অন্যান্য কবিদের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কবিতা (সংগ্রহ)
*
হায় বাঙ্গালী  
কমল চক্রবর্তী

বিশাল কাঁচের বাক্সে, কতদিন সাঁতরে সাঁতরে
মৃত্যু-পিরানহা টু গোল্ডফিস !
প্রেম থেকে নিস্প্রেমে !
খেলা জমিয়ে দিচ্ছে, বন্দুক, রাইফেলবাজ, কাল্টু
                দেড় হাত ঝল্লা কানপুরী !
দুটো ফাইল ঘাঁটলেই একটা আকবরী-কয়েন !
      হেড, দাউ দাউ চিতা
      টেল, ফুরফুরে কবর !

হায় !
একটা বাঙ্গালী, একটা নৈরাজ্য !
একটা বাঙ্গালী, একটা হতাশা !
একটা বাঙ্গালী, নাক কেটে যাত্রা পথ লাল !
একটা বাঙ্গালী, আংটি, জ্যোতিষী, তাবিজ !
একটা বাঙ্গালী, হুড়কো লোহার-ফাটক !!!

একদিকে মাঠ-যা-হাওয়া, নীল-ফাঁসি-নারী
   মলিন দু হাত ভরা কুটকুটি-ভাঙা-পিস্তল
অন্য দিকে রক্তমাখা ঠ্যাং, থুতু নদের নিমাই জং
ঠাকুরমার ঝুলি, হালকা গা ছমছম ভূত !
সব রক্ত মানুষের নয় ! কিছু ধর্ষণের রেখা এঁকেবেঁকে
                         ভাটিয়ালি নাও !
বাঙ্গালীর স্থাপত্য, আহা, টেরাকোটা-প্রেত !
বাঙ্গালীর একটা মাত্র ঠোঙা, ভিতরে বাদাম ভাজা
                         বাইরে রাজা, ইঁটের পাঁজরে !



.              **************                 
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                     সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
ধ্বংসগোধুলি : ১৪ মার্চ ২০০৭
অমিতাভ গুপ্ত

কয়েকজন নিহত এবং কয়েকজন হন্তারকের মাঝখানে থমকে
দাঁড়িয়ে রইল আজ এই সূর্যাস্তের অভিশাপ

যেসব শিশুদের ঠোঁটে আর কোনো দিন জ্বলে উঠবে না ঊষার আভা
যেসব মেয়েরা আর কোনোদিন হেসে উঠবে না রৌদ্রের মতন

তাদের আর্ত ও আতঙ্কপাণ্ডুর একটি দিন থেকে স্খলিত
অন্ধকারের চরম নেমে আসছে মানুষের দিগন্তে

মাটির উদ্বেগ ছুঁয়ে আকাশের জন্মদাগ যেভাবে নির্বাক স্তম্ভিত
হয়ে ওঠে সেভাবেই সূর্যাস্ত থমকে দাঁড়িয়ে

রয়েছে | রাত্রির পরে হয়তো কখনো আর সকাল হবে না
এবার মৃত্যুর পরে আর কোনো বেঁচে-ওঠা নেই



.                **************                           
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                                সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি 'পর্বান্তর' পত্রিকার মে - আগস্ট ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
দৃষ্টিরেখা
সুদীপ বসু

তুমি ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে এসেছিলে জঙ্গলে
তুমি ক্যামেরা রেখে এসেছিলে অনেক দিন আগেই---

সে কিছু বলে নি,
সে,
রেকর্ড করেছে রক্ত,
                  চোখফাটা জল

যখন খালি-পা কটা লোক দিশেহারা ছুটতে শুরু করল
যখন পাঁচজনের চোখের সামনে ফুটো হয়ে গেল আরো পাঁচজন
লুটিয়ে পড়ল কেউ হেমন্তের রক্তের ভেতর ---

থমকে গেল সময়
হাতের হেমসেলাই পড়ে রইল তার

ক্যামেরা জিজ্ঞেস করল
"টকটকে"-এর আগে ঠিক কী বসাব?"
লাল ?

সেদিন
টুঁশব্ দ  করিনি
চিত্কার করে সব চৌচির করিনি
তাই
কাঁটা হয়ে আছি ---


.           **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                          সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি 'সিঙ্গুর থেকে কলিঙ্গনগর' পত্রিকার মে ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
ওদের থাকতে দিন
দীপা বিশ্বাস

ওরা ওদের জমি ছাড়তে চায় না |

ওদের থাকতে দিন নিজস্ব জমিতে
চাষ করতে দিন ওরা যেমন চায়
সবুজে সবুজ জমি কেড়ে নেবেন না

ওরা ওদের জমি ছাড়তে চায় না

ওদের জায়গায় একবার নিজেকে দাঁড় করান




.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
মাটি, তোর জন্য
ঋত্বিক ঠাকুর

মাটি, তুই ঘুমো,
এই দ্যাখ, আমিও ঘুমোচ্ছি
আমার খিদের সঙ্গে |
ফসলের গল্প আপাতত তোলা থাক
রূপকথা স্মৃতির ছড়ায় |
এই ক্ষেত্রে সারের কারখানা হবে, সরকার বলছে |
তোর সাস্থ্য ফিরবে, বিদেশী আয়নায় মুখ দেখবি |
বাবুদের কথা হেরফের হয় না |
তোকে নিয়েই তো স্বপ্নটপ্ন শিল্প মনিহারি |
আকাশ পেরিয়ে বেঁচে থাকবি ভবিতব্যে |
জন্ম জন্ম ধন্য ধন্য করবে তোর ছেলেপিলে |
ভেবে দেখ কত সহজে অমর হবি |
আজেবাজে কথায় না ভুলে ঘুমো, মাটি, ঘুমো,
দুঃখ করিস না |
তোর জন্য জন্মান্তর নিয়ে ফিরবে
রক্তে জাগা নন্দীগাঁ'র অগ্নি কবিয়াল ||


.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
নবান্ন
ইরা ভঞ্জ

আমি "নবান্নের" প্রধান সমাদ্দার
রাজার কূটচক্রে লুট হয়ে গেছে ধানের ক্ষেত
ভাঙা সানকি নিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়েছি
তোদের দরোজায় মা একটু ফ্যান দিবি'
কান্না জড়ানো রুক্ষ উত্তর ছুটে আসে
"ফ্যান দেব কিরে মিনসে
চাল বাড়ন্ত আজ ঘরে ঘরে
জানিস নে তুই সোনা ধান
ডলে দিয়েছে সামন্ত সেনারা
রক্তনদী বইছে এখন বাংলার মাঠে
আমি প্রধান হেঁকে উঠি,
দয়াল লাঠি গাছ আনো,
রাজার জাল ছিঁড়ে চলো
আমরা নতুন ধান ফলাবো,
ভাতের গন্ধে ভরে উঠবে মায়ের আঙিনায়
আবারও ইতিহাস গড়ে দেওয়া "নবান্ন" |


.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
অধিবাসন একলা মে
বাসু পাল

এ কোন দেশ আমার,
আম জাম কাঁঠালের
তৃষাতুর এই নিদাঘ
হারালো কোথায় !

এ কোন দেশ আমার
ভালবাসা, প্রেম
তারাদের নিশিপালন চাঁদের পক্ষ
এখন কোথায় !

এ কোন দেশে আছি,
কলের বাঁশি
বাসি ভাত, কৃপণ সকাল
দিনরাত খাটুনির ঘাম
কোন ডাকে হারালো

এখন এখানে
ভাত নেই, বুলেট আছে
প্রেমিক নেই, ধর্ষক নাচে
লোলুপ বলির পাঁঠা |

এ কোন দেশ আমার---
ঝুমুরের মাদল বাজে না আর
ছেলের বুলেট ক্ষত বুকে
মাথা রেখে রক্তাক্ত জননী
ঘুমিয়েছে ! ভাবছো জাগবে না ?
বসন্ত বিলাপ, রণচণ্ডিনী হবে এবার |


.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
বন্ধু তোমায়
ছন্দময় রায়

তুমি বলছ জ্বলছে আলো
আমি দেখছি আগুন,
চতুর্দিকে তীব্র দহন
জনগণেশ করছে সহন
বন্ধু তোমার বন্ধ চোখে
সেই যে পলাশ ফাঁগুন,
তুমি বলছ জ্বলছে আলো
আমি দেখছি আগুন |
ভোলো তোমার গর্ভগৃহের
মগজ জ্বালা চিতা
মুখোশ আঁটা দুষ্ট রাবণ
করছে হরণ সীতা |
চিরকালই বন্ধু আমার
নিজের হাতেই মারছো
তবুও চোখে ঠুলি এঁটে
কলুর বলদ ঘুরছো |
ছাড়াও এবার বন্ধকী মন
নিজের চোখেই দেখো
মানুষ, তুমি মানুষ হয়েই
প্রতিবাদটা শেখো |



.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
তিনটি ছড়া
নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

কিষাণপ্রেমী আলিমুদ্দীন

হোক না জমি পাঁচ-ফসলী
   দাও ছেড়ে দাও কৃষক ভাই
দেশ-বিদেশের বণিকরা সব
   শিল্প বৃহৎ গড়বে তাই |

পাঁচ-ফসলী জমির মূল্য
   বাজারদর চলছে যা---
সেই টাকারও মিলবে দ্বিগুণ,
   উপরন্তু নানানটা |

রোদ-জল-ঝড় অধিক মেখে
   ধ্বস্ত তুমি কৃষক ভাই
কিষাণপ্রেমী আলিমুদ্দীন---
কৃষক তোমার কুশল চাই !!


একটি হাত

শিল্প এবং শিল্প এখন
   বাড়ছে হু হু নিত্যদিন...
বঙ্গভূমে থাকছে না আর
   একটিও হাত কর্মহীন |


শিল্পের নামে

শিল্পের নামে হবে
    হাইটেক প্রমোটিং
পাগলা বিলুটা বলে---
    নেচে নেচে ডোং ডিং


.      **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       


এই কবিতাটি ১/৬৩ এ, বিদ্যাসাগর কলোনী, কলকাতা ৭০০০৪৭ থেকে
প্রকাশিত "বুলেটিন" পত্রিকার ২৫শে বৈশাখ ১৪১৪ (২০০৭) এর সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
অক্ষরে অক্ষরে যদি ঢেকে রাখতে পারি     
অপূর্ব দত্ত

কিশোরী মেয়েটি ভয়ে বাথরুমে ঢুকে
কাঁপা হাতে কোনোক্রমে নড়বড়ে ছিটকিনি এঁটেছে |
বাতাসে বাউদ গন্ধ, কানে আসছে গুরুম গুরুম
মেয়েটি গুলির শব্ দ  চেনে, হাত দুটো আড়াআড়ি বুকে রাখে
উঠোনে জটলা, অশ্রাব্য ভাষার কূট বৃষ্টিঝড়
টিনের ফুটোতে চোখ রেখেছে মেয়েটি, দৃষ্টি স্থির
জনা দশ-বারো ছেলে, হাতে রড, কোমরে মেশিন
বাপের নাম ধরে দেদার চিত্কার --- কোথায় গেলিরে ?
হিম্মত থাকে তো শালা, সামনে আয় | জমি আটকাবি ?

দু এক মুহুর্ত --- অসাবধানে মেয়েটির হাত লেগে
হ্যালবেলে টিনের দরজা নড়ে ওঠে, ওরা দেখতে পায় |
শুরু হল লাথি-বৃষ্টি, মেয়েটি লুকোতে যায় চৌবাচ্চার পাশে
আটকাতে পারল না, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে হারাল |

এ সবই সত্যের কথা, ফাল্গুনের রোদে পোড়া শিল্পের কাহিনী ;
আমরা দেখেছি দিনভর সমস্ত চ্যানেলে, পৃথিবী দেখেছে
শিশুটিকে বুকে করে মা ছুটছে, পিঠ ফুটো করে
চলে গেল জ্বলন্ত গলন্ত সিসে --- শিল্পের নির্মিতি
শিশুটির মুণ্ডু নিয়ে শুরু হল হাতে হাতে লোফালুফি খেলা |
আমরা দেখেছি, কাগজে পড়েছি, রোজ গিলে যাচ্ছি সেই কথা
আমরা ভেঙেছি রোজ, সেই থেকে নিয়ত ভাঙছি
শিবিরে শিবিরে ভেঙে দু-খান হয়েছি
মিছিল করেছি, গালগলা তুলে ধিক্কার তুলেছি
শাসক না শাসিতের কার দোষ ভেবে ভেবে বিধ্বস্ত হয়েছি |

আমি যে পারিনি এর বেশি কিছু হিম্মত দেখাতে
তাইতো অক্ষম হাতে তুলেছি কলম, যদি পারি
অক্ষরে অক্ষরে যদি ঢেকে রাখতে পারি
মেয়েটির লজ্জা, আর সুরক্ষায় মুড়ে দিতে পারি
তত্ত্বের আড়ালে থাকা মা আর বাচ্চাকে |

শিবির বুঝি না, যদি পারি তবে অভিধান থেকে
আজই মুছে দেব "সন্ত্রাস" নামের সেই বহুরূপী শব্ দটিকে |


.               **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
সন্ত্রাস     
ধীমান চক্রবর্তী

এই তো পুষে রাখি সন্ত্রাস, সারা পৃথিবীময় |
সোনালী সকাল, রূপালী দুপুর ও
সবুজ সন্ধ্যা জুড়ে ভূত ও ভবিষ্যত |
আর কোলো গোলাপের রাতে নেমে আসে সন্ত্রাস,---
বামিয়ান, চেচনিয়া, বলিভিয়া
কিংবা খেজুরি ও নন্দীগ্রাম জুড়ে |
কে কে তবে ঘর ছাড়া তিন মাস ?
কে কে তবে মরলো গুলিতে ?
গুলির কি রং থাকে --- লালা অথবা সবুজ |

আমার তো কোনোদিন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
ছিল না | যদি থাকে
তবে সে সোনাচূড়া যাক, খেজুরি বা নন্দীগ্রাম |
যেখানে গুলির শব্ দ  থাকবে না |
থাকবে না কোনো এপিটাফ |
মানুষ একটু মানুষের মত নিজের ঘরে ঘুমাক,---
মাথার তলায়
মাঝিদের বয়ে আনা এক নৌকো নালাকাশ |
জোনাকি লাগা দু'চার টুকরো ধান
ও একটি হাঁসুলি |


.               **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
প্রসঙ্গ নন্দীগ্রাম     
সঞ্জয় ঋষি

বুকে বুকে আঘাত করে কেউ কেউ সুখী হতে চাইছে
বুকে বুকে আঘাত করে মায়ের শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে
আমরা কেউ কেউ ত্যাগ না করতে পেরে হিংস্র হয়ে উঠি
আমাদের দেবতা রাজা করে পাঠায়
শাসন তার হাতে
হে শাসন দেবতা
তোমার চরণ ছুঁয়ে আজ আশ্রয় চাইছি
ঐ গ্রাম তুমি তুলে দিতে চাইছো
একতলা, দু'তলা, তিন তলা থেকে আরও উপরে
খানে তোমার কোন আত্মীয় নেই
লোভের বশে তুমি সন্দেশ প্রিয় মাটি
মাটির মানুষদের তুমি কি দিতে চাইছো | বলো ? চাকরি !
যাদের শরীর মাটি দিয়ে গড়া
যাদের মনে কোনো পাথরের মূর্তি নেই
তাদের তুমি পাথর হতে বলছো !


.               **************                   
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                       সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
ইতিহাস পাতার দাগ     
সুভাষ রঞ্জন দাস

একটা সকাল উড়ছে, ডানা মেলে, আমিও ...
নীলে নীল আকাশ
নন্দীগ্রামের কাছে যেতেই তার ভেতরে আমি, আমাচে খুঁজি---
সোনারং ধান চিক চিক করে ল্যাপটপে ভেসে ওঠে স্মৃতি
মুঠো খুলে দেখি --- সযত্নে রয়েছে শিশির...

বেলা বাড়ে---
হঠাত বাজপতনের আগুনরেখা
ডানা থেকে খসে খসে পড়ে পালক
বারদের কটু গন্ধ চাপ চাপ রক্ত সেও লাল
লালের সমারোহ
স্রোতের ভেতর জরাসন্ধ শিশু মস্তকহীন শিশু
ছেঁড়া খোঁড়া বিভাজিকা বিপর্যস্ত কাজল গৌরী শ্রাবন্তি...
নীতি-নৈতিকতা মানবিকতা ইটভাটার চুল্লিতে পুড়ে ছাই
ছাই---মেহনতি মানুষ কৃষক কৃষক বধূ
চিমনি বেয়ে রক্ত পোড়া ধোঁয়া
ধোঁয়ায় কলঙ্কিত ইতিহাস...নিখোজ সাতাশ মৃত চৌদ্দ থর্ষিত তিন
বাক্যের বন্ধনে গড়ে না ওঠা অনেক...অনেক...আরও অ-নে-ক...থেকে যায়

খসে যাওয়া পালকের শূণ্যস্থান পূরণের অপেক্ষায় থাকি...

হয়তো সেদিন সবুজ জাফরি গলে রোদের নকশি কাঁথা
হলদি নদী কাঁসাই রূপনারায়ণ কিংবা সুবর্ণরেখার জল ছোঁবে
হয়তো সেদিন নতুন কোনো সর্বজয়ার হাতে কাঁচপোকা টিপ পরে সাজবে
মঞ্জুলা সুপ্রিয়া শাকিলা হৈমবতী সত্যবালা লক্ষ্মী
হয়তো সেদিন কাশফুলের ঢেউ ভেঙে ট্রেন দেখতে ছুটবে
নতুন কোন প্রজন্মের অপু দুর্গা
ঘরে ফিরবে হরিহর...

কিন্তু ইতিহাস, নন্দীগ্রামের ইতিহাস মেদিনীপুরের ইতিহাস
ইতিহাস পাতার রক্তাক্ত দাগ
নৃশংস ১৪ মার্চ


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
দুনিয়ার জঞ্জাল     
নৃসিংহ মুরারি দে

রবি ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি" আজও প্রাসঙ্গিক
অনুষঙ্গটা পালটে গেলেও পরম্পরা এক
চিরকালই ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো
যা খুশি তাই করে
মহত্বের উর্দি গায়ে চাপিয়ে
হত্যা করে নির্যাতন করে
১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম
সেই বিবমিষার বুদবুদ ফেটে গেল
সিঙ্গুর হরিপুর বারইপুর শিলিগুড়ি
সর্বত্রই চলছে একই বর্বরতা
মহত্বের নামটা এখানে শিল্পায়ন

দেব, কেন দেব, কেন দিতে হবে, নিবি, কেড়ে নিবি
জোর করে কেড়ে নিবি
গায়ে জোর আছে তাই বলে
মারবি কাড়বি অত্যাচার করবি
যাতনা দিয়ে হত্যা করবি
আবার রক্ত মাখা হাত পাতবি
ভোট ভিক্ষে চেয়ে আর কত কেড়ে নিবি
কেড়ে নিয়েছিস তো সব কিছু
ঐতিহ্য সম্মান আত্মপরিচয়
এমন কি বাপ ঠাকুরদার নাম গোত্র
আবার চালাকি করে বলিস --- ভুল হয়েছিল
ভুলের পাহাড় তো মুখ ঢেকে দিয়েছে
তাই লজ্জা বলে তলানিতেও কিছু আর নেই |
সেই মুখে একটাই স্লোগান তোরা দিস
পকেট ভর্তি উন্নয়ন---চলছ চলবে
পকেটবাজির মেকী দরদী, তোরা খুনী হানাদার
শোন, তোদের জন্মটাই ভুল হয়েছিল
তোরা দুনিয়ার জঞ্জাল


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
বাঁচব বলে     
জয়ন্ত ঘোষ

স্তিপাকার করা মৃতদেহগুলোর মধ্যে
খুঁজে দেখেছি আমার মুখ---পাইনি
আমার স্বস্তি, আমি এখনও বেঁচে আছি
ওরা যেভাবে বলেছে সেভাবেই হেঁটেছি
যেখানে থামতে বলেছে থেমেছি---যেভাবে
মুখ বুজতে বলেছে সেভাবেই---তাই
আমি জীবিত, আমার হাঁপর টানা বুকে
নড়বড়ে হাতে বিশ্বাস ভাঙে
তবে কি এখন আমার সময়
মৃতদেহের মাঝে মুখ লুকিয়ে
লিকপিকে পা নাড়িয়ে জানাই
আমি কিছু করিনি, যদি করি
ক্ষমা করুন দয়া করে, পাঠাবেন না
লাশ ঘরে---আমি আপনাদের
বিশ্বাস করুন আমি এখনই যেতে চাই না পরপারে


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
রক্তলোক     
সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়

জমি-ফসলের মরা মাথাটাই রাতদিন
স্ত্রি-সন্তান মুখ বুজে আজ রিমঝিম
কার জমি কে, নেবে আমারটাই এত মিষ্টি
বুকভর্তি খিদে-তেষ্টায় আলো টিমটিম
ভিজে ক্রোধিদের শান্ত করোটি বৃষ্টি
মনে দপদপ কার হাত পা-য় নল ঝলসে---
খোঁজখবরে দলবাজিগাছ, শুধু পাখি নেই,
হাড়হিম ঘর খুঁজে মরছে বাবা ছেলেকেই
চোখ মুখ জল, কোন দূর দেশ, ঠাণ্ডায়
সব চেটে খায় মেটে গোষ্ঠির স্নান রক্ত
সেই ঝাণ্ডা দিবা-রাত্রির লাল-পাণ্ডাই |


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
নন্দীগ্রামে গণহত্যার "স্মৃতি"তে
দীপঙ্কর বাগচী

বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো
একটি সকাল আছড়ে পড়ে পা'য়
অন্ধকার বনের ভিতর যতো
লাশের উপর লাশের বোঝা যায়...

.                               আমরা যারা শহরবাসী যারা
.                               ফুলের শোকে মূর্চ্ছাগত প্রাণ
.                               কেমন করে বুঝবো বারিধারা
.                               রক্তে ভেজা মাটির কলতান

ওদের ভিটে মাটির ওপর দিয়ে
ভোরের বাতাস সাঁতরে চলে যায়
লাশের পরে লাশের বেঝা নিয়ে
রাত দুপুরে রাষ্ট্র কুকুর গা'য়...

.                               বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো
.                               নন্দীগ্রামে সন্ধ্যা নামে ভয়
.                               প্রতিরোধের আগুন করো হত
.                               নিদান দিলেন মন্ত্রি মহোদয়

তোমার পিতা লেনিন বলেছিলেন
মুমূর্ষু এই ধনের কলি কাল
তোমার চোখে মাও সে দেখেছেন
আপস কালীন কতো তারিখ সাল

.                               বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো
.                               হাজার বুলেট আছড়ে পড়ে গায়
.                               অন্দকার নদীর পাড়ে কতো
.                               ঝাঁঝরা হওয়া লাশের বোঝা যায়


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'নন্দীগ্রাম থেকে কলিঙ্গনগর' পত্রিকার মে ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত
হয়েছিল |

মিলনসাগ
যাদু মুকুটের ইতিহাস     
অমিতাভ সেন

আমাকে তোমরা কবিতা লিখতে বলেছো
কিন্তু এখন কবিতা লেখার সময় নয়

নরম মনের এই এক মুশকিল
তাতে আঘাত করলেই গভীর ক্ষত---
ক্ষতগহ্বর লাল রক্তে ভরা
আর তা না শুকোনো পর্যন্ত
আগুন জ্বলতে থাকে

সে আগুনে একদিন পুড়েছিলো পর্তুগীজ জলদস্যুরা
আজ তার আঁচ পেয়েছে দেশী হার্মাদ বাহিনী
আর আগুনের শিখায় শিখায়
আমার কবিতা লেখার ইচ্ছে
ওরা চাপা দিয়েছে মাটির তলায়, ভাসিয়ে দিচ্ছে নদীর জলে

তবু আমি একটা আশার কথা বলতে চাই---
দুনিয়ার মালিকরা এক হয়ে যে আক্রমণ করছে
তার মধ্যে এবং আমার আত্মাকেও কিনে নেওয়ার আগে
ভূমিপুত্রদের ধ্বংস করার আগে-আমার এই লেখাকেই
তোমরা কবিতা ব'লে বিশ্বাস করো---

আমার ছোট্টো মেয়েটাকে বলেছিলাম যাদুমুকুটের ইতিহাস
আমি বাঘের কথা বলেছিলাম
জঙ্গলের রাজত্বের কথা বলেছিলাম
বলেছিলাম ভয়ানক সব দিনের কথা
তারপর বাঘের মুকুট কেড়ে নিয়ে
বিড়ালের মাথায় পরিয়ে দেওয়ার কাহিনী

ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের সে কথা---
তার জন্মের ঢের ঢের আগের---
সে সব সে গল্প মনে করেছিলো,
আমি তাকে আরো বলেছিলাম
প্রজাপতি একদিন এসে
লোহার উপরে বসবে

এখন মেয়ে বড় হ'তে হ'তে
সেই বিড়াল বাঘ হয়েছে,
এখন সে নিজের চোখে দ্যাখে
তার ভয়াল নোখ --- বিশাল থাবা

সে দেখে
প্রজাপতি উড়ে এসে লোহা চুষে খায়
আর রঙীনপাখা কালো হয়ে লুটিয়ে পড়ে,
এখন সে মুকুটের যাদুতে বিশ্বাস করে
আর,
মুকুটটা সে ভেঙে ফেলতে চায় |


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'পর্বান্তর' পত্রিকার মে আগস্ট ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
এ বৈশাখে     
সুজিৎ ঘোষ

বাকি সব ঋণে যাবার পরও
দুই বিঘা জমি ছিল উপেনের,
অনেক পড়শি তার শশী বিপিন মকবুল ইয়াসিনদের
তা-ও নেই, কবিতাপ সাফল্যে কাঁপে হলদির জল---
চল্ চল্ বিশ্বকবি সম্মেলনে চল্
কবিরা চলেছে দলে দলে
প্রশাসক ঘোষক-ঘোষিকা সভাসদ বিদূষক সঞ্চালক
দূরে একটু আড়ালে আড়ালে
জগৎ শেঠের কোঠি নবায়িত রাজধানী লক্ষণাবাদের
ফিনানসিয়ার স্পনসর প্রমোটার
অষ্টাদশ শতকের মুরুব্বিরা নতুন ভাষায়
নতুন ভাষায় নেই মোসাহেব শব্ দের  চলন
শব্ দ  বড় অর্থ বদলায়---
সময়ের থেকে দ্রুত তালে লয়ে ব্যাঞ্জনায় কবিতায় গানে
রাজা হয়ে নার্সিসাস অহরহ মুখ দেখে বিম্বিত দর্পণে
যদিও বিম্বিত ছবি বিপ্রতিপ বামই দক্ষিণে,
১৪ই মার্চের থেকে ২৫শে বৈশাখ বলো
কতদূর অনন্ত এ চতুর্মাপ কাল আকাশ ক্রমে ?
কতটুকু সময় ও স্মৃতি বইবে শিশু নারী পুরুষের লাশ ?
মাটির এমন ক্ষুধা, অচিরেই হাড় মাস রক্ত সব খাবে |

তোমার মুখের দিকে সম্ভ্রমে তাকিয়ে একবার
তোমার পায়ের কাছে নতজানু হব ইচ্ছায় পঁচিশে |
বাইশে শ্রাবণ থেকে মনস্থির করে, দেখি
শ্রাবণে কান্নাই চলছে ...
সাজানো-গোছানো মঞ্চে
শ্বেশুভ্র শোভিত পোশাকে
তোমার মুখের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে
কবিতার অন্তহীন আয়ুকে শাসাবে

সুবর্ণ ? সুবর্ণ, সে কি ভীত, তৃপ্ত স্বর্ণালী আলোকে ?

অন্ধকারের রাজা, আলোক সংকাশ, এ বৈশাখে তবে তুমি থাকো
যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া মানুষের মনে, অন্ধকারে |


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
নিশ্চল পাথর     
মৃণাল বসুচৌধুরী

অপমানেও
এখন আর লালা হচ্ছে না তোমার মুখ
মানুষের অকৃত্রিম ঘৃণাও
    অস্থির করছে না তোমায়
প্রতিক্রিয়াহীন
    নিশ্চল পাথর হয়ে বসে আছো
যেন পাপ পুণ্যে আর কোনো ভেদাভেদ নেই
যেন রঙিন মোড়কে ঢাকা
    লোভ অভিসন্ধি
    অন্ধকার চোরা অলিগলি
    এ সমস্ত নিয়ে
তোমার অযথা কোনো অস্বস্তিও নেই
যেন জেনে গেছো
    প্রতিবাদ প্রতিরোধ
                    বড়জোর গুটিকয় মৃত্যু ডেকে আনে
প্রত্যাশাপূরণ নিয়ে নিঃশব্ দ  উল্লাসে
অশরীরী মানুষেরা কোনোদিন
মাত্রাহীন রক্ত ছড়াবে না

অপমানেও লালা হচ্ছে না তোমার মুখ
অকৃত্রিম ঘৃণাও আর স্পর্শ করছে না তোমায়
অথচ লজ্জায় নতমুখ
আমরা লুকিয়ে বসে আছি

তোমরা তো আমাদেরই সহোদর ছিলে |


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
রাজাকে প্রশ্ন করতে নেই     
তাপস রায়

আম জনতার মাঝে রাম, সত্যপ্রতিষ্ঠার রামায়ণ
যুধিষ্ঠিরও ফলে প্রহল নিষ্ঠা দেখান, তবু
বকরূপী সাংবাদিক বারবার বিপদগ্রস্থ করে তোলে তাকে

শহরের রাস্তায় মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ভাঙা বিস্কুট হাতে কেউ
পেছনে প্রভুভক্ত ক'টি সারমেয়, ঘুরঘুর
তাদের লেজনাড়া চমত্কার লাগে

আমার নিজের লেজও তেলে জলে তখন দৃশ্যমান বেশ
যখন গলার স্বরে মৃদু কুঁই কুঁই
অন্য কেউ আমাকে সারমেয় ভাবে, গোপনে হাসেও

একদিন পাড়ায় পাড়ায় --- কুকুরেরা ধরা পড়ে
দীঘল সাঁড়াশি এসে টুটি টেপে
কিছুদিন ওদের চিত্কারে প্রভুদের রাত্তিরের ঘুম
                                     নষ্ট হয়েছিল


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
জননী     
জয় মুখোপাধ্যায়

কতদূর দেশজ বাস্তবের চোখ তোমার অষ্টবক্র ঘনশ্যাম
শিকড় আমার সর্ব অঙ্গে তৃতীয় কালীন
অন্তর্গত সোপান জুড়ে ভেসে যাচ্ছি ক্রমনত |
সফেদ দেখাচ্ছিল বেশ চিহ্নিত আস্ফালনগুলি ও
কথা-হাওয়ায় ছিল বিষ
জলের নদী কাঁদলো অহর্নিশ ; সেই থেকে হায় অন্তবিহীন
দুয়ারে পরাগ---পা ছড়িয়ে বসলো কালপেঁচা | পাড়ার
মাচা ঝুললো দ্যাখো কোমল কোলাহল
জড়িয়ে থাকা শান্তি ভাঙলো, ভাঙলো আহা সাধের অন্রাল
এভাবেও তবু পলায়পর ফিরেছি বারংবার, একটু কাছাকাছি
তোমরা তো দেখি গভীর শিয়ালচোখ ; অপৃর্ব
তবু নতুন বল এ কি | বিহ্বল হবে?
না হয় মিছিমিছি ঘুরবে কিছুক্ষণ গাছের শিকড়ে
এলিয়ে পড়বে বুঝি---একটি শিশুর মৃত্যুর মতন
এমনতর সোহাগ বিলোও তুমি
নাড়ি কেমন আছাড়কাছাড় করে
"জননী" হায় ইটভাটাটির নাম, অষ্টাবক্র ঘনশ্যাম
মায়ের রক্ত আমার অঙ্গে ঝরে !


.                 **************                         
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                               সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'লুব্ ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
হাজার কংসারি হালদার কাঁদছে কমরেড    
রাণা চট্টোপাধ্যায়

অতি আপনজনও স্বেচ্ছাচারী, নিষ্ঠুর হতে পারে
তখন একটু দূরে থাকাই ভালো |
আত্মজন বলেই মেখে নিতে হবে কালো ?
আবেগ সরিয়ে বোঝাতে চাই
এত খাই খাই ভালো নয়, এক লাফে সাগর ডিঙোবে ?

দু-বছরও যায় নি গুজরাট নিয়ে তুমিই তো
মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করেছিলে কমরেড ?
তখন মনে হয়েছিল
"রণরক্ত সফলতা শেষ সত্য নয়"
আজ নন্দীগ্রাম নিয়ে স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে |

মনে কি পড়ে না স্বাধীনতার পরপর
কাকদ্বীপে চলেছিল পুলিশের গুলি---
লাশগুলি শুয়ে ছিল আকাশের নিচে পাকাধান বুকে ?
যাদের হাত ধরে হেঁটে এলাম
তাদের হাতেও দেখি রক্তের দাগ !

বুদ্ধিজীবীদের দেখেছি, দুর্বুদ্ধিজীবীকেও দেখেছি,
চোদ্দোজন মারা গেল কার অভিশাপে
এখন হাত ধুয়ে ফেলবে নাকি
সকলের হাতে কুষ্ট হয়েছে ?
তোমাদের সঙ্গে আছি বলে সাতখুন মাফ ?
আমার মুখে তো সেলোটেপ নেই
কথা বলতে পারবো না, প্রতিবাদ করবো না ?
হাত তুলে বলতে পারবো না---
থামো কমরেড | হয় পতাকার রং বদলে নাও
কিংবা দাঁড়াও নিহতের পাশে
হাজার কংসারি হালদার কাঁদছে নন্দীগ্রামে |


.              **************                
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                   সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই ২০০৭
এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
না কিছুতেই নয়    
নমিতা চৌধুরী

আপনি যেভাবে বলেছিলেন আমি
ঠিক সেইভাবেই ঘাড় গুঁজে লিখে যেতাম
রোজনামচার খাতা নির্বাক সেই
অক্ষরের মধ্যখানে আজ উঁকি দিচ্ছে দেখি
নিষ্পাপ শিশুদের লাশ ধর্ষিতার চোখ |
এতদিন আপনার কথামতই তো কাজ করে এসেছি
এবার আমাকে মাপ করবেন হুজুর
আর পারছি না | আমার হাতের আঙুল ক্রমশ
শিথিল হয়ে পড়েছে | হাত থেকে
খসে পড়েছে কলম কালো কালির ধারায়
অনবরত মিশে যাচ্ছে --- রক্তের স্রোত
বুলেবিদ্ধ প্রতিটি মানুষের চিত্কার সাদাপাতাকে
উসকে দিচ্ছে---কিছু বলার জন্যে |

ওরাও কিছু বলতে চায় এখন, আপনি শুনুন
শুনুন যতই আপনার ক্যাডার বাহিনী এভাবে
ভয় দেখাক না কেন কিছুতেই ওরা
ওদের জমি ছিনিয়ে নিতে দেবে না
না প্রাণ থারতে কিছুতেই নয় |


.              **************                
 অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                   সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই ২০০৭
এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
বাংলার ভূমি    
সুভদ্রা ভট্টাচার্য

রাজনীতির ধার ধারি না আমি
শুধু বুঝি মানুষ শহর থেকে গ্রাম
রক্ত বহন করে শরীরে যার দাম
বণিকেরা করে লুণ্ঠন নিয়ে নেয় জমি

রাজনীতির ধার ধারি না আমি
শিশু-নারী বাদ যায় নি কেউ
রক্ত মেখেছে মাটি অত্যাচারীর শাণিত ঢেউ
লুটিয়ে পড়েছে লজ্জায় মুখ ঢেকেছে জমি

রাজনীতির ধার ধারি না আমি
মানুষ হিসেবে মানুষের কাছে যেতে চাই
বাংলার এই মাট্ আমাকে লালন করে জানি তাই
কৃষি না শিল্প ভাবছে নিথর জমি

রাজনীতির ধার ধারি না আমি
জমি সে আমার পায়ের তলার নাকি নন্দীগ্রাম
শুধু জানি অহংকারের পরাগ ছুঁচ্ছে কৃষকের সম্ভ্রম
লাঙল ছুঁতে চাইছে না কারখানার চিমনির আকাশজমি

রাজনীতির ধার ধারি না আমি
শুধু জানি কর্ষণের ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতেচায় এই বাংলার ভূমি

.       **************                
.                                               
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                                        সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই ২০০৭ এর
সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
তুমি যে    
অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
বাকি কথা লিখি পদ্যে অসময়
ধ্বংস হত্যা ক্রোধের রক্তে লাল
ঘামমাটিময় এখন দঃসময়

জেগে থাকে চোখ কোটরে কঙ্কাল
আলজিব চাটে কার্তুজসিসাবিষ
শস্যের মাঠ শ্মশানের প্রান্তর
এক হয়ে আছে মৃত্যুর কাছে হিম

ত্রাসের কাছে স্তব্ ধ  বোবাভয়
বারুদ বুলেট জিহাদের হুংকারে
উড়ে আসে চোখে পোড়া মানুষের ছাই
রক্ত জমাট কালশিরা পাঁজরে

আকাশে মিনার গম্বুজ ছুঁয়ে চাঁদ
খুনখোশরোজ গ্রাম থেকে শহরে
কবে মুছে দেবে রক্তের নোনাদাগ
চেয়ে আছো তুমি ক্লান্ত আকাশ ভরে

.       **************                
.                                  
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                            সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই
২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
বাহ্    
অনীক রুদ্র

মুখে মার্ক্সবাদ
পিঠে গাঁটছড়া পুঁজির
কেড়ে নেয় চাষি আর
শ্রমিকের রুজির
জায়গা-জমিন, শুরু করে ঠিকাদারি
বুদ্ধ-বিমান, বিনয় কোঙার, নিরুপম...
কায়েম করেছে জঙ্গল-রাজ
ফ্যাসিজম---
দাঁত-নখ বের করে, তিরিশ বছরে
            মরিচঝাঁপির পথ ধরে সিঙ্গুরে
            নন্দীগ্রামের পথে-মাঠে-ঘাটে
ফ্রাঙ্কোর বাচ্চারা
            দাপিয়ে বেড়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে

ভণ্ড বামের মুখোস পড়েছে খসে

.       **************                
.                                  
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                            সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই
২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
তৈরি থেকো    
বিশ্বজিৎ রায়

যে সব ভয়ের কথা লিখেছি এতদিন
তার চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর ভয় ছুটে আসছে
প্রতিটা হৃদয়, ঘর, রূপকথা তাক করে
ষড়যন্ত্রের অস্ত্র হাতে...

একদিন যারা দলবেঁধে গড়েছিল কমিউন
যারা একদিন গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল গান---
  "মানুষের জীবন হোক অনন্ত স্বাধীন..."
তারা প্রত্যেকে উপহার পেয়েছিল উষ্ণ বুলেট
আর "থার্ড ডিগ্রি" আপ্যায়ন...

আজও যারা চাইছ মুক্ত আকাশ-মাটি-জল
চাইছ ছাপোষা সরল জীবন,
একটুকরো মাটির অহংকার---
                       তারাও তৈরি থেকো
তোমাদের জন্যও হয়তো অপেক্ষা করছে...

.       **************                
.                                  
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                            সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই
২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
নয়া ইতিহাস    
ইরা ভঞ্জ

পিপীলিকার পাখা ওঠে মরণের তরে
কত যে ঝাপটানি দিল তিরিশ বছরে |
"বলে লোকে, অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে|"
বিশ্বায়নের গানে শিল্পায়নের ধুয়ো ধরে
শিশুর মুখের গ্রাস নেবে কেড়ে |
করতে গিয়ে ধুরন্ধর দলবাজি
দিলি যে নিজেরই মুখে চুনকালি,
যখন আগ্রাসী থাবায় আপন ঘর ভাঙে
ফেলা থুতু চাটিস তাই বারে বারে
এক কান পকেটে পুরে
দু-কান কাটাদের লজ্জা নাইরে |
আবরণ খুলে গেছে মগজের কোশে
সুচেতনার জলবিন্দুমাত্র নেই অবশেষে |
দু-হাজার সাতে গিরগিটির জাত
লিখে দিল মানবতার কালা-ইতিহাস
মানুষের বুকের রক্তে করে যারা স্নান
বাস্তুহারা শস্যহীন নিপীড়িত জন
ছিঁড়েকুটে করবে এবার স্বেচ্ছাচারী রাজা খানখান |
বেঁচে থাক ঘরে ঘরে যত ভাইবোন
মানুষের জেগেছে পিঠে কুলো বাঁধা হুঁশ আর মান
ভাঁওতাবাজিতে নয় আর অসম উন্নয়ন
নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর দিয়েছে সাহসী আহ্বান
তারা আজ প্রতিজ্ঞায় অটল, প্রতিবাদী
বিনা যুদ্ধে দেবে না কণামাত্র আবাদি ভূমি,
নজির গড়ল তাবৎ মানুষই
দেশবাসীর জন্য দেশ, দেশের জন্য নয়া ইতিহাস
                          আমরাই গড়ে তুলি |

.       **************                
.                                  
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                            সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই
২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*
কবিতা তুমি কোথায়!    
শুভাশিস চক্রবর্তী

সবুজের সোনালী খেতে
আলপথ বেয়ে তোমাকে খুঁজতে গিয়ে---
এসেছি ফিরে |
ভোরের শিশির রক্তবিন্দুর মতো
পড়ে আছে মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে!
পৃথিবীটা থমকে গেছে সেখানে!
তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিতে
ভুল করে যাই, গোধুলি লগ্নে
ওই নীল নীলিমার পথে |
বারুদের ঘ্রাণে মূর্ছা যাই
স্বপ্নে তোমাকে দেখি তারপরে
লাশকাটা ঘরে |
নিনন্দুকেরা কী বলবে
কে জানে!

.       **************                
.                                  
অন্যান্য কবিদের সূচির পাতায় ফেরত
.                            সিঙ্গুরের কবিতার মূল সুচির পাতায় ফেরত       

এই কবিতাটি 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটি'-র পত্রিকার ১ জুলাই
২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল |

মিলনসাগ
*