কবি অমিতাভ গুপ্তর কবিতা
*
কবি অমিতাভ গুপ্তর পরিচিতির পাতায় . . .
এই কবিতাটির পাঠ শুনুন শিল্পী স্বপ্না দের কণ্ঠে . . .
মনে রেখো
কবি অমিতাভ গুপ্ত

এখানে একদিন ফিরে আসব, ফিরে আসতে হবে আমাকে
একটি নতুন কবিতার খাতা নিয়ে

যদি না--ই ফিরে আসি, মনে রেখো আমাকে।









*
মন্দিরে
কবি অমিতাভ গুপ্ত

সেদিন মন্দিরে চতুরা দেবদাসী কন্ঠে তুলে নিল রত্নহার
নাচের মুদ্রায় আঙুলে বক্রতা দু’পায়ে বেজে ওঠে গভীর ছন্দ।

ঋতুর উত্সবে, দেশান্তর হতে এসেছে বহুজনে, এখনো দ্বার
রুদ্ধ দেখে তারা চকিত হয়ে ওঠে, নয়ন মনে হয় আঁধারে অন্ধ।

পর্যটক আর তরুন ব্রহ্মবিদ্, কবি ও সম্রাট অধীর করাঘাতে
কাঁপায় মন্দির, ক্রমশ রাত বাড়ে, ফুরিয়ে আসে যেন পুজোর লগ্ন।

এদিকে দেবদাসী পাঁচটি মল্লিকা নিয়েছে তুলে ক্ষিপ্র দু’হাতে
এবং পুরোহিত শান্ত উদাসীন নিজের সনাতন ধ্যানে মগ্ন।

ক্রমশ জ্যোত্স্নায় রাত্রি ঝরে যায়, চূর্ণ উপবন ক্রমশ স্তব্ধ
কেবল তরুণীর নাচের মৃদু ধ্বনি অর্থ যার শুধু স্বপ্নলব্ধ।









*
মহাকালীর নুপূর
কবি অমিতাভ গুপ্ত

অযথা সময়গুলি কেঁপে ওঠে। অযথা সময় ?
কোন্ ক্ষেত্রকাল যথাযথ ?
     আমাদের ভ্রতৃবোধ থেকে
ছিঁড়ে যায় জননীর আয়তন, নিরর্থক লগ্নের এপারে
যে দাঁড়িয়ে----তারই তমসায় ত্রাণ পাবে এই
অযথা সময়গুলি ?
    ক্রমশ কঠিন জবা হয়ে ওরা
ফুটে ওঠে। তারপর, ফুলের অকূলে ভেসে যায়









*
যমুনা
কবি অমিতাভ গুপ্ত

কোন্ দেবতার হাত ধ’রে
মানুষের ছোটো নীচু ঘরে
এসেই দেখেছি চারিদিকে
যমুনার নীল ভাঙে গড়ে

ঝরা যমুনায় দেবতার
ঈষৎ নীলাভ অভিসার
লেগে আছে, বিষ হয়ে আছে
আমি তাই হাত ধরি তার

আহার করুক এই জল
আমাদের ভাষাগভীরতা
এই জল পিপাসাবশত
পান ক’রে নিক সব কথা

চারিদিকে মানুষের ঘরে
তবু মৃত্তিকার রাধিকার
শরীরের শান্তি ঝরে পড়ে








*
লক্ষ্মণটিলা
কবি অমিতাভ গুপ্ত

ইতিহাসকে মুচড়ে দিয়ে
    প্রাচীর তোলেন তিনি
        আমার যাওয়া হয় নি, আমি তাঁর কাছে যাইনি

ধর্ম নামক অহংকারের
    ভল্ল বুক বিঁধে
        এমনি হাজার প্রাচীর ওঠে মন্দিরে মসজিদে

কিন্তু একটি বিশেষ থাকে
    নির্বিশেষের ঘরে
        যেখানে ভাই, সোদরপ্রতিম, পাথর চেপে মরে

তবু যখন ভাঙবে প্রাচীর
    টলবে যখন টিলা
        জেগে উঠবে লক্ষ্মণভাই, উদ্যত ঊর্মিলা








*
শার্দুল
কবি অমিতাভ গুপ্ত

বাঘের গুহার কাছে আমি তবে, এতক্ষণে, দীর্ঘ পথ হেঁটে
সব পথ পথ নয়, পথের ছলনা শুধু--- দৃষ্টি নেই সকল নয়নে
প্রলয়কাজলে মায়া আঁকা দুটি বাঘনখ তবুও রয়েছে পড়ে
পাথরে পাথরে।

সন্ধ্যার এখনো দেরি, সূর্য মাত্র মধ্যযৌবনে হানা দিল,
এখনো অযথা ছায়া, ছায়া--ছায়া ভেজামাটি, সারি সারি
হিংস্র বটের থাবা, অশ্বথ্বের দাঁত,
দীর্ঘ দীর্ঘ দেবদারু, অঙ্গুলিপ্রমাণ মৃত্যু পা মুড়ে বসেছে ঊঁচু ডালে
পাথর বলে না কথা, পাথর কেবল করে কটাক্ষে ইশারা----

গুহার হাঁ--করা শূন্য বিস্ফারিত হয়ে ওঠে,
বিস্ফারিত হতে হতে ফেটে যায় দিগন্তে, প্রান্তরে।








*
সীমন্তিনী
কবি অমিতাভ গুপ্ত

আফ্রিকাগোঠের দিকে এসেছিল প্রথম মানবযূথ। জননীর কপালে জড়ালো
তারপর তিলেকমাত্রিক চূল। যেহেতু আমাকে
জননীর আগে জাত হ’তে হয়, যেহেতু সন্তান আমি, প্রতীক্ষাই
যেহেতু স্বভাবধর্ম তাই
বন্য নদীর বিম্বে ডানা মেলে বাওবাব পুনরায় ভূমিতে উথ্বিত
আলো দিয়ে গড়া যেন মৃদু আলো দিয়ে গড়া অতিপ্রতিভাত কোনো
আলোর মতন আলো দিয়ে
আকাশ আকীর্ণ তাই জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি








*
সুন্দর
কবি অমিতাভ গুপ্ত

সহজ সমুদ্র আমি দেখেছি কি কোনোদিন ? সবুজাভ জল
ফাটা হাতে, এড়িয়ে ঝিনুক--কাঁটা, কোনোদিন বেঁধেছি অঞ্জলি
যেখানে আচ্ছন্নঘুমে টেরপাই মেয়েদের চোখের কাজল
অন্ধকারে ঝ’রে গেছে, টিলার নির্জন ছুঁয়ে ব্যক্তিগত বিপন্ন দেহলি

নেমে আসে। সেই অনুরমণীরা কোনোদিন সাগরের আগুনচাঁপায়
আমাকে বাসে নি ভালো, সাজায় নি স্তবকে বিন্যাসে
তবুও পেয়েছি ঘ্রাণ---- নৈশগন্ধক, নুন ----রাতের নিশ্বাসে
নারী ও সমুদ্র মিলে আমাকে এখনো তবু তরঙ্গে কাঁপায়

জেগে ওঠে এই জল মেঘমর্ম, ছায়া, মহাকাল
আর্ত রূপবোধ নিয়ে। যেকানে আশ্লিষ্ট ওই ঝাউবন, শিকড়ের দ্রুত অভিজ্ঞানে
সৌন্দর্যপ্রয়াসী চেনে বিপুল অক্ষম ভুল। সমুদ্রবাঁধাল
ছেড়ে তবু দমযন্তী ভেসে যায় বাহুকের টানে








*
স্পর্ধা : উপসংহার
কবি অমিতাভ গুপ্ত

এইমাত্র দেখলাম সমুদ্র ঝল্ সে উঠল। এ’সব আকাশ
তোমার উদ্দেশে তবে থুয়ে রাখি ? তবু
প্রশ্ন উঠতে পারে কোথায় আমার তবে কার কাছে তুচ্ছতার সীমা
আকস্মিকভাবে পূর্ণ মহাপৃথিবীকে যদি পুনরায় প্রণাম করেছি
কোন্ নির্ণিমেষে
মেরুবরফের দিকে প্রায়--লুপ্ত সভ্যতার মতো কোনো সূর্যের প্রতিভা
এইসব বাক্ সংযমের দিনে এইসব আলাপরেখায়
অকথিত শ্রাবণেরই মতো যেন ঝরে পড়ে। অথচ যে অন্তহীন একদিকে, তার
অন্যদিকে সে--ই অন্তহীন
তাহলে রহস্য ব’লে কিছু নেই ? উদ্ভাসিত শাদা
জীবনের হিমযুগলেরা শুধু উভয়মেরুর মতো দিনেরাতে আঁধারে ফাল্গুনে
অথবা গভীরতর গুল্মমূলে চৈত্রের আরতি
হয়ে ঝরে। বিদ্ধ করে। অথবা চোখের জলে যাকে চেনা যায়
আমারও অপাপরূপ আবার ঘুমোতে চায় অর্বুদের বিভঙ্গ কোলে


যাদের উদ্দেশে আজ স্মৃতি নেই, ধ্বনিযাপনের
মতন আমার সব ক্ষণমুহূর্তকে আমি তাদেরই করুণাঘন পায়ে
রেখে যাব ব’লে
নতুন আঁধারপট বড়ো বেশি চেনা লাগে, যেন তার পরে ওই
দূরাহত নক্ষত্রের শাদাটির মতো কিছু লেখা
আমিও লিখেছি
এখনো জানিনা শুধু রচিত বা বিবর্জিত সেইসব চিহ্নের মতন
অন্য কেউ কোথায় রয়েছে, যারা নম্রভাবে মরে গেছে তাদের উদ্দেশে

‘স্পর্ধা’ পুঁথিটির শিরোণাম প্রসঙ্গে

সোনার জঠরে জাত মৃত্তিকাকে মনে পড়ে। মরিচাকোষের
আঘাতে লৌহের ভ্রূণ বড়ো হয় অসুন্দর হয় যেন খনিগর্ভ লুটিয়ে পড়েছে
যাকে অপাবক বলে সেইসব যজ্ঞাগ্নির মতো
সেইসব আশ্রমিক ভেসে যায়। মহান ও মতিভ্রান্ত
আঁচের তাপের
গ্রন্থনাকে ধীরে ধীরে মূঢ় ম্লান স্বপ্নাতুর কবিতাভঙ্গির কাছে রেখে
অকস্মাৎ সমস্ত শিশির জুড়ে তৃণঋতু নামে

‘স্পর্ধা’ : পুঁথিভূমিকা
একমুঠো জ্যোত্স্না যেন সরস্বতী, তার
বীণা থেকে একটি আলাপ রাখে। অর্থাৎ, বিস্তার
আমার তরঙ্গে তাই নদীটিকে বুকে নিয়ে সাগরে ভেসেছি


এ’ কবিতাপুঁথিটির ইচ্ছামৃত্যু সম্ভব হবে না
যেহেতু যা রণসজ্জা তার পিছে পিছে চলে অনন্ত ভীষ্মেরা
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোনো অতিমাত্রিকতাময় খড়ের মতন
কিষাণের অভিশ্রুতির মতো প্রাবল্যের মতো কিংবা বাঁশরিপ্রতিমের মতো প্রায় অনুরূপ
যখন নির্জন ঝরে তখনই কী লক্ষ কর আমার এ আবিল আখরে
রৌদ্রদাগ ভেসে যায়। যদি চায় যাক্ ভেসে যাক্
অথচ অস্পষ্ট হয় চারিদিকে বাক্ শৈলী কবির নাব্যতা কিংবা প্রতিভানির্ণয়








*
আমার কয়েকটি প্রতিবাদ
কবি অমিতাভ গুপ্ত

শাদা অতীতের মতো----পাথরখন্ডের মতো কয়েকটি অতীত ওই
ঋঁকে পড়ে আসন্নের অনাস্বাদিত কোনো ঘ্রাণের উদ্দেশে
যেখানে----সেসব দেখে প্রতিটি জলই যেন স্থির
যেন সমুদ্রের বুকে এক-একটি অন্তহীন শ্মশান ফুটেছে
আরো বেশি শাদা শাদা অতীতের মতো যেন একটি বিশাল
জ্যোত্স্নার বিভঙ্গ। শুধু পাথরের স্মৃতি ? একী শুধু পাথরেরই স্মৃতি

সুদীর্ঘ ছায়ার মতো কালোমানুযের ঢল, সুদীর্ঘ রাত্রির মতো ক্ষুধা
দুঃখের আনন্দ যারা ভাগ করে নিতে পারে ---সেইসব আসন্নের দানে
যা কিছু ঘটেছে তারও শান্তিলাভ হয়। আধফোটা
ঢেউয়ের কল্যাণবোধে কী দীপ্ত কী অচঞ্চল কী যেন সে মর্মস্পর্শী বোধের সাগর

ধ্বনিরা মানে না তবু এভাবেও কালের নীরব
ঘন শ্মশানের মতো জড়ো হয়। কী যে বাঙময় জ্বলে ওঠে
জীবনের মধুক্ষেত্র একটি ভ্রমর আজও একটি পরাগরেণু বুকে তুলে নিয়ে
বহুদূর দেশ থেকে যেভাবে সে উড়ে আসে নিকটের দেশে
যেভাবে, জানে না কেউ, আজও তুমি আর এই স্পন্দমান মুহূর্তটি যার কোনো
বিগত বা অনাগত নেই
উভয়ে মিলিতভাবে বিপরীতধর্মিতার লক্ষ করে চারিদিকে ঝ্ব্ব্ব্বস্ত সৃষ্টি শুষে নিতে নিতে
পাথরে শ্যাওলার দাগ দ্রুত রাঙা হয়








*
জন্মদিনে
(নন্দিতা ভট্টাচার্য, কল্যাণীয়াসু)
কবি অমিতাভ গুপ্ত

নিবেদিত এই নির্বাসনের
আড়ালে লুকানো প্রশ্নের মতো
কত প্রার্থনা কত--যে না--পাওয়া
অমীমাংসিত কত অপমান

রাতে, ছায়াপথে, উত্সবে আজও
নিরুত্তরের আলপনা আঁকা

শুধু দু’একটি মুমুক্ষাহীন
প্রতিনির্জনে আমার অপার
নির্বাসনের প্রহরে প্রহরে
আঁধারে বৃন্তে রৌদ্র স্তবকে

নির্ভারভাবে অযাচিতভাবে
কখনো দ্বিধায় কখনো ক্ষমায়
ফুটে উঠেছিল আধেকমুক্ত
রজনীগন্ধা রজনীগন্ধা



স্বর্গ বাঙ্ময়। আমিই মৌন
আমিই একাধিক, স্বর্গ বহু নয়

তবুও মূর্খের ভিক্ষাপাত্রে
   ঝলসে ওঠে সোনা। হারাতে হারাতে

 আমিও জয়ী। স্বর্গাদপি আমার
   স্বদেশে রেখে যাই সোনার সংসার