের হত আশা যত
.       অন্ধকারে কাঁদিয়া বেড়ায় |
আয় শান্তি, আয় রে নির্বাণ,
.       আয় নিদ্রা, শ্রান্ত প্রাণে আয় |
মূর্ছাহত হৃদয়ের ‘পরে
.        চিরাগত প্রেয়সীর প্রায়
.               আয়, নিদ্রা আয় !


সোলাপুর
১ ভাদ্র ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
উচ্ছৃঙ্খল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

.         এ মুখের পানে চাহিয়া রয়েছ
.               কেন গো অমন করে ?
তুমি     চিনিতে নারিবে, বুঝিতে নারিবে মোরে |
আমি    কেঁদেছি হেসেছি, ভালো যে বেসেছি,
.               এসেছি যেতেছি সরে
.               কী জানি কিসের ঘোরে |

.          কোথা হতে এত বেদনা বহিয়া
.                এসেছে পরান মম |
.          বিধাতার এক অর্থবিহীন
.                প্রলাপবচন-সম
.          প্রতিদিন যারা আছে সুখে দুখে
.               আমি তাহাদের নই---
আমি    এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষ বই |
আমি    আমারে চিনি নে,  তোমারে জানি নে,
.               আমার আলয় কই !

.          জগৎ বেড়িয়া নিয়মের পাশ,
.               অনিয়ম শুধু আমি |
.          বাসা বেঁধে আছে কাছে কাছে সবে,
.          কত কাজ করে কত কলরবে,
.          চিরকাল ধরে দিবস চলিছে
.               দিবসের অনুগামী----
শুধু      আমি নিজবেগ সামালিতে নারি
.               ছুটেছি দিবসযামী |

.           প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ,
.               প্রতিদিন ফুটে ফুল |
.           ঝড় শুধু আসে ক্ষণেকের তরে
.               সৃজনের এক ভুল---
.           দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা
.               ফুকারিয়া উভরায়
.           আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায় |

.           এ আবেগ নিয়ে কার কাছে যাব,
.                নিতে কে পারিবে মোরে !
.           কে আমারে পারে আঁকড়ি রাখিতে
.                দুখানি বাহুর ডোরে !

আমি          কেবল কাতর গীত !
.            কেহ বা শুনিয়া ঘুমায় নিশীথে,
.                 কেহ জাগে চমকিত |
.            কত-সে বেদনা সে কেহ বোঝে না,
.                 কত-যে আকুল আশা,
.            কত যে তীব্র পিপাসাকাতর ভাষা |

ওগো,           তোমরা জগৎবাসী,
.             তোমাদের আছে বরষ বরষ
.                 দরশ-পরশ-রাশি---
.              আমার কেবল একটি নিমেষ,
.                  তারি তরে ধেয়ে আসি |

.              মহাসুন্দর একটি নিমেষ
.                  ফুটেছে কাননশেষে,
আমি        তারি পানে ধাই, ছিঁড়ে নিতে চাই,
.              ব্যাকুলবাসনাসংগীত গাই
.              অসীমকালের আঁধার হইতে
.                   বাহির হইয়া এসে |

শুধু           একটি মুখের এক নিমেষের
.                    একটি মধুর কথা,
.               তারি তরে বহি চিরদিবসের
.                    চিরমনোব্যাকুলতা |
.               কালের কাননে নিমেষ লুটিয়া
.                    কে জানে চলেছি কোথা !
ওগো,         মিটে না তাহাতে মিটে না প্রাণের ব্যথা |

.                     অধিক সময় নাই |
.                ঝড়ের জীবন ছুটে চলে যায়
.                     শুধু কেঁদে ‘চাই চাই’ ---
.                যার কাছে আসি তার কাছে শুধু
.                     হাহাকার রেখে যাই |
.                ওগো, তবে থাক্ , যে যায় সে যাক---
.                      তোমরা দিয়ো না ধরা !
.                      আমি চলে যাব ত্বরা !
মোরে          কেহ কারো ভয়, কেহ কোরো ঘৃণা,
.                       ক্ষমা কোরো যদি পারো !
.                 বিস্মিত চোখে ক্ষণেক চাহিয়া
.                       তার পরে পথ ছাড়ো !

.                 তার পরদিনে উঠিবে প্রভাত,
.                        ফুটিবে কুসুম কত,
.                 নিয়মে চলিবে নিখিল জগৎ
.                         প্রতিদিবসের মতো |
.                 কোথাকার এই শৃঙ্খল-ছেঁড়া
.                         সৃষ্টি-ছাড়া এ ব্যথা
.                 কাঁদিয়া কাঁদিয়া, গাহিয়া গাহিয়া,
.                 অজানা আঁধার-সাগর বাহিয়া,
.                         মিশায়ে যাইবে কোথা !
.                 এক রজনীর প্রহরের মাঝে
.                         ফুরাবে সকল কথা |


সোলাপুর
৫ ভাদ্র ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আগন্তুক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওগো সুখী প্রাণ, তোমাদের এই
.       ভব-উত্সব-ঘরে
অচেনা অজানা পাগল অতিথি
.       এসেছিল ক্ষণতরে |
ক্ষণেকের তরে বিস্ময় ভরে
.       চেয়েছিল চারি দিকে
বেদনা-বাসনা-ব্যাকুলতা-ভরা
.       তৃষাতুর অনিমিখে |
উত্সববেশ ছিল না তাহার,
.       কন্ঠে ছিল না মালা,
কেশপাশ দিয়ে বাহিরিতেছিল
.       দীপ্ত অনলজ্বালা |
তোমাদের হাসি তোমাদের গান
.       থেমে গেল তারে দেখে---
শুধালে না কেহ পরিচয় তার,
.       বসালে না কেহ ডেকে |
কী বলিতে গিয়ে বলিল না আর,
.       দাঁড়ায়ে রহিল দ্বারে ----
দীপালোক হতে বাহিরিয়া গেল
.       বাহির-অন্ধকারে |
তার পরে কেহ জান কি তোমরা
.       কী হইল তার শেষে ?
কোন্ দেশ হতে এসে চলে গেল
.       কোন্ গৃহহীন দেশে ?


সোলাপুর
৫ ভাদ্র ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিদায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অকূল সাগর-মাঝে চলেছে ভাসিয়া
জীবনতরী | ধীরে লাগিছে আসিয়া
তোমার বাতাস, বহি আনি কোন্ দূর
পরিচিত তীর হতে কত সুমধুর
পুষ্পগন্ধ, কত সুখস্মৃতি, কত ব্যথা,
আশাহীন কত সাধ, ভাষাহীন কথা |
সম্মুখেতে তোমারি নয়ন জেগে আছে
আসন্ন আঁধার-মাঝে অস্তাচল-কাছে
স্থির ধ্রুবতারাসম ; সেই অনিমেষ
আকর্ষণে চলেছি কোথায়, কোন দেশ
কোন্ নিরুদ্দেশ-মাঝে ! এমনি করিয়া
চিহ্নহীন পথহীন অকূল ধরিয়া
দূর হতে দূরে ভেসে যাব----- অবশেষে
দাঁড়াইব দিবসের সর্বপ্রান্তদেশে
এক মুহূর্তের তরে---- সারাদিন ভেসে
মেঘখন্ড যথা রজনীর তীরে এসে
দাঁড়ায় থমকি | ওগো, বারেক তখন
জীবনের খেলা রেখে করুণ নয়ন
পাঠায়ো পশ্চিম-পানে, দাঁড়ায়ো একাকী
ওই দূর তীরদেশে অনিমেষ-আঁখি |
মুহূর্তে আঁধার নামি দিবে সব ঢাকি
বিদায়ের পথ ; তোমার অজ্ঞাত দেশে
আমি চলে যাব ; তুমি ফিরে যেয়ো হেসে
সংসারের খেলাঘরে, তোমার নবীন
দিবালোকে | অবশেষে যবে একদিন----
বহুদিন পরে----- তোমার জগৎ-মাঝে
সন্ধ্যা দেখা দিবে, দীর্ঘ জীবনের কাজে
প্রমোদের কোলাহলে শ্রান্ত হবে প্রাণ,
মিলায়ে আসিবে ধীরে স্বপন-সমান
চিররৌদ্রদগ্ধ এই কঠিন সংসার,
সেইদিন এইখানে আসিয়ে আবার !
এই তটপ্রান্তে বসে শ্রান্ত দু’নয়ানে
চেয়ে দেখো ওই অস্ত-অচলের পানে
সন্ধ্যার তিমিরে, যেথা সাগরের কোলে
আকাশ মিশিয়া গেছে | দেখিবে তা হলে
আমার সে বিদায়ের শেষ চেয়ে-দেখা
এইখানে রেখে গেছে জ্যোতির্ময় রেখা |
সে অমর অশ্রুবিন্দু সন্ধ্যাতারকার
বিষণ্ণ আকার ধরি উদিবে তোমার
নিদ্রাতুর আঁখি-পরে ; সারা রাত্রি ধরে
তোমার সে জনহীন বিশ্রামশিয়রে
একাকী জাগিয়া রবে | হয়তো স্বপনে
ধীরে ধীরে এনে দেবে তোমার স্মরণে
জীবনের প্রভাতের দু-একটি কথা |
এক ধারে সাগরের চিরচঞ্চলতা
তুলিবে অস্ফুট ধ্বনি, রহস্য অপার,
অন্য ধারে ঘুমাইবে সমস্ত সংসার |

কোল্ ভিল টেরেস | লন্ডন
আশ্বিন ১৮৯০ | রাত্রি

.         ***************************     

.                                                                    
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
সন্ধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওগো তুমি, অমনি সন্ধ্যার মতো হও |
সুদূর পশ্চিমাচলে                    কনক-আকাশতলে
অমনি নিস্তব্ধ চেয়ে রও |
অমনি সুন্দর শান্ত                    অমনি করুণকান্ত
অমনি নীরব উদাসিনী,
ওইমতো ধীরে ধীরে                আমার জীবনতীরে
বারেক দাঁড়াও একাকিনী |
জগতের পরপারে                নিয়ে যাও আপনারে
দিবসনিশার প্রান্তদেশে |
থাক্ হাস্য-উত্সব,                      না আসুক কলরব
সংসারের জনহীন শেষে |
এসো তুমি চুপে চুপে                শ্রান্তিরূপে নিদ্রারূপে,
এসো তুমি নয়ন-আনত |
এসো তুমি ম্লান হেসে                  দিবাদগ্ধ আয়ুশেষে
মরণের আশ্বাসের মতো |
আমি শুধু চেয়ে                        অশ্রুহীন-শ্রান্ত-আঁখি,
পড়ে থাকি পৃথিবীর ‘পরে -----
খুলে দাও কেশভার,                      ঘনস্নিগ্ধ অন্ধকার
মোরে ঢেকে দিক স্তরে স্তরে |
রাখো এ কপালে মম                    নিদ্রার আবেশ-সম
হিমস্নিগ্ধ করতলখানি |
বাক্যহীন স্নেহভরে                     অবশ দেহের ‘পরে
অঞ্চলের প্রান্ত দাও টানি  |
তার পরে পলে পলে                     করুণার অশ্রুজলে
ভরে যাক নয়নপল্লব |
সেই স্তব্ধ আকুলতা                       গভীর বিদায়ব্যথা
কায়মনে করি অনুভব |



রেড সী
৭ কার্তিক ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                                       
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com