তুই সেই শেষ ঘোড়া যার ওপর আমার সর্বস্ব বাজি ধরেছি।
একত্রিশ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এ আমার স্পেকুলেশন। তোমার ডাইনে সুইট ফায়ার, বাঁয়ে ব্লিডিং হার্ট, এক কদম পিছনে প্রিন্স কাজু, নেক-টু-নেক ফুলমালা--- আমার একত্রিশ বছরের সুখদুঃখ একত্রিশ বছরের চাপা ব্যর্থতাকে অধীর ক’রে তুমি ছুটছো। হোয়াইট স্ট্যাণ্ডে বায়নাকুলার ভেঙে লাফিয়ে উঠি। কনুয়ের ধাক্কায় উল্টে যায় জগত্সংসার। তোমার পাঁজরের পিসটনে আমার হাঁফ্ সে ওঠা বুক তোমার ছুটন্ত ধমনীতে আমার টালমাটাল রক্ত, তোমার প্রতিটি গ্যালপে আমার বাদামি উরুর জলোচ্ছাস--- তোমার অসহ তারুণ্য খানিকটা খিমচে নিয়েছে আমার বয়স।
ভরাডুবির সময় তুমি লাল বয়া, থৈ থৈ জলের ওপর পেট্রলের আগুন-জ্বালা হারেম-সুন্দরী, মরিয়াপানার ল্যাসো দিয়ে . চম্বলের জঙ্গল থেকে বেঁধে আনা বেওকুফ, বাত্তামিজ ঘোড়া, কদমের চকমকিতে ফুটেছে লাল নীল ফুল, ডাইনে হেলো না বাঁয়ে ঝুঁকো না--- ট্রাক সামাল রাখ।
পথ ভুল হলেই, ফেন্সের ওপর রাফেল উঁচিয়ে আছে তোমার মরণ, পথ ভুল হলেই আস্তিনে লুকানো বক্র ছুরিতে ওঁৎ পেতে আছে তোমার মরণ, কাঙাল হয়ে দাবি জানাই, সম্রাট হয়ে পদাঘাত করি--- উইন চাই, উইন।
তোমার ডাইনে সুইট ফায়ার বাঁয়ে ব্লিডিং হার্ট, এক কদম পিছনে প্রিন্স কাজু নেক-টু-নেক ফুলমালা, মনে রেখো, তুমি সেই শেষ ঘোড়া যার ওপর আমার সর্বস্ব বাজি ধরেছি।
সব সময় বিপ্লবের কথা না ব’লে যদি মাঝে মাঝে প্রেমের কথা বলি--- . আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস। সব সময় ইস্তেহার না লিখে যদি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চাই--- . আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস। সব সময় দলের কথা না ভেবে যদি মাঝে মাঝে দেশের কথা ভেবে ফেলি--- . আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস। পাঁচ আর সাত নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের ভোট কম ব’লে সেখানকার মানুষ রাস্তা পাবে কি পাবে না--- জানতে চেয়েছিলাম। আমার জিভ কেটে নেবেন না। পার্টির ছেলে নয় ব’লে ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস চন্দন কাজটা পাবে কি পাবে না--- বলতে চেয়েছিলাম। আমার নাক ঘষে দেবেন না। দাগি বদমায়েশ আমাদের হয়ে উর্দি বদল করলেই রেহাই পাবে কি পাবে না--- বলতে চেয়েছিলাম। আমায় জুতোয় মাড়িয়ে যাবেন না।
বিশ্বাস করুন কমরেডস আমি দলছুট নই বিক্ষুব্ধও নই ; বিশ তিরিশ চল্লিশের গনগনে দিনগুলিতে কমরেড লেনিন থেকে প্রিয় হো চি মিন আমাদের যেসব কথা বলেছিলেন, এই শতকের অন্তিম দশকে দাঁড়িয়ে আমি স্রেফ সেই কথাগুলো সেই সব আহত, রক্তিম অথচ একান্ত জরুরি কথাগুলো আপনাদের সামনে সরাসরি তুলে ধরতে চাই। জানতে চাই অবিশ্বাস আর ঘৃণার ছোট ছোট জরজা জানালা ভেঙে আমরা কি একবারের জন্যেও সেই বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর গিয়ে দাঁড়াতে পারি না যেখানে সূর্যের আলো সব জায়গায় সমানভাবে এসে পড়ে ?
বুকের রক্ত মুখে তুলে যারা মরে ওপারে ঢাকায় এপারের শিলচরে তারা ভালোবাসা-বাংলাভাষার জুড়ি--- উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
সিঁদুর কুড়িয়ে নেওয়া যায় এক আলো প্রাণের পুণ্যে হয়ে ওঠে জমকালো সে-আলোয় দেয় মারের সাগর পাড়ি উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
সে-আলো টলে না মৃত্যুর কালো ঝড়ে তর্জনি তুলে জেগে থাকে ঘরে ঘরে, দুলিয়ে গলায় তাজা বুলেটের মালা পার হয়ে শত শ্মশান ও কারবালা হাজার মুখের মিছুলে দিয়েছে পাড়ি উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
যত দূরেই যাচ্ছি . তোদের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। তোরা আমার সঙ্গ ছাড়িস না, আঁচল পেতে আছেন বসে . ঐ আমাদের মা, একজোটে ঐ দুঃখিনীটির ঘরের দাওয়ায় যাবো . খুঁদকুড়ো যা পাই, সব্বাই খাবো।
মাটি এখন জংলা ঐখানে ঠায় আছেন বসে . দুঃখিনী মা বাংলা, মায়ের দুধের মতন সরল ভাষা, এবার থেকে হোক আমাদের নিত্যি যাওয়া-আসা। . যাচ্ছি মানে আসছি দূর থেকে কার পায়ের শব্দ শ্রবণে টের পাচ্ছি।
যতই আকাশ গর্জায়, তোদের আমার অস্থি মাংস মজ্জায় ফিনিক দিয়ে উঠছে তবু . বুকের বাংলা ভাষা--- এবার থেকে ঐখানে হোক নিত্যি যাওয়া-আসা।
কাল সারারাত একটা ছেলেকে ফলো করতে করতে আমার স্বপ্ন ক্লান্ত হয়ে গেছে। গোড়ালি-ছেঁড়া পাজাম আর মভ্ রঙের পাঞ্জাবি পরা সেই ছেলেটির মুখ কখনো দেখা যায় নি। স্রেফ ঐটুকু জায়গা সে ছায়া দিয়ে সব সময় চেপে রেখেছিল। আর, আমরা তো সকলেই জানি, কারো মুখ না দেখতে পেলে তাকে নিয়ে কবিতা লেখা কতখানি মুশকিল তবে . ঐ ছেলেটির ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। তার ঠোঁটে গুনগুন করছিল আমার একটির পর একটি . প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত। আবার . তারই গলার লী লী আগুন ঝলসে উঠছিল--- ‘অব মছল উঠা হ্যায় দরিয়া হা’, ‘ভাই সাবধান বড়ি আ তুফান’, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না নিগ্রো ভাই আমার, পল রোবসন।’ ওর শরীরের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল মেঘ, পাখি আর লোহার গরাদের ছায়া। একটির পর একটি ফ্রেম ভাঙতে ভাঙতে শিকারী কুকুরের কালো দিগন্তরেখা পেরিয়ে কি অবলীলায় চলে যাচ্ছিল ছেলেটি।
গাঢ় জঙ্গলের বুকচেরা পথে গোয়েন্দার টর্চের মত তার পিছনে ছুটতে ছুটতে একসময় চিত্কার করে উঠলাম ---হল্ট! সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ব্লাস্টিং-এর শব্দ, বারুদের ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারপাশ, পাহাড়ের কলজে-ফাটানো গলায় সে গর্জে উঠলো--- আমি আসছি।
অথচ কাল সারা স্বপ্ন চেষ্টা করেও তার মুখ দেখতে পাইনি আমি। আর আপনারা তো সকলেই জানেন কারো মুখ দেখতে না পেলে তাকে নিয়ে কবিতা লেখা কতখানি মুশকিল।