কবি অজিত পাণ্ডে – জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায়। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ পাণ্ডে মাতা
তরুলতা দেবী। পিতা আজীবন পুরোহিতগিরি করেছেন। বাড়ীর অবস্থা খুব স্বচ্ছল ছিল না কিন্তু বাড়ীতে
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা ছিল।
কর্মজীবনে একসময় হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার কেশোরাম রেয়নের কর্মী ছিলেন।
তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। সদস্য হয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। পরে নকশাল আন্দোলনের
সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ এর জানুয়ারীতে তাঁকে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতে হয়। হাজারিবাগ সহ বিহারের
অনেকগুলি জেলে তিনি ছিলেন।
নকশাল আন্দোলনে একটি নেতিবাচক দিক ছিল ব্যক্তিহত্যা বা খতম বা অ্যানিহিলেশন। যাঁরা উর্দ্ধতন
নেতৃত্বের হুকুম অমান্য বা প্রতিবাদ করতেন তাঁদেরও গদ্দার বলে খতম করে দেওয়া শুরু হয়েছিল। এই
আন্দোলনে বিশ্বাসী বহু মানুষ এই ব্যক্তিহত্যার কথা মেনে নিতে পারেননি এবং তাঁদের অনেকেই
প্রত্যক্ষভাবে দলের কাজকর্ম থেকে সরে আসেন, বা একেবারেই বেরিয়ে আসেন।
কবি গণসঙ্গীতকার অজিত পাণ্ডে, জলার্ক পত্রিকাকে ( নুরুল তরাই : অজিত পাণ্ডের গান, স্বপন দাসাধিকারী
সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ২.৬.১৯৯৭ তারিখে প্রকাশিত “যুদ্ধজয়ের গান”, গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪৭২ ) দেওয়া এক
সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন যে চারু মজুমদার সেই অর্থে অত্যন্ত সাংস্কৃতিক মানুষ ছিলেন এবং অত্যন্ত
ক্ষমাপরায়ন। সরোজ দত্ত ক্ষমাশীল ছিলেন না। উত্পল দত্ত, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পরে, প্রফুল্ল ঘোষের
মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে, যখন রাতারাতি কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করা শুরু হলো, তখন মিনার্ভা থিয়েটারে তীর
নাটক চলছিল। তিনি আণ্ডাগ্রাউণ্ডে চলে যাওয়া মনস্থির করে আসানসোল চলে গেলেন। কিছুদিন
পরেই তাঁকে বম্বে থেকে ধরা হয় আইভরী মার্চেন্টের একটি সিনেমার শুটিং করার সময়ে, একটি তানপুরা
নিয়ে! নকশালদের, আমেরিকানদের ছবি করা তখন ভাবাই যায়না! সেই ঘটনায় চারু মজুমদার, উত্পল
দত্তকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের ঝরিয়াতে একবার অজিত পাণ্ডে, সরোজ দত্তর
কাছে প্রতিবাদ করেন রাজধানী এক্সপ্রেসকে উল্টে দেবার বিরুদ্ধে। সরোজ দত্ত জিজ্ঞেস করেন যে তিনি
এসব লিখিত দিয়েছেন কি না। তিনি “হ্যাঁ” জানিয়ে বলেন --- “রাজধানী এক্সপ্রেসকে উল্টে দেওয়া ঠিক নয়,
ট্রেনে দরিদ্র মানুষও থাকে ; ভিয়েতনামেও কেউ এইভাবে ট্রেন উড়িয়ে দেয়নি। এসব বলাতে এরা আমাকে
থাকতে দিচ্ছে না। গদ্দার বলছে। আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্রেসে যে সে চলে আসছে---গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে, কেউ
কারো কথা শুনছে না। আমার মনে হচ্ছে সেন্ট্রালিজম থাকাটাই জরুরী”। সেই সময়ে পাশ থেকে একজন
বললেন --- গদ্দারকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হল বিপ্লবের ক্ষতি। সরোজ দত্ত বললেন, আপনার কাছে চারু
মজুমদারের কথোপকথনের যে টেপ আছে, দিন। চারু মজুমদারের সাক্ষাত্কারের টেপটি অজিত দত্ত নিজেই
টেপ করেছিলেন। সেটি তিনি খুব বাজাতেন। নকশালবাড়ী মুভমেন্ট কি করে গড়লেন --- জেলে থাকতে
থাকতে প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরী, সুবোধ চৌধুরী আলোচনা করেছেন, জেলে বাইরে
এসে কিভাবে আর্মড স্ট্রাগল করলেন --- এই সব ছিল সেখানে। এই সব কথাবার্তা নিয়ে চারুবাবুর সঙ্গে
অজিতবাবুর দীর্ঘ বাদানুবাদও ধরা ছিল টেপে। তা ছাড়া উত্পল দত্ত, তীর নাটক, মিনার্ভা থিয়েটার ইত্যাদি
অনেক প্রসঙ্গ ছিল। সরোজ দত্তকে টেপটি দিয়ে দেবার পরে তিনি বললেন --- “আপনাকে এক্সপেল করছি”।
এই বলে সরোজবাবু বেরিয়ে গেলেন। এটাই ছিল অজিত পাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ! তিনি তখন কোনো
রকমে পালিয়ে বাঁচেন। তিন চার দিন পরে ধরা পরেন। তাঁর সঙ্গের ছেলেটিকে মেরে ফেলা হয়।
পরবর্তি কালে তিনি মার্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ( C.P.I.M ) মতাদর্শে বিশ্বাসী হন।
ছয়ের দশক থেকে লেগে পড়েন গণসঙ্গীতকে সংগ্রামের সাথী করে নিয়ে। বাম আন্দোলনের ডাক পেলেই
ছুটে যেতেন। গানকে জীবিকা করে নেবার পেছনে অনেক ঝক্কি ছিল। সময়ে পারিশ্রমিক মিলতো না। ছাত্র-
যুব আন্দোলন থেকে গণসংগ্রামের পরিধিতে একটা কথা চালু ছিল --- কিছুই নেই ফাণ্ডে/ আছেন অজিত
পাণ্ডে!
৭০ এর দশকে, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ট্রেনে, পথে ঘুরে ঘুরে সেই
সরকারের বিরুদ্ধে গান গেয়েছেন।
১৯৯৮ সালে বউবাজার বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে তিনি বিধায়ক
হয়েছিলেন।
তাঁর প্রথম রেকর্ড বার হয় ১৯৭৬ সালে ইনরেকো থেকে। তিনি গেয়েছেন লালনের গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত,
নজরুল গীতি, পল রোবসনের গান, সুকান্তের কবিতাকে গানে প্রকাশ করে। তাঁর বিখ্যাত গানের মধ্যে
রয়েছে “চন্দনপিড়ির অহল্যা গো”, চাসনালা খনি দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে লেখা “রাতকে বিত্যায়লাম হো”, “চাসনালা
খনিতে”, কবি বিপুল চক্রবর্তীর লেখা গান “লদি সুখা পইখর সুখা” প্রভৃতি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “লেনিন”
কবিতাটিতে সুরারোপ করেও তিনিব প্রশংসা পান।
ছয়ের দশকে বিশেষভাবে “নন্দন” পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গানের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বাঁচানোর জন্য
“নবজাগরণ” মঞ্চে সামিল হয়ে দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের জন্য পথে নেমেছেন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "আলোকিত ইচ্ছের তরীগুলি" (যৌথভাবে)।
তাঁর প্রাপ্ত সম্মাননার রয়েছে মস্কো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গণশিল্পী হিসেবে ভারতের এরমাত্র প্রতিনিধি,
ঋত্বিক পুরস্কার, ডিসেরগড় ও লালগোলায় নাগরিক সম্বর্ধনা।
আমরা মিলনসাগরে কবি অজিত পাণ্ডের কবিতা ও গান তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
এই প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স - গণশক্তি, গান থামালেন অজিত পাণ্ডে
. অমিতাভ মালাকার, সমান্তরাল, অজিত পাণ্ডে
. এই সময়, প্রতিবাদ থামল অজিত পাণ্ডের
. কল্যাণ সেনবরাট, মাঠ-ময়দানের শিল্পী ছিলেন অজিতদা
. অসীমকৃষ্ণ দত্ত ও আবদুস সামাদ সম্পাদিত “আসানসোল শিল্পভূমি : কবি ও কবিতা” (২০০৫)
কবি অজিত পাণ্ডের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২৭.১০.২০১৩
পরিবর্ধিত সংস্করণ - ৬.১১.২০১৫
...