কবি অচ্যুত মণ্ডলের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
কবি অচ্যুত মণ্ডলের পরিচিতির পাতায় . . .
দিনলিপি (১৯৮৬)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

দূরের দুপুর তার নিকানো উঠোনে ধান---ভেরেন্ডা ঝোপের ঘন কষে
রোদে আঁকা কলাগাছ জলের প্রত্যাশী --
কুয়াশার টুকরি থেকে তুলে নিচ্ছে লঙ্কাজবা, জলছবি, পুরোনো ইস্ ক্রুপ ।
ডাকটিকিটের গঁদ খুঁটে খুঁটে রাবারব্যান্ড রোদ
মাছের চুবড়ির মতো অলস বৈঠক ভেঙে নেমে আসছে দুপুরের সরল দাওয়ায়
জাউ, ফেনাভাত, তেল ও নুনের গন্ধে ও বাড়ির কুয়োতলা
ভ’রে যাচ্ছে কাঁঠালপাতায়।
এইভাবে দুপুরের জল, রোদ, কাঁঠালপাতার ছায়া
পটুকাকীমার বেড়া পেরুবে পেরুবে
আর মানা বলল, ‘লাগছে তিতুদা’
‘তিব্বতের রাজধানী লাসা, জানো মনুমাসী’
বলে ছেলেটি দৌড়োলো তার লাল সাদা গেঞ্জি ;
কালো পিচরাস্তা, চামচগুলির মতো ঠোঁটে নিয়ে দৌড়ুলো বিকেল ।
কিশোরেরা চুপিচুপি যোগচিহ্ন এঁকেছে দেওয়ালে
আর যোগ নিয়মের যত ভুল ।
বাঁকানো চামচ নাকি দিক্ চক্রবাল থেকে বিয়োগ নিয়মবিধি মেনে
খসে পড়ল ঘন লাল মার্বেলের গুলি--
জোড়াচোর খেলে খেলে শেষ মামনিও ঘরে গেছে।
সুতার্কিক মেঘ থেকে অবরোহী অনুমানে চাঁদ নেমে এলে
জামরুল গাছের সঙ্গে সান্ধ্যবৈঠকে বসল জোনাকির আলো --
প্রসঙ্গ আঁধার। অযথা বাতাস উড়ল প্রবল ফুত্কারে,
আকাশ মনে হচ্ছে রঙচটা পুরোনো মিনার।
রাতচরা অটোরিক্সা একা একা গালি পারছে
খেয়ালী চালক ঝুঁকে তুলে নিল অজানা পাথর
নাকি নাম লেখা তোমার রুমাল--
অনূর্ধ্ব পঁচিশ মেয়ে ম্লান হলে
উত্তর পঁচিশ যুবা অন্ধকারে শিস্ দেয় একা।

********************************







*
শীত (১৯৮৬)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

শীত এ্যাতো মেঘলা হও নি বহুদিন।
এ্যামন মেঘলায় এ্যাতো আন্তরিক হও
চক মিলানো রোদ কখন সরে গেছে জানতেও পারোনি।
অবশ সবুজ ছায়া চাদর জড়িয়ে আর উঠোনে দাঁড়ায় না
তবু কেন ফেলে গেল জলপাই শুকোনোর মরা ঝুড়ি--
বাবার চাদর এ্যাতো ধূসর মসৃণ খস্ খস্ , ঘুমে মোড়া
বাবার চাদরে এক শৈশবের ঘ্রাণ বাস করে।
শীতের সবুজ জল, ফ্যাকাশে সাবান কেস, ভিজে চুলে গিঁঠ দিয়ে
তিনবার শাঁখ ---রেলের বাঁশির মতো জোরে নয়
জল আরো চুপিসাড়ে কাঁদে ;
নিথর আতার পাতা ছুঁয়ে দৌড়ে এল কাক
খুব যেন সুরে বাঁধা ছেলেবেলা ডালপালা মেলে দেয়
বিকেলের ঢাকা দেওয়া আটাগোলা রুটি, রসগুড়ে।
ধোঁয়াটে আস্বপ্ন ভাতে ধনেপাতা গন্ধ লেগে আছে
শাড়ি কিংবা বেডকভার, কেরিয়ারে গাঁঠরি নিয়ে
সাইকেলে চলে যায় একক চেহারা--
এমন দুপুরে টিনে, কাঁঠালপাতার কোনো ঝম্ ঝম্ খস্ খস্ নেই,
শুধুই এলিয়ে আছে -- এমন শীতের মেঘে হেঁটে যাওয়া
কারও সঙ্গে দেখা হবে বলে ।
শীত ; তুমি ফিরে গেছ আদিম প্রশ্রয়ে
অত রাতে ঘুম ভাঙা ভালো নয়--
রোজ তুমি মশারিও গুঁজে দেবে বলো
একদিনও বিরক্ত হবে না ?
দুরের ফিল্ মি গান, নীল টোকা ;
বাসিমুখে টুথব্রাস, শীত পেস্ট--
কী যে গায় আজানের মতো ।
একটা পাগল ঘুঘু ডেকে গেল
ট্রেন খুব থেমে থেমে ডাকে।

শীত এ্যাতো নিঃসঙ্গ হতাশ--
পৌষালী সোঁতার মতো ফেলে এসো পূর্ণ পরিবার
ছায়াটোপে মুখ গোঁজে পাড়াটে কুকুর।
কাঁঠালতলায় বসে ধুলোর আলপনা আঁকে একা মেয়ে--
অবস চৌখুপি কাটা হলুদ ডিভানে বসে মাছি ;
লাল লেপ রোদের রোয়াকে ঘুম যায়--
নেহাতই বারান্দা শিশু আঁক কষে মনের দক্ষিণে,
শাঁখাপরা মধ্যবয়সিনী তার ফেলে আসা ডালিম শিশুর কথা মনে পড়ে
সেই শিশু মশারি এড়িয়ে এক বিশাল বারান্দা পায়
রোদ তাতে গাল ঘষে গেছে ।
আগোছালা শাড়ি পরা কুয়োতলা -- তলপেট দুলে উঠলে তার
উদোম দুপুরে তুমি একা একা অশ্বথ্বের কাছে গিয়ে মুখ ঘষো---
জামা বেল্ট খুলে--
যখন দুপুর বোনে উলকাঁটা, রোদের ইস্পাতে গুটিসুটি সোনালী
বুড়িরা বসে থাকে -- মা যার কাছে গেছে ;
অথচ দুপুরে ফোটে ঘাসফুল, কমলার ঝাঁকা থেকে
তুলে নেয় অনন্ত কিশোরী --
তুমি তার স্কার্ট ছুঁয়ে, ঝুঁকে পড়া বুক থেকে প্রজাপতি
গন্ধ তুলে নিয়ে কালোমেঘ গাছে ফুটে ওঠো--
তোমার বাড়ির নাম ‘শ্যামলছায়া’ ছিল বলে,
আমাদের বাড়ির নাম ‘শ্যামলছায়া’ হবে বলে
লুডোর অবশ ছকে দান দিতে ভুলে যায় বারান্দা শিশুরা।

********************************







*
অ-নভযাত্রা (১৯৮৭)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

টেটুদা রাত্তিরবেলা আকাশের দিকে তাকাতে বলেছে--
তার চেয়ে কুয়োতলা বারান্দা অনেক ভালো।
বারান্দাটি রোদ পায় খুব, কুয়োতলা ভরে থাকে কাঁঠালপাতায় ;
সামনের কাঁচা ড্রেনে বৃষ্টি পড়ে অবিরাম ---
কালো কালো মাটি আর কচি ঘাসে ভরে যায় টাইগ্রিস নদীর দু’ধার।
ঝুমাদের বাড়ি থেকে ইউফ্রেটিস, মতিকাকুর দোকানের সামনে গিয়ে
সাট্-এল-আরব, কানুদের কালভার্ট হয়ে পারস্য সাগরে চলে যায় ;
পুরনো তাঁবুর মতো ব্যাঙের ছাতারা বেড়ে ওঠে
পিঁপড়ের নিয়মিত সারি যেন ক্যারাভান অববাহিকায় ;
ছায়ায় নরম রোদে দুপুরের ফিরিওলা হাঁটু
ঝালসুজি রান্নার ফিকে গন্ধ টেনে আনে গৌতমদের লালবাড়ি থেকে
বিকেলের ম্লান রোদ কলেজ মাঠের কোনে মরে গেলে
হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে রাহাজেঠু কাউকে বলেন
‘আমি তো সিনিক তোমরা বোঝো না কিশোরী’
কত কাক উড়ে আসে, চালকুমড়ো গাছ থেকে কেঁপে উঠলে মাকড়সার জাল
কষা মাংসের মতো ঘন রাতে কত শব্দ শোনা যায়
দিনে কেউ কখনো শোনে না।
রোঁওয়া ওঠা কুকুরটা ধাক্কা দিলে আমাদের আমাদের টিনের খিড়কীতে
জড়োসড়ো রাতের জোনাকি এখন কেমন যেন নিমকাঠ ;
তেঁতুলবিচির ঘন বাদামী আঁধারে, এলোমেলো কিছু পোকা
সোঁদালের পাতা ভেঙে উড়ে যাচ্ছে লন্ঠনের দিকে
বাদাম গাছের নীচে হাওয়া কিছু ত্রস্ত হল--
গলা একটু খাঁকরে বলছে ‘কে যায়, কোথায় ?’
রাতের লোমের মতো বেড়ালের রোঁওয়াগুলি স্থির।
বাতাবি লেবুর ডাল ঝুঁকে পড়লে উঠোনের ভিতে
শেয়ালের সমস্বর ভেঙে দিচ্ছে রাত্রির প্রতিমা।
নরেশদার বুড়ি মা ঝুড়ি করে ছাই ফেলে--
ছাই উড়ে কুয়োতলা সাদা হয়ে যায় ;
শ্যাওলার উপর দিয়ে পা টিপে টিপে খুব
চুপিসারে হেঁটে যাচ্ছে কেউ, কার যেন হাতপাখা
মশারিতে খস্ খস্ শব্দ শুনি তার--
যেমন ঝিল্লির শব্দ, আমরা যার মর্মোদ্ধারে অক্ষম সতত ;
অথচ কোথাও যেন টের পাই অর্থময় নৈঃশব্দের গূঢ় উপস্থিতি,
কিছু ফেলে আসা ছবি, কিছু দৃশ্য,
প্রকৃতির সঙ্গে সেই চিরায়ত গান্ধর্ব বিবাহে ফেলে আসা কিছু অভিজ্ঞান
স্মৃতি নয়, সত্তা নয়, ভবিষ্যৎ নয়--
অথবা তিনের মধ্যে লুকানো অমর চাবিটুকু
একটি গম্ভীর তালা খুলে ফেলে, শান্ত, ভারী যেন অনুভব ;
কি করে বোঝাবো তাকে--পরিব্যাপ্ত দরোজার পাশে
ছোট্ট চৌকাঠে চেষ্টা মনে করো--স্মৃতি নয়, বিস্মৃতিও নয়,
স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে অনাদি অনন্ত ইঞ্চি বড়ো।

********************************







*
লে ফ্ল্যর দ্যু মাল (১৯৮৮)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

যে ছেলেটি বড়ো হলো রোদ আর বিকেলের বাফার অঞ্চলে,
মেঘ যাকে বলেছিলো বারান্দা ও শিশুদের ছোঁওয়াছুঁয়ি খেলা,
বৃষ্টি যার ঢুকে আছে অনন্ত পাতার শব্দে গূঢ় মফস্বলে--
অশ্রু আর বৃষ্টি পতনের মধ্যে যে হাঁটছে একা, আর একাকীত্ব হেঁটেছে মাঝখানে,

তখন বিস্তর রোদে গাছেদের গা বেয়ে গড়াচ্ছিল ঘাম--
ভালবাসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না
সাইকেলে পেডাল করে বৃষ্টি এলো বারান্দার কোনে
মুড়ি খাবে বলে কেউ হুটোপাটি করে একা চাটাই বিছালো--
যার হাঁ করা চোখে ফুটে উঠল ঘরবাড়ি, শহর, মেয়েটির বইয়ের ব্যাগ,
ভিজে বগল, ব্রা--বই ভিজে গেছে কিশোরীর।

ঝুলন সাজিয়ে একা যে বালক বসে ছিল শ্রাবণ প্রহরী
ভাঙা পাহাড়, রঙচটা রাধাকৃষ্ণ, বেমানান বড়ো টিয়ে, ‘কি বিষ্টি কি বিষ্টি’—
আগামী রোদের দিনে সেও তো মেঘের কথা ভুলে যাবে
যেভাবে দ্বীপের দিনে আমরা জলের কথা ভুলে যাই--
যাপিত প্রতিটি সন্ধে যেভাবে মৃত্যুর কথা ভুলে আছি
রাতের যোনির মতো লন্ঠনের আলো দেকে কেঁপে উঠছে
বৃষ্টিভেজা বাদামওলার ভাঙা কুপি ।
সতর্কে নিভিয়ে লাইট দ্রুত যাচ্ছে এভারেডি ভ্যান,
মর্টারের মতো ফোঁটা আছড়ে পড়লে প্রাকারে পরিখায়
মূক মিনিবাসগুলো ছাতে স্মোকবম্ব আর পেটের ভেতরে কিছু
দলামোচড়া মাংস নিয়ে চলেছে শেলটারে --

নিয়ন আলোয় জ্বলছে গ্র্যাভিয়েরা , স্যুটিং শার্টিং ;
বৃষ্টি যেন ওল্ডমঙ্ক্ রাম, আধখাওয়া বীফস্টেক
ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছে পাথরে, কাদায় !

রাতের ডায়ালে নীল রেডিয়াম চিহ্নদের মতো
বহু দূরাগত সুর ভেসে আসে আরো নীল মশারির কানে
ভরা কোটালের ছবি, বর্ষার নিয়ত অভিমানে
আমরুলের ম্লানগন্ধে ঢুকে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে।

যেন শৈশবের ব্যথা, যেন ব্যথা নয় ব্যথার ইঙ্গিত ;
যেন ইঙ্গিতের দিকে আবসন্ন আঙুলের ক্ষীণ দৃষ্টিপাত
অমোঘ চকিত স্পর্শে আমার পাঁজরে প্রাগিতিহাসের পামসারি---
অনন্তের অভ্যেসের মতো তোমার, আমার ছেলেবেলা
রক্তাভ মণির চিহ্নে অজস্র শালুকে ফুটে ওঠে আমাদের চোখের পুকুরে।

নরকে অনেক ঋতু, নরকে অনেক রাত জেগে , খুব ভোরবেলা
একা আর শান্ত পুকুরের কোনে পাঁকের কুসুমগুলি ফুটে ওঠো ;
আমাকে বানাও ব্যাধ, বিদ্ধ করো সহস্র সায়কে !

********************************







*
সীমান্ত সংবাদ (১৯৮৮)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

কল্যাণী, সীমান্ত থেকে যখন এই চিঠি লিখছি
তোবড়ানো হেন্ডোলিয়ামের বাটির মতো থমথমে আকাশ
আর সন্দিহান সুপুরির সারি, তুলোট ও লেখনীর ভুমিকা নিয়েছে ।

দিক্ চক্রবাল নাকি দিগন্তের ফ্যাকাশে ব্যান্ডেজে
দগ্ দগে ঘায়ের থেকে ঝরে পড়ছে ঘন লাল স্রোত ;
সিরিঞ্জর মতো স্থির শিহরিত সন্ধ্যার বাতাসে
ডেটলের ভারীগন্ধ কুয়াশার কম্বলে জড়ানো ।
এছাড়া সমস্ত শান্ত পশ্চিমের স্তব্ধ রণাঙ্গনে,
শেয়ালকাঁটার তীক্ষ্ম বেয়নটে উড়ে বসছে লাল প্রজাপতি।

পথের হৃদয় ছিঁড়ে চলে যাচ্ছে ট্রাকের বিরহী গান,
ধূমছায়া গোধূলিতে অস্পষ্ট দাগের মতো
কানাতের যাত্রীরা চিত্কারের মতো কোনো গান গাইছে,
কথা বলছে কিছু নাকি শুধু হাওয়ার উত্তরে কেঁপে উঠছে বারংবার।
সবুজ চিতার মতো নীলচে পাহাড় আর পাড়ভাঙা প্রসন্নতা
উজিয়ে সূর্যের দিকে চলে যাচ্ছে স্টেট এক্সপ্রেস।

ডিমকালো সোয়েটারে রূপসী বালক কাকে ডাকে
রিক্সা নাকি বিকেলের কানামাছি খেলা--বিকেল পাগল করে তাকে।
রোদের দক্ষিণবাহু পুণ্যিপুকুরের জলে স্নানার্থিনী বালিকার মতো
কত খই ছড়ায় সহসা ; যেন ঝরা পাতা--
আদিম সংলাপগুলি মেঘ হলে, মনুসংহিতার চাঁদ
আমূর্ধা শ্লোকের মতো ভেসে ওঠে হাওয়ায়, হাওয়ায় ;
অনেক পাথরে তার নাম লিখে গোপনে ভাসালে জলাশয়ে
পৃথিবী লুকিয়ে যেন থামের আড়ালে একাচোরা বালিকাবয়সে
এই দৃশ্য দেকে কিছু ম্লান হয় আর
চোখের কাজলে তার ছায়া পায় যুবক-যুবতী ।
দূরের মসজিদ থেকে চেতনার ক্ষীণ রক্তপাতে
মেঝেন্ নরম হলে উস্ কে দেয় সলতে পারা রাত।
রেলব্রীজে স্বয়ংক্রিয় সিগ্ ন্যালে রক্তাভ ধমকে
আচম্বিতে শিউরে ওঠে কুয়াশার ক্লান্ত মেলট্রেন --
আর্তচিত্কারের মতো মৃত্যুপথযাত্রী সেই অনন্ত সাইরেনে
জানালা দিয়ে ছোঁওয়া যায় চাঁদের বাড়ানো হাত।
ঝিনুকের খোলের ভিতরে, নক্ষত্রের চোখ থেকে ঝরে পড়া জল
ডুবুরির মুঠো থেকে খসে পড়লে--
রাতগাউনের মতো মিহি কুয়াশা,
আর পশ্চিমের হলুদ বোতাম--
আদিগন্ত মৈথুনের পর বৃষ্টির নিঝুম ছুঁয়ে
চিবুক ওঠায় মুখোমুখি--
ধর্ষণের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে সলাজ কিশোরী সর্ষেক্ষেত,
ওকে একটু বিষ দিও সকালের প্রথম চাষীটি ।
ভোরের ডেয়ারি থেকে নিঝুম বাংলোর দিকে
সাইকেল আরোহী এক কুয়াশা বেরুল--
বাঁধাকপি পাতাগুলি পোকাদের ডেকে নিল হৃদয়ের দিকে--
সূর্য একটু দেরী করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন, কিশোরী রক্তিম হল
ঐ যায়, দৌড়ে যায় আলপথ দিয়ে।

********************************







*
একটি তারার তিমির (১৯৮৯)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

রেলবগিদের পিঠে বুড়ি চাঁদ পেঁচাদের কথা জেনে
শামুকের মতো সিটিশঙ্কিত ; যেন জ্যোত্স্নার তুক্
কালো ছিপি খুলে ছুঁড়ছে আকাশে, উথ্বিত শ্যাম্ পেনে
মদির মাঠেরা, একা প্ল্যাটফর্ম আধো আধো জাগরূক।

নিশাচর কাফে, বাদুড়ের মতো নিঝুম রেলের ইয়ার্ড ;
কালো ডানা মেলে শেষ নেশাতুর কাফেটেরিয়ার ট্রেন--
ইম্প্রেশনিষ্ট রাতের টেবিলে চিরায়ত বিলিয়ার্ড
যেন ভান গখ্ বিষণ্ণ একা তুলি হাতে দাঁড়ালেন !

মধ্যরাতের ভ্রমণকাহিনী ভুলে যেতে লাগে সারাদিন।
রুজরক্তিম পুবের টেবিলে ব্রণ জ্বলে সারি সারি,
রেটিনার জল ঝিনুকে জমিয়ে ডুবুরি ঠকানো তারাটি
মিথ মন্থনে, তুলে আনে মনে ইহুদী ভ্রমণকারী।

দুপুরের দিকে মিছিলের মুখ এত মাজা মনে হয়
যেন ঘটিবাটি তুলে রাখা আছে দুরন্ত ডানপিঠে
রোদের আড়াল, তবু রাজপথে হেঁটে হেঁটে অসময়
ফিরে আসে ম্লান সন্ধের ছায়া পি. সি. সরকার স্ট্রীটে।

কাস্ লের গেটে একা ক্রুসেডার, বর্মের বুকে যেন কেউ
বিঁধিয়েছে ছুরি ; কৃপাণ চিহ্ন বৃষ্টির মতো ভারী--
বেহড়ের বুকে কত বাস চলে, চম্বল অ্যাভেনিউ
এস্ প্ল্যানেডের গুহামুখে আনে অষ্ট্রিক নরনারী।

টিটেনাস ট্রামে ঝোলে বাঁকা রোদ যেন বিকেলের বিকিনি ;
পেনিসিলিনের আলো জ্বলে ওঠে ভূগর্ভ অ্যাম্পুলে--
প্যাস্টেলে আঁকা খোঁচা খেঁচা দাড়ি ঘামে তেল রঙ শিখে নেয়,
টলে টলে হাঁটে, পিচের প্যালেটে স্প্যাচুলার ক্ষত ভুলে।

এই যে শহর ছিল কি ছিল না তিনশো বছর আগে
জল জঙ্গলে জরায়ুর মতো আদি মানুষের বাড়ি ;
প্রসবের ব্যথা যেন টের পাই স্তম্ভিত পুরোভাগে
ডবল ডেকার ছাড়ে যানজট যেন আঁতুড়ের শাড়ি !

শুধু শিকলের সুলুক সরালে ঊরুসন্ধির বিবরে
শরীরে শরীরে যোগ করে তবু হৃদয়ের ক্ষীণ রাডারে
বোতলের ছিপি খোলে আফ্রিদি, জাল হাতে থাকে ধীবরের ;
বলে কাম নেই, বলে প্রেম নেই, এই অনুভব আঁধারের।

একে বাঁচা বলে, জীবনের মানে খুঁজে না পেলে সে বিরোধী ।
শতাব্দী জুড়ে মানবদরদী ঘেয়ো কুকুরের চিত্কার ---
পূর্বপুরুষ শ্মশানে পুড়েছে ভাবী প্রজন্ম নিরোধে
অথচ করুণ সাদা বিবমিষা বিয়োগের কালে শীত্কার ;

বল কোথা থেকে কিভাবে এসেছি কোথায় চলেছি ডোমিনি ?
এই ডুবে যাওয়া, এই ভেসে ওঠা, জেগে জেগে ওঠা কাফনে--
যদি নোয়া থেকে নিকারাগুয়ায় প্লাবন কখনো কমেনি
অলীক ভ্রমণে কেন নিয়ে এলে এই অকারণ যাপনে ---

ইভের শরীরে আদমের খিদে কেন রেখে গেলে প্রাজ্ঞ ?
অথচ বোধের যন্ত্রণা দিলে, বুদ্ধির দ্বিধা রক্তে--
কুকুরের কামে, জ্ঞানে ও নরকের সাজা---মাটি পৃথিবীর তখ্ তে !

পাহাড় শিখরে জমে ওঠে পুঁজ, দুপাশে চড়ানো তুলো,
ডেটলবৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে যায় কুয়াশার কম্বল --
অপারেশনের টেবিলে আকাশ যেন পাশ ফিরে শুলো
সোনালী ঊরুতে ফোটে চিরায়ত লাল কার্বাঙ্কল !

শ্রেণী সংগ্রামে ব্যর্থ বাঙালি পালিয়ে বেঁচেছে পাহাড়ে
দশকের দাবী পালটে দিয়েছে শ্রেণীশত্রুর সংজ্ঞা ;
থাই পাহাড়ের চেয়ে আরো ভারী এ্যাতো ফুল ধারে ধারে--
প্রকৃতির গোদে বিষফোঁড়া দেকে বলে কাঞ্চনজঙ্ঘা !

তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো বিষাদের ঋতুমাখা
শোভনগমনা, চাকা চিরায়ত জবাকুসুমের রথে--
সময় সরণী টায়ারে পিষেছে স্মৃতি জোনাকির পাখা ;
সে ঝরা বকুলে দাঁড়িয়ো না তুমি অই যুবাদের পথে।

তোমাদের মুদি, পানের দোকানি, পাড়াতুতো দাদাকেও
মনে হয় বলি ভূমিকা বদলে আমি সোত্সাহে রাজি ;
কন্ডাক্ টারও, হাত ধরো তারও ; ঈর্ষাভাজন সেও,
খুব ভিড়বাসে, তোমার পিছনে যে যুবাকে বলো পাজি !

কালো কোলো গেঁয়ো কাজের ছেলেটি তুমি যার দিদিমণি ;
তোমাকে দেখার অধিকার যার প্রতিদিন প্রতিরাতে
সিঁড়িভাঙা থেকে শিখিয়েছো যাকে সরলের বন্ধনী --
গোপনে তাকেও করেছি হিংসা গূঢ় অভিসম্পাতে !

জেনেছি আঁধার একা বওয়া ভার, সুগভীর সন্ত্রাসে
সম্পর্কের সাদা কালো সুতো কিপুর জটিল গ্রন্থি
ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়, তবু টেবিলের শেষ তুরুপের তাসে
আমরা দুজনে যৌথ জীবনে একাকীত্বের পন্থী !

তোমাকে দেব না রক্তাভ সিঁথি, শ্বেতকরবীর মালা ;
অথবা রঙিন সাপ্তাহিকের রক্তিম গল্পটি--
আফ্রিকা থেকে কালো ফুল দেব, কেশরের কাম্ পালা
ফুটপাথ থেকে বোদলেয়ারের বই কিনে দেব সখী ।

কালো ভালবাসি, রাত্রির মতো, জীবনের মতো কালো
শাড়ি পরে হেসে দাঁড়াবে না এসে সূর্যের সোজাসুজি ?
সাত রঙ শুষে ভুরুর চিহ্নে মুছে নেবে সাদা আলো ;
সেই চন্দ্রিমা --- আমি তো বুঝি না আমি কালো ভালো বুঝি ।

নিবু নিবু আলো, যেন বলিরেখা কুঞ্চনশীল নিশীথে,
যেন বহদূর দেখার প্রয়াসে রাতের আঁখিরা ক্লান্ত---
যেন বাসি ফুল কালো জল থেকে সাদা কুয়াশার শিশিতে,
যেন মহাদেশের ফুটে ওঠা গ্রাম, চেনা অচেনায় শান্ত।

যেন মাঠ জুড়ে খেজুরের ঘ্রাণ আঁধারের কলসীতে
ঠোঁটে মুছে নেবে জ্যোত্স্নার ফেনা, সাদা সানকির টিপ ;
কুয়াশার চোখে শিশির গড়াবে, ভোরের সোনালী ফিতে
প্রান্তরব্যাপী রাতের কবরী বেঁধে দেবে প্রান্তিক !

গ্রামছাড়া পথ বাউলের মতো চলে যায় ধীরে ধীরে
প্রথম বাসের চাকায় জড়াবে কান্নায় ভেজা বালি,
বেগুনী পাতারা উঁকি দেবে নীল কুয়াশার গম্ভীরে ;
দিগন্তব্যাপী শীতে শিরিষের বিষণ্ণ করতালি।

ভোরের আলোতে অচেনার মতো মনে হবে এই গ্রাম,
বিষাদের খড়ে আনন্দবেড়া, রীতিনীতি উঠোনের
পরতে পরতে খুলে যাবে রোদে, আধো আধো অবিরাম--
বিগত রাতের মলিন তারাটি কেউ কি পাবে না টের ?

বাঁকে বাঁকে নদী, শ্মশান সমীপে চিতাকাঠ ভেসে যায়,
এ পারের চরে ছাড়ে নিঃশ্বাস ওপারের ঘন হাওয়া--
বৈশাখ মাসে হাঁটু জল থাকে, শ্রাবণের সন্ধ্যায়
জোয়ারের ডাকে সাঁতার সমাধি অনন্ত ভেসে যাওয়া--

আমাদের এই গাঁয়ের নামটি সকলেই জানে পৃথিবী,
আমাদের এই নদীর নামটি সময়ের নামে রাখা সে--
আমার নাম তো অজ্ঞাত থাকে পাথরে ফসিলে চিরদিন--
আমাদের সেই তাহার নামটি ---তারা হয়ে ওঠে আকাশে !

********************************







*
রান্নাঘর (১৯৯০)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

হাঁসের ডিমের মতো চাঁদ ওঠে আঁধারের হাতে,
কোজাগর মধ্যরাতে দূর থেকে কেউ গান গায় ;
পুবদিক সাদা হলে ফেলে দেওয়া ডিমের খোসাতে
আকাশের সস্ প্যানে পোচের কুসুম ফেটে যায় !

গুঁড়ো হলুদের রোদ, জিরে ছায়া কড়াতে চাপিয়ে
কারখানায় আঁচ দেয় বাটনা বাটে বেলা দ্বিপ্রহর ।
ধোঁওয়া আর যানজটে পেঁয়াজ ছাড়াতে বসে গিয়ে
ঘামের, তেলের গন্ধে কেঁদে ফেলে একাকী শহর।

আমাদের কিছু নেই, শুধু এই রান্নাঘর ছাড়া
মাঝে মধ্যে শোনা যায় বেড়ালের করুণ কাঁদুনি ;
শাকে মাছে মুখ দেয় -- ও ব্যাটা তো পাজির পাঝাড়া
লাথিঝাঁটা মারে ওকে সামাজিক সফল রাঁধুনী।

রাঁধুনীরা গল্প করলে হাই তোলে ঘুমের আবাদ,
আদিম রান্নার ঘরে বেড়ালের নখে ওঠে চাঁদ।

********************************







*
সম্ভাষণ (১৯৯০)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

ভাল আছ জানি তবু শহরের মেয়ে
ভাল আছ জেনে এ্যাতো হু হু করে বুক ;
এ্যামন কপাল পোড়া আকাশও কামুক
হয়ে আছে আমাদের আলপথ বেয়ে।

লজ্জার সমস্ত রঙ মেঘের কপালে
লেগেছে. অথচ দ্যাখো বেহায়া সূর্যের
ভালবাসাবাসি ওতে মিশে আছে ঢের।
খারাপ থাকার ভানে মাঠে আর আলে

ঘাসগুলো ভাল থাকেষ গরুরাও ভাল
থেকে থেকে মরে যায় ; বাছুরের ডাক--
তুমি ভাল আছ জেনে ভীষণ অবাক
হয়েছে, অথচ জানো বিকেলের আলো

আমাকে নিদেন সুরে বলে গেল এই,
তুমি ভাল আছ জেনে আমি ভাল নেই।

********************************







*
মাংসব্যবসায় (১৯৯০)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

এ্যাতো ম্লান লাগে এ্যাতো অর্থহীন মনে হয় সব,
মরা বকুলের পাশে কুকুরের যৌথ আর্তনাদে--
পাঁশুটে বেড়ালগুলো এ বাড়ির ও বাড়ির ছাদে
নেমে এলে শুরু হয় আমাদের বসন্ত উত্সব !

মেঘের ন্যাপকিন ছুঁয়ে আকাশের জঙ্ঘা লাল স্রাবে
দিগন্তের যৌনলোমে ক্লিটোরিস হারায় গভীরে,
যে পাখি একাকী ওড়ে মানুষের চিরন্তন ভিড়ে
চিত্রকল্পটির থেকে ডানা তার কত দূরে যাবে ?

রাত্তিরের মাংস দেখে টান টান পুরুষের ছিলা--
বাল্মীকির বিছানায় উঠে এলে চিরায়ত উই,
অর্থহীনতার পরে অবশিষ্ট রাত যদি শুই
শ্বাপদের শব্দ বলে--- ‘কবিতা তো রাতের অছিলা।’

লিখি, হাগি, সহাস্যে ঘুমোই তবু জানি
বিকেলের রক্ত বেচে রাত্তিরের মাংস কিনে আনি !

********************************







*
ভ্রমণসঙ্গিনী (১৯৯০)
কবি অচ্যুত মণ্ডল
কবির মৃত্যুর পরে ২০১১ সালে প্রকাশিত, শিল্পী তন্ময় মৃধা সম্পাদিত কবির একমাত্র কাব্যগ্রন্থ "একটি তারার তিমির" থেকে নেওয়া।

করুণ ভাঁটির গঞ্জে দুপুরের ছায়াদির বাড়ি ;
ম্লান মেঝে, স্নানঘরে নেমে আসে রোদের বেড়াল --
নিঝুম পাঁচিল দেখে নুয়ে পড়লে পেয়ারার ডাল
অচেনা দুঃখের মতো মনে পড়ে সঙ্গিনীর শাড়ি।

ঘরের ভিতরে এলে মনে হয় সোঁদা গন্ধে চেনা
এই ভিত, জানালার ঠান্ডা শিক, কুলুঙ্গিতে ধূপ,
ইচ্ছে করে রোদ কারো বিষণ্ণ অধরের অপরূপ
হলে এই বসে থাকা কেন বলো অনন্ত হবে না ?

ভরা কোটালের ঢেউ চাঁদের কামড়ে অ-বাস্তব
রাত্রি তার গিরিখাত আমাদের শেখায় সমূলে ;
সঙ্গিনীর শুভ্র হাত জানালার পর্দা দিলে তুলে---
অন্ধ করে দাও সখী, জ্যোত্স্না এসে দেখে যাক সব।

রাতের আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্পে লেলিহান লাভা
ভুলে গেছি। মনে পড়ে ভ্রমণের অনন্ত গোসাবা ---

********************************