কবি অমিতাভ গুপ্তর কবিতা
*
কবি অমিতাভ গুপ্তর পরিচিতির পাতায় . . .
গ্রাম্য
কবি অমিতাভ গুপ্ত
এই কবিতাটি 'লুব্ধক' পত্রিকার পঁচিশে বৈশাখ ২০০৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

এই সেই মৃত্যু যার অন্রালে ধানের শোণিত
প্রবাহিত হয়েছিল। এই মৃত্যু যার পূর্বাপরে কোনো
    রাজনীতি সমৃদ্ধি হয়েছে
এ'যেন গ্রামীণ, কোনো নিরক্ষর ব্যক্তির উদ্দেশে
নিবেদিত অন্তিম গোধূলি

আবার মাঠের দিকে রাতের অপার শুভ্রটিকে
তরুণ নক্ষত্র, যদি মনে পড়ে, ফিরে আসবে।
    কালপুরুষের
তিরের আঘাত থেকে বিস্ফারিত প্রশ্ন
    আর প্রশ্নের সম্মান
কেন, মৃত্যু কেন









*
ধ্বংসগোধুলি : ১৪ মার্চ ২০০৭
কবি অমিতাভ গুপ্ত
কয়েকজন নিহত এবং কয়েকজন হন্তারকের মাঝখানে থমকে
দাঁড়িয়ে রইল আজ এই সূর্যাস্তের অভিশাপ

যেসব শিশুদের ঠোঁটে আর কোনো দিন জ্বলে উঠবে না ঊষার আভা
যেসব মেয়েরা আর কোনোদিন হেসে উঠবে না রৌদ্রের মতন

তাদের আর্ত ও আতঙ্কপাণ্ডুর একটি দিন থেকে স্খলিত
অন্ধকারের চরম নেমে আসছে মানুষের দিগন্তে

মাটির উদ্বেগ ছুঁয়ে আকাশের জন্মদাগ যেভাবে নির্বাক স্তম্ভিত
হয়ে ওঠে সেভাবেই সূর্যাস্ত থমকে দাঁড়িয়ে

রয়েছে। রাত্রির পরে হয়তো কখনো আর সকাল হবে না
এবার মৃত্যুর পরে আর কোনো বেঁচে-ওঠা নেই









*
হঠাৎ কিছুক্ষণ কেষ্টবিষ্টুপুরে
কবি অমিতাভ গুপ্ত
এই কবিতাটি 'একদিন' পত্রিকার রবিবার, ৫-ই সেপ্টেম্বর ২০১০, এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বীণা কি ফুরোল ? স্রোতে ছন্দ তবু ?

দেবদারুস্নাত রোদে নৈঃশব্দ্য
শুধোয়নি কিছু তবু জানিয়ে দেব
কত-যে আকস্মিক দেখা হয়েছিল

তখন পলাশফুল ঝাঁক বেঁধে উড়ে
গিয়েছে হয়তো অধরোষ্ঠে আঁকা
দিগন্তে ওরা ঝাঁপ দিতে চেয়েছে

দুপুর ফুরোয়। পথে , অবন্ধনে
হারিয়ে যাব। সাঁঝবিহানমেঘে
ইন্দ্রধনুর তরঙ্গ দোলে


এই দৃষ্টিই আবির্ভাব
এই স্পর্শই আমন্ত্রণ

কতদিন পরে অন্তহীন
অঙ্গে সেজেছে অঙ্গীকার

এই সুঘ্রাণই আলিঙ্গন
এই চুম্বনই মার্জনা

কেষ্টবিষ্টুপুরের পাড়ায়
ছিটকে উঠল বোবা বারান্দা

প্রায়--- ঘুমন্ত জানলাটির
বাসনার মতো কাঁপছে পর্দা

অথচ তেমন হাওয়াও নেই
এই মুমুক্ষা কী মোহময়
কেষ্টবিষ্টুপুরের পাড়ায়
লুকিয়ে রইল আধফোটা বাড়ি


তুলে ধরো তোমার পতাকা
যেভাবে ও’ কৃষ্ণচূড়া গ্রীবা
তুলে ধরে। কেষ্টবিষ্টুপুরে
তোমার রক্তিম অভ্যুদয়

পূর্ণ হোক। বন্যহংসীর
মতন আকাশভরা ডানা
ছুঁয়ে যাক যাকিছু তোমার
কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফুটে ওঠে

অফুরান বালকের মতো
ছুটে--যাওয়া ক্ষেত্রকাল। বুকে
বাঁধা তার তোমার পতাকা
বালকের খেলা শুরু হয়


অধোনত পল্লবের কাছেই ছড়িয়ে
পড়েছিল মৌমাছির ছেঁড়া পাখা। তার
মরণে আচ্ছন্ন ছিল কিছুটা অপাপ
কিছুটা --বা অপূণ্যের উচ্ছসিত ছায়া

স্বভাবত যা ভাসে না স্রোতে বীজাঙ্কুরে
স্বভাবত যে-কুসুম এখনও কোরক
তার চারপাশে সেই শূন্যের অসীম
কোথায় লুকিয়ে আছে। থাক। ডাকব না


চিনেছি কি ? মানবিনী নয় ?
চিরকিশোরীর বিনিময়

যারা জেনেছিল, ফিরে এলে
দেখবে ঈগল নখ জ্বেলে
পাহাড়শৃঙ্গের দীপাধার
চকিত সাজালো এ’সন্ধ্যার

কম্পিত বিস্ময় দিয়ে আর
একটি কম্পিত প্রশ্ন দিয়ে

কোনো এক অতীতের আগে
কোন সূচনার আভা জাগে

আরব্ধের রেণুর নিভৃতে
দয়ার পরাগ এনে দিতে

যাব ? পথে যাব তাকে নিয়ে
পার্বত্যবোধের বাঁকে বাঁকে

অন্ধকার। বুকে, দ্যুতিময়
সাঁঝের ঈগল নখ রাখে


এই-তো হ্রদের শিল্প। জল
আঁকল একটি নীলোত্পল

আমার পটের প্রান্তে তারই
বর্ণ লেগেছে। মানতে পারি

হয়েছে সময়। হ্রদের তীব্র
ডেকে নেবে সেই নিভৃত নিবিড়

যাকিছু আমার অস্তাচলে
যাকিছু আবৃত তোমার আঁচলে


ও কার আঙিনা দিয়ে ভেসে যায়
নয়নতারার
মতন নীলাভ কয়েকবিন্দু
জ্যোত্স্না। সরসী
কিছুই জানে না। শুধু কাঁচুলিতে
ঝরে পূর্ণিমা
শুধু সুন্দর চলে যায় তার
রূপ ফেলে রেখে
যাকিছু অর্ধউচ্চারিত যা
মহাদেবতার
শঙ্খে লুকোনো, সে’দুটি ভ্রমর
নয়নতারায়
ছড়িয়ে পড়েছে, সরসী জানে না
আঙিনাটি জানে


প্রতিটি প্রণামই অপূর্ণ। আজও প্রাণে
অপ্রাণ তার রাখেনি অভিজ্ঞান
পাথরে পাথরে প্রগল্ ভ হয়ে-ওঠা
সেতুর মতন বলা না বলার বাঁকে
অপার উপত্যকার মতন আঁকা
অপেক্ষা আর আঁধারের আলপনা
রেখে আশ্রমকুটিরগুচ্ছ ডানা
মেলে দিয়েছিল যুগান্তরের দিকে
সেখানেও বুঝি আমার প্রণাম রেখে
আসিনি। হয়তো প্রথম শিলার পটে
যা লিখেছি সেই ধ্রুবপদটির মতো
না--দেওয়া মিনতি স্পন্দিত হয়েছিল


তোমাকে তোমার সারাত্সার
জানাতে চেষ্টা করিনি। তাই
এই-যে মন্ত্র, নির্বিকার
বিকল্পহীন, সেও কাঙাল
বিদেহী হাত বাড়িয়ে দেয়

শ্বাশত আর ভঙ্গুরে
মন্দ্রিত, হে মন্দ্রিত
দিনান্তের কোন সলাজ
ইমন দিয়ে স্রোতকে আর
আমাকে বীণায় সাজিয়েছে
দীর্ণ মহাবিশ্বকাল
রাঙিয়ে, যেন বিদীর্ণ
প্রবাল। আর্ত আরক্ত

১০
কবে-যে নিভৃতের সাজাব দীপাবলি।
      হয়তো অরচিত প্রতিমা
ফেলেই চলে যাব। স্বর্গদ্যুলোকের
      দ্যুতির মতো তুমি, তোমারই
দুপাড়ে প্রার্থনা ছড়িয়ে রাখি। তবু
      সেদিন স্বর্গের বেদনায়
তোমার দেওয়া যেন আমার না-দেওয়ার
      মন্ত্রে মিশে ছিল, সরসী










*
তরমুজ
কবি অমিতাভ গুপ্ত

রোদে পোড়া মাঠ পেরিয়ে চলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র
আরো এগারো বছর পরে জুটবে
তাঁর বিদ্যাসগর উপাধিটি
কিন্তু তার আগে এই দীর্ঘ পথ, এই মাঠ

সঙ্গে ছিলেন ঠাকুরদাস কিংবা আরো কেউ কেউ
মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজি সংখ্যাগুলি শিখে নেওয়ার
অপরূপ কাহিনীটিও রচিত হতে শুরু করল
কিন্তু সেই পথটিও ছিল দীর্ঘ তৃষ্ণায় অস্থির
আটবছর বয়সের একটি বালক

হটাৎ কোন্ এক আশ্চর্য উদ্ভাস নিয়ে
এল এক তরমুজঅলা
কী শান্তি সেই তৃষ্ণাজুড়ানো সুঠাম ফলের গভীরে
যার কথা
ঈশ্বরচন্দ্র ভুলতে পারেননি, হয়তো কার্মাটারে তাঁর
সেই পিপাসাময় শেষ জীবনেও








*
মোহকুমার
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

দিন শেষ হলে ওরা ফুল ছুঁড়ে দেয়
আমি তো যোদ্ধার ছেলে, যেহেতু আামার
ফুল নেওয়া অসম্ভব, দুহাতে ধনুক
      বিশাল দিগন্ত সে কী ধনুকের মতো
অর্ধবৃত্তকোরকের, ফুটে ওঠে ওদের বাগানে
থাক্ তবে, দিন শেষ হয়ে এল, বাগানের তর্ক পড়ে থাক্
আমি শুধু ধাবমান ফুলগুলি দেখি








*
কথাজাতক
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

সব কথা খুলে রেখে আজো
তরঙ্গের দিকে চলে যাই
আবার নদীর মতো ডাকে
ভরারাত, উজল কিশোরী

তারপর স্রোতব্যূহ ভেঙে
পূর্ণিমার রাতের মতন
উজলের স্পর্শের মতন
স্তব্ধতার স্পন্দনের মতো
ছড়িয়ে পড়েছি স্তরে স্তরে
অক্ষরে ও নদীর মর্মরে


বলো, অক্ষরমালা
কার কাছে রেখে যাব
উজল কিশোরী,বলে

তোমারই গর্ভে, স্বপ্নে
ব্যূহভেদ আমি জেনেছি
অকূল ভাসিয়ে এসেছি
অকূল ভাসিয়ে ফিরব
তার আগে যদি দাও
অভিমন্যুকে কান্তি
তবে ব্যূহভেদ হবেনা
কথা খুলে বাঙ্ময়
গাহন এবারও পাবেনা

শোনো পূর্ণিমারাত্রি
শোনো স্পন্দিত জ্যোত্স্না
স্রোতব্যূহে আমি ফিরব








*
বেলি অসকালে
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

যদি আজ এঁকে রেখে যাই শুধু আত্মসর্বস্বতার আলপনা
তাহলেও পূজারিণী, সমস্ত ব্রতের দিনে আমাকে ডেকোনা

শুধু স্থির দীঘির যে-উপকথা, যাকে পেলে শঙ্খ বড়ো হয়
তারপর শঙ্খ এসে পূজারিণীদের বুকে রেখে যায় রব

ক্ষণগণনার মতো কিছুকিছু ছন্দ-পর্ব-মাত্রাবিভাজন-অন্ত্যমিল
ললিত আক্ষেপে টানে আলপনা, যেভাবে শ্রীমন্ত সদাগর

দেখেছিল সনাল পদ্মকে নিয়ে ঈষৎ কৌতুকরত গজলক্ষ্মী, তার
স্থির সরোবরে তবু ছোট ছোট ঢেউ রাখি শঙ্খ রাখি তোমার আমার








*
ফুলগাছ
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

বাগানের একদিকে কানাখোঁড়া কাঁটাতার, অন্যদিকে
ঋজু স্পষ্ট জবাফুল ফোটে

মন্ত্রের মতন গূঢ় সবুজপাতার কাছে। ওকে বুকে নিয়ে
পৃথিবীর সূর্যপ্রদিক্ষণ

আরো একবার পূর্ণ হল








*
বিন্যাস
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

একটি নীরব দিয়ে শুরু হোক আমাদের প্রথম সংকেত
রাত্রির বিন্যাস দিয়ে আমাদের আলোপথ উন্মোচিত হোক

একটি বিন্যাস পেলে কোরকের মনে পড়ে সুগন্ধের কথা
সুগন্ধকে দেখা যায়, স্পর্শাতুর, বেজে ওঠে সমস্ত সৌরভ

প্রথম গোলাপ যেন মহাজগতের স্থির সাংকেতিক দীপ্ত হ্রদে জাগে








*
ঝাঁপি
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

ভয় বেসেছি। লাজ বেসেছি। ভালবাসার আগে

ভিক্ষে-ধোওয়া আকাঁড়া অন্নের
আভায় লাগে বিষ
দুলে উঠছি অন্নঝাঁপির কাছে, চিকন কালো ঢেউ

সেই-যে ভালবাসার শুরু। মুগ্ধ, ফণা তোলো








*
ফাঁস
কবি অমিতাভ গুপ্ত যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

জল-স্থল-মহাশূন্য ধীরেধীরে সরীসৃপতার
আদলে পেয়েছে অবয়ব

মাটির উপরে বুকে হেঁটে
স্থল এল জলের সংসারে

মহাশূন্য একবার দেখে নিল, নীচে জলেস্থলে
ঝাঁপি খুলে সাপ দুলে ওঠে


মেধায় বিষদাগ, উনিশ শতকের
আকৃতি মুছে যায় কিন্তু রেখা থাকে

স্থলিত জীবনের আগেই দেখলাম
শিউরে উঠবার আগেই শুলাম

এ কোন্ ভালবাসা বধ্যভূমিদের
যত্নে গড়ে তোলা শূন্য-স্থল-ছুঁয়ে
পদ্মপুরাণের কুহরে ভেসে যায়









*
জীবন
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কার জীবনের করো চুরি
চিরজীবন আমার

সূর্যে ধ্রুবতারার কাছে
সমুদ্রে পর্বতে

আমার প্রাণের অসীমতা
অসীম হয়ে জাগে

সূর্যে ধ্রুবতারার কাছে
সমুদ্রে পর্বতে

আমায় ঘিরে প্রাচীর গড়ো
প্রাচীর ঝরে যায়

সূর্যে ধ্রুবতারার কাছে
সমুদ্রে পর্বতে

লক্ষ প্রাণের অসীমতায়
লক্ষ প্রাচীর ভাঙে

সূর্যে ধ্রুবতারার কাছে
সমুদ্রে পর্বতে









*
লেমিং
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

লেমিং যেভাবে যায়, নর্থ সী পেরিয়ে
লেমিং-এর মনে আছে
সবকটি মহাদেশ সমস্ত ভূখন্ড ছিল ছিল পৃথিবীর
সংযুক্ত, অপৃথক, এক


ভাঙাচোরা গলি দিয়ে বাড়ি ফিরছে মা
অবসন্ন শিশুটি তার হাত ধরে
টলোমলো হাঁটার চেষ্টা করছে

এই দৃশ্যটির কথাও যেন চিরদিন মনে থাকে










*
ভয়
কবি অমিতাভ গুপ্ত
যুক্তিশৃঙ্খল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

রাত্রিজয় করে
তাকে চাই রুদ্র অন্ধকারে
তাকে চাই গানে গানে গানের ভাষায়
তারপর ভোর হল, স্তব্ধতায়, সমস্ত প্রাণের অনুমানে