কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তার কবিতা |
বঙ্গ-কুলনারী কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী, ধীরতা-নম্রতা-মাখা, ঘোমটায় মুখ ঢাকা রয়েছে উনন-ধারে চিরকাল ধরি, বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুলনারী। নয়নে কজ্জল-দাগ, অধরে তাম্বুল-রাগ, ললাটে সিন্দুর-বিন্দু লক্ষ্মীর আসন, সহাস্য সুন্দর মুখ, সুন্দর সরল বুক, উজ্জ্বল তারার মত আনত আনন। সলাজ সুন্দর আঁখি, জানে না ছলনা ফাঁকি, কায়মনে চেয়ে রয় পতির বদনে,--- মৃদু হাস্য মৃদু কথা, শ্যামা লজ্জাবতী লতা, অমৃত উথলি উঠে মন্থর গমনে। অঞ্চলে আবরি রাখে যৌবন-মাধুরী, কভু উচ্চ-বাচ্য নাই, যাহা পাবে নিবে তাই, বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী। অবস্থা যেমন যার, তেমনি চরিত্র তার, কুরূপ সুরূপ পতি নির্গুণ নির্ধন, হোক্ বোবা হোক্ অন্ধ, বিচারে না ভাল মন্দ, পিতা মাতা যারে দিবে সেই প্রিয়জন। মারিবে কাটিবে পতি, কথাটী ক'বে না সতী, তবুও মঙ্গল ইচ্ছা করিবে স্বামীর, বুক ভরা স্নেহ-ধারা পতি-প্রেমে মাতোয়ার, স্থির সরসীর ন্যায় গম্ভীর সুস্থীর। আঁখি-ভরা সুশীতল বরষা-গঙ্গার জল, সফেন তরঙ্গে সদা হয় উদ্বেলিত, উচ্চ হিয়া উচ্চ মন, উচ্চ কাজ অনুক্ষণ, তবুও ক্ষুদ্রের ন্যায় পর-পদানত। সর্ব্বদা সন্তুষ্টমনা, সামান্য নীহার-কণা, একটু উত্তাপে শুষ্ক কমনীয় কায়, একটু মলয়ানিলে আবেশে পড়িবে টলে আবার সহালে স’বে ঝঞ্ঝাবাত তায়। সুবাস আবদ্ধ যথা ফুলের ভিতরে, তেমনি গৃহের মাঝে বঙ্গ নারী বদ্ধ আছে, মনভ্রমে পদার্পণ না করে বাহিরে। যদিও আবদ্ধ তারা, তবুও ভারত-ভরা তাদেরি সন্তান স্বামী তাদেরি সকল, যদিও ললনা-লতা বাহিরে কহে না কথা, তবুও উত্থিত সদা শান্ত কোলাহল। যদিও দেখে না চেয়ে, তবুও ফেলেছে ছেয়ে, তাদেরি নয়ন-তারা ভারত-জননী, রমণী কুসুম-থর, তবুও ত খরতর, প্রতি ঘরে ঘরে বংশধর-প্রসবিনী। ত্রিদিব-নন্দন-বনে লক্ষ্মী বসে পদ্মাসনে, বঙ্গ-ঘরে-ঘরে বুঝি তাহারি মাধুরী, সীমন্তে সিন্দুর-ফোঁটা, মাথে চুল ঘনঘটা, অধর তাম্বুলে লাল বিদ্যুৎ-লহরী। বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুলনারী। তৃতীয়ায় শশী-কলা, জানে না কুহক ছলা, বড় ভালবাসি আমি সরলা সুন্দরী। অনিন্দ্যরূপিণী নারী পূজা করি প্রাণ ভরি, মঙ্গল আরতি করি ধান্য দূর্ব্বা দিয়া। জীবন্ত লক্ষ্মীর প্রায় শঙ্খ-সিন্দুরেতে ভায়, সংসারের হিত করে মন প্রাণ দিয়া। বিলাতের রাঙা মেয়ে পথে যায় নেচে গেয়ে, যৌবনে বিবাহ করে "কোর্টসিপ্" করি, বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুলনারী। মেমদের রং সার, ধারে না পতির ধার, সড়কে সড়কে ভ্রমে ড্রেস বুট পরি, বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুলনারী। ভারতের বোকা বধু ঘরে থাকে শুধু শুধু, অতি কষ্টে পত্র লেখে "শিশুশিক্ষা" পড়ি, কিছুতে হয় না রুষ্ট, স্বামীরে দেয় না কষ্ট, তাই ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী। এই কবিতাটি নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল সম্পাদিত "দামিনী" (২০১৩) কাব্য সংকলনে এই সংক্ষিপ্ত রূপে দেওয়া রয়েছে। বড় ভালবাসি আমি বঙ্গকুল-নারী, ধীরতা নম্রতা মাখা, ঘোমটায় মুখ ঢাকা রয়েছে উনন-ধারে চিরকাল ধরি, বড় ভালবাসি আমি বঙ্গৃকুল-নারী। নয়নে কজ্জল-দাগ, অধরে তম্বুল-রাগ, ললাটে সিন্দুর-বিন্দু লক্ষ্মীর আসন, সহাস্য সুন্দর মুখ, সুন্দর সরল বুক, উজ্জ্বল তারার মত আনত আনন। ... বুক ভরা স্নেহ-ধারা পতি-প্রেমে মাতোয়ার, স্থির সরসীর ন্যায় গম্ভীর সুস্থীর। আঁখিভরা সুশীতল বরষা-গঙ্গার জল, সফেন তরঙ্গে সদা হয় উদ্বেলিত, উচ্চ হিয়া উচ্চ মন, উচ্চ কাজ অনুক্ষণ, তবুও ক্ষুদ্রের ন্যায় পর-পদানত। সর্ব্বদা সন্তুষ্টমনা, সামান্য নীহার-কণা, একটু উত্তাপে শুষ্ক কমনীয় কায়, একটু মলয়ানিলে আবেশে পড়িবে টলে আবার সহাসে স’বে ঝঞ্ঝাবাত তায়। . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
শ্যামা পাখী কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮। শ্যাম-লতিকার গা’য় শ্যামা-পাখী গান গায়, অতি সুললিত সুরে মোহিয়া ভুবন, শ্যামল একটী পাতে, শিশির ঝরেছে রাতে, তা দিয়ে পাখীরে ধোয় ধীর সমীরণ। পাখীর গ্রীবাটী ছুঁয়ে একটী পল্লব নুঁয়ে তাহাতে ফুটিয়া আছে একটী বকুল, ঊষার আলোক-মালা চারি দিক্ করি আলা, তাহাতে ঘুমায়ে আছে বেহুঁস্ বিভুল। হঠাৎ প্রভাত-বায় সেখানে বহিয়া যায়, টুপ্ করে পড়ে গেল সাধের কুসুম, সাপ্ টা সমীর-ভরে পল্লব সরিয়া পড়ে, ঊষার সে আলোকের ভেঙে গেল ঘুল। পাখী আর তথা নাই, চলিয়া গিয়াছে ভাই! ওই যে উড়িয়া যায় আকাশের গা’য়, ফিরে আয় শ্যামা-পাখী যাস্ নে কোথায়। . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
প্রাণের দেবতা কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮। তাহারে ছোঁব না আমি সে যে গো দেবতা, এসেছি পূজিব ব’লে, পূজিব হৃদয় খুলে, নাই বা কহিল কথা---না কহিনু কথা। কথা ত কথার কথা, কাজ প্রাণে প্রাণে, দরশ স্বর্গের ধন, পরশে কলুষ মন, দরশন চাহে লোক দেবতার স্থানে। পরশন হ’তে ভাল দরশন অতি, দরশ দেবের যোগ্য, পরশ পশুর ভোগ্য, দরশে জ্বলিয়া উঠে ধরমের ভাতি। আঁখিতে রাখিয়া আঁখি, দূর হ’তে চেয়ে দেখি, দাও গো! এ বুকে বল অগতির গতি! নাই বা ছুঁইনু অঙ্গ---না কহিনু কথা, হৃদে রাখি সদা শুচি, ভকতি-প্রসূনে পূজি, দূরে দূরে ভালবাসি প্রাণের দেবতা। . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
পতিতা রমণী কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা বামাবোধিনী ডিপোজিটরি থেকে ১৩০৪ সালে (১৮৯৭খৃ) প্রকাশিত কবির "প্রীতি ও পূজা" গ্রন্থে কবিতাটি এই রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮। কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্, যাস্ নে যাস্ নে আর, পথে ঘোর অন্ধকার, নিবিড় জলদাচ্ছন্ন রজনী দ্বিযাম, কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। যে পথে যাইতে চাস্, সেথায় বিষের রাশ, বিষে বিষে প্রাণ যাবে রহিবে দুর্নাম, কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। ঘোরতর দেশাচার, পুড়ে হবি ছারখার, দাঁড়াতে পাবি না তৃণ! কোন দেশ গ্রাম, কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। পিতা মাতা সহোদর, সবে হবে পর পর, ঘৃণাতেও লইবে না কেহ তোর নাম, কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। পিছনে অমৃত-গঙ্গা, নাই ভয় নাই শঙ্কা, সোণার শৈবালে ভরা, নাহি দল দাম, তা ফেলিয়া কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। পিছনে অমৃত-পুরী, রয়েছে জগত যুড়ি, আনন্দ বিরাজে তাহে পর্ব্বত-প্রমাণ, তা ফেলিয়া কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। যেখানে যাইবে ব’লে এতটা এসেছ চলে, সেখানে নরককুণ্ড অশান্তির বাণ, মহা বিষ মহা বিষ, অন্ধকার দশ দিশ, জ্বলন্ত অনলবৃষ্টি তরঙ্গ তুফান, না বুঝিয়া কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। ত্যজিয়া সুধার ধারা বিষ-পানে মাতোয়ারা, বিশ্বময় বিশ্বম্ভর মহান্ মহান্, না জানিয়া কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। হোস্ না লো! দিশাহারা, হোস্ না লো! মাতোয়ারা, ডুবাস্ না মহিলার সুনাম-বিভব, সতীত্ব দেবের রশ্মি দেবতা আনন্দে বর্ষি, বাড়ায়েছে পৃথিবীর মহৎ গৌরব। সতীর মূরতি ধরি কনক-আসনোপরি, পূজিছে ভারতবাসী ভরিয়া পরাণ, কোথা যাস্ কোথা যাস্ থাম্ থাম্ থাম্। সতীস্পর্ষে মহা হর্ষ! কত দিন কত বর্ষ সতী-দেহ স্কন্ধে করি ভ্রমিল ত্রিশূলী, সেই সতী-দেহ ছিঁড়ি, পড়িল জগত যুড়ি, তাই সুপবীত্র তীর্থ পীঠস্থা গুলি। সীতার সতীত্ব-গাথা, ভারতে রয়েছে গাঁথা, দময়ন্তী সাবিত্রীর অদ্ভুত কাহিনী, খনা লীলা অরুন্ধতী, গান্ধারী কৌশল্যা সতী, রাজস্থান-সরোবরে পদ্মিনী পদ্মিনী। সম্মান-রক্ষার হেতু বাঁধি নর-মুণ্ডে সেতু গড়িয়া কীর্তির সম্ভ করিল পয়ান, সেই এ ভারতভূমি, সেই এ রমণী তুমি, এতই কি হেয় তুচ্ছ হ’ল তব মান? না না ছি ছি ফিরে আয়! অধর্ম্ম ঠেলিয়া পায়, দেখিবি এখানে কত জুড়াবার স্থান। তোরি তরে রবি তারা ঢালিবে অমিয়-ধারা, তোরি তরে ফুটি ফুটি উঠিবে কুসুম, তোরি তরে সরোবর গেয়ে যাবে তর তর, তোরি তরে ফুলরেণু চন্দন কুঙ্কুম। কোকিলার কলালাপ, লতার নিদাঘ তাপ, পাপিয়ার পিউ পিউ তোমারি কারণ, এলায়ে জলদ-চুল, দেখিবে চপলাকুল তোমাকেই রূপ-রত্ন করে বিতরণ। কুসুমের কোমলতা, শিশিরের শিতলতা, তারার স্তিমিত আলো কত মধুময়, নাহি সুখ নাহি শান্তি, এ কথা সকলি ভ্রান্তি, মানব-জগত সব সুখ-অভিনয়। গাছে গাছে বকফুল, শাখে শাখে বুলবুল সাধিয়া ঢালিবে সুখ তোমার সমুখে, অনধ নয়ন খুলি চাবে যবে ভাবে ভুলি, তখনি অধীর হবে সুখে সুখে সুখে। জীবন-যৌবন-ফুল হবে শীঘ্র নিরমূল, নরের সুশমাত্র চিরস্থায়ী ভবে, আর যদি পাপ কাজে চিরকাল রহ মজে, তা হইলে দুর্গতির অবধি না র’বে। . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |
মধুর পবন কবি অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা অধ্যাপক বিধুভূষণ গোস্বামী ও অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র সম্পাদিত “সম্মিলন” (ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন) পত্রিকার আষাঢ় ১৩১৮ (জুলাই ১৯১১) সংখ্যায় প্রকাশিত। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৬.৮.২০১৮। কোথা হতে এস তুমি মধুর পবন ? কার আজ্ঞ৩মত আসি, পরশ কেশের রাশি, অশরীরী দেহে দেহ কর পরশন। পলকে আবার কোথা কর পলায়ন ? ২ যে স্থানে যে গীত তুমি করহ শ্বরণ, তাহাই বহিয়া আনি, মুগ্ধ কর যত প্রাণী, কোথায় নিঃশেষ তব, কোথায় জনম ? ৩ উচ্চপাহাড়ের শির হিমানী প্রধান, শ্বেত প্রস্তরের স্তূপ, দুগ্ধফেণ-নিত রূপ, প্রবেশি তাহার মাঝে ঠাণ্ডা কর প্রাণ, ৪ বজ্রের পতন তুমি কর অনুভব, ভূমিকম্পে ধরা যবে, সঘনে কম্পিত হবে, সে কম্পনো অনুভব কর তুমি সব। ৫ হে সমীর। সিন্ধু পার হয়ে যবে যাও, খুলিয়া তরল প্রাণ, তালমান-হীন গান, প্রতিলম্ফে প্রতিঝম্পে অবিরত গাও। ৬ বসন্তের সদ্দ ফোটা পুষ্পের কেয়ারী, যখন পরশ কর, তখনও মনোহর, সুরে ও বেসুরে গান গাও প্রাণ ভরি। ৭ অল্প অন্ধকারাবৃত বন-ভূমি দিয়া যখন বহিয়া যাও তখনও গান গাও, সে গীতে নিস্তব্ধ ছায়া উঠে শিহরিয়া। ৮ রসাল তরুর শিরে পাখীর বাসায় অথবা শ্মশানে যথা, ছাইমাখা তৃণলতা, যাও যথা চিতা-ধৌত মরানদী ধায়। ৯ তোমার পরশে বায়ু! কাননে প্রান্তরে, চমকে জন্তুর দল, জল করে কোলাহল, তোমারি পরশে বারি বাষ্পরূপে উড়ে। . *************** . সূচীতে . . . মিলনসাগর |