কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ – জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ব্রহ্মণবাড়িয়া মহকুমা শহর (এখন জেলা)
এর উপকণ্ঠে গোকর্ণঘাটের তথা মালোপাড়ায়, তিতাস নদীর তীরবর্তী এলাকায়। পিতা অধরচন্দ্র মল্লবর্ণ
ছিলেন জমিজমাহীন জনমজুর। মাতার নাম সম্ভবত সারদা মল্লবর্মণ ছিল। অধরচন্দ্রর নিজের বসতভিটে
ছাড়া আর কিছু ছিল না। এমনকি নিজস্ব নৌকা বা জাল কিছুই ছিলনা তাঁর। কিন্তু নিরক্ষর হয়েও তিনি গান
বাঁধতে পারতেন।
ছোটবেলা থেকেই কবির সাহিত্যে আগ্রহ ছিল। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে তিতাস নামক কবিতাটি লেখেন। কলেজে পড়ার আগেই শিশুসাথী খোকাখুকু
মাসপয়লা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। পিতার কাছ থেকে পাওয়া গান বাঁধার গুণে
তিতাস নদীর তীরবর্তী মুসলমান এলাকায় “গানদার” নামে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অদ্বৈতর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এডওয়ার্ড হাই স্কুলের শিক্ষক তথা গোকর্ণঘাটের “সনাতন মাস্টার”-এর প্রত্যক্ষ প্রেরণায়
অদ্বৈত লেখাপড়া শুরু করেন। ভর্তি হন ব্রহ্মণবাড়িয়া মাইনর স্কুলে। ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক
পরীক্ষা পাশ করেন। পরের বছর ভর্তি হন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে। বিপ্লবী দলের কল্পনা দে রায়ের
বাড়ীতে গৃহশিক্ষক হিসেবে থেকে কোনওমতে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে কল্পনাদেবী গ্রেপ্তার হলে
সে সুযোগও হারছাড়া হয়ে যায়।
কল্পনা দেবী গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে ১৯৩৪ সালেই তিনি পড়া অসমাপ্ত রেখেই কলকাতায় চলে এসে ত্রিপুরা
পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত “নবশক্তি” পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে
যোগ দেন। লেখেন “ত্রিপুরালক্ষ্মী” কবিতাটি যা ভূপেন্দ্রনাথ সাহিত্যভূষণ সম্পাদিত “ত্রিপুরালক্ষ্মী” পত্রে
প্রকাশিত হয়। এই সময়ে “নবশক্তি” পত্রিকায় তাঁর “দুটি বারমাসী গান”, “এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়”,
“পল্লীসঙ্গীতে পালাগান” প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবন্ধও প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময়ে তাঁকে সম্পাদনার কাজে
সাহায্য করতেন সাগরময় ঘোষ। ১৯৩৮ সালে তিনি “নবশক্তি”-র সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। কলকাতার ১৬
নর্থ রেঞ্জে ভাগনে ভাগনি সহ বিপ্লবী কল্পনা দে রায়ের সঙ্গে থাকেন। ১৯৩৯-৪০ সালে যোগ দেন “মোহাম্মদী”
পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কাজ করেন “আজাদ” পত্রিকায় প্রুফ দেখার। ১৯৮১ সালে “নবশক্তি”
থেকে বেরিয়ে এসে সম্পাদনা করেন “দলবেঁধে” নামক গল্পগ্রন্থ। ১৯৪৫ সাল নাগাদ তিনি “মোহাম্মদী” পত্রিকা
ছেড়ে যোগ দেন “দেশ” পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সহকারী হিসেবে। ১৯৪৫ সালে “দেশ”
এর দপ্তরে দেখা হয় সৈয়দ মুজতবা সিরাজের সঙ্গে।
এই "দেশ" পত্রিকার সময়েই সাগরময় ঘোষের অনুরোধে, শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগ-এর জীবন অবলম্বনে
আরভিং স্টোনের লেখা “Lust for Life” উপন্যাসটিকে “জীবনতৃষ্ণা” নামে বাংলায় অনুবাদ করেন
ধারাবাহিকভাবে, মার্চ ১৯৪৯ থেকে মে ১৯৫০ পর্যন্ত। সাগরময় ঘোষের উত্সাহদানেই সৃষ্টি হয় অদ্বৈত
মল্লবর্মণের যুগান্তকারী রচনা “তিতাস একটি নদীর নাম”। ১৯৭৩ সালে উপন্যাসটির চলচিত্রায়ণ করেন
প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।
তাঁর রচনা সম্ভারে রয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস “রাঙামাটি”, শাদা হাওয়া : গল্প “সপ্তানিকা” ; ছোট গল্প
“স্পর্ষদোষ”, বন্দী বিহঙ্গ ; প্রবন্ধ “মাঘমণ্ডল”, “রোকেয়া জীবন”, “জলসওয়া গীত”, “অপ্রকাশিত বাউলসঙ্গীত”,
“অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া”, “নাওয়ের গান”, “ভাইফোঁটার গান”, “পরিহাস সঙ্গীত”, “পাখীর গান”,
“বরজের গান”, “উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত”, “ভারতের চিঠি---পার্ল বাক”, “প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি”,
“টি এস ইলিয়ট”, “ছায়াছবির ছবি ও কাহিনী”, “নাটকীয় কাহিনী”, “ছোটদের আঁকা” প্রভৃতি।
১৯৫০ সালেই আক্রান্ত হন টিবি বা ক্ষয়রোগে। চিকিত্সাধীন ছিলেন কাঁচরাপাড়া হাসপাতালে। ১৬ই এপ্রিল
১৯৫১ তারিখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তাঁর নারকেলডাঙার ষষ্ঠিতলার
বাড়ীতে।
আমরা মিলনসাগরে কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সফল মনে করবো। এই পাতা তাঁর জন্মশতবর্ষে, তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। এই
জীবনরেখাটি উত্পল ভট্টাচার্য সম্পাদিত কবিতীর্থ পত্রিকা, বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যার অমলকুমার মণ্ডলের লেখা
অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাটি থেকে তৈরী করা।
কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উত্স - উত্পল ভট্টাচার্য সম্পাদিত কবিতীর্থ পত্রিকা, বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যা।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ৯.৭.২০১৪