পাতা ঝরে যায় ঝরুক তবু গাছ তো বেঁচেই আছে শুকনো হলেও তারি মাঝে পাবে বাঁচার সে স্পন্দন |
শুকনো ডালেতে দুহাত বাড়িয়ে রয়েছে আকাশ পানে সূর্য ওঠার শুভ লগ্নেরে জানায় সে অভিনন্দন || পথ দুর্গম জানি হবে তবু আমরা যে নির্ভীক বিন্দুমাত্র হতাশা এনোনা বক্ষে | জেনে নিয়েছি যে পথ দুর্গম হোকনা যতই বন্ধুর এ পথে হাঁটলে নিশ্চয়ই যাবো লক্ষ্যে || মনের সকল জড়তা কাটাতে নিতে হবে আজ দৃঢ়তা, হতে হবে আজ নির্ভীক প্রাণদানে শত্রু মেঘেরা ঠেকাতে পারে না সূর্য ওঠার লগ্ন বুকের রক্ত ঢেলে সূর্যকে আনবো সসম্মানে ||
তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা অঙ্গীকারকে অস্বীকার করছিনা আমি জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাই তাই তো আমি যখন নিজেকে লেনিন মনে করি তখন তোমাকে ক্রুপস্কায়ার মত পাশে পেতে চাই | যখন সমগ্র পৃথিবী গর্ভবতী রমণীর মত দিন গুনছে দাবী করছে চিরন্তন মাতৃত্বের সাথীদের রক্তের বিনিময়ে ঘাতকদের পরোয়ানা তৈরী হচ্ছে আমাদের চোখের জল শুকিয়ে তৈরী হয়েছে অসংখ্য পাথর আর আমরা যখন আদিম প্রস্তরযুগের মানবের মত তাই দিয়েই অস্ত্র বানিয়ে হিংস্র জানোয়ারদের বিরুদ্ধে লড়াই করি তখন জীবনের তাত্পর্য গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পাই তাই তো যখন আমি নিজেকে লেনিন মনে করি তোমাকে তখন ক্রুপস্কায়ার মত পাশে পেতে চাই | আমার স্বদেশ আজ বিধ্বস্ত, বিষাক্ত অজগরের বিষের ছোবলে তাই সৌখিন কথা বলার ছন্দে কবি হবার বাসনা আমার নেই----- আমার মা আর বোনেদের শ্লীলতা প্রিয়ার পরস্ত্রী হবার আশংকা আজ ওদের অর্থের কৌলিন্যের কাছে বন্ধকী রয়েছে | তিলে তিলে, ঘন কালো আঁধার ঢেকেছে পূর্ণিমা রাতকে ফুলশয্যার বাসরেও তাই প্রিয়াকে পরের বাড়ি পাঠাতে হয় | আমি ও তো দুটো ডাগর চোখের সুন্দর একটা মুখ, আর ছোট্ট একটা ঘরের কথা কল্পনায় ভাবি আর এমন ভাবেই সবার জীবন মুঠো মুঠো আনন্দে ভরে দিতে চাই তাই তো আমি যখন নিজেকে লেনিন মনে করি তখন তোমাকে ক্রুপস্কায়ার মত পাশে পেতে চাই | শত্রুরা জানি বাধা দেবে নব সৃষ্টিকে বাধা হবে জানি পুরাতন ধ্যান ধারণা সূর্য আমাকে ডাকছে দুহাত বাড়িয়ে তাই কিছুতেই আমি মেঘের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারি না | মাঝে মাঝে ভিসুভিয়াসও ভয় পায় আমাকে যখন আমি সমস্ত বিশ্বের জহ্লাদগুলোর সাথে পাঞ্জা লড়ি----- ন্যায় আর মর্যাদার জন্য, বাঁচতে আর বাঁচাবার জন্য তাই যখন আমি ঘাতকের খড়গ কেড়ে নিতে গিয়ে জনগণকে মিলিত করতে চাই তখনই আমি নিজেকে লেনিন মনে করি আর তোমাকেও তাই ক্রুপস্কায়ার মত পাশে পেতে চাই |
তারপর আসবে একদিন----- সে এক সোনা ঝরা দিন ঠিক এখনই নয় অনেকদিন বাদে, আমাদের প্রয়াসের নিশ্চিন্ত প্রত্যয় নিয়ে ঠিক তোমাকে ভালবাসার প্রথম অনুভূতির মত, তখন ক্ষতবিক্ষত দেহে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখবো শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়েছে, মৃত সাথীদের সাক্ষী রেখেই তোমায় সিঁদুর পরিয়ে দেব আমার বিজয়ের রক্ত দিয়ে |
ঝড়ো ইয়েনান থেকে বেরিয়ে, নীল আকাশের তলা দিয়ে ঝর্ণার কাছে যেতে যেতে তোমায় বলবো শরীর আমার বিক্ষত তাতে ভয় নেই সাথী, হৃদয় কিন্তু এখনও আমার তোমার অকৃত্রিম প্রেমের প্রতি অনুরক্ত |
সেখানে এখনও প্রেমের গোলাপ ফোটে ঠিক প্রথম দিনের মতই | অনেকদিন আমরা পরস্পরকে দেখিনি তোমার চোখের যমুনায় তাই স্নিগ্ধ হতে চাই | ধ্রুবতারাও তখন বিদায় নেবে তার আসনটা আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য, কর্তব্য পালনের আমি এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবো | আমাদের উপলব্ধির আলোতেই আমরা পরস্পরকে দেখবো আর তোমার হাতে হাত রেখে আমি আবৃত্তি করবো অঙ্গীকারকে অস্বীকার করিনি আমি জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাই তাই তো আমি যখন নিজেকে লেনিন মনে করি তখন তোমাকে ক্রুপস্কায়ার মত পাশে পেতে চাই আমার স্বদেশ তখন নিশ্চয়ই জবাব দেবে লেনিন একটা নাম নয়----- একটা কীর্তি তাই আমাদেরও কীর্তি হওয়া চাই |
আমার মাতৃভূমির রক্তের স্রোতের উপর দাঁড়িয়ে জহ্লাদেরা যখন পৈশাচিক নৃত্যে রত আমার ক্রোধের দৃষ্টি আর ঘৃণার তূণ তখন ওদের দিকে নিক্ষেপ করেছি এই আমার অপরাধ, শুধু এই, এই মাত্র অপরাধের জন্য জহ্লাদের নিষ্ঠুর হাতগুলো আমার বাক্ শক্তি রুদ্ধ করতে চাইছে || ওদের অবৈধ গোপন অভিসারকে নিষ্কন্টক করার জন্য | হত্যা করেছে ওরা যখন আমার প্রিয়জনকে ভয়ের ভীরু স্পর্শকে উপেক্ষা করে আমার দৃষ্টি তখন আরও প্রসারিত হয়েছে বাইরে থেকে ভিতরে গভীর থেকে আরও গভীরে হে আমার প্রিয় স্বদেশবাসী আমার এই প্রত্যক্ষকে আমি তোমাদেরও দেখাতে চেয়েছিলাম এই অপরাধে, শুধুমাত্র এই অপরাধে ওরা আমার চোখ উপড়ে ফেলে আমাকে অন্ধ করে দিতে চাইছে | ওরা যখন ওদের পানশালায় আমার ভায়ের রক্তের সুরা আকন্ঠ পান করে ওদের লালসার হাত বাড়িয়েছে আমার মা বোন কিংবা প্রিয়ার দিকে | উচ্ছিষ্টের প্রসাদে তৃপ্ত হয়ে করুণার পায়েতে আমি তখন আমার বঞ্চনার ইতিহাসকে বিকিয়ে দিতে চাইনি------ পারিনি ওদের পোষ মানানো সশস্ত্র গোলামগুলোর মত ওদের পায়ের তলায় বসে ‘জী হুজুরর’ বলতে | হে আমার প্রিয় স্বদেশবাসী তোমরা শুনে রাখো শুধু এই , এইমাত্র অপরাধে ওরা আমাকে নিষ্পেষিত করতে চায় নিয়ে যেতে চায় ফাঁসির কাঠগড়ায় আমি এক স্বপ্ন দেখেছি মুক্ত জীবনের স্বপ্ন আমি এক ভালবাসার অনুভূতি পেয়েছি জীবনের গৌরবে যা ধন্য | বন্দী জানোয়ারদের মত দুর্বিসহ জীবন যেদিন মানুষের শেষ হবে অন্ধকারের শেষে, বন্দী জীবনের দ্বার খুলে মানুষ যেদিন রক্তিম অরুণোদয়ের স্পর্শে ভরে নিতে পারবে তার মন স্বপ্নের রঙের সেই প্রজাপতির চঞ্চল নৃত্যের অপেক্ষায় তার গুটিগুলিকে আমি হৃদয়ের উষ্ণতায় সযত্নে রক্ষিত করেছিলাম | হে আমার প্রিয় স্বদেশবাসী তোমরা শুনে রাখো শুধু এই, এইমাত্র অপরাধে ওরা আমার হৃৎপিন্ডটাকে বুলটে ছিন্ন করতে চাইছে মৃত্যুর অন্ধকারে মুছে দিতে চাইছে স্বপ্নকে |
প্রিয় সাথী অমর ভট্টাচার্য ( ১৯৮৬ সালের ৭ই অক্টোবর ইউনিভার্সিটির আশুতোষ হলে প্রতিবাদী কবিসম্মেলনে প্রেরিত )
প্রিয় সাথী শুভ এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই | রাজার বাড়ীতে উত্সবের হাজারো সোনার প্রদীপ যখন রাজদম্ভ প্রচার করে নিভে গেছে তখন দুখিনী মায়ের মাটির প্রদীপ সমস্ত অমাবস্যার অন্ধকারকে আলোর পথ দেখাবে বলে জেগে বসে আছে | এরাই প্রতিবাদী কলমসেনানীর দল তাদের আমার অভিনন্দন জানাই | রাজপথে ভাইয়ের রক্তাক্ত কলজে নিয়ে যখন শ্বাপদেরা কামড়া-কামড়ি করছে ধর্ষিতা বোনকে পাওয়া যাচ্ছে ধানক্ষেতের আলেতে ; ‘ এ দেশ আমার---- আমি তাকে ভালোবাসি------‘ এ কথা উচ্চারণের জন্য রাজকীয় ফাঁসীর দড়ি যখন তাড়া করে ফিরছে আমাদের, তখন যাঁরা সরবে বলেন ‘এ অন্যায় -----‘, সেই মানবাত্মার কারিগরদের আমি আমার শ্রদ্ধা জানাই |
দুষ্টু শিশুর মত মেঘকে ফাঁকি দিয়ে শাল সেগুনের ঘন বনের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে যখন জ্যোত্স্না নামে গাছের পাতায় পাতায় শিশির যখন তার ভালোবাসার চুমু দিয়ে যায়, আলো আঁধারির নিভৃত প্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন আমি দেখেছি দিনের বেলার অনেক কবি------ রাত্রে যারা মৃতদেহের বেসাতি চালায় | দেখেছি অনেক ক্লীবকে, যারা পুরুষ সেজে নববধূকে প্রতারণা করে |
বসন্তের যে ব্রজনিনাদ আমাদের ঘুম ভাঙিয়েছে তরাইয়ের যে বুলবুল তার মেঠোসুরের গান শিখিয়েছে যে যৌবনের প্রাণবন্যা আরও গতিময় হয়েছে অন্যায়ের বাঁধ ভাঙার জন্য তাদেরই ভাষা নিয়ে এ প্রতিবাদ আরও বলিষ্ঠ হোক তাদেরই সুর আমাদের শেষতম মানুষটিরও কাছে গিয়ে পৌঁছোক |
আর যে কবিরা এখনও বর্ষার সূর্যের মতো দ্বিধার মেঘে ঢাকা------ তাদের প্রতি ধ্বনিত হোক আমাদের এ আহ্বান, ‘ফাল্গুনি ! অজ্ঞাতবাসের দিন শেষ করে আজ ছিঁড়ে ফেল বৃহন্নলার সাজ |’
বাঘবন্দী খেলা অমর ভট্টাচার্য ( আলিপুর সেন্ট্রাল জেল )
বড় ঘড়টার মধ্যে ওরা ছ’জন আর আমি | আমি বন্দী আর ওরা তখন আমার শরীরটার মালিক আমার ওপরওয়ালা | খেলাটা এ ভাবেই শুরু হয়েছিল | ওরা আমায় ধমকালো, চাবুকে চাবুকে জর্জরিত করলো আমার শীর্ণ শরীর | প্রাচীন সম্রাটের মত নজরানা চাইলো আমার আনুগত্যের | দড়ির বাঁধনে হাত-পা বেঁধে মাথাকে ঝুলিয়ে দিলো নীচে | ভাবলো এ ভাবেই মাথা নোয়ানো যাবে উল্টোদিকে ঘোরানো যাবে জীবন আর প্রগতির দর্শনকে | তারপর এক সময়---- মার দেবার মেহনতে ওরা হল ক্লান্ত আর আমি সংজ্ঞাহীন |
সে আমার এক নতুন উপলব্ধি অত্যাচারের চরম মুহূর্তে কখনো ভেবেছি ----আমার উপলব্ধি আর বিশ্বাসকে যদি বিদ্ধস্ত করে অত্যাচারের তৃণ | ঐতিহ্য আর গৌরব যদি নত হয় রক্তমাংসের মিনতির কাছে | তবে-----
আমি প্রাণ মনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি জুলিয়াস ফুচিক থেকে অহল্যা কিষাণী, ভ্যানত্রয়ী থেকে বাবুলাল তখন আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে |
এ পৃথিবীর ভালবাসার দহনের কাছে বাগপত রাজপথের কামার্ত কুকুর গুলোর লকলকে জিবের গরম শ্বাস আমার কাছে তখন শিশুর ক্রোধের মতই উপহাস যোগ্য | আমি মানুষকে ভালবাসি সেই ভালবাসার দহনে কেঁদেছি শপথের অঙ্গীকারে দৃপ্ত হয়েছি বাতাসের পরশে ফিরে পেয়েছি আমার মেঠো পথের সোঁদা গন্ধকে |
আমি উজ্জীবিত হয়েছি, উদ্ধত হয়েছি, করুণার ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছি ওদের দিকে |
একটু শুধু বিরতি, শরীরের সাথে প্রাণটা জোড়া লেগে আছে কিনা সেইটুকু জেনে নেওয়া
তারপর আবার প্রশ্নের তীর, বুদ্ধিমত্তার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের সে এক অভিনব প্রতিযোগিতা |
আমার পঞ্চেন্দ্রিয় তখন আমায় বিদায় জানিয়েছে ব্যাথা নেই ; শ্রবন নেই, দৃষ্টি নেই বসুন্ধরার কাছে জয় করে নিচ্ছে ক্লান্তির নিদ্রাকে |
শরশয্যায় শায়িত এক পিতামহ ভীষ্মকে মৃত্যু তখন কাছ থেকে শুধু দেখে যাচ্ছে, স্পর্শ করতে পারছে না | বাজিতে দান হেরে গিয়ে ওরা হলো ক্রুদ্ধ, চড়তে লাগলো ওদের মেজাজ | আর সেই সাথে ভাষা ও তার কেতাবী পোশাক ছেড়ে একেবারে বল্গাহীন উলঙ্গ ভাবে আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো | শেষ মেশ বাক্যবল আবার বাহুবলের সাহায্য প্রার্থী হলো | শুরু হলো ঘুঁষি ডান্ডার আপ্যায়ন অনেকটা মাংস নিয়ে কামড়া কামড়ির মতন |
সূর্য তখন পশ্চিমকে আবিরে রাঙিয়ে অস্তে চলেছে | তার শেষ রশ্মিটুকু আমার মুখের ওপর এসে পড়লো | দেহের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম ওদের অহংকারের মুকুট আমার কালসিটে পরা পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বিজয়ী রাজার আসনে বসে আমি পরাজিত শত্রুর দিকে তাকিয়ে প্রাণ খোলা হাসি হাসছি ||