কবি অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা
*
তোমার ক্ষমায় স্নাত
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

মেঘের খোঁপায় ফুটেছে আলোর ফুল,
তোমাকে কি দেব অনন্য উপহার ?
কোন ঘাটে পার
হ’তে চেয়েছিলে খুঁজে অনুকুল হাওয়া,
নাবিক বাছো নি, এ-নৌকো বেয়ে যায় কি সুদূরে যাওয়া
ভাবো নি, নরম অঞ্জলি মেলে ফুল
ভাসালে জোয়ারে রাজহাঁস বলে—সব ভুল, সব ভুল!

কেবল কথায় বহে গেল বেলা
জল ঝরে গেল মেঘে,
বুকের গভীরে কি শঙ্কা ছিল জেগে
বলে নি বাচাল মুখ,
কথার সাঁকোয় হৃদয়ের আসা-যাওয়া
হয় নি, সমুত্সুক
অধীরতা প্রাণে এসে ফিরে গেছে পাহাড়তলির হাওয়া।

এখন জেনেছো, নীরবতা কত ভালো,
ক্ষীণ সম্বল নিবিড় আঁচলে ঢেকে দিলে, অনুপমা,
বুঝেছ, আমার সকলই চাতুরি, ছল---
জলপ্রপাতে ধাবিত তোমার চোখের তরল ক্ষমা।

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এই স্পার্টাকাস-রাত
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

আজ রাতে
.        যখন চারপাশ সুনসান,
মশারির অনের নিচু থেকে
.        অম্লজান টানার শব্দ,
গলি-উপগলি-কানাগলির শিরায়, টানেলে
.        ঝুপঝাপ অন্ধকার,
গাড়িবারান্দার নীচে
.        ঘর-ছুট্ মানুষ আর আকাশের
অশ্রুর লবণ মিলে-মিশে একাকার,
.        শ্যামবাজারের পঞ্চমুখী মোহনায়
নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ঘোড়ার লেজের ওপর
.        ঘনঘন ছিপ্ টি মারছে বিদ্যুৎ
বেশ্যার থালার ওপর
.        মাংসভুক পুলিশের থাবা,
শ্মশানে-শ্মশানে
চিতার আগুনের চারপাশে
গোল হয়ে বসে থাকা মানুষজনের
হাতে হাতে ভোলাবাবার ধোঁয়াটে প্রসাদ,
তিন ইঁটের উনুনে
টগবগ শাকপাতায় ত্রিনয়ন রেখে
ফুটপাথের অন্নপূর্ণা,
তাকে ঘিরে
.        কয়েকটি হাভাতে-জাতকের ছায়া
পাতালের দরজায় ঘাতক,
হাসপাতালের দরজায় মরণ . . .
ঠিক তখনই
.        আমি তোমাকে এই চিঠি লিখতে বসেছি,
জুলিয়াস সিজার!
তোমাকে তিনবার মুকুট সাধা হয়েছিল।
তিনবার তুমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে।
কাস্ কা, ব্রুটাস, অ্যান্টনিদের ভীড় থেকে
নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধ
.        তোমার পায়ের শব্দ,
আগুনের কপাট-খোলা সব কটি চুল্লি
এখন তোমার হাঁ-মুখ,
আকাশ-প্রেমিক সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট-এর মাথায়
জ্বল জ্বল তোমার লাল চোখ,

চিমনির ধোঁয়ায়
গঙ্গার জলে  
বেবিফুডহীন শিশুদিবসের কালো আকাশে
তোমার নিশ্বাসের বিষ,
কলকাতার প্রতিটি মানুষের
ঘাড়ের ওপর
.        নেকড়ের মত গড়িয়ে ওঠা তোমার উল্লাস
আমার হাতে তুলে নিয়েছি
এই একাঘ্ন
এই ক্ষমাহীন কলম
যা দিয়ে আজ রাতে
আমি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি,
.        জুলিয়াস সিজার!

তোমার শববাহকেরা
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
পরম অধীরতায়
পাথুরে রাস্তায় জুতোর নালের শব্দ তুলছে,
কালো কাপড়
তোমাকে ঢেকে দেবে বলে
অতিকায় ডানা মেলে
.        ছটফট করছে হাওয়ায় হাওয়ায়,
হাজা-মজা মানুষের
হাতে হাতে উঠে আসছে
.        প্রত্নের পাথর,
কুষ্ঠরোগীর শক্ত মুঠি
.        পাল্টে যাচ্ছে গ্রেনেডে,
তোমার মধ্যরাতের সুরায়
মিশে যাচ্ছে
নিহত ভূমিপুত্রের বুক ভেঙে উঠে আসা
.                        আর্সেনিক,
তোমার প্রিয় গোলাপের পাপড়ির আড়ালে
অপেক্ষায় স্থির বজ্রকীট,
ভিখারি ক্রীতদাস ধর্ষিতা কিশোরী
অপমানিত বিদূষকদের
চোখ
আর আমার চিঠির প্রতিটি অক্ষর
নিবু নিবু লণ্ঠনের আলোয়
তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে
কত কল্পান্তের শেষে
টেনে নিয়ে এসেছে আজ এই রাতে
বলির বাজনায় ঝা ঝা মশানভাঙার মাটিতে।

এই স্পার্টাকাস-রাত
আর এই একাঘ্নী চিঠি
তোমার শববাহকদের সঙ্গে
শেষবারের মতো
কিছু জরুরি কথাবার্তা সেরে নিচ্ছে,
.                জুলিয়াস সিজার!

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এসো স্পর্শ করো
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

.        এসো।
.        ছোঁও।
সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গেছি কিনা, দ্যাখো।
পাথরের বুক থেকে মাংস নাও,
পাঁজরের রিডে রিডে চাপ দাও দশটি আঙুলে,
.        আমাকে বাজাও তুমি
.        বিঠোফেন-বালিকার হাত,
.        বলো---
.        আমি প্রত্ন নই,
.        নই অন্ধ, জমাট খনিজ,
.        বলো---সব শেষ নয়,
এখনও আমার কিছু সম্ভাবনা আছে।

টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
.        মেটেনি কুসুম।
ভুল চাওয়া নিয়ে গেছে ভুল সিন্ধু পারে।
সেখানে মুখোশ, পরচুলো
বালির সাদায় ওড়ে দূরতম হাসির মতন,
গাঢ় শোচনার রঙে সন্ধ্যা নামে,
ডেকে ওঠে হাড়গিলে, অসুখী শকুন---
টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
.        মেটেনি কুসুম।

.        দ্যাখো,
কতখানি দীন হয়ে গেছি আশায় আশায়
.        কত বেশি পেতে চেয়ে
নিজেকে ভেঙেছি অন্ধ, ভ্রুক্ষেপবিহীন,
ছেঁড়া শিমুলের আঁশে উড়িয়েছি সর্বস্ব আমার,
.        ‘দাও’ ‘দাও’ হাহাকারে
কখন উঠেছে জেগে বৈজুনাথ---প্রধান চণ্ডাল ;
.        সুনীলে পাতালে
.        এখন যে দিকে চাও
ব্যথিত প্রশ্নের হাড়, করোটি, কংকাল!

.        মকরবাহিনী-জলে
পোশাক ভাসিয়ে আজ এসে দাঁড়িয়েছি---
.        স্পর্শ করো,
অগ্নিতে সঁপেছি স্বাহা, অহংকার,
.        রাখো, ভাঙো মারো,
তুলনামূলক প্রেমে সারারাত জেগে থাক
.        আমাদের কাঠ ও করাত,
.        আমাকে বাজাও তুমি
.        বিঠোফেন-বালিকার হাত।

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ধান ও মাঠের কবিতা
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

ধানের বুকের দুধে হাত দাও।
মনে হবে, নারী।
আমি সেই নারীকে জপাতে
সারারাত উবু হয়ে বসে থাকি হেমন্তের মাঠে---
যার নাম বাসমতী,
যার নাম পদ্মা, কামিনী।

মাঝখানে সরু আল। দু-ধারে লুঠেরা, ঠগি, খুনি।
হেটো-চাষা হয়ে বসি সেইখানে,
এমন আনাড়ি,
ধানের বুকের দুখে হাত দিই।
কেঁপে ওঠে নারী।



মাঠও রমণীর মতো। সহজে সে হয় না তোমার।
সদ্য-পরিণীতা কোনো ভয়ে কাঠ-কিশোরীর প্রায়
তাকেও জাগাতে হয় জলসেকে, মৃদু বলাধানে
পটিয়ে-পাটিয়ে হয় ফলনের যোগ্যা করে নিতে।

তারপর সে-ই হবে রতিপটিয়সী,
নিবিড় বর্ষণ ছাড়া কিছুতে সুপ্রসন্না হবে না,
ধানের বুকের দুধে আলগোছে দাঁত দিলে তুমি
তৃপ্তির শির শির শব্দে মুদে আসবে হেমন্তের মাঠ।

.                *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কাঠের চেয়ার
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত

কাঠের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে
মানুষও একদিন কাঠ হয়ে যায়।
তার পায়ের আঙুলগুলো
শিকড় হয়ে চাড়িয়ে যায় মেঝের ভেতর।
তার কোমর থেকে
সোঁদরি, গরান, গঁদের আঠা ঝরতে ঝরতে
একদিন তাকে পুরোপুরি এঁটে ধরে তক্তার সঙ্গে।
কুরকুর...কুরকুর
ঘুনপোকা ঘুরতে থাকে তার আশির নখর,
কাঠের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে
একদিন পুরোপুরি কাঠ হয়ে যায় সে।

তখন
কেউ তাকে চড় মেরে চলে যায়।
সে রাগে না।
সমর্পণ নিয়ে নারী এসে কাছে দাঁড়ায়।
সে কেঁপে ওঠে না।
টালমাটাল পায়ে শিশু ছুটে আসে।
সে দু হাত বাড়িয়ে দেয় না।
একটার পর একটা কাঠ জুড়তে জুড়তে
সে এমন এক কাঠের চেয়ার এখন,
যার শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে শুধু
জং-ধরা পেরেকের গান
ঘুরঘুর ঘুনপোকার গান
একটানা করাত চেরাইয়ের গান।

যে হাতে একদিন সমুদ্র শাসন করত,
তা এখন চেয়ারের দুই হাতল।
যার দুই উরুতে একদিন
টগবগ করত একজোড়া বাদামী ঘোড়া
আজ আর ডান পা কেটে নিলে
বাঁ পা জানতে পারে না।
কাঠের অশ্রু নেই, স্বপ্ন নেই, নিদ্রা নেই, হাহাকার নেই ;
একটু কষ্ট করলেই
জানালায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেত
ঢ্যাঙা কালো বেঁটে মাঝারি
উটের মত পরিশ্রমী
মানুষ মানুষ আর মানুষ।
কিন্তু কাঠের চেয়ারের এই হল মুশকিল
সে জানালা অবদি হেঁটে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।

শুধু
কাঠের ভেতর লোহার পেরেক আঁটা
তার দুটো চোখ
বাকি জীবনভর
ছোট চেয়ার থেকে মেজ চেয়ার
মেজ চেয়ার থেকে বড় চেয়ার
.        হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে।

.            *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর