আজ রাতে . যখন চারপাশ সুনসান, মশারির অনের নিচু থেকে . অম্লজান টানার শব্দ, গলি-উপগলি-কানাগলির শিরায়, টানেলে . ঝুপঝাপ অন্ধকার, গাড়িবারান্দার নীচে . ঘর-ছুট্ মানুষ আর আকাশের অশ্রুর লবণ মিলে-মিশে একাকার, . শ্যামবাজারের পঞ্চমুখী মোহনায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ঘোড়ার লেজের ওপর . ঘনঘন ছিপ্ টি মারছে বিদ্যুৎ বেশ্যার থালার ওপর . মাংসভুক পুলিশের থাবা, শ্মশানে-শ্মশানে চিতার আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা মানুষজনের হাতে হাতে ভোলাবাবার ধোঁয়াটে প্রসাদ, তিন ইঁটের উনুনে টগবগ শাকপাতায় ত্রিনয়ন রেখে ফুটপাথের অন্নপূর্ণা, তাকে ঘিরে . কয়েকটি হাভাতে-জাতকের ছায়া পাতালের দরজায় ঘাতক, হাসপাতালের দরজায় মরণ . . . ঠিক তখনই . আমি তোমাকে এই চিঠি লিখতে বসেছি, জুলিয়াস সিজার! তোমাকে তিনবার মুকুট সাধা হয়েছিল। তিনবার তুমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে। কাস্ কা, ব্রুটাস, অ্যান্টনিদের ভীড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধ . তোমার পায়ের শব্দ, আগুনের কপাট-খোলা সব কটি চুল্লি এখন তোমার হাঁ-মুখ, আকাশ-প্রেমিক সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট-এর মাথায় জ্বল জ্বল তোমার লাল চোখ,
চিমনির ধোঁয়ায় গঙ্গার জলে বেবিফুডহীন শিশুদিবসের কালো আকাশে তোমার নিশ্বাসের বিষ, কলকাতার প্রতিটি মানুষের ঘাড়ের ওপর . নেকড়ের মত গড়িয়ে ওঠা তোমার উল্লাস আমার হাতে তুলে নিয়েছি এই একাঘ্ন এই ক্ষমাহীন কলম যা দিয়ে আজ রাতে আমি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি, . জুলিয়াস সিজার!
তোমার শববাহকেরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরম অধীরতায় পাথুরে রাস্তায় জুতোর নালের শব্দ তুলছে, কালো কাপড় তোমাকে ঢেকে দেবে বলে অতিকায় ডানা মেলে . ছটফট করছে হাওয়ায় হাওয়ায়, হাজা-মজা মানুষের হাতে হাতে উঠে আসছে . প্রত্নের পাথর, কুষ্ঠরোগীর শক্ত মুঠি . পাল্টে যাচ্ছে গ্রেনেডে, তোমার মধ্যরাতের সুরায় মিশে যাচ্ছে নিহত ভূমিপুত্রের বুক ভেঙে উঠে আসা . আর্সেনিক, তোমার প্রিয় গোলাপের পাপড়ির আড়ালে অপেক্ষায় স্থির বজ্রকীট, ভিখারি ক্রীতদাস ধর্ষিতা কিশোরী অপমানিত বিদূষকদের চোখ আর আমার চিঠির প্রতিটি অক্ষর নিবু নিবু লণ্ঠনের আলোয় তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কত কল্পান্তের শেষে টেনে নিয়ে এসেছে আজ এই রাতে বলির বাজনায় ঝা ঝা মশানভাঙার মাটিতে।
এই স্পার্টাকাস-রাত আর এই একাঘ্নী চিঠি তোমার শববাহকদের সঙ্গে শেষবারের মতো কিছু জরুরি কথাবার্তা সেরে নিচ্ছে, . জুলিয়াস সিজার!
কাঠের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে মানুষও একদিন কাঠ হয়ে যায়। তার পায়ের আঙুলগুলো শিকড় হয়ে চাড়িয়ে যায় মেঝের ভেতর। তার কোমর থেকে সোঁদরি, গরান, গঁদের আঠা ঝরতে ঝরতে একদিন তাকে পুরোপুরি এঁটে ধরে তক্তার সঙ্গে। কুরকুর...কুরকুর ঘুনপোকা ঘুরতে থাকে তার আশির নখর, কাঠের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে একদিন পুরোপুরি কাঠ হয়ে যায় সে।
তখন কেউ তাকে চড় মেরে চলে যায়। সে রাগে না। সমর্পণ নিয়ে নারী এসে কাছে দাঁড়ায়। সে কেঁপে ওঠে না। টালমাটাল পায়ে শিশু ছুটে আসে। সে দু হাত বাড়িয়ে দেয় না। একটার পর একটা কাঠ জুড়তে জুড়তে সে এমন এক কাঠের চেয়ার এখন, যার শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে শুধু জং-ধরা পেরেকের গান ঘুরঘুর ঘুনপোকার গান একটানা করাত চেরাইয়ের গান।
যে হাতে একদিন সমুদ্র শাসন করত, তা এখন চেয়ারের দুই হাতল। যার দুই উরুতে একদিন টগবগ করত একজোড়া বাদামী ঘোড়া আজ আর ডান পা কেটে নিলে বাঁ পা জানতে পারে না। কাঠের অশ্রু নেই, স্বপ্ন নেই, নিদ্রা নেই, হাহাকার নেই ; একটু কষ্ট করলেই জানালায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেত ঢ্যাঙা কালো বেঁটে মাঝারি উটের মত পরিশ্রমী মানুষ মানুষ আর মানুষ। কিন্তু কাঠের চেয়ারের এই হল মুশকিল সে জানালা অবদি হেঁটে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।
শুধু কাঠের ভেতর লোহার পেরেক আঁটা তার দুটো চোখ বাকি জীবনভর ছোট চেয়ার থেকে মেজ চেয়ার মেজ চেয়ার থেকে বড় চেয়ার . হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে।