কাশীরাম দাসের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।  ভীষ্মের শরশয্যা         
২।  বিপ্রবেশে অর্জ্জুন          
৩।  শিবের সমুদ্রমন্থনে যাত্রা      
৪।   দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠির সংবাদ          


   
*
ভীষ্মের শরশয্যা

অর্জ্জুনের বাণ সব অগ্নিসম ছুটে |
ভীষ্মের শরীরে যেন বজ্রসম ফুটে ||
গঙ্গার নন্দন বিচারেন মনে মন |
এই অস্ত্র শিখণ্ডীর না হয় কখন ||
শিখণ্ডী পশ্চাতে থাকি পার্থ ধনুর্দ্ধর |
আমারে মারিছে বীর তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ শর ||
এত চিন্তি হরি পদে হৃদে ধ্যান করি |
উচ্চারণ করিলেন শ্রীহরি শ্রীহরি ||
বাণাঘাতে শরীর কম্পিত ঘনে ঘন |
শিশির কালে যেন কাঁপিয়ে গোধন ||
ধনঞ্জয় আপনার অস্ত্র বরিষণে |
রোমে রোমে বিন্ধিলেন গঙ্গার নন্দনে ||
সর্ব্বাঙ্গ ভেদিল অস্ত্রে স্থান নাহি আর |
সর্ব্বাঙ্গ বহিয়া পড়ে শোণিতের ধার ||
তবে পার্থ দিব্য অস্ত্র নিলেন তখন
|
পিতামহ বক্ষস্থলে করেন ঘাতন
||
বাণাঘাতে মহাবীর হয় হীনবল
|
রথের উপর হতে পড়ে ভূমিতল
||
শিয়র করিয়া পূর্ব্বে পড়িল সে বীর
|
আকাশ হইতে যেন খসিল মিহির
||
ভূমি নাহি স্পর্শে অঙ্গ শরের উপর
|
হেনমতে শরশয্যা নিল বীরবর
||
দেখিয়া কৌরবগণ করে হাহাকার
|
সংগ্রাম ত্যাজিয়া সবে আসে দেখিবার
||

           ********
উপরে
*
বিপ্রবেশে অর্জ্জুন

হাসিয়া ক্ষত্রিয় যত করে উপহাস
|
অসম্ভব কার্যে দেখি দ্বিজের প্রয়াস
||
সভা-মধ্যে ব্রাহ্মণের মুখে নাহি লাজ |
যাহে পরাজয় হৈল রাজার সমাজ ||
সুরাসুর জয়ী সেই বিপুল ধনুক |
তাহে লক্ষ্য বিন্ধিবারে চলিল ভিক্ষুক ||
কন্যা দেখি দ্বিজ কিবা হইল অজ্ঞান |
বাতুল হইল কিবা করি অনুমান ||
নির্লজ্জ ব্রাহ্মণে মোরা অল্পে না ছাড়িব |
উচিত যে শাস্তি হয় অবশ্য তা দিব ||
কেউ বলে ব্রাহ্মণেরে না বল এমন |
সামান্য মনুষ্য বুঝি না হবে এ জন ||
দেখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি |
পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি ||
অনুপম তনু শ্যাম নিলোত্পল আভা |
মুখরুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা ||
সিংহগ্রীব বন্ধুজীব অধর রাতুল |
খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতূল ||
দেখ চারু যুগ্ম ভুরু ললাট প্রসর |
কি সানন্দ গতি মন্দ মত্ত কবিবর ||
ভুজযুগ নিন্দে নাগে আজানুলম্বিত |
করিকর-যুগ্ম বর জানু সুবলিত ||
মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত |
অগ্নি-অংশু যেন পাংশু-জালে আচ্ছাদিত ||
লয় মনে এই জনে বিন্ধিবেক লক্ষ্য |
কাশী ভনে হেন জনে কি কর্ম অশক্য ||


         ********
উপরে
*
শিবের সমুদ্রমন্থনে যাত্রা

পার্বতীর কটুভাষ             শুনি ক্রোধে দিগ্ বাস
টানিয়া আনিল বাঘবাস
|
বাসুকি নাগের দড়ি           বাঁধিল কাঁকালি বেড়ি
তুলিয়া লৈল যুগপাশ
||
কপালে কলঙ্কি-কলা           কণ্ঠেতে হাড়ের মালা
করযুগে কঞ্চুকি-কঙ্কণ |
ভানু বৃহদ্ভানু শশী              ত্রিবিধ প্রকার ভূষি
ক্রোধে যেন প্রলয়-দহন ||
যেন গিরি হেমকূটে             আকাশে লহরী উঠে
উথে মধ্যে গঙ্গা জটাজূটে |
রজত-পর্বত-আভা           কোটি চন্দ্র-মুখ-শোভা
ফণি-মণি বিরাজে মুকুটে ||
গলে দিল হার সাপ             টঙ্কারি ফেলিল চাপ
ত্রিশূল ভ্রূকুটি লইয়া করে |
পদভরে ক্ষিতি টলে            হুংকার ছাড়িয়া চলে
অতিশয় বেগে ভয়ঙ্করে ||
ডম্বরুর ডিমি ডিমি             আকাশ পাতাল ভূমি
কম্প হইল ত্রৈলোক্য-মণ্ডলে |
অমর-ঈশ্বর ভীত                আর সবে সচিন্তিত
এ কোন্ প্রলয় হৈল বলে ||
বৃষভ সাজায়ে বেগে           নন্দী আনি দিল আগে
নানা রত্ন করিয়া ভূষণ |
ক্রোধে কাঁপে ভূতনাথ             যেন কদলীর পাত
অতি শীঘ্র কৈল আরোহণ ||
আগু-দলে সেনাতি                ময়ূর-বাহনে গতি
শক্তি করে ধরি ষড়ানন |
গণেষ চড়িয়া মূষ              করে ধরি পাশাঙ্কুশ
দক্ষিণ ভাগেতে ক্রোধ-মন ||
বামে নন্দী মহাকাল              করে শূল গলে মাল
পাছে জরাসুর ষট্ পদে |
চলিলা দেবের রাজ            দেখিয়া শিবের কাজ
তিন লোকে গণিল প্রমাদে ||
ক্ষণেকে ক্ষীরোদ-কূলে            উত্তরিলা সহ দলে
যথায় মথনে সুরাসুর |
কাশীরাম দাস কয়                শীঘ্রগতি প্রণময়
সর্ব দেবে দেখিয়া ঠাকুর ||


********
উপরে
*
দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠির সংবাদ

দ্বৈতবনমধ্যে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন
|
ফলমূলাহার জটাবাকল ভূষণ
||
একদিন বসি কৃষ্ণা যুধিষ্ঠির পাশে |
কহিতে লাগিলা দুঃখ সকরুণ ভাষে ||
এ হেন নির্দয় দুরাচার দুর্যোধন |
কপট করিয়া তোমা পাঠাইল বন ||
কিছু মাত্র তব দোষ নাহি তার স্থানে |
এ হেন দারুণ কর্ম করিল কেমনে?
তোমার এ গতি কেন হৈল নরপতি |
সহনে না যায় মম সন্তাপিত মতি ||
কুসুম-শয্যায় শুয়ে নিদ্রা না আইসে |
এখন শয়ন তব তীক্ষ্ণধার কুশে ||
কস্তূরী চন্দনে সদা লিপ্ক কলেবর |
এখন হতেছে হায় ধূলায় ধূসর ||
মহারাজগণ তব বসিত চৌপাশে |
সেই তুমি রহ এবে তপস্বীর বেশে ||
এই তব ভাতৃগণ ইন্দ্রের সমান |
এ সবার প্রতি নাহি কর অবধান ||
মলিনবদন ক্লিষ্ট দুঃখেতে দুর্বল |
হেঁটমুখে সদা চিন্তে ভীম মহাবল ||
ইহা দেখি রাজা তব নাহি জন্মে দুখ |
সহিতে না পারি মম ফাটিতেছে বুক ||
ভীমসম পরাক্রম নাহি ত্রিভূবনে |
ক্ষণমাত্রে সংহারিতে পারে কুরুগণে ||
সকল ত্যজিল রাজা তোমার কারণ |
কেমনে এ সব দুঃখ দেখহ রাজন্ ||
এই যে অর্জ্জুন কার্তবীর্যের সমান |
যাহার প্রতাপে সুরাসুর কম্পমান ||
পৃথিবীতে বৈসে যত রাজরাজেশ্বর |
রাজসূয়ে খাটাইল করিয়া কিঙ্কর ||
দুঃখচিন্তা করে সদা মলিন বদনে |
ইহা দেখি রাজা তব তাপ নাহি মনে ||
সুকুমার মাদ্রীসুত দুঃখে অধোমুখ |
ইহা দেখি রাজা তব নাহি জন্মে দুখ ||
ধৃষ্টদ্যুম্নস্বসা আমি দ্রুপদনন্দিনী |
তুমি হেন মহারাজা আমি তব রাণী ||
মম দুঃখ দেখি তব তাপ নাহি হয় |
ক্রোধ নাহি তব মনে জানিনু নিশ্চয় ||
ক্ষত্র হয়ে ক্রোধহীন নাহি হেন জন |
তোমাতে না রয় রাজা ক্ষত্রিয়লক্ষণ ||
দ্রৌপদীর বাক্য শুনি ধর্মনরপতি |
উত্তর করিল তার যথাধর্মনীতি ||
ক্রোধসম পাপ দেবী না আছে সংসারে |
প্রত্যক্ষ শুন ক্রোধ কত পাপ ধরে ||
লঘু গুরু জ্ঞান নাহি থাকে ক্রোধকালে |
অবক্তব্য কথা লোক ক্রোধ হৈলে বলে ||
থাকুক অন্যের কার্য আত্ম হয় বৈরী |
বিষ খায়, ডুবে মরে, অস্ত্র অঙ্গে মারি ||
এ কারণে বধুগণ সদা ক্রোধ ত্যজে |
অক্রোধ যে লোক তারে সর্বলোক পূজে ||
ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ, ক্রোধে কুলক্ষয় |
ক্রোধে সর্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয় ||
হেন ক্রোধে যেই জন জিনিবারে পারে |
ইহলোকে পরলোক অবহেলে তরে ||
দেখাইবে সময়েতে তেজ সমুচিত |
ক্রোধ মহাপাপ না করিবে কদাচিত্ ||
এ কারণে দ্রৌপদী ত্যজহ ক্রোধন |
অশ্বমেধফল ভুঞ্জে অক্রোধ যে জন ||


       ********
মিলনসাগর
উপরে