কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা
*
আমার নাম ভারতবর্ষ
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

স্টেন গানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র---
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে
চা-বাগিচায় কফি খেতে,
কয়লা-খাদানে, পাহাড়ে-অরণ্যে
লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা---
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ
খুনীর চেয়েও রুক্ষ কঠোর মাটিতে
বোনা হয়েছে যে-অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন---
তার নাম ভারতবর্ষ।

আমার ঠাণ্ডা মুখের ওপর
এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে
ভাক্ রা নাঙ্গালের পাথুরে বাঁধের গমেভীর ছায়া।
ডিগবয়ের বুক থেকে
মায়ের দুধের মত উঠে আসা তোলো ভেসে যাচ্ছে
আমার সারা শরীর।

কপাল থেকে দাঙ্গার রক্ত মুছে ফেলে
আমাকে বুকে ক’রে তুলে নিতে এসেছে
আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর।
আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ
প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম।
প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর
শোক নয় ক্রোধের আগুনে
দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।

ভরাট গর্ভের মত
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
বৃষ্টি আসবে।
ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝবরাবর
ঝরে যাবে বরফ-গলা গঙ্গোত্রী।
আর একটু পরেই প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর
কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত।
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুদ চুম্বনে।

ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়
সাঁওতালী মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে
জেগে উঠবে তুমুল উত্সবের রাত।
সেই রাতে
সেই তারায় ফেটে পরা মেহফিলের রাতে
তোমরা ভুলে যেও না আমাকে
যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্ জে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম
মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
.        স্বদেশ
.        স্বাধীনতা
.        ভারতবর্ষ॥

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাতের কবিতা
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

মাঠময় খেলে জোনাকির ছেলেমেয়ে
রাত বসে আছে চাঁদের হ্যাজাক জ্বেলে
.        ঝর ঝর ঝর ঝর
ঝরনা খুঁজছে কোনখানে তার ঘর---
আকাশে বাতাসে দুলছে আলোক ভেলা।

.        তুমি একা ঘরে বসে রবে
.        না কি পা টিপে পা টিপে যাবে ?
.        যদি হাওয়া ডাকে চুপি-চুপি
.        ঝড় খুলে ফেলে তার টুপি,
.        যদি লাল নীল কালো মাছ
.        দীঘি জুড়ে শুরু করে নাচ
.        ঘরে বসে রবে না কি যাবে
.        সেই ঝলমলে উত্সবে ?

.            *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
খো খো
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়.,
বিকেলে খেলে খো খো,
বনগাঁ থেকে বার্লিনে যায়,
সাধ্যি থাকে রোখো।
মেয়ের বাবা সকাল-সন্ধে
চৌমাথাতে হকার,
ছোট বোনটি ফাইভে পড়ে,
এখনও দাদা বেকার।
তবুও খো খো খেলুড়ে মেয়ে
লড়ছে এমন লড়াই
তাকে নিয়েই দেশসুদ্ধ
আমজনতার বড়াই।

হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম
সিয়ারামের খেলা
খেলতে খেলতে সাঁঝের কোলে
গড়িয়ে আসে বেলা,
ভাতের গন্ধে লাফিয়ে ওঠে
খিদের নাড়িভুঁড়ি
বালিকা তবু উজানভরা
স্বপ্ন করে চুরি,
মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়,
বিকেলে খেলে খো-খো
খেলার পাতায় সেই মেয়েটির
স্বপ্ন ছেপে রেখো।

.    *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!

চরায়-বড়ায় খই ফুটেছে তপ্ত খোলা
পাথর মাটি পাথর,
গোয়ালে গাই বিইয়েছে
.        তার দুধ বাঁটে নেই এক পো,
পুকুর-নদীর জল শুকিয়ে বাষ্প,
কোলে কলসি, কাঁখে কলসি কাতার কাতার
ছা বৌ জোয়ান মদ্দ ভাতার

চলছে চলছে---
.         এক মূকাভিনয়
তার খেজুরের মাথার ওপর খাঁড়ার মতো দাঁড়িয়ে দ্যাখে
অলপ্পেয়ে সময়।

ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!

লে লে ছে আনা লে যা লিবি ছে আনা
আমি রাজার ভাতিজা---এসেছি সদর থেকে
গাঁও বুড়ো থেকে ঘরের ঝিয়ারি,
বাল-বাচ্চাও শুধোয়---
তুমি কোঁচড়ো এনেছো কি ?
এনেছি---এনেছি প্রতিশ্রুতি।
আমি এনেছি টি আর, জি আর
সেচ প্রকল্প, সার, গোরু,
আমি ছ’হাজার নলকূপে
জলে নদী করে দেব মরু।
এই আমিন, এদিকে এসো,
ওরা যা বলে, সবটা টোকো
খুব ভালো করে মাপো-জোকো
যত দাবি আছে মোটা সরু---
আমি ছ’হাজার নলকূপে
জলে নদী করে দেব মরু।

হাড়ের ওপর মাই কামড়ে
.        টিংটিঙে প্যাকাটি---
ফটো খিঁচুন প্রেস,
মজা পুকুরে পেট ফুলো ঢোল
.        শ্যামলী ধবলী---
ফটো খিঁচুন প্রেস.
এমন মাটি মায়ের আঁচল
এখন গর্ত-খোদল-ফাটল,
ছাতিফাটার মাঠ
হা হা খিদে দিচ্ছে ঝাঁট,
মুখে মুখোশ এঁটে নিস,
হিস্ হিস্ হিস্ হিস্
জমি-জিরেত জ্বালিয়ে
ধা ধা কালকেউটের বিষ।
হট্ যা হট্ টিয়ে টা
এই সিরিঙ্গী মেয়েটা

ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!

.    *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
দুই ঠোঁট ছিঁড়ে নাও,
চোখের কোটর থেকে নীলপদ্ম তুলে নাও,
নিষিদ্ধ দেরাজ থেকে তুলে নাও বক্র ছুরি-ছররা-কার্তুজ।

মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
পিকাপে চকিত দেখা রূপস চিতার আলোড়ণে
তোমার শাড়ির ডোরা, হেডলাইট ছুটেছে অস্থির,
ভুটানি মদের গন্ধ খোলা চিলে,
তোমাকে চুম্বন করলে সমুদ্রের নীল জল ভয়ঙ্কর ফুঁসে ওঠে,
খাঁড়ির গর্জনে গ্রীবার সটান ভঙ্গি---
নাভির পাতালে তুমি প্রতি রাত্রে গুম করো একটি যুবক।

মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
চোখ দুটো দৃষ্টি রাখছে চোখের ওপর
হাত দুটো দৃষ্টি রাখছে হাতের ওপর
গোপন গহ্বর খুলে উবু হয়ে বের করো রেশমের ফাঁস
তুমি বিশালাক্ষী, তুমি মৃত্যু, নীলতারা,
হঠাৎ সশব্দে ফেটে বুক মুখ জ্বেলে দাও ঈর্ষার অ্যাসিডে!

মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
এত সরলতা
স্টোভের বুকের পরে নীল ফুল হয়ে বসে থাকা
লাল রিবনের ঘূর্ণি মহল্লায় মহল্লায় ছোরা-চালাচালি
করুণ শাখার মতো কৃশ হাত কতকাল ছুঁইনি তোমাকে
ঘুমের ভিতরে নির্বাসন-দণ্ড দিইনি তোমাকে
শুয়োরের গন্ধে ম ম শালবন---
খয়েরি ফিতার টানে ছুটে যায় লাটাগুড়ি, চালসা ফরেস্ট।
কিছুটা সময় আরো
রুদ্র সাগরের তেল হু হু করে জ্বলে যাচ্ছে
ত্যাপিটালে শব্দ তুলে কেটে যায় হাজার মাইল
স্টিয়ারিং জেদি ঘোড়া অবাধ্য গিয়ার-বাক্সো ব্রেক ধরছে না . . .

এই বেলা
টান টান উঠে এসো,
ঘন ঘন দন্তের পীড়নে
ওষ্ঠপুটে ফোটাও প্রবাল,
এই বেলা
ছোখ মুখ খুবলে নাও
.        ট্রিগারে তর্জনি রাখো জ্বালাও মাইন
কিছুটা সময় আরো
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
.        পাঁচ . . .
.                চার . . .
.                        তিন . . .

.          *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর