. দুইজনে ভয়ঙ্কর, বীভত্স, নিষ্ঠুর, . শুধু ছবি আঁকি বসে জীবন মৃত্যুর ! আমার ভুবনে আমি তোমা মত খুসী-ক্ষ্যাপা স্রষ্টা ভগবান, কাহারে বঞ্চিত করি, বক্ষ ভরি’ কাহারে সর্ব্বস্ব করি দান |
. মিলন-চুম্বন কা’রে, কাহারে বা আতপ্ত বিরহ, . কা’রে দগ্ধ মরুভূমি, কা’রে বর্ষা-স্নিগ্ধ অনুগ্রহ ! আমার খেয়াল মত গান গাহি ভৈরবী বিভাসে, ধন্য করি কা’রে প্রেমে , খিন্ন করি কা’রে দীর্ঘশ্বাসে ; . কা’রে কন্টকের মালা, কা’রে বা মাধবী, . যাহা খুশি দান করি তোমা-সম, কবি ! আমিও তোমারি মত পাইয়াছি অমূল্য সে স্বর্ণ-সিংহাসন, রাত্রি দিন সেথা বসি’ মূল্যহীন রাজত্বের করি আয়োজন ; . অকারণে বসে’ বসে’ ক্ষণিকের ক্ষণপ্রভা হানি, . তার পরে ইচ্ছা হ’লে মৃত্যুর গুন্ঠন দিই টানি’ একে একে মিশে’ যায় মূল্যহীন স্বপ্নের বুদ্বুদ, আতঙ্কে নিবিয়া যায় সৃষ্টির সে রহস্য-বিদ্যুৎ, . পড়ে’ থাকে বিদীর্ণ বাঁশরী, . ভগ্ন যত ভাবের গাগরী ||
তোমারে ভুলিয়া গেছি,-----পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত আজি মোর মন, আমার মুহূর্তগুলি উড়ে চলে লঘুপক্ষ বকের মতন | তোমারে ভুলিয়া গেছি নভচারী শ্রান্ত ডানা ধীরে বুজে আসে | কূলের কুলায়ে হায়---কুয়াশার ঘুম ভাঙে চৈত্রের বাতাসে | শ্মশান ঘুমায়ে আছে, আষাঢ়ের অশ্রু জলে নিভে গেছে চিতা, শীতার্ত বিশীর্ণ নদী---নাহি আর আবেগের অমিতব্যয়িতা | হাতে আজ কতো কাজ : ভুলে গেছি কখন ফুটেছে ছোট জুঁই, ক্ষুদ্র গৃহনীড় ছেড়ে কখন বিদায় নিল চটুল চড়ুই | তোমারে ভুলিয়া গেছি--- উদ্বেগ-উদ্বেল তনু লভেছে বিশ্রাম, প্রতীক্ষার ক্লান্তি হতে লভিয়াছি শূন্যতার আরোগ্য আরাম | রৌদ্রের দারিদ্র মাঝে ভুলে গেছি নক্ষত্রের মধুক্ষরা চিঠি, গায়ে হলুদের দিনে, ভুলে গেছি, পরেছিলে হলুদ শাড়িটি |
দ্বার রুদ্ধ করি নাকো--- জানি আর বাজিবে না ভীরু করাঘাত, রজনীর সুপ্তিশেষে জানি শুধু দেখা দিবে প্রসন্ন প্রভাত | তোমারে ভুলিয়া গেছি --- জীবনেরে তাই যেন আরো বড়ো লাগে, অনুর্বরা মৃত্তিকার রুক্ষদহ ভরে গেছে আতাম্র বিরাগে ! তোমায়ে মানায় কি-বা সিন্দুরেতে, কে বা জানে ! হাতে এত কাজ ! বেদনার অপব্যয়ে গড়িব না, ভয় নাই, বিরহের তাজ | ছিলাম সঙ্কীর্ণ গৃহে, চলে গিয়ে, ফেলে গেলে এত বড়ো ফাঁকা, আমার কানের কাছে মুহুর্মুহু বেজে চলে মুহূর্তের পাখা | তোমারে ভুলিয়া গেছি,----কে জানিত এর মাঝে এতো তৃপ্তি আছে, আমার বক্ষের মাঝে মহাকাশ বাসা বেঁধে যেন বাঁচিয়াছে |
প্রথম যখন দেখা হয়েছিল, কয়েছিলে মৃদুভাষে ‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো,---- কিছুতে মনে না আসে | . কালি পূর্ণিমা রাতে ঘুমায়ে ছিলে কি আমার আতুর নয়নের বিছানাতে ? মোর জীবনের হে রাজপুত্র, বুকের মধ্য়মণি, প্রতি নিশ্বাসে শুনেছি তোমার স্তব্ধ পদধ্বনি ! তখনো হয়তো আঁধার কাটেনি,---সৃষ্টির শৈশব,----- এলে তরুণীর বুকে হে প্রথম অরুনের অনুভব !’ . আমি বলেছিনু, ‘জানি, স্তবগুঞ্জন তুলি তোরে ঘিরে হে মোর মক্ষিরানী !’ যাপিলাম কত পরশ তপ্ত রজনী নিদ্রাহীন, দু’চোখে দু’চোখ পাতিয়া শুধালে, ‘কোথা ছিলে এতদিন ?’ . লঘু দুটি বাহু মেলে’ মোর বলিবার আগেই বলিলে ; ‘যেয়ো না আমাকে ফেলে |’
আজি ভাবি ব’সে বহুদিন পরে ফের যদি দেখা হয়, তেমনি দু’চোখে বিশ্বাসাতীত জাগিবে কি বিস্ময় ? . কহিবে কি মৃদুহাসে, ‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো, কিছুতে মনে না আসে ||’
. তুমি ছাড়া কে পরিতো . নিয়ে যেতে অবারিত মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির-সন্ধানে ; . তুমি ছাড়া আর কার . এ-উদাত্ত হাহাকার----- হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |
চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছি না : আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে উড়ছে আমার স্বদেশের পতাকা----- তিমিরমুক্ত অম্বরের অভিমুখে উথ্বিত হচ্ছে আমার নিরুদ্ধ আত্মার প্রথম উদার সম্ভাষণ আমার জন্মের প্রথম জয়ঘোষণা | এক প্রান্তে গম্ভীর গৈরিক অনপনেয় দুঃখের ঔদাস্য আর অপরিমেয় ত্যাগের প্রসন্নতা ; অন্য প্রান্তে উল্লাস-উজ্জ্বল সবুজের অপর্যাপ্তি অমিত জীবনের সৃজনসৌন্দর্যের উদ্ভাবন ; মধ্যস্থলে তুষারসঙ্কশা শুভ্রতা কর্মের নির্মলতা ও অনবদ্য অন্তরমাধুর্যের প্রতীতি | আর সেই শুভ্রতার অন্তরে ঘননীল অশোকচক্র, সমস্ত অলাতচক্রের ঊর্ধ্বে শান্তির স্থির বাণী দিকে-দিকে দেশে-দেশে মৈত্রীর আমন্ত্রণ ; শোকশূন্য সময়ের ঘূর্ণ্যমানতার প্রতীক বর্তমান থেকে বৃহত্তর ভবিষ্যতের মহত্তর সম্ভাবনায় নিয়ত-আবর্তিত উড়ছে আমার ধ্রুব বিশ্বাসের ধ্বজপট আমার বীজমন্ত্রের বৈজয়ন্তী |
কত দুর্গম পর্বত ও কত কন্টকক্লেশিত অরণ্য পার হয়ে কত দুঃসহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে অভ্রান্তলক্ষ্যে চলে এসেছ তোমরা, দৃঢ় হাতে বহন করে এনেছ এই পতাকাকে | কত রোষকষায়িত কশা, কত বলদর্পিত বুট কত বর্বর বুলেট ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে তোমাদের, কিন্তু বজ্রমুষ্টি শিথিল করতে পারেনি, স্খলিত করতে পারেনি তোমাদের পতাকার উদ্ধতি, নমিত করতে পারেনি তোমাদের দুষ্পরাজেয় প্রতিজ্ঞা | মায়ের বুকে সন্তানের মত পক্ষিচঞ্চুপুটে তৃণখন্ডের মত বারুদের বুকে বহ্নিকণার প্রত্যাশার মত বহন করে এনেছে এই পতাকা যাতে আমি প্রোথিত করতে পারি আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে | নবীনারম্ভের নিশ্বাসে বিস্তার করতে পারি বুক, জজ্জ্বল উপলব্ধিতে উদ্ধত করতে পারি মেরুদন্ড |
লেখনীকে বিশ্বাস করতে পারছি না যা আমি আজ লিখছি এই মুহূর্তে | কত বাক্য রুদ্ধ হয়ে গেছে তোমাদের কন্ঠে দলিত হয়েছে কত অরুন্তদ আর্তনাদ স্তব্ধ হয়েছে কত বঞ্চিত বুকের দ্রোহবাণী | সত্যভাষের সেই অধিকারকে তবু বিধ্বস্ত হতে দাওনি, বহন করে এনেছ এই পতাকা এই উদাত্ত বীরবার্তা ; তন্দ্রিত আকাশে মুক্ত করে দিয়েছ সিতপক্ষ কলহংসের কাকলি, যাতে আমি পেতে পারি আমার ভাষা লেখনীতে অপরাঙ্মুখ তীক্ষ্ণতা |
তাই আজ এই পতাকাকে যখন প্রণাম করি প্রণাম করি তোমাদের দুর্জয় বীর্যবত্তাকে | স্মরণ করি তোমাদের যারা ফাঁসির রজ্জুকে মনে করেছে কন্ঠলগ্ন কোমল ফুলমালা মৃত্যুতে দেখেছ অমরত্বের রাজধানী | স্মরণ করি তোমাদের নাগ-নক্ষত্র যাদের যাত্রা, যারা কারাকক্ষে নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে যাপন করেছে অবিচ্ছেদ্য অন্ধকার, আকাঙ্ক্ষার অগ্নিতেজে তপ্ত রেখেছ বক্ষঃস্থল, জতুগৃহদাহে দেখেছ ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মিতি | আর তোমাদের স্মরণ করি সেই সব অগণন নানহীন পথিক পদাতিকের দল, নির্বিশঙ্ক জীবনের আহ্বানে পদে-পদে রক্তচিহ্নিত করেছ পথ-প্রান্তর-জনপদ, ঘরে ঘরে জ্বেলেছ জায়া-জননীর হাহাকারের দাবাগ্নি | যাতে আমি জীবনে পেতে পারি মর্যাদা অমূল্য মূল্যবোধ | যাতে হাতে পেতে পারি তেজিষ্ঠ লেখনী কন্ঠে পেতে পারি দুর্বার কলস্বন আর প্রকাশ্য গৃহচূড়ে এই অপ্রকল্প পতাকা ||
তোমার শীতললক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ তোমার কর্ণফুলি আর আমার শিলাবতী তোমার পায়রা আর আমার পিয়ালী এক জল এক ঢেউ এক ধারা একই শীতল অতল অবগাহন, শুভদায়িনী শান্তি | তোমার চোখের আকাশের রোদ আমার চোখের উঠোনে এসে পড়ে তোমার ভাবনার বাতাস আমার ভাবনার বাগানে ফুল ফোটায় |
তোমার নারকেল সুপুরি অশোক শিমুল আমার তাল খেজুর শাল মহুয়া এক ছায়া এক মায়া একই মুকুল মঞ্জরী | তোমার ভাটিয়াল আমার গম্ভীরা তোমার সারি-জারি আমার বাউল এক সুর এক টান একই অকূলের আকূতি তোমার টাঙ্গাইল আমার ধনেখালি তোমার জামদানি আমার বালুচর এক সুতো এক ছন্দ একই লাণ্যের টানা-পোড়েন চলেছে একই রূপনগরের হাতছানিতে |
আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিন পাখির আনাগোনা | আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি | আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায় |
আমাদের এক সুখ এক কান্না এত পিপাসা ভূগোল ইতিহাসে আমরা এক এক মন এক মানুষ এক মাটি এক মমতা পরস্পর আমরা পর নই আমরা পড়শী ---আর পড়শীই তো আরশি তুমি সুলতানা আমি অপূর্ব আমি মহবুব তুমি শ্যামলী |
আমাদের শত্রুও সেই এক যারা আমাদের আস্ত মস্ত সোনার দেশকে খন্ড-খন্ড করেছে যারা আমাদের রাখতে চায় বিচ্ছিন্ন করে বিরূপ করে বিমুখ করে | কিন্তু নদীর দুর্বার জলকে কে বাঁধবে কে রুখবে বাতাসের অবাধ স্রোত কে মুছে দেবে আমাদের মুখের ভাষা আমাদের রক্তের কবিতা আমাদের হৃদয়ের গভীর গুঞ্জন ? তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি আমি তোমাদের ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যে দেখ এই ভাষায় আমাদের আনন্দে -আশ্চর্যে সাক্ষাত্কার | কার সাধ্য অমৃতদীপিত সূর্য-চন্দ্রকে কেড়ে নেবে আকাশ থেকে ?
আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ এক নজরুল | আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক মানবতায় এক বিনা সুতোয় রাখীবন্ধনের কারিগর আমরাই একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ মর্মের মধুকর, মঙ্গলের দূত আমরাই চিরন্তন কুশলসাধক ||
গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া -- আঁকাবাঁকা শুকনো কতকগুলি কাঠির কঙ্কাল শূন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া, রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল-বাকল নেই নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা | ওই পথ দিয়ে জরুরি দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি ক’রে | ড্রাইভার বললে, ওদিকে যাব না | দেখছেন না ছন্নছাড়া ক’টা বেকার ছোকরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে-- চোঙা প্যান্ট, চোখা জুতো, রোখা মেজাজ, ঠোকা কপাল-- ওখান দিয়ে গেলেই গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে, বলবে, হাওয়া খাওয়ান |
ওরা কারা ? চেনেন না ওদের ? ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের --এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে | ওদের কিছু নেই ভিটে নেই ভিত নেই রীতি নেই নীতি নেই আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই শ্লীলতা-শালীনতা নেই | ঘেঁষবেন না ওদের কাছে |
কেন নেই ? ওরা যে নেই রাজ্যের বাসিন্দে-- ওদের জন্যে কলেজে সিট নেই অফিসে চাকরি নেই কারখানায় কাজ নেই ট্রামে-বাসে জায়গা নেই
মেলায়-খেলায় টিকিট নেই হাসপাতালে বেড নেই বাড়িতে ঘর নেই খেলবার মাঠ নেই অনুসরণ করবার নেতা নেই প্রেরণা-জাগানো প্রেম নেই ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারু দরদ নেই-- ঘরে-বাইরে উদাহরণ যা আছে তা ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ নয়, তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ-- শুধু নিজের দিকে ঝোল- টানা | এক ছিল মধ্যবিত্ত বাড়ির এক চিলতে ফালতু এক রক তাও দিয়েছে লোপট ক’রে |
তাই এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে সড়কের মাঝখানে | কোথ্বকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই | কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানের গতি নেই কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা |
আমি বললুম, না ওদিক দিয়েই যাব, ওখান দিয়েই আমার শর্টকাট | ওদের কাছাকাছি হতেই মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, তোমাদের ট্যাক্ সি লাগবে ? লিফট চাই ? আরে এই তো ট্যাক্ সি, এই তো ট্যাক্ সি, লে হালুয়া সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ওরা সিটি দিয়ে উঠল পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি চল পানসি বেলঘরিয়া | তিন-তিনটে ছোকরা উঠে পড়ল ট্যাক্ সীতে, বললুম কদ্দুর যাবে | এই কাছেই | ওই দেখতে পাচ্ছেন না ভিড় ? সিনেমা না, জলসা না, নয় কোনো ফিল্মি তারকার অভ্যর্থনা | একটা নিরীহ লোক গাড়িচাপা পড়েছে, চাপা দিয়ে গাড়িটা উধাও-- আমাদের দলের কয়েকজন গাড়িটার পিছে ধাওয়া করেছে আমরা খালি ট্যাক্ সি খুঁজছি | কে সে লোক ? একটা বেওয়ারিশ ভিখিরি | রক্তে-মাংসে দলা পাকিয়ে গেছে | ওর কেউ নেই কিছু নেই শোবার জন্য ফুটপাথ আছে তো মাথার উপরে ছাদ নেই, ভিক্ষার জন্য পাত্র একটা আছে তো তার মধ্যে প্রকান্ড একটা ফুটো | রক্তে মাখামাখি সেই দলা-পাকানো ভিখিরিকে ওরা পাঁজাকোলা করে ট্যাক্ সির মধ্যে তুলে নিল | চেঁচিয়ে উঠল সমস্বরে --আনন্দে ঝংকৃত হয়ে-- প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে |
রক্তের দাগ থেকে আমার ভব্যতা ও শালীনতাকে বাঁচাতে গিয়ে আমি নেমে পড়লুম তাড়াতাড়ি | তারপর সহসা শহরের সমস্ত কর্কশে-কঠিনে সিমেন্টে-কংক্রিটে | ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে দেয়ালে-দেয়ালে বেজে উঠল এক দুর্বার উচ্চারণ এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি-- প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও আছে অস্তিত্বের অধিকার |
ফিরে আসতেই দেখি গলির মোড়ে গাছের সেই শুকনো বৈরাগ্য বিদীর্ণ ক’রে বেরিয়ে পড়েছে হাজার-হাজার সোনালি কচি পাতা মর্মরিত হচ্ছে বাতাসে, দেখতে দেখতে গুচ্ছে গুচ্ছে উথলে উঠছে ফুল ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ, উড়ে এসেছে রঙ-বেরঙের পাখি শুরু করেছে কলকন্ঠের কাকলি, ধীরে ধীরে ঘন পত্রপুঞ্জে ফেলেছে স্নেহার্দ্র দীর্ঘছায়া যেন কোনো শ্যামল আত্মীয়তা | অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলুম কঠোরের প্রচ্ছন্নে মাধুর্যের বিস্তীর্ণ আয়োজন | প্রাণ আছে, প্রাণ আছে-- শুধু প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ এক ক্ষয়হীন আশা এক মৃত্যুহীন মর্যাদা |