*
মানসী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র—রচনাবলী
প্রথম খন্ড
( ১২৫ তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী  উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক )
প্রকাশক বিশ্বভারতী
শেষ উপহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি রাত্রি, তুমি ফুল | যতক্ষণ ছিলে কুঁড়ি
জাগিয়া চাহিয়া ছিনু আঁধার আকাশ জুড়ি
সমস্ত নক্ষত্র নিয়ে, তোমারে লুকায়ে বুকে |
যখন ফুটিলে তুমি সুন্দর-তরুণ-মুখে,
তখনি প্রভাত এল, ফুরালো আমার কাল ;
আলোক ভাঙিয়া গেল রজনীর অন্তরাল |
এখন বিশ্বের তুমি ; গুন্ গুন্ মধুকর
চারি দিকে তুলিয়াছে বিস্ময়ব্যাকুল স্বর ;
গাহে পাখি, বহে বায়ু ; প্রমোদহিল্লোলধারা
নবস্ফুট জীবনের করিতেছে দিশাহারা |
এত আলো, এত সুখ, এত গান, এত প্রাণ
ছিল না আমার কাছে----আমি করেছিনু দান
শুধু নিদ্রা, শুধু শান্তি, সযতন নীরবতা ,
শুধু চেয়ে-থাকা আঁখি, শুধু মনে মনে কথা |

আর কি দিই নি কিছু ? প্রলুব্ধ প্রভাত যবে
চাহিল তোমার পানে, শত পাখি শত রবে
ডাকিল তোমার নাম, তখন পড়িল ঝ’রে
আমার নয়ন হতে তোমার নয়ন-‘পরে
একটি শিশিরকণা | চলে গেনু পরপার |
সেই বিষাদের বিন্দু, বিদায়ের উপহার,
প্রখর প্রমোদ হতে রাখিবে শীতল ক’রে
তোমার তরুণ মুখ ; রজনীর অশ্রু—‘পরে
পড়ি প্রভাতের হাসি দিবে শোভা অনুপম
বিকচ সৌন্দর্য তব করিবে সুন্দরতম |


রেড সী
৯ কার্তিক ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                   
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মৌন ভাষা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

থাক্ থাক্, কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা |
চেয়ে দেখি, চলে যাই,    মনে মনে গান গাই,
মনে মনে রচি বসে কত সুখ কত ব্যথা |
বিরহী পাখির প্রায়     অজানা কানন ছায়
উড়িয়া বেড়াক সদা হৃদয়ের কাতরতা---
তারে বাঁধিয়ো না ধরে, বলিয়ো না কোনো কথা |

আঁখি দিয়ে যাহা বলো সহসা আসিয়া কাছে
সেই ভালো, থাক্ তাই,   তার বেশি কাজ নাই---
কথা দিয়ে বলো যদি মোহ ভেঙে যায় পাছে |
এত মৃদু এত আধো     অশ্রুজলে-বাধো-বাধো
শরমে-সভয়ে-ম্লান এমন কি ভাষা আছে ?
কথায় বোলো না তাহা আঁখি যাহা বলিয়াছে |

তুমি হয়তো বা পারো আপনারে বুঝাইতে ----
মনের সকল ভাষা     প্রাণের সকল আশা
পারো তুমি গেঁথে গেঁথে রচিতে মধুর গীতে |
আমি তো জানি নে মোরে,   দেখি নাই ভালো করে
মনের সকল কথা পশিয়া আপন চিতে---
কী বুঝিতে কী বুঝেছি, কী বলিব কী বলিতে |

তবে থাক্ | ওই শোনো, অন্ধকারে শোনা যায়
জলের কল্লোলস্বর      পল্লবের মরমর---
বাতাসের দীর্ঘশ্বাস শুনিয়া শিহরে কায় |
আরো ঊর্দ্ধে দেখো চেয়ে     অনন্ত আকাশ ছেয়ে
কোটি কোটি মৌন দৃষ্টি তারকায় তারকায় |
প্রাণপণ দীর্ঘ ভাষা জ্বলিয়া ফুটিতে চায় |

এসো চুপ করে শুনি এই বাণী স্তব্ধতায়----
এই অরণ্যের তলে    কানাকানি জলে স্থলে,
মনে করি হল বলা ছিল যাহা বলিবার |
হয়তো তোমার ভাবে   তুমি এক বুঝে যাবে,
আমার মনের মতো আমি বুঝে যাব আর ---
নিশীথের কন্ঠ দিয়ে কথা হবে দুজনার |

মনে করি দুটি তারা জগতের এক ধারে
পাশাপাশি কাছাকাছি  তৃষাতুর চেয়ে আছি,
চিনিতেছি চিরযুগ, চিনি নাকো কেহ কারে |
দিবসের কোলাহলে    প্রতিদিন যাই চলে,
ফিরে আসি রজনীর ভাষাহীন অন্ধকারে----
বুঝিবার নহে যাহা চাই তাহা বুঝিবারে |

তোমার সাহস আছে, আমার সাহস নাই |
এই-যে শঙ্কিত আলো   অন্ধকারে জ্বলে ভালো,
কে বলিতে পারে বলো যাহা চাও এ কি তাই |
তবে ইহা থাক্ দূরে   কল্পনার স্বপ্নপুরে,
যার যাহা মনে লয় তাই মনে করে যাই----
এই চির-আবরণ খুলে ফেলে কাজ নাই |

এসো তবে বসি হেথা, বলিয়ো না কোনো কথা |
নিশীথের অন্ধকারে   ঘিরে দিক দুজনারে,
আমাদের দুজনের জীবনের নীরবতা |
দুজনের কোলে বুকে    আঁধারে বাড়ুক সুখে
দুজনের এক শিশু জনমের মনোব্যথা |
তবে আর কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা |


রেড সী
১০ কার্তিক ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                   
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
আমার সুখ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালোবাসা-ঘেরা ঘরে             কোমল শয়নে তুমি
যে সুখেই থাকে,
যে মাধুরী এ জীবনে             আমি পাইয়াছি তাহা
তুমি পেলে নাকো |
এই-যে অলস বেলা,               অলস মেঘের মেলা ,
জলেতে আলোতে খেলা সারা দিনমান,
এরই মাঝে চারিপাশে        কোথা হতে ভেসে আসে
ওই মুখ, ওই হাসি, ওই দু’নয়ান |
সদা শুনি কাছে দূরে                 মধুর কোমল সুরে
তুমি মোরে ডাকো-----
তাই ভাবি এ জীবনে              আমি যাহা পাইয়াছি
তুমি পেলে নাকো |

কোনোদিন একদিন                  আপনার মনে, শুধু
এক সন্ধ্যাবেলা,
আমারে এমনি করে              ভাবিতে পারিতে যদি
বসিয়া একেলা -----
এমনি সুদূর বাঁশি                    শ্রবণে পশিত আসি,
বিষাদকোমল হাসি ভাসিত অধরে,
নয়নে জলের রেখা                 এক বিন্দু দিত দেখা,
তারি ‘পরে সন্ধ্যালোকে কাঁপিত কাতরে ---
ভেসে যেত মনখানি                      কনকতরণীসম
গৃহহীন স্রোতে----
শুধু একদিন-তরে                      আমি ধন্য হইতাম
তুমি ধন্য হতে |

তুমি কি করেছ মনে                দেখেছ, পেয়েছ তুমি
সীমারেখা মম ?
ফেলিয়া দিয়াছ মোরে              আদি অন্ত শেষ করে
পড়া পুঁথি – সম ?
নাই সীমা আগে পাছে,               যত চাও তত আছে,
যতই আসিবে কাছে তত পাবে মোরে |
আমারেও দিয়ে তুমি                   এ বিপুল বিশ্বভূমি
এ আকাশে এ বাতাস দিতে পারো ভরে |
আমাতেও স্থান পেত                  অবাধে সমস্ত তব
জীবনের আশা |
একবার ভেবে দেখো                 এ পরানে ধরিয়াছে
কত ভালোবাসা |

সহসা কী শুভক্ষণে                      অসীম হৃদয়রাশি
দৈবে পড়ে চোখে |
দেখিতে পাও নি যদি,            দেখিতে পাবে না আর,
মিছে মরি বকে !
আমি যা পেয়েছি তাই            সাথে নিয়ে ভেসে যাই,
কোনোখানে সীমা নাই ও মধু মুখের ---
শুধু স্বপ্ন, শুধু স্মৃতি,                তাই নিয়ে থাকি নিতি,
আর আশা নাহি রাখি সুখের দুখের |
আমি যাহা দেখিয়াছি ,              আমি যাহা পাইয়াছি
এ জনম-সই,
জীবনের সব শূন্য                   আমি যাহে ভরিয়াছি
তোমার তা কই !


রেড সী
১১ কার্তিক ১৮৯০

.         ***************************     

.                                                                   
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
ছবি সৌজন্যে-
http://rabindranathtagore-150.gov.
in/gallery-2.html
মানসী কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচনাকালের
মধ্যেই, ১৮৮৭ সালে তোলা, কবির এই
ছবিটি এই পাতার সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
উপস্থাপন করা হয়েছে।   
মানসী
www.milansagar.com